বুধবার, ১ জানুয়ারী, ২০১৪

গল্প – শুভেন্দু ধাড়া

কালপুরুষ
শুভেন্দু ধাড়া



( ১ )

গত তিন বছরে এই শহর কিছুই বদলায়নি তেমন । শুধু একটা বদলের হাওয়া দলা পাকাচ্ছে সারা শহর জুড়ে । আলিপুর থেকে তেঘরিয়া পর্যন্ত বাসে ফিরতে ফিরতে কত জায়গায় এই সেই বদলের স্লোগান দিয়েছে প্রতিটা মোড় তা ঠিক মনে পড়ল না । কিন্তু আদৌ হবে কিনা তা জানা নেই জয়দীপের । পঁচাত্তরে জন্ম হয়েছিল বলেই কি কমরেড হওয়ার সাধ জেগেছিল কলেজে? সেই আগুনের আঁচ কি তার রক্তে ঢুকিয়ে দিয়েছিল সময়? না কি সেও কিছু বদলের স্বপ্ন দেখেছিল আজকের বাতাসের মত ? না হলে কেন মিছি মিছি কলেজ লাইফে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া? মাঝে মাঝে ভাবত নিজে নিজেই কিন্তু সদুত্তর পায়নি কোনও দিন।

আর তাছাড়া আজ সে কোনও বদলের স্বপ্ন দেখে না । লোহার বেড়া ধরে স্বপ্ন দেখা বেমানান ছিল যে ! কমরেডের পোশাকটা তার দল কেড়ে নিয়েছে আগেই। মাঝে তিনটা বছর ! অনেকটা সময় । কিভাবে কেটেছে তা সে নিজে ছাড়া কেউ জানে না । জানার কথাও নয়। আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যায়, এটা যে শুধু জানে আর যার আগুনে হাত পুড়ে , দুজনের জানার কিংবা বোঝার মাঝে কিছু ফারাক থাকেই যদিও এখন সেটা অতীত ।

আজকেই সে সেই অতীতকে ছেড়ে পুনরায় ফিরছে ঘরে । কিন্তু কেন যে পরমা তাকে আনতে আসেনি সেটা কিছুটা হলেও ভাবাল । ভাবার কারণ ও আছে। গত চার মাস হল পরমার কোনও খবর নেই, কোনও দেখা সাক্ষাত নেই । অথচ মাসে এক দুইবার দেখা করতে আসত । বৃদ্ধ মা আসতে না পারলেও পরমা আসত খোঁজ নিতে ।

অনেকটা ভাঙ্গন বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জয়দীপের জীবনে পরমার মুখটাই ছিল শেষ দীপ। ফলে কিছু দুশ্চিন্তা আগে থেকেই ছিল না এমন নয়, তবু গেট থেকে বেরিয়ে অন্তত পরমাকে দেখতে চেয়েছিল তার চোখ । বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় ঘটনাটা ঘটলেও জয়দীপের আগের মতই আজও প্রেম পরমার প্রতি । ব্যস্ত শহরবাসীর ভিড় কাটিয়ে সামনের রাস্তায় দুরন্ত বেগে ছুটে চলছিল সারি সারি ছোট গাড়ি । অনেক মুখ হেঁটে যাচ্ছিল ফুটপাত বরাবর আপন আপন গন্তব্যে কিন্তু পরমাকে দেখা যায়নি ।

বাস থেকে নামল লোকনাথ মন্দিরের সামনে । ডান দিকের গলিতে ঢুকতেই রামের চায়ের দোকান । এই এলাকায় তাকে সবাই রাম দা বলেই চেনে এবং তার দোকানের চা বেশ ফেমাস । তাই ভর দুপুরেও বেশ ভিড় হয় । এখানে আগে সন্ধ্যায় সকালে চা আর সিগারেট চলত। এতক্ষণে একটা পরিচিত মুখ দেখে মনে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা খেলে গেল তার । অনেক দিনের খিদে ! কম নয় । সামনের বেঞ্চটায় বসে ঠিক আগের মতই হাঁক দিয়ে বলল – রাম দা , চা দাও তো এক খানি ।

আগে হলে রামকে এক হাঁকেই পাওয়া যেত। মাঝে একটা লম্বা গ্যাপ, ফলে কিন্তু আজ তার আওয়াজ রামের কান ঘেঁসে বেরিয়ে গেল । রাম অন্য ভিড় সামলাতে ব্যস্ত ছিল। ফলে আবার হাঁক দিল – রাম দা, একটা চা ।

এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রাম । কিছুটা অবাক হল, আবার কিছুটা আনন্দিতও হল জয়দীপকে দেখে । আসলে এই ছেলেটার সাথে তার একটা অজানা সখ্যতা ছিল। সেই অনেক বছর আগে থেকে, যেটা কিন্তু কোনও মতেই রাজনৈতিক নয়, মনের ভেতর থেকে। রামের খেটে খাওয়া দিন গুজরানে কোন দলের তেমন কোনও ভূমিকা নেই। আসলে রাখেনি সে সচেতন ভাবেই, আর এই জয়দীপ যখন চা খেতে খেতে নানা রাজনৈতিক কথা বার্তা বলত, তখন রাম শুনত । বোধ হয় ছোট বেলায় পড়তে না পারার বা কাল মার্ক্সকে না পড়ার খিদেটা মিটিয়ে নিত এর কাছ থেকেই । জয়দীপ এলাকার যুব নেতা , তবে মাথা বিকিয়ে দেওয়া নেতা নয়। মানুষের বিপদে আপদে পাওয়া যেত খুব সহজে তাই ভালো ছেলে বলেই পরিচিত ছিল সে । কিন্তু চক্রে ফেঁসে গেলে পরিচয় মুঝে যেতে বেশি সময় লাগে না । তবুও রামে’র মনে জয়দীপ আছে আগের মতই। কেননা অন্যান্য অনেকের মতই সেও জানে ছেলেটাকে ফাঁসানো হয়েছিল । সে কিছুটা চমকে ওঠে বলল

- আরে ! জয়... কবে ছাড়া পেলি?

