বুধবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১২

ছোটগল্প - সরদার মেরাজ

স্বপ্ন-মঙ্গল
সরদার মেরাজ

ঘুমিয়ে আছি। নদীর পানির ঢেউ ভাঙার শব্দ। স্বপ্নে দেখলাম, কেউ একজন এসে আমাকে বলছে‘, তোর বাড়ির দক্ষিণ দিকের পুকুর, পুকুরে অনেকগুলো শাপলা ফুল ফুটে আছে। তার মধ্যে একটি শাপলা ফুটেছে লাল। সেই লাল শাপলাটির নিচে, পানির তলায় সোনার ডেক। তাতে কাঁড়ি কাঁড়ি সোনার মোহর। ঘুম থেকে তুই জাগবি, আজানের ঠিক আগে। কেউ যেন না দেখে, কাউকে যেন তুই কিছু না বলিস, যাবি পুকুর পাড়ে, একডুবেই তুলে নিবি যত পারিস সোনার মুদ্রা। খবরদার ভুলেও যেন দ্বিতীয়বার ডুব দিয়ে লোভ না করিস। ’ তারপর সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

একটু পরেই ঘুম ভাঙলো আমার। তখনো কেউ জেগে ওঠেনি, ফজরের আজান হয়নি মসজিদে। পাশে ঘুমাচ্ছিল বৌ-এ। তাকে কিছু জানালাম না। পা টিপে টিপে চলে গেলাম পুকুর পাড়ে। দেখলাম পুকুরের ঠিক মাঝখানটিতে একটা লাল শাপলা। নেমে গেলাম পুকুরে, উত্তেজনায় বুক কাঁপছিল আমার। লাল শাপলাটির কাছে এসে নি:শব্দে ডুব দিলাম। দেখলাম, সোনার ডেক। তার আলোয় পুকুরের পানি সব সোনা হয়ে গেছে! দুহাতে সাধ্যমতো সোনা নিয়ে উপরে উঠে এলাম। আবার নেমে পড়লাম। আর এক ডুব দিয়ে আরও কিছু সোনার মোহর নিয়ে আসা যাক। স্বপ্নের কথা স্মরণ করে উঠে এলাম। শেষে আমার হাত দুটো ডেকে আটকা পড়ে থাকে কী না কে জানে!

সোনা নিয়ে বাড়ি চলে এলাম। কাউকে কিছু বললাম না। আনন্দে আমি আটখানা। এবার হবে শুরু আমার ইচ্ছা পূরণের পালা। টাকা দিয়ে আমি কিনে ফেলবো এই গ্রামের জায়গা-জমি সব। আমি হবো গ্রামের মাতব্বর। তখন আমার উপর কথা বলার কেউ থাকবে না। আদিগা-র থেকে শিখে নেব ভয়ঙ্কর সব যাদুবিদ্যা। তারপর তাকেই শেষ করে দেবো। নাহারকে বানাবো দুই নম্বর বৌ। আমার প্রেমকে প্রত্যাখ্যান করে বিয়ে বসেছে আসাদের সঙ্গে। আমি ওর বিয়ে ছুটাবো।

সূর্য মাথার উপরে। সোনার মুদ্রাগুলো তখনও চলে যায়নি। মনে হয় অদৃশ্য হবে না। অদৃশ্য হবার কোনো কারণও নেই। অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি স্বপ্নলোকের কথা।

স্বর্ণকারের দোকানে গেলাম। একটি মুদ্রা বেচে পেলাম পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। সবগুলো মুদ্রা বেচলে আমি হয়ে যাবো কোটিপতি। হলামও তাই। আদিগাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলাম। টাকার জন্য বেচারা যাদু-মন্ত্র শেখালো, শেষে টাকা পেল না, জীবনটাও গেল। রহস্যময় ব্যাধি ধরিয়ে মেরে ফেললাম আসাদকে। নাহারকে আনলাম ঘরে। এলাকার লোকজন মাতব্বর বলে মানে। সাহায্যের জন্য আসে। পা টিপে দেয়।


অন্যকে অদৃশ্য করার ক্ষমতা আমার আগে থেকেই ছিল বলে আমি দাবি করি। এখন নিজেকেও অদৃশ্য করতে পারি। যাদুবলে যার-তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিতে পারি। অসাধারণ ক্ষমতা আমার। ধরা যাক বাতাসের অভাবে ধান উড়ানো বন্ধ হয়ে আছে, মন্ত্র আওড়ালাম, বাতাস শুরু হলো, ধান উড়ানো শুরু হলো। হাতে মাটির পিণ্ড রেখে মুঠি বন্ধ করলাম, হয়ে গেল একটি আপেল। যাদু বলে আমি মুহূর্তে চলে যাই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। সমূদ্রে তুফান সৃষ্টি করি।

একটি যাদু ছিল অন্যরকম। সে যাদুর বলে বৃদ্ধ মানুষ জোয়ান হয়ে যেত। অনেক উৎসাহী এসে সে যাদু শিখতে ধর্ণা দিয়েছে। টাকা খুইয়েছে। কিন্তু সে যাদু আর শিখতে পারেনি। ভুল শিখিয়ে দিয়েছি তাদের। সে মন্ত্রটি আজ এখানে বর্ণনা করছি:

‘সং তুং আফালাং যম্
রং জুং আফালাং মম্
বিং সেথি যাগ কিস্ কিস্
পং তু সা ইবলিশ।’

কী? ভাবছেন বিনা পয়সায় আপনি শিখে গেলেন মন্ত্রটা! জি-না। সে ভরসা মিছে। আমাকে কি তাই মনে হয়! ভুলেও সে কাজটি করবেন না। মন্ত্রের মাঝের একটি লাইন এখানে বাদ দিয়ে বলেছি। ফলে মন্ত্রটি এখন ভয়ঙ্কর। এটাকে আপনি যতবার পাঠ করবেন ততবার আপনার হায়াত থেকে একটি একটি করে দিন কেটে নেওয়া হবে।

এভাবে যাচ্ছিল। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যাদুকর আমি এবং শ্রেষ্ঠ ধনী। যাকে খুশি তাকে দান করি, যাকে খুশি হয় না করি না। যখন খুশি মেঘের সৃষ্টি করি, যখন খুশি রোদ্দুর।

রোদ্দুরে বসেছিলাম। নাহার এসে বলল, আপনার কফি।

কফির কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিলাম। বরফের মতো ঠান্ডা কফি।

ফজরের আজান হয়ে গেছে। আসমতো খাঁ এসে বলল, করিমুদ্দি, ওই করিমুদ্দি, বেলা বাড়ছে, ওঠ, পার কর।

উঠে বসলাম। দুহাত দিয়ে দুপা চুলকাচ্ছিলাম। ডোগা ডোগা উঠে গেছে পায়ে। আলসেমি ভাঙতে ভাঙতে বুঝলাম: গতরাতে ঘরে ফেরা হয়নি। নৌকাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সারারাত মশার কামড় খেয়ে কেটেছে।

বললাম, আজ কী বার য্যান চাচা?

ক্যান, শুক্কুরবার যে আজ, হাটবার, তাও ভুলে গেছিস!

চাচাকে পার করে দিতে দিতে ভাবছিলাম গতরাতের কথা। স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্নটা ভালোই জমে উঠেছিল আমার।