অসমাপ্তি
বিবেক ভট্টাচার্য
(১)
আবার বাজছে ফোনটা । এই এক জ্বালাতন হয়েছে সায়ন্তনীর । বি.এ. কমপ্লিট করার সাথে সাথেই যে বাবা ওর বিয়ে নিয়ে এরকম আদাজল খেয়ে লেগে যাবে ভাবতেই পারেনি । বলা নেই কওয়া নেই একদম কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে দিয়েছে পাত্র-পাত্রী বিভাগে ।
স্লিম, ফর্সা, গৃহকর্ম নিপুণা, ব্রাহ্মণ পাত্রীর জন্য সঃ চাঃ / বে সঃ চাঃ ব্রাহ্মণ পাত্র কাম্য ।
আর তারপর থেকেই সারাদিন ল্যান্ডফোনটা বেজে চলেছে । হাড়-হাভাতের দল একেবারে উঠে পড়ে লেগেছে ওকে বিয়ে করার জন্য ।
রাগে গা জ্বলে উঠেছিল সায়ন্তনীর । এত কিছু করা হয়ে গেল অথচ কেউ ওর সাথে আলোচনা পর্যন্ত করলো না । বিয়ে কি ছেলেখেলা নাকি যে রেশন দোকানে গিয়ে কার্ড সাবমিট করলাম আর পাত্র পকেটস্থ করে বাড়ি ফিরে এলাম? আর কিছু না হোক ওর নিজের পছন্দ বলেও তো কিছু একটা থাকতে পারে । বাবাকে এসব বোঝাতে যাওয়াও দায় । বোঝানোর চেষ্টা যে ও করে নি তাও না । এই তো গতকাল বাবাকে বলতেই বলল ‘ তোমাদের জেট গতির যুগের রীতিনীতি আমি বুঝিনা আর বুঝতেও চাইনা । যে যুগের আদর্শ বলে কোন বস্তু নেই তার মধ্যে বাহাদুরিও কিছু নেই । নিজের পছন্দের কিছু আমার জীবদ্দশায় করা যাবে না । তোমাকে বড় করেছি আমি বিয়েটাও আমিই দিয়ে যাবো । তারপর তোমার যা খুশি করতে পার ’।
এরপর তো আর কথা বলা যায় না । একছুটে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিয়েছিল । খায়ও নি কিছু সারাদিন, কিন্তু তাতে সুপ্রকাশ ব্যানার্জীর যে কিছু যায় আসে না তা ও ভালো করেই জানে । দিদির বিয়ের সময় দেখেছে কীভাবে ভালবাসাকে চাবকে সোজা করেছিল ওই লোকটা । কিন্তু এত সহজে হারও মানবে না ও । লাগাক চাবুক, সুনির্মলকে ছেড়ে থাকা ওর পক্ষে জাস্ট অসম্ভব ।
সেই কলেজে প্রথম আলাপ হয়েছিল সুনির্মলের সাথে । আজও সেই দিনটা মনে আছে । প্রথম কলেজ যাওয়ার সময় কত জপিয়েছিল ওই লোকটা । কলেজ যাচ্ছ পড়তে । যাবে, পড়বে বাড়ি আসবে । মাঝপথে কোন আড্ডা দেবে না আর ছেলে বন্ধুর সংখ্যা যেন হাতে গোনা যায় । বাবার মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েও নিজেকে সুনির্মলের সামনে আটকাতে পারেনি । ঝোড়ো হাওয়ার মত এসেছিল আর ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল গহন থেকে গহনে । বাবাকে নিয়ে ভয় ছিল, কিন্তু তাও একটা ঝরা পাতার মত ওর ভালোবাসায় উড়েছিল ও । বাবার কথা মেনেই চলত সবসময় । পারতপক্ষে কারুর সাথে কথা বলতো না । সুনির্মলই এগিয়ে এসে আলাপ জমিয়েছিল-
