সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১২

সুবীর বোস

সঞ্জীবনী


বেশ ছোটোবেলা থেকে অদিতি সময়-সুযোগ পেলেই ন্যাশনাল জিওগ্রাফি আর ডিসকভারি চ্যানেল খুব মনযোগ দিয়ে দেখে। ওই চ্যানেলগুলোর দৌলতেই অদিতি চেনা-অচেনা বহু জীব-জন্তুর আদব-কায়দা, স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে অনেকটাই ওয়াকিবহাল হতে পেরেছে। অন্যদিকে এইসব খবরাখবর রাখার সঙ্গে সঙ্গে বছর দুয়েক হলো অদিতি আরও একটা অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেছে। নামকরণ। মানে অদিতি তার পরিচিত লোকজনদের ব্যবহারে বা আদব কায়দায় যদি কোনো জীব-জন্তুর ছায়া দেখতে পায়, সঙ্গে সঙ্গেই সে ব্যক্তির নতুন নামকরণ এ ক্ষেত্রে অনিবার্য। এমন নয় যে অদিতি রোজই একেক জনের একেকটা নামকরণ করছে। এ ক্ষেত্রে বরং উল্টোটাই ঘটেছে। গত কয়েক বছরে মাত্র কিছু হাতে গোনা ব্যক্তি অদিতির এই “নাম”এর তালিকায় প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করেছে।

হ্যাঁ, এই নামকরণের তালিকা থেকে অদিতি নিজেকেও বাদ রাখেনি এবং অবস্থা অনুযায়ী নিজের নামটা সে বেশ ঘন ঘন বদল করেছে। এই যেমন যখন সে ঠাকুমার আচার চুরি করে ছোটো ভাইকে এড়িয়ে চিলেকোঠায় চলে যায়, তার নিজেকে মনে হয় লেপার্ড, যে অন্যদের হাত থেকে নিজের খাবারকে নিরাপদে গাছের মাথায় সরিয়ে নিয়ে গেল। আবার পরীক্ষায় কম নাম্বার পেয়ে নিজের রিপোর্ট কার্ডটা বাবাকে দেখানোর আগে যখন তার ইচ্ছে হয় বাবাকে একটা বিশেষ ব্র্যান্ডের চকোলেট খাওয়ানোর, যাতে বাবা খাতা দেখায় একটু অমনোযোগী হয়ে পড়ে, তখন সে মনে মনে কাঠবেড়ালি, যে সাপকে ধোঁকা দেবার জন্য নিজের লেজটা বার বার এগিয়ে দিতে চায় সাপের দিকে। একবার তো সে নিজেকে কিছুদিন সিংহী হিসেবেও ভাবা শুরু করেছিল। সে অবশ্য অন্য কাহিনি!

অদিতির এই “নাম” এর তালিকায় প্রথম প্রবেশ করার যোগ্যতা অর্জন করেন জনৈক রিক্সাওয়ালা। অদিতি তখন ফার্স্ট ইয়ার। এক সকালে অদিতি খবর পেল যে তার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু মিলি খাট থেকে আচমকা পড়ে গিয়ে তার হাতটি ভেঙেছেন। ব্যস, মিলির হাত ভাঙার খবরটা পেয়েই পাড়ায় মোটামুটি ডানপিটে বলে পরিচিত অদিতি তক্ষুণি পরিচিত এক রিক্সাওয়ালা কাকুর রিক্সায় চাপিয়ে মিলিকে নিয়ে চলল গোপাল ডাক্তারের কাছে।

ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পথেই অদিতির রিক্সাওয়ালাকাকু মিলির হাত ভাঙার কারণ শুনে খুব গম্ভীরভাবে বলল, এই জন্যেই আমাদের মাটির বাড়িই ভালো।

কথাটার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে না পেরে অদিতি রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, কেন, মাটির বাড়ি ভালো কেন কাকু?

- সেটা বুঝতে পারলে না অ’দি?

এই রিক্সাওয়ালাকে প্রায়ই অদিতিকে নিয়ে এখানে-সেখানে যেতে হয় এবং সে আদর করেই হোক বা সুবিধার জন্যেই হোক - অদিতিকে ডাকে অ’দি। অদিতির ধারণা “অদিতিদি” জাতীয় জটিল উচ্চারণ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যেই এই ব্যবস্থা। তো “অ’দি” খুব করুণ মুখে বলল,

- না, বুঝতে পারিনি কাকু। তুমি বুঝিয়ে দাও।

- কী জানো তো অ’দি, মাটির বাড়ি মানে তো মেঝেও মাটির। মাটির মেঝে খুব নরম হয় তো। তাই আমার মনে হয় মাটির মেঝে হলে মিলিদির হাতটা ভাঙত না। রিক্সাওয়ালা নিদান দেয়।

রিক্সাওয়ালার নিদান শুনে এমনকি মিলিও ওই অত কষ্টের মধ্যে হেসে ফেলে। অন্যদিকে অদিতি আর কাল বিলম্ব না করে রিক্সাওয়ালার একটা নামকরণ করে। এই প্রথম। সে রিক্সাওয়ালার নাম রাখে জিরাফ।

এ ক্ষেত্রে রিক্সাওয়ালা তার সীটে বসে অনেকটা উচ্চতা পেয়ে গেছিল বলেই শুধু নয়, রিক্সাওয়ালার এই “প্রথমে শোনায়, পরে ভাবায়” পর্যবেক্ষণটাও অদিতির মনে ধরেছিল খুব। অদিতি জানে যে, এমনিতে নিরীহ কিন্তু উচ্চতার কারণে বিপদের আঁচ আগেভাগেই পেয়ে ঠিকঠাক প্রতিরোধের ক্ষমতা আছে জিরাফের। আর সে জন্যেই অন্যান্য অনেক তৃণভোজী প্রাণী জিরাফের কাছাকাছি থাকতে নিরাপদ বোধ করে। কারণ তারা জানে যে, উচ্চতার কারণে অনেকটা দূর থেকে জিরাফ বিপদের গন্ধ আগেভাগেই পেয়ে যাবে আর নিজে সাবধান হবার সময়ে অন্যদের কাছেও সেই বার্তা পৌঁছে দিয়ে যাবে। রিক্সাওয়ালার সরল নিদানের আড়ালে অদিতি সেদিন যেন সেই বার্তারই আগাম আভাস পাওয়া শুরু করেছিল। তার মনে হচ্ছিল, সামনে আরও কিছু সমস্যা আছে যেটা সে বা মিলি বুঝতে পারছে না। তবু অদিতি ভয় পেল না। তার কেন জানি না মনে হলো, তার সঙ্গে আছে এক আন্তরিক অভিভাবক, যে তাদের বিপদে পাশে থেকে লড়বে।

এ সব ভাবত ভাবতেই আরেকটু হলেই আবেগে টলমলো অদিতি রিক্সাওয়ালাকে প্রায় “জিরাফকাকু” ডেকে ফেলেছিল। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে সে তার “নতুন অভিভাবকক”কে বলে, কাকু, ভাবছি, মিলিকে গোপাল ডাক্তারের কাছে না নিয়ে ডাঃ নিখিল ব্যানার্জীর কাছে নিয়ে যাব। তুমি কি বলো?

অদিতি এই প্রশ্নটা আসলে জিরাফকে করেছিল, যে তার উচ্চতার জন্য অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখতে পায়। দেখা গেল অদিতি ভুল ভাবেনি। রিক্সাওয়ালা একটু ভেবে জানাল, ও হো, আজ তো বুধবার। মানে আজ গোপাল ডাক্তারের ছুটি। অ’দি, হ্যাঁ, তার চেয়ে চল আমরা নিখিল ডাক্তারের কাছেই যাই।

রিক্সাওয়ালার উত্তর শুনে আরও নিশ্চিন্ত অদিতি বুঝতে পারল যে, সে সঠিক লোকের সঠিক নামকরণ করেছে। তার মনে হলো, অনেকটা ঘাড় তুলে তার “জিরাফকাকু” আশপাশটা ভালো করে বুঝে নিয়ে তাকে এবং মিলিকে সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দেবে, দেবেই। তারপর সে হেসে বলল, হ্যাঁ, কাকু, তাই চল।

সেদিন সত্যিই অদিতির “জিরাফকাকু” সমস্ত সময়টা ওদের সঙ্গে থেকে মিলিকে ডাক্তার দেখিয়ে, এক্স রে করিয়ে, হাতে প্লাস্টার করিয়ে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে দিয়ে মিলি এবং অদিতিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারপর ছুটি নিয়েছিল। মাঝের ঘটনা বলতে কম্পাউন্ডারকে জিরাফকাকুর হালকা ধমক “অত জোরে প্লাস্টার” করার জন্য আর ওষুধের দোকানদারকে বিড়বিড় করে গালমন্দ “বেশি দাম নেবার” জন্য।

সেদিন বাড়ি ফেরার পর অদিতির কেন জানি না মনে হয়েছিল ডাঃ নিখিল ব্যানার্জী যদি এক্স রে না করিয়েই মিলির হাতে ঠিক জায়গায় প্লাস্টার করে দিতে পারতেন তো তাঁর নাম দেওয়া যেত জ্ঞানী প্যাঁচা।

সেই অদিতি এখন ফাইনাল ইয়ার, ইংলিশ অনার্স। গত দু’ বছরে আরমাত্র একজন অদিতির কাছ থেকে ওই “বিশেষ নাম” পাবার যোগ্যতা অর্জন করেছে। সেটা ওর নিজের ছোটো ভাই সন্তু। অদিতি দেখেছে, সন্তু খুব নিরীহ মুখ করে কখনো পাকা আম, কখনো পাটালি গুড়, কখনো কনডেন্সড মিল্কের কৌটো নিয়ে সোজা খাটের নিচে ঢুকে নিশ্চিন্তে সে গুলো সাবাড় করে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দোষ পড়ে অদিতির উপর। এ ক্ষেত্রে প্রশ্রয়ী “দিদি” তার ভাইয়ের নাম রেখেছে কচ্ছপ।

সন্তুর বুকে হেঁটে খাটের তলায় ঢুকে পড়া, আদ্যন্ত নিরীহ মুখ করে সবার সামনে ঘুরে বেড়ানো, অপরাধ করেও খুব ঠান্ডা মাথায় সেটা প্রায় কাউকেই বুঝতে না দেওয়া অদিতিকে একটা ভিডিওর কথা মনে পড়িয়ে দেয়, যে ভিডিওতে অদিতি দেখেছিল একটা কচ্ছপ তার পাশে প্রায় নিশ্চিন্তে ইতিউতি চড়ে বেড়ানো এক ঝাঁক পায়রার থেকে একটাকে খপ করে মুখে তুলে নিচ্ছে। অবিশ্বাস্য! ভিডিওটা অদিতি অবিশ্বাসী চোখে বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছিল। তারপরেও ভিডিওতে দেখা দৃশ্যটা ভুলতে না পেরে অদিতি এক সময়ে তার বাবাকে বলেছিল ঘটনাটা। ওর বাবা সব শুনে বলেছিলেন, এর থেকেও অবাক করা উদাহরণ আছে।

- এর থেকেও অবাক করা মানে? একটু বুঝিয়ে বল। অদিতি তার বাবাকে চেপে ধরেছিল।

- আরে কচ্ছপের পায়রা খাওয়া তো তবু একটু মাথা ঠান্ডা করে ভাবলে একটা যুক্তিগ্রাহ্য বাতাবরণ পেয়ে যাবে। কিন্তু তুই যদি দেখিস যে, একটা পেলিক্যান খপ করে একটা পায়রা ধরে নিয়ে তার ঠোঁটের নিচে ঝোলা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিচ্ছে, তো কেমন লাগবে?

- এমনটা ঘটেছে নাকি? অদিতি চোখ বড়ো বড়ো করে বলে।

- হ্যাঁ, ঘটেছে। আর কী আশ্চর্য দেখ, এ ক্ষেত্রেও ভিকটিম সেই বেচারা পায়রা।

- এই ভিডিওটা খুঁজে দেখতে হবে। আমি এর আগে অনেকগুলো ভিডিওতে বেবুনকে দেখেছি হরিণের বাচ্চা ধরে মাংস খাচ্ছে, জলহস্তীকে দেখেছি কুমীরের থেকে জেব্রার মাংস কেড়ে নিয়ে খাচ্ছে।

- ঠিকই দেখেছিস। আসলে বেবুন অবস্থায় পড়ে কখনো কখনো তার খাদ্যাভ্যাস বদলায় আর জলহস্তী টাটকা মাংস পেলে কখনো-সখনও একটু গিলে নেয়। তবে তুই আরেকটা কথা শুনলে খুব অবাক হবি।

- কী? কী? বলো।

- অন্তত একবার দেখা গেছে একটা হরিণ খুব ছোটো একটা পাখি মুখে নিয়ে খাবার চেষ্টা করছে।

