বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

শিল্পকলায় নারী চেতনা

শিল্পকলায় নারী চেতনা
অমিত বিশ্বাস


কোনো বুদ্ধিজীবীর আগে 'নারী' শব্দটি লিখলেই সাংস্কৃতিক মহলো থেকে নানা উক্তি ভেসে আসে। কেউ বলেন ঠিকই তো ওরা এতোদিন পর্দানসীন ছিলেন এখনই বাহিরে আসার সময়। কেউ বলেন ধুৎ এটা আবার কি নতুন হ্যাংলামি!!! কেউ মনে করেন এটা অযোগ্যকে হাইলাইট করার উপায়। কেউ কেউ মনে করেন ওরা 'সংরক্ষিত কোটা'র জীব মাত্র, তাই তাদেরও কোটার মধ্যে থেকে কিছু বলা বা করা উচিত। ওদের কিছু করবার নেই বলেও কেউ কেউ নাক সিঁটকান। আবার অনেকেই মনে করেন নারী পুরুষ সমান সমান কোনো লিঙ্গভেদ নেই, তারা সমানভাবে সমাজের সব কাজে অংশীদার। ব্যক্তিগতভাবে আমি এগুলির সঙ্গে সহমতো পোষণ করি না। আমি মনে করি নারীদের বুঝতে গেলে তাদের অন্তর্জগতটি আমাদের জানা দরকার, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা উচিত। পুরুষের সঙ্গে তুলনা করে তাদের সঠিক মূল্যায়ন করা অনুচিত। আমার যোগ্যতা যেহেতু শিল্পকলা সম্পর্কীত, তাই আমি কেবলমাত্র শিল্পকলায় 'নারী চেতনা' সম্পর্কে আমার অনুভূতির কথা আলোচনা করবো। এই আলোচনায় যদি আমি কাউকে আঘাত করে থাকি, তাহলে সেটাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অনুরোধ করবো।



শিল্পকলায় এখনো পর্যন্ত খুব বড়োমাপের 'নারী' প্রতিভার আবির্ভার হয়নি (?) বিশ্বের অধিকাংশ শিল্পসমালোচক এব্যাপারে একমতো। কেন হয়নি প্রশ্ন করলে তারা বলেন 'অভিঘাত' সৃষ্টি করতে পারেননি নারীশিল্পীরা। এদিক ওদিক থেকে কয়েকটি নাম ভেসে আসে মীরা মুখোপাধ্যায়, অর্পিতা সিংহ, অমৃতা শেরগিল, ক্যাথে কোলভিটস, অথবা ফ্রিদা কাহলো শেষেরজনকে চিনেছি আবার চলচ্চিত্র দেখে। রবি বর্মা, হুসেন, অবনীন্দ্রনাথ, পিকাসো , ভিঞ্চি বা মিকেলাঞ্জেলোকে আমরা অনেক বেশি চিনি। কারণ তারা বড়োমাপের শিল্পী, কাজ করেছেন বড়ো বড়ো কিংবা মিডিয়ার বহু আলোচিত। আর কজন 'পুরুষ' শিল্পীকে নামে চিনি? অথবা যদি নারী পাঠকদের প্রশ্ন করা হয় কজন মহিলা শিল্পীর নাম আপনি জানেন , তাদের শিল্পকর্মের নমুনা চেনেন ... ওনারা নিরুত্তর থাকবেন। কেউই নিজের অজ্ঞতা বা জানার অনিচ্ছা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন না। পাশের বাড়ির যে কাকিমা/মাসিমা প্রতিবছর আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠান উপলক্ষে আলপনা এঁকে দিয়ে যান হাসিমুখে তার কোনো ফটো তুলেছি বা জানতে চেয়েছি ওনার নাম কি অথবা খুঁটিয়ে দেখেছি ওনার শিল্পকর্ম? ...প্রশ্ন তোলা অনেকটাই সহজ, অন্তত প্রমাণ করার দায় তো নেই।





প্রাকৃতিক ভাবে নারী ও পুরুষের লিঙ্গগত পার্থক্য বিদ্যমান (উভলিঙ্গ মানবও আছেন যাদের মূল্যায়ন এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, তাছাড়া ওনাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ আরও কম)। দৈহিক পার্থক্যের সঙ্গে আমরা যেটি স্বীকার করি না সেটি হলো নারীর মনোগত বা অবচেতনের পার্থক্য। নারী পুরুষের মতো স্বপ্ন দেখেন না, তাঁর চাওয়া পাওয়া দেখা ভিন্ন। শিল্পকলায় নারী যে রূপক/চিহ্ন ব্যবহার করেন তা পুরুষের চেয়ে ভিন্ন। স্বপ্নের মধ্যে যে প্রতীকগুলি আসা-যাওয়া করে সেগুলিও পুরুষের থেকে ভিন্ন, ফ্যান্টাসির ধরণ অন্যরকম। এই ভিন্নতার জন্য তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে পুরুষের সৃষ্টির তুলনা করা নেহাতই বোকামি। বড়ো বড়ো শিল্পকর্ম দিয়ে 'অভিঘাত' সৃষ্টির মূল্যায়ন একইভাবে ধোপে টেকে না। সুতরাং তুলনামূলক আলোচনা না করে যদি মেধা, যুক্তি এবং শ্রদ্ধা সহ নারীশিল্পীর কাজ দেখি তাহলে বোধহয় আমাদের প্রকৃত রসোলব্ধি ও সমৃদ্ধ হবো। আবার অনেক ক্ষেত্রে আমরা যে বুঝেও বুঝি না তার একটি উদাহরণ যেটি আমরা সকলেই কমবেশি জানি। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আমরা অনেক বিদেশির শিল্পকর্ম দেখতে পাই। তাদের নাম পড়ে লিঙ্গভেদ বোঝা যায় না, প্রোফাইল ছবিতে মুখের ফটো থাকে না কিন্তু কাজের ধরন দেখে সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায় সেটি নারী না পুরুষের কাজ।

যৌন ফ্যান্টাসি নিয়ে একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি যেটি আমার অনুভবকে সমর্থন করবে। সময়কাল ৭০-র দশকের আশেপাশে। যে সময়ে অন্তত কিশোর-কিশোরীদের কাছে নীল ছবি বা চটি বই সহজলভ্য ছিল না। ঘটনাটি শেয়ার করেছেন রিটায়ার্ড অধ্যাপক ব্রজেন্দ্রনারায়ণ দত্ত। সেই সময় ভোটকর্মী হিসাবে ব্রজেনজেঠুকে বিভিন্ন স্কুলে (ভোটকেন্দ্রে) যেতে হত। উনি অবসর সময়ে স্কুলের ছেলেমেয়েদের দেওয়ালে চক বা ইঁটের টুকরো দিয়ে আঁকা ছবি খুঁটিয়ে দেখতেন। তিনি লক্ষ্য করলেন ছেলে ও মেয়ে উভয়ের স্কুলের বাথরুমে (প্রস্রাবখানা) নগ্নদেহ বা যৌনাঙ্গের ছবি অপটু হাতে আঁকা থাকতো। ছেলেদের স্কুলে থাকতো বিশাল স্তন সমৃদ্ধ নগ্ন নারীর ছবি যার নিন্মযৌনাঙ্গ অদৃশ্য, আর মেয়েদের স্কুলে নগ্ন পুরুষের বিশাল অন্ডকোষ ও ক্ষুদ্র পুরুষাঙ্গের ছবি। স্বাভাবিক ভাবেই এটা অনুমান করে নেওয়া যায় শাড়ি বা ধুতির আড়াল থেকে সামান্য দৃশ্যমান বস্তুকে কিভাবে ফ্যান্টাসিতে (মনের মাধুরী মিশিয়ে) রূপান্তরিত করেছে ঐ কিশোর কিশোরীরা। ভিন্ন লিঙ্গের মানুষের কল্পনা যে ভিন্ন তা নিশ্চয় এই ঘটনা থেকে সহজেই বুঝে নেওয়া যায়।

এবার ফিরে আসি শিল্পীদের শিল্পকর্মের কথায়। শিল্পকলায় অবচেতনের প্রভাব অনস্বীকার্য। বিশেষ করে আধুনিক শিল্পে প্রায় প্রধান বিষয় অবচেতন। আধুনিক যুগে মানবজাতির অন্যান্য অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানবমনের জটিলতা। ব্যক্তিগত কথোপকথন, উপলব্ধি, অনুভূতির প্রাধান্য অন্যান্য সুকুমার কলার তুলনায় শিল্পকলায় বেশি। এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে খুব সহজেই যে কোনো শিল্পকর্মকে পড়ে নেওয়া যায়। ফ্রিদার জীবন সম্পর্কে জানা থাকলে সহজেই আপনি বুঝতে পারবেন তাঁর ছবিতে কোথাও আছে জৈবিক যন্ত্রনা, কোথাও সমকামী, কোথাও বা পুরুষ হবার প্রবল ইচ্ছা। সুনয়না দেবীর ছবিতে ঘরকন্নার মিষ্টিরূপ অথবা আমিনা আহমেদ করের ছবিতে পাবেন অবরূদ্ধ চেতনার বহিঃপ্রকাশ। কয়েকবছর আগে প্রয়াত শিল্পী করুণা সাহার একই বিষয় নিয়ে কয়েকবছর পর পর করা কাজ নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। প্রথমে দেখব ১৯৫০ দশকে করা ন্যুডটি। প্যাষ্টেলে আঁকা ছবিটি নিখুঁত স্টাডিধর্মী ছবি বলা যেতে পারে। আবেদনহীন সাধারণমানের ছবি। দ্বিতীয় ছবিটি ১৯৬০ দশকে আঁকা, শিরোনাম 'রিক্লাইনিং ন্যুড'। তেলরঙে আঁকা ছবিটি অনবদ্য। পাশ্চাত্যশিক্ষার অভিজ্ঞতা, আধুনিকতা আর নিজস্ব মনন ছবিতে বেশ ভালোভাবে মিশে গেছে। রঙ, আলোছায়া, ব্রাশের মোচড় সাধারণ স্টাডিধর্মী ন্যুড থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে ছবিটিকে ছবির ভাষায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। তৃতীয় ছবিটি তেলরঙে আঁকা ১৯৭০ দশকে, শিরোনাম 'মহাশ্বেতা'। নারীদেহ আলংকারিক হয়েছে, অজন্তাশৈলী আর আধুনিক শৈলীর উত্তম মেলবন্ধন। সর্বশেষ ছবিটি ১৯৮০ দশকে সৃষ্টি। জলরঙে আঁকা 'স্ট্যান্ডিং ন্যুডটি হয়ে উঠেছে মার্জিত, সংক্ষিপ্ত। আছে কেবল সারাৎসার। একজন শিল্পীর এতগুলি বাঁকের মোচড় (টার্নিং পয়েন্ট) কি দর্শকের মনে কোনো উল্লিখিত 'অভিঘাত' সৃষ্টি করে না !!! এখান থেকে কি শিল্পীর মানসিক বিবর্তন স্পষ্ট হয় না ? বৌদ্ধিক উত্তরণ প্রমাণিত হয় না ? অন্যের বক্তব্যকে পাশে সরিয়ে রেখে একবার ঠান্ডা মাথায় নিজে ভেবে দেখুন।
(ক্রমশ)