সোমবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১২

ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি - শ্রীশুভ্র

ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি
শ্রীশুভ্র


শোনা যায় ভারতবর্ষে প্রতি কুড়ি মিনিটে একটি করে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে! এরসাথে শ্লীলতাহানী যৌনহয়রানী যোগ করলে পরিসংখ্যানটি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে! শারীরীক সক্ষমতায় মেয়েরা দূর্বল বলেই যে এঘটনা ঘটে তা নয়! পুরুষের মনস্তত্বে নারী মানেই ভোগ্যপণ্য স্বরূপ! মূল কারণটা নিহিত আছে এখানে! আর এই মানসিকতা থেকে প্রায় কেউই মুক্ত নন! তারা সবাই যে ধর্ষণে উৎসাহ পাচ্ছেন সর্বদা, তা নয়! কিন্তু সমাজের সেকল শ্রেণীতেই নারী মানেই পুরুষের ইচ্ছাধীন, পুরুষের কামনা বাসনা মেটানোর নরম ক্ষেত্র! পারিবারিক সূত্রেই এই বোধ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে বেড়ে ওঠে একটি বালক! ফলে সামাজ বাস্তবতার প্রতিফলনে এই জমিতেই জমে ওঠে তার মূল্যবোধ!

ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের মধ্যেই নারীকে পুরুষের ভোগ্য করে রাখার প্রচলন চলে আসছে আবহমান কাল ধরেই! ফলে যারা বলেন পশ্চিমী খোলা দুনিয়ার খোলামেলা পোশাকের সংস্কৃতি এই সব অপসংস্কৃতির মূলে তারা সঠিক বলেন না! যে দেশে একদিকে দেবদাসী প্রথা আর একদিকে একটি পুরুষের বহু বিবাহ সমাজ স্বীকৃত ব্যবস্থা ছিল বহু শতাব্দীব্যাপী এবং আজও কোনো কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ে পুরুষের বহুবিবাহ প্রথা আজও প্রচলিত; সেখানে নারীর উপর পুরুষের ক্ষমতায়ন সতঃসিদ্ধ হবেই! ফলে ভালো মন্দ সকল পুরুষের মধ্যেই নারীকে ভোগ করার মানসিকতাতেই পুরুষার্থ বোধটি ষোলো আনা কাজ করে! এই সামাজিক পটভূমিতেই পারিবারিক সংস্কৃতির বিন্যাসে বেড়ে উঠতে থাকে ছেলেরা!

ভারতবর্ষের অধিকাংশ জাতিতেই অধিকাংশ সম্প্রদায়েই পুরুষতন্ত্রের ঘেরাটোপে, নারী মানেই পুরুষের পোষ্য! পুরুষের ইচ্ছাধীনেই নারীর স্বাধীনতার পরিসর! এখানেই পুরুষের মানসিকতায় নারীর প্রতি কোনো সম্মানবোধ গড়ে ওঠার পরিসর থাকে না! ফলত ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক সমাজবাস্তবতার উত্তরাধিকার সূত্রেই নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান কোনোকালেই দেওয়া হয় নি! বর্তমানে স্বাধীন ভারতবর্ষের সমাজে নারীর অবস্থানের মৌলিক কোনো পরিবর্তন আজও সূচীত হয়নি! হয়নি বলেই বধু নির্যাতন বধু হত্যার এত বাড়বাড়ন্ত! যে সমাজে নিজের স্বামীর কাছে, শ্বশুর বাড়িতেই নারীর জীবনের নিশ্চয়তা নেই, সেখানে পথে ঘাটে তার সুরক্ষার নিশ্চয়তা কে দেবে!

ফলে ভারতবর্ষে ধর্ষণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়! এই রকম সামাজিক প্রেক্ষিতেই সুপ্ত থাকে এই জঘন্যতম অপরাধের বীজ! উপযুক্ত জলবায়ু পেলেই তা অঙ্কুরিত হয়ে ওঠে! পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজে শিশুদের শৈশব থেকেই প্রায় ছেলে মেয়েদের মধ্যে স্বাভাবিক মেলামেশার ক্ষেত্রগুলিকেই যথাসম্ভব সঙ্কুচিত করে রাখা হয়! আর এই পর্যায়ে সবচেয়ে বড় অভিশাপ হয়ে দেখা দেয় ছেলেদের মেয়েদের আলাদা আলাদা স্কুল কলেজগুলি! জ্ঞান উন্মেষের সূচনা লগ্ন থেকেই সম্পূর্ণ এই অপ্রাকৃতিক অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগে শিশুমন সুস্থ হয়ে বিকশিত হবার সুযোগ পায় না! গড়ে ওঠে অজানা কৌতুহলের হাত ধরে একটা অসম্ভ্রমবোধের মানসিকতা! স্বাভাবিক মেলামেশার অভাবে শ্রদ্ধাবোধ জাগে না!

