বুধবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১২

ডেনমার্কের কবিতা - সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ

হ্বিলিয়াম হাইনেসেন
(ফারো দ্বীপপুঞ্জ, ডেনমার্ক - ১৯০০-১৯৯১)

ড্যানিশ ভাষা থেকে অ্যান বর্ন্-এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে বঙ্গানুবাদ:
সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ


নিশাচর

জমাট আকাশের বন্ধ্যা আভাটুকু
ফিরিয়ে দেয় অগণিত
ঝরনা-খাল-বিল সন্ধ্যা-গাঢ় এক
পাথুরে প্রদেশের ভিতর।

উপত্যকাটিতে তুলেছে মাথা কত
বিশাল পাথরের দানো,
ফসিল-হ’য়ে-যাওয়া সুদূর অতীতের
মূর্তিগুলি থমকানো।

এখানে দেখা মেলে না কোনো জীবিতের,
আশা না পৌঁছয় লক্ষ্যে,
হাওয়ার কালো-কালো ঝাপটা থেকে-থেকে
কাঁপিয়ে যায় জল-ত্বক্-কে।

মন আমার, জাগো এখানে, পেল্লায়
একটা কেল্লার ধরনে
সুনীল শূন্যতা জ্বলছে জানালায়,
বরফ-জলে প্রতিফলিত পাণ্ডুর
নীরব ডেরাখানি মরণের।

(William Heinesen, Nightwanderer)


প্রেত

এমনই হয়েছে এক শব্দহীন গোধূলিবেলায়
যে তোমার আশেপাশে সবকিছু ঠান্ডা ও আজগুবি,
চেয়ারে আরাম নাই, হিবাচিতে নিভেছে আগুন,
খাবারে কাদার আর কাঁই আর ছাতার বিস্বাদ;

তুমি আলো চাইলে-- কিন্তু মোমগুলি তলানিতে সব;
সারাটা আলমারি হাতড়ে পেলে না পরার মতো জামা
মথ আর মাকড়শার-জালে ভরা কিছু ন্যাকড়া-ছাড়া;
দেয়ালের আয়নাটায় দেখা গেল কেবলই কুয়াশা,
সেই ভুসো-ধূসরিমা, উড়ছিল যা ঘরের ভিতর।

তারপর বেরুলে তুমি; গিয়ে পড়লে হেমন্ত-হাওয়ায়,
যেখানে আঁধারে বইছে শব্দহীন ধূলি আর বীজ।

(William Heinesen, Spectre)



ঘাস


প্রান্তর সবুজ আজ, ভ’রে আছে রাত-কুয়াশা ও
লাইলাক পাতার থেকে ঝরা জল, আর সোঁদা ঘ্রাণে।
সন্ধ্যার ধূসর আলো-অন্ধকারে উঁচু-উঁচু ঘাস
অকম্পিত দাঁড়িয়ে ওখানে।

গুল্মে-ঢাকা চাপা শব্দ কাছেপিঠে কোনো ঝরনার,
সততজাগ্রত মহাসিন্ধুর গভীর কালো স্ফীতি।
উঁচু ঘাস নু’য়ে আছে স্যাঁতসেঁতে আঁধারের চাপে,
সূক্ষ্ম হিমিকায় মোড়া, যেন খামে-আঁটা কোনো চিঠি।

(William Heinesen, Grass)


ধূসর পর্বতগুলি পিছলে গেল ঘন অন্ধকারে


ধূসর পর্বতগুলি পিছলে গেল ঘন অন্ধকারে।
কঠিন পৃথিবী-- পলে গায়েব কেমন ক’রে হয়?
সহসা লাফিয়ে উঠে মহাশূন্যে খুঁজে পেল ঠাঁই :
স্বর্গের তারার গাছে হ’য়ে গেল একটা কিশলয়।

মত্ত হুহু ছলচ্ছল শব্দ করে অন্তহীন ধাওয়া,
জ’মে-যাওয়া জলঘূর্ণি, আসমানি তাজের মাঝখানে--
মরহুম জমানা আর শাশ্বতের থেকে বওয়া হাওয়া।

তারাকারা পাতারা পাখসাট করে, যেন যাতনায়--
যেন তারা যুঝে যাচ্ছে মুক্ত হতে গাছখানি থেকে,
যেন তারা চলে যাবেনিজ-নিজ পথে একে-একে,
ঠিকানা-নিশানা-হীন ভেসে যাবে অন্ধকার নায়।

(William Heinesen, The Dark Mountains Slid into the Gloom)


চুকোর

বসন্ত-বর্ষণ আর ভোরের হাওয়ায়
কাঁপছে মেঠো ঘাস।
শিশির-ধূসর আর অন্ধ, ঐ টুকটুকে চুকোর ঘুমায়।

চুকোরের ছাদের তলায়
তথায় বসত করে কালো-কালো নীরব শামুক।
এবং দিনের কাঁচ-সবুজ আলোয় তারা ঘোরে
রাতের ছোপের মতো, মৃত্তিকার মতো আলোভুক্।

চুকোরটি তরুণ আর বাড়ন্ত-শরীর,
অবশ্য সামান্য তন্দ্রাতুর
যেন চুষে যাচ্ছে বাচ্চা-ঠোঁটে
দুরারোগ্য স্বপ্ন কোনো বিরহবিধুর
কালো মাটি হতে।

(William Heinesen, Sorrel)


উপেক্ষিত ফরিয়াদগুলি

কনসার্ট হলের দিকে ওঠা
প্রশস্ত সোপান, তার নীচে
পা-হারা বেচারা এক ভায়োলিন-হাতে।
উঁচুদর সঙ্গীতের কদরদারির ফাঁকে-ফাঁকে
তাকে নিয়ে ভেবে গেছি আমি।

তার পদবিহীন দশায়
তাকে দেখাচ্ছিল তারই বাদ্য-
যন্ত্রটার মতো,
এবং হঠাৎই মনে হলো
বাদ্যযন্ত্রগুলি হরেদরে
অঙ্গহীন মানুষ বা পশুদের মতো দেখতে হয়।

চেলো এক মাথা- কিংবা হাত-পা-হীন নারী,
ক্ল্যারিনেট দেহহীন এক রাজহাঁস,
ট্রম্বোন হাঁ-মুখ এক হোমানক্যুলাস১,
কেটলড্রাম যেন কোনো পেটুকের ভুঁড়িটা কেবল।

আঁধার, হেমন্ত-ভেজা পথে
সারি-সারি গাড়ির মাঝখানে
দাঁড়িয়ে বা ব’সে থাকে হামেশা-হাজির যন্ত্রিদল,
কেউ আহা ফিরেও দেখে না,
এমনই সচরাচর তারা।

চড়া সুরে মর্সিয়া শু নিয়ে চলে তাদের কষ্টের,
কিন্তু কোনো ট্র্যামগাড়িও অমনি আহাজারি করতে পারে
এবং গাড়িরা পারে চিৎকার করে উঠতে আর
এতে সমস্যাও কিছু নাই।

দুনিয়াটা জুড়ে
এমন অপূর্ব কত মানবিক অভাব-পাখিরা গেয়ে যায়
আর আমরা দয়া করে এদের ব্যবস্থা করে দিই
ঐ রাস্তা-দৃশ্যে।

ন্যক্কারজনকভাবে শুধে দেয় তারা সব ঋণ
আমাদের হৃদয়গুলিকে ব'দলে দিয়ে
অস্বস্তির কনসার্ট হলে
যেখানে বিলীয়মান কান্নার বাদন বেজে চলে।

(William Heinesen, Ignored Appeals)

১ মধ্যযুগীয় অ্যালকেমিস্টদের দ্বারা সৃষ্ট ব’লে কল্পিত অতিক্ষুদ্রাকার মানব বা ভ্রূণ।



পাথর-বালিকা

সাঁঝের হাওয়ায় ভেজা-ভেজা
ঐ অন্ধকার চত্বরের
পাথর থেকে সে বেরিয়েছে,

যেন ছায়াঘন সাগরের
তলা থেকে সবেমাত্র এক
মামুলি বেলায় পা রেখেছে।

মডেলের মতো পোজ নিয়ে
দাঁড়িয়েছে-- অজানা রাজ্যের
এ-অতিথি; মেয়েই শেষতক।

অলীক রহস্য পাথরের,
তবু সিধা, নরমসরম,
যেন একটা ডালে একটা পাতা।

মিলেছিল অজানা ও জানা
এক মুহূর্তের জন্য, এক
নিঃশব্দ ও নিগূঢ় মিলন।

তারপর আঁধার নেমে আসে
তারপর সে বদলে গিয়ে হয়
অসাধ্যের এক পুজারিনী।

কালকেই সে দাঁড়াবে, বালিকা,
খেলতে-থাকা শিশুদের মাঝে,
পাথরের, তবু মানবীয়।

(William Heinesen, The Stone Girl)


প্রস্থান
তাদের দেখেছি উঠতে ঝড়ের আকাশে, গোধূলির
লাল খিলানের মধ্যে ঢুকে পড়তে, তুলে দিয়ে পাল,
উপরে দিনের শেষে শেষ-আলোটুকুর ভিতর।
সে-সময় শোনা যেত পুড়ে-পুড়ে নিঃশেষ গ্রীষ্মের
ওপারে গর্জায় ক্রুদ্ধ হাওয়া।

একখানা পলিনেশিয়া মেলে দেওয়া হয়েছে আকাশে,
অন্ধকার উঠি-উঠি সাগরের সোনালি কিনারে
যেখানে দরিদ্র আর অনুর্বর শুয়ে ছিল রাত।
এবং প্রতিফলিত হচ্ছিল সবগুলি কুটিরের
জানালায় দাউদাউ আকাশ।

তাদের পাখায় জ্বলছে পড়ন্ত বেলার যে-রোদ্দুর
মিটিমিটি জ্বলছিল তা তুফান-মথিত পূর্বাশার
বিপরীতে, জরাগ্রস্ত বছরের বিষণ্নতা-রাঙা।
যখন গায়েব হলো তারা দূর পর্বতের পিছে
নৈঃশব্দ্যের জমানার শুরু।

(William Heinesen, Leavetaking)


স্রষ্টা
(গোইয়া১-র ড্রয়িং নিয়ে তিনটি ফ্যান্টাসি থেকে)

জাগিয়ে তুলেছ স্বর্গের ভারি আবহাওয়া তুমি, শিল্পী,
বেখেয়াল এ-খেলায়।
নিয়তি তোমার অপেক্ষা করে চলেছে তো আলকাতরা-
-কালো আলখাল্লায়।
তোমার তালাশে গহন খাদের তলা থেকে উঠে আসছে
ছায়াগুলি আঁকাবাঁকা,
আধো-আধো কাঁপে হায় কুহেলির নীরব অধর-ওষ্ঠ :
আমাদের পথ দেখাও!
দল বেঁধে কত বরফ-ঠান্ডা খালি-ঠোঙা-ফাঁপা চামড়া
জুটছে তোমার পাশে
তোমার প্রেমের আগুন পোহাতে এবং তোমার সঙ্গে
বাস করবার আশে।
তোমার মাথায় লানত ঝরবে, যদি নির্জন রাস্তায়
তোমার একলা ঘরে
তোমার আগুন না-জ্বলে তখন রঙিন শিখায় দাউদাউ
এবং যদি তা মরে।

(William Heinesen, ‘The Creator’ from Three Fantasies on Drawings by Goya)

১ ফ্রানথিস্কো হোসে দে গোইয়া ই লুথিয়েন্তেস (১৭৪৬-১৮২৮), তাঁর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী।


রাজহাঁস-ছাড়া লীডা১


হিমানী ও রোদমাখা বসন্তের দিনে
কাই নিয়েলসেন২-এর ভাস্কর্য দেখে
এই বসন্ত-শীতল পার্বত্য প্রভাতে
এর উঁচু আকাশ আর নীল গিরিশ্রেণি
আর এর চকমকানো আয়নার মোজেইক-ভরা
সুদূর, প্রশস্ত জলীয় মেঝেয়--
এই চোখধাঁধানো আর হুহুঙ্কৃত দৃশ্যটির ঠিক মাঝখানে :
তার একাকিনী দেহবল্লরী
ন্যাড়া পাথরখণ্ডগুলির ভিতরে তিরতির কাঁপছে
টানটান শুয়ে থেকে শ্যাওলা-বিছানায়।

উদ্ভ্রান্ত চোখগুলি জ্বলছে
চুলের ছায়ার নীচে,
দোটানায় গাল-দুটি লাল--
উজ্জ্বল তরুণ নাসারন্ধ্রগুলি উঠছে ফুলে-ফুলে--
মুখ জুড়ে ফুটে উঠছে উৎকণ্ঠিত হাসি, গোপন।

সে আবার টের পায় শ্যাওলা আর পাথর থেকে
পৃথিবী আর আকাশ আর আর-সবখান থেকে
এইসব দুর্দমনীয় দমকা,
উদ্দাম আর অযৌক্তিক
তবু অনিবার্য আর অপ্রমেয় ঐশী অভিলাষ,
এইসব খিঁচুনি-- জঠরে ও ধড়ে আর প্রতি-হাত-পায়ে,
অন্তঃস্থ হৃৎপিণ্ডে এই ভয়াল কম্পন।