- কী বলছ তুমি বাবা? অদিতি প্রায় চীৎকার করে ওঠে।

- বুঝতে পারছি তুই খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিস। তবে একটা কথা মনে রাখিস, জন্তু-জানোয়াররা যাই করুক না কেন তার পিছনে কোনো প্ররোচনা কাজ করে না। ওদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, ওদের প্রবৃত্তি ওদের যা করতে বলে, ওরা তাই করে। যা রাত হয়েছে শুয়ে পড়।

সব শুনে সে রাতে অদিতি ভালো করে ঘুমোতে পারেনি। তবে একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল যে, সন্তুর নামকরণটা সে ঠিক লাইনেই রেখেছে। সবচেয়ে বড়ো কথা অদিতি এরপর থেকে সন্তুকে মাঝে-সাঝেই কচ্ছপ বলে ডাকত। এই নামকরণের পিছনের কারণটা জানা ছিল না বলে সন্তু মাঝে মাঝেই নিজের চেহারাটা আয়নায় একবার দেখে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করত যে, দিদি কেন হঠাৎ তাকে কচ্ছপ বলে ডাকছে।

ইদানিং অদিতি একটা নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। মাঝে মাঝেই কলেজ থেকে ফেরার পথে ও লক্ষ্য করেছে চারটে ছেলে, হাতে বই-খাতা ওদের গলির মুখটায় জড় হয়। ছেলেগুলো অদিতিকে কোনোদিন কিছু বলেনি, কিন্তু তবুও অদিতি যে পথ দিয়ে আসে, সেদিকে ওদের হা করে তাকিয়ে থাকা অদিতির ভিতরে একটা অস্থিরতা তৈরি করে। সেই অস্থিরতা থেকেই অদিতি ছেলেগুলোর নাম রাখে “হায়নার পাল” এবং ওদের মোকাবিলা করার জন্য, নিজের মনে জোর আনার জন্য অদিতি এ ক্ষেত্রে নিজের নাম রাখে “সিংহী”। অদিতি জানে, জঙ্গলের নিয়ম অনুযায়ী একটা সিংহী চারটে হায়নাকে অনায়াসে রুখে দিতে পারে। অদিতি এও জানে যে, এ জন্যেই হায়নারা সংখ্যায় নিজেদের বাড়িয়ে নিয়ে সময়-সুযোগ পেলেই সিংহীকে আক্রমণ করে। যেহেতু সংখ্যায় ওরা চার, ছেলেবেলা থেকেই ডানপিটে নাম পাওয়া অদিতির ভয় করে না। তার মনে হয়, ওই চারজনকে সে একাই সামলে নিতে পারবে।

কিন্তু অদিতির এই থিয়োরি হঠাৎ করেই একদিন সমস্যার মুখে পড়ল। সেদিন সে কলেজ থেকে ফেরার সময়ে লক্ষ্য করল ছেলেগুলো আর তার ফেরার পথের দিকে তাকিয়ে নেই। কিন্তু বিপদ বেড়েছে অন্য জায়গায়। সেদিন দেখা গেল ছেলেগুলো সংখ্যায় নিজেদের বাড়িয়ে নিয়ে পাঁচে পৌঁছে গেছে। তার মানে বিপদ। তার মানে অদিতি বুঝতে পারল যে, নিজেকে বাঁচাতে তার কাছে দু’টো অপশন ওপেন আছে। প্রথম অপশন, কলেজ থেকে ফেরার সময়ে আরও একজন “সিংহী”কে তার সঙ্গে নেওয়া। অদিতি ভেবে নিল এটা সম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয় অপশন, জঙ্গলের নিয়ম অনুযায়ী একটা সিংহ কাছাকাছি থাকা মানে হায়নারা তা সে সংখ্যায় যতই হোক, ধারে কাছে আসার চেষ্টা করবে না। তার মানে নিজের সঙ্গে একটা সিংহ রাখতে হবে। অদিতি জানে দ্বিতীয় অপশনটা একেবারেই সম্ভব না। কারণ তার কলেজের সিংহদের প্রায় সবারই একাধিক সিংহী আছে। এবং তারা অনেকেই আসলে এক-একটি ছদ্মবেশী হায়না। এ সময় অদিতির হঠাতই মনে হলো, আরে তার তো জিরাফ কাকু আছে। জিরাফের পিছনের পায়ের লাথি ঠিক জায়গায় পড়লে, হায়না তো কোন ছার, এমনকি পশুরাজও হাড়-গোড় ভেঙে মাটিতে পড়ে থাকবে।

