বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

কাশকন্যা ও কাপুরুষের কথা

কাশকন্যা ও কাপুরুষের কথা
সৈয়দ সাইফুর রহমান সাকিব


পুরাণ থেকে নারী বিষয়ক একটা গদ্য লেখা লিখবার জন্য আমাকে বলা হয়েছে শুক্রবারের এই সকালে চায়ে মুখ পুড়ে মেজাজটা এমনিতেই তালগোল পাকিয়ে ফেলল। তার উপর মিথের চাপ। নেটবুকটার দিকে হাত বাড়াবো ভাবছি এমন সময় গিন্নির কন্ঠে ঝাঁঝ! আর কি! বাজার! সপ্তাহের এই দিনটিতেই মুলতঃ যতটুকু সময় মেলে। কি আর করা লেখা মাথায় হাতে বাজারের ব্যাগ। দরজায় দাঁড়িয়ে আরেকটি ধারালো বক্তব্য রিকশা নেবে না হেঁটে যাও। ইদানিং মুটিয়ে যাচ্ছি। দৃষ্টিতে আগুন আরো একবার। এবার নিশ্চয় সিগারেট সম্পর্কীয় নিষেধাজ্ঞা। মাথার ভেতর একপাশে ‘প্রাচ্য পুরাণ’ সীতা-সাবিত্রী, দ্রৌপদী, কুন্তি কিংবা গান্ধারী আর অন্যপাশে স্বর্গের প্যান্ডোরা নাকি হেরা। বেদ ও উপনিযদ, উপবেদ, বেদান্ত, স্মৃতি সংহিতা, গীতা, পুরাণ, আগমশাস্ত্র, রামায়ণ ও মহাভারত, চন্ডী, ষড়্দর্শন কোথায় যাব? নাকি নরনারীর চিরন্তন প্রেম-উপাখ্যান কচ ও দেবযানী, রাধা-কৃষ্ণ, সীতা-রাম, দ্রৌপদী ও পঞ্চপান্ডব, দুষ্মন্ত-শকুন্তলা, শিব-পার্বতী, অর্জুন-চিত্রাঙ্গদা, আম্রপালী-বিম্বিসার, সাবিত্রী-সত্যবান, বেহুলা-লখিন্দর, দময়ন্তী ও নল, সত্যবতী ও শান্তনু, অনসূয়া ও অত্রির সম্পর্ক, প্রেম, বিরহ থেকে ঝেড়ে দেব। হায়রে মিথ আমাকে কোনো বিপদে ফেললি বলতো নাকি পত্রিকা থেকে তুলে দেবো- ‘সম্প্রতি ন্যাশানাল ওয়াইল্ডলাইফ এসোসিয়েশন এই নদীটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর নদীর খেতাব দিয়েছে। নদীটির নামকরণ করে স্প্যানিশরা। গ্রীক পুরাণে বর্ণিত সর্বকালের সবচেয়ে শক্তিশালী নারীরা হলেন ‘আমাজন’। আর তাদের নামেই নামকরণ করা হয়েছে প্রমত্তা এ নদীটির।’ কি হলো দাঁড়িয়ে আছ কেন?। আমি আমাজনের স্রোত দেখতে পেলাম। সংসারের ঘানি টানা বলে কথা। টেনে যাচ্ছে।সুখের সংজ্ঞা খুঁজতে খুঁজতে আজকাল শরীরের লতানো ভাবটা ছন্দ হারাচ্ছে। প্রেমের মতো অতিমূল্যবান আবেগকে দায়িত্বে বেঁধে ফেলেছে। তাই নিত্য নতুন সমস্যার উপসর্গে ভালোবাসা শক্ত হাতে সামাল দিতে পারে। এর অবশ্য আরো একটি কারণ আমার অনেকক্ষেত্রে উদাসীনতা। শরীরের এই কবি ভাব মুলতঃ দায়ী। আসলেই কি তাই? এটি একটি এড়িয়ে যাবার মতো ব্যাপার। ফাঁকি দিলাম বটে।