- এইতো আজই । এখুনি বাস থেকে নামলাম । তুমি ভালো আছো তো ?

- আমার কথা থাক । তুই বল ? তুই কেমন আছিস?

কথাটা বলেই কিছুটা একটু থমকাল রাম । জেলে কেউ কি ভালো থাকে? থাকতে পারে? তাই চায়ের কাপটা জয়দীপের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে কথা ঘুরিয়ে বলল – ছাড় এই সব । তুই চা নে । আমি দোকান বন্ধ করব এবার । তোর বৌদিকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে ।

- কেন? কি হয়েছে বৌদির ।

- সে বলব ক্ষণ- দাঁড়া। দোকান বন্ধ করি । তারপর যেতে যেতে কথা হবে ।

রাম অন্যান্য চার পাঁচজন ক্রেতাদের চা দিয়ে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করার আগেই জয়দীপ চা শেষ করল। তারপর দুজনে হাঁটতে থাকল লোকনাথ মন্দিরের পাশ দিয়েই। এই রাস্তায় কিছুটা হেঁটে এগিয়ে গেলেই রামের বাড়ি, আসলে যেটা ভাড়া বাড়ি । মানুষটা মালদার লোক। গত প্রায় দশ বছর এই লোকনাথ মন্দিরের মোড়ে ব্যবসা করে এই শহরে একটা আস্ত সংসার চালাচ্ছে । ঠাকুর ভক্ত লোক, রাম আগে জয়দীপকে প্রায়ই বলত, দেবতা দয়ালু হয়। তারই দয়ায় নাকি ওর ব্যবসা চলছে এবং তাই প্রায়ই লোকনাথ মন্দিরে পূজো দেয় রাম । লোকনাথ মন্দির দেখেই কথাগুলো মনে পড়ে গেল জয়দীপের , এই মন্দিরে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ জন আসে। পূজো দেয়। সে ও কখনো সখনো পূজো দিয়েছে । কিন্তু আজ তার এর মনে প্রশ্নটা না চাইতেও উকি মারল, আজকের দিনে দেবতা কে? নেতা’রা কি নয়? নেতারা চাইলেই তোমার অনেক কিছু হবে, নইলে কিছুই নয়, উলটে যা আছে তাও চলে যাবে। নেতৃত্ব থেকে দেবত্ব কতদূর ? মনে হল তার । কিন্তু এইরকম কোনও প্রশ্ন করল না সে । পাশে হাঁটতে হাঁটতে শুধু জিগ্যেস করল -

- কি হয়েছে বৌদির ? বললে না তো !

- আরে, তেমন কিছু না। জ্বর হয়েছে কাল থেকে । একটু আগে ফোন করেছিল । মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে বলল, তাই মনে হল ডক্টর এর কাছে নিয়ে যাই, এই আর কি । তুই এসব বাদ দে , তোর কথা বল , তুই এইবার কি করবি? কিছু ভেবেছিস ? মানে কিছু প্লানিং ...।

- না, তেমন কিছু ভাবিনি , দেখি কি করি ! তবে রাজনীতি আর করব না, এটা নিশ্চিত ।

- আচ্ছা, তোকে একটা কথা জিগ্যেস করব ?

- এমন করে বলছ কেন? কতদিন পরে তোমার সাথে দেখা হল। বলো কি বলবে ।

- আর্মসগুলো আসলে কে এনেছিল বলত ? তুই যে এই সব করিস নি, তা আমি অন্তত জানি। কিন্তু তুই কি জানতিস কিছু?

- না, জানতাম না, তবে আন্দাজ করেছিলাম, যেদিন বাক্সটা নিয়ে তরুনদা আমার বাড়িতে এসেছিল, সেদিন আমি জিগ্যেস করেছিলাম, কি আছে এতে? ওর জবাব কিছু অসংলগ্ন লেগেছিল, তার উপর আমাকে ওটা লুকিয়ে রাখতে বলল এবং যতদূর মনে পড়ে তার কয়েকদিন আগেই পার্টির মিটিং এ সিদ্ধান্ত হয়েছিল আর্মস আনার । বিরোধী আওয়াজ বন্ধ করতে এর চেয়ে ভালো কিছু নেই, বলেছিল সুবোধ বাবু । আমি জোর আপত্তি করেছিলাম, আর বোধ হয় তারই মূল্য চুকাতে হল আমাকেই ।

- তুই বাক্সটা খুলে দেখলি না কেন ?