অদিতি ভেবে নিল, “ঠিক হ্যায়, পরদিন থেকে সে জিরাফ কাকুর রিক্সাতেই ফিরবে”। এ সব ভাবতে ভাবতেই অদিতি ততক্ষণে তার কল্পিত “হায়না”দের কাছাকাছি এসে পড়ে। তারপর “ধুত্তোরি” বলে অদিতি “পাঁচটা হায়না”কে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবার সময়ে হঠাৎ একটা বিকট শব্দ। ঠিক তার পরেই অদিতি অনুভব করল ওর ডান হাতের কনুই বরাবর কেউ যেন প্রবল ছ্যাঁকা দিয়েছে। প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে অদিতি বুঝতে পারল ওর খুব কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে রাখা একটা মারুতির টায়ার বার্স্ট করেছে এবং সেই টায়ারের একটা ছোটো গরম টুকরো ওর ডান হাত ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। কিছুটা ভয়, কিছুটা আতঙ্কে অদিতি রাস্তার ধারের ফুটপাথে বসে পড়ল।

অদিতি দেখল, কী আশ্চর্য, ওর ওই অবস্থা দেখে সবার আগে দৌড়ে আসছে তার “পাঁচ হায়না”। এরপর স্থানীয় একটা ওষুধের দোকানে অদিতির প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে ওই পাঁচ জনই অদিতিকে বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে একটুও না দাঁড়িয়ে খুব দ্রুত কোথায় যেন চলে গেল।

পরের দৃশ্যে বাড়ির লোকের নানা প্রশ্ন, আহা, উহু সামলে অদিতি বাড়িতে টায়ার বার্স্টের ঘটনা এবং নিজের হাতে ছ্যাঁকা লাগার ঘটনাটা বলল, কিন্তু তার কল্পিত “হায়না”দের ব্যাপারটা পুরো চেপে গেল।

এই ঘটনাটার পর থেকে খুব স্বাভাবিক কারণেই অদিতির থিসিস পেপারটা পুরো ঘেঁটে গেল। কারণ ওই পাঁচজন সেদিন তার জন্যে যা করেছে, তারপর থেকে তাদের আর হায়না বলা যাচ্ছে না। “তবে ওরা কী?” এটা জানার জন্যেই অদিতি ঠিক করল যে, সে একদিন ওই পাঁচ মূর্তির সঙ্গে কথা বলে দেখবে। সরাসরি। মুখোমুখি।

দিন দুয়েক পর অদিতির সে সুযোগ এসে গেল। কলেজ ফেরত অদিতি দেখল যে, সেদিন “পাঁচ মূর্তি” নয়, “চার মূর্তি” দাঁড়িয়ে আছে গলির মুখে। আজও ওরা অদিতি যে দিক থেকে আসছে, সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। আজ কিন্তু অদিতির একটুও ভয় লাগছিল না। সে সটান গিয়ে জিজ্ঞেস করল, অ্যাই, তোমরা মাঝে মাঝেই এই গলির মুখে দাঁড়িয়ে কী করো বলো তো?

ছেলেগুলো সম্ভবত এমন প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না। তবু ওদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা যে ছেলেটা সে হেসে বলল, আগে তুমি বলো, তোমার হাত এখন কেমন আছে?

- আমার হাত পুরো সেরে গেছে। একটা কালো দাগ অবশ্য এখনও রয়ে গেছে, তবে ডাক্তারবাবু বলেছেন, ওটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাবে। অদিতি একটানা বলে থামল।

- বাহ্‌, গুড নিউজ। ফের সেই লম্বা ছেলেটাই উত্তর দিল।

- সে না হয় হলো। তোমরা কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না। অদিতি ফের মূল স্রোতে ফিরে আসে।

- আরে, আগে আলাপ-পরিচয় হোক, তারপর তো বলব। এবারেও উত্তর দিল লম্বা ছেলেটা।

- ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি অদিতি, ফাইনাল ইয়ার, ইংলিশ অনার্স। তোমাদের নামগুলো বলো এবার।

অদিতির কথা শুনে ফের সেই লম্বা ছেলেটাই বলল, আমি অরিন্দম, আর আমার সঙ্গে এরা আমার সহপাঠী মিঠুন, রাজা আর নিলাদ্রী। আমাদের আরেক বন্ধু এখনই এসে পড়বে, ওর নাম সুদীপ। হ্যাঁ, আমরাও ফাইনাল ইয়ার, ইংলিশ অনার্স।

- তোমরা পড়াশোনা না করে হাতে বই-খাতা নিয়ে প্রায়ই এই মোড়ের মাথায় এসে আড্ডা মারো কেন? অদিতি হঠাৎ যেন অভিভাবক হয়ে যায় ছেলেগুলোর।

- অদিতি, আমরা এখানে আড্ডা মারতে আসি না। আসলে আমরা পাঁচজন আমাদের আরেক বন্ধু সমীর, যে এ পাড়াতেই থাকে তার বাড়িতে পড়তে যাই। মানে এক সঙ্গে একটা গ্রুপ বানিয়ে পড়াশোনা করি আর কী। নিজেরা যে যতটুকু জানি, সেটা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করি। আশা করছি এতে আমাদের রেজাল্টটা ভালো হবে। এবারে অরিন্দম নয়, উত্তরটা এলো মিঠুনের কাছ থেকে।

ওদের উত্তর শুনে অদিতি আক্ষরিক অর্থেই হতভম্ব হয়ে পড়ল। তবু শেষ কাঁটাটা উপড়ে ফেলার জন্য সে প্রশ্ন করল, তোমরা আমি যে পথ দিয়ে ফিরি সেদিকে তাকিয়ে থাক কেন?

অদিতির কথায় সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। তারপর অরিন্দমই বলল, আরে আমাদের “পঞ্চপান্ডব”এর পঞ্চম জন মানে সুদীপের আসতে একটু দেরি হয় কারণ ও একটু দূরে থাকে। আর সুদীপ আসে তুমি যে পথ দিয়ে আসো, সে দিক দিয়েই।

সেই সময়ই নিলাদ্রী বলে উঠল, আরে ওই তো সুদীপ আসছে।

অদিতি টের পেল তার ঘাড়টা নিজে থেকেই নুয়ে পড়ছে। সেই অবস্থাতেই সে তার একদা “হায়না”দের বলল, আজ তবে আসি। তোমাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল।

বাড়ি ফেরার পথে এই প্রথম অদিতি টের পেতে শুরু করল – ওর ভিতরে যেন অন্য একটা অদিতি জেগে উঠছে। অদিতি বুঝতে পারছিল – এই অদিতিকে সে চেনে না। তার মনে হলো একটা লম্বা ছায়া যেন তাকে অনুসরণ করছে। অথচ এমনটা হবার কোনো কারণ সে খুঁজে পায় না। প্রায় অপরিচিত একজনের সঙ্গে দু’-চারটে কথা বলার সঙ্গে এই অনুভূতি বদলের কী সম্পর্ক সেটা ভাবতে গিয়েই অদিতি যেন আরও ঘেঁটে যায়। বাড়ি ফেরার পরেও তার সে অস্থিরতা কমার বদলে যেন বেড়ে গেল। অন্য এক জিরাফের কথা ভেব অদিতি তখন যেন সেই জিরাফকেই অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরে অন্যতর সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে চাওয়া অন্য কেউ।

এতদিন দস্যিপনা আর সরলতার আড়ালে মোড়া অদিতি কি সে জন্যেই সে রাতে তার বাবাকে “হায়না” পর্বের খানিকটা অংশ ধোঁয়াশায় রেখে একটা আবদার গুঁজে দিয়ে বলল, বাবা, আমি কি ওদের সঙ্গে ওই গ্রুপে পড়াশোনা করতে পারি? সপ্তাহে তো মাত্র তিন দিন।

- নিশ্চয়ই পারিস। তবে দেখ ওরা রাজি হয় কিনা। অদিতির বাবা হেসে বলেন।

- হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আমার সঙ্গে ওদের ফের পরশু দেখা হবে। আমি ওদের জিজ্ঞেস করে নেব। অদিতি মনের আনন্দ চেপে রেখেই বলে কথাগুলো।

পাশে বসে অদিতির ঠাকুমা তাঁর ছেলে আর নাতনীর শেষ কথোপকথনগুলো শুনে ফেলেছিলেন। এবং তিনি রেগে গিয়ে ছেলেকে দাবড়ানো শুরু করলেন, নারান, তোর কী আক্কেল বল তো, ওই ধিঙ্গি মেয়েটাকে একা কতগুলো জানা নেই - শোনা নেই ছেলেদের সঙ্গে পড়তে পাঠাবি। তোর কি কোনোদিনই বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না রে?

