সাহিত্যে পলিট্রিক্স
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য
ঠাকুমার ঝুলি পড়েছেন ? সেই যে রাজপুত্তুর, কোটালপুত্র আর সওদাগরপুত্র ? এই তিনটে চরিত্র নিয়ে প্রচুর গপ্পো আছে !আর আছে জঙ্গল, বৃষ্টি, রাজকুমারী, ব্যঙ্গমা- বেঙ্গমী, রাক্ষস- খোক্কস, সব মিলিয়ে জমজমাট, মারকাটারি ব্যাপার ।
পরে, আমার এক সবজান্তা- হরফন মৌলা বন্ধু বুঝিয়েছিল, এই রাজপুত্র হচ্ছে প্রশাসক । সওদাগরপুত্র হচ্ছে শিল্প আর ব্যবসার প্রতীক আর কোটালপুত্র হচ্ছে প্রশাসন । রাক্ষস- খোক্কস হচ্ছে বদ লোকজন ।
তাহলে কি দাঁড়াল ? বাচ্চাদের গল্পেও রাজনীতির প্রথম পাঠ । এটা পলিটিকস থুড়ি পলিট্রিক্স কিনা বলুন তো ! আমি ও সব বুঝি না বাপু !
চাঁদ সওদাগরের গল্পে আসি ! প্রশাসকের মনোরঞ্জন না করতে পারলে তোমার সাড়ে সর্বনাশ । মূল ব্যাপারটা তাই ! ঠিক কিনা ? ধম্মোও হল , আর বুঝিয়ে দেওয়া হলো- ক্ষমতায় যে থাকবে, তাকে তুষ্ট করতেই হবে ! মানে, ফাঁকতালে এই সব বক্তব্য তুলে ধরা ! ভাগ্গিস তখন নেট ছিল না ! থাকলে চাঁদু বাবু কার্টুন আঁকতো আর সাপেরা এসে ছোবল দিত ।
বলছি কি, এটাও তো রাজনীতি ! আর মনসামঙ্গল সাহিত্য । দুয়ে, দুয়ে দুধ বা চার না হয়ে হয়ে গেল, পলিট্রিক্স !
তারপরে, ধরুন গিয়ে মহাভারত বা রামায়ণ ! যে বিরুদ্ধে যাবে, তাকে খুন করে প্রতিবাদ যে করা যাবে না, সেটার যথার্থতা প্রমাণ করে দিল সবাই ! খুন, হয়ে দাঁড়াল রাষ্ট্রর ইনসিগনিয়া। মহাভারত আর রামায়ণ আবার মহাকাব্যও বটে ! সাহিত্যের চরম মাপকাঠি ।
তা বাপু, এই সব ব্যাপার আমাদের বর্তমান সাহিত্যে আসবে না, তো আসবে কোথায় ?
এসব দেখে শুনেই তো ওয়াজেদ আলি সাহেব বলেছিলেন- সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলিতেছে।
প্রথমেই বঙ্কিম চন্দ্রে যাই !
“১১৭৪ সালে ফসল ভাল হয় নাই, সুতরাং ১১৭৫ সালে চাল কিছু মহার্ঘ হইল-- লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়া লইল। রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝাইয়া দিয়া দরিদ্রেরা এক সন্ধ্যা আহার করিল। ১১৭৫ সালে বর্ষাকালে বেশ বৃষ্টি হইল। লোকে ভাবিল, দেবতা বুঝি কৃপা করিলেন। আনন্দে আবার রাখাল মাঠে গান গায়িল, কৃষকপত্নী আবার রূপার পৈচাঁর জন্য স্বামীর কাছে দৌরাত্ম্য আরম্ভ করিল। অকস্মাৎ আশ্বিন মাসে দেবতা বিমুখ হইলেন। আশ্বিনে কার্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না, মাঠে ধান্যসকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দুই এক কাহন ফলিয়াছিল, রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহীর জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল, তার পর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল, তার পর দুই সন্ধ্যা উপবাস আরম্ভ করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে তাহা কুলাইল না। কিন্তু মহম্মদ রেজা খাঁ রাজস্ব আদায়ের কর্তা, মনে করিল, আমি এই সময়ে সরফরাজ হইব। একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয়া দিল। বাঙ্গালায় বড় কান্নার কোলাহল পড়িয়া গেল।”
আনন্দমঠ উপন্যাসে, এই ভাবেই শুরু হয় অত্যাচারীদের বর্ণণা । পুরো উপন্যাসেই পাই সেই সময়ের এক নিঁখুত ছবি । সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে ইংরেজ রাজপুরুষদের কদর্য্য রাজনীতির নিপুণ প্রতিফলন ।
শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রবি দাদুর সেই বিখ্যাত সাহিত্য- তোতা কাহিনী । আরম্ভ কি ভাবে হচ্ছে দেখা যাক !