- আরে! আমি খুলব কি করে ? চাবি তো ওই নিজের কাছে রেখেছিল।

- ছাড় , যা হওয়ার হয়ে গেছে । আবার নতুন করে শুরু কর। আর কি করছিস পারলে জানাস আমায়, যদি কিছু হেল্প করতে পারি করব ।

হাঁটতে হাঁটতে রাম তার ঘরের সামনের গলিটায় পৌঁছে গেলে জয়দীপকে আবার দোকানে আসার আমন্ত্রণ দিয়ে চলে গেল। জয়দীপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার পথের দিকে। আশ্চর্য লাগল তার এই পৃথিবীকে। যাদের সামর্থ্য কম তারা তবু অসময়ে পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা রাখে । আর যাদের সামর্থ্য আছে তারা চুপ থাকে কেমন তা সে আগেই দেখেছিল । কেউ তাকে বাঁচাতে আসেনি । সেই কলেজ লাইফ থেকে পার্টির সেবা করা বা মার্ক্সবাদ নিয়ে তুমুল ভাষণ এর ফল হিসেবে পার্টিই তাকে মারলে কেইবা বাঁচাতে পারত ?

আজও স্পষ্ট মনে আছে সেই দিন গুলো । পার্টির নানা ভুল ভাল কার্যকলাপে এই অঞ্চলে বিরোধিতা বাড়ছিল ফলে ঘন ঘন মিটিং ডাকা হত। কোন বারে তেমন কিছু বলেনি দলের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে কিন্তু যেবারে বন্দুক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিল দল, রাজারহাট- নিউ টাউনের মস্তান টোটনকে অস্ত্র জোগাড় করতে বলল দলিয় নেতৃত্ব , সেবারে আর চুপ থাকতে পারল না । এমনিতেই এই সব লোকদের নিয়ে মিটিং হচ্ছে দেখে মেজাজটা বিগড়েই ছিল তার । জয়দীপ বলেছিল

- স্যার, এটা কিন্তু ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ।

দোর্দণ্ড প্রতাপ নেতা সুবোধ সামন্ত ভাবতে পারেননি যে, তার হাতে গড়া কর্মি তার ভুল ঠিক ধরবে। এই রাজারহাট এলাকায় এমন কেউ নেই যে তাকে কোনও প্রশ্ন করে । বছর বছর জেতা নেতা সে, প্রমোটার রাজ , আর বেনিয়মের বাড়ি যত, তার যে মূল কারিগর, সেই রাজার হাট পুরসভা, এমন কি ইদানীং জন্ম নেওয়া নতুন মস্তান টোটন, সবই চলত এনার অঙ্গুলি হেলনে । মান্য গণ্য ব্যক্তি। সেটা ভয়ে না শ্রদ্ধায় তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল জয়দীপের । সেই সুবোধ বাবু চশমাটা খুলে রুমালে মুছতে মুছতে বলেছিল -

- কোনটা ভুল কোনটা ঠিক তা বিচার করার কথা তোমার নয় জয়দীপ , সেটা দল ভাববে । তাছাড়া প্রশাসনের মত শক্তি হাতে থাকতেও যদি কাজে না লাগাই , সেটা কিন্তু রাজনীতির ইতিহাসে বোকামি হবে ।

- তাই বলে এই সব বন্দুক বাজি না করলেই নয় ?

হা হা হা করে হেসে উঠেছিল সুবোধ বাবু, অট্টহাসির সুরে বলেছিল – তুমি এখনও বাচ্চা আছো । তা তুমিই বলো , বন্দুক ছাড়া আর কি আছে শক্তিশালী? তোমাদের ভাষণ ?



প্রচণ্ড কথা কাটা কাটিতে খুব উত্তপ্ত ছিল সেদিনের সভা । অয়ন, কুণাল ও আরও দুই এক জন ছিল জয়দীপের দলে , বিপক্ষ ছিল খুব ভারী । তাই ভারী গলায় শেষমেশ দলের মধ্যে কাউকে চেঁচিয়ে বলতে শুনেছিল – বের করে দে সব কটা মাদার ড্যাশ কে । শালারা যে পাতে খায়, সে পাতেই থুতু ফেলে । অবশ্য তেমন কিছুই হয়নি কেননা তার আগেই নিজ থেকেই বেরিয়ে এসেছিল সভা ছেড়ে ।



( ২ )

বাকি পথটুকু একা হাঁটতে হাঁটতে এই সব ভাবছিল সে । তার পর এক সময় ঘরে পৌঁছে গেল । পৈত্রিক বাড়ি। বাবা মারা যাওয়ার সময় বিশেষ কিছুই রেখে যায়নি। সামান্য স্কুল মাস্টার ছিলেন। কোনও মতে এই বাড়িটুকুই তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাও এই শহরে একটা বাড়ি তৈরিও কম কথা নয়। আজকাল যা জমির দাম! তাতে জমি কিনে বাড়ি করা মধ্যবিত্তদের পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার। দোতলা বাড়িটির নিচের তলায় নিজেরা থাকে, উপরটা ভাড়ায় দেওয়া আছে। সেই ভাড়াটুকুই কিন্তু জয়দীপের আয়ের একটা উৎস । পুরো তলাটা ভাড়া বাবদ মাসে বারো হাজার টাকা আসে । আর তার মায়ের পেনসন। দুই মিলে মোটামুটি তাদের চলে যেত মা ও ছেলের সংসার। কোনও অসুবিধা হত না কিন্তু বিয়ের পর কিছুটা ভাবতে বাধ্য হয়েছিল জয়দীপ , কিছু একটা করার জন্য। একটা চাকরি । ইংলিশে এম এ পাশ । ফলে কিছুটা আশা সে করতেই পারে। করেও ছিল । কিন্তু মানুষের সেবার ভুত মাথার ভেতরে , তার উপর দলের অবস্থাও বিগড়ে থাকায় তেমন কিছুই হচ্ছিল না। তবু আশা ছিল অপার ।

নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা থমকাল সে। রাস্তার ধারেই বাড়ি । সামনে গ্রিল দেওয়া গেট, তারপর কিছুটা ফাঁকা জায়গা । সেখানে বেশ ঘাস জন্মেছে দেখল সে, আর একটি অজানা বয়স্ক মেয়ে সেই ঘাস পরিষ্কার করছে । কে মেয়েটা? চিনতে চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু মনে করতে পারল না, যা থেকে সে মেয়েটাকে চিনতে পারে । তবে কে মেয়েটি ? বুকের মধ্যে অজানা একটা ভয় খেলে গেল মুহূর্তে ।

আলতো করে গ্রিলের গেটটা খুলে ভেতরে এলো। তাকে ভেতরে আসতে দেখে মেয়েটি অবাক হয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর বলল – কাকে চাই?

কিছুই বুঝতে পারল না জয়দীপ । তার নিজের ঘরে তাকে অন্য কেউ প্রশ্ন করছে –কাকে চাই? রাগ হল খুব তার। কিন্তু বাইরে শান্ত ভাবে সে উত্তর করল – আমি জয়দীপ। এই বাড়ির ছেলে । আপনি কে ?

মেয়েটির চোখে মুখে অবিশ্বাসের ছায়া স্পষ্ট দেখতে পেল সে । কিন্তু কিভাবে সে বিশ্বাস দেবে ? পরমাই বা কোথায়? কিংবা ইনিই বা কে? অনেক প্রশ্ন ভিড় করল তার বুকে । ততক্ষণে মেয়েটি যেন একপ্রকার দৌড়ে ভেতরে চলে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সে দেখতে পেল মেয়েটি তার মাকে সাথে নিয়ে বাইরে এসেছে।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে । ওদিকে অনেক দিন পর ছেলেকে দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেলল তার মা। সাথে মেয়েটিকেও কিছুটা যেন আশ্বস্ত দেখাল ।

ভেতরে গেল সবাই। তিনটে ঘর । মায়ের, নিজের ও একটা অতিথির ঘর । মাঝে ডাইনিং । আজ যেন তার নিজের ঘরও অনেক অচেনা লাগছে । সময় কি তবে ধুলো বয়ে নিয়ে বেড়ায় ? ধীরে ধীরে জমা করে সব ছবিতে! আবছা হয় ছবি ! এই ডাইনিং এ বসেই কত মিটিং হত পার্টির । তরুন দা, কুণাল এরা আসত। এলেই নানা গল্প গুজবে আড্ডায় এই ডাইনিং হলটা গম গম করত । জয়দীপের মাকে সবাই কাকিমা বলে ডাকত, তবু কিভাবে যে তরুনদা’রা তাকে ফাঁসাল, সেটা ভাবতে গিয়েই মাথাটা আরও একবার ঝিম ঝিম করল। সেখানেই বসল জয়দীপ এবং মায়ের সাথে নানা জমানো কথা বার্তার মাঝে সে বলল -

- ইনি কে মা? মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল সে ।

- ও এক অভাগী। ওকে রেখেছি, ঘরটা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগত না হলে ।

জয়দীপ বুঝতে পারল তার মা কাজের মেয়ে রেখেছে, কিন্তু কাজের মেয়ে ভাবতে কিংবা বলতে কোথাও সংকোচ বোধ করছে ।

- কোথায় বাড়ি? জানতে চাইল সে তার মায়ের কাছে ।

- উপরে যে ভাড়াটিয়া আছে, তাদের গ্রামের মেয়ে। বেশ ভাল মেয়ে। তুই দিদি বলে ডাকতে পারিস একে । জয়দীপের মা বলল।

- সে না হয় বুঝলাম মা, কিন্তু পরমা কোথায় ? তাকে দেখছি না কেন?

ছেলে ফিরে আসার খুশিতে উজ্জ্বল উনষাট বছরের মুখটা যেন থমকে গেল । যদিও তিনি জানতেন কিছুদিনের মধ্যেই এসবের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। পরমা যে তাদের সংসার ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে সেটা একদিন তাকেই যে জানাতে হবে তা বিলক্ষণ জানত । তবু সচেতন ভাবে আজকেই না বললে চলত। বলে দিলেই হত যে , সে বাপের বাড়ি ঘুরতে গেছে। কিন্তু তা করলেও যে আরও প্রশ্ন আসবে। সে যে আজ ছাড়া পেতে চলেছে, তা পরমা জানে, তবু কেন সে এলো না বাড়ি? এই প্রশ্নও আসত । তাই সে সবে না গিয়ে কিছুটা পাংশু মুখে সে বলল-

- বৌমা গত চার মাস হল, বাপের বাড়িতে । ফোন করেছিল মাঝে একবার , আর আসবে না বলেছে । বলেই চুপ হয়ে গেলেন তিনি ।

যেন আকাশ থেকে পড়ল জয়দীপ।

- কেন? কি এমন হল যে পরমা চলে গেল । কিছুটা বিস্ময়ের সুরে বলল জয়দীপ ।

- কিছুই হয়নি। ঘরে বসে বসে মন খারাপ করত, আমিই বললাম, বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে, গেল । কিন্তু আর এলো না।

