বুধবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১২

এবেলা ওবেলার শৈশব - শৌনক দত্ত তনু

এবেলা ওবেলার শৈশব
শৌনক দত্ত তনু


সময় নিরন্তর ছুটছে। তার পায়ে ধুলো উড়ে না। সময়ের খেয়ালে কখন যেন যান্ত্রিক হয়ে গেছে জীবন। পাল্টে যাওয়া সময়ে পাল্টে গেছে সব। এমন কী শৈশব সময়ও । নগরায়নের ছোঁয়া শহর পেরিয়ে এখন গ্রামে। বিলুপ্তের রুলটানা খাতায় প্রতিদিন লেখা হচ্ছে কারো নাম আমরা তার খবরও রাখি না। আমাদের এত সময় কোথায়! কতপাখি হারিয়ে যাচ্ছে রোজ,কত নদী তার পাশে বেড়ে ওঠা কাশফুল,কত মাঠ,কত দিগন্ত,আকাশ,তার নীচে বেড়ে ওঠা কোমলমতি শৈশব। আমরা তার খোঁজও রাখি না। কিংবা খোঁজ রাখি কেবল অবসর মেলে না তাদের পাশে বসবার।

শৈশব আবার হারায় কি রে? আড্ডায় কথাগুলো বলতে বলতে সিন্‌হার করা প্রশ্নে একটু থামতে হলো। শুভঙ্কর সিন্‌হা। বাবা মার এক মাত্র পুত্রসন্তান। কোচবিহার ম্যাগাজিন রোডে ওর বাসা এখন স্ত্রী পুত্র নিয়ে চাকরিসূত্রে কলকাতায়।

তুই বলতে চাইছিস এখনকার শিশুদের শৈশব চুরি যায়নি? -না। এখনকার শিশুরা অনেক কিছু পাচ্ছে জন্মের পরেই যা আমরা পাইনি।

তোর এই কথাটা তাই মানতে পারলাম না। -সব বলতে? আধুনিক এবং আধুনিকতার কথা বলছিস তুই?
-হ্যাঁ। জন্মের পর তুই কিংবা আমরা কি মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেটে হাতের মুঠোয় পৃথিবী পেয়েছি?

ওরা পাচ্ছে। এটা শৈশব থেকেই ওদের মেধাবী তৈরি করছে। সিন্‌হার মতো অনেকেই হয়তো এমন করেই ভাবে। তবু আমার মনে হয় পথ হাঁটে না পথিক হেঁটে যায়। একসময় শৈশব হাওয়া ধরতে নদীর ওপারে যাবার স্বপ্ন দেখতো। একদিন রেলব্রিজের সন্ধেটার সাথে তার দেখা হয়ে যেত। রেললাইনের দিগন্ত গমনের পথ দেখে সে বিস্ময়ে চেয়ে থাকত আর দ্রাঘিমাংশের অসংখ্য আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন বুনতো। ভারী বইয়ের ব্যাগ কাঁধে যখন শিশুকে হাঁটতে দেখি তার চোখে আমি স্বপ্ন দেখি না। জিজ্ঞাসা খুঁজে পাই না তার অভিব্যক্তিতে। এ কি আমার দেখার ভুল? বন্ধু বান্ধবীদের সন্তানদের দেখি আর অবাক হই। তাদের শিশুকে জন্মের বছর চারেক পরেই অলরাউন্ডার বানাবার ইচ্ছায় শৈশব কেড়ে নেয়া দেখি। ঘড়ি ধরা জীবন তখন থেকেই একটু একটু করে স্বপ্ন কেড়ে নেয় তা জানতেও পারি না হয়তো।

আমাদের সময় বিকাল মানেই বাহারী খেলার জগত। গুটিগুটি পায়ে প্রথমে দুধ ভাত থাকতে হতো বয়সে বড়দের সাথে খেলায়। তারপর ধীরে ধীরে মূল খেলোয়াড় হয়ে উঠা। কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ, গোল্লাছুট, কুতকুত, জলডাঙ্গা, পুলিশ চোর, একটু বড় হয়ে ফুটবল, ক্রিকেট, দায়রাবান্ধা, হাডুডু, এসব খেলা এখন আর শৈশব কে ছুঁয়ে থাকে না। মাঠ কমে গেছে কখন,কমে গেছে মাটি কাদা মেখে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা।

ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম। বৃদ্ধাশ্রমের এই বেড়ে ওঠার পেছনে কোথাও কি আজকের আত্মকেন্দ্রিক বেড়ে ওঠা শৈশব দায়ী? আজকের প্রায় পরিবার যখন সময়ের দাবীতে মা বাবা আর আমি-তে বেড়ে উঠছে তখন আমি বেড়ে উঠছি দাদু দিদা আত্মীয়স্বজনহীন একটি নিয়ম জগতে। মা বাবা দুজনেই যখন চাকরির দৌড়ে ছুটছে আমি তখন গৃহপরিচালিকার সাথে বাড়ছি। পড়ালেখা, গান, আঁকা, সাঁতারের ব্যস্ত সিডিউলে আমার জগত তখন টিভি,কম্পিউটার গেমসের নিজস্বতায় সাজচ্ছে। তাহলে কি তখন থেকেই নিজেরটা বুঝে নেবার যে শিক্ষা তা শৈশবকে আত্মকেন্দ্রিকতায় গড়ে তুলছে? একাকীত্বের এই বেড়ে ওঠা শৈশবকে করছে বিপথগামী? বুদবুদের মতো প্রশ্ন বাড়ে। পোল্ট্রিফার্মের মতো সীমিত গণ্ডি আর মাপা আলোয় বাড়তে থাকে শৈশব।

এইসব শৈশব আত্মকেন্দ্রিকতায় বেড়ে উঠলেও বিষণ্ণ! বড়দের সহচার্যের অভাবে সংস্কারহীন, অপরকে শ্রদ্ধা ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ব্যর্থ এবং অধিকাংশই আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা ও মনোবলের তলানিতে বাস করে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য গত বার বছরের পরিসংখ্যান বলছে কিশোর আত্মহত্যার পরিমাণ গত যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু কেন? শৈশব থেকে শিশুদের মনে আমরা যে প্রতিযোগিতার বীজ বুনে দিচ্ছি সেই ইদুঁর দৌড়ে টিকে থাকার দৃঢ় মানসিকতা তৈরি করে দিচ্ছি কি?একটা যুদ্ধে হেরে গেলে আরেকটি যুদ্ধে জেতার দৃঢ়তা হয়তো আমরা দিতে পারিনি বা পারছি না তাই পরীক্ষায় ফেল মানেই একমাত্র সমাধান মৃত্যু এই হচ্ছে শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখা এইসব ছেলে মেয়েদের একমাত্র সমাধান। অথচ আমাদের সময় একক্লাসে দুই তিনবার ফেল করা ছাত্র ছাত্রীদের দেখেছি ফেল করেও উজ্জ্বল হাসি হেসে আদুভাই কিংবা আদুদিদি হয়ে বহিল তবিয়দে খেলে কুদে আজ সফল স্থানে প্রতিষ্ঠিত হতে।

1 comments:

অপরাজিতা বলেছেন...

"পথ হাঁটে না পথিক হেঁটে যায়।".......

আমারও তাই মনে হয় ব'দ্দা, এখনকার শিশুদের শৈশব আমরা নষ্ট করে দিচ্ছি, এতো যান্ত্রিকতার ভেতর দিয়ে হুলুস্থূল মানুষ বানানোর চেষ্টায় আমরা ওদের আসলে কোন পথের প্রান্তে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি?