খামচানো কালখণ্ড
(ধারাবাহিক)
বুড়োদের কুসঙ্গে
মলয় রায়চৌধুরী
'কুসঙ্গ' শব্দটা কি বর্তমান সমাজের প্রেক্ষিতে প্রযোজ্য? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শব্দকোষ কাছে থাকলে শব্দটার উৎপত্তি টের পাওয়া যেত। কলকাতা থেকে চলে আসার সময়ে সব বইপত্র বিলিয়ে দিয়েছিলুম ( মুম্বাইতে একরুমের ফ্ল্যাটে থাকি ) বলে হাতের কাছে উৎস খোঁজার সূত্র নেই। কবেই বা জন্ম হলো শব্দটার? কার রচনায় প্রথম দেখা দিয়েছিল এই অভিব্যক্তিটি ? ইংরাজরা এনেছিল কি এই অভিব্যক্তিটি, ভিক্টোরীয় ইংরাজদের প্রভাব কম ছিল না আমাদের নতুন প্রাগাধুনিকমূল্যবোধে । হয়তো সেখান থেকেই শব্দটির জন্ম, 'ইভল কমপ্যানি' ভাবনাটির বাংলা হিসাবে । কেননা 'ইভল' ভাবকল্পটির উৎস খ্রিস্টধর্ম , যে ধর্মটির প্রভাব আমাদের রেনেসঁসি ভাবুকদের ওপর ছিল প্রগাঢ় । রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসে মনোরমার স্বামী টাকা ওড়াত, নেশা করত কুসঙ্গে পড়ে, জানিয়েছেন ঔপন্যাসিক । আমার প্রজন্মে শৈশবে শুনেছি কুসঙ্গে পড়ার কথা -- আমার মেজদা ( যাকে বড়জ্যাঠা এক বেশ্যার কাছ থেকে কিনেছিলেন ) তাড়ি, দিশি মদ অর্থাৎ বিহারি ঠররা খেতেন, বেশ্যাদের সঙ্গ করতেন, জুয়া খেলতেন, মারামারি করতেন ইত্যাদি , মাত্র ১৫-১৬ বছর বয়স থেকেই; ওই সমস্ত ব্যাপার তিনি নিজেই বেছে নিয়েছিলেন, কেউ ওনাকে শেখায়নি। ওনার সঙ্গকে পাটনার বাঙালিরা বলত কুসঙ্গ । আমি মারামারি করিনি কখনও ; কবিতা লেখার জন্য পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতে তুললে পাটনার বাঙালিরা আমার সঙ্গকে বলতেন কুসঙ্গ । অবশ্য টাইম ম্যাগাজিন ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় আমার সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশিত হবার পর ওই 'কু' ব্যাপারটা আপনা থেকেই উবে গিয়েছিল। তার মানে সমাজের একটি বর্গের কাছে কবিতা লেখাও কুকর্ম । তবে যাঁরা রাজসাক্ষী হয়েছিলেন আর আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তাঁরা আমার সঙ্গকে পরবর্তীকালেকুসঙ্গ মনে করে এড়িয়ে গেছেন । চরিত্রের কোনো মাত্রা যে কখন কার চোখে 'কু' হয়ে দেখা দেবে বলা মুশকিল। শৈশবে বহু বাঙালি পরিবারে শেয়ারে টাকা খাটানোকে ভালো চোখে দেখা হত না-- বলা হতো অমুক লোকটা ফাটকা খেলে, অর্থাৎ কুকর্ম করে, তার সঙ্গ কুসঙ্গ !
'কু' আর 'সু' এর পার্থক্য ঘুচে গিয়ে সব সঙ্গই হয়ে গেছে সাময়িক । তবু নানা শহরে থাকার পর এখন মুম্বাইতে পৌঁছে টের পাচ্ছি যে বুড়োরাও ওই 'কু' ব্যাপাগুলোয়এখনও বেশ মজে আছেন।
আজকাল একা থাকতে ভালো লাগে বলে সকালে বা বিকালে জগার্স পার্কে গিয়ে নিজের মনে ঘোরাঘুরি করতে থাকলেও কোনো না কোনো বয়স্ক এগিয়ে এসে গল্প করতে চান । কম বয়সে কুসঙ্গে পড়ার মতোই বেশি বয়সেও কুসঙ্গে যে পড়া যায় তা এই জগার্স পার্কের বুড়োদের কাছ থেকে জানলুম। একদল বুড়ো আছেন যাঁরা হৃদযন্ত্রকে টাটকা রাখার জন্য একটা লাফিং ক্লাব বা হাসাহাসির গোষ্ঠী চালান। যে কেউ ওই দলে ঢুকে সমবেত হাসিতে যোগ দিয়ে হাসতে পারেন। কেউই হাসায় না কিন্তু সবাই একযোগে হাত উঁচু করে অট্টহাস্যর নমুনা প্রদর্শন করেন। নেতা গোছের এক বুড়ো ওয়ান টু থ্রি বলতেই, ব্যাস, হাত উঁচু করে বেদম নকল-হাসি । আমিও ঢুকে গেলুম অচেনা বুড়োদের জমঘটে, দেখার জন্য যে অকারণ হাসি হাসার আগে সকলের মুখগুলো কেমন দেখায়-- গম্ভীর, চিন্তান্বিতনাকি মুচকি হাসি যা ক্রমে দাঙ্গার মতো ছড়িয়ে পড়ে মুখের সর্বত্র। কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে কেউ হাসালে হাসিটা আপনা থেকেই আসে আর যিনি যতক্ষণ সেই ঘটনার মজায় মজে থাকেন, তিনি ততক্ষণ হাসেন। কিন্তু এই হৃদয়-বিষয়ক হাসি একেবারে সুনির্দিষ্ট সময়ের । প্রথমে গম্ভীর মুখ, তারপর হাসি, তারপর আবার গম্ভীর মুখ।হাসির আগে আর পরে ঠিক কী চলতে থাকে সবায়ের মগজে ? তা জানার জন্য আমি এক-এক করে বুড়োদের সঙ্গে পরিচয় করলুম। সকলেই যে অবসরপ্রাপ্ত তা নয় । চাকরি করলে তার একটা অবসরপ্রাপ্তির দিন হয়। এই বুড়োদের মধ্যে চাকুরিজীবী কম । শেয়ার-ব্রোকার, আমদানি-রপ্তানি, হীরের ব্যবসা, জজসায়েব রিটায়ার করে অ্যাডভোকেট, দোকানদার, রেস্তরাঁ মালিক, ঠিকাদার ইত্যাদি।
আমার সঙ্গে যিনি যেচে আলাপ করতে এলেন তিনি যে কাজটি করেন তা হলো কুকুরকে হাগাতে নিয়ে যাওয়া ! মুম্বাইতে কারোর হাতে সময় নেই । অথচ বড়োলোকমি দেখাবার জন্য বিদেশি কুকুর পোষেন। সেই কুকুরকে হাগাতে নিয়ে যাবার, ভেটেনারি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। সুধাংশু প্যাটেল বাড়ি-বাড়ি গিয়ে কুকুরটিকে হাগাতে নিয়ে যান। প্রতি বাড়ি থেকে এক হাজার টাকা পান। সকালে চারটে কুকুরকে হাগিয়ে এসেছেন। ফিরে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করে আবার বেরিয়ে পড়বেন কুকুর হাগাতে । প্রতিটি কুকুরের হাগবার সময় নির্ধারিত । উনি সেই সময়েই যান। রটউইলার আর পিট বুল কুকুর হলে তাদের মুখে বাঁধন পরিয়ে পথে বেরোন। এই দুটি কুকুর হাগানোর চার্জ দুহাজার টাকা মাসে । সারাদিন ধরে যে এলাকায় উনি কুকুর হাগাতে নিয়ে যান সেটি ওনার কন্সটিটিউয়েনসিহয়ে গেছে; পথের কুকুররা সেই এলাকা মাড়ায় না।
হল্যাণ্ডে দেখেছিলুম পথের ধারে, পার্কে প্রায় সর্বত্র, একটা করে বাক্স ঝোলানো । তাতে লেখা, আপনার কুকুর পথে যদি হাগে তবে দয়া করে তার গু তুলে নিয়ে এই বাক্সে ফেলবেন। ওনাকে কথাটা বলতে উনি বললেন যে তা উনি জানেন । মুম্বাইতে সে-সমস্যা নেই, কেননা মানুষই তো এই শহরে রাস্তার ধারে, রেললাইনের ধারে পায়খানা করতে বসে, স্ত্রী-পুরুষ সবাই।
আমি জানতে চেয়েছিলুম, মাসে কত রোজগার হয়, সংসার চলে যায় ?
উনি বললেন, পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা মতোন হয় । বুড়ো-বুড়ি দুজনের ভালো ভাবেই চলে যায়।
কবে থেকে একাজ করছেন ?
বছর পাঁচেক। তার আগে ডগ ব্রিডিং ব্যবসা করতেন। সে-কাজটা এখন ওনার ছেলে করে, আহমেদাবাদে।
ভাবলুম, গুজরাতিগুলোটাকা রোজগারের কত উপায় বের করেছে।
উনি জানতে চেয়েছিলেন, আমি কী করি ।
আমি বলেছিলুম, কবিতা লিখি। বাংলায় ।
সুধাংশু প্যাটেল বললেন, চলুন না আমার বাড়ি । আমিও কবিতা লিখি । শোনাবো আপনাকে। গুজরাতিতে লিখি না, ইংরেজিতে লিখি । ইউটিউবে আমার অনেক কবিতাপাঠ আছে।
শুনে বেশ ভালো লাগল। কুকুর হাগানোর কাজ করেও তাহলে কবিতা লেখা যায়। পোস্টমডার্ন কুসঙ্গ !
10 comments:
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
কুকুর হাজানো
হেঃ হেঃ হেঃ
কুকুর হাজানো
পঁয়
তা
ল্লিশ
বাওয়া
হাগার
আর ও-এন-গি-সি গয়েন করে কি হবে ? চলোওও মুম্বই গাওয়া গাক্,সার্থক এ গনম্
'সু' আর 'কু' ব্যাপারগুলি সত্যিই আপেক্ষিক। ভালো লাগছে পড়তে। এগিয়ে চলুক আরো।
chamatkaar suchonaa hoyechhe. parer kisti-r opekkhaay thaakbo. shubhechchhaa!!
দারুণ লাগচগে, সাবলীল গদ্য। ভাবছি কাজতা নিয়েই ফেলি
কু যে কে ? আর কেই বা সু ?
বুঝতেই সময় চলে যায় । আজ যে কু,কালকেই সু আবার এই উল্টোটাও সত্যি ।
খুবই প্রাঞ্জল আর ঝরঝরে লেখা । ভালো লাগছে পড়তে । অপেক্ষায় রইলাম ।
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি পরবর্তী কিস্তির। ভীষণ ভালো লাগল...
porer sonkhar jonno apeksar sobure mewa joto taratari fole toto i valo......rosograhi...chitto aakorsok.
নাঃ, আর যাই হোক, পাঠককে নিজের মনোভাবের অংশীদার ক'রে নেওয়ার কাজটা বেশ সুচতুরভাবেই ক'রে ফেলতে পারে তার গদ্য - অথচ কোন বিশেষ এফর্ট দেবার-ও প্রয়োজন হয়না, হয়নি এখেনে। চলুক মলয়দা। আপনি আসুন, আমাদের গলায়-বাঁধা দড়িগুলি হাতে নিন।
কোনো কথা হবে না !
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন