বুধবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৪

প্রবন্ধ – সুমন গুণ

শহিদদিবসের কবিতা
সুমন গুণ



বাংলা কবিতায় মণিভূষণ ভট্টাচার্যের একটি সম্ভ্রান্ত অবস্থান আছে। আমাদের ভাষায় যাঁরা শুধু স্বাভাবিকভাবে কবিতা লিখে নিজের কণ্ঠস্বর মুদ্রিত করতে পেরেছেন, গল্প-উপন্যাস নয়, কবিসম্মেলন নয়, রাইটার্স নয়, টেলিভিশন নয়, টরন্টো নয়, এমনকি সেভাবে গদ্যও নয়, শুধু কবিতা লিখে যা বলার বলে যেতে পেরেছেন, মণিভূষণ ভট্টাচার্য সেই গুটিকয় বিস্ময়ের একজন।

আমি যখন সবে লেখালেখি শুরু করছি, আশির শেষ আর নব্বইয়ের শুরুর দিকটায়, তখন মণিভূষণের আসল বইগুলো সব বেরিয়ে গেছে। বেরিয়ে গেছে ‘গান্ধিনগরে রাত্রি’র মতো দাপুটে কিন্তু মসৃণ, শাণিত আর তীব্র, প্রবল অথচ সংহত একটি বই। যত দিন যাচ্ছে, বইটির আঁচ তত বেশি করে টের পাচ্ছি আমরা। সময়ের নানা ক্ষত আর ক্ষতি নিয়ে লেখা কবিতা তো আমরা খুব কম পড়িনি বাংলায়, কিন্তু সত্তর দশকের বাংলার দহন আর বিপন্নতাকে যে-দক্ষতায় ধরেছেন মণিভূষণ ভট্টাচার্য তাঁর কবিতায়, তার মন্দ্রতার সঙ্গে তুলনীয় লেখা আমি অন্তত খুব বেশি পড়িনি। ‘গান্ধিনগরে একরাত্রি’র মতো সেই মিতবাক কবিতাটির কথা মনে করুন! কবিতাটির নামের মধ্যেই বিপুল ধিক্কার আর ব্যঙ্গ ঐতিহাসিক ব্যঞ্জনাসহ গনগন করছে। আর কবিতাটি তো হয়ে উঠেছে সেই সময়ের একটি অবধারিত প্রচ্ছদ। এত ছোটো কবিতায় যে কী করে এত বড়ো একটা প্রসঙ্গকে ছুঁয়ে দিলেন তিনি! মাত্র চারজনের একলাইন করে মন্তব্য দিয়ে একটা উদ্দাম আন্দোলন সম্পর্কে গোটা সমাজের চাহনি একনজরে দেখিয়ে দিলেন তিনি :
অধ্যাপক বলেছিল , দ্যাট্‌স্‌ র-ঙ্‌, আইন কেন তুলে নেবে হাতে?
মাস্টারের কাশি ওঠে কোথায় বিপ্লব, শুধু মরে গেল অসংখ্য হাভাতে!
উকিল সতর্ক হয়, ‘বিস্কুট নিইনি, শুধু চায়ের দামটা রাখো লিখে’।
চটকলের ছকুমিঞা ‘এবার প্যাঁদাবো শালা হারামি ও. সি-কে’
আমার মোটেই কবিতার লাইন মনে থাকে না, কিন্তু আশ্চর্য, এই চারটি লাইন আমি পুরো স্মৃতি থেকে লিখলাম। লিখতে পারলাম, তার কারণ তখন এইসব উচ্চারণ বারবার পড়তাম। তখনো সোভিয়েত-পূর্ব ইওরোপ ভাঙেনি, আদর্শ বলে একটা শব্দ তখন খুব আক্রমণ করত আমাদের, বামপন্থা নামে একটা ধারণা আমাদের সবসময় আগলে রাখত। মণিভূষণ তাই টানত আমাদের। না চাইতেই কণ্ঠস্থ হয়ে যেত এইসব লাইন:
খরায় উজাড় গ্রাম--- প্লাটফর্মে পড়ে থাকে হাজারে হাজারে
না খেয়ে মানুষ মরে---‘অপুষ্টিজনিত মৃত্যু’ লেখা হয় আনন্দবাজারে

