সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১২

মধুছন্দা পাল


মেজজ্যাঠাইমা

মেজজ্যাঠাইমা ছিল খুব ছোটোখাটো , রোগা, বড়ো বড়ো চোখ । একদম নির্বিরোধী মানুষ । আমার মায়ের সঙ্গে খুব ভাব ছিল । অনেক সময় মা আর মেজজ্যাঠাইমাকে দেখতাম বহুক্ষন ধরে কথা বলে যেতে । কখনো আমদের বাড়িতে কখনো অন্য কোথাও দেখা হলে । দুর্গা নবমীর দিন মায়েরা গঙ্গা স্নান করতে যেত , মা আর মেজজ্যাঠাইমা দুজনে দুজনের হাত ধরে এক এক করে ডুব দিত । অন্যদিকে জ্যাঠাইমা আর ছোটোকাকীমা আর এক দিকে সেজজ্যাঠাইমা আর ন’কাকীমা । আমরা পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম এই মজার দৃশ্য ।

মেজজ্যাঠাইমারা পরে এজমালি বাড়ি ,( যেটাকে বড়ো বাড়ি বলা হত শুধু,আয়তনের জন্যে নয় ওটাই আমাদের ঠাকুরদার করা বাড়ি এবং ওটাতেই একসময় সকলে একসঙ্গে থাকত , আমরা , ছোটোকাকারা জ্যাঠাইমারা ,লালুদারা পিসিমা সকলে শেষ পর্যন্ত ঐ বাড়িতেই থেকে এসেছি ),ছেড়ে এক সাহেবের থেকে খুব সুন্দর একটা বাড়ি কিনে চলে গিয়েছিল । কাছেই ছিল বাড়িটা । সামনে লন। পোর্টীকো , হলো । অনেকগুলো ঘর । অনেকটা জায়গা বাগান করার । বিরাট বড়ো স্নানের ঘরে উঁচু পাড়ের বড়ো চৌবাচ্চা সিঁড়ি দিয়ে উঠে সেই চৌবাচ্চায় নেমে আমরা রীতিমতো দাপাদাপি করেছি ।

বাগান ছিল , লন ছিল কিন্তু যত্ন ছিলনা , যারা আগে আমার মেজজ্যাঠাবাবুর কথা পড়েছেন তাঁদের মনে থাকতে পারে তাঁর সাংসারিক উদাসীনতার কথা । ডাক্তার হয়েও সারাজীবন প্র্যাকটিস না করার কথা সারাদিন বই পত্র আর মাঝে মাঝে মরফিন ইঞ্জেক্সন নেওয়ার কথা । কাজে কাজেই মেজজ্যাঠাইমার জীবনযাত্রা খুব কঠিন ছিল । অথচ শুনেছি মেজজ্যাঠাইমার ডাক্তার বাবা ডাক্তার জামাই পাবার আনন্দে অনেক টাকা বরপণ দিয়েছিলেন । আর আমাদের মেজজ্যাঠাবাবু সেই টাকা দিয়ে এক বিশাল আমবাগান কিনেছিলেন । নাম ভৈরবা । আমরা মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতাম সেখানে । বিরাট বিরাট আমগাছে ছায়া ছায়া হয়ে আছে ভেতরটা । মাঝে মাঝে একটা করে কুয়ো । পরে ঐ বাগান ইউনিভার্সিটি করার জন্যে সরকার থেকে কিনে নিয়েছিল ।

পাঁচজন দিদি ছিল আমাদের । পড়াশোনায় , সেলাই ,বোনায় প্রত্যেকে গুনী নানানভাবে । কিন্তু সমস্ত কিছুর মধ্যেই কেমন যেন অগোছালো ভাব । চারিদিকে বই পত্র ছড়ানো , হয়তো সেলাই করার জন্যে কিছু কাটাকাটি করেছে মাদুরের ওপর সেলাই মেসিন আর কাটা কাপড় পড়ে আছে স্তূপ হয়ে ,আর হাত পড়েনি । আবার কবে পড়বে ঠিক নেই । একটা মজার ঘটনা মনে পড়লো দীপাদি আর গীতাদি পিঠোপিঠি দুই বোন । দীপাদি একদিন গীতাদির হাতে একটা চিরুনি দিয়ে বলেছিল ওর চুলের ডগাটা একচিরুনির মাপে ছেঁটে দিতে । একচিরুনি মানে যে কাত করে এক চিরুনি খাড়া করে নয় সেটা আর বলেনি । গীতাদি কিন্তু সেইটাই করল । মনে হয় ইচ্ছে করেই , চুল কাটার পর ঘাড় পর্যন্ত চুল দেখে দীপাদি তো কেঁদেই সারা । তার পর সেই নিয়ে রাগারাগি , বকাবকি যা যা হবার সবই হোল কিন্তু কাটা চুল আর জোড়া লাগলোনা! বানীদি সবচাইতে বড়ো ।বিয়ে হয়েছিল অনেক পরে । দেখতে তেমন সুশ্রী ছিলনা ।বড়োদের আলোচনায় শুনতাম । অবশ্য আমাদের কাছে সেসব কোন ব্যপারই ছিলনা । খুব সুন্দর করে গল্প বলতো । খুব কাজের ছিল । অনেক গুন ছিল সবাই বানীদির প্রশংসা করতো । কিন্তু পাত্র পক্ষ ফিরে যেত । যতই গুন থাক ফর্সা রঙ ছাড়া চলে নাকি ? সে তারপর যতই সংসারের তাপে ঝলসে পোড়া কাঠ হোক !

