বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

মলয় রায়চৌধুরীর ডাইরি


খামচানো কালপৃষ্ঠা




কবির চিরকৌমার্য
মলয় রায়চৌধুরী



ষাটের দশকে, যখন ব্যাংকশাল কোর্টে আমার এক মাসের কারাদণ্ডের আদেশ হয়ে গেছে, আর কলকাতা হাইকোর্টে অ্যাপিল করেছি , কবে কেস উঠবে জানিনা, বন্ধুরা ভয়ে রাজসাক্ষী হয়ে কেটে পড়ে আলাদা কোটেরি গড়ে তুলেছে, কলকাতায় মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই ছিল না বলে পাটনায় চলে যেতুম। উত্তরপাড়ার আদিবাড়িতে থাকা যেত, কিন্তু তা এমন নোনাধরা খন্ডহরের চেহারা নিয়ে ফেলেছিল যে একা-একা ওই বারোঘরের বিশাল অন্ধকারাচ্ছন্ন স্যাঁতসেতে বাড়িতে থাকতে ভালো লাগত না, খাওয়ারও অসুবিধা ছিল । যখন গ্রেপ্তার হয়েছিলুম তখন ঠাকুমা অজস্র পায়রা অধ্যুষিত ওই খন্ডহরে একা থাকতেন ; কিন্তু আমি আর দাদা গ্রেপ্তার হয়েছি শুনে সেই সময়েই উনি মারা গেলেন । উনি যতদিন ছিলেন, কলকাতায় কাজ থাকলে উত্তরপাড়ার খন্ডহরেই উঠতুম, খেতুম ওনার প্রতিদিনের হবিষ্য , আলু বা পটল ভাতে , এক চামচ ঘি-সহ । ঠাকুমার দিনের বেলাকার ভাতে সারাজীবন অন্তত এক চামচ ঘি জরুরি ছিল , রাতে কিছুই খেতেন না ।

আমি পাটনায় থাকলে কবি ফাল্গুনী রায় চলে আসতেন পাটনায় । আমার জন্য নয় , ওনার প্রেমিকার জন্য । প্রেম করার জন্য নয়, কেবল দূর থেকে এক ঝলক দেখার জন্য । ফাল্গুনী ছিলেন কলকাতার বরানগরের জমিদার রতন রায় পরিবারের যুবক । ওদের বাড়ির রাস্তাটার নামও ছিল রতন রায় রোড । বিয়ের আগে ওর প্রেমিকা কাছেই থাকতেন কোথাও । পাটনার এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মেয়েটির । পাটনায় ফাল্গুনীর দিদিরও বিয়ে হয়েছিল । ফাল্গুনীর জামাইবাবু ছিলেন আমার কলেজের অধ্যাপক, বিশেষ পছন্দ করতেন না আমাকে । উনি এত মোটা ছিলেন যে সাইকেল রিকশঅলারা সহজে নিত না ওনাকে । রিকশায় বসার আগে সেটাকে ঝাঁকিয়ে দেখে নিতেন, লোড নিতে পারবে কিনা । রিকশঅলারা বলত,'বাবু নেমে যাবার পর নাড়িয়ে দেখবেন' । হাংরি আন্দোলনের সময়ে পাটনার হিন্দি ও ইংরেজি সংবাদপত্র পড়ে আমার সম্পর্কে ওনার ধারণাটি ফাল্গুনীর দিদিকে এমনই প্রভাবিত করেছিল যে দিদি একদিন আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে বকুনি দিয়ে গেলেন , আমার মাকেও বললেন যে, 'মলয় তো নিজেকে নষ্ট করেছে এবার আমার ভাইকেও নষ্ট করছে ।'




প্রেমিকাকে এক ঝলক দেখা হয়ে গেলে ফাল্গুনীর তখনই কলকাতায় ফিরত না, আরও কয়েক ঝলক দেখার অপেক্ষায় থাকত । আমি চাকরি থেকে নিলম্বিত আর ফাল্গুনীর চাকরি নেই, চায় না কোনো চাকরি করতে । দুজনেরই হাতে অফুরন্ত সময় । পাটনা স্টেশানের সামনের হনুমান মন্দিরের পাশের গলিতে সে-সময়ে কয়েকটা 'নিশাওয়ালা' পানের দোকান ছিল । সেখানে পাওয়া যেত ভাঙের ঠান্ডাই অর্থাৎ শরবত, দুধেতে গোলমরিচ, চিনি, ঘি আর কাগজিবাদাম দিয়ে তৈরি । ভাঙের ফিকে সবুজ লস্‌সি, ভাঙ-মেশানো খোয়ার বরফি, আর 'গিলোরি' নামে একরকম পানের খিলি যার ভেতরে থাকত মধুতে গোলা ভাঙ । সুজির হালুয়াও পাওয়া যেত ভাঙ দেয়া । এই বস্তুগুলোর নেশা করতে ফালগুনীর ভালো লাগত । আমার এই নেশা পছন্দ ছিল না, কেননা কোনো জলে যে এগুলো তৈরি হত জানি না , এগুলো খেলেই আমার পেট খারাপ হতো । শুনতুম যে ট্রেন ধোবার জল স্টেশান থেকে আনত এই গলির দোকানদাররা ; গোয়ালারাও ট্রেন থেকে নেমেই দুধে ওই জল মেশাতো । অথচ ক্রেতারা গলির দোকানগুলোয় আসত জ্বর, শ্লেষ্মা, পেটকামড়ানি, সানস্ট্রোক, তোতলামি সারাবার ওষুধ হিসাবে কেনার জন্য, কোনোও আয়ুর্বেদিক ডাক্তারের 'নুসখা' বা প্রেসক্রিপশান নিয়ে । ফাল্গুনী বলত যে ভাঙও তো আরেক প্রেমিকা, কেননা ভাঙ তৈরি হয় মাদি বা কুমারী ক্যানাবিস গাছের পাতা আর ফুল গুঁড়ো করে । আয়ুর্বেদের ডাক্তাররা পুরুষ ক্যানাবিস গাছের পাতাকে বলত 'মৌলানা' , যা পরে জেনেছিলুম, আসলে মালায়নি ক্রিম নামে একরকমের গাছের পাতা, হিমাচল প্রদেশ থেকে আসত ।


ভাঙ সম্পর্কে আমার অ্যালার্জি ছোটোবেলা থেকে, যখন ইমলিতলা পাড়ায় থাকতুম তখন থেকে । ওই পাড়ায় দোল বা হোলির দিন ভাঙ খেয়ে যৌন স্বাধীনতার চূড়ান্ত হতো । গৃহবধুদের দল বেরিয়ে পড়ত পথে, দুপুর নাগাদ , যেখন বেশিরভাগ পুরুষ নেশায় একেবারে টং । শ্রীকৃষ্ণ নাকি ভাঙ খেয়ে দোলের দিন গোপীকাদের জন্য সহজলভ্য ছিলেন। শিবরাত্রীর দিনও ইমলিতলার উপোসি বাসিন্দারা ভাঙের শরবত পান করে গলির রাস্তায় গড়াগড়ি খেত । ওইভাবে শিবের ধ্যান করত বাসিন্দারা । ভাঙের নেশা একটু দেরিতে শুরু হয় । মনে হবে ঘাড়ের ওপরে মাথাটা নেই ; ধড় হয়ে হাঁটছি ।



ফাল্গুনীর সঙ্গে বেরিয়ে, পাটনা স্টেশানের ঠেসাঠেসি ভিড়ের ওই ঘিঞ্জি গলিতে এক ট্রিপ দিয়ে, গঙ্গার ঘাটে গিয়ে আড্ডা মারতুম দুজনে । কিংবা চলে যেতুম গোলঘরের ছাদে চিলতে-মতো জায়গায় বসে আড্ডা দেবার জন্য । অ্যালেন গিন্সবার্গ যখন এসেছিলেন তখন ওনাকে গোলঘরে নিয়ে গেলে উনি ঘরের ভেতরে ঢুকে 'সানফ্লাওয়ার' কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন । পাটনার মিউজিয়ামে গিয়ে ঘোরাঘুরি করতেও ভালো লাগত ফাল্গুনীর । আমার বড়োজ্যাঠা এই মিউজিয়ামের 'কিপার অব পেইনটিংস অ্যান্ড স্কাল্পচার' ছিলেন বলে আমি ছোটোবেলায় ছুটির দিনে চষে বেড়িয়েছি মিউজিয়ামের আনাচ-কানাচ । তাই ফাল্গুনীর যতটা আগ্রহ ছিল, আমার ছিল না । নিখুঁতদেহ পাথরের নারীমূর্তিগুলো খুঁটিয়ে দেখত ফাল্গুনী । মনে হত প্রেমিকার ঝলকটুকু নবীকরণ করে নিচ্ছে । মিউজিয়াম দেখতে-আসা যুবতীদের দিকে তাকিয়ে দেখত না । আমি একদিন প্রসঙ্গটা তুলেই ফেললুম ।

উত্তরে ফাল্গুনী বলেছিল, 'না হে মলয়, আমি আজও ভার্জিন , আর বোধহয় মরার সময়েও ভার্জিন থাকব ; যিশুখ্রিষ্টের মতো ।'


কলকাতায়, বরানগরের বাড়িতে, চিলেকোঠায় ওর ঘরে, যিশুখ্রিস্টের একটি ছবি ছিল । ছবিটিতে জড়ানো থাকত একটি নকল কালো সাপ ।