সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১২

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ

উইলিয়াম ব্লেইক-এর কবিতা


উইলিয়াম ব্লেইক (William Blake, ১৭৫৭-১৮২৭)
অঙ্কন: Thomas Phillips, ১৮০৭

অনুবাদ: সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ


উপক্রম


বাজাচ্ছিলাম বাঁশি যখন সুখের সুরে,
বাজাচ্ছিলাম বাঁশি যখন উপত্যকায়,
একটা মেঘে দেখতে পেলাম এক শিশুরে,
মোহন হাসি হেসে শিশু বলল আমায়:

“মেষশিশুকে নিয়ে গান-এক শুনিয়ে দাও!”
সুখের সুরে বাঁশিতে গান উঠল বেজে।
“বাঁশিওয়ালা, গানটি তুমি আবার বাজাও!”
তাই বাজালাম, কিন্তু শুনে কাঁদল সে যে!

“দাও, ফেলে দাও আনন্দিত বাঁশি তোমার,
গানখানি গাও গলা ছেড়ে, সুখের সুরে!”
গাইলাম তাই ঐ গানটাই ফের একবার,
সুখের সুরে ফের কাঁদালাম ঐ শিশুরে।

“বাঁশিওয়ালা, ব’সো এবার, লেখো এ-গান
পুথির পাতায়, সবাই যেন পড়তে পারে।”
বলতে-বলতে করল শিশু অন্তর্ধান–
হানা দিলাম খাগড়া-বনে, নদীর পাড়ে,

খাগড়া দিয়ে বানাই একটা গ্রাম্য কলম,
স্বচ্ছ জলে আলতা গুলে বানাই কালি;
গান লিখে যাই, আনন্দিত, আর মনোরম,
শুনে সকল শিশু বাজায় করতালি।


রাখাল

কী সুন্দর রাখালের ঐ মেষপাল!
তাদের চরায় সে যে সকাল-বিকাল।
পালের পিছনে ছুটে কোনো ক্লান্তি নাই,
গলায় মধুর গানে শুধু প্রশংসা-ই–

কারণ, সে শোনে, মেষশাবকের ডাকে
সজীব জবাব দেয় সুখী মাতা-মেষ;
পালক সতর্ক, তাই পাল সুখে থাকে,–
রাখাল কাছেই আছে–জানে তারা বেশ।


মুখর শ্যামলিমা

ভোরের সূর্য উঠল,
আকাশে পুলক ফুটল,
ঘণ্টার টংটং
বসন্ত স্বাগতং,
দোয়েল কোয়েল সব
পাখি করে কলরব,
মেলায় মুহুর্মুহু
ঘণ্টার টং-এ কুহু,
আমরা মাতি খেলায়
মুখর শ্যামলিমায়।

হাসে বুড়ো হরিদাস,
মাথা-ভরা সাদা কাশ,
পিঁপুল-গাছের তলে
বুড়োর আড্ডা চলে,
আমাদের দেখে হাসে,
কত ছবি মনে আসে,
তারাও তো শৈশবে
এম্নি মেতেছে সবে
সারাটা-দিন খেলায়
মুখর শ্যামলিমায়।

আমরা শ্রান্ত হই,
ক’মে আসে হৈচৈ,
সূর্য অস্তে নামে,
আমাদেরও খেলা থামে,
মায়ের কোলের কোণ
খোঁজে সব ভাই-বোন,
পাখি যথা যায় ফিরে
তন্দ্রা-আঢুল নীড়ে:
আয় ঘুম, ঘুম আয়,
তিমির শ্যামলিমায়।


মেষশাবক

মেষশিশু, শোন্ প্রশ্ন এ,
বল্ তো, তোকে গড়ল কে?
আহার দিল, বিহার দিল,
গোচর-ঘাসে, র্ঝনা-পাশে;
কাপড় দিল পশমি নরম
আরামদায়ক, সফেদ, গরম;
গলায় দিল কোমল সু-স্বর,
অধিত্যকায় তুলিস লহর–
মেষশিশু, শোন্ প্রশ্ন এ,
বল্ তো, তোকে গড়ল কে?

