বুধবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১২

মলয় রায়চৌধুরীর অপ্রকাশিত ডাইরি

খামচানো কালপৃষ্ঠা

ঘৃণিতের আহ্লাদ
মলয় রায়চৌধুরী


যখন লেখালিখি আরম্ভ করেছিলুম, তখন বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও লিখতুম । কিন্তু ইংরেজিতে লেখাগুলো কলম দিয়ে লেখার দরুণ ফেরত আসতো, এই সম্পাদকীয় বার্তা নিয়ে যে "দয়া করে আপনার রচনাটি টাইপ করে পাঠান ; টাইপ করার সময়ে খেয়াল রাখবেন দুই লাইনের মাঝে যেন স্পেস থাকে এবং বাঁদিকে এক-চতুর্থাংশ মার্জিন থাকে । " অনেক খুঁজে পেতে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড টাইপরাইটার কিনেছিলুম । টাইপ করাটা প্রথানুগতভাবে টাইপিংস্কুলে গিয়ে শিখিনি । এক আঙুল দিয়েই টাইপ করতুম । ১৯৬১ সালে যখন হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হলো তখন প্রথম দিকের বুলেটিনগুলো ইংরেজিতে বেরিয়েছিল । ওই টাইপরাইটারে এক আঙুল দিয়ে টাইপ করে প্রেসে ম্যাটার দিতুম । কলকাতা পুলিশ যখন আমায় গ্রেপ্তার করতে এসেছিল তখন তাদের সম্ভবতনির্দেশ দেয়া ছিল যে লেখালিখির সঙ্গে জড়িত যা হাতের কাছে পাবে সবই বাজেয়াপ্ত করে কলকাতায় নিয়ে আসবে । ইন্সপেক্টার মশায়, যিনি সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করছিলেন, তিনি বললেন, "এ শালা চোরের টানা মাল মনে হচ্ছে", এবং সেটিও, আরও কুড়িটি জিনিসের সঙ্গে নিয়ে নিলেন । প্রথম টাইপরাইটারটা গেল ।

দ্বিতীয় টাইপরাইটারটা আমেরিকা থেকে পাঠিয়েছিলেন 'সলটেড ফেদার্স' পত্রিকার সম্পাদক ডিক বাকেন । ওনাকে মামলার কাগজপত্র পাঠিয়েছিলুম আর তা থেকে উনি জেনেছিলেন যে আমার টাইপরাইটারটা গেছে । তাছাড়া ওনাদের লেখা পাঠাতে হচ্ছিল হাতে লিখে । মামলার পর বেশ কিছুকাল লেখালিখি করিনি । ডিক বাকেনের দেয়া টাইপরাইটারটা ব্যবহার না করার ফলে অকেজো হয়ে পড়েছিল । তারপর যখন পাটনা থেকে লখনউ চলে গেলুম তখন পাটনায় আমার জিনিসপত্র সব নয়ছয় হয়ে যায় । পাটনায় আর ফিরিনি । লখনউতে মা মারা যাবার পর যখন আবার লেখালিখি শুরু করলুম একটা পোর্টেবল রেমিংটন টাইপরাইটার কিনলুম । বাংলা লেখায় একাগ্র হবার কারণে এই টাইপরাইটারটিও পড়েপড়ে অকেজো হয়ে গিয়েছিল ।

লখনউ থেকে গেলুম মুম্বাই । সঙ্গে অকেজো টাইপরাইটারটিও । হঠাৎ একদিন একটা চিঠি পেলুম বাউলিং গ্রিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাওয়ার্ড ম্যাককর্ডের কাছ থেকে । উনি জানিয়েছেন যে আমেরিকার টমসন প্রেস ওদের আত্মজীবনী সিরিজে আমার আত্মজীবনী প্রকাশ করতে চায় ; এই আত্মজীবনীগুলো রাইটার্স ওয়র্কশপের ছাত্রদের পড়ানো হয় সেখানে । আবার টাইপরাইটারের প্রয়োজন দেখা দিলো । নাড়ানাড়ি করে দেখলুম যে জ্যাম হয়ে গেছে । তখন থাকতুম সান্টাক্রুজে । খোঁজ নিয়ে কোনো টাইপরাইটার মেকানিক পেলুম না । জুহু রোডে একটা কমপিউটার শেখার স্কুল ছিল ; সেসময়ে কমপিউটারে টাইপ করার জন্য অনেকে টাইপ করা অভ্যাস করতেন । সেই স্কুলে ঢুঁ মেরে জানতে পারলুম যে জুহুর সমুদ্রের ধারে গোয়ানিজ কলোনিতে একজন টাইপরাইটার মেকানিক থাকেন, তাঁর নাম ন্যাজারেথ ।