কিংবা

কাল যে বিপ্লবী ছিল আজ সে-ই মন্ত্রী হয়, মন্ত্রীত্ব খোয়ালে হয় বহুরূপী নেতা
কাল যে ঘাতক ছিল আজ সে-ই প্রকল্প-প্রণেতা

একই কবিতায় :
ছোটো ভাই মাঝরাতে মাঝে মাঝে আসে, খেয়ে যায়--
চটকলের লোকজন গভীর উদ্বেগ নিয়ে জেনে নেয় ভাইয়ের খবর,
কেবল বেড়ার ফাঁকে হঠাৎ বুটের শব্দে মায়ের বুকের রক্ত হিম
ধুপকাঠি তৈরি করে আমাদের পাড়ার মহিম
অথবা, স্বাধীনতা দিবসের উত্তোলিত পতাকার দিকে তাকিয়ে নিরন্ন ভারতবাসীর ‘এতখানি রঙিন কাপড়’ নষ্ট হয়ে গেল বলে সেই অসহনীয় খেদোক্তি ।

ব্যঙ্গ আর কৌতুকের পরিবহন ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়ে অসাধ্য সাধন করেছেন মণিভূষণ বহু কবিতায়। রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত অসততার বিরুদ্ধে, ভন্ডামির বিরুদ্ধে, নস্টামির বিরুদ্ধে তাঁর ক্রোধ অনেক সময় সরাসরি উচ্চারিত না হয়ে ব্যঙ্গ বা ধারালো কৌতুকের আশ্রয় নিয়েছে। এর ফলে তার ধার বেড়ে গেছে আরও। আর যখন সেই ক্রোধ সরাসরি উচ্ছ্রিত হয়েছে, তার উত্তাপ হয়েছে অলঙ্ঘ্য। ক্রোধ কত পবিত্র হতে পারে, বাংলা কবিতায় সুকান্ত আর মণিভূষণ ভট্টাচার্য তা বারবার চিনিয়ে দিয়েছেন। ‘দক্ষিণ সমুদ্রের গান’ বইয়ের ‘দধীচি’ কবিতায় জনৈক সরকারি আমলার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যেভাবে গর্জে উঠেছিলেন এক আমূল বিপ্লবী, তা পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দেয় :
কলম ছুঁড়ে দিয়ে ফর্‌ম্‌টা ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো ক’রে সেক্রেটারির
মুখে উড়িয়ে দিয়ে চিৎকার ক’রে উঠলেন ---
‘স্কাউন্ড্রেল্‌স্‌, আমাকে এভাবে ইন্‌সালট করার মানে কী?
আমি প্রাক্তন বিপ্লবী নই , এখনো বিপ্লবী’
এই কবিতাটিতে নাটকীয়তার যে-গড়ন রয়েছে, মণিভূষণের কবিতার সেটা একটা প্রখর বৈশিষ্ট্য। তাঁর তরুণ বয়সের অনেক বন্ধুই ছিলেন আদ্যোপান্ত নাটকের লোক, এটা আমি বিশেষ সূত্রে জানি। আর ষাট-সত্তর দশকে বিপ্লবী নাটকের সঙ্গে একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল বিবেকী শিল্পীদের। নাটক আর কবিতার সখ্য তাই স্বাভাবিক ছিল তখন। মণিভূষণের কবিতাকে এই নাটকীয়তা আরো পরাক্রান্ত করেছে। ‘কোনো কবিসম্মেলনে’ নামে পুরো নাটকীয় ভঙ্গিতে লেখা একটা দীর্ঘ কবিতা আছে মণিভূষণের, গোটা