প্রায় সাত বছর হবে আমাদের বৈবাহিক জীবন। আমার স্ত্রী বেশ শক্তভাবেই সামাল দিচ্ছে। বোধকরি আমার ঔদাসিন্য সেকারণেই। চোখের সামনে সবকিছু আছে তবুও কিছু্ই খুঁজে না পাওয়াটা যেমন আমার রোগ তেমনি কোমরে আঁচল গুঁজে গিন্নিপনায় তার হাত যশ। বেশ উপভোগ্য তাই না!

প্রেমটা করিনি হয়ে গিয়েছিল। ঠিক বুঝিয়ে বলছি। এ হচ্ছে একসংগে চলতে চলতে নির্ভরতা, বিশ্বাস জন্মানো আর কি। আমরা ভালো বন্ধু। আহামরি না হলেও দেখতে সুশ্রী। বিয়েথা আসে কথা এগোয়, ভাঙ্গে, আবার আসে। হয়ে যাবে বললাম একদিন। আমার বিয়ে হলে তুমি খুব খুশী হও? ঠিক বুঝতে পারিনি সেদিন তার কথা। হেসে বলেছিলাম কেন হবো না! এই কেন হবো না পরে আমাকে ভাবিয়েছিল অনেক। তখন তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এনগেজমেন্ট রিং আদান প্রদান শেষ। তবু তার চোখে জল। পরস্পরের নির্ভরতা, বিশ্বাস ভালোভাবেই জানান দিয়েছে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। এনগেজমেন্টের আগে আমার কাছে এসেছিল। বলল তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমি বলেছিলাম চল আজ তাহলে সারাদিন ঘুরি। তোমাকে তো আর পাওয়া যাবে না। কর্পোরেট অফিস পাড়ায় ব্যস্ততা রয়েছে। তবুও এতদিনের বন্ধুর কাছে থাকতে চাওয়াটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমার কাছে। বেলা বাড়ছিল আর আমার বাড়ছিল আকুলতা কাছে পাবার। এর জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না যখন সে বলল যাচ্ছি, ভালো থেকো আর একটা অনুরোধ রাখবে? কি? সিগারেট খেয়ো না! ঠোঁট কালো হয়ে গেছে। ও চলে যাচ্ছে। সিগারেট ধরা হাতটা কেঁপে উঠলো। আমি প্রথম টের পেলাম আমি ওকে ভালোবাসি। রিকশার এত গতি যে ওকে দ্রুতই চোখের আড়ালে নিয়ে গেল। ব্যটারীর চার্জ ফুরিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোনের বাটনে ঘুরে বেড়ালাম অযথাই কিছুক্ষণ। বৃথা আস্ফালনে সিগারেট পুড়লো হাত। এতটা ভালোবাসি ওকে!

