শৌনক দত্ত তনু
বর্ষা ফিরে গেলে কাশফুলে লেগে থাকে শ্রাবণের দাগ। কাশফুল কথা বলে। কবিতা লেখে। সমালোচনা করে। কাশফুল আপন পর চেনে না। রাজনীতি বোঝে না। গোষ্ঠী কিংবা দলবাজী করে না। হেঁটে যেতে যেতে স্কুল পালানো ছেলেটা কাশের পাশে বসে গল্প করে প্রথম সিগারেটের ধোঁয়া নিয়ে কাশতে থাকে।কাশফুল হাসে,চিকচিকে বালু উত্তাপ ছড়ায় কাশফুল কথা বলে নদী কবিতা লেখায়।উড়ে যাওয়া পাখি দেখে ছেলেটি পাখি হতে চায়।মেঘেরা উড়ে যায়।স্কুলপালানো ছেলেটি কাশফুল স্কুলে নদী মেঘ আর পাখিদের ক্লাশ করে।বখে যাওয়া সময়ে ভাষার জন্য রক্ত ঝরে পড়লে রাজপথে ছেলেটি প্রথম কাশের কথা আর নদীর কবিতায় নিজের কথা জুড়ে দেয়।গাছেদের বাহবা দেয় পাখিরা ছেলেটির কথা ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যায়।মেঘেরা কবিতা বলে ছায়া ফেললে কাশফুল ছেলেটির নাম রাখে কবি।ছেলেটির নাম এখন কবি।মুক্তির জন্য যুদ্ধ এলে কবি কবিতা লেখে।নদীর বুকে কবিতারা রক্তে ভেসে যায় পূর্ব থেকে পশ্চিমে।দেশান্তরী হয় মেঘ পাখি আর কাশফুল।কবি কাশফুলের পাশে দেখে কাঁটাতার।নদীর বুকে শূন্যতার চর।সময়ের ক্যালেন্ডার থেকে টুপ টুপ করে ঝরে পড়া এক একটি বছর,শতাব্দীর চাকায় ছুটে আসা অর্ধপাক নগরীর নৈঃশব্দিক আস্তরণকে উন্মোচন করে দেয়।
নিস্তব্ধতার চাদর সরিয়ে যানজট,জনবহুলতা,ইট কংক্রিটের খাঁচাবদ্ধ নগরী ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে জেগে ওঠে নিঃসীম নাগরিক ব্যস্ততায়।ঝকঝকে কাঁটা তারে জঙ লাগে।কাশফুলের নাম দেয়া সেই স্কুলপালানো কবি ছেলেটি বাংলা সাহিত্যচর্চার দুটি কেন্দ্রে ভাগ হয়ে যায় কলকাতা আর ঢাকা।কাঁটা তারের এপারের কবি কাঁটা তারের ওপারের কবি এক টা কাশফুল,নদী,মেঘ,পাখিরা জানে কিন্তু সাহিত্য কখনোই অভিন্ন বাংলা সাহিত্য হয়ে উঠতে পারেনি।হাওয়ায় দুলে দুলে ওঠে ছোট্ট প্রশ্ন।প্রশ্ন গভীর হয়ে ওঠে।ত্রিপুরা,আসাম,জেলা,গ্রাম দূরে সরে যেতে থাকে আর কবি ছেলেটির ছায়া পড়তে থাকে বাংলাভাষা ও মননে।কবি আকাশ দেখে আকাশ কি নীল কার্টিসপেপার নাকি ঈশ্বরের বেডকভার?ঈশ্বরের সাথে কথোপকথনে কবি ছেলেটি ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে ওঠে আকাশ তার নাম রাখে সাহিত্যিক।বয়স বাড়লে প্রশ্ন বাড়ে।গভীর প্রশ্ন।সাহিত্যিক আয়না দেখে ছায়ার সাথে কথা বলে বাংলাদেশ বাংলা ভাষার প্রধান লেখকদের স্মরণে বিশেষ ক্রোড়পত্র,অনুষ্ঠান,ছোটোকাগজগুলো বিশেষ সংখ্যা করে পশ্চিম বাংলায় তেমনটি ঘটে না কেন?তাহলে কি দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্য সম্পূর্ণ দ্বিখন্ডিত হয়ে গেছে?ছায়া কথা বলে বাঙালি মুসলমানরা বিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলাসাহিত্যচর্চায় অবতীর্ণ হন।বাঙালী মুসলমানরা তাই একই সময়ে হিন্দু লেখকদের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসেননি,বাংলা সাহিত্যও শুরুর দিকে দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের অভিন্ন সাহিত্য হয়ে উঠতে পারেনি।এরপর যখন দেশভাগ হলো তখনো বাঙালি হিন্দু লেখকদের তুলনায় বাঙালি মুসলমানদের রচিত সাহিত্য পরিমানগত দিক থেকে ছিল কম আর মানের দিক থেকে নিচু।