কবিতাটি একটুও টোল না খেয়ে বিস্ময়করভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। নাটকীয়তার দমকে মাঝে মাঝেই তৈরি হয়েছে এক-একটা বাঁক। প্রতিটি বাঁকের আঘাতে পাঠক নতুন করে সচকিত হয়ে ওঠেন। এটা ঠিক দুটো-তিনটে লাইন তুলে বোঝানো যাবে না, গোটা কবিতাটি এক নিরবচ্ছিন্ন দমকে লেখা। তবু একটা অংশ তুলছি, যেখানে এই নাটকীয়তার সর্বোচ্চ বৈচিত্র্য টের পাওয়া যাবে :
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ঔরসজাত লাবণ্যের ঘনঘটা আপনাদের চামড়ায় –
মার্কিনী মাধুর্যে বিগলিত হাড়ে-বজ্জাত ঠগচাচা এবং ঠগচাচির দল,
না হলে আপনাদের চোখের সামনে আসানসোল মেদিনীপুর দমদম প্রেসিডেন্সিতে
কেবল রক্তের দাগ, অকাতর তরুণ রক্তে কেন ভেসে যায় জেলের উঠোন---
বিশ্বাস করুন, আমি আপনাদের পটাতে চাইছি না, কোনো রকম
বিবেকের ফুসলানির মধ্যে আপনাদের মতো সরেস মালদের টানতে
চাইছিনা আমি--- কারণ ইতিহাস আপনাদের জন্য ভয়াবহ অ্যাপ্রোচ পেপার
তৈরি করেছে, সুতরাং সমস্ত লাম্পট্য বাঁটোয়ারা করে নেওয়া যাক –-
(হিস্‌সার জন্য নিজেদের মধ্যে লড়িস না গুরু, মেজোবাবু প্যাঁদাবে)।
এই নাটকীয়তার গমকে লেখা আর একটি স্মরণীয় কবিতা ‘ডানকানের মৃত্যু’। এখানেও বলার ভঙ্গির ভাঁজ পালটে পালটে এগিয়ে গেছে কবিতাটি। রূপকের অনায়াস আর তির্যক ব্যবহারে মণিভূষণের দক্ষতার সেরা নজির এই কবিতা। পেশল, রুক্ষ আর নৈর্বক্তিক ধরনটি গোটা কবিতায় সফলভাবে রক্ষা করেছেন তিনি। ‘কোনো কবিসম্মেলনে’র চেয়েও অনেক সংহতভাবে। এই কবিতাটিও এত অবিচ্ছিন্ন আর টানটান যে কোনো একটা অংশ তুলে এর জোর বোঝানো অসম্ভব। তবু কয়েকটা লাইন তুলে এই ধরনের লেখায় মণিভূষণের তুখোর দাপট টের পাওয়া যেতে পারে :
খিদেয় নেতিয়ে-পড়া কনিষ্ঠ কঙ্কালগুলো দলা পাকিয়ে
ঘুমিয়ে পড়েছে। বিরক্ত বয়স্করা ঝিমুচ্ছে। মধ্যরাত্রির এই পচনশীল
নৈঃশব্দ্যের দিকে, নিবন্ত উনুনের পাশে গরমমশলার সুদূর গন্ধের মধ্যে
হে অন্ধ অধিরাজ, আপনাকে বসিয়ে রাখবো; মনে রাখবেন, পরিবেশনের
ভার আপনাদের উপর; জানি, অসমবন্টনে আপনার কতো শ্রান্তি! তবু,
মেটের টুকরোগুলো বাচ্চারাই যেন পায়।
গন্ধের ‘সুদূর’ বিশেষণটির বহুতল সম্ভাবনা খেয়াল না করে পার পাওয়া যাবে না। শেষ লাইনটিতে এসে কথার গমক যেভাবে হঠাৎ বেঁকে গেল, তাও আমাদের মুহূর্তে সচকিত করে তোলে।

আসলে, প্রত্যক্ষভাবে সমাজপ্রবণ যে ধারা আছে বাংলা কবিতার,ভেবে দেখেছি, তার কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে। ব্যঙ্গ বা কৌতুকের বহুগামী ঝোঁক, নানা সূত্রে ব্যবহৃত বাক্য বা মন্তব্যের প্ররোচনাময় উদ্ধৃতি, একধরণের উদ্দেশ্যমূলক নাটকীয়তা সহ আরো কয়েকটি প্রবণতা এই ধারার কবিতায় সহজেই নজরে পড়বে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে শঙ্খ ঘোষ, জয়দেব বসু পর্যন্ত সবার কথা মনে করলেই এই কথার মানে ধরা যাবে। উচ্চারণে ঘন ও স্তরবহুল নাটকীয়তার দীর্ঘ বিন্যাস মণিভূষণের মতো জয়দেবেরও বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘ কবিতার উদারতায় ইচ্ছেমতো ভাঁজ ও বক্রতা রচনা করা যায়। কথার চুড়ো বেঁধে আবার খুলে মেলে দেবার আহ্লাদ টের পাওয়া যায়।

মণিভূষণের ‘একটি শ্লোগানের জন্ম’ কবিতাটি পড়তে পড়তে আমার শঙ্খ ঘোষের ‘স্লোগান’ আর জয়দেব বসুর "মায়াকোভস্কির শেষ সাতদিন" কবিতাদুটির কথা মনে পড়ে যায়। মণিভূষণ লিখেছিলেন :
যখন পড়ি, ‘কমরেড কানু সান্যালকে জেল ভেঙে ছিনিয়ে আনুন’ ---
তখন ভাবি এরা অন্যের উপর দায়িত্ব দিয়ে
চলে গেলেন কেন? কিংবা আলকাতরা এবং ব্রাশের নৈশসংঘর্ষে
যখন দেয়ালে ফুটে ওঠে, ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ তখন
ক্ষমতার আগে ‘রাজনৈতিক’ শব্দটা নেই বলে আমি আঁতকে উঠি এবং
খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ি...
এর পাশাপাশি শঙ্খ ঘোষের ‘শ্লোগান’ কবিতাটি মনে করুন :
এমনিভাবে থাকতে গেলে শেষ নেই শঙ্কার
মারের জবাব মার

বুকের ভিতর অন্ধকারে চমকে ওঠে হাড়
মারের জবাব মার

বাপের চোখে ঘুম ছিল না ঘুম ছিল না মার
মারের জবাব মার

কিন্তু তারও ভিতরে দাও ছন্দের ঝংকার
মারের জবাব মার
লক্ষণীয়, দুটি দেয়াললিখন প্রসঙ্গেই কবির সপ্রশ্ন অস্বস্তি রয়েছে। শঙ্খ ঘোষের কবিতাটিতে এই অস্বস্তি রূপ নিয়েছে সব্যঙ্গ অথচ নিঃশব্দ প্রত্যাখ্যানের। শ্রেণি-ঘৃণার দুটি স্লোগানই (‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’, ‘মারের জবাব মার’) একসময় বাংলাপ্লাবিত ছিল। এই প্লাবন এবং তার জোয়ারে ভেসে-যাওয়া সময়ের নানা চিহ্ন ‘স্লোগান’ কবিতাতেও ধরা পড়েছে। সেন্ট্রাল জেল কিংবা কার্জন পার্কে ঝরে যাওয়া সোনার ছেলেদের স্মৃতিকণা ঝলক দেয় ‘বুকের ভিতর অন্ধকারে চমকে ওঠে হাড়’-এর কথায়। স্মৃতির লালন আর নির্মম মৃত্যুকে একই সঙ্গে ধরে রেখেছে ‘হাড়’ শব্দটি। আর তারপরেই ‘মারের জবাব মার’ অসহায় বৈপরীত্যে চলকে ওঠে।
জয়দেবের ভাষ্য ছিল এইরকম :

'কে জানে কতদিন আমি বাস করছি
বিছানাভর্তি ছারপোকার সঙ্গে,আর
স্বপ্নে দেখছি হতাশাব্যাঞ্জক,ভীতিপ্রদ কয়েকটা শব্দ;
দেখছি - 'পার্টিলাইন' কথাটা কেটে দিয়ে লেখা হচ্ছে
'জমায়েত' আর 'মহামিছিল'।
'গণতন্ত্র' কেটে দিয়ে 'প্যানেল এবং পাল্টা প্যানেল',
'যোগ্যতা' কেটে দিয়ে - 'কালেকশান',
আর,'বিপ্লব' শব্দটা কতদিন দেখিনা...কতদিন?'
শব্দের এই বিপন্ন সংশোধনের সান্নিধ্য লক্ষ করার মতো।

‘গান্ধীনগরে রাত্রি’ বইয়ের খরতায় যে-মসৃণতা ছিল, ‘মানুষের অধিকার’ বা ‘দক্ষিণ সমুদ্রের গান’-এ তা ঈষৎ কমে এলেও কোনো কোনো কবিতায় তা আরো দ্রুত আর সাবলীল হয়ে ওঠে। ‘মানুষের অধিকার’-এর ‘সুকান্ত ভট্টাচার্যকে খোলা চিঠি’ পড়লে তা বোঝা যায়। বোঝা যায় ‘দক্ষিণ সমুদ্রের গান’-এর ‘ফেরা’, ‘দধীচি’ কবিতাগুলি পড়লে। এই দাপুটে সাবলীলতার শীর্ষ ‘সুকান্ত ভট্টাচার্যকে খোলা চিঠি’ পড়লে টের পাওয়া যায়। পণ্যপ্রবণ এই সময়কে আমাদের ভাষার অনেক ক্ষমতাবান কবি তাঁদের মতো করে কবিতায় বিদ্ধ করেছেন। তাঁদের নিজস্ব স্বর ও ব্যঞ্জনায় সেই সব উচ্চারণ আলাদা হয়ে উঠেছে। নিওন আলোয় আমাদের যা কিছু ব্যক্তিগত সব পণ্য হয়ে ওঠে , আমাদের মুখ ঢেকে যায় নির্মম বিজ্ঞাপনে, একথা তো আজ প্রবাদের মতো উচ্চারণ করি আমরা। মণিভূষণও লেখেন একই তথ্য, তাঁর স্বাধীন আর ভরাট ভঙ্গীতে :
এই কোটি কোটি পিছু-মোড়া-হাত-পা-বাঁধা ক্রীতদাসের বাজারে
সব কিছুই পণ্য---
এই মৌসুমী অঞ্চলে ফুল ও ফল,
ঐ বাতাসা হাতে ছুটন্ত শিশুটির চিবুকের তিল,
এই জবরদস্তি জীবনের সমস্ত লবঙ্গ ও এলাচ
ঐ রোদে পোড়া ফুটপাতে ডান হাতের আঙুলকাটা আসন্নপ্রসবা
ভিখিরি মেয়েটির চিত্রকল্প,
নিঃস্বের ন্যাকড়া কিংবা পণ্ডিতের মগজ,
এমনকী তোমার জন্মদিনও
পণ্য।
মৌসুমী ফুল, শিশুটির চিবুকের তিল, জীবনের গোপন সুগন্ধের কথা বলেই মণিভূষণ থামতে পারেন না। তাঁর মনে পড়ে যায় ভিখিরি মেয়ের কথা, আসন্নপ্রসবা কথাটি মণিভূষণ অকারণে লেখেননি। সময়ের যে-সুডৌল ভবিষ্যতের দিকে তাঁর নজর, তার ইশারা দিতে তিনি সবসময় তৎপর। এটা একটা আলাদা আলোচনার বিষয় হতে পারে যে কীভাবে মণিভূষণ সমতাময় আসন্ন সমাজের দিকে শব্দের তর্জনী তুলে ধরেন। সদ্যোজাত, লাল ডাকবাক্স, বাঁ হাত, সিন্ধুসারসের গান, বড়ো শহর, দক্ষিণ সমুদ্র, সন্ন্যাসী এবং এইরকম অনেক শব্দ মণিভূষণের কবিতায় একটি নির্দিষ্ট তাৎপর্যে লেখা হয়।

কিন্তু, আমার মনে হয়, ‘দক্ষিণ সমুদ্রের গান’-এর পরের বইগুলোতে মণিভূষণের এই তেজ, এই তারুণ্য আস্তে আস্তে শমিত হয়ে আসে। এটা তো ঠিকই যে একজন কবি সারাজীবন একই গমকে কথা বলেন না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, ভাবনাবদলের টানে, সচেতনতার হেরফেরে নানা বাঁকবদল ঘটে যায় লেখায়, এক পর্বের কবিতার সঙ্গে অন্য পর্যায়ের রচনার তফাৎ লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। এটা কখনো কখনো, কোনো কোনো কবির বেলায় সচেতন উদ্যোগের পরিণাম হতে পারে, কিন্তু মণিভূষণের লেখা ঠিক সেরকম কোনো উদ্যত চেষ্টার টানে পালটে গেল বলে আমার মনে হয়না। যে-কোনো কারণেই হোক, ক্রমশ, ‘প্রাচ্যের সন্ন্যাসী’ বইটি থেকেই মণিভূষণ তাঁর মোক্ষম ভঙ্গিটিকে নাছোড়ভাবে ধরে থাকলেও সেই আঁচ আর ভেতর থেকে জাগ্রত রাখতে পারলেন না। কথা এক রইল, ধরনটিও অক্ষত, শুধু শব্দ দিয়ে সেই কাজ আর করানো গেল না যা তিনি অবলীলায় করেছেন এতদিন। আর সেইজন্যেই, দেখা গেল, ব্যঙ্গ আর কৌতুকের পরিবহনও উধাও হয়ে গেল তাঁর রচনা থেকে। শব্দবিন্যাসের সক্ষম দাপট তিনি তারপরেও রক্ষা করেছেন, ভাষার কুশলী মোচড় তাঁর প্রতিটি কবিতাকেই অটুট রাখে। তারপরেও তিনি লিখেছেন এমন মহার্ঘ সব লাইন :
বড় এক গ্লাস চায়ে দু চুমুকে তৃপ্তি পায়
গুলজার একুশ শতক,
ক্রমশ তলানিটুকু শেষ করে
গিয়ারে বাঁ হাত রেখে
ডানহাতে ধরে স্টিয়ারিং,
সামনে হাজার মাইল অসহিষ্ণু দিন আর রাত্রি পড়ে আছে
চলন্ত প্রবাসে।
এখানেও বাঁ আর ডান হাতের শোচনীয় সহাবস্থান কত স্বাভাবিকভাবে সামনে আনা হল। লক্ষণীয় দিন আর রাত্রির উচ্চারিত ব্যবধানটুকুও। মণিভূষণের কবিতায় দিন আর রাতের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণভাবে আলাদা। দিন হয়ত ঘটমান বর্তমানের স্মারক, কিন্তু রাত রহস্যময় জটিলতা আর সম্ভাবনার সমাধানহীন অন্ধকারে ঢাকা।

কিন্তু এই ঘরানার কবিতার শীর্ষ তো আমরা ছুঁয়ে এসেছি ‘গান্ধিনগরে রাত্রি’ পর্বেই। তার পরের কবিতাগুলো সেই অনতিক্রমণীয় ধরনেরই সম্প্রসারণ। আমি এখনো অপেক্ষায় আছি, মণিভূষণ আবার আমাদের সেই মৌসুমী উত্তাপে ধীরে ধীরে পেকে-ওঠা লঙ্কার মতো লাল কবিতার আগ্নেয় ভূখণ্ডের দিকে নিয়ে যাবেন।