মেজজ্যাঠাইমার একটা অদ্ভুত অভ্যেস ছিল বাড়ির যত ছেলেমেয়ে কে কি খেতে ভালোবাসে সব মনে রাখতো আর সুযোগ পেলেই সে গুলো খাওয়াতো ।

একটা কথা খুব মনে পড়ে , উঁচু স্ট্যান্ডে একটা গ্রামাফোন রাখা থাকত । আগেকার দিনের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দম দেওয়া গ্রামাফোন , নীচে পরপর ড্রয়ারে রেকর্ড । আমরা ওখানে গেলেই মধুসূদন দাদার যে রেকর্ড ছিল বাজিয়ে শুনতাম । একটা চেয়ারে দাঁড়িয়ে তারপর হাত পৌঁছত গ্রামাফোন অবধি । পিন বদলানো , রেকর্ড পালটানো , দম দেওয়া সব কিছুই দারুণ আকর্ষণীয় মনে হতো । আমরাই করতাম সবকিছু । কেউ কখনো বাধা দেয়নি ছোটো বলে । নষ্ট হয়ে যেতে পারে ভেবে । একদিন ঠিক তাই হলো ছোড়দি চেয়ারে উঠে এমন দম দিল হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এক বিকট আওয়াজ করে দম কেটে গেল গ্রামাফোনের, আর সেই আওয়াজে ভয় পেয়ে ছোড়দি চেয়ার সুদ্ধু ছিটকে পড়লো । সকলে ছোড়দির পড়ে যাওয়া নিয়েই ব্যস্ত হলো কেউ একটা কথাও বললনা গ্রামাফোনের বিষয়ে । তবে ওটা আর সারানো হয়নি ।

আমদের দুই দিদি মেজজ্যাঠাইমার দুই মেয়ে মায়ের কাছে ছেলেদের রেখে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করতে গেল । ফিরে যার যার সংসারে । মেজজ্যাঠাইমা একলা । সেই সময় দেখেছি প্রচুর হাঁস , মুরগী , রাজহাঁস , টার্কি পুষেছিল । পোলট্রিই বলা যায় । মনে হয় সংসারের জন্যে এই সমস্ত ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল । ভেতরের বাগানের গাছপালা কেটে সেখানে গোটা কয়েক দু’ কামরার বাড়ি বানানো হয়েছিল । ভাড়া দেওয়ার জন্যে । একটা খুব বড়ো নারকোলে কুল গাছ ছিল খুব বড়ো বড়ো মিষ্টি কুল ভেবেছিলাম ওটাও কাটা পড়বে হয়তো ! পড়েনি আমাদের কুল খাওয়া বন্ধ হয়নি ।মেজজ্যাঠাবাবু মাঝে মাঝে বাড়িতে রাগারাগী করে খাওয়া বন্ধ করে দিত । পিসিমাকে খবর পাঠাতো মেজজ্যাঠাইমা এবাড়িতে এলে যেন না খাইয়ে ছাড়া না হয় । মেজজ্যাঠাবাবু তো এখানেই সকাল থেকে । পিসিমা হুকুম দিল “ভাত খেয়ে তবে যাবি ।” কাজেই তাই হলো । মেজজ্যাঠাইমার কথা এতো লিখলাম । এরকম চরিত্র সচরাচর দেখা যায়না । কারো দোষ দেখতে পেতনা , নিন্দে করতনা কখনো । সম্পন্ন ঘরের মেয়ে , বৌ হয়েও শেষ জীবন বেশ কষ্টে কেটেছিল , তবু নালিশ ছিলনা কারো বিরুদ্ধে । ঈশ্বরের কাছে শান্তিতে আছে আশাকরি । 


অলংকরণ – কৌশিক বিশ্বাস