কাশফুলের কবি আর আকাশের সাহিত্যিক আয়না থেকে সরে আসে।ঈশ্বরকে ডেকে আনে চায়ের আড্ডায়।ঈশ্বর কিছু বই উপহার দিয়ে যায় অতীতের কবি বর্তমানের সাহিত্যিককে।ঈশ্বরের সাথে ভররাত আড্ডা মেরে ছোটো,ছোটো প্রশ্নগুলো গভীর হয়ে ওঠে।ঈশ্বর ফিরে গেলে গভীরতর হয়।ঐদিকে নদী শুকায়।পাখিরা হারায়।কাশফুল জঙ্ধরা কাঁটাতারে বেঁচে থাকে।কাশফুলের কদিন হলো শ্বাসকষ্ট ধরা পড়েছে।আগের মতো কথা বলতে কষ্ট হয়।মেঘ আসে ,ঈশ্বরের দেয়া বইগুলো থেকে তুলে নেয় প্রাজ্ঞ সাহিত্য ইতিহাসবিদ সুকুমার সেনের বইটি ।কবিকে পড়ে শোনায় ,সাহিত্যিক সেই ছেলেবেলার মতো শোনে।মেঘ পড়া শেষ করে প্রশ্ন করে কি বুঝলে কবি?সাহিত্যিক হেসে বলে কবি তো আমার ডাক নাম গো এখন আমি বড়ো হয়েছি আমার নাম সাহিত্যিক।মেঘ ও হাসে।আচ্ছা সাহিত্যিক বলো কি বুঝলে তুমি?
সাহিত্যিক গম্ভীর হয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে একরাশ শূন্যতা নিয়ে বলল বাংলাদেশের মুসলমান লেখকদের রচিত সাহিত্যকে বাঙালী হিন্দু সমালোচকরা কখনোই মূল বাংলা সাহিত্য বলে মনে করেননি।সুকুমার বাবু তাই এসময়ের মুসলমান রচিত বাংলা সাহিত্যকে 'এছলামি' বাংলা সাহিত্য বলে আখ্যায়িত করেছেন।সাহিত্যিকের আয়নার ছায়া যা বলেছিল তা মনে পড়ে এবং তখন তার মনে হয় বাংলা সাহিত্য তখন থেকেই দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।দেশভাগ এ বিভক্তিকে দিয়েছে কেবল রাজনৈতিক বৈধতা।কবিবেলা মনে পড়ে তার।নিজের বিভক্তির কান্না চেপে সে নদীর কাছে যায়।নদী এখন ধীর বয়সের পলিতে।তাকে দেখে নদী প্রসন্ন চোখ মেলে।কি সাহিত্যিক কেমন আছো?আমাকে তুমি কবি বলো।নদী মুচকি হাসে কবি তো তোমার ছোট্টবেলার নাম এখন তুমি সাহিত্যিক।আচ্ছা বেশ আমাকে তুমি বাংলা সাহিত্যের কথা বলো।নদী নড়ে বসে।এই যে আমি,এই যে তুমি,ঐ যে কাশ,নীলাকাশ,মেঘ পাখি গাছ আমরা সবাই সাহিত্য কিন্তু তফাত কোথায় জানো আমাদের অর্ধেক আছে পশ্চিম দিকে অর্ধেক পূর্বদিকে,মাঝে শুধু কাঁটাতার নয়ত আমরা এক।একটা কথা তো অনস্বীকার্য,নতুন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য একটি একক রাষ্ট্রের জাতীয় সাহিত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে।এটাই হচ্ছে সমকালীন রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতা।এখানে উল্লেখ যোগ্য কি জানো গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ উপনিবেশ কবলমুক্ত হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।তাই ওই সময় জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজনে দেখা দেয় জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা।তোমার মনে নেই বাহান্নতে তুমি কবি হয়েছিলে!ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এ প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটে।একাত্তরে আরও বিকশিত হয় নব্বইয়ে হয়ে ওঠে দূর্বার এ প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত আছে।তোমার নিশ্চয় কিউবার স্বাধীনতা আন্দোলনের কবি হোসে মার্তির কথা মনে আছে।যিনি বলেছিলেন সন্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিচয় গঠনে সাহায্য করে,রাষ্ট্রকেন্দ্রিক জাতি সৃষ্টির পথ উন্মুক্ত হয়।মার্তির এ ভাবনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র গঠনের সঙ্গে এর সাহিত্যও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।অন্যদিকে পশ্চিম বাংলায় বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে ভিন্ন এক আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পটভূমিতে।ফলে পশ্চিম বাংলার সাহিত্য বাংলাদেশের সাহিত্য থেকে অনেকটাই আলাদা হয়ে গেছে।ঠিক তেমনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে দূরে থেকে গেছে আসাম,ত্রিপুরা।তবে কি জানো কবি একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ যেখানে একটা জাতি হয়ে উঠলো সেখানে হয়তো ইচ্ছুক শিকার কিংবা অজান্তে পশ্চিম বাংলা হয়ে উঠলো সর্বভারতীয় সভ্যতার মায়াবিনী হাতছানির শিকার।তারা ত্যাগ করল তাদের আত্মপরিচয়,ভারতীয় এক জাতিসত্তার মধ্যে বিলীন হয়ে গেল।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ কী ভারতীয় জাতিসত্তা,কী পাকিস্তানি কোনোটির মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন হতে দেয়নি।তারা স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় নিয়ে প্রতিষ্ঠা অর্জন করে।বৃহত্তর বাংলা সাহিত্য এভাবেই প্রথমে পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠন এবং পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে ওঠার সামগ্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পৃথক হয়ে যায়।সমকালীন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ সীমান্তের এপার আর ওপারের লেখদের পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করতে থাকে।একই ভাষায় লেখা হলেও বাংলাদেশের সাহিত্য পশ্চিমবাংলার সাহিত্য থেকে আলাদা হয়ে যায়।তবে রাজনৈতিক বিভাজন যত সহজে তোমার চোখে পড়ে,সাহিত্যের পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্য তত সহজে ধরা পড়ে না।
নদী আর কবির ক্লাসে কখন কাশফুল আর মেঘ গাছ পাখিরা এসে বসে গেছে।কবি কাশের কাছে গিয়ে বসে তার বুকে হাত রেখে কুশল বিনিময় করে।কাশ আলতো করে কবির গাল ছুঁয়ে দিয়ে কপালে চুমু দেয় তারপর ধীর গলায় বলে কিন্তু কবি লক্ষণীয় কি জানো,এ পার্থক্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের সাহিত্যসমালোচক,কবি লেখকরা মনে করেন সমগ্র আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মধ্যেই তাঁদের অবস্থিতি,সৃজনী সাফল্যের দিকটিও তারা এ প্রেক্ষাপটেই বিবেচনা করে থাকেন।আধুনিক বাংলা কবিতা,উপন্যাস,গল্প,নাটক ইত্যাদি সম্পর্কে যখন আলোচনা করা হয়,তখন এ পটভূমির কথা তাঁরা বিস্মৃত হন না।