‘ এই নে ’ একটা ক্যাডবেরি এগিয়ে দিয়ে বলেছিল ‘ আজ আমার জন্মদিন, তুই তো কারুর সাথে কথা বলিস না তাই তোকেই আগে দিলাম । এই ফাঁকে বন্ধুত্বটাও হয়ে যেতে পারে’ ।
এত স্বচ্ছন্দ কথার সামনে পড়ে দিশেহারা লেগেছিল সায়ন্তনীর । খুব ভালো কবিতা লিখত ছেলেটা । ফ্রেশার্স ওয়েলকাম এর দিন একটা ছোট্ট কবিতা পড়ে শুনিয়েছিল । স্বচ্ছন্দ লেখা ও বলার কায়দায় বিভোর হয়ে শুনেছিলো সায়ন্তনী । সেই বোধহয় ভালোলাগার শুরু । তারপর নোট নেওয়া হোক বা এক্সামের সাজেশান সবেতেই সুনির্মল । ব্যাপার জানাজানি হতেও সময় লাগেনি । ক্লাসমেট থেকে টিচার সবাই জেনে গেছিল ওদের ব্যাপারে ।
সায়ন্তনীর জন্মদিনে ওকে নিয়ে লেখা একটা কবিতা গিফট করেছিল, সেটা বইয়ের তাকে গুছিয়ে রাখা আছে । মন খারাপ হলেই পড়ে । একবার-দুবার-তিনবার পড়ার পরেও আজ আর মন ভালো হল না । কীভাবে বোঝাবে ও সুনির্মলকে । আর বোঝাবেই বা কি ? নাকি এবার নিজেকেই বোঝানো দরকার । না না, ওর দিদির মত ও পারবে না সব ছেড়ে অদৃষ্টের হাতে নিজেকে ঠেলে দিতে । কিন্তু করবেই বা কি ?
(২)
-‘ দাঁড়া বাবা ঘরটা একটু ঝাড় দিয়ে দিই । বাসি ঘরে বেরোতে নেই রে, অমঙ্গল হয় ’।
-‘ উফ মা, ছাড়ো তো । এমনিই দেরি হয়ে গেছে । লেট করে গেলে আজ আর ক্লাসে ঢুকতে পারবো না, আর তোমার শরীরের অবস্থাটা দেখেছ । একটা কাজের লোক রাখতে বলছি কবে থেকে... ’ বলতে বলতে বেরিয়ে গেল সুনির্মল । ও অবশ্য জানে কাজের লোক রাখাটা ওদের মত ফ্যামিলিতে একটা বিলাসিতা, তাও আজকাল লিখে নিজের হাতখরচের টাকা উঠে আসায় প্রায়ই মাকে বলে ওই কথা ।
আজ গরমও পড়েছে, তার ওপর বাসে এত ভিড় যে দাঁড়ানোর জন্যেও যুদ্ধ করতে হচ্ছে । কোনমতে হাতটা তুলে বারবার ঘড়ি দেখছে সুনির্মল । নাহ আজ কপালে ঝাড় নির্ঘাত । সায়ন্তনীকে পাক্কা এগারোটায় টাইম দেওয়া আছে আর এখনই প্রায় পৌনে এগারোটা বাজে । তার ওপর কলকাতার বাস! শালা প্রত্যেকটা সিগন্যালে না দাঁড়ালে এর পেটের ভাত হজম হবে না । দুটো কবিতা নিয়ে এসেছে সায়ন্তনীকে দেবে বলে । যেকোনো ফাইন কমাতে ওগুলোই ওকে বরাবর হেল্প করে ।
বাস থেকে যখন হেদুয়ার মোড়ে নামলো তখন অলরেডি সাড়ে এগারোটা বাজে । নিজের সেলফোনটা থেকে নাম্বার ডায়াল করে কানে চেপে ধরতেই ‘ দ্য নাম্বার ইউ আর ডায়ালিং ইজ কারেন্টলি সুইচড অফ, প্লিস ট্রাই আফটার সামটাইম ’। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে আবার ডায়াল করতেই আবার সেই এক কথা । ব্যাপার কি ! ও তো কখনো ফোন অফ রাখে না । আরও দু-তিন বার ফোন করেছিল কিন্তু লাইন পায়নি । মনের ভেতর হাজার রকম চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো । সারাটা রাস্তা ফোন করতে করতে এসেছে । বাড়ি ফিরে মুখে দুটো গুঁজেই নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল । যে মেয়ে কখনই ফোন বন্ধ করে না তার ফোন আজ এতক্ষণ বন্ধ ! বলা নেই কওয়া নেই, দেখা করার কথা ছিল তাও এলো না, ব্যাপার কি । যেভাবেই হোক যোগাযোগ করতেই হবে । কিন্তু কীভাবে করবে কিছুতেই ভেবে পেল না । ওরা একসাথে পড়ে না, সাবজেক্টও আলাদা, ও আর্কিওলজি নিয়ে পড়ছে আর সায়ন্তনী বাংলা নিয়ে । নাহলে হয়ত নোটের ব্যাপারে বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসা যেত । মাঝে এক বছর শুধু একসাথে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়েছিল, তাও একবছরের বেশি মন টেকেনি বলে ছেড়ে দিয়েছে । লাভের মধ্যে শুধু সম্পর্কটা তৈরি হয়ে গেছিল । ওদের সম্পর্ক ওর বন্ধুদের ভালো লাগেনি । ওরা সবসময় বলতো ‘ কেন বাপু বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে যাচ্ছিস ? ওরা কত বড়লোক তোর মত ভ্যাগাবন্ডকে পাত্তাই দেবে না দেখিস । বেকার হেদিয়ে মরবি আর দারু খেয়ে দেবদাস হবি ’। তারপরও আশা হারায় নি, মনের কথা গোপন করার থেকে বলে ফেলা অনেক ভালো । মনটা অনেক হালকা থাকে ।
সায়ন্তনী ওর বাবাকে নিয়ে খুব ভয় পেত । বলতো খুব সাবধানে যোগাযোগ রাখতে, সারাদিন এসএমএস করতে না। বাবা জানতে পারলে খুব প্রবলেম হবে । ওর দিদিকে নাকি জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল লোকটা । বিয়ে করতে
রাজী করানোর জন্য নিজের মেয়েকে চাবুক দিয়ে মেরেছিল । ওর দিদির কথা ভেবে খুব খারাপ লাগত সুনির্মলের, আরও খারাপ লাগত সবসময় যোগাযোগ রাখতে পারবে না ভেবে । তাও কিছু করার ছিল না, নিজের পায়ে না দাঁড়ানো অবধি সাবধানে থাকাই ভালো । আর ওর জন্য সায়ন্তনী গায়ে আঘাত লাগলে ও নিজেকে ক্ষমা করতে পারত না কোনোদিন । তাহলে কি ওর বাবাই...... নাহ্, যেভাবেই হোক খোজ একটা নিতেই হবে ।
(৩)
শুধু ফোনে যে ঝামেলা মেটার নয় সেটা আগেই বুঝলেও এত তাড়াতাড়ি পরের আঘাত আসবে ভাবেনি ও । বুঝলো যেদিন সকালে মা বলল তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হয়ে নে । তোকে দেখতে ছেলের বাড়ির থেকে লোক আসবে । মাথা ঝিমঝিম করে উঠেছিল সায়ন্তনীর । ছেলের বাড়ির লোক মানে ? কোন ছেলে ? কিসের লোক ? আজ কিছুতেই বাড়িতে থাকা সম্ভব না, আজ যে ওর সুনির্মলের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা আছে ।
- ‘ এগুলো কি ঠিক হচ্ছে মা ?’
