বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

Look সংস্কৃতি – পল্লব ভট্টাচার্য

হাতে রইল শূন্য
পল্লব ভট্টাচার্য


মেয়েকে হাসিখুসির ছবি দেখিয়ে , বলি ,- এই দেখ , খোকা গেছে মাছ ধরতে ক্ষীর নদীর কূলে…..

মেয়ে আমার বুদ্ধিমতী , ছবির দিকে একটু তাকিয়ে বলে ,- ক্ষীর কই ?

সত্যি , রঙিন ছবিতে নদীটা তো আর পাঁচটা নদীর মতোই ,নীল রঙে আঁকা জলের ছবি ।

ভাবলাম , শিল্পী ক্ষীরের নদী আঁকতে পারেননি । মেয়েকে বললাম , -জলের তলায় আছে তো ক্ষীর , তাই দেখা যায় না ।

মেয়ে মাথা নেড়ে ছবি দেখতে লাগলো । বোধহয় জলের তলায় ক্ষীর খুঁজছিল ।

আমার কেন যে মনে হলো , বাংলাদেশে এত খাল-বিল-নদী-নালা থাকতে , খোকা কেন ক্ষীর নদীতেই গেল ? ক্ষীর নদীতে কি মাছ থাকে ? কেমন সে মাছ ? এই ক্ষীর নদী কি সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে ? সে-ই ক্ষীর সমুদ্র , যেখানে অনন্তশয্যায় ভগবান বিষ্ণু বিশ্রাম নিচ্ছেন আধশোয়া হয়ে , আর লক্ষীঠাকরুন তার পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ? তাহলে মাছটি কি দশাবতার স্তোত্রের সেই মীন অবতার ?

ধ্যুৎ , সবকিছুতেই মিথ খুঁজে বেড়ানো একটা বাজে স্বভাব । তার চেয়ে ভাবা যাক , খোকা মাছ ধরতে গেছে , এই কথাটুকু নিয়ে । জলে থাকে মাছ , একথা তো আমার ছোটো মেয়েটাও জানে । তাহলে খোকা কেন জানে না ! এই খোকাটি বোধহয় পাকা মাছ শিকারী নয় , কারণ সে প্রথমেই মাছ ধরার জন্য একটা ভুল জায়গা বেছে নিয়েছে । ক্ষীর নদীতে মাছ ধরতে কোনোও জ্ঞানগম্যিওয়ালা মানুষ যায় না । তাহলে , খোকাকে তো প্রথমেই একটা বুদ্ধু বানিয়ে দেওয়া হলো । যেখানে মাছ থাকা সম্ভবই না , সেখানে সে মাছ ধরতে গেছে ।

এরপরের ঘটনা তো আরও হাস্যকর ব্যর্থতার । খোকার মাছধরার ছিপ কোলাব্যাঙে নিয়ে যায় , আর মাছটা নিয়ে যায় চিলে । তাহলে , এই যে এত তোড়জোড় করে খোকা মাছ ধরতে গেল , তার নীটফল দাঁড়ালো , মাছ তো নয়ই , মাছধরার সরঞ্জামটুকুও গেল । শুধু এইটুকু ! এই করুণ হাস্যরসটুকু জানানোর জন্যই তবে এত বছর ধরে মায়েদের মুখে মুখে বলা হয়েছে এই ছড়া ? নাকি এর মধ্যেও রয়ে গেছে , বাঙালি জীবনের কোনোও করুণ সামাজিক অভিজ্ঞতার ইতিহাস ?

তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মন , বাংলাদেশে মালোদের জীবনকে তুলে ধরেছিলেন । প্রায় বিত্তহীন সেইসব মানুষ । মাছে ভাতে বাঙালির পাতে মাছ জুগিয়ে যেতে এই মানুষদের নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করে কেড়ে আনতে হয় জলের ফসল , কিন্তু সেই ফসলের প্রকৃত মালিকানা তাদের ছিল না । এই ফসলও এমন যে , নির্দিষ্ট সময়ের পর তা পচে যাবে । তৎক্ষণাৎ বিক্রি না হলে , তা আর ব্যবহারই করা যাবে না । এই অনিশ্চিতি তাদের অর্থনৈতিক নিশ্চিতি দেয়নি । অন্যদিকে হিন্দু সমাজ কাঠামোয় তাদের যে নিম্নবর্গীয় স্থান চিহ্নিত করেছিল , তাতে সামাজিক সুস্থিতিও তাদের ছিল না । এই দুই অনিশ্চিতির মধ্যে যে জীবন , সেই জীবনে মাছ শিকারের উপকরণ জাল ও নৌকাও থাকে না বেশিরভাগ মালোর । নিতে হয় মহাজন বা বেপারিদের কাছ থেকে ধার হিসাবে বা আগাম হিসাবে । মাছ ধরার পর একটা অংশ চলে যায় তাদের ঋণ মেটাতে । বাকি অংশ সরাসরি বাজারে বা বেপারিদের (মধ্যসত্বভোগী) বিক্রি করে তার সংসার ও বেঁচে থাকা । সেখানে অর্থাৎ বাজার যারা বসায় , তারাও যখন বাজারে বসার মাশুল আদায় করতে চায় মাছের ভার পিছু , তখন ভার পিছু মাশুল দেওয়ার পর , কী থাকে অইসব মানুষদের হাতে মাছ শিকার করে আনলো নদীর বুক থেকে ।

প্রসঙ্গত মনে পড়ে , সামাজিক সম্ভ্রম আদায়ের উদ্দেশ্যে , এই নিম্নবর্গীয় মানুষদের মধ্যে চৈত্রমাসে গাজনের সন্ন্যাসী হওয়ার চল রয়েছে । বৈষম্য বা সামাজিক দমনের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ খুব সরল বা একরৈখিক কোনোও কালেই ছিল না । এমন কি প্রত্যাখ্যানের রাস্তা থেকে সরে , অনেক সময়ই উচ্চবর্গীয় ধ্যান ধারণা থেকেই বানিয়ে নিয়েছেন প্রতিবাদের রসদ । গাজন বা চড়কপুজোও তেমনই এক দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা প্রতিবাদের রূপ । এ নিয়ে বিস্তারিত অন্য কোথাও বলা যাবে , এখন শুধু বলার যে এই গাজনের সঙ্গে একটা সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশে , যেখানে ভক্তা অর্থাৎ সাময়িক সন্ন্যাসীরা নাচ ও গানের মধ্য দিয়ে তাদের প্রাসঙ্গিকতা ও সারবত্তা প্রকাশ করতেন । তেমনই একটি প্রশ্নোত্তর গানে আমরা দেখি ,-

বাঁধন - তোমরা তো সন্ন্যাসী ঠাকুর সব বলিতে পারো
কোনো সময়ে শিবের মাথায় নৌকা চলেছিল ?
কাটন ঃ স্বর্গ থেকে ভগীরথ গঙ্গা এনেছিল
সেই সময় “মালো”রা সব নৌকা বেয়েছিল ।

অর্থাৎ উচ্চবর্গীয় মিথ ইত্যাদিকে পরিত্যাগের বদলে , এই মিথগুলোকেই লৌকিক যুক্তি সাজিয়ে নিজেদের মতো করে নিয়ে , নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরা হচ্ছে নিম্নবর্গীয় চৈতন্যের একধরণের প্রতিবাদী প্রকাশ ।

এই প্রকাশ প্রবণতা মনে রেখে ক্ষীর সমুদ্র বা ক্ষীর নদীর কথা যদি আমরা ভাবি, তবে দেখা যাবে হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী এই ক্ষীরসমুদ্র মন্থন করেই তুলে আনা হয়েছিল , ধন-সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষীকে । মালোদের জীবনজীবিকাও নদীর গভীর থেকে তুলে আনা মাছের উপর নির্ভরশীল । মাছই তাদের ধন ।

এখন মাছ তুলে আনার যে উপকরণ , জাল , পলো , বড়োশি সেগুলো তাদের নয় । অনেকক্ষেত্রেই আড়তদার বা দাদন খাটানো মহাজনদের । তাদের গদিতে বসে থাকার ধরণটি কল্পনা করলে , পেট ফোলা , আধচোখ বোজা ব্যাঙদের সঙ্গে কেরিকেচারসুলভ একটা সাদৃশ্য সহজেই চোখে পড়বে । খোকার ছিপ যখন কোলা ব্যাঙ নিয়ে যায় , তখন কি অবচেতনেও জাগেনি , আড়তদার , দাদনদার , মহাজনদের চেহারা ?

তিতাস পাড়ে গোকন্নপুরের মালোদের নিজেদের নামে বসানো বাজারে মাছ নিয়ে বসানোর যে প্রতিযোগিতা শহরের দুই জমিদার আনন্দবাবু আর জগৎবাবুর মধ্যে আমরা দেখি , তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে , তার অন্তর্গত অভিপ্রেত আমরা দেখবো বহুদিন পর যখন আনন্দবাজারের জমিদারের লোকেরা মাছ বিক্রেতাদের কাছে মাছের ভার পিছু দুই আনা মাশুল বসালো । যদিও জমিদারের নায়েব , লেঠেলদের জুলুমের কোনোও আখ্যান অদ্বৈত মল্লবর্মন আমাদের শোনাননি , তবু তাদের ধন অর্থাৎ মাছের ছো মেরে নিয়ে যাওয়া চিলের অভাব কোনোও কালেই ছিল না ।

তাহলে খোকার মাছ ধরতে যাওয়ার কাহিনিটি যে শেষ পর্যন্ত কোলাব্যাঙ আর চিলের দ্বারা উপকরণ আর সম্পদ কেড়ে নেওয়ার কাহিনিতে পর্যবসিত হয় । আর জেলে মালোদের জীবন সংগ্রাম পরিণতি পায় ব্যর্থতায় ।

এই ব্যর্থতার করুণ কাহিনি কি অন্যভাবে লেখা রইল না , এই শিশুতোষ ছড়ায় ?

ভাবতে ভাবতে মেয়ের কথায় চমকে উঠি । মেয়ে জানতে চাইছে ,-বাবা , অ বাবা , খোকা তবে কী নিয়ে বাড়ি ফিরবে ?

উত্তর আমিও জানি না । বললাম , আবার খোকা মাছ ধরতে যাবে ।