এতক্ষণ সেই অজানা মেয়েটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল তার মায়ের চেয়ারের পাশে । এবার সে কথা বলল – জয় ভাই, পরমা অন্য কাউকে পছন্দ করেছে বোধ হয়। পছন্দ করেছে কিনা জানি না, তবে পরমা আবার বিয়ে করছে এবং তোমার কাছে ডিভোর্স চেয়েছে। তুমি ফিরলেই সে সব হওয়ার কথা ছিল ।

কিছুটা অবাক হল জয়দীপ , বলল – তোমরা মজা করছ না তো? সিরিয়াস বল । কিছুটা উত্তেজিতও লাগল তাকে ।

- না, মজা করছি না ভাই । তোমার মাকে বলতে পারেনি বলে ফোনে আমাকে বলেছিল সব ।

এসব কি সত্যি শুনছে সে? না কি কোনও দুঃস্বপ্ন ! না, দুঃস্বপ্ন নয়। কিছু যে একটা ঘটেছে তা জেলে বসেই ভেবেছিল। না হলে পরমা শেষের দিকে কেন তাকে আর দেখতে গেল না ? কিছুক্ষণ থ মেরে বসে রইল জয়দীপ। তারপর মাকে বলল – মা, আমি একটু আসছি ।

- কেনরে? কোথায় যাবি এতবেলা? শোন, পাগলামো করিস না। আজকেই এলি তো। দুদিন বাদে না হয় যাস...!

- না, মা। আমাকে জানতে হবে কেন পরমা এসব করল আমার সাথে ।

মাথাটা তার বন বন করে ঘুরছে । কেন? কি দোষ সে করেছে ? এসবের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই । সন্ধ্যে প্রায় হয় হয় তবু সে উঠে গেল চেয়ার ছেড়ে , বাইরে, বাইর থেকে রাস্তায়।



আবারও এক মায়ের চোখে জল এলো । চেয়ারে চুপ মেরে বসে বসে নিজের ভাগ্যের দোষ খুঁজে বেড়াতে থাকল জয়দীপের মা। ভাগ্যই তো। নইলে কেন তার ছেলেটা অপরাধ না করেও জেলে গেল? মানুষের জন্য কি করেনি তার ছেলে? করেছে । অনেক কিছু করেছে। নিজেকে নিয়ে কখনো তেমন করে কিছু ভাবেনি যার কারণ তার মমতাময়ী মন মাঝে মাঝে ক্ষোভে ফেটে পড়লেও আবার কখনো মনে মনে খুশিও হত ।

স্বামীকে হারিয়েছে প্রায় সাত বছর হতে চলল। হার্ট এটাক, অন্যান্যর বেলায় তবু সুযোগ দেয় ভগবান, কিন্তু তার স্বামীর বেলায় কোনও সুযোগ দেয়নি। এমনকি কোনও ট্রিটমেন্টও নিতে দেয়নি মানুষটাকে । দুপুরে শরীর খারাপ লাগছে বলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল। রাস্তায়ই পথ ফুরিয়ে গেল । তারপর নিজের একাকীত্বের এই সাত বছরের চারটা বছর একমাত্র সন্তান জয়দীপই যে তার বেঁচে থাকার সোপান, তা সে ছেলেকে বোঝাবে কি করে? কিংবা এই যে তিনটা বছর ছেলের মুখ না দেখেই তাকে কাটাতে হল তার জন্যও কি তার কপাল দায়ী নয় ? তার উপর পরমাও দূরে সরে গেল । দিনগুলো যেন শুধু তার পরীক্ষা নিচ্ছে একে একে । এর শেষ কোথায়?

চোখের কোন দিয়ে নীরবে জল বয়ে যেতে লাগল যা তার পেছনে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্য বয়স্ক মহিলাটি দেখতেও পেল না। সে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে ছিল সদর দরজার দিকে যেখান দিয়ে এই সবে বেরিয়ে গেল জয়দীপ ।



( ৩ )

- তাহলে এটাই তোমার শেষ সিদ্ধান্ত ?

- হ্যাঁ, আমার আর বেশি কিছু করার নেই। আমি বাবার সিদ্ধান্তের বিপরীতে যেতে পারব না। বাবা , মা , ভাই , সবাই বলছে এই সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে যেতে ।

- আর তুমি? তুমি কি বলছ ?

- আমারও তাই মনে হয় । লোকে কত কথা বলে, বলে তোর স্বামী একটা দুষ্কৃতি । আরও কত কি বলে । এই সব থেকে বেরুতে হবে আমায় ।

- পরমা, তুমি তো অন্তত জানো, আমি কিছু করিনি । সবটাই রাজনৈতিক গেম ছিল ।

- তাহলে রাজনীতি করতে কেন? কতবার তোমায় বলেছিলাম, ছেড়ে দাও এসব, চাকরি খোঁজ একটা ! কতবার ?

- পরমা, রাজনীতি একটা অর্গানাইজেশন, এর উপর ডিপেন্ড করে মানুষের সামাজিক, অর্থ নৈতিক মুক্তি । এটাকে বাদ দিয়ে কিছু হয় না পরমা, কিছু হয় না । বাদ দিতে হলে সুবোধ বাবুদের মত লোকদের বাদ দিতে হয় । কিন্তু তাও সম্ভব নয় এই বিচিত্র সমাজে ।

- থাক। ওসব আমাকে শুনিও না আর , অনেক শুনেছি । আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই ওসবে, তুমি তোমার জীবন নিয়ে থাকো, আমি আমার জীবন নিয়ে ...

- এটাই তোমার শেষ কথা? ভেবে বলছ তো ?

