কোলকাতায় পূর্ববঙ্গ রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য দেশ ভাগ হয়েছে সেই কবে,তবুও কোলকাতার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে টুকরো টুকরো ওপার বাঙলা।
আমাদের মত যারা বয়স্ক, তাদের মধ্যেও যেমন আছে স্মৃতি মেদুরতা, তেমনই যাদের এই পারে জন্ম, জীবনে ওপার বাংলা দেখে নি, তাদের রক্তের মধ্যেও স্রোতের মত সেই পূব বাংলার জোয়ার অব্যাহত ।
এই পূব বাংলার লোকেদের বেশীর ভাগই নিজেদের ভাষায় কথা বলেন । হাজার চেষ্টা করেও কোলকাত্তাইয়া ভাষা আয়ত্ত করতে পারেন নি এখনও । সেই তাগিদও অনুভব করেন না আর । “মাতৃভাষায়” কথা বলে গর্ব অনুভব করেন তাঁরা।
এপার বাংলায় যে সব কথা “ অশ্লীল” ভেবে প্রকাশ্যে বলা হয় না, সেখানে অনায়াসে সেই শব্দ বা বাক্য বন্ধ ব্যাবহার করেন তাঁরা, একফোঁটা সংকোচ না রেখে। অনর্থক স্নবারি তাঁদের নেই ।
তাই এই সব “ ভাষা”কে বড় নিজের মনে হয়। বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে সেই সব শব্দের, নেই- অবয়বকে ।
এখনও কোলকাতার আশে পাশে কিছু অঞ্চল আছে ( যেমন বেলঘরিয়া এক্সপ্রেস ওয়ের ধারে ), বিশ্বাস না করলেও করতে পারেন- তবে সেখানে এখনও চপ, ফিস ফ্রাই বা চাউমিন জাতীয় ফাস্ট ফুডের দোকান নেই । কারণ, মুড়ি, চিঁড়ে, কাঁচা মরিচ, নারকেল কোরা দিয়ে সকাল বা বিকেলের খাবার খান ওনারা । বাড়ীতে অতিথি এলেও একই ব্যবস্থা ।
কোলকাতা সবাইকে জায়গা দিতে পারে নি, বলে অনেকে ভারতের পশ্চিম বা অন্য কোনো প্রান্তে চলে গেলেও, সেখানেও একই ধারা প্রবহমান ।
বাড়ীতে অতিথি এসেছেন পশ্চিম থেকে । রাত্তিরে ঘুমোবেন । চোখে আলো লাগছে । সেই আলোটাও একটা পাঁচ ওয়াটের সিএফএল ল্যাম্প। সেটাও সহ্য হচ্ছে না অতিথির।
বাড়ীর কর্তাকে বললেন:-
- ও মনু !
- কি অইসে?
- চক্ষ দুইডা দুখায়, বাত্তি বুজা! (বাত্তি বুজাদে-র হিন্দী প্রভাব)
- ক্যান! আন্ধারে তো দ্যাখবা না কিসু
- সে আমি বুজুমনে ! বাত্তি বুজা !
কত্তা রেগে নিজের ছেলেকে ডেকে বললেন – ! যা এক কাম কর, এখান কিছু নিয়া, গরুর “ পোন্দে” ধর গিয়া। গোবর আইনগ্যা এক ধ্যাবরা দেয়ালে দে, হ্যার লগে দুইডা যোনাকি...হালায় ৫ ওয়াডেও চক্ষু দুহায়( পাঠক, ক্ষমা করবেন, অশ্লীল শব্দের জন্য)
-
ঠাকুমার “ প”কে “ ফ” বলা দেখে নাতি বলল- ওরম কও ক্যান ?
- কি কইলাম ?
- অই, “প” রে “ফ” কইত্যাসো!
- “ফ” রে “ফ” কমু কিয়ার লাই ? আমারে কি ফাগলে ফাইলো ?
-
বাজারে গেছেন কত্তা
জিজ্ঞাসা করলেন মাসীকে:-
- অ মাসী! শশা তোমার তিতা হইবো ?
- কি যে কন!!
- কইত্যাছিলাম, তিতা শশা বাইচ্ছা দাও । বাড়ীত শুক্তানী করুম আর মুড়ির লগেও খাম্ । করলার যা দাম!
-
কুইর্যা মরা গরু, মাগ্গো লাড়তে উদয় চাঁদ ! কিছু বুঝলেন ? এটা বরিশালের খাস গালাগাল ।
একদা বরিশাল নিবাসী একজনের বাড়ীতে এই গালাগাল এখনও দেন ৮৭ বছর বয়সের ঠাকুমা ।
কারণ ? নাতিকে জল চেয়েছেন, আর নাতি দিতে দেরী করেছে ।
মানেটা হলো – কুঁড়ে মরা গরু, পেছন নাড়াতে নাড়াতেই আকাশে চাঁদ উঠে যায় ।মানেটা শুনে, সিতু মিঁয়ার কথা মনে পড়ল । তিনি হলে বলতেন :-
ফরাসিরা বলেছিল, ‘এপাতাঁ!’ ‘জর্মনরা, ‘ক্লর্কে!’ ইতালিয়ানরা, ব্রাভো!’ স্প্যানিশরা, ‘দেলিচজো,দেলিচজো।’ আরবরা, ‘ইয়া সালাম, ইয়া সালাম!’
সরস হাস্য রসের বন্যা বয়ে যায়, যখন এই সবের চুটকি শুনবেন । আপাতত নোয়াখালির একটা চুটকী দিচ্ছি ।
একবার এক দোয়ানদার দোয়ানে ওগ্গা ছোডো হোলা রাইখলো। একদিন হেতে দোয়ানে হোলারে থুই বারে যাইব, হিয়ারলাই হোলারে কইলো,"কেও কিচ্ছুরলাই আইলে যদি ন থায় অইন্য কিচ্ছু দিবি। যদি তিব্বত সাবান চায়, ন থাইকলে লাক্স সাবান দি দিবি।"
কতক্ষন হরে দোয়ানে এক বেডা আইলো। বেডা কইলো," এরে ছুটকিয়া, লেট্রিনের টিস্যু কাগজ আছেনি?" হোলা কইলো ,"হেই কুম্পানিরগিন নাই গো কাগা, শিরিষ কাগজ আছে, আইজ এগিনদি কাম চালান হরে হেগিন আইলে নিয়েন।"
ওগ্গা = একটা । হোলা = ছেলে । হিয়ার লাই = এজন্য । এবারে বুঝে নিতে পারবেন আশা করি ।
কয়েকটা প্রবাদ প্রবচন :-
হেতে হুইসের হোন্দেদি কুরাইল চালায়
হুইস = সূঁচ । হোন্দেদি = গোড়ায় । কুরাইল = কুড়ুল ।
অর্থ –যেখানে অন্যের কাছে কোনো কাজ করা অতি কঠিন, সেখানে অভিজ্ঞ লোক অতি সহজে সমস্যার সমাধান করতে পারেন ।
খানার আগ
দরবারের শেষ
আগে খেতে হবে, শেষে দরবারের রায় শুনতে হবে । এরকম প্রচুর প্রবাদ প্রবচন ছড়িয়ে রয়েছে ।
সূক্ষ্ম অথচ তীব্র মর্মব্যাথাও ছড়িয়ে রয়েছে নানা গল্পে :-
দুর্গা ষষ্ঠীর দিন।মূর্তি আনাহচ্ছে । ঢাকীর বোল ফুটলো । একটু বাজানোর পর পরইবাড়ীর কর্তা হুংকার ছেড়েঢাকীকে বাদ্যি বাজাতে বারণকরলেন ।
ওইছ্যামড়া ! ঢাকের বাজনা কোইশিখছস ?
-এজ্ঞে ! বাপের কাসে, কত্তা !বাপে আসে?
-নাকত্তা ! গতহইসেন !
-মায়ে ?
-হঃ ! জীবিত ।
-তোর লহে থ্যাহে ?
-না কত্তা !
-ক্যান ?
-বৌয়ের লগে ঝগড়া করে, হের লাইগা তাড়াইয়া দেসে আমার বৌ !
-তুই কিসু কইলি না , বৌরে?
-কি আর লাই ? কত্তা !!
-তোর মায়েরে তোর বৌ তাড়ায়ে দেসে, হেইডা !
ঢাকী চুপ
-অহনে বুজসি !! ঢ্যাবরা ঢাক লইয়া, হালায় ষষ্ঠীর দিন বিসর্জনের বোল বাজায় !
তীক্ষ্ণ শ্লেষ আছে , উদাহরণ :-
গুরুদেব এসেছেন এক বাড়ী । প্রচুর লোক এসেছেন তাঁর কথা শুনতে । সবাই তাঁকে চেপে ধরল:- আপনার কাছে শাস্ত্রের কথা কিছু শুনবো ।
গুরুদেব রাজী হলেন , তবে সর্ত নোয়াখালির কেউ থাকলে কিছুই বলবেন না ।
বললেন :-“নোয়াখালির কেউ কি আছেন? যদি থাকেন তাইলে এখনই বলেন, পরে নোয়াখাইল্লা পাওয়া গেলে আমি আর শাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করব না।”
কেউ দাঁড়ায় না দেখে গুরুদেব শুরু করলেন।
এক পর্যায়ে গুরুদেব বলছেন, “বুঝলেন, শ্রীকৃষ্ণের এমনই লীলা গাছের পাতা মাটিতে পড়লে বিশালবাঘ হয়ে যায় আর জলে পড়লে বিরাট কুমির হয়ে যায়……”
এমন সময় একটি লোক দাঁড়িয়ে বলল, “গুরুদেব আমার একটা প্রশ্ন আছে।”
কী প্রশ্ন? – গুরুদেব বললেন ।
লোকটা বলল, “যদি অর্ধেক পাতা মাটিতে আর অর্ধেক পাতা জলে পড়ে তাহলে কি হবে ?”
গুরুদেব বললেন “আমি আগেই বলেছিলাম নোয়াখালির কেউ থাকলে আমি শাস্ত্রালোচনা করব না”
( এর আরও একটা গল্পান্তর আছে, হজুরকে নিয়ে)
কৌতুকও আছে :-
তবেএই দুটোআপনাদের সামনে, পেশকরার আগেবলে রাখি, এইদুটোই খালিনির্মল কৌতুক।
কারওপেশা বাশারীরিক প্রতিবন্ধকতার প্রতি অশালীন ঈঙ্গিত নয়।
যদি মনে হয়, তবে করজড়ো মাফচাইছি- আগেভাগেই ।
কৌতুক- এক
-মাষ্টার মশাইয়ের সাথে এক ছাত্রের আলাপ :-
- বু বু বু বুজঝস ?
- কি মাষ্টার মশাই ?
- তততততততত তরা আমার চাচাচাচাকরি পাওনের গগগগগপ্প জাজাজানস ?
- না
- আআআআ মিতো চাচাচাচাকরি পাপাপাইতাম না
- ক্যান?
- আআআমার আআগে যে আআছিল, সেসেসে আআমার থিথি থি কা অঅঅনেক কককয়ালিফায়েড !
- হেয়ার চাকরি হইল না ক্যান?
- হেহেহে তোতোতোতোতলা আছিল ।
কৌতুক- দুই
-এক রিক্সাচালকপ্যাসেনঞ্জারকে বলল-
- ছাব ! আমারে একডা চাকরি দ্যান না !
- ক্যান?
- রিস্কা চালাইতে আর বালা লাগে না । অহনে হাঁফাইয়া পডি । পাও কাঁপে ।
- আইচ্ছা ! কাল চইল্যা যাবি পার্ক ষ্ট্রিটে আম্রাগো আপিসে । হেয়ানে পিওন লইবো। তয়, আম্মো থাহুম না । বোঝঝস ?
- ছালাম ছাব, যামু অনে ।
রিক্সাচালক গেল ইন্টার ভিউতে । এরপরে বাড়ীতে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছে ।
-বেবাকে বইয়া রইসে ওহানে । আম্মো দেহি আর কাঁপি । এক একজন মু কালা কইর্যা বাইরাতেসে।
-আম্মোর কাঁপন বাড়তাসে ।
একজন জিগাইলো- আফনে কাঁপেন ক্যান ?
-কাঁপুম না ? কি যে জিগাইবো ভাইব্যা কাঁপন বাড়তাসে ।
-কি যে কন ?
-কমু মানে, আফনে আমারে জিগান, দ্যাখবেন অনে, কি রম কাঁপুম !!!!
অলমতি
ঋণ :- ধ্রুবজ্যোতি গঙ্গোপাধ্যায়, জাহিদ হাসান, মোস্তাক আল মেহেদী ও লোকজ সংস্কৃতির বিকাশ সাইট ।