সামাজিক উৎসবে পার্বণেও এই লিঙ্গভেদের দূরত্বের কারণে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা সহজ সচ্ছন্দ হয় না! ফলে একটা অজানা আকর্ষণ ক্রিয়াশীল থাকে! যে আকর্ষণটা মূলতই বয়সসন্ধি জনিত শারীরীক উত্তেজনা প্রসূত! যেখানে মানসিক সৌকর্য গড়ে ওঠার পরিসর থাকে না সমাজ বাস্তবতার পরিকাঠামোতেই! এইযে মানসিক সৌকর্য, এরই পরিশিলীত নিরন্তর অনুশীলনে গড়ে ওঠে পরস্পরের সম্বন্ধে শ্রদ্ধাজনিত সম্ভ্রমবোধের! যা থেকে সৃষ্টি হয় দরদের! গড়ে ওঠে দায়িত্ববোধ! সামাজিক প্রেক্ষিতে সুস্থ নৈতিকতার বাস্তবায়নে যা সবচেয়ে জরুরী! কিন্তু দুঃখের বিষয় ভারতবর্ষের

সমাজের সকল স্তরেই এই জরুরী বিষয়টাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত! এই অবহেলার পথরেখা ধরেই সমাজে দানা বাঁধে অসুখ!

এই যে সামাজিক অসুখ এরই অন্যতম ভয়ংকর প্রকাশ এই ধর্ষণ! মানুষের সমাজে এর থেকে জঘন্য অপরাধ আর হয় না! অথচ এই অপরাধের ফলে সমাজে প্রায় একঘোরে হয়ে পড়ে ধর্ষিতা নারী! সমাজ তাকে আর আশ্রয় দেয় না সসস্মানে! এই যে সমাজের ভূমিকা, যেখানে সে ভিকটিমের পক্ষে ততটা সহানুভূতিশীল নয়; এই ভূমিকাই অপরাধীদের উৎসাহ দেয় অপরাধে! একটি সমাজ যখন তার নৈতিক দায়বদ্ধতার দায় এড়িয়ে উদাসীন থাকে, বুঝতে হবে সেই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পচন! সেই পচন থেকেই সৃষ্টি হয় দূর্নীতির! জন্ম নেয় অপরাধী! ফলে ধর্ষণের ঘটনার দায় সমাজের ওপরও বর্তায়! আমরা স্বীকার করি আর না করি! আর সেই সুযোগে দূর্নীতির পালে হাওয়া লাগিয়ে অবাধে বিচরণ করে বেড়ায় অপরাধীরা!

ভারতবর্ষের সমাজে ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বস্তরে যে অনৈতিকতা এবং আদর্শহীনতার বাড়বাড়ন্ত তারই প্রতিফলন; একদিকে গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক দলতন্ত্রের ক্ষমতা নিয়ে ব্যাভিচার যার ফলে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, আর অন্যদিকে অপরাধীদের অবাধ স্বাধীনতা ও দুঃসাহস! ধর্ষণের এত বাড়বাড়ন্ত এই সমস্ত কারণেই আজ এতখানি সমাজবাস্তব! ফলে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে কোনো সামাজিক আন্দোলনের অভিমুখকেই এই সমগ্র বাস্তবতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে! কোনো একটি ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত নির্দিষ্ট অপরাধীর চরমতম শাস্তিবিধান নিশ্চিত করতে পারলেই কিন্তু আন্দোলন সফল হবে না! ধর্ষণমুক্ত সমাজ দূর্নীতি মুক্ত প্রশাসন ছাড়া সম্ভব নয়!

আবার দূর্নীতিমুক্ত প্রশাসন নির্ভর করে সুস্থ সবল সুন্দর দায়িত্বশীল সমাজের উপর! যে সমাজ গড়ে ওঠে সুশিক্ষিত সুনাগরিকের ভিতের উপর! ফলে দেখা যাচ্ছে ধর্ষণমুক্ত সমাজ গড়ার চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে সুশিক্ষিত সুনাগরিকের সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে! তাই এই সামাজিক আন্দোলনের মূল অভিমুখ থাকা দরকার সার্বিক সুশিক্ষার প্রসারের দিকে! যে শিক্ষার ভিত্তি হবে সমস্ত রকম লিঙ্গ বৈষম্যের উর্ধে! যে শিক্ষার সূত্রপাত হতে হবে একেবারে প্রতিটি সংসারের নিজস্ব চৌহদ্দী থেকে! সমাজে সম্প্রদায়ে স্কুল কলেজে কর্মক্ষেত্রে যে শিক্ষাকে করতে হবে সর্বত্রগামী! সামাজিক অসুখকে সমাজের অন্তর থেকে না সারালে শুধুমাত্র ওপর থেকে কটা আইন প্রনয়ণ করে হবে না!

যে কোনো আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা রক্ষা করার প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের! যে দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রশাসন যত বেশি নিরপেক্ষ থাকতে পারে, সে তত বেশি দক্ষ হয়! এই নিরপেক্ষতা আর দক্ষতার বিষয়ে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসনের সুখ্যাতি কেউ করবে না! কিন্তু এদেশের প্রশাসনের প্রতিটি অলিন্দে যে পরিমাণ দূর্নীতির চর্চা হয়, তাতে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে সাধারণ মানুষের অবস্থা জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ নিয়ে বেঁচে থাকার মতো! ফলে এই রকম সামগ্রিক পরিস্থিতিতে নারীর সুরক্ষার বিষয়ে নিশ্চিত নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে কে? আইন আদলতও তো দূর্নীতির উর্দ্ধে নয়! পুলিশ সরকারী দলের আজ্ঞাবহ! স্বভাবতই এই অবস্থায় রক্ষকও ভক্ষক হয়ে উঠবে সেটাই খুব স্বাভাবিক! এবং অপরাধীরাও ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক মঞ্চকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে সক্ষম হবে! ভারতবর্ষের সমাজে এটাই বাস্তব চিত্র! এই প্রেক্ষিতেই মোকাবিলা করতে হবে ধর্ষণের মতো নারকীয় অপরাধের সাথে! ফলে কাজটি যে চুড়ান্ত কঠিন তা বলাইবাহূল্য! শুধুই আইন আদালতের উপর ভরসা করে থাকলে কপাল চাপড়াতে হবে! কারণ সর্ষের মধ্যেই যে অনেক সময়ে ভুতের উপদ্রপ! আর এইখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সদর্থক সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয় উপযোগিতার! সমাজের সর্বত্র দূর্নীতির পচন ধরলেও এখনও বহু মানুষ সুনীতির পক্ষে আদর্শের পক্ষে জীবন সংগ্রাম করে চলেছেন! প্রয়োজন শুধু সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠার!

সামাজিক আন্দোলনের স্বার্থে চিন্তাশীল সুনাগরিকদের প্রবলভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলতে হবে সামগ্রিক প্রতিরোধ! এই প্রতিরোধী গণ আন্দোলনের অভিমুখ একদিকে যেমন সমাজের ভিতর থেকে শুদ্ধিকরণের প্রস্তুতিতে ক্রিয়াশীল থাকবে; সেই সঙ্গে একই সাথে সরকারী প্রশাসনের দায়বদ্ধতা সুদক্ষতা এবং বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির উপর নিরন্তর গণতান্ত্রিক চাপ বজায় রাখতে স্বচেষ্ট থাকবে! প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও প্রয়োজনে অকার্যকর আইনের সংশোধন করে সংঘটিত অপরাধগুলির দ্রত সুবিচার সম্পন্ন করার বিষয়ে সংঘবদ্ধ সামাজিক আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম! বিভিন্ন গণ সংগঠন গুলির এই ব্যাপারে সামনে এগিয়ে আসা উচিৎ!

সংগঠিত প্রতিরোধী এই সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্বের ভার নিতে হবে নারীদেরকেই! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ঘরে বাইরে নারী আজও শেষ পর্য্যন্ত পুরুষের উপরেই নির্ভরতার জীয়ন কাঠিটি ন্যাস্ত রাখে! আর তখনই মুখ থুবড়ে পড়ে সমস্ত প্রয়াসের মূল কার্যকারিতা! তাই নারী আন্দোলনের প্রবক্তাদের নিজেদের এই পুরুষ নির্ভরতা কাটিয়ে উঠে আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে হবে দ্রুত! নেতৃত্ব দিতে হবে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সুনাগরিকদের আত্মবিশ্বাসী প্রত্যয়ে! সামাজিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার সূত্রেই ধর্ষণ মুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব! এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার হাত ধরেই সম্ভব দেশের সামগ্রিক উন্নতির বাস্তবায়ন! সামাজিক সুস্থতা আজ তাই নারী আন্দোলনের উপরই নির্ভরশীল!