- হ্যাঁ , অনেক ভেবেই বলছি।

- আর, যদি আমি তা না হতে দিই?

- তুমি কিছুই করতে পারবে না, তোমার কাছে এখন কিছু নেই, নিজের পার্টিও নেই, যুব নেতা তমকাও নেই। কিচ্ছু নেই। পারবে না তুমি কিছু করতে ।

করতে পারা বা না পারাটা বড় কথা নয় জয়দীপের কাছে। বড় কথা হল পরমার চাওয়া । কালকে সন্ধ্যায় যখন দেখা করতে গিয়েছিল তখন পরমার বাবা দেখা করতে দেননি। বলেছিল পরদিন সকালে আসতে । রাগে যন্ত্রণায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল । ফলে একটা রাত নিদ্রাহীন কাটিয়েই আবার সকাল বেলায় বেরিয়ে পড়েছিল জোড়া মন্দিরের উদ্দেশ্যে । ভি আই পি রোডের ঠিক ওপাশেই একটা শুরু গলি । তা দিয়ে কিছুটা সামনে এগোলেই যে শান্তি ভবন সেটাই পরমার বাড়ি । তার মায়ের নামে বাড়িটির নাম, বাড়িটির নিচের তলায় ভুসিমাল দোকান পরমাদের , আর উপরে নিজেরা থাকে ।

প্রায় সকাল দশটায় পৌঁছেছিল জয়দীপ । ছিল আধ ঘণ্টা মত । একবার জেল খাটা মানে জীবন কত খাটো হয়ে যায় সাধারণ মানুষের তা বুঝল জয়দীপ । জামাই, কিন্তু জামাই নয়। স্বামী, কিন্তু স্বামী নয় । সব কিছু কেমন মূল্যহীন হয়ে গেছে তার জন্য । কোন কদর বা কোন খাতির নেই , শুধু মানবিক কিছু সৌজন্য বোধ , অবশিষ্ট কিংবা উচ্ছিষ্ট । সেটুকু নিয়েই কিছুটা সময় কেটে যাওয়ার পর পরমাকে বিদায় জানিয়ে নেমে এলো পথে ।

মনে মনে স্থির করে নিল সে, পরমার পথে সে বাধা হবে না, পরমা ভালো থাকুক। সুখে থাকুক। এর বাইরে আর কিছু চাওয়ার নেই তার। আর বেশি কিছু ভাবতে পারল না সে । হেঁটে হেঁটে ভি আই পি রোড, তারপর রোড ক্রস করে অটোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকল ।

এমন সময় কেউ তাকে পাশ থেকে ডাক দিল । - আরে! জয়দীপ না! হ্যাঁ, তাই তো। কি রে কবে ছাড়া পেলি? জয়দীপ পাশ ফিরে তাকাল , দেখল- ভোলা দা। ভোলা সমাদ্দার। ছোট খাটো প্রমোটার , ওদের একটা গ্রুপ আছে প্রমোটিং ব্যবসার। এই তেঘরিয়া এলাকায় ওরা ভালই ব্যবসা করছিল আগে, এখন কি করছে তা জানে না জয়দীপ তবু মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হল না তার ।

- তুমি! ভোলা দা না ? জয়দীপ বলল ।

- হ্যাঁরে, চিনতে পেরেছিস তাহলে ।

- বা ! চিনব না কেন? বলো, কেমন আছো?

- ভালোই আছি , তবে খুব ভালো নয়। এলাকার অবস্থা খুব খারাপ রে । তুই কিছু শুনিস নি ?

- না তো, আমি তো কালকেই এলাম, কিছু তো শুনিনি ! কি হয়েছে? কিছু বিস্ময়ের সুরে বলল জয় দীপ ।

- অয়ন । মনে আছে তোর ছেলেটাকে ? তের নম্বর ওয়ার্ডের ছেলে । তোদের সাথেই পলিটিক্স করত, মনে পড়ে ? সেই অয়ন গত সপ্তাহে খুন হয়েছে ।

- সে কি? কি বলছ তুমি? আরে, সেই অয়ন দাসের কথা বলছ তুমি?

- হ্যাঁ, ও ইদানীং দল বদলে নিয়েছিল। ছয় সাত দিন আগে ওর লাশ টা বাগ জোলা খালে পাওয়া গেল । মাথায় বুলেটের চিহ্ন ছিল । আরও অনেক খুন খারাপি, মারপিট দাঙ্গাবাজি .. এই সব এখন নিত্যকার ঘটনা হয়ে গেছে ।

- সে কি? শুধু বিস্ময় আর বিস্ময় । জয়দীপ মুক হয়ে গেল । বুকের ভেতর একটা দমকা হাওয়া এ দেওয়াল ও দেওয়াল ধাক্কা মারছে , ভেঙ্গে ফেলতে চাইছে পাঁজর । চোখের পাতায় এসে আটকে আছে এক বুক কান্না । সব কিছু নিয়ে সে মুক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ।

- তুই ঘর যাবি তো? আয় আমি তোকে লোকনাথ মন্দিরে ছেড়ে দিচ্ছি ।

একটা বাইক দাঁড় করানো ছিল পাশেই । ওটা যে ভোলার, তা এখন জানল জয়দীপ । তাতে করেই ভোলা জয়দীপকে ছেড়ে দিয়ে এলো লোকনাথ মন্দিরের কাছে ।

