বুধবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১২

সম্পাদকীয় - ৯ম সংখ্যা, ১ম বর্ষ



শৈশব যখন


'কাগজফুলের গাছটা তো এতটা ঝাড়ালো ছিল না, আমার ছটফটে শিমি, সে কোথায় গেল - তাকে তো উঁকি মারতে দেখছি না।' 
- বিড়িবড় করে বলে উঠলো চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠা রিক্তযৌবনা বিলকিস।


এইতো ক'দিন আগেকার কথা, রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে এই আপন ঘর, গাছ আর শৈশব ছেড়ে অজানার পথে। সে ছিল মায়ের জেষ্ঠ কন্যা। বাপ মরা অভাবের সংসারে পাঁচ ভাই-বোনের বড় হবার সুবাদে তাকেই কাঁধে তুলে নিতে হতেছিল সংসারের জোয়াল। একব্যাগ বই-খাতা নিয়ে যে সময়ে তার সমবয়সী ছেলেমেয়েরা সকাল বেলায় ঠেলাঠেলি করতে করতে স্কুলে যেত, সেই সময় উনুনের ছাই নিয়ে বাসন মাজতে হতো তাকে। ছয়-ছয়টা বাড়িতে বাসন মাজা, কাপড় কাচা আর কুটনো কাটা করে বেলা একটা বেজে যেত বাড়ি ফিরতে। তারপর ঘরের কাজ, রান্নায় মা-কে সাহায্য, খেতে-খেতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত। তাতেও নিস্তার নেই, আবার তো বেরোতে হবে - এবেলার কাজগুলো সারতে হবে তো, ছ’ছয়টা বাড়ির কাজ বলে কথা। সব মেনে নিয়েছিল সে, চলছিল বেশ, বাদ সাধল তার নকুল মামার কথায়। একটা নাকি ভালো পাত্র পাওয়া গেছে। পাঁচ-হাজার টাকা দেবে বলেছে বিয়ে দিলে। মায়ের কথার কী আর দাম তখন, মামার কথায় রাজী হতেই হলো। একবার সে উঁকি মেরে শুনেছিল, তার নাকি একবার বিয়ে হয়েছিল, বয়স অবিশ্যি একটু বেশি - সাতচল্লিশ, তাতে কি, শহরে বাড়ি, শুনেছি নাকি চাকর-বাকরও আছে। তবু তার তের বছরের কিশোরী মন মেনে নিতে পারেনি। আজ বাবা বেঁচে থাকলেও যে ওইরকম বয়েস হতো। তাই রাতের অন্ধকারে ধানক্ষেত ধরে ছুট, শহরের প্রান্তরে ভোররাতের ট্রেন ধরে অজানার পথে।

তারপর, সে অনেক কথা, হায়না-নেকড়ের হাত থেকে ন-ন'টা বছর বাঁচিয়ে সদ্য ফিরে এসেছে নিজের গ্রামে, নিজের বাড়িতে।

গ্রামে এখন 'খিচুরি-স্কুল'। দুপুরের খাবার খেতেও অনেকে স্কুল যায় না। কী করে যাবে, মিনতি, সামিনা ওদেরও তো একই দশা, কাজ না করলে ওরা খাবে কী ! তাই বিলকিস সবাইকে নিয়ে সন্ধে স্কুলে যায়, শেখায় জীবনের মানে, বেঁচে থাকার অন্য মানে। বেঁচে থাকা মানে দু'বেলা ফ্যান-ভাত খাওয়া নয়, বেঁচে থাকা মানে তের বছরে বিয়ে করে সন্তান উৎপাদন নয়। বেঁচে থাকা মানে নিজেকে জানা, চেনা, নিজেকে উজাড় করে দেওয়া।







আজ শিশুদিবস। আজ যখন আমাদের মনে পড়ে যায় সেই ড্রয়িং খাতায় পেন্সিলে আঁকা শৈশবের কথা, দিদার কোলে শোয়া রুপকথা, মেঘের ডাকে সোঁদা গন্ধভরা আম কুড়ানোর গল্প, মাঝবয়সেও ভারাক্তান্ত হয়ে যায় মন। শৈশব মানুষের কতো রকমেরই না হয়, কখনো রঙ্গিন, কখনো সাদাকালো, কখনো হাসিমাখা, কখনো অশ্রুভরা - বিচিত্রতায় ভরা শৈশবগুলো খুব তাড়াতাড়ি পথ হেঁটে যায়, বড্ড তাড়াতাড়ি। চাইলেই আর ফিরতে পারি না সেই দিনগুলোতে।

আর আজ, খবরের কাগজ খুললেই দেখি ধর্ষিত শিশুর খবর, কিশোর-কিশোরীর শ্রমে গড়ে ওঠা পর্যটন শিল্পের কাহিনি, ভীষণ চঞ্চল হয়ে ওঠে মন। মনে পড়ে যায় সেই উদ্দাম দুরন্ত দিনগুলোর কথা, কোনোরকম ভাবনা-চিন্তা না করেই যখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারতাম। তবু সান্ত্বনা, এখনও বেঁচে আছে আজকের বিলকিস-রা, নিজের নীলরঙা শৈশব আঁচলের কোঁচরে লুকিয়ে রেখে তুলোর ভেলায় তারা এনে দিতে চায় নতুন জীবনের স্বাদ আজকের কচি-কাঁচাদের জন্য, তাদের নিজেদের চাওয়া পাওয়ার ইচ্ছাপুরণ করতে চায় আজকের মিনু-গোপালের শৈশব গড়ে তুলে, নিজের অজান্তেই শপথ নেয় –


“এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার”।


আসুন আজ আমরা সকলে এসে দাঁড়াই আজকের এই বিলকিসদের পাশে, আজকের দিনটা হয়ে উঠুক ওদের আনন্দের দিন, আমরা আমাদের চাওয়া-পাওয়াটুকু ভাগ করে নিই ওদের সাথে। উৎসর্গ করি আমাদের ক্ষেপচুরিয়াসের এই সংখ্যাটি এই বিলকিসদের।

শুভ হোক সকলের। যে সমস্ত লেখক/লেখিকা তাঁদের অমূল্য সৃষ্টি এ সংখ্যায় দিয়েছেন তাঁদের অশেষ ধন্যবাদ জানাই। বিশেষ করে অন্যবারের মতো এবারের সংখ্যাটিকেও অলংকরণ করে দেবার জন্য আমার অসংখ্য ধন্যবাদ কবি কৌশিক বিশ্বাস ও কবি মেঘ অদিতিকে ।


ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষে -
সুমিত রঞ্জন দাস।




2 comments:

Banibrata বলেছেন...

ক্ষ্যাপামিতে অভিযুক্ত সকল কর্মকুশলীকে আমার অভিনন্দন!

অপরাজিতা বলেছেন...

খুব সুন্দর লিখেছ, সুমিত।