স্বাভাবিকভাবেই বাংলা সাহিত্যের একটা তুলনামূলক ছবি তাঁদের বিশ্লেষণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপস্থিত থাকে।কিন্তু পশ্চিম বাংলার সাহিত্য সমালোচনায় এ তুলনাসূত্রটি একেবারেই অনুপস্থিত।বাংলাদেশ, ত্রিপুরা,আসাম,জেলা,গ্রামের সাহিত্যকে তারা বিবেচনায় আনেন না বলেই এমনটা ঘটছে।কিন্তু এইসব সাহিত্যিকদের তারা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেন এমনটা কিন্তু মনে হয় না।গত এক দশকে তাকালে দেখবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস,হাসান আজিজুল হকের গল্প ও উপন্যাস,সেলিনা হোসেনের কথাসাহিত্য,তসলিমা নাসরিন,হুমায়ূন আহমেদ,শামসুর রহমান,আল মাহমুদ,আসামের শিলচর থেকে রণজিত্ দাশ,রানাঘাটের জয়গোস্বামী,মুর্শিদাবাদের আবুল বাশার প্রকাশিত হলে এর পরই পশ্চিম বাংলার পাঠকরা বুঝতে পেরেছেন যাদের সামগ্রিকভাবে পশ্চিম বাংলায় মানে কলকাতায় সাহিত্যের প্রকাশনা সেই অর্থে উল্লেখযোগ্য নয়।তাদের সৃষ্টিশীল প্রতিভা কতটা শিখরস্পর্শী ।
প্রজাপতি আর মৌমাছি উড়ে এলো।আরে কবি যে কেমন আছো?কাশফুল একটু শ্বাস নিয়ে বলল তা প্রজাপতি আমাদের একটু দুই বাংলার প্রকাশনা নিয়ে কিছু বলো।তুমি তো বেশ রঙ ছড়িয়ে বেরাচ্ছো।প্রজাপতি কবির দিকে তাকিয়ে বলল কবি বুঝি বই বের করবে?মেঘ বলে আরে না আমরা একটু আলাপ করছি আর কি অনেকদিন তো দেখা নেই।নদী ও সায় দিলো।কবির চোখে তাকিয়ে অনেকদিন পর দেখা হবার একটা রঙ ছড়িয়ে প্রজাপতি বলল দেখো বাংলাদেশে পশ্চিমবাংলার বই যেভাবে বিপনন হয় পশ্চিমবাংলায় তেমনটি হয়না।একে অনেকে উপেক্ষা কিংবা গুরুত্বহীন দৃষ্টিতে দেখে আসলে এখানে ভাবনাটা যতটা আবেগময় বাস্তবের সঙ্গে ততটাই অসংগতিপূর্ণ আসল রহস্য হচ্ছে বানিজ্য এটা বন্ধু মৌমাছি ভালো বলতে পারবে।মৌমাছি চিরকাল সদালাপী বানিজ্য নিয়ে তার পড়াশোনাও অনেক।একগাল হেসে নিয়ে মৌমাছি বলল এই তো বিপদে ফেললে প্রজাপতি বেশ তো বলছিলে এখানে আবার আমাকে ডাকার কি দরকার ছিল তা যখন ডাকলে বলতে তো কিছু হবেই।আমরা জানি বানিজ্য বসতি লক্ষ্মী তাছাড়া পুঁজিবাদের সুত্রে যদি যাই কি দেখবো।কাশফুল শ্বাস নিয়ে বলল ভাই অত্ত থিওরির দরকার নেই সোজাসাপ্টা কথা বলাটা তুমি আজো শিখলে না।মোদ্দা কথাটা বলো।
মৌমাছি একটু হেসে নিয়ে বলল তা যা বলেছো।মোদ্দা কথাটা হচ্ছে সাহিত্যের প্রকাশনা বা যেকোনো প্রকাশনার সবচেয়ে বড়ো দিক হচ্ছে ব্যবসা কিংবা বানিজ্য।এ ব্যবসা বিষয়টি নির্ভর করে পাঠকের রুচি ও উপভোগের চাহিদার গতিপ্রকৃতির ওপর।পশ্চিম বাংলার পাঠকদের কাছে বাংলাদেশের লেখকদের লেখার চাহিদা খুব কম বলেই পশ্চিমবাংলার প্রকাশকরা বাংলাদেশের সাহিত্য প্রকাশে তেমন আগ্রহী হন না।সোজা কথায় প্রকাশকরা ব্যবসা করেন,সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করা তাদের ধর্ম নয়।এই ব্যবসার জন্যই আনন্দ পুরষ্কারের ছায়ায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও হাসান আজিজুল হকের বই প্রকাশ পেয়েছে।বানিজ্যের কথা ভেবেই খোলামেলা মূর্তিভাঙা নারীবাদী আত্মস্মৃতি বা আত্মজৈবনিক রচনার জন্য তসলিমা নাসরিন রয়েছেন প্রকাশনার শীর্ষে।শুধু ব্যবসার জন্য মলয় রায় চৌধুরী,সমরজিত্ সিনহা,মুরারী সিং,পূণ্যশ্লোকদাশগুপ্ত,প্রবুদ্ধ,কিংবা কোচবিহার,জলপাইগুড়ি,মালদার অনেক প্রতিভাকে আমরা তেমনভাবে পাইনি কিংবা অনেক কে আজো পাইনি।কাশফুল তোমার নিশ্চয় মনে আছে 'হাওয়া৪৯'নামের একটি ছোটোকাগজের কথা অধুনান্তিক প্রান্তিক কবিতা সংকলনের কথা!এতে সাব অল্টার্ন ইতিহাসতত্ত্বের অনুসরণে ছাপা হয়েছিল নিন্মবর্গের শ্রেণীভুক্ত কবিদের কবিতা।
বটগাছটি এবার বল শোনো মৌমাছি আমি একটি কথা বলি।প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে যেমন রয়ে গেছেন অনেক উল্লেখযোগ্য প্রতিভা।তেমনি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ও তাদের প্রাথমিক লক্ষ তবে এটাও স্বীকার্য প্রতিষ্ঠানের সহৃদয় হাতছানি পেলে তাঁদের অনেকেই পৌঁছতে চাইবে বৃহত্তর পাঠকের কাছে।এই ধরো না কবি উত্পলকুমার বসু,রনজিত্ দাশ কিংবা বিনয় মজুমদার যিনি আক্ষেপ করে বলেন তার কাছে কেউ যায় না।কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্ত্তীর কথাই ভাবো কিংবা বাংলাদেশের হরিপদ দত্ত প্রমুখ।সাহিত্যচর্চার বিষয়টি যদি বিবেচনা করি তাহলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পশ্চিম বাংলার চেয়ে অনেক বেশি অনুকূল।
বিকেল গড়িয়ে এলে।বাবুই পাখি চা নিয়ে আসে আড্ডায় একটা বিরতি হয়।চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কথাটা টেনে নেয় পিপঁড়া দেখো বটা দা এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার কেননা বাংলাদেশ হচ্ছে একক ভাষার দেশ আর পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা হচ্ছে একটি প্রাদেশিক ভাষা।সর্বভারতীয় ভিত্তিতে হিন্দি আর ইংরেজীর দাপট।ভাষার আধিপত্য নয়,অধিকাংশ ভাষা বাংলা হওয়ায় বাংলাদেশে বাংলায় সাহিত্যচর্চা ও প্রকাশনার দিকটি পশ্চিম বাংলার মতো ততটা জটিল নয়।বাংলাদেশের প্রকাশকরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি লেখককে প্রমোট করছে এবং ধীরে ধীরে চোখে পড়ার মতোন একটা পাঠকশ্রেনী গড়ে উঠছে।অন্যদিকে পশ্চিম বাংলা বা বাংলাভাষাভাষী রাজ্যগুলোয় আকাশ সংস্কৃতির জাল এ সাংস্কৃতিক ও ভাষাপ্রতিবেশে বাংলা ভাষার ব্যবহার সংকুচিত হয়ে পড়ছে।কিন্তু এরকম অবস্থায় দাঁড়িয়েও হিন্দি ইংরেজী ও বহু প্রাদেশিক ভাষার চাপে বাংলা সাহিত্যের চর্চা কিন্তু থেমে নেই বরং ক্রমবর্ধিষ্ণু।এর কারণ হতে পারে বাংলাভাষী জনসংখ্যা বৃদ্ধি,শিক্ষা ও পাঠাভ্যাসের হার পশ্চিমবাংলায় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি,কিংবা বাংলা সাহিত্য পাঠের প্রতি পশ্চিমবাংলাও অন্য বাংলাভাষার রাজ্যগুলোতে শিক্ষিত বাঙালীদের অনুরাগ অনিঃশেষ বিশেষ করে সৃজনশীল ভালো লেখা হলে তার পাঠকের কোনো অভাব হয়না।এসোব কারণেই প্রকাশনা শিল্প ও লেখকের সংখ্যা পশ্চিমবাংলায় অনেক বেশি।
নীরব শ্রোতার ভূমিকায় থাকা নদী পিপঁড়ার কথার জের টেনে নিয়ে বলে তবে একটা কথা কি জানো পিপিলিকা পশ্চিম বাংলায় লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া খুব কঠিন।কেননা পশ্চিমবাংলায় যারা সাহিত্যচর্চা করে তাদের গভীর আত্মনিবেদন আর নিষ্ঠার সাথে সাহিত্যচর্চা করতে হয়।সাহিত্যশৌখিনতার কোনো সুযোগ সেখানে নেই।রীতিমতো সমগ্র বাংলাসাহিত্য মন্থন করে প্রতিমুহুর্তে নিজেকে আপডেট করে সৃজনী যুদ্ধে নামতে হয়।মন্থনের শেষে বিষ মিলবে না অমৃত তা কিন্তু অধিকাংশের কাছেই অজানা থেকে যায়।আরেকটি ব্যাপার হলো পশ্চিমবাংলার সাহিত্যিকগন কে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটকে মানসপটে ছায়ার মতো রাখতে হয় ফলে তাদের দৃষ্টিকে রাখতে হয় প্রসারিত প্রাদেশিক হয়েও সর্বভারতীয় ফলে সাহিত্যে অনেক গভীর বিষয় ভাবনা যেমন উঠে আসার সম্ভাবনা থাকে তেমনি থাকে বহুভাষা বহুসাহিত্যের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।বাংলাদেশে সাহিত্যচর্চার পরিবেশটি তুলনামূলকভাবে তাই সহজ।বাংলাদেশ পশ্চিমবাংলার মতো আনন্দবাজার,উত্তরবঙ্গসংবাদ,প্রতিদিন,আজকাল কেন্দ্রিক নয় সেখানে প্রচুর দৈনিক পত্রিকা প্রতি সপ্তাহে সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করে।এছাড়া আছে তিনটি মাসিক পত্রিকা।
উত্তরাধিকার নামের মাসিক পত্রিকাটি প্রকাশ করে বাংলা একাডেমী আর কালি ও কলম এবং নতুন ধারা যার পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে বড়ো দুটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান।এছাড়া নতুন লেখকদের আত্মপ্রকাশের জন্য আছে প্রধান কেন্দ্র ছোটোকাগজগুলো।এই দিকে পশ্চিমবাংলা অনেকটা পিছনে।বাংলাদেশের চনমনে লেখকরা একটু নিষ্ঠার সাথে লেগে থাকলে তারা প্রকৃত পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে খুব দ্রুত সমর্থ হন।এছাড়া সাহিত্যচর্চার বিকেন্দ্রিকতা ছোটো ছোটো প্রান্তিক শহর থেকে নতুন কবি গল্পকার উপন্যাসিক উঠে আসে ঢাকায়।
তবে কি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা,গোষ্ঠীবাদ,দলবাজী নেই বলছো নদী।বটগাছের প্রশ্নে ধনেশ পাখি মুখ খোলে,আছে তবে পশ্চিমবাংলার মতো এতটা নয়।বাংলাদেশেও ঢাকা কেন্দ্রিক একটা সাহিত্যচর্চা আছে কিন্তু তা কলকাতার মতো প্রকট নয়।কেন না বাংলাদেশে ছোটোকাগজগুলোর পাশাপাশি দৈনিকগুলোও একটু ভালো মান ও গুনগত সম্পন্ন হলে তরুন লেখা ছাপায় কার্পন্য করে না।তবে অদৃশ্য একটা গোষ্ঠীবাজী,লেজুড়বৃত্তি যে কাজ করেনা তেমন নয়।তুলনামূলকভাবে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে এখনো বাংলাদেশ কিছুটা সমস্যাসংকুল হয়ে আছে।বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত প্রকাশকরা তরুন,খ্যাতি অর্জিত নন এমন লেখকের বই ছাপতে চাননা।তাই নিজের টাকা খরচ করে প্রতারনার শিকার হয়ে তরুনদের প্রথম লেখকজীবনটা প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়ে বইপ্রকাশ করতে হয়।তারচেয়েও বড়োসংকট পাঠকসংকট আর মননশীল লেখক সংকট।বাংলাদেশে হাতে গোনা দুচারজন ছাড়া আর কারো তেমন পাঠকপ্রিয়তা নেই।ধনেশদা তুমি কি তবে বলছো পশ্চিমবাংলায় প্রকাশকরা তরুনদের ডেকে ডেকে বই ছাপিয়ে দেয়?বাবুইয়ের কথায় ধনেশ পাখি একটু হোঁচট খায়।বাবুই পাখি একটু হেসে বলে সেইদিনই তো শুনলাম সমরজিত্ সিনহার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বইপ্রকাশ করে মোট একশ না তিনশ বইয়ের মাত্র পনেরটি বই দিয়েছে এক প্রকাশক।
বাবুই কথার রেশ টেনে বলে যায় দেখো ধনেশদা এসব ব্যাপারে দুই বাংলাই সমান জায়গায় অবস্থান করছে কিন্তু সাহিত্যবিচার মূলত পরিমাণগত নয়,গুনগত।সেদিক থেকে বিবেচনা যদি করো তবে পশ্চিমবাংলার সাহিত্যচর্চার ইতিহাস দীর্ঘদিনের।অসংখ্য লেখকের সেখানে আবির্ভাব ঘটেছে।তাঁদের লেখার পরিমান যেমন বিপুল,তেমনি বৈচিত্র্য বা পরীক্ষা নিরীক্ষা বিস্ময়কর।একেকজন লেখক আবির্ভূত হয়েছেন একেক বৈশিষ্ট্য নিয়ে,জীবনের বহুকৌনিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছে কবিতা,উপন্যাস,গল্প,নাটক,প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রতিটি দিক।সেই তুলনায় বাংলাদেশের সাহিত্য এতটা বহুমুখী নয়,অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ও সীমিত।আমার মনে হয় কারণটা মূলত আর্থসামাজিক।কেন নদীমাসি এমনটা বলছো কেন?দেখ বাবু পশ্চিমবাংলার জনজীবন অনেকটাই নাগরিক।পশ্চিমবাংলার গ্রামীণ জীবনেও লেগেছে নগর সংস্কৃতির ছোঁয়া।জনমানুষের প্রধান অংশটি মধ্যবিত্ত,কলকাতা থেকে শুরু করে ছোটো ছোটো শিল্প শহরে তারা ছড়ানো।গ্রাম্যজীবন বলতে যা বোঝায় পশ্চিমবাংলা থেকে তা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
ভাষাগত দিক থেকে পশ্চিমবাংলার বাংলা সাহিত্য প্রায় নিখুঁত।আবেগ অনুভূতির দিকটিও নাগরিক অর্থাৎ পরিমিত,সুনিয়ন্ত্রিত। ফলে আত্নরতি, নির্বেদ, নিঃসঙ্গচেতনা, মরবিডিটি, বিচ্ছিন্নতার বোধ যেমন প্রকট তেমনি হয়তো ওটাই পশ্চিমবাংলার বাংলাসাহিত্যের শক্তি।
বাংলাদেশের সাহিত্য সেই তুলনায় ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকাশমান। বাংলাদেশের নাগরিক জীবন বিকাশ তেমনভাবে ঘটেনি বলে নাগরিক পরিশীলন তেমন নেই। অধিকাংশ লেখকের শেকড় যেহেতু গ্রামে ফলে লেখায় তা গ্রামজীবনের সজীব স্পর্শে উজ্জ্বল। নাগরিক জীবন ও বিষয় ভাবনার দিক থেকেও বাংলাদেশের সাহিত্য পশ্চিমবাংলার সাহিত্যের তুলনায় অনেকটাই পৃথক। রাজনৈতিক স্বাধিকার আন্দোলন,সংগ্রাম ও দেশকাল সম্পৃক্ততা হচ্ছে বাংলাদেশের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।তাই বাংলাদেশের কবিতায় আবেগের প্রকাশ অবাধ,ভাষা উচ্চকিত কিংবা উঁচু স্বরগ্রামে বাঁধা।অন্যদিকে পশ্চিমবাংলার নাগরিকজীবন নির্বেদ এবং পরিশীলনের কারণে পশ্চিমবাংলার কবিতার স্বরগ্রাম অনেকটা নিচু অথবা অনুচ্চ।
পশ্চিমবাংলার কবি যেন সারাক্ষণ নিজের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কথা বলেন।ব্যক্তিজীবন যেন ছোটো বৃত্তে আবদ্ধ।রাষ্ট্রীয় উত্থান পতন তাদের তেমন একটা স্পর্শ করে না।শুধু বড়ো ধরনের কোনো রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক সংস্কার যদি দৈনন্দিন নাগরিক জীবনকে সংকটাপন্ন করে তোলে,তাহলেই কেবল তারা নড়েচড়ে উঠেন।অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় টানাপড়েন ও বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে যেতে হয় বলে বাংলাদেশের সাহিত্য কবিতা অধিকাংশই আদর্শায়িত জীবনবোধে উজ্জ্বীবিত।রাজনৈতিক উত্থান-পতন,রাষ্ট্রসংকট খুব সহজেই তাদের স্পর্শ করে।
সর্বভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে পশ্চিম বাংলার বাংলা সাহিত্য কিছুটা বিলুপ্তীর পথে হাঁটলেও বাংলাদেশ সেই পথে বিকাশমান এবং বাংলাসাহিত্য বাংলাদেশে হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা একেবারই নেই।পশ্চিম বাংলার অনেক লেখককে তাই আজ বাংলাদেশের পাঠকদের মুখাপেক্ষী হতে দেখা যায়।সেদিক থেকে বিবেচনা করলে একক নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও পশ্চিমবাংলা এবং বিশ্বসাহিত্যকে সাথে নিয়ে আত্মমর্যাদার সাথে বাংলাদেশের সাহিত্য প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে চলছে বললে ভুল হবে না।বরং বলা যায় বাংলাদেশই হয়ে উঠছে বাংলা সাহিত্যের মূল কেন্দ্র।
অন্ধকার উড়ে এলে।কবি উঠে দাঁড়ায়।কোথাও কোন ছায়া পড়েনা।অন্ধকারে কাঁটাতার ডুবে গেলে পূবের আকাশ রঙ ছড়ায়।গায়েত্রী মন্ত্র আর ফজরের আযান মিলে মিশে গেলে কবি হাঁটতে থাকে।গত চারশত বছরের জাতিগত মানদন্ড ব্যবহার করে সাহিত্যবিচারের বৈশ্বিক প্রবণতা।জাতীয়করণকৃত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচারের খন্ডিত,একচক্ষুবিশিষ্ট অন্ধত্ব পিছে ফেলে।কবির কবিতা নদীর বুকে রেখে কবির কাশফুল ইস্কুলের সবাই মানচিত্রের রঙে মিশে যায় আর কবি আগত ভোরকে প্রত্যক্ষ করতে করতে তারাদের সাথে রাতে কে বুকে নিয়ে উচ্চারণ করে এখন সময় সাহিত্যকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেখার,বিচার বিবেচনা করার।বিশ্বমানবের আর্ত,ভঙ্গুর অথচ উজ্জ্বীবিত মুখ যদি আমরা দেখতে চাই তাহলে জাতীয় সাহিত্যের ছোটো বৃত্ত কাঁটাতার কেটে বেরিয়ে ছুঁতে হবে দিগন্ত!দুইবাংলার সমালোচক ও ইতিহাসবিদের দৃষ্টি করতে হবে স্বচ্ছ।শুধু ব্যক্তিগত বন্ধুতা বা প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ নয়,দুইবাংলার সাহিত্যিকদের ভাবতে হবে কী করে বাংলা সাহিত্যের সীমানা আরও প্রসারিত করে দেয়া যায়।বৈশ্বিক হয়েও তার শেকড় যেন প্রোথিত থাকে বাংলাভাষার মর্মমূলে।যে জীবন কাশফুল নদীর,যে জীবন প্রজাপতি মেঠোপথের,যে জীবন নগরের সে জীবন যেন মিলেমিশে হয়ে ওঠে সর্বজীবস্পর্শী ও মানবিক।
উড়ে যায় অন্ধকার নতুন একটি দিনের সূর্য আভায়...
অলংকরণ - অমিত বিশ্বাস ও মেঘ অদিতি
1 comments:
শ্যালকবাবু !
অহো ! কি লিখিয়াছো ! জন্ম- জন্মান্তেরও ভুলিব না ।।।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন