বুধবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১২

সুবীর সরকার

এপিটাফ



সরে থাকতে চাই তবু বিরক্তিকর মানুষজনদের সাথে জড়িয়ে পড়তেই হয়। এক সময় অবসাদ আসে । মানুষের জটিলতা অন্ধকারের তীব্রতম কুহক । কুহকের চোরাস্রোতে ভেসে যাই। জঙ্গল টানে । বনবাসি টানে । মাইল মাইল ধানের ক্ষেত তছনছ করেছে হাতির দল । মানুষ মরেছে। হাতি ছিল লোকমনে লোকগানে আদরণীয় । এখনও উত্তরবাংলায় নিম্ন অসমে হাতি মাহুতের গান ভাসে, বাতাসে বাতাসে বাতাসে ওড়ে । অথচ মানুষ এখন হাতিকে আতঙ্ক আর অভিশাপ হসেবে দেখে । বিষ খাইয়ে হাতি মারে । অথচ হাতির তো কোনো দোষ নেই । যে রাস্তা দিয়ে নিত্য দিনের যাতায়াত ছিল সে পথরেখা অবলুপ্ত । জনবসতি । কুলি বস্তি । চায়ের । বাগান জঙ্গল উধাও হয়ে যাচ্ছে মানুষ আর সভ্যতার আগ্রাসনে । হাতিদের খাবার নেই । বন্য প্রাণী বিপন্ন নয় কেবল সমগ্র বিশ্বের ইকো-সিস্টেম প্রবলভাবে বিপন্ন । আর বিরক্তিকর মানুষজন তাদের মো-সাহেবি ঘ্যান ঘ্যান সৃষ্টিহীনতা যাবতীয় সব কিছুর গায়ে মাঝে মাঝে ঢালে পড়ে চিত্রিত হরিণ, কুকুর ছানা আর পেখম তোলা ময়ূর । আর ঢেউতোলা কষ্টগুলির পাশে তা লিখি । নদী নালার দেশে বোধ করি খুব গাছপালা ছিল । চা খেতে খেতে পুরনো মানুষেরা যখন সে সব বলেন তখন বুঁদ হয়ে শুনি । গল্প বলা গল্প শোনা দুই এর আবহে এক ধরনের ধুকে পড়া ঘোরে চলে যাওয়া, মানে খুব কুয়াশা হলে যেমন হয় আর কী । মানে কাছে দূরে ঘুরে বেড়ানো হেঁটে চলে বেড়ানো মানুষকে কেমন পটচিত্র কেমন গুহাকন্দর বা পরিত্যক্ত রাজবাড়ির ঘোরানো সিঁড়ি ভাঙা পাঁচিল এরকম মনে হয় । মনে হওয়াটাকে স্থায়িত্ব দিতে হলে লিখে ফেলা দরকার 'ডানামেলা পাখির মতো জীবন '। অথচ যখন ব্রিজ হয়নি যখন বন্যাপরবর্তীকালীন বিপন্নতায় দীর্ঘতম অহংকারী সেতুনির্মিত হয়নি তখন বিশালাকার গম্ভীর সেই নদীর বুকে মাইল মাইল কাশিয়ার জঙ্গল, ভাবনাবন । বাঘ বেরোত । ভালুক বিচরণ করত । আর এত কিছুর পরেও প্রতিদিন আবিষ্কৃত হতো অসংখ্য পায়ে চলা পথ । আর সেইসব পথের গল্পে মানুষই ছিল প্রধান উপজীব্য ।




ধরো নদীপাড়। আবছায়া ।ধরো চাঁদনিরাত ।নদীপার্শ্ব স্মৃতি থেকে সরে গেলে টুকরো টুকরো আসে নদীচর আর স্রোতে ভাষা শ্যাওলা । বেশ পুরনো, metaphysical এক পৃথিবী তার নিজেস্ব কুহকে বসে থাকে স্থির ও শান্ত । তবেতো হেঁটে যেতেই পারি মাইলের পর মাইল রৌদ্র কিংবা ছায়ায় । ছায়ার ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে জয়ন্ত দা আর চৈতালি দি । দুই অনবদ্য কবি । স্বজন । ঢেউঝাপটার দিনে যারা আমার পাশে থাকে । আবার নদীচরে গান বাজে । বাজে মানে আসগর আলি সরসর গলা তুলে গান গায় - - -

" হাটের মধ্যে শামুকতলা / হালুয়া গরুর লাগছে মেলা / ছেউটি গরুর লেখাই জকাই নাই........"

জল কমে জাওয়া নদী হাটুও ডোবেন এমন ........ আর সেই জল ডিঙ্গিয়ে আসে সব মানুষজন । ব্রাত্য ও প্রান্তবাসী । খোলা আকাশের নিচে মাঠঘাটের শূন্যতায় আগুন পোহাতে পোহাতে কেটে গেল কুয়াশাপ্রবন শীতঋতু । আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসি । কত কত পারিবারিক গল্পকথার শরিক হয়ে যাই নিঃশব্দে । পুরনো পথের কথা এলে ডানা ভাসানো পাখিরাও আসে । আর নদী সংলগ্ন জনপদে গান ঘোরে লাটিমের মতো -"ওরে হ্যাঁচকা টানে পিরীত খসে মাঘমাসি শীতে......."

তারপর পিনড্রপ নীরবতা । আর কোথায় কোথায় কেবল আটকে থাকে কবি চৈতালি ধরিত্রীকন্যার ব্যাকরণহীন হাসি । আর আমি , জয়ন্তদা, চৈতালিদি আসগরের মাটির উঠানে কীটদষ্ট পুঁথির ঢঙে বসে পড়ি । অথচ পম্পা কে বোঝাতেই পারলাম না পাখিরা ছানা খেতে ভালোবাসে । নদীনাম লিখে রাখে । আর আক্রমণ অভিযোগ, ঘৃণায় আমি বিক্ষত ও নীল হয়ে যেতে থাকি । প্রিয় নারী বলে কিছু আছে কি ! তবে কি হলুদবরণ সরশেখেতে পম্পার জন্য এই অবেলাইয় রেখে আসবো সাদা টুঁপি , রঙপেন্সিল আর লিপস্টিক । আমি নিজেকে কষ্টের নৌকায় তুলে দেই । মিথ্যে গুজব আর অপবাদ অনুযোগের হাতে ছেরে দেই । অনেক যুদ্ধে লড়া সৈনিক আমি । বারুদের গলায় আক্রান্ত আমার হাত-পা-বুক-পিঠ আর চিবুক । অথচ সে আমার কান্নার শব্দ শুনতে পাই না । অবশ্য আমি বরাবরই নিঃশব্দে কাঁদি । আর রোগা ,বর্ণরুপময় এক নদীর কিনারে আমি ও গৌরাঙ্গদা হইহই হুডখোলা বেগুনবাগিচায় গুড়ি মেরে ধুকেপড়ি । খোলা মাঠ । খোলা জীবন ।দর্শকশূন্য স্টেডিয়াম । বাতাসে ভাতের গন্ধ । গন্ধের সংক্রমণে খিদে বাড়ে । আর ভরা পেটে খরা বন্যা যুদ্ধ দেখেন বাবু ও বিবি । সমস্ত কষ্টের পাশে সার বেধে দাঁড়ায় যুদ্ধে আহত শিশু ও বৃদ্ধদের আশ্চর্য অসহায় বিপন্ন মুখচোখ । আর পোশাকবদলের রাতে কড়া নাড়ে দুঃখপুকুর , কষ্টসমুদ্র, একা একা চলে যাওয়া

সাইকেল বন্ধুর দল ।