- ‘ আমি কি জানি । আমায় কেন বলছিস । যা বলার তোর বাবাকে গিয়ে বল ’।
- ‘ হ্যাঁ, বলবই তো । আর শুধু বাবাকে কেন থানাতেও বলব । একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে এভাবে বিয়ে দেওয়া যায় না এটা সুপ্রকাশ ব্যানার্জীর জানা দরকার ’।
তার আগে দরকার সুনির্মলকে ব্যাপারটা জানানো । আজকে যে দেখা করা যাবে না সেটা জানাতে হবে । সবেমাত্র ফোনটা করতে যাচ্ছিল এমন সময় ওর বাবা ঘরে ঢুকে হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল । বাবার হাতে সেদিনের চাবুকটা উঁকি দিচ্ছিল ।
- ‘ তোমাকে যেটুকু করতে বলা হয়েছে তার একচুলও যেন এদিক ওদিক না হয় । বেয়াদবি করলে মেরে তোমার চামড়া ছাড়িয়ে নেব মনে রেখো । যাও রেডি হয়ে নাও লাখ কথা না হলে বিয়ে হয় না, এরা তো শুধু দেখতে আসছে । আপত্তিটা কোথায় তোমার ?’
- ‘ তুমি তো জানো আমি একজনকে......’
- ‘ ও দ্যাট ব্লাডি রাস্কেল, আমার কথামত না চললে ওটাকে মেরে পুঁতে দেব কেউ ট্রেস করতেও পারবে না । ওর ভালো চাও তো ডু ইট আর্লি ’ বলেই বেড়িয়ে গেছিল লোকটা ।
ওই লোকটাকে বাবা ভাবতে ঘেন্না লাগছিলো এবার । কিছুতেই ও বসবে না ওখানে । দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল । কীভাবে এই মৃত্যুপুরী থেকে বেরবে ? জানে না ও, কেউ জানে না । পালাতে হবে ওকে, যেভাবে হোক পালাতেই হবে । যেভাবেই হোক । আর কিছু না হোক একটা ব্লেড ঠিক খুজে পাবে ঘরে । তারপর উচিৎ শিক্ষা হবে লোকটার ।
কাজটা খুব সাবধানে করতে হবে । হাতে লেখা সুনির্মলের ‘ এস ’ টায় যেন আঁচড় না লাগে । এইসময় অন্তত ওকে ব্যাথা দিয়ে যাবে না সায়ন্তনী, কিছুতেই না ।
(১)
আবার বাজছে ফোনটা । এই এক জ্বালাতন হয়েছে সায়ন্তনীর । বি.এ. কমপ্লিট করার সাথে সাথেই যে বাবা ওর বিয়ে নিয়ে এরকম আদাজল খেয়ে লেগে যাবে ভাবতেই পারেনি । বলা নেই কওয়া নেই একদম কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে দিয়েছে পাত্র-পাত্রী বিভাগে ।
স্লিম, ফর্সা, গৃহকর্ম নিপুণা, ব্রাহ্মণ পাত্রীর জন্য সঃ চাঃ / বে সঃ চাঃ ব্রাহ্মণ পাত্র কাম্য ।
আর তারপর থেকেই সারাদিন ল্যান্ডফোনটা বেজে চলেছে । হাড়-হাভাতের দল একেবারে উঠে পড়ে লেগেছে ওকে বিয়ে করার জন্য ।
রাগে গা জ্বলে উঠেছিল সায়ন্তনীর । এত কিছু করা হয়ে গেল অথচ কেউ ওর সাথে আলোচনা পর্যন্ত করলো না । বিয়ে কি ছেলেখেলা নাকি যে রেশন দোকানে গিয়ে কার্ড সাবমিট করলাম আর পাত্র পকেটস্থ করে বাড়ি ফিরে এলাম? আর কিছু না হোক ওর নিজের পছন্দ বলেও তো কিছু একটা থাকতে পারে । বাবাকে এসব বোঝাতে যাওয়াও দায় । বোঝানোর চেষ্টা যে ও করে নি তাও না । এই তো গতকাল বাবাকে বলতেই বলল ‘ তোমাদের জেট গতির যুগের রীতিনীতি আমি বুঝিনা আর বুঝতেও চাইনা । যে যুগের আদর্শ বলে কোন বস্তু নেই তার মধ্যে বাহাদুরিও কিছু নেই । নিজের পছন্দের কিছু আমার জীবদ্দশায় করা যাবে না । তোমাকে বড় করেছি আমি বিয়েটাও আমিই দিয়ে যাবো । তারপর তোমার যা খুশি করতে পার ’।
এরপর তো আর কথা বলা যায় না । একছুটে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিয়েছিল । খায়ও নি কিছু সারাদিন, কিন্তু তাতে সুপ্রকাশ ব্যানার্জীর যে কিছু যায় আসে না তা ও ভালো করেই জানে । দিদির বিয়ের সময় দেখেছে কীভাবে ভালবাসাকে চাবকে সোজা করেছিল ওই লোকটা । কিন্তু এত সহজে হারও মানবে না ও । লাগাক চাবুক, সুনির্মলকে ছেড়ে থাকা ওর পক্ষে জাস্ট অসম্ভব ।
সেই কলেজে প্রথম আলাপ হয়েছিল সুনির্মলের সাথে । আজও সেই দিনটা মনে আছে । প্রথম কলেজ যাওয়ার সময় কত জপিয়েছিল ওই লোকটা । কলেজ যাচ্ছ পড়তে । যাবে, পড়বে বাড়ি আসবে । মাঝপথে কোন আড্ডা দেবে না আর ছেলে বন্ধুর সংখ্যা যেন হাতে গোনা যায় । বাবার মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েও নিজেকে সুনির্মলের সামনে আটকাতে পারেনি । ঝোড়ো হাওয়ার মত এসেছিল আর ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল গহন থেকে গহনে । বাবাকে নিয়ে ভয় ছিল, কিন্তু তাও একটা ঝরা পাতার মত ওর ভালোবাসায় উড়েছিল ও । বাবার কথা মেনেই চলত সবসময় । পারতপক্ষে কারুর সাথে কথা বলতো না । সুনির্মলই এগিয়ে এসে আলাপ জমিয়েছিল-
‘ এই নে ’ একটা ক্যাডবেরি এগিয়ে দিয়ে বলেছিল ‘ আজ আমার জন্মদিন, তুই তো কারুর সাথে কথা বলিস না তাই তোকেই আগে দিলাম । এই ফাঁকে বন্ধুত্বটাও হয়ে যেতে পারে’ ।
এত স্বচ্ছন্দ কথার সামনে পড়ে দিশেহারা লেগেছিল সায়ন্তনীর । খুব ভালো কবিতা লিখত ছেলেটা । ফ্রেশার্স ওয়েলকাম এর দিন একটা ছোট্ট কবিতা পড়ে শুনিয়েছিল । স্বচ্ছন্দ লেখা ও বলার কায়দায় বিভোর হয়ে শুনেছিলো সায়ন্তনী । সেই বোধহয় ভালোলাগার শুরু । তারপর নোট নেওয়া হোক বা এক্সামের সাজেশান সবেতেই সুনির্মল । ব্যাপার জানাজানি হতেও সময় লাগেনি । ক্লাসমেট থেকে টিচার সবাই জেনে গেছিল ওদের ব্যাপারে ।
সায়ন্তনীর জন্মদিনে ওকে নিয়ে লেখা একটা কবিতা গিফট করেছিল, সেটা বইয়ের তাকে গুছিয়ে রাখা আছে । মন খারাপ হলেই পড়ে । একবার-দুবার-তিনবার পড়ার পরেও আজ আর মন ভালো হল না । কীভাবে বোঝাবে ও সুনির্মলকে । আর বোঝাবেই বা কি ? নাকি এবার নিজেকেই বোঝানো দরকার । না না, ওর দিদির মত ও পারবে না সব ছেড়ে অদৃষ্টের হাতে নিজেকে ঠেলে দিতে । কিন্তু করবেই বা কি ?
(২)
-‘ দাঁড়া বাবা ঘরটা একটু ঝাড় দিয়ে দিই । বাসি ঘরে বেরোতে নেই রে, অমঙ্গল হয় ’।
-‘ উফ মা, ছাড়ো তো । এমনিই দেরি হয়ে গেছে । লেট করে গেলে আজ আর ক্লাসে ঢুকতে পারবো না, আর তোমার শরীরের অবস্থাটা দেখেছ । একটা কাজের লোক রাখতে বলছি কবে থেকে... ’ বলতে বলতে বেরিয়ে গেল সুনির্মল । ও অবশ্য জানে কাজের লোক রাখাটা ওদের মত ফ্যামিলিতে একটা বিলাসিতা, তাও আজকাল লিখে নিজের হাতখরচের টাকা উঠে আসায় প্রায়ই মাকে বলে ওই কথা ।
আজ গরমও পড়েছে, তার ওপর বাসে এত ভিড় যে দাঁড়ানোর জন্যেও যুদ্ধ করতে হচ্ছে । কোনমতে হাতটা তুলে বারবার ঘড়ি দেখছে সুনির্মল । নাহ আজ কপালে ঝাড় নির্ঘাত । সায়ন্তনীকে পাক্কা এগারোটায় টাইম দেওয়া আছে আর এখনই প্রায় পৌনে এগারোটা বাজে । তার ওপর কলকাতার বাস! শালা প্রত্যেকটা সিগন্যালে না দাঁড়ালে এর পেটের ভাত হজম হবে না । দুটো কবিতা নিয়ে এসেছে সায়ন্তনীকে দেবে বলে । যেকোনো ফাইন কমাতে ওগুলোই ওকে বরাবর হেল্প করে ।
বাস থেকে যখন হেদুয়ার মোড়ে নামলো তখন অলরেডি সাড়ে এগারোটা বাজে । নিজের সেলফোনটা থেকে নাম্বার ডায়াল করে কানে চেপে ধরতেই ‘ দ্য নাম্বার ইউ আর ডায়ালিং ইজ কারেন্টলি সুইচড অফ, প্লিস ট্রাই আফটার সামটাইম ’। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে আবার ডায়াল করতেই আবার সেই এক কথা । ব্যাপার কি ! ও তো কখনো ফোন অফ রাখে না । আরও দু-তিন বার ফোন করেছিল কিন্তু লাইন পায়নি । মনের ভেতর হাজার রকম চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো । সারাটা রাস্তা ফোন করতে করতে এসেছে । বাড়ি ফিরে মুখে দুটো গুঁজেই নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল । যে মেয়ে কখনই ফোন বন্ধ করে না তার ফোন আজ এতক্ষণ বন্ধ ! বলা নেই কওয়া নেই, দেখা করার কথা ছিল তাও এলো না, ব্যাপার কি । যেভাবেই হোক যোগাযোগ করতেই হবে । কিন্তু কীভাবে করবে কিছুতেই ভেবে পেল না । ওরা একসাথে পড়ে না, সাবজেক্টও আলাদা, ও আর্কিওলজি নিয়ে পড়ছে আর সায়ন্তনী বাংলা নিয়ে । নাহলে হয়ত নোটের ব্যাপারে বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসা যেত । মাঝে এক বছর শুধু একসাথে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়েছিল, তাও একবছরের বেশি মন টেকেনি বলে ছেড়ে দিয়েছে । লাভের মধ্যে শুধু সম্পর্কটা তৈরি হয়ে গেছিল । ওদের সম্পর্ক ওর বন্ধুদের ভালো লাগেনি । ওরা সবসময় বলতো ‘ কেন বাপু বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে যাচ্ছিস ? ওরা কত বড়লোক তোর মত ভ্যাগাবন্ডকে পাত্তাই দেবে না দেখিস । বেকার হেদিয়ে মরবি আর দারু খেয়ে দেবদাস হবি ’। তারপরও আশা হারায় নি, মনের কথা গোপন করার থেকে বলে ফেলা অনেক ভালো । মনটা অনেক হালকা থাকে ।
সায়ন্তনী ওর বাবাকে নিয়ে খুব ভয় পেত । বলতো খুব সাবধানে যোগাযোগ রাখতে, সারাদিন এসএমএস করতে না। বাবা জানতে পারলে খুব প্রবলেম হবে । ওর দিদিকে নাকি জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল লোকটা । বিয়ে করতে
রাজী করানোর জন্য নিজের মেয়েকে চাবুক দিয়ে মেরেছিল । ওর দিদির কথা ভেবে খুব খারাপ লাগত সুনির্মলের, আরও খারাপ লাগত সবসময় যোগাযোগ রাখতে পারবে না ভেবে । তাও কিছু করার ছিল না, নিজের পায়ে না দাঁড়ানো অবধি সাবধানে থাকাই ভালো । আর ওর জন্য সায়ন্তনী গায়ে আঘাত লাগলে ও নিজেকে ক্ষমা করতে পারত না কোনোদিন । তাহলে কি ওর বাবাই...... নাহ্, যেভাবেই হোক খোজ একটা নিতেই হবে ।
(৩)
শুধু ফোনে যে ঝামেলা মেটার নয় সেটা আগেই বুঝলেও এত তাড়াতাড়ি পরের আঘাত আসবে ভাবেনি ও । বুঝলো যেদিন সকালে মা বলল তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হয়ে নে । তোকে দেখতে ছেলের বাড়ির থেকে লোক আসবে । মাথা ঝিমঝিম করে উঠেছিল সায়ন্তনীর । ছেলের বাড়ির লোক মানে ? কোন ছেলে ? কিসের লোক ? আজ কিছুতেই বাড়িতে থাকা সম্ভব না, আজ যে ওর সুনির্মলের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা আছে ।
- ‘ এগুলো কি ঠিক হচ্ছে মা ?’
- ‘ আমি কি জানি । আমায় কেন বলছিস । যা বলার তোর বাবাকে গিয়ে বল ’।
- ‘ হ্যাঁ, বলবই তো । আর শুধু বাবাকে কেন থানাতেও বলব । একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে এভাবে বিয়ে দেওয়া যায় না এটা সুপ্রকাশ ব্যানার্জীর জানা দরকার ’।
তার আগে দরকার সুনির্মলকে ব্যাপারটা জানানো । আজকে যে দেখা করা যাবে না সেটা জানাতে হবে । সবেমাত্র ফোনটা করতে যাচ্ছিল এমন সময় ওর বাবা ঘরে ঢুকে হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল । বাবার হাতে সেদিনের চাবুকটা উঁকি দিচ্ছিল ।
- ‘ তোমাকে যেটুকু করতে বলা হয়েছে তার একচুলও যেন এদিক ওদিক না হয় । বেয়াদবি করলে মেরে তোমার চামড়া ছাড়িয়ে নেব মনে রেখো । যাও রেডি হয়ে নাও লাখ কথা না হলে বিয়ে হয় না, এরা তো শুধু দেখতে আসছে । আপত্তিটা কোথায় তোমার ?’
- ‘ তুমি তো জানো আমি একজনকে......’
- ‘ ও দ্যাট ব্লাডি রাস্কেল, আমার কথামত না চললে ওটাকে মেরে পুঁতে দেব কেউ ট্রেস করতেও পারবে না । ওর ভালো চাও তো ডু ইট আর্লি ’ বলেই বেড়িয়ে গেছিল লোকটা ।
ওই লোকটাকে বাবা ভাবতে ঘেন্না লাগছিলো এবার । কিছুতেই ও বসবে না ওখানে । দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল । কীভাবে এই মৃত্যুপুরী থেকে বেরবে ? জানে না ও, কেউ জানে না । পালাতে হবে ওকে, যেভাবে হোক পালাতেই হবে । যেভাবেই হোক । আর কিছু না হোক একটা ব্লেড ঠিক খুজে পাবে ঘরে । তারপর উচিৎ শিক্ষা হবে লোকটার ।
কাজটা খুব সাবধানে করতে হবে । হাতে লেখা সুনির্মলের ‘ এস ’ টায় যেন আঁচড় না লাগে । এইসময় অন্তত ওকে ব্যাথা দিয়ে যাবে না সায়ন্তনী, কিছুতেই না ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন