মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ১৩তম সংখ্যা ১ম বর্ষ





সম্পাদকীয় 



দাবানলের সামনে দাঁড়িয়ে বুক যখন উত্তাপ পোহায়, তখন শীতল আলিঙ্গনে
সাহিত্য আমাদের জীবনে বন্ধুত্বের পেলব ছোঁয়া দেয়। আমাদের ক্ষেপচুরিয়াস একটি সাহিত্য সংগঠন। কবি, গদ্যকার, পাঠক, সাহিত্যিক সমালোচক সকলকে এক মঞ্চে দাঁড় করিয়ে সার্বিক মেলবন্ধন – এই আমাদের লক্ষ্য ।


জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মূলত সাহিত্য পার্বণের সময়। লিটিল ম্যাগাজিন, বইমেলা সবেতেই নতুন লেখার গন্ধ। আমাদের এবারের সংখ্যাটিও প্রতি বারের মতো সাহিত্যের প্রাণ সহযোগেই সাজানো হলো। নতুন বছরের দ্বিতীয় সংখ্যা আমাদের সাহিত্য প্রেমী পাঠকদের সহযোগিতায় পূর্ণ হয়ে উঠুক, এই কামনা করি।


ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষে ঊষসী ভট্টাচার্য

সোমবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৩

খামচানো কালপৃষ্ঠা - মলয় রায় চৌধুরী


নেহেরু দর্শন : ব্লেডস অব গ্রাস
মলয় রায়চৌধুরী

(আমার এই লেখাগুলো, যেগুলো ক্ষেপচুরিয়ানে প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলো মগজের নামচা থেকে সরাসরি নামানো। অনেকে এই লেখাগুলো নিজের পছন্দমতো ই-জাইনে বা ব্লগ-পত্রিকায় তুলে নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু পাঠকদের বলে দিচ্ছেন না যে এটা কী ধরণের লেখা। ফলে রচনাটিকে ছোটোগল্প মনে করে তাঁরা ভাষা, শৈলী, সজ্ঞাভূক্তি ইত্যাদি খুঁজছেন। আমার লেখাপত্র যেখানে ইচ্ছা প্রকাশ করা যায়। তবে উৎসটা পাঠকদের জানিয়ে দিলে তাঁরা সেইভাবে লেখাটা পড়বেন।)

আমি যে কলেজে পড়তে ঢুকি, সেখানে, কিছুদিনের ভেতরই আঁচ করতে পারি যে, হিন্দির অধ্যাপক আর ইংরেজির অধ্যাপকদের মাঝে সরকারি ভাষা নিয়ে খোঁচা দেবার একধরণের খেলা চলে । হিন্দির অধ্যাপকরা দাবি করতেন যে হিন্দি হল রাষ্ট্রভাষা । তা কিন্তু নয় । হিন্দি হল সরকারি দপতরের কাজ চালাবার ভাষা । ইংরেজির অধ্যাপকরা মাঝে-মাঝে ইংরেজি থেকে হিন্দিতে রূপান্তরিত শব্দগুলোকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করতেন । ১৯৫০ সালে হিন্দি সরকারি ভাষা হিসাবে সংবিধানে গ্রহণ করার পর হিন্দি-প্রেমীদের গোঁ ধরে যায় প্রতিটি ইংরেজি শব্দের হিন্দিকরণের জন্য । বিটকেল সমস্ত শব্দের জন্ম দিতে আরম্ভ করেছিলেন তাঁরা । যেমন লেটারবক্সের হিন্দি হয়েছিল চিঠ্ঠিঘুষেড় যা পরে হল পত্রমঞ্জুষা ! সেই সমস্ত শব্দগুলো নিয়েই খোঁচাখুঁচির খেলা চলত । তাঁরা কিন্তু কেউই অহিন্দিভাষী ছিলেন না । যাঁরা ইংরেজি পড়াতেন আর হিন্দিকে টিটকিরি মারতেন তাঁদের মাতৃভাষাও হিন্দি । ইংরেজির বাঙালি বা উর্দুভাষী অধ্যাপকরা এই খেলাটিতে স্বাভাবিকভাবেই অংশগ্রহণ করতেন না ।

খোঁচামারার খেলা সবচেয়ে বেশি জমে উঠত দুই অধ্যাপকের মাঝে । হিন্দির অধ্যাপক শার্ট-ফুলপ্যান্ট পরতেন আর ইংরেজির অধ্যাপক পরতেন ধুতি-পাঞ্জাবি । হিন্দির অধ্যাপক ছিলেন কলেজে ন্যাশানাল ক্যাডেট কোরের প্রশিক্ষক । সবে হিন্দি করা সৈনিক নির্দেশগুলো নিয়েও খোঁচার খেলা খেলতেন ইংরেজির অধ্যাপক । যেমন অ্যাটেনশান হিন্দিতে ছিল 'সাওধান' বা স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ হিন্দিতে ছিল 'আরাম লো' ; এখন কী হয়েছে ঠিক জানি না । ইংরেজির অধ্যাপক পান খেতেন আর পানের পিক মুখে নিয়ে এই টিটকিরিগুলো মারতেন । অবশ্য ক্লাসে ঢোকার আগে মুখ ধুয়ে আসতেন । দুজনেই ছাত্রদের প্রিয় ছিলেন, নিজের-নিজের বিষয়ে প্রভূত জ্ঞানের জন্য । দুজনেরই পদবি ছিল 'সিনহা' । ছাত্ররা হিন্দির অধ্যাপককে বলত 'হিংসিন' আর ইংরেজির অধ্যাপককে 'ইংসিন' ।

একদিন শুনলুম যে জওহরলাল নেহেরু আসছেন, সরকারি কাজকর্মে হিন্দির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ছাত্রদের জমায়েতে বক্তৃতা দেবেন । হিন্দিতেই দেবেন, যখন কিনা উনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেলে কেবল ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতেন । সংবাদটি চাউর হবার ফলে হিন্দির অধ্যাপকের ছাতি বেশ চওড়া দেখাতে লাগল । ইংরেজির অধ্যাপক বলেছিলেন যে নেহেরু চিন্তা করেন ইংরেজিতে, তাই ওনার বক্তৃতা শোনার পৃথক আনন্দ আছে, কেননা একজন মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে নিজের ভাবনাকে কোন প্রক্রিয়ায় অনুবাদ করেন তার হদিশ পাওয়া যাবে ।

আজকাল রাজনৈতিক নেতাদের কাছাকাছি হওয়া বেশ কঠিন। যে নেতা যত বেশি কেলেঙ্কারিতে ফেঁসেছে তাকে ঘিরে থাকে ততো বেশি পাহারাদার বন্দুকধারী । আর তাদের ঘিরে থাকে স্যাঙাতের দল । যদিও সাধারণ মানুষ তাদের থেকে যত দূরে সম্ভব থাকতে চান । নেতারা এমনভাবে তখন চলেন যেন কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে হাঁটছেন ; মুখ অনেকটা তেমনই ভজকট হয়ে থাকে । কবে থেকে যে এই অনাবশ্যক নাটুকেপনা শুরু হয়েছে জানি না । নেতাকে ঘিরে ব্যাটম্যান পোশাকের বন্দুকধারী । এই নেতাদের শত্রু যে কারা আর তাদের মেরে কার যে কী লাভ তার হদিশ মেলা কঠিন । সেসময়ে, পাঁচের-ছয়ের দশকে, নেতাদের কাছাকাছি হতে বিশেষ অসুবিধা হতো না, তার কিছুকাল আগেই মোহনদাস করমচন্দ গান্ধীর হত্যা সত্ত্বেও । নেতা হবার জন্য বোধহয় প্রথমে বেশ কিছু শত্রু তৈরি করতে হয় আজকাল । তবে টিভিতে আর সংবাদপত্রে তাঁদের মুখ থেকে যে ইনজিরি বেরোয় তা থেকে অন্তত এটা টের পাওয়া যায় যে তাঁদের প্রধান শত্রু হল ইংরেজি ভাষা । এব্যাপারে টেক্কা দেন দলনির্বিশেষে বাঙালি নেতারা । ভাষা ছাড়াই যে চিন্তা করা যায় তার তাঁরা নমুনা । একজন বিহারি নেতার স্যাঙাতের কাছে শুনেছি যে নেতা কথা আরম্ভ করলেই প্রতিটি শব্দের সঙ্গে পঞ্চাশ ফোঁটা থুতু ছেটান ।



জওহরলালকে তার আগে কাছ থেকে দেখিনি, দূর থেকে দেখেছিলুম, গান্ধি ময়দানে । বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন, তার মানে কাছ থেকে দেখা যাবে, হয়তো কথা বলারও সুযোগ হতে পারে । আমার সহপাঠী বারীন গুপ্ত, সুবর্ণ উপাধ্যায় আর তরুণ শূর, যারা স্কুল থেকেই আমার সহপাঠী ছিল, কলেজেও ছিল একই সঙ্গে ; সুবর্ণ অবশ্য বিজ্ঞান পড়ত । সুবর্ণর মুখে এডউইনা মাউন্টব্যাটেন আর নেহেরুর সম্পর্কের গল্প শুনে-শুনে নেহেরুকে কাছ থেকে দেখার আগ্রহ আরও বেড়ে গিয়েছিল ; বয়সকালের প্রেম বলে । তরুণ শূর নেহেরুকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছিল আগে । ও জানিয়েছিল যে নেহেরু নাকি এডউইনার চেয়েও ফরসা, গোলাপি-ফরসা, যখন কিনা এডউইনা সাদা-ফরসা ।

নেহেরু বক্তৃতা দিতে এলেন । বেশ ফরসা মানুষ । টুপি খুললে টাক আরও ফরসা দেখায় ।আমরা চারজনই এন সি সিতে ছিলুম বলে হিন্দির অধ্যাপক আমাদের ডিউটি দিলেন বক্তৃতামঞ্চের কাছেই । বক্তৃতা আরম্ভ হল । আমার সামনেই হিন্দি আর ইংরেজির অধ্যাপক । পরস্পরকে খোঁচা দেবেন বলেই বোধহয় একসঙ্গে এসে থাকবেন । হিন্দির অধ্যাপকের পেছনে ইংরেজির অধ্যাপক । হিন্দির অধ্যাপকও ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি পরে এসেছেন । নেহেরু হিন্দির, যাকে উনি বক্তৃতায় বলছিলেন 'হিন্দুস্তানি জবান', তার গুণগান করছিলেন । হঠাৎ উনি থেমে গেলেন, একটা উক্তিতে এসে আটকে গেলেন ।

সমবেত ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে আচমকা জিগ্যেস করলেন, 'ব্লেডস অব গ্রাস'-এর ...

(ক্রমশঃ)

আমার চর্যাপদ - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য



আমার চর্যাপদ
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য
ভাষা বলতে,  বিশেষ করে কথ্য ভাষা বা মুখের কথাই বোঝায় । তবে, কথ্যভাষার মধ্যেও অসম্পূর্ণতা আছে । মুখোমুখি কথা বলতে গেলে, বক্তা আর শ্রোতাকে সামনাসামনি আর একই সময়ে থাকতে হয় । ইদানীং- সেল ফোন, ডেস্কটপ ফোন, টিভি, সিডি প্লেয়ার, নেট চ্যাট ; এসব এসে যাওয়াতে একজায়গায় না থাকলেও চলে কিন্তু সমকালে থাকতে হয় ।
টিভি, সিডি প্লেয়ার – এই সবের বেলায় বক্তা / শ্রোতা সমকাল এবং কাছাকাছি থাকে না, আর তাই সেটাকে কথোপকথন চলে না । শুধু, কথা আর দৃশ্য দেখা যায় ।
তাই এটাকে আমি লিখিত ভাষা বলব, কারণ লিখিত ভাষায় কোনো কথোপকথন চলে না । তবে,আজকাল ওয়েবজিন আসাতে, এই সমস্যার সমাধান হয়েছে কিছুটা । পাঠকদের প্রতিক্রিয়া কিছুটা হলেও পাওয়া যায়, কিন্তু মুদ্রিত বা লিখিত কোন ব্যাপারে এই সব সম্ভব নয় । আর এটা ভেবেই আমি আশ্চর্য্য হই ।
সাম্প্রতিক কালের কথা বলছি না । বলছি, সেই সব দিনের কথা, যখন মুদ্রণ ব্যাপারটাই ছিল অকল্পনীয় । এইসব কেই বোধহয় যুগোত্তীর্ণ লেখা বলে ! লেখাগুলো ভরপুর হয়ে থাকে মন । কেন ? সেটা বলছি ! তার আগে আরও কিছু ভূমিকা করে নেই ।
১৮৮২ সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে প্রাপ্ত সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন বৌদ্ধপুঁথির একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। এই তালিকাটির নাম ছিল- Sanskrit Buddhist Literature in Nepal রাজেন্দ্রলাল মিত্রের (২৬.৭.১৮৯১) মৃত্যুর পর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাংলা-বিহার-আসাম-উড়িষ্যা অঞ্চলের পুথি সংগ্রহের দায়িত্ব দেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-র উপর। এই সূত্রে তিনি ১৯০৭ সালে নেপালে যান (তৃতীয় অনুসন্ধান-ভ্রমণ)। এই ভ্রমণের সময় তিনি নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগারে কিছু নতুন পুঁথির সন্ধান পান। এই পুঁথিগুলোসহ হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা- নামেএকটি সংকলন প্রকাশিত হয় ১৩২৩ বঙ্গাব্দে (১৯১৬) সালে। এই সংকলনের একটি গ্রন্থ ছিল চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চিয়
গ্রন্থনাম : ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে নেপালে প্রাপ্ত তালপাতার পুথি সম্পর্কে একটি তালিকা প্রকাশিত হয়। এই তালিকার নামছিলো- A Catalogue of Palm Leaf and selected Paper MSS belonging to the Durbar Library, Nepal এর দ্বিতীয় খণ্ডের তালিকায় এই পুথির নাম হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন -চর্য্যাচর্য্যটীকাএই নামটি পুথির মলাটে লিখা ছিল। কিন্তু ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা- নামক গ্রন্থের ভূমিকায় এই গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন- চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চিয়  কেন তিনি গ্রন্থটির নাম পরিবর্তন করেছিলেন তার ব্যাখ্যা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দেন নি।
এই পুঁথির বন্দনা শ্লোকে আছে-
 'শ্রীলূয়ীচরণাদিতিসিদ্ধরচিতেহপ্যাশ্চর্য্যাচেয়সদ্বার্ত্মাবগমায়নির্মলগিরাং......। এই শ্লোকে উল্লিখিত 'আশ্চার্য্যচর্য্যাচয়' শব্দটিকে এই গ্রন্থের নাম হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন বিধুশেখর শাস্ত্রী। প্রবোধকুমার বাগচী এবং সুকুমার সেন এর যথার্থ নাম হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন- চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চিয় এই গ্রন্থের মনুদত্তের তিব্বতী অনুবাদ অনুসরণে এই পুথির নাম চর্যাগীতিকোষবৃত্তি নামকরণের প্রস্তাব করেছেন। নামকরণের এই বিতর্ক থাকলেও সাধারণভাবে এই পুথিকে চর্যাগীতি বা চর্যাগীতিকা নামেই পরিচিত।

রচনাকাল : বিভিন্ন গবেষকগণ এই পুথিঁর পদগুলোর রচনাকাল সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য কিছু মত দেওয়া হলো। যেমন-

সুনীতি চট্টোপাধ্যায় : খ্রীষ্টীয় ৯০০ হইতে ১২০০-র মধ্যে রচিত "চর্য্যাপদ" নামে পরিচিত কতকগুলি বৌদ্ধ সহজিয়া মতের গানে আমরা বাঙ্গালা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন পাই। [ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ
রূপা।বৈশাখ ১৩৯৬]

সুকুমার সেন : বাঙ্গালা ভাষার আদি স্তরের স্থিতিকাল আনুমানিক দশম হইতে মধ্য-চতুর্দশ শতাব্দ (৯০০-১৩৫০ খ্রীষ্টাব্দ)। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত
'হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা' নামক বইটির প্রথম গ্রন্থ "চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়" অংশে সঙ্কলিত চর্যাগীতিগুলি আদি স্তরের অর্থাৎ প্রাচীন বাঙ্গালার নিদর্শনরূপে উল্লিখিত হইলেও এগুলির ভাষা খাঁটি আদি স্তরের বাঙ্গালা নহে। [ভাষার ইতিবৃত্তআনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর ১৯৯৪]
ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : আমি বাঙ্গালা সাহিত্যের আরম্ভ ৬৫০ খ্রীঃ অঃ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছি। নাথ-গীতিকার উদ্ভব বৌদ্ধযুগে। কিন্তু আমরা তাহা পাই নাই। আমরা বৌদ্ধযুগের একটি মাত্র বাঙ্গালা পুস্তক পাইয়াছি। ইহার নাম আশ্চর্যচর্যাচয়। [বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্তমাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮]

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে চর্যার একটা খণ্ডিত পুঁথি উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে আচার্য  সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চর্যাপদের সঙ্গে বাংলা ভাষার অনস্বীকার্য যোগসূত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তিসহ প্রতিষ্ঠিত করেন। চর্যার প্রধান কবিরা হলেন লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ এবং আরও অনেকে
যে পুঁথিতে তিনি ঐ বৌদ্ধগানগুলো পেয়েছিলেন তার নাম ছিল- চর্য্যাচর্য্য- বিনিশ্চয় । চর্য শব্দের অর্থ হলো- আচরণীয় আর অচর্য্য অর্থে- অনাচরণীয় ।
এটা থেকে পরিস্কার বোঝা যায়, যে এই সব রচিত হয়েছিল- ধর্মসম্বন্ধীয় বিধিনিষেধ নিয়ে ।
চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে ভাষাবিদদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ মনে করেন- ৬৫০ খ্রীঃ বাংলা সাহিত্যের আরম্ভকাল। এছাড়া ফরাসী পণ্ডিত সিলভ্যাঁ লেভির (Sylvain Levi) তাঁর Le Nepal ( Vol. I.P 347) গ্রন্থে বলেছেন- মৎসেন্দ্রনাথ (নাথপন্থার আদি গুরু) ৬৫৭ খ্রীষ্টাব্দে রাজা নরেন্দ্র দেবের রাজত্বকালে নেপালে গমন করেনফলে এটা ধারণা করা অস্বাভাবিক নয় যে, ৬৫০ খ্রীঃ এর দিকেই বাংলা সাহিত্যের জন্ম। কিন্তু আরেকজন প্রখ্যাত ভাষাবিদ ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Origin and Development of the Bengali language (Vol I.P 122)-এ উল্লেখ করেন, “মীননাথের শিষ্য গোরাক্ষনাথের সময় খ্রীঃ ১২শ শতকের শেষে।ফলে মীননাথ দ্বাদশ শতকের লোক। এজন্য তিনি প্রাচীনতম বাংলা রচনার কাল ৯৫০ খ্রীঃ অঃ বলে নির্দেশ করেন। এবং সুকুমার সেন সহ বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব পণ্ডিতই সুনীতিকুমারকে সমর্থন করেন
লুইপাদ বৌদ্ধসিদ্ধাচার্য ও চর্যাপদের প্রবীণ কবি, এই মত প্রকাশ করেছেন অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি। কিন্তু মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র মতে, লুইপা ছিলেন শবরপার শিষ্য। তাই তিনি প্রথম কবি হতে পারেন না। তাঁর মতে লুইপা ৭৩০ থেকে ৮১০ খ্রীঃ মধ্যে জীবিত ছিলেন। লুইপাদ বাংলাদেশের লোক ছিলেন। তবে এ নিয়ে মতভেদ আছে। ব্‌স্তন্‌-গু্যরে শ্রীভগবদভিসময়নামক একটি তিব্বতী পুস্তকে তাকে বাংলাদেশের লোক বলা হয়েছে। আবার, তিব্বতী ঐতিহাসিক লামা তারনাথের মতে লুইপা পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার ধারে বাস করতেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, তিনি রাঢ় অঞ্চলের লোক। এবং শ্রীযুক্ত রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর একটা হিন্দী অভিভাষণে বলেছেন – “লূয়িপা মহারাজ ধর্মাপালকে কায়েস্থ বা লেখক থে।লুইপা রচিত পদ দুটি- ১ ও ২৯ নং। তার রচিত সংস্কৃতগ্রস্থগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়- অভিসময় বিভঙ্গ, বজ্রস্তত্ত্ব সাধন, বুদ্ধোদয়, ভগবদাভসার, তত্ত্ব সভাব। লুইপার প্রথম পদটির দুটি উল্লেখযোগ্য চরণ-

কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পৈঠা কাল ।।

আধুনিক বাংলায়ঃ দেহ গাছের মত, এর পাঁচটি ডাল/ চঞ্চল মনে কাল প্রবেশ করে।
কুক্কুরীপাদ > পদ নং- ২/২০/৪৮

চর্যাপদের দ্বিতীয় পদটি কুক্কুরীপাদ রচিত। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য অনেকে মনে করেন তিনি তিব্বতের কাছাকাছি কোনো অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। নিশ্চিতভাবে বললে কপিলসক্র। মুহঃ শহীদুল্লাহ্‌ মনে করেন, কুক্কুরীপাদ বাঙলা দেশের লোক। তার জন্মকাল নিয়ে দ্বিধামত নেই। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে তার জন্ম। কুক্কুরীপাদের নাম নিয়ে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুকুমার সেন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, কুক্কুরীপাদের ভাষার সাথে নারীদের ভাষাগত মিল আছে। তাই তিনি নারীও হতে পারেন। আবার তার সহচারী যোগিনী পূর্বজন্মে লুম্বিনী বলে কুক্কুরী ছিলেন বলে, তার এই নাম হয়েছে; এমতও পোষণ করেন অনেক ঐতিহাসিক। চর্যাপদে কুক্কুরীপাদের তিনটি বৌদ্ধগান ছিল। কিন্তু একটি অপ্রাপ্ত। ২ ও ২০ নং তার লিখিত পদ। এবং চর্যাপদে খুঁজে না পাওয়া ৪৮ নং পদটিও তার রচিত বলে ধরা হয়। কুক্কুরীপাদের পদযুগল ছিল গ্রাম্য ও ইতর ভাষার। কুক্কুরীপার দ্বিতীয় পদটির দুটি উল্লেখযোগ্য চরণ-
দিবসহি বহূড়ি কাউহি ডর ভাই।
রাতি ভইলে কামরু জাই ।।
আধুনিক বাংলাঃ দিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয় / (কিন্তু) রাত হলেই সে কামরূপ যায় ।
(চলবে )

এই লেখাটির জন্য আমি যে সব বই এবং যাদের লেখার সাহায্য নিয়েছি :-

১। চর্যাপদ- ডঃ সুকুমার সেন ।
২। 'চর্যাপদ' কবিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী -মুহম্মদ মাজ্‌হারুল ইসলাম মাজ্‌হার
  

আমার মঙ্গলকাব্য - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়


আমার মঙ্গলকাব্য
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

যুগে যুগে সাহিত্যে নতুন ধারার প্রবর্তন করার প্রয়াস চালিয়ে যান নবীন প্রজন্ম,তাদের মধ্যে ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা, ভেঙ্গেচুরে দেওয়ার কথা বেশ সোচ্চারে উচ্চারিত হয়, যেন নতুনতর সৃষ্টিতে পুরাতন পথ আগলে দাঁড়িয়েছে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এরকম প্রয়াস নানা সময়ে হয়েছে কিন্তু কোন স্থায়ী ছাপ রেখে যেতে পারেনি । ঐতিহ্য বা শিকড়কে অস্বীকার করে কোন সাহিত্যধারা কোনকালেই গড়ে উঠতে পারেনা, স্থায়ী হতে পারেনা । বাংলা সাহিত্যের মূল ধারাকে ভেঙ্গে দাও, চুরমার করে দাও এমন হুংকার খুব শোনাযায় আধুনিক কবিকূলের একাংশের কাছ থেকে । সাহিত্যে নবনব নীরিক্ষা নিয়তই চলতে থাকে- সেটাই সেই সাহিত্যের বেঁচে থাকার লক্ষণ কিন্তু তা কখনোই সেইসাহিত্যের মূল ধারাকে অস্বীকার করে নয় – বরং মূল ধারাটিকে আরো ঐশ্বর্যমন্ডিত করার লক্ষ্যে – এটাই কাম্য ।
বাংলা সাহিত্যেতো বটেই সব সাহিত্যেই গদ্য এসেছে কাব্যের অনেক পরে আর বাংলাভাষার যে প্রথম লিখিত রূপ পাওয়া গেছে তা কাব্য – গীতিকাব্য, সাতচল্লিশটি গীতিকবিতার সংকলন ‘চর্যাগীতি’ যা পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে উদ্ধার করেছিলেন । চর্যাগীতির সময়কাল দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী । আশ্চর্যের বিষয় চর্যাগীতির পর, চতুর্দশ শতব্দী পর্যন্ত অর্থাৎ  দুশ’বছর বাংলা সাহিত্যের আর কোন লিখিত নিদর্শন পাওয়া যায়না । আমরা জানি দ্বাদশ শতাব্দীতে এদেশে বারংবার পাঠান আক্রমণ হয়েছে আর ঐ শতাব্দীতেই মুহম্মদ ঘোরি এদেশে স্থায়ী ইসলামী শাসনের সূচনা করেন (১১৯২)। ফলে বাংলার সমাজ জীবনে দারুণ বিপর্যয় ও বিশৃংখলা দেখা দেয় যার পরিণতিতে সাহিত্যের স্বাভাবিক বিকাশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু সাহিত্যের মূল ধারাটি ছিলই লৌকিক গান,পাঁচা্লী,ব্রতকথা এইসবের মধ্যে । তারপর চতুর্দশ শতাব্দীর প্রাক-চৈতন্য ও পঞ্চদশ শতকের চৈতন্যযুগে বৈষ্ণব সাহিত্য ও মঙ্গলকাব্যে সাহিত্যের পুনর্গঠন শুরু হয়সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি উদ্ধৃতি এই প্রসঙ্গে শিরোধার্য করি । ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ গ্রন্থে সুনীতিকুমার মন্তব্য করেছেন “বাংলা ভাষার জন্মমুহুর্তেই যে তাহার সাহিত্য নিজের মূল ধারা বা মূল সুর, অর্থাৎ গীতিকাব্য  খুঁজিয়া পাইয়াছিল ইহা পরম সৌভাগ্যের বিষয় । তাহা না হইলে আজ বাংলা সাহিত্য জগতের প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যের মধ্যে স্থান গ্রহণ করিতে পারিত কিনা সন্দেহকি সেই সৃষ্টিলগ্নের সাহিত্যধারা ? সুনীতি কুমারই নির্দেশ করেছেন “জয়দেবের কাব্যে এবং বৌদ্ধ গানগুলিতে যে গীতিকবিতা ও পদাবলীর যাত্রা শুরু হইল এই ধারা পরবর্তী কালে বৈষ্ণব কবিদের কাব্যে অশেষ রস ও শক্তি সঞ্চয় করিয়া বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারা রূপে পরিণত হইয়াছিল । আধুনিক সাহিত্যের মধ্যেই গীতিকাব রূপে এই ধারাই খাত বদলাইয়া নিরন্তর প্রবাহে অক্ষুন্ন গতিতে চলিয়াছে”। অর্থাৎ মানুষই সাহিত্যের মূল উপজীব্য । কোন মানুষ ? নিশ্চিত ভাবেই ব্যক্তি মানুষ নয়, গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ, আমাদের প্রাচীন সাহিত্য সেই সাক্ষ্য দেয় ।
দ্বাদশ শতাব্দীর চর্যাগীতির চারটি পঙক্তি উদ্ধার করি –
টালত মোর ঘরে নাহি পড়বেষী ।
হাঁড়ীতে ভাত নাঁহি নিতি আবেশী ।।
বেগ সংসার বড্ হিল জা অ
দুহিল দুধু কি বেন্টে যামায় ?
[অর্থাৎ টিলায় আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই । হাঁড়ীতে ভাত নেই অথচ নিত্যই অভ্যাগতের আগমন। বেগে সংসার বেড়ে যায়,দোয়া দুধ কি আর বাঁটে ফিরে যায় ]
এই দুঃখের বর্ণনার সঙ্গে আরো চারশ বছর পরে লেখা ‘চন্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ফুল্লরার দুঃখ যাপন বর্ণনার কোন অমিল নেই -
“কতশত জোঁক খায় নাহি খায় ফণী, দুঃখ কর অবধান
বৃষ্টি হইলে কুঁড়ায় ভাসিয়া যায় বান”।
কিংবা চর্যাগীতির কবি ভুসুকু পাদ’এর বর্ণনা –
“ বাজনার পাড়ি পউয়া খালে বাহিউ ।
অদঅ দঙ্গালে দেশ লুড়িউ ।।
আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী
ণিঅ ঘরিণী চন্ডালেঁ লেলী ।।

[ অর্থাৎ, বাজরা নৌকার পাড়ি, পদ্মার খালে বাওয়া ।
দয়াহীন দাঙ্গাবাজে দেশ লুট করে ।
আজ ভুসুকু বাঙালি হয়ে গেল ।
নিজ গৃহিণীকে চন্ডালে নিয়ে গেল”।
এক হাজার বছর পরেও, চর্যা যুগের সমাজ বাস্তবতা আমাদের অচেনা লাগেনা । কারণ সাহিত্য, সমাজ ও সময়ের ইতিহাসও বটে ।
          চর্যাযুগের পর দুশ বছরে বাংলা সাহিত্যের কোন লিখিত নিদর্শন পাওয়া যায়নি । বাংলার শেষ হিন্দুরাজা লক্ষণ সেনের সময়ে বখতিয়ার খিলজীর আক্রমণ ও পরবর্তী পাঠান শাসনে বাংলার সমাজ জীবনের বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলার কারণে বাংলা সাহিত্যের গত স্তব্ধ হয়েছিল বটে কিন্তু দেব-দেবীর অর্চনা, লোকিক গান , ব্রতকথা, ছড়া ইত্যাদির মধ্যে সাহিত্যের উপাদান ছিলই এবং সেই লৌকিক উপাদান থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দী বা প্রাক-চৈতন্য যুগের বাংলা কাব্য সাহিত্য । ইতিমধ্যে বাংলার সমাজ কিছুটা সুস্থিত হয়েছে,সমন্বয়ী সংস্কৃতির আলোকরেখা দেখা দিয়েছে, চন্ডীদাশ ও বিদ্যাপতির আবির্ভাব হয়েছে । অতঃপর বাংলায় ইলিয়াস শাহের আমল থেকে বাংলা সাহিত্যের রচনা ও অনুশীলন শুরু হল, বৈষ্ণব সাহিত্য ও মঙ্গল কাব্যের মধ্যে । মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের প্রধানতম সাহিত্যধারাই হল মঙ্গলকাব্য। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী মঙ্গলকাব্যের যুগ এমনকি সপ্তদশ শতকের পরেও অনেক মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে । বৈষ্ণব সাহিত্যও এই সময়কালেই রচিত হয়েছিল । বৈষ্ণব সাহিত্য আমার বিষয় নয়, আমি সীমিত থাকবো মঙ্গলকাব্যে ।
          মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্য সৃষ্টির পৃষ্ঠভূমির এক ঐতিহাসিক ও সামাজিক তাৎপর্য আছে । মর্তে লৌকিক দেব-দেবীর পূজা প্রচলন এবং সেই পূজা প্রচলনকারীর তা্র আরাধ্য দেবতার কৃপালাভের আখ্যানই মঙ্গলকাব্যের বিষয় বস্তু । মঙ্গলকাব্যে যেসব দেব-দেবীর মহিমা প্রচারিত তারা কেউই আর্যদের দেবতা নন, গ্রামীণ লৌকিক বিশ্বাস নির্ভর আর্যেতর মানুষের দেবতা । মনসা, চন্ডী বা ধর্মঠাকুর কেউই পুরাণকথিত দেবতা ছিলেননা, বৈদিক যুগে তাদের পূজাও প্রচলিত ছিলনা। সাধারণ গ্রামীণ পীড়িত মানুষ, অন্ত্যজ শ্রেনী, ব্যাধ, শবর গোষ্ঠী লৌকিক বিশ্বাসে, তাদের বিপদতারণ রূপে কল্পনা করে এই দেবদেবীদের পূজা করতো । আমরা জানি সমাজ গড়ে ওঠার আদীপর্বে, বৈদিক যুগে আর্যরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে দেবতা কল্পনায় পূজা করতেন যেমন সূর্য, বরুণ, মরুৎ, ইন্দ্র, ঊষা, সরস্বতী প্রমুখ । এঁরা কেউই মঙ্গলকাব্যের দেবতা নন । সুতরাং এই সিদ্ধান্তে আসতেই হয় যে ‘চর্যাগীতি’তো নয়ই, মঙ্গলকাব্যগুলিও বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য সাহিত্য-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করেনা , যেমন বাংলা ভাষা বৈদিক ভাষার (সংস্কৃত) উত্তরাধীকারী নয় । বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকরা যে গান গাইতেন সেই গানের ভাষা অবহট্ট, প্রাকৃত ও অপভ্রশ ভাষার সংমিশ্রণেই সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা ভাষা । আমাদের সামাজিক ইতিহাস একথাও জানায় যে খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে বৈদিক কঠোরতা ও ব্রাহ্মন্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন রূপেই বৌদ্ধ মতবাদের উদ্ভব । সুতরাং বাংলাভাষা ও সাহিত্যের আদীপর্বে বৈদিক সংস্কৃতি বা ব্রাহ্মণ্যবাদের কিছুমাত্র ছায়াপাত ঘটেনি, বিম্বিত হয়েছে মানুষ ও তার পারিপার্শ্ব ।
          পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এই তিনশ বছর ছিল মঙ্গলকাব্যের যুগ । একাধিক শ্রেণীর মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল । তিন শ্রেণীর মঙ্গলকাব্য ‘মনসামঙ্গল’, ‘চন্ডীমঙ্গল’ ও ধর্ম মঙ্গল’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মনযোগ অর্জন করেছে । পঞ্চদশ শতকে রচিত মনসামঙ্গল’ই প্রাচীনতম মঙ্গলকাব্য । পরবর্তী কালে চৈতন্য ও উত্তর চৈতন্যযুগেও একাধিক মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে । মনসামঙ্গলের আখ্যান পূর্ববঙ্গেই বেশি প্রচলিত ছিল , চতুর্দশ শতাব্দীর আগে থেকেই ব্রতকথা, পাঁচালী গান, ও লৌকিক ছড়ার মধ্যে মনসার গান প্রচলিত ছিল পরে বাংলাসাহিত্যের পুনর্গঠনের কালে এগুলিই আখ্যান কাব্যের রূপ পায় । বিজয় গুপ্ত, নারায়ন দেব, বিপ্রদাস পিপলাই, কেতকাদাশ ক্ষেমানন্দ প্রমুখ  মনসা মঙ্গলের প্রধান কবি । মনসামঙ্গলের আখ্যান – লখীন্দর ,বেহুলা ও চাঁদ সদাগরের কাহিনী আমাদের অপরিচিত নয় । সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে চন্ডীর পূজা প্রচলনের দেবী চন্ডীর ছলনা, ক্রুরতা, পূজায় অসম্মত চাঁদ বেনের বিপর্যয় বেহুলার সতীত্বের গুণে চাঁদ বেনের চন্ডীর পূজায় সম্মত হওয়া – এই হল মনসা মঙ্গলের আখ্যান । বিস্ময়কর এতাই যে চর্যাযুগের পর পরবর্তী দুশ’বছরের ব্যবধানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কি অসাধারণ অগ্রগমন ঘটেছিল । কাব্যের লাবণ্যময় রূপ নির্মাণ, চরিত্রবিন্যাস, সেকালীন মানুষ ও সমাজের বর্ণনা সবেতেই বিপুল অগ্রগতি । চাঁদ বেণের পৌরুষত্ব, বেহুলার সতীত্ব স্বামীর জন্য তার ত্যাগের এক মহৎ চরিত্রের ছবি এঁকেছেন মনসা মঙ্গলের কবিরা । আজও আধুনিক কাব্যে বেহুলার মত কত চরিত্র ঘুরে ফিরে আসে , মঙ্গলকাব্যের রূপ-রীতি, শব্দের ঝংকার একালের কাব্যেও তো দেখি । আর এখানেই মঙ্গলকাব্যের প্রাসঙ্গিকতা এখনও । স্বামীকে সর্প দংশন থেকে বাঁচাতে নীদ্রাহীনা বেহুলা শেষ্রাত্রে পলকের জন্য চোখের পাতা বুজিয়েছিলেন আর সেই কয়েক পলক পরেই লখীন্দরের মৃত্যুবিলাপ
“জাগো ওহে বেহুলা, সায়বেণের ঝি
তোরে পাইল কালনিদ্রা, মোরে খাইল কি ?”
শাশুড়ি সনকাও বেহুলাকে গালি দেয় –
“সনকা কাঁদিয়া দেয় বেহুলাকে গালি
সিঁতার সিঁদুরে তোর না পড়িল কালি ।।
পরিধান বস্ত্রে তোর না পড়িল মলি ।
পায়ের আলতা তোর না পড়িল ধূলি ।।
খন্ড কপালিনী বেহুলা চিরুণী দাঁতী ।
বিভাদিনে খাইলি পতি না পোহালে রাতি ।। (ক্ষেমানন্দ কেতকাদাস)
স্বামীর শবদেহ নিয়ে কলার ভেলায় ভেসে চলেছেন বেহুলাশবদেহে পচন ধরেছে , তবু বিশ্বাস দেবতাকে তুষ্ট করে মৃত স্বামীর গলিত দেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনবেন । হিংশ্র জন্তুরা শবদেহ কেড়ে খেতে চায় , বেহুলা তাদের বলে—
“অভাগিনী বেহুলার সহায় কেবা আছে ।
আগেতে আমারে খাও, প্রভুরে খাইও পাছে”।। (বিজয় গুপ্ত) আবার অনদিকে রূপসী রমণীর প্রতি দুষ্ট মানুষেরও লোভ-
“পথের পথিক যত পথ বাইয়া যায়।
বেহুলার রূপ দেখি ঘন ঘন চায় ।।
ত্রিজগৎ মোহনী কেন মড়া লৈয়ে কোলে
কলার মান্দাসে ভাসে ঢেউ’র হিল্লোলে” ।। (কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ)
মসামঙ্গলে বেহুলা চিরকালীন শ্বাশ্বত পতিপ্রাণা নারীচরিত্রের মর্যাদা পেয়েছেন, কবির কল্পনায় হয়েছেন চিরকালের নির্যাতিতা নারীত্বের প্রতিনিধি । বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রামাণ্য ইতিহাসকার পন্ডিত দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন “কবি স্বচক্ষে সতী দেখিয়া সতী আঁকিয়াছেন । ... ...তদ্রূপ রমণী চরিত্র সাহিত্যে বড় বিরল । বেহুলা চরিত্র আঁকিতে কোন কবিগুরু বাল্মীকি লেখনী ধারণ করেননাই । গ্রাম্য কবিগণ বংশদন্ডাগ্রে তুলট কাগজের উপর বেহুলা সতীর রেখাপাত করিয়াছেন;...... দৈনন্দিন গার্হস্থ্য জীবনে পরার্থে আত্মোৎসর্গ ,উপবাস, ব্রতাদির কঠোরতা ও স্বামীর জন্য প্রাণত্যাগ – এই নানাবিধ প্রতিভা যেন আপনা আপনি সমাজ হইতে সাহিত্যে প্রতিবিম্বীত হইয়া বেহুলার ন্যায় আদর্শ চরিত্র সৃষ্টি করিয়াছে , ইহাতে কবিগণের সাহিত্যদর্পণ পড়িতে হয়নাই” ।
                প্রথম মনসা মঙ্গল রচিত হয়েছিল পঞ্চদশ শতকে , পরের শতাব্দী ‘চৈতন্যযুগ’ রূপে চিহ্নিত, যা বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রথম নবজাগরণ কালও বটে । শ্রী চৈতন্যদেবের আভির্ভাবে বাংলায় ভক্তিরসের অভূতপূর্ব প্লাবন ও সমন্বয়ী সংস্কৃতির প্রভাবে মানব প্রেমের যে প্রকাশ ঘটে বাংলা সাহিত্যেও তার অবিসংবাদী প্রভাব পড়েছিল । বাংলার প্রথম নবজাগরণ কালে রচিত বৈষ্ণব সাহিত্য ও মঙ্গল কাব্যগুলি মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ । আজ ছ’শ বছর পরেও আমাদের ফিরে যেতে হয় , অবগাহন করতে হয় বৈষ্ণব সাহিত্য আর মঙ্গলকাব্যের মধ্যে । উনবিংশ শতকেও বাংলার সমাজ-সংস্কৃতিতে বুদ্ধি ও মননের যে জাগরণ হয়েছিল তাকেও আমরা নবজাগরণ বা রেনেসাঁস বলি বটে কিন্তু তা চৈতন্যযুগের মত এত ব্যাপক ছিলনা । চৈতন্যযুগের প্রথম নবজাগরণের অংশভাগী ছিল কোন ধর্মীয় আবরণহীন, সমাজের অশিক্ষিত, অন্ত্যজ পীড়িত মানুষজন , কিন্তু উনিশ শতকের নবজাগরণ ছিল শহর কেন্দ্রিক শিক্ষিত মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠার জাগরণ, যার একটি অধ্যায়কে হিন্দু পুনরভ্যুথ্বানবাদও বলেন কেউ কেউ ।
          পঞ্চদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত রচিত মনসামঙ্গল কাব্যগুলির মধ্যে সংশয়াতীত ভাবেই শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা পায় কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্য , যদিও চন্ডীমঙ্গলের আখ্যান ভাগ মনসামঙ্গলের বেহুলা-লখিন্দরের আখ্যানের মত হৃদয়স্পর্শী নয় বলেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবেত্তাদের অভিমত । চন্ডীমঙ্গল কাব্য শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা পায় এতে বিম্বিত সেকালীন সমাজবাস্তবতার অনুপুঙ্খ, বিশ্বস্ত প্রকাশ ও তার কাব্যভাষার জন্য । কবিকঙ্কণ দুইখন্ডে চন্ডীমঙ্গল রচনা করেছিলেন । প্রথম খন্ডে কালকেতু ব্যাধ – ফুল্লরার আখ্যান এবং দ্বিতীয় খন্ডে ধনপতি সওদাগর – খুল্লনা –লহনার আখ্যান । কবি কঙ্কণের আগে মালদহের গ্রামীণ কবি মাণীক দত্তও চন্ডীমঙ্গলের গান বেধেছিলেন, তাঁকেই চন্ডীমঙ্গলের আদীকবির মর্যাদা দেওয়া হয় । কবিকঙ্কণের জন্মতারিখ কিংবা মৃত্যুদিন কিছুই জানা যায়না কিন্তু তিনি লিখেছেন তাঁর পরিচিতির ভণিতায় –
ধন্যরাজা মানসিংহ                            বিষ্ণুপদাম্বুজভৃঙ্গ
                   গোড়বঙ্গ উতকল অধীপ ।
যে মানসিংহের কালে                         প্রজার পাপের ফলে
                   ডিহিদার মামুদ সরিফ
অর্থাৎ আকবর বাদশাহর রাজত্বকালেই চন্ডীমঙ্গলের রচনা (১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ আকবরের শাসনকাল)। সেকালীন সমাজ বাস্তবতার এমন অনুপুঙ্খ বিবরণ মধ্যযুগের আর কোন কাব্যে পাওয়া যায়না । সমাজতাত্বিকরা একালেও বাংলার বহু জনপদের উৎস সন্ধান করতে মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গলের আশ্রয় নেন । ধনপতি সওদাগরের বিদেশ যাত্রার বর্ণনায় এমন বহু জনপদের নাম পাওয়া যায় তাই কবিকঙ্কণের ‘চন্ডীমঙ্গল’ সেকালীন বাংলার সামাজিক ইতিহাসও বটে ।  ব্যাধ কালকেতু-ফুল্লরার দারিদ্রের যে বর্ণনা চন্ডীমঙ্গলে পাওয়া যায় সেখান থেকে সেকালীন সমাজ বাস্তবতার চিত্র যেমন জানতে পারি তেমনই বিস্ময় জাগে কবিকঙ্কণের কাব্যভাষার নির্মাণে’ চন্ডীমঙ্গলের কালকেতু-ফুল্লরার আখ্যানে এক অসাধারণ চরিত্র ‘ভাড়ু দত্ত’ এযুগের চলচ্চিত্রের কোন দুষ্ট চরিত্রও হার মানে তার কাছে । কালকেতুকে ভাঁড়ুর শাসানি বর্ণনা করছেন কবি –
“হরিদত্তের বেটা হই জয়দত্তের নাতি
হাটে লইয়া বেচাইব বীরের ঘোড়া হাতী
তবে সুশাসিত হবে গুজরাট ধরা
পূনর্বার হাটে মাংস বেচিবে ফুল্লরা” ।।
[চন্ডীর বরে ব্যাধ কালকেতু গুজরাটের রাজা হয়েছিলেন। দুবৃত্ত ভাঁড়ু তাদের ক্ষতি করতে চায় । কালকেতু ভাঁড়ুকে বিতাড়িত করে , তখন  ভাঁড়ু এই শাসানি দেয়, সে কালকেতুকে নিঃস্ব করে ফুল্লরাকে আবার আগের মত বাজারে পশুমাংশ ফেরি করতে বাধ্য করবে]
ফুল্লরা-কালকেতুর আখ্যানে ফুল্লরা তার বারোমাসের দুঃখ কষ্ট ছদ্মবেশী চন্ডীকে বর্ণনা দিচ্ছেন – শীতে – “জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্রাণ”
বসন্ত ঋতুতে -  “মধুমাসে মলয় মারুত মন্দ মন্দ / মালতী এ মধুকর পিয়ে মকরন্দ ।
“বনিতা পুরুষ দোঁহে পীড়িত মদনে
ফুল্লরার অঙ্গ পোড়ে উদর দহনে” ।।
আবার দ্বিতীয় আখ্যানে, কবিকঙ্কণ ধনপতির পুত্রবধু সুশীলার বয়ানে আষাঢ় মাসের বর্ণনা দিয়েছেন –
“দেখহ ঘন নাচয়ে ময়ূর । / নব জলধর দৃষ্টে ডাকরে দাদুর ।।
শুন প্রাণনাথ তুমি শুন প্রাণনাথ । / নিদাঘে শীতল বড় তরুণীর হাত”।
কবিকঙ্কণের কাব্যভাষার দুটি ছবি পাশাপাশি - সেকালীন সমাজদ্বন্দ্বের কি অপরূপ প্রকাশ ! – ছ’শ বছর পরে একালেও কি আমাদের মুগ্ধ করেনা !
          এখানেই কাব্যে সমাজ বাস্তবতার অনুপম প্রকাশ এবং সামাজিক ইতিহাসের উপাদান হয়ে ওঠার কারণেই মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য আজও প্রাসঙ্গিক । মঙ্গলকাব্যে ধর্মের স্পর্শ আছে, কিন্তু লোকায়ত ধর্মর শাসন নেই ,আছে লোকধর্মর বিপুল স্পর্শ লোকায়ত ধর্মআর লোক ধর্ম’ – সমার্থক নয় । চৈতন্য যুগের বাংলা সাহিত্যে লোকধর্মশব্দটি বহুল প্রচলিত ছিল । লোকধর্মবেদ-পুরাণ থেকে আগত নয়, এসেছে লৌকিক জীবনের বোধ, বিশ্বাস আর তাদের জীবনচর্যার মধ্য দিয়ে শাস্ত্রের শিক্ষা ও সাধনার মধ্য দিয়ে নয় । লোক ধর্ম , লোকজীবনই মঙ্গল কাব্যের মূল সুর । মঙ্গলকাব্যেগুলি তাই কালজয়ী হতে পেরেছে । আধুনিক বা উত্তর-আধুনিকতার দাবীদার - যারা মনে করেন একালের কাব্য শুধুই ব্যক্তি আমিব্যক্তি আমারআত্মমন্থন বা আত্ম অনুসন্ধানের শব্দ সমাবেশ, তারা কি চোখে দেখবেন মঙ্গলকাব্যকে , আমার জানা নেই । আমার নিশ্চিত বিশ্বাস লোকজীবন ও সমাজ বাস্তবতার প্রকাশ ভিন্ন মহৎ সাহিত্য রচিত হতে পারেনা, কালোত্তীর্ণ হতে পারেনা ব্যক্তি আমারআত্ম মন্থন । মঙ্গলকাব্য আমাকে সেই শিক্ষাই দেয় । চলো, একবার শিকড়ের কাছে যাই !