“পাখিটা মরিল। কোন্কালে যে কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই। নিন্দুক লক্ষ্ণীছাড়া রটাইল, 'পাখি মরিয়াছে।'
ভাগিনাকে ডাকিয়া রাজা বলিলেন, 'ভাগিনা, এ কী কথা শুনি।'
ভাগিনা বলিল, 'মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।'
রাজা শুধাইলেন, 'ও কি আর লাফায়।'
ভাগিনা বলিল, 'আরে রাম!'
'আর কি ওড়ে।'
'না।'
'আর কি গান গায়।'
'না।'
'দানা না পাইলে আর কি চেঁচায়।'
'না।'
রাজা বলিলেন, 'একবার পাখিটাকে আনো তো, দেখি।'
পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, পাইক আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্খস্ গজ্গজ্ করিতে লাগিল।
বাহিরে নববসন্তের দক্ষিণহাওয়ায় কিশলয়গুলি দীর্ঘনিশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ আকুল করিয়া দিল।”
শিক্ষাব্যবস্থার ওপর রাজনীতির কটাক্ষ এই সাহিত্যের উপজীব্য ।
এবারে আসা যাক, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনাবলীর প্রারম্ভিক সূচনায় :-
“শরৎচন্দ্রের সমস্ত উপন্যাস ও ছোট গল্পগুলিকে প্রধানত পারিবারিক, সামাজিক ও মনস্তত্ত্বমূলক – এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করলেও তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসের কেন্দ্রভূমিতে বিরাজমান রয়েছে বাঙালীর সমাজ সম্পর্কে এক বিরাট জিজ্ঞাসা এবং বাঙালির মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ জীবনের রূপায়ণ। সমাজের বাস্তব অবস্থা নরনারীর জীবনভঙ্গিমা ও জীবনবোধকে নিয়ন্ত্রিত করে তাদের মানসলোকে যে সূক্ষ্ম জটিল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, শরৎসাহিত্যে আমরা পাই তারই সার্থক রূপায়ণ। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের দুঃখবেদনার এতবড় কাব্যকার ইতিপূর্বে দেখিনি আমারা। মূঢ়তায় আচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার নিষ্ঠুর শাসনে লাঞ্ছিত নরনারীর অশ্রুসিক্ত জীবনকথা অবলম্বন করে মানবদরদী শরৎচন্দ্র গদ্যবাহিত যে কতকগুলি উৎকৃষ্ট ট্রাজেডি রচনা করেছেন তাতে বাঙলা সমাজের অতিবিশ্বস্ত ও বহুচিত্রিত এক আলেখ্য উন্মোচিত হয়েছে আমাদের সামনে।”
বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের দুঃখবেদনাকে উপজীব্য করেই তো রাজনীতির সূত্রপাত । এখানে, রাজনীতিকে উপেক্ষা করি কি করে ?
পথের দাবী উপন্যাসে, সেকালের ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা সেই রাজনীতিরই প্রতিফলন ।
চলে আসি, সৈয়দ মুজতবা আলিতে । কাবুল থেকে আরম্ভ করে হিটলারি জমানার জার্মানীর রাজনীতি নিয়ে সে সরস বর্ণণা তিনি দিয়েছেন, তাতে সমকালীন রাজনীতির স্বচ্ছ ধারণা পাঠকের হতে বাধ্য ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন পূর্ব পশ্চিম । বাংলা ভাগের ফলে যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল জনগণের, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণণা প্রতি ছত্র । রাজনীতি আমরা সেখানে বুঝতেই পারি ।
সত্তোর একাত্তরের উত্তাল রাজনীতি নিয়ে লেখা হয়েছে, প্রচুর গল্প – উপন্যাস । এই প্রজন্ম বুঝতে পারবে, তখন কি রকমের রাজনীতি বজায় ছিল । কত আত্মত্যাগ যে এই সব রাজনীতির পেছনে ছিল, সেটা সে সব গল্প – উপন্যাস না পড়লে আমরা বুঝতেই পারবো না।
ইদানীং যে সব গল্প – উপন্যাস লেখা হচ্ছে তাতে রয়েছে নব প্রজন্মের উত্থান পতনের ছবি। সে সবেও রয়েছে সমকালীন রাজনীতি ।
শেষে বলি, জীবনে সবকিছুর প্রভাব সাহিত্যে প্রতিফলিত হবেই । রাজনীতি তার বাইরে নয়। প্রভাব যদি নাই পড়ে, তবে পরবর্তী প্রজন্ম বুঝবেই না ! হতে পারে, রাজনীতি পাঠকের কাছে বিস্বাদ. তাই বলে তো সাহিত্য তার ধর্ম বিসর্জন দিতে পারে না !
ঠাকুমার ঝুলি পড়েছেন ? সেই যে রাজপুত্তুর, কোটালপুত্র আর সওদাগরপুত্র ? এই তিনটে চরিত্র নিয়ে প্রচুর গপ্পো আছে !আর আছে জঙ্গল, বৃষ্টি, রাজকুমারী, ব্যঙ্গমা- বেঙ্গমী, রাক্ষস- খোক্কস, সব মিলিয়ে জমজমাট, মারকাটারি ব্যাপার ।
পরে, আমার এক সবজান্তা- হরফন মৌলা বন্ধু বুঝিয়েছিল, এই রাজপুত্র হচ্ছে প্রশাসক । সওদাগরপুত্র হচ্ছে শিল্প আর ব্যবসার প্রতীক আর কোটালপুত্র হচ্ছে প্রশাসন । রাক্ষস- খোক্কস হচ্ছে বদ লোকজন ।
তাহলে কি দাঁড়াল ? বাচ্চাদের গল্পেও রাজনীতির প্রথম পাঠ । এটা পলিটিকস থুড়ি পলিট্রিক্স কিনা বলুন তো ! আমি ও সব বুঝি না বাপু !
চাঁদ সওদাগরের গল্পে আসি ! প্রশাসকের মনোরঞ্জন না করতে পারলে তোমার সাড়ে সর্বনাশ । মূল ব্যাপারটা তাই ! ঠিক কিনা ? ধম্মোও হল , আর বুঝিয়ে দেওয়া হলো- ক্ষমতায় যে থাকবে, তাকে তুষ্ট করতেই হবে ! মানে, ফাঁকতালে এই সব বক্তব্য তুলে ধরা ! ভাগ্গিস তখন নেট ছিল না ! থাকলে চাঁদু বাবু কার্টুন আঁকতো আর সাপেরা এসে ছোবল দিত ।
বলছি কি, এটাও তো রাজনীতি ! আর মনসামঙ্গল সাহিত্য । দুয়ে, দুয়ে দুধ বা চার না হয়ে হয়ে গেল, পলিট্রিক্স !
তারপরে, ধরুন গিয়ে মহাভারত বা রামায়ণ ! যে বিরুদ্ধে যাবে, তাকে খুন করে প্রতিবাদ যে করা যাবে না, সেটার যথার্থতা প্রমাণ করে দিল সবাই ! খুন, হয়ে দাঁড়াল রাষ্ট্রর ইনসিগনিয়া। মহাভারত আর রামায়ণ আবার মহাকাব্যও বটে ! সাহিত্যের চরম মাপকাঠি ।
তা বাপু, এই সব ব্যাপার আমাদের বর্তমান সাহিত্যে আসবে না, তো আসবে কোথায় ?
এসব দেখে শুনেই তো ওয়াজেদ আলি সাহেব বলেছিলেন- সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলিতেছে।
প্রথমেই বঙ্কিম চন্দ্রে যাই !