বিস্ময় লাগার আগে স্বাক্ষর তৈরী করা ভালো। এটা বোঝার সময় পার হয়েছিল। বড্ড দেরী হয়ে গেছে। এখন আর কি করা মেনে নেয়া ছাড়া। মেনে আমি নিতাম। যদিনা এর পরের ঘটনাগুলো আমাকে তাড়িত না করতো। ঘটনাক্রমে তুচ্ছ কারণে কর্পোরেট মিডিয়া-এ্যাড ফার্ম ছাড়লাম হাতে কোনো কাজ নেই আপাততঃ। নাটকেও মন নেই। তবু গ্রুপে আড্ডা দিয়ে বোরিং সময় পার করে বেড়াচ্ছি। একই পাড়ায় বাসা। দেখা হয়ে গেল। ঠিকমতো তাকাতে পারছি না। বুকটা হু হু করে উঠল। আমাকে বলল তুমি এমন হয়ে গেছ কেন? ওর কান্নাটা যেন নদীর জল তবে জোয়ার থাকে সবসময়। একটুতেই কেঁদে ফেলে। আমি বললাম কাঁদছো কেন! আমি ভালো আছি। দেখতেই তো পাচ্ছি। শুকিয়ে গেছো অনেক। চোখ মুছতে মুছতে বলল আমার সাথে চল কথা আছে। আমার কি তোমার সাথে যাওয়াটা ঠিক হবে। শোন আমার এখনও বিয়ে হয়নি। এ সমাজে এনগেজমেন্ট মানেই বিয়ে তুমি তা এড়াতে পার না। আমিই সমাজ তুমি এসো। এরপর পাশে পাশে দ্বিধা নিয়েই হাটি। তখন শরতের শেষ। প্রজেক্টের মাঠে কিছু কিছু কাশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার চোখে চোখ রেখে বলল তুমি আমাকে ভালোবাস এ কথাটি এতদিনেও বলতে পারলে না! গত একমাস তোমার এই কথাটি শুনবার জন্য প্রতিটি মুহূর্ত অপেক্ষা করেছি। আমি বললাম এখন আর হয়না বড্ড দেরী হয়ে গেছে। তাছাড়া বাসায় ম্যানেজ করবো কীভাবে। ঠিক আছে আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। তুমি এই সমাজ সংসার ম্যানেজ করবে কিভাবে? তুমি শুধু মুখে একবার বলো আমাকে ভালোবাসো। ভালোবাসি বললেই সবকিছু ম্যানেজ হয়ে যাবে। খুব কঠিন তানি। মাথা গরম কোরো না। তুমি অন্যরকম নিভৃতে শেষ হয়ে যাবে। তবু কাউকে কিছু বলবে না জানি। আমি তা হতে দেবো না। তুমি শুধু বল আমাকে ভালোোবাস কি না? হ্যাঁ আমি তোমাকে ভালোবাসি। এরপর সেদিনই প্রথম শরতে মুষলধারে বৃষ্টি দেখলাম।

ধৈর্য থেকেই মানুষের সকল আবিষ্কার। সফলতায় উৎকৃষ্ট ফলাফল দেখেই তবে মানুষ শান্ত হয়। একপর্যায়ে যখন হালটা এবার চেপে ধরবো ভাবছিলাম। ঠিক তখনই বাবা শর্ত দিলেন যদি ঐ মেয়ে সমাজকে মানাতে পারে ফ্যামিলির অবস্থান সমাজে ঠিক রাখতে পারে আর সমাজের সামনে বিয়ে ভেঙ্গে আসতে পারে তবে আমি ঐ মেযেকে মেনে নিতে পারি। বুঝতে পারি এতদিন এত কষ্ট করে যে বাবা মা লালন পালন করেছেন তাদেরওতো কিছু প্রত্যাশা থাকতে পারে আমার কাছে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণের জন্য আমি অন্যকিছু করতে রাজী আছি। কিন্তু একগাদা অর্থকে আমি বিয়ে করতে পারবো না। মুলতঃ কিছু জমিজমা লাখ লাখ টাকা আমার জন্য প্রত্যাশা করেছিল তখন। আর মধ্যবিত্ত বাবা মা সেই নির্ভরতাতেই নিবিষ্ট ছিলেন। তাই আমার বাবার ভাষ্যমতে এ যুগে কোনো মেয়েই বোধহয় ভালোবাসার জন্য এটা করবে না। তুমি তাকে বলে দেখতে পার। তার মতো পালটে যাবে। তখন হয়ত তোমার ভ্রম ভাঙ্গবে। কারণ পরস্পর আবেগে হয়ত তোমরা সাময়িকভাবে বাস্তবতা চ্যুত। লোকচক্ষুর আড়ালে অনেক কিছুই সম্ভব। কিন্তু সমাজের সামনে এসবই ঠুনকো। আশা করি দ্রুতই বুঝতে পারবে। এ কথাই তন্ত্রীতে বাজাতে বাজাতে তানির সামনে উপস্থিত হলাম।

আমি সর্বদাই পৌরুষের রূপ, রস, গন্ধ থেকে বীরত্ব দেখবার প্রতিযোগীতায় পেছনের সারির এক মানুষ। দ্বিধান্বিত কাপুরুষ বললেও ভুল হবে না। তবু কেন এই মেয়েটি আমাকে ভালোবাসলো আমি মাঝে মাঝে এখনও ভেবে পাই না। মিথজ জ্ঞানের পরিধি থাকলে হয়ত জ্ঞাতে উদাহরণ দেয়া যায় উদাহরণ হওয়া যায় না। কিন্তু তানি বোধহয় পেরেছিল। প্রতিদিন ঐ এনগেজমেন্ট রিংধারীকে ইটালীতে ধরে রেখে তার পরিবারকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়া। বাসায় অসন্তোষ কাটিয়ে আমার ব্যাপারে উৎসাহিত করা আর সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখবার প্রস্তুতি যখন শেষ ঠিক তখনই আমার বাসায় আমাকে স্ট্রেইট বলে দিলো ঐ মেয়ে নয় অন্য কেউ হলে বল। আর তুমিতো এখন কিছুই কর না। বউকে খাওয়াবে কি? বাস্তবতা! মাথা ছিড়ে যাবার যোগাড়।

তানির সাথে ফের দেখা। ওর উচ্ছল চোখে এখন স্বপ্ন পূরণের স্বর্ণলতা বেয়ে উঠে যাচ্ছে। অথচ আমার ভেতর শীতের প্রকোটে মরা কাঠ হয়ে মন মরে আছে। কি বলবো আমি ওকে? কি বলা যায়? উচ্ছাসে সে যখন বলল আমি পেরেছি। তুমি বাসায় গিয়ে বল।ওনারা এবার আসুক। সেই প্রথম আমার চোখ বেয়ে জল বেরিয়ে আসলো। শুধু বললাম তারা আসবে না। কিন্তু তোমার বাবা মা আমার বাবা মাকে ছাড়া বিয়ে করতে পারবো না। একটা সঞ্জীবনী আগুনে আমাকে পুড়িয়ে বলে গেল, সেই ছেলেটি সবকিছু জেনেও আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল চাইলে সেটা এখনও সম্ভব কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি বিয়ে যদি করি তোমাকেই করবো তবে অন্য কোনোভাবে নয়। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো যদি পার তৈরী হয়েই এসো।

হায় ব্যর্থ মানুষের জীবন। কাপুরুষ! কাপুরুষ! কাপুরুষ! ধিক্কারে যখন আগাছার মতো দাড়ি জমে গেল। বসন্ত ছুঁই ছুঁই করছে তখন। আত্মহত্যা করার মতো সাহসও বোধহয় আমার নেই। হাজার বাধা সত্ত্বেও অন্য যায়গায় কথা পাকাপাকি চলছিল। শেষে ভাবলাম অন্তত যাকে ভালোবাসি তার সাথে এতবড়ো অন্যায় কি করে হতে দেই। আমি কি পারি না! পারতেই হবে। ভগ্নিপতির সাহায্যই নিতে হলো। তিনিই এখন আমার গুরুজন কি আর করা। অবশেষে তানির সামনে দাড়ালাম। এই এক মাসে পাঁচ বছর বয়স যেন ওর বেড়ে গেছে। নাহ্ আর দেরী নয়। যা হবার হবে। আমরা হাত ধরলাম। অবশ্য এর পরের গল্প আরও কষ্টের বাস্তবতার ঘাত আমাদের অনেক পুড়িয়েছে। আমরা শুধু এগিয়েছি। থামিনি কোথাও। শুনবে? থাক। বলবো না হয় অন্য কোনো সময়।