সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১২

নন্দিতা ভট্টাচার্য


অনুবাদ ও দেশ বিদেশের সাহিত্য
 
প্রথমদিন নতুন ভাড়াটে বাড়িতে এসে শোয়ার ঘরের জানালাটা খুলে চমকে উঠেছিলাম । জানালাটা থেকে তিন-চার ফুট দূরে বিশাল মা কালীর মূর্তি , এক মানুষ সমান তার উচ্চতা । তার হাঁ-করা মুখ থেকে জিহ্বা বেরিয়ে আছে , গলায় মুণ্ডমালা , উলঙ্গ দেহ , কুচকুচে কাল একঢাল চুল , হাতে রক্তমাখা অসি , হাতে ঝোলান কাটা মুণ্ডু থেকে রক্ত ঝরছে । চকচকে বেদীতে ধুপ-ধুনো , ফুল নৈবেদ্য পরিবেষ্টিত মূর্তিটা দেখে এক ধরণের অস্বাস্তি হচ্ছিল । দুম করে খিড়কিটা বন্ধ করে দিলাম ।
কিছুদিন থাকার পর গা সওয়া হয়ে গেছিল । আজকাল আর কিছু মনে হয় না । সকাবেলা ঘুম থেকে ওঠা
থেকে রাত পর্যন্ত উঠতে বসতে মূর্তিটি দেখে দেখে মনে কোনো বিকার হয় না ।
সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গে এক বিকট আওয়াজ শুনে । ধল পোহর বা ব্রাহ্ম মুহূর্তে কালি মূর্তির সেবক বিশাল বপুর গৃহস্বামী ভেজা গায়ে কালীর পায়ে মাথা দিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে তিনবার হুঙ্কার দিয়ে – মা , মা , মা ! সেই শব্দে আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠি । চায়ের কাপ হাতে নিয়ে যখন বসি নাকে আসে কড়া ধুপ-ধুনোর গন্ধ আর কর্ণ কুহর পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে কাঁসি আর ঢাকের আওয়াজ ।গৃহস্বামী দেবতার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন –তারপর এলেন তার মা , এরপর বোনের পুজোর সময় । সারা দিনটাই দেবীর ফুল, ফল, ধুপ , চন্দনের সুগন্ধিতে ভরে থাকে । প্রসাদের তামার থালা সন্দেশ , বাতাসা , কলা , ছোলা-মটর , বিভিন্ন ফলমূলের টুকরো-টাকরাতে ভর্তি হয়ে যায় । দুপুরে যখন সমস্ত কোলাহল থেমে নিঝুম হয় বাড়ি , দেবীর চাতাল ; তখন প্রায়ই দেখি একটি জীবন্ত কঙ্কাল , হাতে পায়ে হাজা-ঘা -তে ভর্তি, এসে তামার থালার প্রসাদ টুকু আঁচলে বেঁধে বকুল গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে । মানুষটাকে দেখলেই গা শির শির করে ওঠে ।মানুষ কি এভাবে বাঁচতে পারে ? মানুষটার সমস্ত শরীর শুকনো কাঠের মতো । গায়ে কোনোমতে জড়িয়ে রাখা শাড়িটি ময়লা শতছিন্ন , গর্তে ঢোকা চোখ চাউনি উদভ্রান্ত , চুলগুলো অদ্ভুতভাবে কদম ছাট করে কাটা । প্রসাদটুকু খেয়ে ও পুজোর বেদীতে বসে মা কালীকে ইচ্ছেমতো গালাগাল করতে থাকে । ঘরের ভেতর থেকে কেউ লাঠি নিয়ে তেড়ে না এলে সে দেবীর সামনে অঙ্গভঙ্গি করে ভেঙাতেই থাকে ক্রমাগত । সকলে এসে ওকে সরাতে চাইলে আর মারপিট করলে ওর কুবাক্যের প্রকোপ বাড়তেই থাকে । উরুতে চাপড়ে চাপড়ে সে অনর্গল গালাগালি করতে থাকে ,আহা-হা ...... কত খাবার জিনিস , সোনার গয়না ......আহা-হা ! স্ত্রীলোকটি লাঠির বাড়ি খেয়ে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে ওঠে । ‘ওরে আমার পেট জ্বলে গেল রে ......মোটা চাকরটা যখন রশি বেধে ওকে টানতে থাকে তখন সে শেষবারের মতো প্রসাদের তামার থালাটা চেটে নেয় , কাছে পড়ে থাকা পিঁপড়ের চাটা বাতাসাটুকু ও বাদ যায় না ।
গৃহস্বামীর বাড়িটি যেন একটি নাটকের মঞ্চ । নাটকের প্রধান চরিত্র দুটোকে কেন্দ্র করে পার্শ্ব চরিত্রগুলো যেন পাক খাচ্ছে , নাটকটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে । প্রধান চরিত্র দুটোর একটি নির্জীব , মাটির , কেবল বিশ্বাস ও পরম্পরা দিয়ে তৈরি ---অন্যটি রক্তমাংসের জীবন । কখনো বা রাত্রির জোনাকি, কখনো সকালের রোদ , দুপুরের নির্জনতা , কখনো মাঝরাতের অন্ধকারের সঙ্গে—নাটকের বিভিন্ন দৃশ্য আমার ঘরে জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে যখন তখন ঢুকে পড়ে ।
শীতের বৃষ্টিতে লেপের ভেতর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া আমি শিউরে উঠলাম । না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম আজ বাড়ির ভৃত্যটি ওকে রশি বেঁধে টানছে না , বিশাল বপুর গৃহস্বামী ইচ্ছেসুখে লাঠিপেটা করছে , আর ও চিৎকার করে কাঁদছে । কান্নার মাঝে মাঝে থেকে থেকে একটি কথা কেঁপে কেঁপে উঠছে –বাবারে ! কী শীত ! মাগো ‘রে কী শীত ওর কান্না চড়তে লাগল । মেরে ফেলবে না –কি ?
খিড়কির সামনে আজ আর এক অদ্ভুত দৃশ্য । অর্ধ উলঙ্গ রমণীটি কচি বাচ্চাকে জড়িয়ে রাখার মতো বুকে জড়িয়ে রেখেছে রেশমি ঝলমলে একটি কাপড় । ঝুলে থাকা অংশটুকু দেখেই বুঝেছি , এটা দেবীর নীল রং –এর রেশম ও ভেলভেটে তৈরি ,চুমকি দেয়া মূল্যবান চন্দ্রাতপ । বিশালবপু ওর হাত থেকে চন্দ্রাতপটি নেয়ার জন্যে টানা-হেঁচড়া করছে , স্ত্রীলোকটি ছিটকে ছিটকে সরে যাচ্ছে , তবুও চন্দ্রাতপটি ছাড়ছে না । মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছে --- মাগো’রে । কী শীত । বাবারে কী শীত । বিশালবপু চন্দ্রাতপটি এনে আবার দেবীর মাথার ওপর টাঙ্গিয়ে দিল । কালির পায়ে পড়ে ভক্তি সহযোগে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিল , মা! মা ! মা ! মা মাগো ! স্ত্রীলোকটি কোথায় গেল , আরে ?
বকুল গাছের তলায় কেমন নিথর পড়ে আছে মানুষটি , রমনীরত্ন ! মরে গেল না-কি ! ও মাটিতে পড়ে আছে আর মুখের ওপর টপ টপ করে পরছে বৃষ্টির জল । , গায়ের শতছিন্ন শাড়িটি কোনমতে শরীরকে জড়িয়ে রেখেছে । বীভৎস , শুকনো , উদলা বুকের ওপরে বৃষ্টির টপ টপ জল ! কি হলো ? ও উঠছে । দেবীর বেদীর চারদিকে গ্রিল দেয়া হলো – ঘিরে দেয়া হলো শক্তিকে । তালা মারা থাকে । এ-কি ! স্ত্রীলোকটি গ্রিলের সুক্ষ্ম কারকার্য করা জালির ভেতর হাত গলিয়ে দিয়েছে কোনফাঁকে , আবার খুক খুক করে হাসছে , প্রসাদের থালাটা না পেয়ে কাঁদছে , মাঝে মাঝে কপালও চাপড়াচ্ছে ---চিৎকার করছে ---আহা–হা ! কত খাবার ! বিশালবপু আসছে –ঠাস । মারল নাকি ! ও কি দেখেনি পুরুষমানুষটি ওখানে দাঁড়িয়ে ! এবার বোধহয় দেখেছে । দৌড়ে গিয়ে বকুল গাছের তলায় দাঁড়াল । লোকটি তালা খুলে দেবীকে উৎসর্গ করা প্রসাদের থালাটা বের করে আনছে । খিচুড়ির মতো কিছু একটা মনে হচ্ছে । মানুষটি ওকে দেখে নি । ঠিক বকুল গাছের কাছে গিয়েই থালা থেকে খিচুড়ি ছুড়ে ফেলল , তা দেখে গুঁড়ি মেরে স্ত্রীলোকটি এগোতে থাকে ।পড়ে থাকা খিচুড়ি দুহাতে সাপটে আপ্রাণ খেতে থাকল , তামার থালার প্রসাদও এমনভাবে খেতে লাগল , দেখে আমার ভারি কষ্ট হলো ।
কিন্তু আশ্চর্যভাবে তারপর থেকে ওকে আর গ্রিলের চারপাশে দুপুরে আসতে দেখি না । প্রসাদের থালা ধরে আর টানাটানি করে না । সেই সময়টা সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় । আমার বাড়ির চাতালে একটি বড়ো বাতাবি লেবুর গাছ আছে । তবে গাছটি তেমন উৎকৃষ্ট নয় বলে ফলও তেমন ভালো হয় না । স্বাদ তেমন নেই । বাচ্চারা যখন তখন এসে গাছের তলা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বল খেলে । না হলে ফলগুলো কেউ ছুঁয়েও দেখে না । আজকাল ভর দুপুরে চুপিসাড়ে এসে ও প্রায় ই মাটিতে পড়ে থাকা বাতাবি লেবু কুড়িয়ে নেয় । এই আধপচা লেবুগুলো নিয়ে সে কি করে ?
বন্ধের দিন দুপুরে ভাত একমুঠো বেশি বসিয়েছিলাম ।
সকালে মাছওয়ালা একটি বেশ বড়ো ওজনের মাছ দিয়ে গিয়েছিল । দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একটি বই নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ছিলাম । ওদিক থেকে আসা চিৎকার চেঁচামেচি । কুকুরের একনাগাড়ে চিৎকারে আমি বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলাম । ও শরীরের এক কোণে আঁচলের তলায় বাতাবি লেবু লুকোবার চেষ্টা করছে – সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । ভীষণ ভয় পেয়েছে ও । রাস্তার নেড়ি কুকুরটি ওর দিকে তেড়ে আসছে । ঘেয়ো কুকুরটাও বুঝেছে এই মানুষটি আর মানুষের পর্যায়ে নেই – সে একটি ইতরবিশেষ প্রাণী । ঢিল মেরে কুকুরটাকে তাড়াতে দেখে ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল । হাসিতে ওর ফ্যাকাসে মুখেও এক ধরণের উজ্জ্বলতা এনে দিয়েছিল । ও ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ।
--এই বাতাবি লেবুগুলো নিয়ে কী করবে ?
ও বুকের মধ্যে ফলগুলো চেপে ধরে রইল । ওর চোখে হাসির উজ্জ্বলতা আর নেই । আবার সেই শূন্যতা ওর চোখে । ভয়ে শিটকে আছে ।
--ভাত খাবে?
মাথা নাড়ল । বারান্দায় বসে চেছে পুঁছে ভাত কটা খেল । এক গরাস ভাত খায় আর মাছের টুকরোটা বাচ্চাদের মতো একবার চেটে নেয় । , আবার এক গরাস ভাত মুখে দেয় –আবার মাছের টুকরোটা চাটে । চেহারাটা ঠিক পেত্নীর মতো । কঙ্কালের মধ্যে যেন কে একটি চামড়া জড়িয়ে রেখেছে । খাওয়া শেষ করে ও আমার দিকে একবার তাকাল , হাসল ।
তারপর মেঝেতে ধপ করে শুয়ে পড়ল , শুয়ে একনাগাড়ে বিড় বিড় করতে লাগল । ও স্বপ্ন দেখছে না – কি ! কিসের স্বপ্ন দেখতে পারে ? একথালা ভাত ? দেবীর সামনে উৎসর্গ করা থালাটি ? না চন্দ্রাতপ ? সাড়া পেয়ে অবিন্যস্ত আঁচল ঠিক করল । প্রেতনীর মতো মুখটিতে লজ্জার আভা । ওরও লজ্জা করে! দু’জন স্ত্রী মারা যাওয়া এক ধনী ব্যবসায়ী বিশালবপুর বিরাট সংসার একহাতে সামলেছিল ঘাটের মড়া এই গ্রামের মেয়েটি । জনার ঠাকুমা বলছিল , খুব হাসিখুশি বউ ছিল ও , চেহারাটি ছিল দেবীর মতো । কী হলো হঠাৎ ওর ? শাশুড়ি বলছিল দেবী পুজায় আনাচার করার জন্যেই এমন হয়েছে । পাগলামিতে ধরেছে । কী অনিয়ম করেছিল সতেরো বছরের মেয়েটি ? আমাকে সকালে জল এনে দেয়া , এটা সেটা ঘরের কাজে সাহায্য করা কমলার মা বলছিল , একদিন পুজোর ভোগ তৈরি করে দেয়ায় দেরী হওয়াতে স্বামী ওকে ধরে মারধর করে , তাতে ওর পেটের বাচ্চাটি পেটেই মারা যায় । সেই ধাক্কা কাটিয়ে ও আর উঠতে পারেনি ।
চলে গেল বোধহয় !
বিশালবপুর বাড়ির বিস্তর আয়োজন । কালীপুজোর নেমতন্ন আমিও পেয়েছিলাম । ফুলেফেঁপে ওঠা বিশাল বপুর বাড়ির আড়ম্বর দেখবার মতো । দেবীর গায়ের গয়না টুনি বাল্বের আলোয় ঝলমল করছিল । চন্দ্রাতপটিও নতুন । আগেরটা নিশ্চয়ই অশুচি হলো । পুজোর বেদীতে নৈবিদ্যের উপচানো সম্ভার ! ক্ষীর মিষ্টি পায়েস ফলমূল কত কী ! হুলুস্থুলের মধ্যে আমি কান পেতে ছিলাম একটি হাল্কা পায়ের আওয়াজের জন্যে । ওকে নিশ্চয়ই বন্ধ করে রেখেছে ।
হঠাৎ হুলুস্থুল পড়ে গেল । কোথা থেকে ও এসে পুজোর বেদি থেকে দেবীর নৈবিদ্যের থালা নিয়ে খাবলে খাবলে খেতে শুরু করেছে । কালী মূর্তিকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করেছে।
--আহ –হা সোনার গয়না !
বিশাল বপু ও আরও অনেকে মিলে ওকে তাড়াবার জন্যে চারদিক থেকে ছুটে এলো । সব্বাইকে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পাস কাটিয়ে ও খেতে লাগল ।
--কী পিরিত ! আহা ! মাটির মেয়েছেলের সঙ্গে কি পিরিত !—বীভৎসভাবে হাসছে ও । লোকজনের তাড়ায় হাত থেকে ছিটকে পড়া কলাটা কুড়িয়ে নিতে গিয়ে চিৎকার করে উঠল –কি ক্ষিধেরে – ও কাঁদছে । বিশাল বপুর এক লাথিতে ও তিনহাত দূরে গিয়ে পড়ল । বকবক করেই চলেছে , মাটির মেয়ের সাথে কি পীরিত !আহা-হা ! কি দরদ ! ও একফাঁকে তুলে নেয়া ক্ষীরের বাটি চাটছিল তক্ষুনি মোটা চাকরটি এসে ওকে রশি দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে গেল ।
সারা রাত্তির ধরে কালীপুজো চলল , সঙ্গে ঢাকের বাদ্যিও সারারাত । মাঝে মাঝে ঢাকের আওয়াজ থামলে কানে ভেসে আসছিল চাপা কুঁইকুঁই কান্নার আওয়াজ । ও কি খুব ব্যথা পেয়েছে ? ছিটকে বেদীর কোণায় পড়েছিল ।
সারারাত ঢাক কাশি বাজতে থাকল আর থামলেই শোনা যাচ্ছিল একটি বন্ধ ঘর থেকে ভেসে আসা চাপা গোঙ্গানি । সারারতের জাগরণে উত্তেজিত স্নায়ুতে অহরহ ঘুরতে থাকল ঢাকের শব্দ ও একটা চাপা কান্না ! কতকাল জুড়ে যেন সমান্তরালভাবে উতসভ উচ্ছল ঢাক ও কান্না ...... কান্না ও ঢাক ......ঢাক আর কান্না ...... কান্না ......


অলংকরণ - মেঘ অদিতি

4 comments:

ঘনাদা বলেছেন...

মনে হল, নন্দিতার লেখাই পড়ছি । মূলটা পড়ি নি, তবে, বোঝাই যাচ্ছে- অনুবাদে মুন্সিয়ানা আছে ।

চালাও পানসী বেলঘরিয়া

nandita bhattacharjee বলেছেন...

অনুপ্রেরণা , ধন্যবাদ।

nandita bhattacharjee বলেছেন...

অনুপ্রেরণা , ধন্যবাদ।

nandita bhattacharjee বলেছেন...

কচি মধুমিতা ধন্যবাদ ।