মঙ্গলবার, ১৪ আগস্ট, ২০১২

অত্রি ভট্টাচার্য


প্রবন্ধ
আধুনিক ব্রিটিশ কবিতাঃ ১৯৪৫ উত্তরপর্ব / সিনজিয়া মোজাটো -1

অনুবাদ – অত্রি ভট্টাচার্য

যুদ্ধোত্তর পটভূমিঃ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের অঙ্কুরোদ্গমঃ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক বিধিনিষেধের কালপর্ব থেকে ষাটের দশকে সংযুক্ত ব্রিটেনের তুলনামূলক সমৃদ্ধির সময় নাটক ও উপন্যাসের মতো কবিতারও উত্তরণ ঘটেছিল, যখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তি ও জাতীয় সংস্কারসাধন (মার্শাল প্ল্যান, সমৃদ্ধ ইউরোপিয়ান আসোশিয়েশন এবং টোরি-লেবার সমঝোতা ইত্যাদি) অবশেষে সংঘটিত হয়। বৃহদার্থে, তৎকালীন কবিতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টাটকা স্মৃতি এবং নব্য-মানবতাবাদের ব্যাপক প্রভাব দ্বারা সমানভাবে প্রভাবিত হয়েছিল । এইজাতীয় চেতনা কবিতায় এসেছে মূলতঃ সামাজিক অভিজ্ঞতায় একক ওসমষ্টির চৈতন্যের মাধ্যমে, এড়িয়ে গিয়েছে খোলাখুলি নৈতিক ও রাজনৈতীক প্রশ্নের উত্থাপণকে।

লেখালেখির বিষয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী-র পত্তন সামনে আনল আংলো-আমেরিকান আধুনিকতাবাদী পরীক্ষনিরীক্ষার পরিপন্থী এক কাব্যময় স্বর-কে। এই নব্যকবিতাবিশেষভাবে সংযুক্ত ছিল আন্দোলনকারী” (Movementeers) নামক তরুণ লেখকদের এক গোষ্ঠির সাথে, যারা সাংস্কৃতিক উৎপাদনের মূল বিষয়গুলির (বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বাধীন প্রেস) পাশাপাশি তাদের সাহিত্যবোধ এবং সামাজিক সম্পর্কও ভাগ করে নিয়েছিল। এই Movement Poets – ফিলিপ লার্কিন, থম গুন, জেমস ডি. এনরাইট, ডোনাল্ড ডেভি, এলিজাবেথ জেনিংস ও অন্যান্যরা প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন New Lines I এবং II-এ (১৯৬০) এবং ক্রমশঃ নিজেদের পরিচিতি তৈরী করেন । যে সমস্ত লেখক ১৯৪৪ সালের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার দ্বারা লাভবান হন এবং প্রাদেশিক সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা সচেতনভাবেই অতি আধুনিক নাগরিকতা (cosmopolitanism) বাদ দিয়ে মফঃস্বলের পটভূমিকে বেছে নিয়েছিলেন। আঞ্চলিকতা তথা অবদমিত প্রত্যাশা (diminished expectations)-র অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও, শক্তিশালী অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তারা যুদ্ধোত্তর পরিবেশে কিছু জরুরি সামাজিক ও নৈতিক প্রশ্ন তুলে ধরেন, যখন উজ্জ্বলতর ষাটের দশকে পা রাখছে ইউরোপএইসব প্রশ্নের বেশীরভাগ ছিল বামপন্থি চেতনাপ্রসূত, যদিও তাৎপর্যপূর্ণভাবে, রাজনৈতিক মতামতপ্রকাশে অনিচ্ছুক, এমন কি, ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় প্রতিক্রিয়াশীল, যখন নতুন পৃথিবী ভোগবাদী, প্রগতিশীল তথা ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক ঝোঁক নিয়ে তার দোরগোড়ায় হাজির হয়েছে।

এই “Movement” লেখালেখি বিষয়বাদীতা” (Subjectivism) থেকে সচেতন দুরত্বে থাকা, জীবনের প্রতি এক তীর্যক, বিচ্ছিন্ন ও ফিলিস্তিনদৃষ্টিভঙ্গীর দ্বারা চিহ্নিত হয়েছিল। এ ছিল একবক্তব্যের কবিতাযা আধুনিকতাবাদী প্রয়াসের কড়া বিরোধীতা করে সাবেকী রূপগুলিতে২ ফিরে গিয়েছিল। যেমন ফিলিপ লার্কিন তার “All What Jazz” (1985) বইতে সাবেকী এবং আধুনিক জ্যাজ-এর এক অসাধারন প্রতিতুলনার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে তার প্রজন্ম আর জীবনের প্রতি উচ্চ আধুনিকতাবাদী স্বচ্ছ দর্শনে বিশ্বাস রে না। তাদের কাছে ইতিহাস শিল্পকলার দ্বারা উদ্ধারযোগ্য নয়। জেমস জয়েস যেখানে জনৈক মিঃ ব্লুমের জীবনের একটি দিনকে গভীর রূপক দ্বারা ওডিসিয়ুসের (গ্রীক মহাকাব্য ওডিসি”-র নায়ক) সাথে তুলনা করছেন, মুভমেন্টিয়ার-রা সেখানে লিখছেন ঘটনাবীহিন দৈনন্দিন জীবন নিয়ে, যার সাথে কোনও মহাকাব্যের প্রসঙ্গ তুলনায় আসে না। নৈর্ব্যাক্তিকতার জন্য বিখ্যাত এই আধুনিকতাবাদী ধারাটি এই কেন্দ্রাতিগ ঝোঁক(solipsistic)-এর জন্যই শেষপর্যন্ত বিবর্জিত হয়। আধুনিকতাবাদীরা ধীরে ধীরে লেখক ও মাধ্যমের মধ্যেকার সম্পর্ক থেকেপাঠককে বিদায় দ্যান। অথচ তরুণ কবিরা নিত্যদিনের যন্ত্রনাপ্রকাশের মাধ্যমে পৌঁছতে চেয়েছিলেন সাংস্কৃতিক এলিট সম্প্রদায়-কে ছাড়িয়ে, বৃহত্তর জনতার বৃত্তে। এইভাবে তারা একটি অনাধুনিক আধুনিকতার (Non modernist modernism)” এর পুনঃপত্তন ঘটান, যা ক্রমশঃ থমাস হার্ডির জান্তবতাবাদ (brutalism)-এ ফিরে আসে, যুদ্ধকালীন কবি উইলফ্রেড আওয়েন, সিগফ্রিড স্যাসোঁ এবং এডওয়ার্ড থমাসের হাত ধরে।