“১১৭৪ সালে ফসল ভাল হয় নাই, সুতরাং ১১৭৫ সালে চাল কিছু মহার্ঘ হইল-- লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়া লইল। রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝাইয়া দিয়া দরিদ্রেরা এক সন্ধ্যা আহার করিল। ১১৭৫ সালে বর্ষাকালে বেশ বৃষ্টি হইল। লোকে ভাবিল, দেবতা বুঝি কৃপা করিলেন। আনন্দে আবার রাখাল মাঠে গান গায়িল, কৃষকপত্নী আবার রূপার পৈচাঁর জন্য স্বামীর কাছে দৌরাত্ম্য আরম্ভ করিল। অকস্মাৎ আশ্বিন মাসে দেবতা বিমুখ হইলেন। আশ্বিনে কার্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না, মাঠে ধান্যসকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দুই এক কাহন ফলিয়াছিল, রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহীর জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল, তার পর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল, তার পর দুই সন্ধ্যা উপবাস আরম্ভ করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে তাহা কুলাইল না। কিন্তু মহম্মদ রেজা খাঁ রাজস্ব আদায়ের কর্তা, মনে করিল, আমি এই সময়ে সরফরাজ হইব। একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয়া দিল। বাঙ্গালায় বড় কান্নার কোলাহল পড়িয়া গেল।”
আনন্দমঠ উপন্যাসে, এই ভাবেই শুরু হয় অত্যাচারীদের বর্ণণা । পুরো উপন্যাসেই পাই সেই সময়ের এক নিঁখুত ছবি । সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে ইংরেজ রাজপুরুষদের কদর্য্য রাজনীতির নিপুণ প্রতিফলন ।
শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রবি দাদুর সেই বিখ্যাত সাহিত্য- তোতা কাহিনী । আরম্ভ কি ভাবে হচ্ছে দেখা যাক !
“পাখিটা মরিল। কোন্কালে যে কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই। নিন্দুক লক্ষ্ণীছাড়া রটাইল, 'পাখি মরিয়াছে।'
ভাগিনাকে ডাকিয়া রাজা বলিলেন, 'ভাগিনা, এ কী কথা শুনি।'
ভাগিনা বলিল, 'মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।'
রাজা শুধাইলেন, 'ও কি আর লাফায়।'
ভাগিনা বলিল, 'আরে রাম!'
'আর কি ওড়ে।'
'না।'
'আর কি গান গায়।'
'না।'
'দানা না পাইলে আর কি চেঁচায়।'
'না।'
রাজা বলিলেন, 'একবার পাখিটাকে আনো তো, দেখি।'
পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, পাইক আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্খস্ গজ্গজ্ করিতে লাগিল।
বাহিরে নববসন্তের দক্ষিণহাওয়ায় কিশলয়গুলি দীর্ঘনিশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ আকুল করিয়া দিল।”
শিক্ষাব্যবস্থার ওপর রাজনীতির কটাক্ষ এই সাহিত্যের উপজীব্য ।
এবারে আসা যাক, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনাবলীর প্রারম্ভিক সূচনায় :-
“শরৎচন্দ্রের সমস্ত উপন্যাস ও ছোট গল্পগুলিকে প্রধানত পারিবারিক, সামাজিক ও মনস্তত্ত্বমূলক – এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করলেও তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসের কেন্দ্রভূমিতে বিরাজমান রয়েছে বাঙালীর সমাজ সম্পর্কে এক বিরাট জিজ্ঞাসা এবং বাঙালির মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ জীবনের রূপায়ণ। সমাজের বাস্তব অবস্থা নরনারীর জীবনভঙ্গিমা ও জীবনবোধকে নিয়ন্ত্রিত করে তাদের মানসলোকে যে সূক্ষ্ম জটিল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, শরৎসাহিত্যে আমরা পাই তারই সার্থক রূপায়ণ। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের দুঃখবেদনার এতবড় কাব্যকার ইতিপূর্বে দেখিনি আমারা। মূঢ়তায় আচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার নিষ্ঠুর শাসনে লাঞ্ছিত নরনারীর অশ্রুসিক্ত জীবনকথা অবলম্বন করে মানবদরদী শরৎচন্দ্র গদ্যবাহিত যে কতকগুলি উৎকৃষ্ট ট্রাজেডি রচনা করেছেন তাতে বাঙলা সমাজের অতিবিশ্বস্ত ও বহুচিত্রিত এক আলেখ্য উন্মোচিত হয়েছে আমাদের সামনে।”
বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের দুঃখবেদনাকে উপজীব্য করেই তো রাজনীতির সূত্রপাত । এখানে, রাজনীতিকে উপেক্ষা করি কি করে ?
পথের দাবী উপন্যাসে, সেকালের ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা সেই রাজনীতিরই প্রতিফলন ।
চলে আসি, সৈয়দ মুজতবা আলিতে । কাবুল থেকে আরম্ভ করে হিটলারি জমানার জার্মানীর রাজনীতি নিয়ে সে সরস বর্ণণা তিনি দিয়েছেন, তাতে সমকালীন রাজনীতির স্বচ্ছ ধারণা পাঠকের হতে বাধ্য ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন পূর্ব পশ্চিম । বাংলা ভাগের ফলে যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল জনগণের, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণণা প্রতি ছত্র । রাজনীতি আমরা সেখানে বুঝতেই পারি ।
সত্তোর একাত্তরের উত্তাল রাজনীতি নিয়ে লেখা হয়েছে, প্রচুর গল্প – উপন্যাস । এই প্রজন্ম বুঝতে পারবে, তখন কি রকমের রাজনীতি বজায় ছিল । কত আত্মত্যাগ যে এই সব রাজনীতির পেছনে ছিল, সেটা সে সব গল্প – উপন্যাস না পড়লে আমরা বুঝতেই পারবো না।
ইদানীং যে সব গল্প – উপন্যাস লেখা হচ্ছে তাতে রয়েছে নব প্রজন্মের উত্থান পতনের ছবি। সে সবেও রয়েছে সমকালীন রাজনীতি ।
শেষে বলি, জীবনে সবকিছুর প্রভাব সাহিত্যে প্রতিফলিত হবেই । রাজনীতি তার বাইরে নয়। প্রভাব যদি নাই পড়ে, তবে পরবর্তী প্রজন্ম বুঝবেই না ! হতে পারে, রাজনীতি পাঠকের কাছে বিস্বাদ. তাই বলে তো সাহিত্য তার ধর্ম বিসর্জন দিতে পারে না !
7 comments:
ভাল লাগল ঘনাদা, সহজ সরল সুন্দর উপস্থাপনা
খুব খুব মনোগ্রাহী, আমি সমরেশ'দার "কালপুরুষ" উপন্যাসটার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। অতিবাম রাজনীতি আর তার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য ঘটনাবলীর সে এক অনন্য লেখ ।
সুন্দর ব্যাখ্যা।
দারুন লাগলো ঘনাদা !
ঘনাদা বিজ্ঞ বিচক্ষন ততোধিক জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যক্তি। অব্যক্ত বিশ্লেষণ আশ্লেষে তিনি অনেকটা প্রেক্ষাপটে সরল পাটিগণিতে সাহিত্যে সুপ্ত 'রাজনীতি' কে আতস কাঁচে ফেলে স্বচ্ছ স্ফটিক আলোয় মেলে ধরেছেন। এই অধম নিতান্তই দুচাট্টি শব্দের নাড়াচাড়ার দূর্বল অভ্যাসি। সাহিত্যে কোন বিষয় ব্রাত্য নয়, যথার্থ লিখেছেন ঘনাদা প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধতার কথা। সংসারের কূটকাচালি কি ধূর্ত রাজনীতির পৃষ্টপোষক নয়? অতএব, ব্যাখ্যার জেল্লা কেল্লামাত করেছে অবশ্যই। ধন্যবাদ।
khub bhalo lekha....kintu jeno 'shesh hoye hoilona shesh'. Aro kichhur dabi roye gelo.
Khub e uchu maner lekha. Kobita ebang prabandha khub e bhalo legechhe.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন