সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১২

সুবীর ঘোষ

কবিতার মানসাঙ্ক

মানুষ যখন কবিতা লেখে নি তখন সে কবিতা বলেছে । যখন কবিতা বলে নি তখন সে শব্দ বলেছে । যখন শব্দ শেখে নি তখন ধ্বনি উচ্চারণ করেছে । এবং সেই ধ্বনি কুজন কল্লোল হ্রেষা বৃংহণের মতো সমভাবেই অর্থহীন । আমাদের প্রয়োজনে শব্দকে অর্থময় করা হয়েছে । আমার কাছে যা অর্থময় অন্যের কাছে তা অর্থহীন বা অন্য অর্থের দ্যোতক । ভাষার কাপলিংয়ে জুতে দিলে শব্দরা শকটের মতো এগোয় । তখন সেই গতির বস্তুসংগতি তুলে এনে চেতনপ্রতিমা সৃজিত হয় ।

নদী ও কবিতা দুই-ই যদি নারীর মতো হয় তাহলে নারী কীরকম ? নারী আসলে দুই প্রতিমার সমাহার – শারীরপ্রতিমা ও চেতনপ্রতিমা । নারীশরীরের প্রতি পৃথিবীর আবহমান হিপোক্রিসির জবাবে কবিতা সিংহ একটা চমৎকার সাজেশন দিয়েছিলেন—‘তার চেয়ে নগ্ন যাও হে রমণী ধু ধু রৌদ্রে জোড় করি পাণি’ । কবিতা শূন্যতার বুকে দাঁড়িয়ে অস্মিতার স্বাক্ষর । তুমুল হতাশ্বাস ও মূল্যবোধহীনতার কেন্দ্রভূমি থেকে উড়ে যাওয়া মুক্তিবলাকা । উপলব্ধির তীর ঘেঁষে বয়ে যায় অনাবশ্যকতা ও অসর্মথনের অবান্তর বিপ্রতীপতা ।

একটা সর্মথণ
একই সঙ্গে নিশ্চিন্ত করছে
হাজার অসর্মথন ।
একটা নির্বাচন একই সঙ্গে
প্রমাণ করছে কত স্তব্ধ
অনির্বাচন, অমনোনয়ন !
যা আছে তাই
অস্বীকারের ভিতর আছে
তামস নির্বান্ধব অস্বীকার
আর আমাদের
অশনভূষণ ।
( আলোক সরকার )

আসলে আমরা বাঁচতে চাই বলে প্রাণপনে কবিতাকে আঁকড়ে ধরি । আসলে আমরা বাঁচতে চেয়েই এতদূর নইলে এমন হাঁটার মানে আর কী ! পৃথিবী আছে তার সমস্ত ভ্রান্তিময়তা নিয়ে।

জ্ঞানশূন্য হতে লাগে যত অনুপল
তার থেকে আগে
বিশ্বস্ত কলম থেকে ছিটকে যায়
বিচারের বাণী ।

কলম কখনো বিশ্বস্ত কখনো পক্ষপাতিত্ব তার । তবু কবির কলম তাঁর শেষ পারানির কড়ি তাঁর শেষ স্বেদবিন্দু ।

অশক্ত হলেও হাত প্রতারক নয়
আমি বলি ধরো , হাত ধরো
এ হাত যে দিকে মেলা সে দিকে দিগন্ত
ওই পারে দিশা , মনে করো ।

কবির পিপাসা অনন্ত কিন্তু তাঁর চাওয়া বড়োই সীমিত । এ এক অদ্ভুত পরস্পরবিরুদ্ধ অবস্থান । কবি তাঁর চোখের সামনের বিচিত্র রঙে রঙিন ধরিত্রীকে যেন গণ্ডূষে ধরে অবলোকন করতে চান তবু যদি সে তৃষ্ণা মেটে । ভূমি থেকে ভূমার মাঝখানে কত বিরুদ্ধতা কত সংঘর্ষ । কবি সমর চক্রবর্তী যেমন বলেছেন—‘কোথাও কবিতা হচ্ছে , আমি তার পিপাসা পেয়েছি’ । এই পিপাসা আসীমান্ত যা সারা জীবনেও মেটে না ।

এ পৃথিবীর কাছে আর
কতটুকু চাই বলো ;
শুধু দুটো শুকনো পাতা
যতক্ষণ হাতের আদরে
ভেঙে না যাচ্ছে
শুয়ে না যাচ্ছে ধুলোর শয্যায়
ততক্ষণ চোখের বুরুশে মাখি
উড়ে যাওয়া বয়সের রঙ ।
এসব কী বেশি চাওয়া ?
কঞ্জুষের জমারও অধিক
সবুজে সবুজ থাক
রক্তের লাল দিয়ে
কবিতার সংবর্ধনা হোক ।

অলংকরণ –কৌশিক বিশ্বাস

1 comments:

অপরাজিতা বলেছেন...

'কবির পিপাসা অনন্ত কিন্তু তাঁর চাওয়া বড়োই সীমিত । এ এক অদ্ভুত পরস্পরবিরুদ্ধ অবস্থান ।'---ভাল লাগল।