সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১২

অলোকপর্ণা


চান্দের চর

দুর্জয়দা আজকাল বড্ড ইনটারেস্ট দেখাচ্ছে দীপার প্রতি। একদম ভালো লাগছে না। আমিও কম সুলগ্না নই! ওই বদ মেজাজী মেয়েটাকে কি করে কারোর ভালো লাগতে পারে কে জানে, তার ওপর বিবাহিত! বাব্বা! এরা পারেও। দুর্জয়দার বউ জানতে পারলে কোর্ট অবধি দৌড়াবে, যা ঝগড়াটি! দাঁড়াও না, অ্যানিভার্সারী আসছে না তোমার!? সেখানেই তো দেখা হবে বৌদির সাথে, সারাক্ষণ ‘দীপান্বিতার মন খারাপ’, ‘দীপান্বিতার কি হয়েছে’ বেরিয়ে যাবে! খুব ডানা গজিয়েছে দীপারও। বরকে ফেলে একা একা সাউথের ফ্ল্যাটে দিনের পর দিনে পড়ে আছে। কে আসছে কে যাচ্ছে দেখার মতো কেউ নেই! ওরকম ভালো লেখক মানুষ, তাকে তুই ডিভোর্স দিবি! কী করে পারিস! তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীর যোগ্য হতে সারা জীবন লেগে যাবে দীপার। ওনার এক একটা বই, আমি নিজের চোখে দেখেছি, বই মেলায় আসছে আর উড়ে যাচ্ছে, আসছে আর উড়ে যাচ্ছে! এক এক বইমেলায় এক একটা বইয়ের তিন চারটে এডিশান কী এমনি এমনি বের হয়! সব ঠুনকো ইগো। আজকালকার মেয়েরাও হয়েছে এক। সবার উপরে থাকা চাই, এক চুল নীচে নামলেই যা নয় তাই করবে! এত সহজে বিয়ে ভেঙে দেওয়া যায়! আবার মহত্বও দেখাতে হবে। কী দরকার ছিল আজ তোর ওই দোপাটিকে চাইনিজ খাওয়াবার। পড়াবার তো ক্ষমতা নেই, ঘুষ দিয়ে স্টুডেন্টদের কাছে জনপ্রিয় হতে চাওয়া ছাড়া এটা আর কি! আর মেয়েটাও বলিহারি, নিজের ডিপার্টমেন্টের ম্যাডামকে ভুলে গিয়ে সারাক্ষণ দীপার সাথে বকর বকর করে গেল। অনার্সের প্র্যাক্টিকাল পেপারে তো বাছা আমার কাছেই নম্বর চাইতে আসতে হবে, তখন তোমার দীপাম্যাম কি হেল্প করতে পারবে তোমায়?


বাথরুমের আয়নার বাষ্পে নিজের ক্রুর মুখ দেখে নিজেই ভয় পেয়ে যায় সুলগ্না। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে নিজের সামনে। অহেতুক জোর করে হাসি এনে দেখে আয়নার ছায়াটা তার নিজেরই কিনা। কলকাতা শহরে এরকম অনেক মানুষ থাকেন যারা আয়নাকে ভয় পান। আইসোপ্ট্রোফোবিয়া কে তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী বাংলা নাম দিয়েছেন,-বিম্বভীতি। মানুষ ভয় পায় না এমন জিনিস পৃথিবীতে দুর্লভ। তাঁর শ্যালকটির অবশ্য বিম্বভীতি ব্যতীত অন্য কোনো ভয় নেই। স্বল্পবুদ্ধি মানুষের এটাই সুবিধা, তারা বিপদ, সত্য, ভয় এবং নিজের ভালো কীসে হবে,- বুঝতে পারে না। দয়া হয় তীর্থঙ্করের। গত তিন দিন ধরে পিকু কোথায় রয়েছে জানা যাচ্ছে না। দীপার ম্যানিয়াটা বাড়িয়ে দিয়ে সে যে শহরের কোন প্রান্তে হারিয়েছে কে জানে। দুশ্চিন্তা এতই বেড়েছে যে ডঃ ঘোষ পর্যন্ত মৌনব্রত ভেঙে কথা বলেছেন তীর্থর সাথে। অবশ্যই ফোনে। কলকাতা শহর ধ্বংস হয়ে গেলেও ডঃ ঘোষকে হসপিটাল থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে বলে তাঁর মনে হয় না। নিজের সোর্সগুলো খুলে দিয়েছেন তীর্থঙ্কর। জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেলে অনবরত বিবরণ সহ পিকুর নাম স্ক্রল করে যাচ্ছে ঘন্টায় ঘন্টায়। কোনো সাড়া মেলেনি। শিয়ালদহ স্টেশান চত্তরে চিরুনিতল্লাশি সারা হয়ে গেছে বার তিনেক। আর কতই বা কমিশনারকে অনুরোধ করা যায়। দীপার ফোনে জেরবার হয়ে গেছেন তিনি গত তিন দিনে। সেপারেট হওয়ার এক বছরেও এতোবার ফোন করেনি দীপান্বিতা। দয়া হয় তীর্থঙ্করের। নিজের ম্যানিয়া আর পিকুর নিরুদ্দেশ, খুব খারাপ সময় যাচ্ছে মেয়েটার। নতুন উপন্যাসের বইটার জন্য তীর্থর ফটো সেশান আছে আজ। তাই সকাল সকাল গাড়ি নিয়ে উত্তর কলকাতার দিকে বেরিয়ে পড়েন তিনি। পথে ছড়িয়ে আছে তাঁর তৈরী চরিত্রগুলো, কেউ আধপেটা ঘুরছে, কেউ মতোলবি। নিত্য নতুন চরিত্র তৈরী করতে হয় তীর্থঙ্করকে। কখনো নায়ক, কখনো খল নায়ক, কখনো জয়ী, কখনো পরাজিত, দু একটি মহাপুরুষ চরিত্রেও হাত দিয়েছেন তিনি। তাঁর নতুন উপন্যাসেই রবীন্দ্রনাথ আছেন।
গদ্যে প্রয়োজন মিটে গেলে তিনি এদের কলকাতার পথে ছেড়ে দেন। এইতো সামনের বাসেই, ফাঁকা জালনাটা জুড়ে বসে লেকচারার সুলগ্না। চিনতে ভুল হয় না তীর্থঙ্করের। কোন গল্পের জন্য তাকে বানিয়েছিলেন মনে নেই তাঁর। কিন্তু সে রয়ে গেছে, আজ কলেজে যাচ্ছে। পরশ্রীকাতর অবিবাহিতা মহিলাটি এক পার্শ্বচরিত্র ছিল তাঁর লেখায়। কে জানে এই কলকাতা শহর তাকে কি ভূমিকা দিয়েছে!


যাদবপুরের বনেদি বাড়িটায় খুব সকালে ভোর হয়। সামনের বাগানটা সূর্যের ছোঁয়া পাওয়ার আগেই বাড়িশুদ্ধ বাবা, মা, ভাই, জ্যেঠু, ছোড়দা, ছোটো কাকা, ছোটো কাকি এবং অবশ্যই পিসঠাক’মা স্নান সেরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিসের যে এত ব্যস্ততা বোঝেনা দোপাটি। তাই বিছানা ছাড়তে ছাড়তে ঘড়ির কাঁটারা নয়ের ঘরে ঢুকে যায়। আর তখনই বইয়ের র‍্যাক, পেন, গানের ডায়েরী, নোট খাতা, মোবাইল ফোন গা ঢলাঢলি করে এমনভাবে পড়ে থাকবে যে, রোজই কোনো না কোনো জিনিস বাড়িতে ফেলে সাড়ে নটায় কলেজের জন্য ট্রেন ধরতে নাকানি চোবানি খেয়ে ছুটবে, সেন বাড়ির ছোটমেয়েটা। জ্যেঠু বলবে “ওই যায় দ্যা ভিঞ্চি!” মা মুখ বেকিয়ে বলবে “সর্ববিদ্যা পারদর্শীনি!” বাবা কমলা কমলা খবরের কাগজটা মুখ থেকে না সরিয়েই নির্বিকার বলবে, “হুইম্‌জিকাল!” ছোড়দা এসে সদ্য আঁচড়ানো চুল ঘেঁটে প্রতিবাদ করতে না দিয়ে বাথরুমে ঢুকে যাবে। ছোটোকাকার প্লেট থেকে ক্রীম বিস্কুট ছিনতাই করে নীচে নেমে আসবে দোপাটি। দেখবে কৃষ্ণ স্যারের কাছে দুলে দুলে সংস্কৃত পড়ছে ভাই। দোপাটি ডাকে কৃষ্ণস্যার। ইদানিং মুখে শ্বেতী গজানো লোকটা একটু অদ্ভুত। ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা যায় উনি নাকি অঙ্কে মাস্টার্স! অথচ সংস্কৃত পড়াতে উত্তর কলকাতা থেকে ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে যাদবপুর আসেন।
আজ দৃশ্য অন্যরকম, কৃষ্ণস্যার আসেননি তাই সারা বাড়িতে মগের শাসন জারি করেছে ভাই। শান্তভাবে খাওয়ার উপায় দিচ্ছেনা সে কাউকেই। আরও লেট হয়ে আসছে দোপাটির। “মা, কৃষ্ণস্যার আসেনি কেন আজকে?”
“আহ! বলেছিনা ওরকম বলবে না!” বাবার ভ্রূ কুঁচকে থাকে কমলা কাগজের আড়ালে। মা উষ্ণতা হ্রাস করতে ফিল্ডে নামে, “আসবে না কেন, সেই কোন ভোরে এসে উপস্থিত। দেখেই মনে হোল শরীর ভালো নয়, নিজের মুখে তো মাইনে চায়নি কোনোদিন। মায়া লাগলো, অগ্রিম দিয়ে আজ চলে যেতে বললুম, সেই কোন নর্থ থেকে আসে বেচারা!” মা একটু থেমে বাবার উদ্দেশ্যে বলে, “আচ্ছা বাবুর পড়ার ঘরটা আজ পরিস্কার করাতে হবে, কিছু একটা মরে পড়ে আছে মনে হয়, কী বিশ্রী গন্ধ! সাত পুরুষের বাড়ি, সাপ, খোপ সবাইকে আশ্রয় দিয়ে বেড়াও!” খাবার মুখে গুঁজতে গুঁজতে অর্ধেক কথা কানে ঢুকল কী ঢুকলো না,- সিঁড়ি দিয়ে তরতরিয়ে নামতে লাগলো সে। ল্যান্ডিং এ তখন ভাইয়ের রাজধানী।

“দাঁড়া, আসুক তোর কৃষ্ণস্যার, যদি না বলেছি তোর নামে!”
“এই একদম ওরকম বলবি না ওনাকে!”
“ওরকম নাম হলে আর কি বলবো!”
“কেন, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বলবি!”
তাকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেতে দেখে থতমত খেয়ে যায় ভাই, ভয়ে ভয়ে বলে, “কী হলো ?”
“ওনার পুরো নাম কি?”
“কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ঘোষ।”
বাড়িতে হুলুস্থুলু বাধতে দু মিনিটও লাগল না। টিভি চ্যানেল, ভবানীভবন সহ সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় মুহুর্তের মধ্যে ফোন করা হোল। উত্তেজনা কেটে যাওয়ার পর দোপাটি যখন কলেজের দিকে পা বাড়ালো ততক্ষণে কম্পালসারী ইংলিশ ক্লাস সেরে ফ্যাকাল্টি রুমে ঢুকেছে দীপা। পিকু হারিয়ে যাওয়ার তিন দিন পরে সে কলেজে এসেছে। পিকুর জন্য দুশ্চিন্তায় অস্বস্তিটা সর্বক্ষণ আরও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। টেবিলে মাথা রাখার সাথে সাথে মোবাইলের ভাইব্রেশানে চমকে ছিটকে যায় সে। বাবা, এই সময়ে!
ধুকপুকে ভয়টা নিয়ে দীপা ফোন তোলে, “পেলে বাবা?”
“না, তবে ভবানীভবন থেকে ফোন করে জানাল সে নাকি যাদবপুরে কোনো এক বাড়িতে পড়াতে যাচ্ছে গত তিন বছর ধরে। আজও গিয়েছিল। শরীর ভালো না থাকায় তাকে ওনারা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন।”
দীপা একটু ধাতস্থ হয়। কিন্তু পরক্ষণেই রাগে ফেটে পড়ে, “ওনারা নিউজ দেখেন না! পিকুর খবরটা তো রোজ নিয়মিত দেখানো হচ্ছে!”
“ভবানীপুরকে ওঁরা জানিয়েছেন যে ওঁরা ওকে কৃষ্ণ স্যার নামেই চিনতেন।”
“কি অদ্ভুত পিকুটা! হোপলেস! নিজের পুরো নামটাও জানায়নি, অথচ পড়াচ্ছে তিন বছর ধরে!”
“কি বলবে বলো! যাই হোক আর কোনো খবর পেলে জানাবো, তুমিও জানিও।”
“বাবা!”
“কী?”
“আমি আজই যাদবপুরে যাবো। আমায় ঠিকানা যোগাড় করে দাও!”
দীর্ঘশ্বাস সহ ডঃ ঘোষ বলেন, “এস.এম.এস করে দিচ্ছি দাঁড়াও।”

“মনের মানুষ নইলে
মনের কথা কইও না।
কথা কইও না, প্রাণ সজনী গো
মনের মানুষ নইলে
মনের কথা কইও না।”

সিগনালে কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর গাড়ি ঘোরাতে গিয়েও থেমে যান তীর্থঙ্কর। সফল কিছু ছবি তুলিয়ে ফেরার পথে পাঁচ মাথার মোড়ের জনপ্রিয়, পুরনো, ছোটো, চাইনিজ হোটেলটা দেখে পুরনো লোভ সামলাতে পারেন না। দীপান্বিতা ঘোষ আর তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীর অনেক স্মৃতি ওখানে পড়ে আছে এখনও। এখানে মবড হবেন না- আশা করেন তিনি। গাড়ি পার্ক করে, স্বাভাবিকভাবে হোটেলটায় ঢুকে পড়েন। সামনেই চেনা মুখ।
ভারী গলায় বলে ওঠেন, “কী রে হাবুল চন্দ্র পুরকায়স্থ! তুমি হাফ কায়স্থ না ফুল কায়স্থ! খবর কী!”
“দাদা যে! কতদিন বাদে এলেন!”
“সে এলাম। তাগড়াই হয়েছিস তো দেখছি! তা জায়গা আছে ভিতরে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, চলে যান, অফিস টাইম তো, ফাকা আছে। অ্যায় রেজ্জাক! দাদাকে টেবিলে নিয়ে যা।”
হাঁটু অবধি গেঞ্জি পরা ছেলেটাকে দেখে তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীর দয়া হয়।
“রেজ্জাক?”
“হ্যাঁ দাদা।”
“দাদা কি রে? কাকু বল আমায়!”
“হাবুলদার দাদা আমারও দাদা!” উজ্জ্বল চোখে ছেলেটা উত্তর দেয়।
“তোর পরার প্যান্ট নেই?”
“হ্যাঁ আছে।” রেজ্জাক যেন লজ্জা পায়।
“তাহলে এরাম তুমি ন্যাংটাপুটু কেন?!” কপট রাগ দেখান তিনি। ছেলেটা বেমক্কা ভয় খেয়ে যায়। মজা লাগে তাঁর। “যাঃ, দুটো চিলি চিকেন আর এগ চাওমিন নিয়ে আয়!”
“দু পিস চিল্লি চিকেন আর এগ চাউমিন।” কোনো রকমে রিপিট করে ছেলেটা পালায়। খুব মজা লাগে তীর্থঙ্করের। চারদিকে চোখ বোলান তিনি। তিনটে টেবিল ফ্যান ছাড়া আর কিছুই বদলায়নি নয় বছরে। কে জানে তিন নম্বর টেবিলটা খুঁজলে এখনও দীপা আর তীর্থর কাটাকুটি খেলার ছক দেখতে পাওয়া যাবে। কলকাতা শহরে নয় বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও হোটেলটা অদ্ভুত কোনো উপায়ে নিজের গা বাঁচিয়ে রেখেছে। হোটেলটার প্রতিও দয়া হল তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীর। আজকাল দয়া আর মজা- এই দুটো ছাড়া আর কোনো অনুভূতি হয়না তাঁর। উপরে উঠতে উঠতে ঈশ্বর হয়ে গিয়েছেন তীর্থঙ্কর, তাঁর নিজের অন্তত তাই মনে হয় আর সে কারণে এই শহরকে দেখে দয়া আর মজা ছাড়া কিছুই আসে না তাঁর। হঠাৎ আড়চোখে পাঁচ নম্বর টেবিলের ক্যামেরা ঝোলানো যুবকটির দিকে তাকান তিনি। বিস্ফারিত চোখে সে তখন তমাম বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিককে দেখছে। প্রমাদ গুনলেন তীর্থ। আর সাথে সাথেই ছেলেটি “তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী!” বলে চেঁচিয়ে উঠল।

অলংকরণ –কৌশিক বিশ্বাস ও মেঘ অদিতি , চন্দ্রশেখর মিত্র