দায়, দায়িত্ব ও পলায়ন প্রবণতা
পলায়নপরায়ণতাই যে কোনও
জাতির সবচাইতে বড় অসুখ।
বিশেষতঃ এই প্রবণতা যখন
ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা ও
সুবিধাবাদী মনোভাবের প্রকটরূপ।
কার্যকে যখনই আমরা কর্তব্যের আধারে
দেখি তখনই এই
প্রবণতা আমাদের সেই কর্মযোগের প্রতি
প্রতিকূল শক্তি প্রয়োগ করে। অবশেষে ক্ষান্ত
হয়
সেই কার্যের নৈতিক কর্মীর সন্ধান করে। যে কোনও কার্যের
দায়কে আমরা অপরের ওপর
চাপিয়ে
দিতে চাই। অর্থাৎ এই কাজটা আমার নয়, অমুকের কাজ।
‘এক্স’ দায়িত্বটা আমার নয়,
‘ওয়াই’-এর কাজ
‘জেড’ কেন করবে জাতীয় প্রবণতা। এও এক ধরণের
পলায়নপরায়ণতা।
প্রকৃতপক্ষে এই প্রবণতাই
আমাদের মধ্যে এমন এক মানসিকতা সৃষ্টি করছে যাতে মনে
হয়
কর্ম অর্থেই কর্তব্যস্বরূপ। শরীরের
প্রত্যঙ্গের মতো অভ্যেসে এবং মনেরও তো অভিযোজন
হয়।
‘প্রবণতা’ সেই মনের অংশ হিসেবে অভিযোজিত হয়ে কালক্রমে ‘মানসিকতায়’ পরিণত হয়।
সমস্ত কিছু
থেকে পালাতে পালাতে এমনই
আমরা অভ্যেস করেছি যে ‘পলায়ন প্রবণতা’ ক্রমশ
‘পলায়ন মানসিকতায়’ পর্যবেশিত হয়েছে। কার্য,
চিন্তনপ্রক্রিয়া এবং সমস্যা--মূলত এই
তিনটিই হল এই প্রবণতার প্রকৃত বিকর্ষণবিন্দু। এই তালিকায়
দায় বা দায়িত্বকে রাখলাম
না, কারণ দায় বা দায়িত্ব আসলে কর্মেরই আর এক রূপ যা কোনও বিশেষ
কর্মের
অগ্রাধিকারকেই বোঝায়। কর্ম থেকে পলায়ন যেমন আমাদের স্থবিরতা দেয়, উৎপাদনশীলতাকে
হ্রাস করে, তেমনই চিন্তন থেকে পলায়ন
সমাজকে পশ্চাদমুখী করে, মননকে সংকুচিত ও অন্তর্মুখী করে
তোলে। তখন ভাবনাকে
স্তাবকতা করতে হয় অন্যের কাছে। চিন্তার পরনির্ভশীলতা জাতীয়তাবাদের
ক্ষেত্রেও
অন্তরায় হয়ে ওঠে। ক্রমশ ভাবতে ভুলে যাওয়া মানুষ তখন নিজস্বতা হারিয়ে ক্রমশ
পরিচালিত
হয় অন্যের ভাবনা দ্বারা। এভাবে যখন সমষ্টিগত পরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়
তখনই শুরু হয় জাতির
পশ্চাদ অপসারণ। সেই জাতিকে পেরে ফেলা তখন সহজ হয়, কারণ জাতিটি
ততক্ষণে সমর্পণে অভ্যস্ত
হয়ে উঠেছে, তার নিজস্বতা বলে কিছু নেই, বলিষ্ঠতা বলে কিছু
নেই, সব সময়ই আত্ম-নিরাপত্তাহীনতায়
ভুগছে। ভাবনা কখনও সহজলোভ্য নয়, সেটা কঠিন
সু-অভ্যেস। পলায়নপরায়ণতাও একটা কু-অভ্যেস।
জাতির উন্নতির টিকিটি বাঁধা থাকে এই দুই
অভ্যেসের বিরোধের ওপর। যে জয়ী হয় তার ওপরেই নির্ভর
করে জাতির সামগ্রিক মেরুদণ্ডের
মাপকাঠিটি। চিন্তার বিষয় এটাই যে পালানোটাই বর্তমানে আমাদের
মজ্জাগত বৈশিষ্ট্যে
রূপান্তর করেছি। সব কিছু থেকেই এখন আমরা পালাতে চাই সে যে বিষয়ই হোক না
কেন!
পালালেই যেন আমরা অবলীলায় বেঁচে যাব। এই যে পালাতে পারলেই বেঁচে যাব যত এই ধারণাটা
যত প্রকটিত হয় ততই আসলে আমরা বাঁচার বদলে একটা মৃত্যুর দিকে পা বাড়িয়ে দিচ্ছি।
অর্থাৎ যার
থেকে রেহাই পেতে চেয়েছিলাম প্রকারন্তরে তার মধ্যেই আবার ঢুকে যাওয়া।
মানসিকতাটা তৈরি হয়
পরিবেশ থেকে। একটা মানসিকতা অন্যের মানসিকতাকে দলভারি করার মতো
অধিগ্রহণ করতে চায়।
পলায়নপরায়ণতাও সেই রকম ব্যাকটেরিয়ার মতো। একটা জাতির মেরুদণ্ড
শুধুমাত্র জাতির অর্থনীতি,
শিক্ষা, কিংবা উৎপাদনশীলতা থেকে নির্ধারিত হয়ে আসাই
এতদিনকার সাধারণ ধ্যানধারণা ছিল। কিন্তু
নাগরিক কর্তব্যগুলো থেকেও এই পলায়নমুখী
মানসিকতায় আমরা সেই কর্তব্যগুলোকে পালন না করে
শুধুই “সরকার কী করছে?” এই প্রশ্ন
তুলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সরকার মানে শুধু গুটিকয় সাংসদ বা
বিধায়ক নয়, সরকার মানে
আমি, আপনি, আমাদের সমষ্টি, এবং মানসিকতা। ‘কিছু করব’ এটাই হল
আমাদের ঈশ্বর, ভগবান
বলে আসলে কিছু নেই, ইচ্ছাশক্তিই প্রকৃত ঈশ্বরের প্রতিভূ। তাই পলায়নমুখী
মানসিকতা
থেকে যত তাড়াতাড়ি আমরা বেড়িয়ে আসতে পারব যতই জাতির উন্নতি সম্ভব। নিজেরাই
সেই
উন্নতির একেকজন নির্ধারক হতে পারি। আরও বলিষ্ঠ করে তুলতে পারি জাতিকে, সর্বপরি
নিজেদেরকেও।
ক্ষেপচুরিয়াসের
পক্ষে সম্পাদক – জুবিন ঘোষ
‘প্রবণতা’ সেই মনের অংশ হিসেবে অভিযোজিত হয়ে কালক্রমে ‘মানসিকতায়’ পরিণত হয়। সমস্ত কিছু
থেকে পালাতে পালাতে এমনই