একেবারে সাদাচোখে সে দ্যাখে আবার
স্ফটিকের দানাগুলি ঝিকমিক করছে ধূসর গ্র্যানিটে
আর হাওয়ায় ঝলসে উঠছে ধাতব দ্যুতিমা
পরিযায়ী বালিহাঁসগুলির ডানার আভায়।

তারপর আবার তার গা গোলায়--
জানে না সে পরের মুহূর্তটি
জীবন নাকি মৃত্যু,
কিন্তু সে আঁচ করে ক্রমবর্ধমান ভীতি আর উন্মত্ত উল্লাসে
যে এক অজানা কামনার গর্জায়মান অনিরুদ্ধতা
হাসিল করে নিয়ে নিচ্ছে তাকে।

(William Heinesen, Leda Without the Swan)


১ গ্রীক উপকথায়, স্পার্টার রানি লীডার রূপে মুগ্ধ হয়ে দেবোরাজ জিয়ুস একটা রাজহাঁসের রূপ ধরে তাঁকে ভোগ করেন। কোনো কোনো উপকথায় বলা হয় যে এই সম্ভোগের পর লীডা দুটি ডিম প্রসব করেন, যার একটির থেকে হেলেন (পরবর্তী সময়ে স্পার্টার রাজা মেনিলাউসের রানি এবং ট্রয়-যুদ্ধের উপলক্ষ) ও পোলাক্স, এবং আরেকটির থেকে ক্লাইটেমনেস্ট্রা (মাইসিনির রাজা অ্যাগামেমননের রানি- অ্যাগামেমনন মেনিলাউসের ভাই, এবং ট্রয়-যুদ্ধের প্রধান নেতা) ও ক্যাস্টর জন্ম নেয়। এই কবিতাটির সঙ্গে ডব্ল্যু বি ইয়েটস-এর লীডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান কবিতাটি মিলিয়ে পড়তে পারেন পাঠক। সুবিধার্থে আমার করা ইয়েটস-এর কবিতাটির তরজমা নীচে দিয়ে দিলাম। সু.অ.গো.।


লীডা আর রাজহাঁস
ডব্লু বি ইয়েটস


এক সহসা আঘাত : মহীয়ান্ ডানাগুলি পাখসাটে মাতে
টলে-ওঠা মেয়েটির উপরে, উরুতে তার আদুরে পরশ
বুলায় ও’ কালো দুটি ঠ্যাঙের চামড়া, চেপে ধরেছে চঞ্চুতে
মেয়েটির ঘাড়, বুকে ধরেছে সে তার নিঃসহায় উরস্।

কীভাবে পারবে বা হায় ঠেলে ফেলতে ওই ভীত দুর্বল আঙুল
ক্রমশঃ-শিথিল ঊরু থেকে ঐ ঐশ্বর্য, যা পালকে ছাদিত?
কিংবা, সে কি পারবে জানতে, ঐ ধবলিমা-মাঝে নির্জিত আমূল,
কোথায় ধুকপুক করে অদ্ভুত হৃৎপিণ্ডখানি, যেথা সে শায়িত?

জঘনে সন্ত্রস্ত এক শিহরণ ত্বরান্বিত করে ভাঙা সেই
নগর-প্রাকার আর জ্বলন্ত মিনার আর প্রাসাদের ছাদ,
অ্যাগামেমননের মরণ।
আহা, এমন দারুণ অধ্যুষিত,
বাতাসের পাশব রক্তের দ্বারা এরকম তুমুল দূষিত,
মেয়েটি পেরেছিল কি, ‘তার’ ক্ষমতার সাথে নিতে ধী অগাধ
উদাসীন চঞ্চু-দুটি অবহেলে তাকে ফেলে দেয়ার আগেই?

২ কাই নিয়েলসেন (১৮৮২-১৯২৪), ড্যানিশ ভাস্কর। বিখ্যাত ভাস্কর্য মর্মর-বালিকা এবং লীডা ও রাজহাঁস (যার উল্লেখ এ-কবিতায়)। 

1 comments:

অলক বিশ্বাস বলেছেন...

শীতের বাতাসে টাটকা কবিতার স্বাদ। অভিনন্দন। অভিনন্দন। অভিনন্দন।