ফিরতি পথে ভোলা মনে মনে একবার ভাবল , সময়টা বড় খারাপ যাচ্ছে আজকাল । যেই বিরোধিতা করছে সেই শত্রুর তালিকায় চলে যাচ্ছে । তার মন কিছু চিন্তিত হল । এই ছেলেটা যেন আবার না ভুল করে সাপের ল্যাজে পা দিতে যায় । দিলে আবার কিভাবে ছোবল খাবে কে জানে! সেদিনের চেয়েও আজকের সময়টা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। কেননা ঐ দলটার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে । তাই যা খুশি তাই করতে পারে ওরা ।

রামের চায়ের দোকানে কিছুক্ষণ দাঁড়াল , মুখটা ভার ভার। যেন মাথায় কিছু ভর করে বসে আছে। কিংবা হয়ত বা বুকে । রামের দোকানে প্রচুর ভিড় , তাই বেশি কথা না বলে ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল, কিন্তু পেছন থেকে রামের ডাক একটু তাকে দাঁড়াতে বাধ্য করল।

রাম বলল – কিরে, চা না নিয়েই চলে যাচ্ছিস যে? বসবি না একটু ?

- না , রাম দা। পরে আসব, শরীরটা খারাপ লাগছে ।

- কেন রে? তোর আবার কি হোল? জ্বর টর হল না কি?

- না না, তেমন কিছু না, এমনিই । সন্ধ্যে তে আসব। বৌদি কেমন আছেন?

- ভালো আছে। তুই সন্ধ্যেতে আসিস কিন্তু ।



তারপর একটা নয়, দুটা সন্ধ্যে কেটে গেছে । জয়দীপ ঘর থেকে বিশেষ বের হয়নি । ঘরে পায়চারি করে আর মাথার মধ্যে একটা যন্ত্রণাকে সামাল দিতে দিতে সময় কেটে গেল তার । মাঝে একবার বেরিয়েছিল বিকাশে’র সাথে দেখা করতে। গতকাল বিকেলে । ছেলেটা আগে জয়দীপের নেওটা ছিল খুব। যা বলত শুনত । বিকাশ রাজার হাট পুরসভায় কাজ করে, সাথে জমি , ফ্লাট কেনা বেচার দালাল । অনেক ভেবে ভেবে শেষে বিকাশের কাছেই যাওয়া স্থির করল সে ।

জয়দীপকে প্রথমে দেখেই কি উল্লাস সেই বিকাশের। যেমন করে গুরুকে দেখে চ্যালার উল্লাস হয়, ঠিক তেমনি । ক্লাবে একদল ছেলের মধ্যে গলায় গলা মেলাতে মেলাতে বিকাশ বলল - কি ব্যাপার বশ। তুমি ফিরেছ শুনেছি, হয়ত কালকেই যেতাম তোমার বাড়ি ।

- থাক, তোকে আর ভণিতা করতে হবে না। একটু বাইরে আয়, কথা আছে তোর সাথে । বিকাশ জয়দীপের সঙ্গে ক্লাব থেকে বেরিয়ে এলো রাস্তার মোড়ে । তারপর বলল – কি বল বশ কি এমন ব্যাপার যে আমাকে না ডেকে পাঠিয়ে এখানে আসতে হল ।

- তেমন কিছু না, তবে আমার একটা ঘোড়া চাই। আর তিন টা দানা । জোগাড় করে দিতে পারবি?

কিছুটা চিন্তিত দেখাল বিকাশ কে । সেভাবেই বলল সে- দ্যাখো দাদা, জোগাড় করাটা কোনও ফ্যাক্টর না, অন্তত এখন । কিন্তু তুমি ঘোড়া নিয়ে করবে কি?

- কিছু না, এমনিই। তুই তো জানিস এই সময়টা কেমন যাচ্ছে । তার উপর আমার শত্রুও কম নয় । মনে মনে খুব ভয়ে আছি । ওটা সাথে থাকলে একটা সাহস আসবে বুকে। জানিস তো আমার বাড়িতে পুরুষ বলতে আমি একাই ।

- সে তো বুঝলাম, কিন্তু আবার যদি কিছু হয় !

- আরে না না , তোর উপর আমার বিশ্বাস আছে। তুই আর আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না। আর তেমন হলে লুকিয়ে ফেলতেও পারবো, কেননা আমি তো জানি ওটা আমার কাছে আছে। তখন তো জানতামই না যে আমার ঘরে তালা বন্দি করে যে বাক্সটা রেখে গেল তরুণ দা, সেটাতে এই সব জিনিস আছে। জানলে পরে যেমনটা হল তেমন টা কিন্তু হত না। তাছাড়া সবটাই তো চক্রান্ত ছিল, তুই তো সব জানিস ।

উত্তর টা যথাযথ না হলেও বিকাশ বিশ্বাস করেছিল । ফলে আর সে কোন কিন্তু কিন্তু করেনি ।