মায়ের ধমক খেয়ে অদিতির বাবা থমকে যান। অদিতির বুক ঢিপঢিপ করে। তার ভয় হয় ঠাকুমার বকুনিতে যদি বাবা...।

ঠিক এই সময়ে ঘরে অদিতির মা’র প্রবেশ এবং তিনি সব শুনে অদিতির বাবাকে একটা প্রস্তাব দেন, দেখ না ছেলেগুলো আমাদের বাড়ি এসে পড়তে রাজী কিনা। আমাদের পূব দিকের ঘরটা তো খালিই আছে।

প্রস্তাবটা এমনকি অদিতির ঠাকুমারও পছন্দ হয়। তিনি বলেন, হুম্‌ম্‌, এমনটা হলে মন্দ হয় না। অদিতিও আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরে তার গালে একটা বড়ো চুমু এঁকে দেয়। ঠাকুমা এবারেও বিড়বিড় করেন, ধিঙ্গি মেয়ের কাণ্ড দেখ। বুঝি না বাপু, কী দিনকাল পড়ল।

অদিতি আজকাল তাদের বাড়ির পূবদিকের ঘরে সপ্তাহে তিনদিন ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে পড়াশোনা শেয়ার করে। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে অদিতি বুঝতে পারে যে সে মনে মনে সেই লম্বা ছায়ার সান্নিধ্য পাবার জন্যে ভিতরে ভিতরে ছটফট করছে। সে অপেক্ষা করে, গভীরভাবে অপেক্ষা করে এক দীর্ঘকায় তিরন্দাজের – কিন্তু বলা হয় না কিছুই।

এর মধ্যেই এক রাতে সন্তু হঠাৎ অদিতিকে জিজ্ঞেস করে, দিদি, আমাকে তো কচ্ছপ ডাকিস, তো ওই ছেলেগুলোর কী নাম রাখলি তুই?

- ডলফিন্‌। অদিতি এক কথায় উত্তর দেয়।

- ও আমি হলাম কচ্ছপ আর ওরা ডলফিন। কেন? দৃশ্যতই উত্তেজিত সন্তু প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়।

- দেখ, ওরা দলবেঁধে থাকে, পরের উপকার করে...

অদিতির কথা শেষ হবার আগেই সন্তু তার হাসিতে দুষ্টুমি ছড়িয়ে বলে, দাঁড়া আমিও তোর একটা নাম ঠিক করব।

- অ্যাই ভাগ, তুই আবার কী নাম দিবি রে। তুই জানিস কী যে নামকরণ করবি। অদিতি প্রায় তেড়ে ওঠে।

- তবে শুনে রাখ, আমি আর ঠাকুমা দু’জনে মিলে তোর নাম রেখেছি পাগলিবুড়ি...

এবার সন্তুর কথা শেষ হবার আগেই অদিতি ওকে তাড়া করে। সন্তু দৌড়ে তার প্রিয় খাটের তলায় আশ্রয় নেয়।

এর কয়েক দিন পরেই অদিতিদের বাড়িতে দেখা গেল ওর ঠাকুমা চিৎকার করছেন, আমার বয়ম সমেত কুলের আচার কে চুরি করে নিয়ে গেল? আমি আজ এর একটা হেস্তনেস্ত চাই। আজ আসুক নারান...

অদিতির মা তখন ওনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ঠিক আছে মা, আমরা খুঁজে দেখছি। আপনি চিন্তা করবেন না। ঠাকুমা তবু বলেই যাচ্ছেন, আজ নারান আসুক...

ঘরের এক কোণে তখন অন্য দৃশ্য। সন্তু অদিতির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা দিদি, ডলফিনরা কি কুলের আচার খায়?

সন্তুর প্রশ্ন শুনে অদিতি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর খুব আস্তে আস্তে বলল, ডলফিন কুলের আচার খায় কিনা জানি না, তবে জিরাফ নিশ্চয়ই খায়। সে জন্যেই তো...

অবাক সন্তু দেখল তাকে আর প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে তার একদা ডানপিটে দিদি খুব শান্তভাবে হেঁটে যাচ্ছে পূবদিকের ঘর বরাবর।

অলংকরণ –কৌশিক বিশ্বাস ও মেঘ অদিতি