লখনউতে যখন পাটনা থেকে গিয়েছিলুম তখন সেখানের অকটোবরের শীত সামাল দিতে ফিকে সবুজ রঙের পাঠানি স্যুট বা আফগানি স্যুট করিয়েছিলুম । পাটনা অফিস যে কটা ফেয়ারওয়েল দিয়েছিল তাতে ওই স্যুট পিসটাও পেয়েছিলুম । আমার জামাকাপড়ের কোনোনিজস্ব স্টাইল নেই । বুশ শার্ট বা টি শার্টের সঙ্গে ফুলপ্যান্ট পরি । মুম্বাইতে যেটুকু ঠান্ডা পড়ে, গরম জামাকাপড় দরকার হয় না । তবে আমি শীতকাতুরে বলে জানুয়ারি মাসে আফগানি স্যুটটা পরতুম । লখনউতে দাড়ি রাখা আরম্ভ করেছিলুম । একগাল দাড়ি আর আফগানি স্যুটে লখনউতে বেশ নওয়াবি চালে হাঁটা-চলা করা যেত । অনেকেই আফগানি স্যুট পরতেন সেসময়ে । বাবরি মসজিদ কাণ্ড ঘটেনি তখন । মুম্বাইতেও পরা যেত আফগানি স্যুট, শিবসেনার সেনাবাহিনীর হাতে প্যাঁদানি খাবার ভয় ছিল না । অবশ্য অনেকে আফগানি স্যুট পরে কপালে একটা লাল টিকা এঁকে ঘুরে বেড়িয়েছে দাঙ্গার পরেও ।

ন্যাজারেথকে খুঁজে বের করতে গিয়েছিলুম আফগানি স্যুটটাপরেই । জুহু সেসময়ে এখনকার মতোন বৈভবশালীদের এলাকা হয়ে উঠেনি, এত নামিদামি হোটেল-রেস্তরাঁ আর হাইরাইজ হয়নি । সেসময়ে কিছু-কিছু বস্তিও ছিল । কয়েকটা বস্তিতে জিগ্যেস করে শেষে পৌঁছোলুম গোয়ানিজ বস্তিতে । তারপর সরু ঘিঞ্জি নোংরা গলির পাকে সেঁদিয়ে জিগ্যেস করে করে পাওয়া গেল ন্যাজারেথের চালাঘরটা । নামে গোয়ানিজ বস্তি হলেও পাড়াটায় যে নানা প্রদেশের আর ভাষার লোক থাকে তা বাসিন্দাদের দেখে টের পাচ্ছিলুম । ন্যাজারেথের চালাতে ঢুকেই বুঝতে পারলুম ঠিক জায়গাতেই এসেছি । ঘরের দেয়ালে কাঠের তাকের ওপর রাখা ছিল নানা কিসিমের টাইপরাইটার । ফ্রকপরা একজন মোটা কালচে গোয়ানিজ প্রৌঢ়া বেরিয়ে এলেন । ওনাকে আমার টাইপরাইটার সারাবার কথা বলতে, উনি জানালেন যে ন্যাজারেথ তো বেরিয়েছে, আমাকে অন্তত ঘন্টাখানেক বসতে হবে । ভাবলুম যে ন্যাজারেথ আসুন, সঙ্গেনিয়ে যাবো । তাড়াতাড়ি সারিয়ে টাইপ করে অন্তত প্রথম খসড়াটা পাঠিয়ে দিতে হবে ।

বসে-বসে হাই তুলছিলুম, কী-ই বা করি । সামনে বসে আছেন প্রৌঢ়াটি । ছোটোবেলায় ক্যাথলিক স্কুলে পড়েছিলুম বলে ক্যাথলিকদের ঘর সাজানো দেখলেই খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে তাঁদের আনুগত্য টের পাওয়া যায় । পর্তুগালের ক্যাথলিসিজমের ছাপ ঘরের দেয়াল জুড়ে । হঠাৎ সামনের বাড়িতে তারস্বরে গিটার আর ড্রাম বাজাবার আওয়াজ আসতে লাগল । মন্দ নয়, টাইমপাসের জন্যে ভালোই । বোকা চেহারা নিয়ে চুপচাপ এই প্রৌঢ়ার সামনে বসে থাকার চেয়ে বরং পাশ্চাত্য বাজনা শুনে সময় কাটাই । শুনছিলুম সেই দিকে তাকিয়ে ।

আচমকা প্রৌঢ়া বলে উঠলেন, "শুনছেন তো জগঝম্প ? কান ঝালাপালা করে দিলো এই প্রটেস্ট্যান্টগুলো ; এরা হিন্দুদের চেয়েও নোংরা, চিৎকার চেঁচামেচি হইচই ঝগড়াঝাঁটি ছাড়া থাকতে পারে না । "