আজ সারাদিন মায়ের সাথে অনেক গল্প করেছে । কাজের মেয়েটিকে দিদি বলে ডেকেছে । একটা ছোট্ট ভরপুর সংসার সে উপভোগ করেছে যথেষ্ট । গতকাল সকালেই সে দ্বিধাহীন ভাবে সই করে দিয়েছে পরমার পাঠানো ডিভোর্স ফর্মে । তারপর কথায় কথায় , হাঁসির ছলে মাকে, তার নতুন দিদিকে বলেছে , চিন্তা করিও না, একটা নতুন পরমা আনব আবার । কেউ টের পায়নি তার ভেতরের ভাঙ্গন টাকে। ফলে সব কিছুই স্বাভাবিক ছিল দিন ঘণ্টা সেকেন্ড অনুযায়ী । কিন্তু আজ বিকেল গড়িয়ে যত সন্ধ্যে হতে লাগল , জয়দীপের বুকটা যেন শক্ত হতে থাকল ধীরে ধীরে , খবর পেয়েছে সে আজ বাগুইহাটি বাস স্ট্যান্ডে পার্টির সভাতে ভাষণ দেবেন সুবোধ বাবু । ঘড়িতে প্রায় ছয়টা বাজে । এবার তাকে বেরুতে হবে ।

রান্না ঘর থেকে আজ মাংস রান্নার গন্ধ পুরো ঘর ময়। আসার পর এই প্রথম তার জন্য মাংস হচ্ছে । একবার রান্না ঘরে গেল , তার নতুন দিদিটির নাম জানা হয়নি আজও , সে পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল – দিদি, তোমার নাম কি? আমি জানি না যে !

- কেন? নাম জেনে এত বেলা কি কাজ ?

- বলই না। জানতে ইচ্ছে করছে খুব । বলই না !

- আচ্ছা বাবা, কালকে বলব ক্ষণ ।

- কাল কে দেখেছে বল? তুমি দেখেছো? আমি কিন্তু দেখিনি !

- ছি! অমন করে বলতে নেই। আচ্ছা ঠিক আছে , বলছি । আমার নাম – তিথি ।

- তিথি ! বা ! সুন্দর নাম তো !

- তিথি নামটা সুন্দর? কে বলল তোমায়? তিথি মানে জানো তো? লগ্ন । লগ্ন শুভও হয় আবার অশুভও হয় ।

- জানি, তবু নামটা সুন্দর । আর তাছাড়া শুভ অশুভ তো স্বার্থের মাপ কাঠিতে মাপা হয় । তাতে ‘নাম’ টার কিছু যায় আসে না ।

- তুমি খুব ভালো কথা বলত । রাজনীতি করতে শুনেছি তোমার মায়ের কাছে । এত ভাল কথা বলতে সেটা তো শুনিনি !

জয়দীপ হা হা করে হাঁসতে হাঁসতে বেরিয়ে এলো রান্না ঘর থেকে । তারপর মায়ের ঘরে, মা তখন টিভি তে সিরিয়াল দেখছিল , কোন এক বাংলা সিরিয়াল । নাম জানে না জয়দীপ , কেননা সে কোনও দিন এইসব দেখেনি । পেছনে দাঁড়িয়ে বলল – মা, একটু মোড় থেকে আসছি ।

- এত বেলা আবার কেন মিছি মিছি বাইরে যাচ্ছিস ? সন্ধ্যে হতে চলল তো ?

- এমনিই , এখুনি ফিরে আসব ।

বলতে বলতে একটু আগের হাঁসিটা গলায় ফাঁস দিয়ে এঁটে গেল যেন । গলা কেঁপে উঠল নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে হয়ত বা চোখের পাতাও যা তার মায়ের নজর এড়িয়ে গেল । ফিরে আসার রাস্তা আর নেই তার । একে একে সব ভেঙ্গে গেছে । সে এখন পরমার চোখে দুষ্কৃতি এবং সব কিছুর মূলে তার ‘পার্টি’র নেতা । সে সব কথা কেউ কি বোঝে? কেউ না। কেউ বুঝবেও না ।

চুপচাপ বেরিয়ে গেল মায়ের ঘর থেকে, তারপর নিজের ঘরে । বিকাশের দেওয়া ঘোড়াটা আলমারি থেকে বের করল । এটাই নাকি সব ক্ষমতা’র উৎস। কোনও দিনও বিশ্বাস করেনি এ কথা । কিন্তু আজকের জয়দীপ আর সেদিনের জয়দীপের মধ্যে অনেক ফারাক। সেদিনের জয়দীপ যদি সৎপুরুষ হয় , তাহলে আজকের জয়দীপ যে বিবাদী কালপুরুষ সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই তার নিজের মনেও। আজ এই ঘোড়ার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস । বাদ দিতে হলে সুবোধ বাবুদের মত লোকদের বাদ দিতে হয়, যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের জীবন নিয়ে ছেলে খেলা করে - কথাটা দু দিন আগেই পরমাকে বলেছিল । চারিদিকে এই যে বদলের হাওয়া তাতে হয়ত উড়ে যাবে সুবোধ বাবুরা । আবার নাও উড়তে পারে। কিন্তু সে যা হবে হোক গণতন্ত্রে । আজ তাকে আরও একবার কমরেডের পোশাকটা পরতে হবে, হবেই । শেষ বার ।

পকেটে ভরে নিল যন্ত্রটা , সাথে বিকাশেরই দেওয়া তিন রাউন্ড গুলি । সন্ধ্যেকে সাথে নিয়ে পা রাখল বাইরে । দূরে কোথাও কোন সভা থেকে ভেসে আসছে ব্রততি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সেই বিখ্যাত কবিতাটি – তবু আমি প্রাণ-পণে টেনে যাই শ্বাস/ আমার বিশ্বাস/ জানি- রক্ত কণিকারা / লাল ফৌজের মত জয় সুনিশ্চিত / আবার দখল নিয়ে দেবে প্রত্যাঘাত / অমর স্তালিনগ্রাদ / আবার আমারই বুকে ফিরে পাবো আমি ......