দিচ্ছি আমি এর উত্তর,
শোন্ রে কে যে স্রষ্টা তোর:
মেষশিশু কয় সবাই তাকে,
নিজ-কে নিজে এ-ই সে ডাকে–
সেও তো নম্র, নরমসরম,
পলকা, ছোট্ট, সেও আজনম;
মানুষ, মেষের আমরা শাবক,
তার নামে নাম আমরা পাবো।
মেষশিশু, পা’স্ প্রভুর আশিস্!
মেষশিশু, পা’স্ প্রভুর আশিস্!


কুঁড়ি

চলচঞ্চল চড়–ই ওরে,
ঘনসবুজ পাতার মেঘে
সুখী কুঁড়ি-এক দেখছে তোরে,
তুইছুটিস তিরের বেগে–
দ্যাখ্, তোর বাসা আছে
আমার বুকের কাছে।

চারু চিতলোল বাবুই ওরে,
ঘন-সবুজ পাতার ভিড়ে
সুখী কুঁড়ি-এক শুনছে তো রে
তুইকাঁদছিস ফিরে-ফিরে–
বাবুই, বাবুই, আছে!
আমার বুকের কাছে।


চিম্‌নি-ঝাড়ুদার

যখন আমি এতটুকুন, মা যে গেল ম’রে,
কথাও ভালো ফোটে নি, বাপ দিল বিক্রি ক’রে,
কাঁদতেও খুব পারি নি যে ওঁয়া ওঁয়া ওঁয়া–
তাই তো তোমার চিম্নি ঝাড়ি, তাই তো ছাইয়ে শো’য়া।

ঐ তো ছোট্ট লাভলু মিয়া, চেঁচাচ্ছিল খুব
ন্যাড়া হবার সময়–আমি বলি তাকে, “চুপ!
লাভলু বোকা, মাথায় যদি না-থাকে তোর চুল,
চুলে জটা হবে না আর লাগলে কালি-ঝুল।”

এই শুনে সে শান্ত হ’ল। সেই সে রাতেই, যখন
ঘুমে অচৈতন্য, লাভলু দেখতে পেল স্বপন:
আবুল ভুলু মণ্টু–হাজার চিম্‌নি ঝাড়ুদার,
বন্দি সবাই কালো-কালো কফিনে যে যার;

ফেরেস্তা এক এলো একটা দিব্য চাবি-হাতে,
খুলল কফিন–সবাই মুক্তি পেলো। সাথে-সাথে
নেচে, হেসে সবুজ মাঠে খেলল ঘুরে-ঘুরে,
গোসল করল নদীতে, গা শুকাল রোদ্দুরে–

ন্যাংটা এবং ফর্সা–সবাই ঝুড়িটুরি ফেলে
চড়ল মেঘে, খেলল তারা বাতাসে গা মেলে;
লাভলুকে কয় ফেরেস্তা, “তুই হ’লে ভালো ছেলে,
বিভু হবে বাবা রে তোর, যাবে না সে ফেলে।”

ঘুম ভাঙে ওর, আমরাও সব ভোর না-হ’তেই উঠি,
ঝুড়ি নিয়ে, ঝাড়ু নিয়ে, কাজের জন্য ছুটি;
ঠাণ্ডা সকাল, লাভলু তবু গরম আছে সুখে–
ফুর্তিতে কাজ করো যদি, শীত লাগে না বুকে।


হারিয়ে-যাওয়া ছেলে

“ও বাপি! বাপি! তুমি যাচ্ছ কোথায়?
হাঁটতে পারি না যে অমোন জোরে!
আমার সাথে তুমি কথা কও, বাপি,
হারিয়ে যাব তবে পিছনে প’ড়ে!”

অন্ধকার রাত, বাবা কাছে নেই,
ছেলেটা ভিজে গেছে শিশিরে, জলে,
কাদায়-ভরা পথে কাঁদল বেচারা,
কুহেলি উড়ে কই যায় যে চ’লে–


ফিরে-পাওয়া ছেলে

হারিয়েছিল পথ বিজন জলায়
ছেলেটা–ঘুরে-ফিরে আলেয়া-ধাঁধায়
কেঁদেছে–তারপর এসেছে ঈশ্বর
বাবার মতো সেজে, ধবল জামায়;

খেয়েছে চুমু সেই শিশুর মুখে,
নিয়েছে মা’র কাছে হাতটি ধ’রে–
ছেলেকে খুঁজে-খুঁজে, গভীর দুখে
পাণ্ডু হ’য়ে যে-মা রয়েছে প’ড়ে।


হাসির গান

হাসছে যখন সবুজ বনটা খুশিতে ডগমগ,
গালে-ঢেউয়ের-টোল–নদীটা হাসিতে ঝকমক,
আমাদের এই মজায়, দমকা রোল ওঠে বাতাসে,
সেই শব্দে, পাহাড় মুখে রুমাল দিয়ে হাসে,

যখন খুশি মাঠটি দেখায় সবুজ দাঁতের পাটি,
সেই ছবিটার মধ্যে যখন হাসে ঘাসপোকাটি,
হাসে মৌরি, হাসে সুজন, হাসে জোনাকি,
চাঁদের মতো গোল-মুখে সব হি হি হা হা হি

বাতির ছায়াটিতে যখন ছবির পাখি হাসে,
মাদুর-ভরা জাম, বাদামের, লিচুর হাসি আসে,
এসো, আমার পাশে ব’সো, প্রাণ জাগিয়ে দি
মধুর হাসির ঐকতানে হি হি হা হা হি


দোলনার গান

মধুর স্বপন, ছায়াটি দিয়ো রে
এই সুন্দর শিশুর শিয়রে,
পুলকনদীর মদির স্বপন,
আমুদে, নীরব, জোছনা-মগন।

নরম, গরম, সুমধুর ঘুম,
আমার সোনার চোখে দাও চুম,
ঘুমের পরি-রা, এই শিশুকে
দোলাও, দোলাও কোমল বুকে!

মধুর হাসি-রা, যাও ঘুরে-ফিরে
আমার সুখের ঠোঁটে, রাত্তিরে।
সুমধুর হাসি জননীর মুখে
সমস্ত রাত ভ’রে দিক সুখে।

অফুট কাঁদন, ঘুঘুর শ্বাস,
না-টানুক তোর ঘুমের রাস,
মধুর কাঁদুনি, মৌ-মৌ হাসি
সারারাতভর বাজাক সে বাঁশি।

ঘুমাও ঘুমাও তুষ্ট শিশুটি,
সকলের চোখ এখন নিদুটি,
পুলকিত ঘুম ঘুমাও ঘুমাও,
মা যখন কাঁদে, তুমি ঘুম যাও!

কচি-মুখে তোর, অ মোর সোনা লো,
দেখি যেন, আহা, স্বর্গের আলো;
তোমার স্রষ্টা একদা ঝুঁকে
আমার মুখেও–কেঁদেছে সুখে।

তোমার, আমার, সবার তরেই
কেঁদেছে–যখন শিশু সে নিজেই;
তার সোনামুখ–জানিস খোকন,
তোর মুখে হেসে উঠছে এখন?

তোমার, আমার, সবারই মুখে
হাসি-মুখে দেখি ঐ শিশুকে!
শিশুর হাসিই তার হাসি, হায়–
স্বর্গ-পৃথিবী সুখে ঘুম যায়।


ঐশী স্বরূপ

করুণা দয়া ভালোবাসা ও শান্তি
কষ্টকালে ডাকে সবাই এদের,
ধন্যবাদ দেয় এদেরই কেবল
ঝঞ্ঝা থেমে গেলে বিপদাপদের।

করুণা দয়া ভালোবাসা ও শান্তি
বিধাতা–যে সবার পিতার মতন;
করুণা দয়া ভালোবাসা ও শান্তি
মানুষ–শিশু তার, পরম যতন।

কারণ দয়া মানবাত্মারূপিণী,
করুণা মানুষের মুখেই সে হাসে,
ঐশীরূপ ভালোবাসা মানুষের,
শান্তি থাকে তার গায়ের লেবাসে।

কাজেই সঙ্কটে মানুষেরা সব
সর্বদেশে আর সর্বাঞ্চলে
করুণা দয়া ভালোবাসা ও শান্তি
ঐশীরূপে ডাকে এদের সকলে।

মানুষমাত্রেই সমপূজনীয়,
তুর্কি, য়িহুদি, বা নাস্তিক ঘোর–
করুণা দয়া ভালোবাসা ও শান্তি
-আকারে বিভু থাকে মানুষে বিভোর।


পুণ্য বৃহস্পতিবার

পুণ্য বৃহস্পতিবারে বাচ্চাগুলি অমল-আনন
নীল লাল আর সবুজ জামায় হেঁটে যাচ্ছে দু’জন-দু’জন
আগে-আগে পুরুত সচল, যষ্টি-হাতে তুষারধবল
ঢুকল সবাই সাধু পলের গির্জায় টেম্‌স নদীর মতন

আহা কী জনতা এটা লন্ডনের এই কুসুমনিচয়
বসেছে সব দলে-দলে স্বীয় প্রভায় প্রতিভাময়
গুঞ্জনশীল এই জনতা এই জনতা মেষের জাত
হাজার-হাজার ছেলেমেয়ে তুলছে তাদের পুণ্য হাত

প্রবল ঝ’ড়ো হাওয়ায় যেন মেলল তারা সুরের পাল
স্বর্গ-গাঙে কিংবা যেন সুসংহত বজ্রমাল
নীচে দীনের অভিভাবক প্রৌঢ় ভাঁজে করুণা-সুর
নইলে দুয়ার থেকে কোনো হুর খেদাবার ঝুঁকি প্রচুর


ধাত্রীর গান

যখন বাছাদের মুখর আমোদের
প্রতিধ্বনি শুনি পাহাড়ে
আমার সুখী বুকে হৃদয় থাকে সুখে,
নিখিল-নিশ্চল, আহা রে!

বাছারা ফিরে আয়, সুজ্জি ডুবে যায়,
শিশিরে ভ’রে ওঠে মেঠো ঘাস;
আজ না খেলা আর, সময় ঘুমাবার,
না-রাঙে যতখন পুবাকাশ।

ধাই মা, তুমি ভালো, দ্যাখো-না, আছে আলো,
এখুনি যায় নাকি ঘুমোনো?
একটু খেলা বাকি, আকাশে ওড়ে পাখি,
ভেড়ারা মাঠে চরে এখনও।

ঠিকাছে, র্ক খেলা যাবৎ আছে বেলা,
আসবি পরে সোজা বিছানায়–
শুনেই, কোলাহলে দস্যিগুলি তোলে
পাহাড়ে রুনুরুনু পুনরায়।


শিশু খুশি


“আমার কোনো নাম তো নেই,
দু’দিন বয়েস মোটে–”
কী নাম ধ’রে ডাকব তোরে তবে?
“খুশি আমি সবতাতেই,
নামটি খুশি-ই হবে।”
খুশি রে, তোর খুশি-ই যেন জোটে!

ছোট্ট খুশি, মিষ্টি খুশি,
ছোট্ট খুশি, দু’দিন বয়েস মোটে–
ছোট্ট খুশি, ডাকি তোরে,
মিটমিটিয়ে হাসিস, ওরে,
আমিও গাই আদর ক’রে:
খুশি রে, তোর খুশি-ই যেন জোটে!


স্বপ্ন

একদা স্বপন এক ফেলেছিল ছায়
দেবদূত-সুরক্ষিত আমার শয্যায়:
ঘাসে শুয়ে থেকে, আমি দেখি যেন চেয়ে,
পথ হারিয়েছে এক পিপীলিকা-মেয়ে।

বিক্ষিপ্ত, সন্ত্রস্ত, ব্যস্ত দেখি আমি তারে,
হেঁটে-হেঁটে ক্লান্ত, শ্রান্ত, অন্ধ অন্ধকারে,
ধস্তাধস্তি ক’রে-ক’রে পানিতে কাদায়
বুক-ফাটা আর্তনাদে বলল সে হায়:

“হা আমার খোকা-খুকু! কেঁদে বুঝি সারা,
বাপের ছটফটানি দেখে দিশাহারা,
বাইরে তাকায় শুধু ছোট্ট মাথা তুলে,
কাঁদে আর কাঁদে শুধু, খাওয়া-শো’য়া ভুলে!”

কথা শুনে আমি কেঁদে ফেলি করুণায়:
একটা জোনাকি এলো, এসেই শুধায়,
“রাতের প্রহরী আমি এই মধুবনে,
কে কাঁদো গো, কেন কাঁদো, কোন্ ব্যথা মনে?

“পথ হারিয়েছ, বাছা? খুঁজে দিতে হবে?
আলো জ্বেলে রাখলাম। ওঠো, মেয়ে, তবে।
গুবরেটা রোঁদ দেবে, সব ওর চেনা,
ওর সাথে চ’লে যাও, বিপদ্ হবে না।”