বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

ছোটগল্প - শ্রাবণী দাশগুপ্ত

বড়োকাকিমার পুঁটুলি


নৈহাটি থেকে গুরগাঁও – দূরত্ব নেহাত “কম নয়” বলে শান্তনুর যাওয়া হলোনা। অঝোর বর্ষা, স্যান্ডাকের জুতো, রোজকার কলেজ-বাড়ি, শুঁড়িখানার মাতালের টানে সাহিত্যসংসদ, লেখালেখি। তার মা বলল, তমসাও বলল, “যাও, না যাওয়াটা খারাপ দেখায়। বড্ড টান ছিল তোমার ওপরে।” বাইরে লম্বা বুনোঘাসের মাথায় টুসটুসে বৃষ্টিফোঁটা। বৃষ্টি এখন থেমেছে। দিনপনের আগে শমীক ফোন করেছিল, “আসতে পারলে ভালো হত বড়োদা, তোমাদের তো ছুটির অভাব থাকেনা।” তা অবশ্য, শমীক বহুজাতিক সংস্থার উচ্চ-আধিকারিক। হয়না, হলোনা কত কিছুই। ছায়ারঙের মেঘপর্দা। স্যাঁতানো গন্ধে বুনোভাপ। বড়োকা’র বিয়ের সময় সে ক্লাস-টু। বাগানের পাঁচিলে একটা মা-বাঁদর এসে বসত। তিনবছর পরে বাঁদরছানা বড়োকাকিমার শাড়ির বুকের কাছে গোলাপী...। একটুখানিই দেখেছিল সে। “ও শানু, ভাই দুধ খাচ্ছে...পরে আসিস?” সে লম্বা এক দৌড়। পেছনের বাগানে বড়োবড়ো ডাঁসা কাশীর পেয়ারা। সেই গাছের নীচে তেড়ে হিসি করেছিল শান্তনু। এই ক’দিন সবাই হবিষ্যি না খেলেও নিরামিষ। রিম্পি রোজ ঘ্যানঘ্যান করছে, “ও ঠাম্মা, আরো কদ্দিন?” তমসাকে বলছিলেন শান্তনুর মা,“...তোমার শ্বশুরের সঙ্গেই আগে গৌরীর সম্বন্ধ এনেছিল ওর মেজমামা। দেখাশোনা...তা পনেরবছরের তফাত বলে আমার শাশুড়ি অরাজী। ওনার আগের ফোটো দেখেছ তো; কী রূপবান ছিলেন! বাড়ির মধ্যে বটঠাকুরপোই কুচ্ছিত।” গুমোরে মেঘ ডাকল। “বড়োকাকিমাও তো ওয়াহিদার মতো – ফোটো দেখেছি মা। কী সুন্দর!” “ওই! রঙ তেমন নাঃ।” শান্তনুর মা ধবলা, বেঁটে, ল্যাপচা-মুখ। বড়োকাকিমার পা সে দেখেছিল, একদিন। কচুপাতা গোছ, গোড়ালি। উঁচু হয়ে কাপড় মেলছিল। সে দোতলার বারান্দায়। তখন তার মাধ্যমিকের ছুটি। আজ সন্ধ্যেবেলায় কমলদা’র বাড়িতে মিটিং – পুজোসংখ্যা-সংক্রান্ত। ইচ্ছে করছে না। সাদাকালোয় সেজপিসি, মা, বড়োকাকিমা, ছোটকা, বড়োপিসি, ১৯৬৯। পাছবাগানে বড়োবড়ো সাবানের গোল্লা উড়ছে, ভাসছে, বড়ো হচ্ছে, ফাটছে। বৃষ্টির ধোঁয়ায় ঝাপসা বড়োকাকিমার সবুজ-শাড়ি, হলোদে-পাড়। গোল্লাগুলো ঘরে ঢুকছে। এক, দুই, তিন, চার পাঁচ...। আসছেই। “তোকে দিলুম যে শানু, খুলে দ্যাখনা!” একখানা কালো খোঁপা, একজোড়া বকফুল, তাসের জোড়ায় রুইতনের সাহেব-বিবি, লালসুতোর গোলাপে তার বাবার নাম সেলানো রুমাল। পাঁচ নম্বর পুঁটুলিতে...? শান্তনু ছোঁওয়ার আগেই উড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির মধ্যে। জলছাপ ঘরের মেঝেয়।