সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১২

অপ্রকাশিত ডাইরি - মলয় রায়চৌধুরী

খামচানো কালপৃষ্ঠা


ফোরটিন গ্রিনস
মলয় রায়চৌধুরী





ইনারবিট মলের ফুড কোর্টে বসে অপেক্ষা করছিলুম এক দম্পতির, যাঁরা তাঁদের বিবাহবার্ষিকীউদযাপন করার জন্য আমাদের কয়েকজনকে মেইনল্যান্ড চায়নায় ডিনার করাবেন । নিমন্ত্রিতরা সবাই এসে পৌঁছোয়নি বলে গ্যাঁজাচ্ছি । একজন অচেনা সুশ্রী যুবতী এগিয়ে এলেন ; ভাবলুম তিনিও নিমন্ত্রিত । কিন্তু তিনি আমার কাছে এসে একটা লাল রঙের বই খুলে বললেন, ইংরেজিতেই বললেন,--- এই ধরণের মলে ঢুকলে সকলেই দেখি মাতৃভাষা ভুলে যায়---"স্যার, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছেআপনি বাঙালি ; কাইন্ডলি বলুন এই গ্রিনগুলোর ইংরেজি কী? এখানের ভেজি-মার্কেটে কেউ বলতে পারল না ; পাওয়াও যাচ্ছে না কোথাও , আমি ক্রফোর্ড মার্কেটে খোঁজ করেছিলাম, ওরা বলল যেইনঅরবিট মলে পাবো ।"

আমি বললুম, এটা তো বাংলা পাঁজি ? পাঁজি কোথায় পেলে ? ইনঅরবিট মলে পাঁজিও পাওয়া যায় নাকি ?

যুবতী বললে, "না স্যার, ঠাকুর ভিলেজের মাছের দোকান থেকে কিনেছি ।"

ঠাকুর ভিলেজ জানি, গ্রাম নয়, উচ্চবিত্তদের এলাকা । নিউ ইয়র্কের গ্রিনিচ ভিলেজ যেমন গ্রাম নয় ।

--মাছের দোকানে পাঁজি ? এই চালুনিও সেখান থেকে কিনেছ ? আজকাল তো আটা চালার ব্যাপারটা উঠেই গেছে ।

--হ্যাঁ স্যার । কয়েকটি মুসলমান ছেলে মেদিনীপুর থেকে এসে মাছের দোকান খুলেছে, তারা বাঙালির প্রয়োজনের সব জিনিস বিক্রি করে ।

মেয়েটিকে দেখে অবাঙালি মনে হচ্ছিল । যদিও সব যুবতীই আজকাল জিনস আর টপ পরে বেরোন । দুহাতে মেহেন্দি আঁকা । এক হাতে দামি ব্যাগ আর একটা চালুনি, অন্য হাতে পাঁজি । দামি পারফিউম লাগিয়ে থাকবে ।

বললুম, তুমি বাঙলা পড়তে পারো না ?

মেয়েটি বসল পাশের চেয়ারে । ব্যাগ আর চালুনি রাখল টেবিলের ওপর । পাঁজিটা মেলে ধরল । বলল, আমি কানপুরের মেয়ে, আমার হাজব্যাণ্ড বাঙালি । চালুনি কিনেছি করওয়া চৌথ অনুষ্ঠানের জন্য, প্লাসটিকের ইউটেনসিলের দোকান থেকে । আর এই রেড বুকে লেখা ফোরটিন গ্রিনস কিনতে বেরিয়েছি আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির জন্য, সেই সকাল থেকে বেরিয়েছি । আমায় কিনতেই হবে, এটাআমার বিয়ের প্রথম বছর; ওনাদের ইমপ্রেস করার জন্য আমি এই ফোরটিন গ্রিনস যোগাড় করবই ।

"পাঁজিতে ফোরটিন গ্রিনস আবার কী জিনিস ?" জানতে চাইলেন আমার একদা এক সহকর্মীর স্ত্রী । সহকর্মীও অবসর নিয়েছেন । পাঁজিটা নিয়ে তিনি পাতা ওলটাতে-ওলটাতে বললেন, কতোকাল পরেবেণিমাধব শীলের পাঁজি দেখছি, বেশ নসটালজিক লাগে ।

সবায়ের নসটালজিক হাত ঘুরে পাঁজিটা আবার আমার কাছে এলো ; আমার চুলে বেশি পাক ধরেছে বলে সম্ভবত ।

মেয়েটি যে পাতাটায় পেজ মার্ক দিয়ে রেখেছে, সেখানে ফোরটিন গ্রিনসগুলো হলুদ রঙে হাইলাইট করা ।

সবাইকে পড়ে শোনালুম ফোরটিন গ্রিনসের নামগুলো, যদি কেউ কোনো হদিশ দিতে পারে । ভুত চতুর্দশীতে খাবার জন্য চোদ্দ শাক : ওলপাতা, কেঁউ, বেতো, সরিষা, কলকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা আর সুষণী ।

শুনে, সকলের মুখের মুচকি হাসিতে যুবতীটি বিব্রত বোধ করলে, আমার স্ত্রী মেয়েটির থুতনি ধরেআদর করে বলল, "এই ফোরটিন গ্রিনসের তিনচারটি ছাড়া মুম্বাই কেন তুমি কলকাতার বাজারেও পাবে না । তোমার শ্বশুর-শ্বাশুড়িও এই গ্রিনসের সব কয়টি দেখেছেন বলে মনে হয় না । আমরা কলকাতায় বহুদিন ছিলুম, চোদ্দশাক বাজারে বিক্রি হয় ভুতচতুর্দশীতে, কলমি, পুঁই, পালঙ, নটে, লাউ, কুমড়োশাক কুচোনো, তারসাথে হয়তো দুচারটে নিম আর সুষণী পাতা । উত্তরপাড়ার বাজারেআমার গোঁড়া শ্বশুরমশায়ও খুঁজে পাননি কখনও । আমি তো এই প্রথম শুনছি শাকের নামগুলো ।আমার শ্বাশুড়িও ভুতচতুর্দশী করতেন, ফোরটিন গ্রিনস দিয়ে নয়, দুতিনরকম শাকের চোদ্দ টুকরো । যা শাক পাও কিনে শ্রেডিং করে নাও, ব্যাস, ইয়োর ইনলজ উইল বি হ্যাপি ।"

আমার সহকর্মীর স্ত্রী, এক সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন, বললেন, রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দেও বোধহয় এই গাছাগাছালির নাম নেই ।

আমি ভাবছিলুম, ভুতচতুর্দশিতে যে এই শাকগুলো খেতে হয় তা-ই তো জানতুম না ।

5 comments:

bidisha sarkar বলেছেন...

খুব ভালো লাগলো।

Preetha Roy Chowdhury বলেছেন...

ভীষণ ভালো লাগলো।

Pritam Bhattacharyya বলেছেন...

মলয় দার কলম তো নয় যেন বুলেট।

sonamann(piyush Banerjee) বলেছেন...

ভীষণ স্মৃতিমেদুর ..মন কেমন করে uthlo

sonamann(piyush Banerjee) বলেছেন...

ভীষণ স্মৃতিমেদুর ..মন কেমন করে uthlo