ডোনাল্ড ডেভি যেমন এই প্রবণতার তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ করেছেন, অ্যাল অ্যালভারেজ এর যাবতীয় অনুভবের তীব্র বিরোধীতা করেছেন। আমেরিকান কবিতার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে খ্যাত অ্যালভারেজ যে কোনও রকম বাহ্যিক প্রভাবের পূর্ণ সমর্থক ছিলেন। তিনি এই নতুন প্রজন্মের কবিতার বিধিবদ্ধ আবহগুলির বিরোধীতা করতে গিয়ে, এর আচারসিদ্ধ রীতিনীতিগুলির সাথে তুলনায় নিয়ে আসেন মার্কিন পরীক্ষানীরিক্ষা-র দুইটি পৃথক ধারাকেঃ- নিক্ষিপ্ত গদ্য” (Projective verse)-এ চার্লস ওলসেনের কন্ঠের তাৎপর্য্যময় আর্তি, এবং হুইটম্যানীয়* কবি গিন্সবার্গ এবং বারোস (Burroughs), যাদের কিছুদিন পরেবিটসম্প্রদায় অনুসরন করেন। ইংলিশ ঘরানার নাগরিকতা ও লালিত্য, রবার্ট লোওয়েল, সিলভিয়া প্লাথ, অ্যান সেক্সটন এবং জন বেরিম্যান প্রদর্শিত মনস্তাত্ত্বিক সূত্রে বিতর্কিত বিষয়মুখগুলির দ্বারা দৃঢ়ভাবে পরীক্ষিত হয় । The New Poetry (১৯৬২) ইত্যাদি সাড়াজাগানো গ্রন্থের রচয়িতা অ্যালভারেজ ব্রিটিশ কবিতায় নবজাগরনের বীজ অন্যত্র খুঁজে পান।
অ্যালভারেজ-এর নিজস্ব পছন্দের তালিকায় ছিলেন টেড হিউজেস, যিনি ষাটের দশকের মার্কিন সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোত হন। তার কবিতায় মুভমেন্ট”-এর প্রতিকূল, বক্তব্যের পরিবর্তে এক দার্শনিক কাব্যালোচনা পরিলক্ষ্যিত হয়। হিউজেসের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বসমর নির্মাণ তথা ধ্বংসের প্রতি মানবিক প্রজ্ঞার এক শক্তিশালী অনুভূতির জন্ম দেয় যাকে যুদ্ধ-পরবর্তী ঠান্ডা লড়াই লালন করে। The group Anthology, ১৯৬২ সহ তৎকালীন বিভিন্ন সংকলনে উল্লিখিত অন্যান্য লেখকদের মতোই টেড হিউজেস নির্মান ও ধ্বংস উভয়প্রকার শক্তিরই প্রশস্তি করেন, যদিচ তিনি কবিতায় সমকালীন দর্শন, মনস্তত্ত্ব এবং রহস্যময়তা-র সম্মিলনের পক্ষপাতী ছিলেন। মাতৃভূমি ইয়র্কশায়ারের নিসর্গে শিকড় প্রোথিত থাকলেও, (পরবর্ত্তী খন্ড শিরস্ত্রানের অবশেষবা Remains of Helmet-এ বর্ণিত) বিশ্বময় প্রকৃতি তথা মানবিক রহস্যের অমানিশা-ও তাকে সমানভাবে প্রলুব্ধ করেছিল। মানবপ্রকৃতির যুক্তিকাঠামো-বীহিন অংশের ধারনায় পুষ্ট কবি-র কলমে অহরহ, মনস্তাত্ত্বিক দৃশ্যকল্প তথা কিংবদন্তি-আশ্রিত এক কবিকৃতি প্রতিফলিত হয়েছে।কাকের জীবন ও গান (The Life and Song of Crow, ১৯৭০) কাব্যগ্রন্থের Crow কবিতা-টি এপ্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। আধুনিকতাবাদী আবেদন থেকে কিংবদন্তীতে এই অনুপ্রবেশ ধরা পড়ে সহজেই, কারণ  হিউজেস স্বেচ্ছায় তার এই মিথ-আশ্রয়ী পৃথিবীকে ত্রুটিপূর্ণ ও হাস্যকর করে গড়ে তোলেন। এই সৃষ্টিতত্ত্বের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে কাক নামক এক ঈশ্বর-বিরোধী (an enemy to the god) জীবের রূপকাবরনে। কাকের ক্ষমতার জন্য দাবী প্রতিভাত হয় তার কর্কশ আওয়াজ দিয়ে, যা কৌতুকজর্জরিত এক ভাষা দ্বারা তীব্রভাবে সংক্রমিত এবং অত্যধিক গর্বে(hybris) পরিপূর্ণ।

Crow এক ব্যাঙ্গাত্মক বীরগাঁথা, যা তৎকালীন ঠান্ডা লড়াই ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিস্থিতিতে উঠে আসা হিংসা-র উৎক্ষেপণগুলিকে একই সাথে প্রতিফলিত ও প্রতিপ্রশ্ন করে। হিউজেসের বর্ণনায় মানুষ হল সমকালীন উত্তেজিতা ও দুর্নীতিপরায়নতার প্রতিধ্বনীতে পরিপূর্ণ এক রূপকথার জানোয়ার, কারণ  এই উত্তেজিতাই, এক অন্তর্নিহিত ভারসাম্যহীনতার প্রবণতায় মহাবিশ্বের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। মানুষ ও জানোয়ার উভয়েই একে অপরের ভিতর ও বাইরে বিরাজমান। কানাডিয়ান চিত্রী তথা খোদাইশিল্পী লেনার্ড বাস্কিনের সাথে যৌথভাবে করা হিউজেসের কাজগুলিকে দেখলেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই বাস্কিন-ইবিতর্কিত মানব/জন্তু দৃশ্যকল্পের জন্মদাতা।

টেড হিউজেসের ষাট ও সত্তরের সৃষ্টিগুলি, অ্যালভারেজ ও অন্যান্য কবি যথা মাইক হোরোভিজ (১৯৫৯ সালে New Departures শুরু করেন), ও জন সিল্কিন (স্বনামধন্য Stand পত্রিকার সহ-সম্পাদক, ১৯৫২)-এর সহায়তায় ইংরাজী ভাষায় ও ইংরাজী ভাষা থেকে অনুবাদের এক দীর্ঘ যাত্রার সূচনা করেন। ব্রিটিশ কবিরা “Poetry Incarnation” (১৯৬৫) পত্রিকার সংস্পর্শে আসেন এবং আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব (১৯৬৭)-এর প্রথম পর্যায়ের সাথে পরিচিত হন। কবিতা উৎসব ও পড়াশোনা-র এই প্রবণতার বিস্তৃতি, ব্রিটিশ কবিতা থেকে উদ্ভূত ও বৃহত্তর সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল দ্বারা পরিপুষ্ট হয়েছিল। প্রয়োজন ছিল এমন এক কবিতাভাষ্যের, যা জনগনের কাছে আবেদন রাখবে এক স্বচ্ছন্দ মৌখিক ভাষায়, কারণ হিউজেস তখন সন্ধান করছেন কবিতা ও সঙ্গীতের (জ্যাজ, এবং নতুন ঘরানার রক, ফোক-রক, পপ, আন্ডারগ্রাউন্ড ইত্যাদি) এক সমীকরনের, যা ষাটের দশকে ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় এবং (ব্রিটেনের থেকে আমেরিকায় অনেক বেশি পরিমাণে) রাজনৈতিক মতামতে উদ্বুদ্ধ কিছু গীতিকারের দ্বারা আংশিকভাবে সমর্থিত। সুতরাং খোলা হাওয়া এবং শিথিল নৈতিক বন্ধনের এই রাজনৈতিক সক্রিয়তা সাহিত্য নিয়ে পরীক্ষানীরিক্ষার ক্ষেত্রে হাজির হল সাংস্কৃতিক শ্রেণীগুলির এক আংশিক বিশ্লেষণ রূপে। উদাহরনস্বরূপ, উচ্চ ও নিম্ন সংস্কৃতি-র যোজক হয়ে উঠেছিল বিটলস-দের গান।

বীটলসরা যখন তাদের প্রথম অ্যালবাম (Please Please me, ১৯৬১) বার করে, তখন লিভারপুলের কবিরা, আদ্রিয়ান হেনরি, রজার ম্যাকগা এবং ব্রায়ান প্যাটেন বাজনদারদের সঙ্গে নিয়ে সারা দেশে ঘুরে ঘুরে কবিতাপাঠের আয়োজন করছিলেন। তাদের কাজের একটি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক দিক ছিল, যা নিয়ে মৃদু তর্ক-ও ওঠে। যেমন গিন্সবার্গের ইশতেহার (Howl) –এর মতো যুদ্ধবিরোধী দীর্ঘকবিতার ধাঁচে লিখিত আদ্রিয়ান মিচেলের কবিতাগুলি। ৬৮-র পর, যৌবনের সুর যখন ক্রমেই চড়ছিল, এবং উডস্টক স্টার-রা রক মিউজিককে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছিলেন, সারা পৃথিবীর কবিরা, হিউজেসের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে যোগ দ্যান। এই উৎসবেআমন্ত্রিত বিভিন্ন কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম ছিল ডব্লিউ এইচ অডেন, পাবলো নেরুদা, পিয়ের পাওলো পাসোলিনি এবং ডেরেক ওয়ালকট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় মৌলিকত্বের অভাব এবং ফ্যাশন ও সঙ্গীতশিল্পের নিকট অধিকতর গ্রহণযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও, চিত্রশিল্প তথা নাট্যকলায় সক্রিয় ব্রিটিশ আন্ডারগ্রাউন্ড দৃশ্যাবলী আদিম এক অগ্রগামী সেনা-র পুনরুদ্ধার ঘটিয়েছিল এবং দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোত এক সাহিত্যচর্চার সূচনা করেছিল ।

সত্তর থেকে মধ্য-আশীর দশকঃ ব্রিটেনের দেশ”-গুলির উত্থানঃ-

ষাটের শেষদিকে ব্রিটেনে যে আলোড়ন উঠেছিল, সত্তরের শুরু ও মধ্যপর্ব সে তুলনায় বেশ কিছুটা ফিকে হয়ে যায়। ভিয়েতনাম ও অন্যান্য যুদ্ধক্ষেত্রগুলি সম্পর্কে অদৃশ্য প্রভূরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। দেশের ভিতরেও সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমেই বেড়ে চলেছিলঃ IRA সন্ত্রাস, শ্রেণীসংগ্রাম এবং আর্থিক সংকট শুধু প্রত্যেক রাজনীতিবিদেরই নন, সাধারন মানুষের-ও দৈনন্দিন চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল। এই উৎকন্ঠার সামগ্রিক পরিবেশ-ই কালক্রমে যুদ্ধোত্তর রাজনৈতীক পরিস্থিতির পালাবদল ঘটায় এবং লেবার পার্টির হার ও মার্গারেট থ্যাচারের ক্ষমতায়নের নেপথ্য কারণ  হিসেবে কাজ করে। থ্যাচারের রাজনৈতিক উচ্চারন, “আইন এবং শৃঙ্খলা (Law and Order)” এক সামাজিক সাম্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ ডাকে সাড়া দিয়েছিল; যদিও, সরকারি নীতি ধীরে ধীরে রাজনৈতীক তথা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নাটকীয় মেরুকরণের সূচনা করে। (ইংল্যান্ডের উত্তর/দক্ষিণভাগ; আয়ারল্যান্ড/ ইউকে; মধ্যবিত্ত/শ্রমিক শ্রেণী)। সাধারণভাবে এই উৎকন্ঠাই দীর্ঘ সময় ধরে কবিতা, সঙ্গীত ও শিল্পকলার মাধ্যমে প্রতিধ্বনিত হয়।

প্রকৃতপক্ষে, সত্তর দশকের গোড়া এবং মধ্যভাগ সাংস্কৃতিক সচেতনতার ক্ষেত্রে এক আবশ্যক স্থানান্তর এনেছিল। ষাটের দশকে মানুষ সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলিকে ঝেড়ে ফেলছিল, কারণ তারা আর সমকালীন বাস্তবে প্রাসঙ্গিক ছিল না। অপরদিকে, সত্তরে সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের গঠন সম্পর্কে সচেতনতা ক্রমে বাড়তে থাকে। তর্কাতীতভাবেই, এর কারণ  ছিল শৃঙ্খলাপুনঃস্থাপনের সরকারী প্রচেষ্টাগুলি। কবিতা, গান আর শিল্প এক কেন্দ্রীয়, প্রবল সাংস্কৃতিক, সামাজিক বা ভাষাতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন তুলল, যা অন্যান্য তন্ত্রগুলিকে (system) পরোক্ষ করে তোলে। সত্তরের দশক, অতএব, সরবরাহ করল প্রতিসাংস্কৃতিক বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী ও বিশ্বব্যবস্থা-র সর্বশেষ উত্থাপনের প্রেক্ষাপটকে, যারা গুণগতভাবে প্রান্তিক(peripheral)মাত্র এক দশকের মধ্যেই এই ধারনাগুলি নিয়ে শুরু হবে ভিন্ন ভিন্ন বিদ্যাধারায় গবেষণা ও বিশ্লেষণ, যাকে একত্রে বলা হবে সাংস্কৃতিক চর্চা” (cultural studies). এখানে থেকেই আজকের পরাএকত্ব (meta identity) সমন্বিত ধারাগুলির, যেমন জাতিগত অবস্থান, শ্রেণী ও লিঙ্গ ইত্যাদিকে সাহিত্যিক বিশ্লেষণের মাপকাঠি লে ধরা হয়।

উল্লিখিত উৎপাদকগুলির মধ্যে সমন্বয়ের ফলে লেখকদের মনে আন্তঃবয়ানধর্মিতা (intertexuality), সংলাপধর্মীতা (Dialogicity), কন্ঠ ও কাহিনির বহুস্বরিক অর্কেস্ট্রেশন সম্পর্কে কৌতুহল ক্রমশঃ বাড়তে থাকে।একদিকে শৃঙ্খলা”-র বিষয়টি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, কারণ  শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে যোগাযোগ ক্রমেই বাড়ছিল। বি-শিল্পায়ন এবং বিশেষ কিছু সামাজিক গোষ্ঠির আপেক্ষিক স্বচ্ছলতা অবশ্যই এই ব্যবধানকে দীর্ঘায়িত করছিল। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরের সন্ত্রাস, শতাব্দীর বাঁকে এসে পরিচিত বিষয়গুলিকেও তমসাবৃত করছিল। সত্তরের সন্ত্রাসবাদ, ব্রিটিশের আত্মঘাতী ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার ভিন্ন আর কিছুই নয়। আইরিশ সমস্যা, Ulster এর উত্তরের রাজ্যগুলিতে প্রোটেস্ট্যান্ট একতাবাদী ও ক্যাথোলিক

স্বাধীনতাপন্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ঐতিহাসিক আইরিশ প্রশ্ন”-এর জন্ম দেয় এবং ইউনাইটেড কিংডমে সাবেকী ইংল্যান্ডীয় শাসন ভেঙে পড়বার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা নেয়। তথাকথিতবিলিতিপনা” (Englishness) মুখ্য সংখ্যালঘু শ্রেণীগুলির প্রশ্নেরও সম্মুখীন হয়। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, এশিয়ান তথা আফ্রিকান বংশোদ্ভুত অভিবাসীরা সামাজিক ও রাজনৈতীক অধিকারের দাবীতে আইরিশ, স্কটিশ অথবা ওয়েলশ-এর আন্দোলনে গিয়ে যোগ দ্যান।

লিঙ্গবৈষম্যের পাশাপাশি আলোচ্য বিষয়গুলিও এক নেপথ্য আন্দোলনের সূচনা করে, যা যুদ্ধোত্তর অব-ঔপনিবেশিকতা পদ্ধতি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটেনের গুরুত্ব হ্রাসের পরিস্থিতিতে, দীর্ঘদিনের ধরে ক্ষীয়মান Englishness-এর স্বরূপ বীদির্ণ করে। জাতি, ধর্ম এবং নাগরিকত্ব নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রদানের দাবীতে ষাটের দশকের আন্দোলন-ও এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
এই সামাজিক-রাজনৈতিক পালাবদলের উত্তরে, অধিকাংশ কবিতা সমাজে তাদের নিজেদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকে। আইরিশ কবিরাই প্রথম এই দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়েন। বিশেষ করে উত্তর আয়ররল্যান্ডের কবিরা, যারা গল ও ইংলিশ উভয়ের মৌখিক তথা লিখিত সাহিত্যের মিলনে এক সংকরধর্মী পরম্পরা-র ধারক ও বাহক ছিলেন। তারাই প্রথম শিল্পের পরিধি বিস্তারের উদ্দেশ্যে সাবেকী ইংরাজীর পাশাপাশি আঞ্চলিক বাচনভঙ্গী তথা গলকেন্দ্রিক ভাষাগুলি থেকেও উপাদান সংগ্রহ করেন। (যদিও এই সাফল্যের পিছনে, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতীক-উভয় কারণ ই কাজ করেছিল। এবং আঞ্চলিকভাষা-র ব্যবহার এখনও সম্পূর্ন বিতর্কের উর্ধ্বে নয়)। সেমাস হেনি (Seamus Heaney), পল মালডুন (Paul Muldoon), ডেরেক মাহোন (Derek Mahon), সেমাস ডিন (Seamus Deane), এবং মাইকেল লংলি (Michael Longley) তাদের কবিতায় কিছুটা কঠিন পথেই অঙ্গীকারের ব্যাপারে প্রশ্ন করেন এবং সমাজে তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা তোলেন। নিজের দেশে হিংসার নাটকীয় উত্থানের সাক্ষী (১৯৭২-এর রক্তিম রবিবার”, ’৭৪-এ বার্মিংহামের পানশালায় বোমাবাজি) বিশুষ্ক তথ্যপ্রমাণের পরিবর্ত এক অভিঘাত তথা গুরুত্বের অনুভব আমদানী করেন। যখন তারা মধ্য ষাটে উত্তরিত হয়েছিলেন (১৯৬৫-র বেলফাস্ট উৎসবে যোগদান অথবা সংখ্যালঘু প্রেসের সমর্থনলাভ), তাদের মনোভাব মূলধারার ইংলিশ কবিতা থেকে খুব একটা পৃথক ছিল না। হতাশা, রাজনৈতীক সন্দেহবাদ বা অবিশ্বাস, উচ্ছেদ হবার ক্রমবর্ধমান আশঙ্কা- এ সবই হেনি ও মাহোনের কবিতায় প্রবল ছিলকিন্তু অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মতই তারা এই উচ্ছেদের চিন্তাকে কবিতার শক্তিশালী উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।   

(ক্রমশ)

5 comments:

Banibrata বলেছেন...

অত্রি! আমার ভালো লাগা জানালাম। কিছু বলার নেই বিষয় সম্বন্ধে, কারণ যা পড়লাম তা এই প্রথমবার পড়লাম এবং জানলাম। তাই বলি, গুণীজনের গুণী-লেখায় সমৃদ্ধ হলাম নিঃসন্দেহে। ভালো থেকো।

অপরাজিতা বলেছেন...

great job!!! valobasa nio.

Preetha Roy Chowdhury বলেছেন...

লেখাটি পড়ে অনেক কিছু জানলাম...জ্ঞান বর্ধিত হল। এমন লেখা আরও পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।

A Fair well to pen. বলেছেন...

সবাইকে ধন্যবাদ।

Malay Roy Choudhury বলেছেন...

জুবিন
এই লেখাটার ফন্টসাইজ একটু বড় হলে আমার মত কানা লোকেদের পড়তে সুবিধা হতো। লেখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
মলয়দা