বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ

দক্ষিণ সমুদ্রে ‘নীরা’
নন্দিতা ভট্টাচার্য

কাঠের দোতলার সিঁড়িতে আমার ঝুপ্পুস মায়া

সিঁড়ি আমার কানে কানে ঝুম ঝুম বলে ,

--‘দেবীর কি হইল !’

সিঁড়ির আড়চোখ আমার ঘাড় উঁচু
সিঁড়ি টুপটাপ জলছবি পিছুপিছু ---

বাইশে শ্রাবণের রিহার্সাল সিঁড়ি আমার গানে আনচান

টুকটাক রিহার্সাল রুম ছেড়ে পগারপার
সিঁড়ি একধাপ দুইধাপ কথাকলি ,
--‘মাঝে মাঝে এরকম দলছুট দেখে গেলেই তো হয়...’

সিঁড়ি গেছে দক্ষিণ সমুদ্রে ,

সিঁড়িহীন কাঠের দোতলা
ঢেউয়ের জলছবি গুনগুন ।

দক্ষিণ সমুদ্র ফেরত সিঁড়ি

হাতে বই ,
প্রথম সুনসান পাতায়
সিঁড়ি ছিমছাম ,

---দক্ষিণ সমুদ্রে ‘হঠাৎ নীরার জন্যে’ দুটো ঝিনুক কুড়িয়েছিলাম ...



লেমিং ও কবিমৃত্যুঃ সুনীল স্মরণে

রাজর্ষি ঘোষ

একদল ল্যুসিফার উড়িয়ে নিয়ে গেল তাকে দিকশূন্যপুরে।

তখনও পৃথিবীর বুকে সিঁদুররঙা হয়ে ওঠেনি সূর্যের আলো
যদিও রাত জাগা তারা, তারা ঝরে যাচ্ছিল একে একে জনান্তিকে;
টুপ টুপ ঝরে পড়েছিল হেমন্তের প্রথম শিশির, নিষিদ্ধ ভালোবাসা
          একটি নীরার জন্য।
সবশেষে ধোঁয়া ধোঁয়া ভোর আসে আবছায়া; আধধোয়া কাঁঠালপাতা
নিভু নিভু চোখে আবিষ্কার করলে হঠাৎ, চুরি হয়ে গেছে একটি
          নিজস্ব পরশপাথর।

শহর উজিয়ে লেমিং এসেছিল সেদিন।

          দলে দলে তারা আছড়ে পড়ল সমুদ্র সৈকতে।
তারা কেউ জাহাজ ব্যবসায়ী; আদার খোঁজ রাখেনি কোনোদিন।
কেউ মুচি, কেউ মেথর, কেউ সংস্কৃতিমনষ্ক বুদ্ধিজীবী অথবা সঙ।
বস্তুত এ লেমিং নগরীতে লেমিং দুই প্রকার-
          ভালো লেমিং, খারাপ লেমিং।
          যদিও উভয়ই রাজনৈতিক।

একটি কবির মৃত্যু হলে

          লিটার পিছু পেট্রোলের মূল্য বাড়ে এক টাকা চব্বিশ পয়সা
          গিন্নীর দৌলতে রান্নাঘরে বেগুন প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়,
                   যেহেতু একাদশী
          মসজিদের চৌকাঠে ঢং ঢং সুরে ঘন্টা নাড়েন বৃদ্ধ মৌলবি
          একটি মন্ত্রী বা চামচে গান্ধীটুপি পড়ে
                   করেন ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়।
          ওসামা, ওবামা, সোনিয়া, সাদ্দাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
                   লোকটা ভালো ছিল হে।
                   বেঁচে থাকলে একটা নোবেল জুটে যেত।

একটি গাছের মৃত্যু হলে

          নিরাশ্রয় হয় দোয়েল কোয়েল শালিক ও টুনটুনি
          আমার বসার ঘরের পূর্ব দিকের কোণে গজিয়ে ওঠে
                   একটি ঝাঁ-চকচকে নতুন আসবাব
          কিছু পরিবেশবিদ চিন্তিত হন,
                   যেহেতু বায়ুমন্ডলে বাড়ছে গ্রীণ-হাউস গ্যাসের আধিক্য।
          দুটি ইন্দোনেশিয়ান শিশু আতঙ্কে থাকে,
                   আছড়ে পড়বে নতুন সুনামি।
          আর আগাছা ভাবে বিবর্তনের নিয়মে এই সহস্রাব্দ আমার হবে।

একটি লেমিংয়ের মৃত্যু হলে

          জন্মায় না দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ 

একটি লেমিংয়ের মৃত্যু হলে
          এ আর রহমান পাবে না দ্বিতীয় অস্কার
          রবিশঙ্কর পাবে না আর একটি গ্র্যামি
একটি লেমিংয়ের মৃত্যু হলে
          দুই দশকের নৈঃশব্দ ভেঙে সত্যজিৎ জানাবেন না
আ ক্রো ফিল্ম ইজ্‌ আ ক্রো ফিল্ম্‌ ইজ্‌ আ ক্রো ফিল্ম।
          লর্ডসের ময়দানে শতরান সেরে ব্যাট তুলবেন না অন্য সৌরভ
একটি লেমিংয়ের মৃত্যু হলে।

সুতরাং ভিড় উপচে পড়েছিল সবজি বাজারে।

অজস্র দরদাম, চেঁচামেঁচি...
          কবিতার জোড়া তিন টাকা, দশটা কিনলে একটা ফ্রি।
ভিড় উপচে পড়েছিল সুনীল ভোরে।

জাহাজের ব্যাপারি সস্তায় কিনে নিয়ে গেলেন একশ ছোটগল্প,

          যদিও মূল্যবৃদ্ধির বাজারে ইলিশ পাওয়া এখন দুর্লভ।
                     সেনসেক্সটাও কদিন হলো সমানে গড়বড়ো করছে।
আড়ালে মিচকি হাসল সদ্য গোঁফ ওঠা ফচকে ছেলে।
প্রেমিকার কোমর জড়িয়ে প্রেমিক ফিস্‌ ফিস্‌ করে বলল কানে কানে
          লোকটা আমার কবিতা চুরি করেছিল।
একটি না-পুরুষ না-মহিলা বক্তব্য রাখলেন সংবাদ-মাধ্যমে
          কবির প্রচুর নারীদোষ...
          সেসব কেচ্ছা-কাহিনি ছিছি ছ্যাছ্যা
                      বলে গেছেন স্বয়ং ব্রহ্মা পরবাস গৃহে চুড়ান্ত আক্ষেপে।
কাঁদলে তরুণ, কাঁদলে প্রৌঢ়,
ঝুপো গোঁফওয়ালা মাঝবয়সী নাক শিঁটকে বললেন,
          যত্তসব যুগের হুজুক।
আমার আবার বাতের ব্যাথাটা...

শুধু একটি সূর্য খুঁজে পেয়ে আরেকটি সূর্য জিজ্ঞেস করল,

          ছুঁয়ে দেখতে কত লাগবে জানিস?

একটি কাঁঠাল গাছ, একটি শারদ সকাল এবং কিছু ল্যুসিফার...

একটি পরশপাথর হারিয়ে গেলে অপেক্ষায় থাকে নতুন ম্যাজিকের।
শিশির কণা বলেছিল শেষ সাক্ষাৎকারে,
          আমি ঈশ্বর দেখি নি, মানুষ দেখেছি।
          আমি আগুন দেখি নি, কবি দেখেছি।
একটি কাঁঠাল গাছ, একটি শারদ সকাল এবং কিছু ল্যুসিফার...
একটি পরশপাথর হারিয়ে গেলে অপেক্ষায় থাকে নতুন কবির।

ওরা কাঁধে তুলে নিয়ে গেল একটি লেমিংয়ের দেহ...

ওরা, অর্থাৎ লেমিং জাতীয় কিছু মানুষ।
          ধীরে ধীরে ধোঁয়া উঠল কলুষিত,
          পূতিগন্ধময়।
আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল লেমিংয়ের আর্তনাদ।
শুধু একটি পথশিশু খিল খিল করে হেসে উঠে আঙুল তুলে দিল লেমিং সমাজে
          ওরা কাপড় পরে নি।
ল্যুসিফারের চুলে বিলি কেটে দিয়ে কবিও হাসলেন শিশুটির সাথে (অপরিবর্তিত)
          লেমিং কাপড় পরে নি। এখনো, এবারও...
          আহা, তবে যদি চশমাটা তুলে দেওয়া যেত ছেলেটার হাতে...
          নিখরচায়!

হেসে উঠে শিউলি ঝরে গেল রক্ত পায়ে।

সারমর্ম –

একটি কবি অথবা গাছ এবং না-লেমিংয়ের মৃত্যু হলে
          দেবীর গজে আগমন এবং নৌকায় গমন হয়।



সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নীলাঞ্জন সাহা



পায়ের তলায় সর্ষে ,তবু তুমি শুয়ে আছো

হাতের মুঠো গ্রন্থের মতো খোলা
কিলবিল করছে অক্ষর
শব্দবীজ ভুলবশত আজও জন্ম চাইছে বুঝি তোমার কাছে ,
যেন এখনো কলমটা ধরিয়ে দিলে
তুমি চোখ বুঁজেই লিখে দিতে পারো দু চার পৃষ্ঠা ...
তোমার চশমায় শেষ আলোর স্থির চিত্র ,
ছেড়ে রাখা জুতোয় রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে রাস্তা ...
নীরার অসুখ হ'লে কলকাতার সবাই বড়ো দুঃখে থাকে
অথচ কলকাতার দুঃখে নির্বিকার শুয়ে আছো তুমি !


বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়-এর দুটি কবিতা

নীললোহিত, তোমাকে

নীললোহিত,দিকশূন্যপুরে গেছো পূজোয় বেড়াতে..

সেলফোন নট রিচেবল.. ওখানে সিগন্যাল নেই শুধুই উৎসব
বাউন্ডুলে স্বপ্নগুলো ভ্রমণবিলাসী সুখপাখি, উড়তে থাকে নীলিমার ওই পারে
কাঁধে ঝোলা পাঞ্জাবির পকেটে যৌবন থমকে গেছে
তোমার বয়স

নীললোহিত,দিকশূন্যপুর থেকে চিঠি লিখবে

আরও কিছু নিসর্গ, রোমাঞ্চ ব্যাগভর্তি এনো
মি তো সবুজ বয়সকে শাসন করেছ অনায়াসে

যত দূরেই যাও

আমাদের ছুঁয়ে আছো
চোখের মণির মাঝে আছো ।


কবিস্বর বেজে ওঠে


কবিকে দেখলাম আজও

কবিতার ভিড় ঠেলে অক্ষর টাঙিয়ে রাখছে লম্বা বারান্দায়
চারপাশে নীলাভ গাছের ছায়া দিকশূন্যপুর…..
সুগন্ধী রুমাল নেড়ে ডেকে উঠল: নীরা তুমি যাবে?
ঝমঝম দুপুর বাজছে,সৌরবন্ধু তাপ
মাঝখানে ধীরগতি নদী
মেঘ ও পাখির ডাকে বরাভয়… সুবাতাস
সন্ধ্যে হয়ে এলে ফুলস্কেপ জ্যোৎস্নারাত
মায়াবী চাঁদের নীচে সামিয়ানা
বয়স পাথর হয়ে বসে থাকে গায়ে
শ্যাওলা জমেনা মনে….অলৌকক সুখ
:নীরা তুমি যাবে?
কবি ডাকে কবি ডেকে যায়
যুগের ওপার থেকে ভেসে আসে ধ্বনি ।



কথা রাখেনি

গোপাল লাহিড়ী

ঘুম ভেঙ্গে যায় ঢাকের বিরামহীন শব্দে


শিউলি ফোটা সেও শেষ হয়েছে যেন কিছু আগে,
সাদা মেঘ ভেসে ভেসে আজ ভীষণ ক্লান্ত,
কেউ যেন কথা রাখেনি- একা এবং কযেকজন
ছিল চিরটাকাল যেন একেবারে পাশে পাশে.

তুমি এলে কবেই- তখন তখনি সেই শুরু হওয়া

শাণিত ছিল মন, ভালোবাসা ছিল গভীর সমুদ্র,
কোথাও কোথাও যেন মিশে থাকে হলুদ রং-
পিছু ফিরে দাঁড়ানো সেই দীর্ঘ আকাশলীনা,
কানাউঁচু জামবাটি ভরা থাকে চূড়ান্ত আদরে।

হাতের মুঠোয় বয়স ভাঙ্গার শানিত অস্ত্র,

আর কেউ যেন এত বোঝা নেয়নি হাতে-
মাথা নিচু করে আর যেন বেঁচে থাকা নেই
সমস্ত জানালা খুলে দেখে পৃথিবীর মানুষ
যেতে যেতে চায়নি যেতে কখনো কোনোদিন।



নীরার রক্তে লুকোচুরি

(নীললোহিতের জন্যে)
ঈশিতা ভাদুড়ী


তুমি তো এখনও সাতাশ বছর,

তাই রক্তে ভাঙো আবেগ,
সমুদ্রে কত্থক ...
অদ্ভুত চন্দনগন্ধ এখনো তোমার হৃৎপিণ্ডে ।
তুমি তো চল্লিশোর্ধ্বেও সাতাশ বছরের
ছোকরা যুবক,
যেকোনো নারীর রহস্যে এখনও তোমার
চিবুক তুমি রাখতে পারো,
একটি চুম্বনে নীরার রক্তে লুকোচুরি
এখনও তোমায় সাজে।



দিকশূন্যপুরের যাত্রি...
সুনীল বাবুর স্মৃতিতে

সৈকত ঘোষ



বৃষ্টি এসেছিল কাল রাতে
তোমার নিশ্বাস ছুঁয়ে শেষবারের মতো

কেঁদেছিল ঝাউপাতা
আর হয়ত কাঁদবেনা আকাশ
ওঃ হয়ত মাপতে পারেনা জরত্ব
ভুল বলেছিল থার্মোমিটার

নীরারা কোনোদিন মরে না

তোমার জীয়ন কাঠির স্পর্শে তুমি অমর
রাতভোর হিমায়িত কলকাতা


সুনীল শূন্য পারাবার

অনুপ কুমার দত্ত

নবমী গুঞ্জন ছেড়ে...তিনি চলে গেলেন ইহলোকধামে ।

যাঁর কবিতা পড়ে আবার জন্ম নিয়ে
পা জমিয়েছিলাম কবিতার আসরে ।

হে অনন্ত বাহূ আকাশ

হে দূরন্ত সবুজ পৃথিবী
পথিকৃত চিত্রকরের আনন্দ সুবাসে শান্তি দিও তাঁকে ।

হে ঈশ্বর তুমি তো অন্তরযামী


তুমি দেখো......

তাঁর যাবার পথে বৈতরণী পুণ্যজলে স্নাত হোক
যে ভাবে মাঙ্গলিক শ্লোক ভেসে আসে পবিত্র গঙ্গাজলে
সেই ভাবে তাঁর মঙ্গল শব ব্যথাকাঠে মহাশয়ান
যেন প্রভু যিশুকে বইতে দেয়া ব্যথামহান ।

তুমি দেখো.....

গঙ্গা থেকে যমুনা..গোদাবরী সিন্ধু হয়ে স্বরস্বতী থেকে পদ্মা জলে
তাঁর ক্লান্ত মুখ যেন ধুয়ে দেয়া হয়
তাঁর কমল নরম শরীরে যেন বর্ষন করো নির্ঝরের সুখে অমৃত বারি ।
হে মহা নিম কৃঞ্চচূড়া শাল সেগুনে বন মহাক্রম

তুমি আদেশ দাও......

তাঁর যাত্রা পথে সমস্ত গাছেরা যেন তাঁকে দেয়
শান্ত গন্ধবিতান মহানির্ঝর ছায়াঘুম ।
মহানিম শান্ত বটের পাতার মৃদুল হাওয়ায়
সে শান্ত ঘুমায়....সে শান্ত ঘুমায়
তাঁর শেষ যাত্রা পথ মহীয়ান হোক আবার্ও সুখের সুখমহানে ।

তুমি দেখো.....

তাঁর যেন কোনো আঘাত না লাগে ।
সে পুরুষ বিশাল এক দেশ পরিবার নিয়ে হেঁটেছেন
পৃথিবীর পথে আটাওর কাল
শত কবিতা পথিকবরকে পথিকৃত করেছেন
কবিতার অঙ্গনে ভালোবাসা শব্দ চয়নে
আজ শবানুগামীর পিছে তারা একাকী দু:খে দাঁড়িয়ে ।

আজ পঁচিশে অক্টোবর কাল দুহাজার বারো

জানুক.......

তাঁর মুখে গহীন সমুদ্র আলো

তাঁর শরীর নীলাদ্রী মৃত্যুহীন ।