বুধবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১২

ভূতের গল্প - গোধুলির আলপনা


গোধুলির আলপনা

ডালা শিকার
(একটি রোমাঞ্চকর অনুগল্প)


'ডালা শিকার' আমার কাছে এক অদ্ভুত মায়াবী আকর্ষণের নাম। ছোট বেলা থেকেই কেউ যদি একবার আমার কানের কাছে একবার ডালা শিকারের কথা বলে যেত তাহলে সারাদিনের নাওয়া খাওয়া ভুলে নিশি পাওয়া মানুষের মতো তার পিছে পিছে ঘুরতাম। যারা ডালা শিকার শব্দটার সাথে পরিচিত নন তাদের জন্য বলছি, ডালা শিকার হলে রাতে বাতি, মশাল বা টর্চের আলোতে মাছ শিকারের নাম। বর্ষা বা শরতের রাতে আলো জ্বেলে ট্যাটা বা কোচের সাহায্যে মাছ শিকার করা হয়। আমার কাছে অবশ্য মাছ ধরার চেয়ে টর্চের আলোয় ঘুমন্ত মাছদের নিশ্চল ভেসে থাকা দেখতেই বেশি ভালো লাগত।

ডালা শিকারে গেলে প্রায় প্রতিদিনই বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার শিকার হতাম। এগুলোর আকর্ষণও কিন্তু নেহায়েত কম ছিল না। কোনো কোনো দিন দেখা যেত বড় কোনো মাছ পেয়ে গেছি অপ্রত্যাশিতভাবে। আবার সাপখোপের ভয়ও কিন্তু ছিল। শরতবাবুর ইন্দ্রের মতো অমন দুঃসাহসী ছিলাম না কখনোই। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রীকান্তের চেয়েও অনেক কম সাহসী ছিলাম।

দু'টো মাছ দেখতে খুব ভালো লাগতো। বেলে মাছ আর গলদা চিংড়ি। বেলে মাছ হলো আমার কাছে বোকা সোকা সারল্যের প্রতীক। কেমন যেন হাত পা ছড়িয়ে এলে বেলেভাবে ভেসে থাকে। আর চিংড়ি মাছ হলো একমাত্র মাছ যে মাথা পাড়ের দিকে দিয়ে লেজ পানির গভীরে ডুবিয়ে উল্টো হয়ে ঘুমোয়। ধরতে গেলে পেছনের দিকে যায়। কেন জানি প্রায় বিপরীত ধর্মী এ দু'প্রজাতির ওপর আমার প্রচণ্ড নেশা ছিল।

খুব সম্ভবত ভাদ্র মাসের কোন এক রাত। ভাইয়া প্ল্যান করলেন ডালা শিকারে যাবেন। আমি বরাবরের মতো ভাইয়ার এসিস্ট্যান্ট। আমার কাজ হলো ভাইয়ার শিকার করা মাছগুলোকে খলইয়ের মধ্যে নেয়া, আর ভাইকে সঙ্গ দেয়া। মাছ ধরতে ধরতে দু'ভাই মিলে টুকটাক গল্প করি যার বেশিরভাগই শিকারের গল্প।

এবার ভাইয়া প্ল্যান করলেন আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে পুর্ব-পশ্চিমে বয়ে যাওয়া ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কাঁচা রাস্তার পাশের খালে শিকার করবেন। এই খালটার বিশেষত্ব হলো রাস্তাটা লাল মাটির তৈরি। বর্ষার প্রবল বর্ষণ রাস্তার মাটি ধুয়ে ধুয়ে একটা নরম পলিমাটির স্তর সৃষ্টি করে রাস্তার ধারিতে। এই ধারিটা আমার কাছে অনেক কোমল মনে হয়। অনেকটা মায়ের কোলের মতো। খুব সম্ভবতঃ মাছেরাও ধারিটা পছন্দ করে। তাই রাতের বেলা আমার প্রিয় মাছগুলোর বেশিরভাগই এখানে এসে ঘুমায়। লাল নরম মাটির ওপর তাদের নিশ্চল ভেসে থাকা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে।

এ রাস্তার আরেকটা বৈশিষ্ট হলো রাস্তাটা চলে গেছে দু'টো বিশাল মাঠের মধ্যিখান দিয়ে। চারপাশে অনেকদুর পর্যন্ত কোন জনমানুষের বসতি নাই। একটুনিরিবিলি বলে এ রাস্তায় ডালা শিকারিদের উৎপাত একটু কম। রাস্তার মাঝামাঝি জায়গায় একটা প্রাচীন বটগাছ। লোকে বলে সেখানে নাকি মেছো ভুত আর গেছো ভুত থাকে। ভাইয়া অবশ্য এ সবে বিশ্বাস করেন না। তাঁর মতে চোর ডাকাতের দল রাতের বেলা চুরি-ডাকাতি করে মালপত্র এনে নিরিবিলি নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করার জন্য এ ধরনের গুজব ছড়িয়েছে। কারণ যাই হোক নেহাত দায় না পড়লে রাতের বেলা সহজে কেউ এ পথ মাড়াতে চায় না। তবে ভাইয়া যেহেতু অনেক সাহসী মানুষ, অতএব আমি এক কথায় রাজী। রাতের বেলার লাল মাটির ওপর ভেসে থাকা রূপোলি মাছ দেখার নেশা।

মাঝ রাতের দিকে ভাইয়া ঘুম থেকে ডেকে ওঠালেন। কাঁচা ঘুম ভেঙে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে চললাম ভাইয়ার সাথে।

ভাইয়া আগে আগে টর্চের আলো ফেলে যাচ্ছেন, আমি পেছন পেছন। কাদা পানি ঠেলে যখন বড় রাস্তায় (ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায়) পৌঁছুলাম তখন রাত তিনটে টিনটে হবে। চাঁদ বিহীননির্মল আকাশ। ইতি উতি গুচ্ছ গুচ্ছ তারার মেলা। মাঝে মাঝে ছেঁড়া খোঁড়া দু'এক টুকরো মেঘ ভেসে চলেছে। এতক্ষনে প্রথম ভাইয়ার গলা শুনলাম।

"কিরে অনিন্দ্য, অমন ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছিস ক্যান? একটু কন্ট্রোল কর। " ভাইয়ার কথা শুনে বেশ লজ্জা পেলাম।

ভাইয়া এবার জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, ভয় পাচ্ছিস না তো।

বীরদর্পে জবাব দিলাম, মোটেও না।

খুশী হয়ে ভাইয়া বললেন, সাবাস! এই তো চাই!

মনে মনে বললাম, তুমি সাথে না এলে আমি কখনোই এ রাস্তায় রাতের বেলা আসতুম না দাদা।

খালের ধারিটার কাছে নেমে পড়লাম দু ভাই। টলটলে স্বচ্ছ পানি। লালটে কাদার ওপর পরিষ্কার পানি। টর্চের আলোয় একেবারে কলজে পর্যন্ত দৃশ্যমান। ছ' ব্যাটারির এভারেডি টর্চ ভাইয়ার কারিগরী বিদ্যের কল্যাণে আট ব্যাটারিতে পরিণত হয়েছে। তীব্র আলো। অনেকদুর পর্যন্ত দেখা যায়। মাঝে মাঝে ভাইয়া তাঁর টর্চের বাহাদুরি দেখানোর জন্য মাঠের ও পাশের দূরের গাছ গাছালির ওপর টর্চের আলো ফেলছেন। এটা ভাইয়ার এক প্রিয় অভ্যেস। আমিও হাসি হাসি মুখে ভাইয়ার গর্বের ভাগ নিচ্ছি।

মাছ ধরা পড়ছে বাশ। পুঁটি, কৈ, মেনি, টাকি, বেলে। আস্তে আস্তে ভরে উঠছে আমাদের খলুই। আমরা বড় রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি বুড়ো বটগাছটার দিকে। মাছের নেশায় পেয়ে বসেছে ভাইয়াকে।

ভাইয়া টুকটাক কথা বলছেন,বুঝলি অনিন্দ্য! যদি সামনে সাপ পড়ে, একটুও ভয় পাবিনা। চুপ করে দাঁড়িয়ে গিয়ে আমায় ডাক দিবি। আমার এই টর্চের আলোটা এত শার্প যে ফণা তোলা সাপের ওপর ফেললে সাপ দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে স্থির হয়ে যায়। একটুও ঘাবড়াবি না কিন্তু।

আমিও উৎসাহ ভরে বলছি, আচ্ছা ভাইয়া।

তর তর করে এগিয়ে চলেছি দু' ভাই। হঠাৎ ভাইয়া ঝুপ করে ট্যাটা মেরে চেপে ধরলেন। বুঝলাম বড় কোন শিকার। উত্তেজিত কন্ঠে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, কি ভাইয়া?
বললেন, সম্ভবত কোরাল।

আমি লাফিয়ে উঠলাম, আমি চেপে ধরি ভাইয়া, তুমি পানিতে নেমে পড়ো?

ভাইয়া চেপে ট্যাটা চেপে ধরে বললে আমার লুঙ্গির কাছাটা একটু তুলে দে।


আমি খলুই রেখে দ্রুত ভাইয়ার মালকোছাটা বেঁধে দিলাম। ভাইয়া ট্যাটায় ভর দিয়ে পানিতে নেমে পড়লেন। বেশ একটা ধ্বস্তাধ্বস্তি হচ্ছে। ভাইয়া সাঙ্ঘাতিক শক্তিশালী মানুষ। বেশ খানিকক্ষণ যুদ্ধ করে হাত নামিয়ে দিলেন ট্যাটার গোড়ায়। তারপর মাছ সহকারে বীরদর্পে উঠে এলেন ডাঙ্গায়। আমি ভীষণ উত্তেজিত। খলুই নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ভাইয়া ট্যাটা থেকে মাছটা বের করে খলুইতে ঢোকালেন। বেশ বড়সড় আমাদের খলুই। তবুও মাছটার জন্য মনে হয় ছোট। খলুইয়ের মধ্যে লাফালাফি করে নিজের অস্ত্বিত্ব জানান দিতে লাগল।

ভাইয়া বললেন, কিরে, সামলাতে পারবি তো?

আমি একগাল হেসে বললাম, কি যে বলো ভাইয়া! আমার কাছ থেকে কখনো কোনো মাছ পালাতে দেখেছ?

ভাইয়া বললেন, বেশ বেশ! শক্ত করে ধরে রাখিস।

"সে আর বলতে" বলতে বলতে দু' ভাই ক্রমাগতঃ বুড়ো বটগাছটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

ভাইয়া নিপুন হাতে দক্ষ শিকারীর মতো একটার পর একটা শিকার করে যাচ্ছে, আর আমি টপাটপ খলুইতে ঢোকাচ্ছি। এর মাঝে কোরাল মাছটা নড়ে চড়ে আমাকে বেসামাল করছে। এক হাতে তাকে সামলাচ্ছি। চোখ কিন্তু ভাইয়ার ট্যাঁটার দিকে।

হঠাত কেমন জানি গুমোট একটা অনুভূতি চট করে মনের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। কেমন যেন একটা অস্বস্তি। পাত্তা না দিয়ে ভাইয়ার পিছু নিলাম। তারপরও চাপা ভাবটা রয়ে গেল। মনে হলো কেউ একজন ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে। চট করে পিছু তাকালাম। কাউকে দেখলাম না। নিজের মনে নিজেকে বললাম, ও কিচ্ছু না।

ভাইয়া বললেন, কিরে অমন বিড় বিড় করে কী বলছিস।
-কই, কিছু না তো?
-মনে হলো কী যেন বলছিস।
-নাহ্‌, কিচ্ছু না।
-ও, আচ্ছা। চল আরেকটু এগোই।
বটগাছটার প্রায় কাছাকাছি এসে গেছি। মাছও পাচ্ছি প্রচুর। কিন্তু হঠাৎ কেন যেন মনে হলো খলুইতে সে পরিমান মাছ নেই। সন্দিহান চোখে খলুইয়ের দিকে তাকালাম। ভাবছি বড় মাছটার ওলট পালটে অন্য মাছগুলো পড়ে যাচ্ছে কিনা। তেমন কোন নমুনা চোখে পড়ল না।

হঠাৎ ভাইয়া বললেন, অনি, পাতার নীচে মনে হয় গলদা চিংড়ি। দ্যাখ তো
ঠিক দেখছি কিনা?

দ্রুত খলুই হাতে এগোতে গিয়ে মনে হলো কিছু একটাতে আটকে গেলাম। পেছনে তাকালাম। দেখি একটা লোমশ হাত। শিউরে উঠলাম। দেখি টপাটপ মাছ তুলেনিচ্ছে খলুই থেকে। চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। তারপর আর কিছু বলতে পারব না।

জ্ঞান ফিরলে দেখি ভাইয়া মুখের ওপর টর্চের আলো ফেলে ডাকছে, অনি... অনি... এই অনিন্দ্য... কি হয়েছে... তাকা। তড়াক করে উঠে বসে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলাম।

ভাইয়া বললেন, চল বাড়ি ফিরে যাই। আমার তো হাত পা চলছে না। কোনরকম ভাইয়ার কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। রাতে ভীষণ জ্বর এল। সুস্থ হতে পুরো এক হপ্তা। আমার গল্প সবাই শুনল। কেউ বিশ্বাস করল।, কেউ করল না।

বাবা হুকুম দিলেন, আজ থেকে অনির ডালা শিকারে যাওয়া বন্ধ। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তবুও ওই লোমশ কালো হাতের ভয়ে আমিও চুপ হয়ে গেলাম।