শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৪

সম্পাদকীয় - ৪র্থ বর্ষ ৩য় সংখ্যা

সম্পাদকীয়



সম্পাদকীয়র শুরুতেই আমাদের পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি অনিচ্ছাকৃত দেরী হবার জন্য।এপ্রিলের এখন মাঝামাঝি। ভোট পুজোর ঢাকে কাঠি পরে গেছে, গরমও তার স্বমহিমায় হাজির। জননেতারা প্রত্যকেই স্ব স্ব মহিমায় ভোট যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে আপন আপন অস্ত্রে শান দিচ্ছেন। দাদা বলছেন দিদি চোর দিদি বলছেন দাদারা ডাকাত। বাক্যবাণে এক একজন মহাভারতের অর্জুন কর্ণকেও লজ্জায় ফেলে দিতে পারেন। বাঙালীর দোল, পয়লা বৈশাখ পেরিয়ে এখন ভোট পরবই সবচেয়ে সামনে। মাঝে সেই আগষ্টে বাঙালীর চিরকালের সেলেবল রবি ঠাকুর পরব। তাই এই এপ্রিল থেকে আগষ্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেকার সময়ে ভোট উৎসবই সবচেয়ে বড় এবং প্রতিক্ষীত।

এবারের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন স্বাধীনোত্তর ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘ নির্বাচন। শুধু দীর্ঘতম হিসাবেই নয় এবারের নির্বাচন অন্যদিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। দীর্ঘদিনপর দিল্লীর সিংহাসনও পরিবর্তনের মুখে। এই মুহুর্তে চলছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিশ্রুতি পাল্টা প্রতিশ্রুতির পালা। চলছে কাদা ছোঁড়াছুড়ি। কিন্তু কোথাও ভারতবর্ষের বর্তমান হাল ফেরানোর প্রতিশ্রুতি নেই। মনে পড়ে আমাদের ছেলেবেলার কথা সেই যখন সবে আমাদের দাড়িগোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে, আমরাও বড়োদের মত পাড়ার ক্লাবে বা রকে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছি তখন একটা কথা আমাদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল “লঙ্কায় জেই যায় সেই রাবন”। অর্থাৎ ভোটের পর ক্ষমতায় এসে সেই একই পুনরাবৃত্তি, সেই চুরি (পুকুর চুরি!), সেই বড়ো বড়ো স্ক্যাম, হাওলা, গাওলা, বোফর্স, দাঙ্গা। এইখানে কৈশোরে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ‘রাজা আসে যায়’ কবিতাটি প্রাসঙ্গিক।

রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
লাল জামা গায়ে নীল জামা গায়ে
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রঙ বদলায়
দিন বদলায় না

গোটা পৃথিবীটাকে গিলে খেতে চায়
সেই যে ন্যাংটো ছেলেটা
কুকুরের সাথে ভাত নিয়ে তার লড়াই
চলছে চলবেই
পেটের ভিতর কবে যে আগুন
জ্বলছে এবং জ্বলবে

রাজা আসে যায় আসে আর যায়
শুধু পোশাকের রঙ বদলায়
শুধু মুখোশের ঢঙ বদলায়
পাগলা মেহের আলি
দুই হাতে দিয়ে তালি
এই রাস্তায় ওই রাস্তায়
এই নাচে ওই গান গায়
সব ঝুট হ্যায়। সব ঝুট হ্যায়। সব ঝুট হ্যায়
জননী জন্মভূমি
সব দেখে সব শুনেও অন্ধ তুমি
সব জেনে সব বুঝেও বধির তুমি।।


কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি এই ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে পাগল মেহের আলি রাও যেনো কোথায় হারিয়ে গেছে। যারা শত পাগলামির মধ্যেও সার কথাটা বলে যাবে “রাজা তোর কাপড় কোথায়?” বরং আজ মেহের আলিরাও আমাদের মত অন্ধ, বধির। তারাও মেনে নিয়েছে আমাদেরই মত। দু’একটা বিস্ফোরণ যে মাঝে মাঝে ঘটেনা তা নয়, কিন্তু সেগুলো নেহাতই বুড়ীমার চকলেট বোমা, গ্রেনেড বা নিদেনপক্ষে পেটো বোমা হবার যোগ্যতা তাদের নেই। তারা সব নিরবতা পালনের সারিতে মোমবাতি হাতে। তাতে আগুন আছে বটে কিন্তু আঁচ নেই।।  



                                             ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষে ~  শুভেন্দু দেবনাথ







উত্তর সম্পাদকীয় - চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

উত্তর সম্পাদকীয়
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য 


                          খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না

             "মোদি-রাজ্যে মেয়েরা ও একটি নারীবাদী ইস্তাহার"


মেয়েদের জন্য গোটা একটা নির্বাচনী ইস্তাহার! ভাবাই কঠিন। যে দেশে অনাহার, অর্ধাহারে মৃত্যুর চেয়ে মুখোরোচক হয় নারীর শ্লীলতাহানী, ধর্ষণ ইত্যাদি; সেখানে   মেয়েদের সমস্যা, মেয়েদের দাবিদাওয়া নিয়ে একটা ইস্তাহার! উরে ব্বাস! কথাটা এক বন্ধুনী বলতেই মুফে নিলাম। আপত্তি কি? রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তাহার হয়। এমন কি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলিও গোপন ইস্তাহার পাঠায় দলগুলির কাছে যে যতটা মেনে নেবে, সেই অনুযায়ী টাকা পাবে। এবার দেখলাম একটি বহুল প্রচারিত ইংরাজি পত্রিকাও নিজস্ব ইস্তাহার এনেছে। সেগুলি চেটে দেখেছি, চিবিয়ে দেখেছি, গেলা যাচ্ছে না। খাচ্ছি, কিন্তু গিলতে পারছি না। অগত্যাবন্ধুনীর পরামর্শে এই ইস্তাহার লেখায় হাত দিলাম।
          বন্ধুনী বলেছেন, ইস্তাহারটি দুই অংশে ভাগ থাকবে। দ্বিতীয়াংশে থাকবে সেই ইস্তাহার আর প্রথমাংশে থাকবে দেশের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর রাজ্যে মেয়েরা কেমন আছে, তাঁর একটা বিবরণ। কারণ, আর কেউ যখন প্রধানমন্ত্রীর জন্য ভোটে না লড়ে সাংসদ হতে চাইছেন, তাঁদের গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেনই, তা সে সাংসদ না হয়েও, তাঁর কথাকেই গেলার চেষ্টা করা যাক। ও হরি! এই যে সেই চিবানোই সার, গেলা যাচ্ছে না। কেন? তা নিজেই দেখুন

প্রথম ভাগঃ মেয়েদের মরণদশা

অপুষ্টির কারণে গুজরাতের প্রায় অর্ধেক শিশুই বয়সের তুলনায় কম ওজনেরনিজের ব্লগে এ-কথা লিখেছিলেন প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু। তিনি লিখেছেন, “গুজরাতে অপুষ্টিতে ভোগা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর হার ৪৮ শতাংশ, যা শুধু জাতীয় হারের চেয়ে বেশীই নয়, সাব-সাহারা এলাকার সোমালিয়া এবং ইথিওপিয়ায় অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর হারের চেয়ে অনেক বেশী। এই পরিসংখ্যানের যথার্থতা দিয়ে মোদী বলেছেন, ‘গুজরাতের মেয়েরা নিরামিশাষী এবং মোটা হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাঁরা দুধ খায় না।এ-সব ছেঁদো যুক্তি। গুজরাতের শিশুরা কি তবে মোদীর বানানো কারখানা, সড়ক আর বিদ্যুৎ খায়! গুজরাতে সদ্যজাতের মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৪৮ জন, যার ফলে ভারতের সবচেয়ে খারাপ রাজ্যগুলির মধ্যে গুজরাত দশম স্থানে। গুজরাতের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের এক-তৃতীয়াংশের শরীরের বডি মাস ইন্ডেক্স ১৮.৫ এর চেয়েও কম, ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে খারাপের দিক থেকে সপ্তম। গুজরাতে প্রসূতিদের মৃত্যুর হারও বেশি।
          অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী মোদি বলেছেন, ‘গুজরাতের মেয়েরা খুব বেশী ফ্যাশন সচেতন। তাঁরা তো মাছ খায়ই না , দুধটাও খায় না। তাঁরা আসলে স্লিম, রোগা নন।তা, মোদির কথাকেই গুরুত্ব দিয়ে মেলাতে গিয়েই চিত্তির! হিন্দুপত্রিকা গোষ্ঠীরফ্রন্টলাইনলিখেছে, অপুষ্ট শিশু জন্মের মূল কারণ মা-বাবাদের কম মজুরি। কম মজুরির জন্য গুজরাতের শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা কম। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের চিলড্রেন ইন ইন্ডিয়া, ২০১২বলছে, ‘এই রাজ্যের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়। গড়ে প্রতি ১০০০ সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে গুজরাতে ৪৪টি সদ্যোজাত মারা যায়, যা জাতীয় গড় হারের চেয়ে বেশীকেন গুজরাতের শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে বা কেন সঠিক ওজনের সুস্থ শিশুর জন্ম নিচ্ছে না, তা জানা যাচ্ছে গুজরাত সরকারের সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প (আইসিডিএস) সম্পর্কে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)-এর রিপোর্টে। মোট ১.৮৭ কোটি মানুষ আইসিডিএস প্রকল্পের কোনও সুবিধাই পান নি। এই প্রকল্পে চিহ্নিত ২২৩.১৫ লাখ নাগরিকের মধ্যে ৬৩.৩৭ লাখ কোনও পরিসেবা পায় নি। রাজ্যে বার্ষিক ৩০০ দিন পুষ্টিকর খাবার সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে হয়েছে ২০৪ দিন। সদ্য-যুবতীদের পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের প্রকল্পে ঘাটতি ২৭ থেকে ৪৮ শতাংশ। ৩১ শতাংশ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রকে তৈরির অনুমোদনই দেয় নি সরকার। যেগুলি আছে সেগুলিতে পরিশ্রুত পানীয় জল বা প্রস্রাবাগার নেই।
          কাটজুর কথা মিথ্যে প্রমাণের ভার গেল মোদি ব্র্যান্ডের প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়েবজাইন ইন্ডিয়াস্পেন্ড’-এর উপর ক্ষুব্ধ বিকাশপুরুষমোদীর নিযুক্ত ওয়েবজাইন বিচারপতি কাটজুকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করতে নিজেরাই জানিয়েছে, গুজরাতে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর হার ৪৪ শতাংশ আর, সদ্যোজাতের মৃত্যুর হার হাজারে ৪৪ জন, ৪৮ জন নয়। হায়, পোষা তোতাও শেষে নিজের মুখেই ঝামা ঘষে দিল! মোদী সরকার সিএজি-র তথ্যের জবাবে জামিয়েছে, অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা ২০১৩ সালে হয়েছে ৪০ শতাংশ। আর, কম ওজনের শিশুজন্মের হার নাকি ২০০৭-এ ৭৩.০৪ থেকে ২০১৩-র মার্চে লক্ষ্যণীয়ভাবে কমেছে! হাঃ হাঃ। ২০০৭এর চিত্রটি কত উজ্জ্বল! তাই না? মোদি তাঁর পাঁচ বছর আগেই মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তাহলে এই হাল কেন?
          আরও কিছু তথ্য দেখুন। আহমেদাবাদের ওমেনস অ্যাকশন গ্রুপ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ডঃ ইলা পাঠক জানিয়েছেন, গুজরাতের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের ৫৫.৫ শতাংশই রক্তাল্পতায় ভুগছেন। এনিমিক! এই বয়সী মহিলাদের প্রায় ৬১ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তাল্পতার পাশাপাশি অপুষ্টিতেও ভুগছেন। ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর মুখ ঝকঝক করছে! আগের বছরের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট বলেছিল, গুজরাতের অর্ধেক শিশুই অপুষ্টিতে ভুগছে। আর, গ্রামে যেহেতু চিকিৎসার দারুণ অভাব এবং তফশিলী জাতি-উপজাতির পিছিয়ে পড়া লোকেরাই যেহেতু গ্রামে থাকেন, তাই তাঁদের মধ্যেই অপুষ্টি ও শিশুমৃত্যুর হার রাজ্যের গড় হারের চেয়ে অনেক বেশী। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৮-৮৯ সালে দেখা গেছে, ৬ মাস থেকে ৩৫ মাস বয়সী দলিত ও আদিবাসী শিশুদের ৭৪.৫ শতাংশই অপুষ্টিতে ভুগছে। ২০০৫-০৬ সালের হিসাবে ৬ - ৩৫ মাস বয়সের দলিত ও আদিবাসীদের ৭৯.৮ শতাংশ অপুষ্টির শিকার। ৪১ শতাংশ শিশুর জন্মের সময়ের ওজন কম, ৪৯.২ শিশু কম দৈর্ঘ্য নিয়ে জন্মাচ্ছে। এসব হল অপুষ্টিতে জন্মানোর প্রমাণপত্র। মোদি তাঁর রাজ্যের এই হাল করেছেন।
          গুজরাতে পুরুষ-মহিলার অনুপাত ক্রমেই কমছে। ২০০১ সালে ছিল হাজার পুরুষ পিছু মহিলার সংখ্যা ছিল ৯১৮ জন, যা ২০১১তে হয়েছে ৯১৫ জন। জাতীয় স্তরে সংখ্যাটা এই সময়কালে ৯৩৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৪০। গুজরাত ছাড়া অন্য সব রাজ্যে অনুপাত বেড়েছে। অনুপাত কমা মানেরি কন্যাভ্রূণ হত্যা।  দেখা যাচ্ছে, ২০০১ সালে গুজরাতে ৬ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুদের মধ্যে মেয়েদের অনুপাত ছিল প্রতি হাজারে ৮৮৬, যেটা ২০১১তে এসে আরও কমে হয়েছে ৮৮৩।  ২০০১-র তথ্য সামনে আসার পরই মোদি দরকার ১০১টি সোনোগ্রাফি পরীক্ষা কেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ করে। তাঁর পরের দু-বছর অল্প অল্প কিছু কেন্দ্র বন্ধ করলেও কাউকেই পিসিপিএনডিটি আইনে সাজা দেয় নি।
          তাঁর শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকার অসাধারণ কাজ করেছে, দাবী মোদির। মেয়েদের শিক্ষা এক্কেবারে ফ্রি। ঠিক, কিন্তু ফ্রিতে শিক্ষায় যে কিছুই শেখানো হয় না! লেখাপড়া ঠিকঠাক শিখতে তাই ভরসা বেসরকারি স্কুল, দিতে হয় বিপুল অঙ্কের ফিস। যারা পারেন না, তাঁদের ঘরের মেয়েরা অশিক্ষিতই থেকে যান। প্রাথমিকে প্রতি একশো ছাত্র পিছু ছাত্রী ভর্তির হার দশ বছর আগে ছিল ৯৪, এখন সেটা আরও কমে হয়েছে ৮৮। আর, মাধ্যমিকে এই সংখ্যাটা আরও একটু কমে ৮৪ জন। তাদেরও অধিকাংশই অল্প কিছুদিন পড়েই বিয়ের পিঁড়িতে যান। কেউ কেউ একটু এগিয়ে কলেজে যান, চাকরি পান, ব্যস। উচ্চতর শিক্ষায় আগ্রহ হারাচ্ছে কুবেরের রাজ্য গুজারাতের মেয়েরা। ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশনেরএকমাত্র কন্যা সন্তানপ্রকল্পে কোনও পরিবারের একমাত্র কন্যা সন্তান যদি পোস্ট গ্রাজুয়েট পড়ে, ইউজিসি তাঁকে স্কলারশিপ দেবে। ২০১২তে সারা দেশের ২৪১৯ জন এই প্রকল্পে আবেদন জানায়। তাঁর মধ্যে পশ্চিম বাংলার ৭০৬ জন, কেরালার ৫৭৭ জন, মহারাষ্ট্রের ৬০ জন, কর্নাটকের ৫৭৭ জন, তামিলনাডুর ৪৫৬ জন, অন্ধ্রের ১৬১ জন ছিলেন। আর গুজরাটের মোট আবেদনকারী মাত্র ১৮ জন।
          গুজরাতের মেয়েদের উদ্যমী। তাঁরা চাকরি করেন, নিজেরা ব্যবসায়ও করেন। আমুল সমবায়, শ্রী মহিলা গৃহ উদ্যোগ লিজ্জত পাপড় তো বিখ্যাত। সংগঠিত ক্ষেত্রে গড়ে দেশের ২০ শতাংশ কর্মী মহিলা, গুজরাতে তা ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ। তাদের মজুরিও কম, ফলে তারাও অপুষ্টিতে ভোগেন। আগে, এই রাজ্যে নারীধর্ষণ শোনা যেত না। গুজরাত দাঙ্গার পর এই ব্যাধির প্রকোপ বেড়েছে। আগে, গরবা নেচে একটি মেয়ে মধ্যরাতে একা অটোতে চেপে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরৎ।  মোদি আসার পর অবস্থা বদলাচ্ছে। ২০০১-এ এই রাজ্যে ২৩৫টি ধর্ষণের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছিল, ২০১১তে তা বেড়ে হয়েছে ৪১৩। এঁর চেয়েও অনেক বেশী হল সেই সংখ্যা, যা পুলিশ রেকর্ডই করেনি। নারী অপহরণের সংখ্যা বৃদ্ধিও লক্ষ্যণীয়। ২০০১ সালে রাজ্যে ৭৩১টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছিল, যা ২০১১ সালে বেড়ে হয়েছে ১৩২৯টি। প্রায় ১০০ গুণ বৃদ্ধি। ইলা পাঠক জানিয়েছেন, গুজারাতকে অপরাধ-মুক্ত শহর দাবী করার তাগিদে থানায় গেলেও পুলিশ অভিযোগ নেয় না।
          এর নাম মোদির সুশাসন। এই হল সুশাসনের বাস্তব ছবি। মোদি এই সুশাসনকেই দেশে ছড়িয়ে দিতে চাইছেন।
           আর আপনি যদি তা না চান, তাহলে এই নারীবাদী ইস্তাহারটা পড়ে দেখুন। অন্যান্য ইস্তাহারের মত একদুইকরে লেখা নয়, টানা লেখা। টানা পড়তে ভাল লাগবে ভেবেই এভাবে লেখা। কেমন লাগল, দয়া করে জানান।

দ্বিতীয় ভাগঃ আছি কোথায়

মেয়েদের অবস্থার কথা বললেই শোনা যায় ধর্ষণের কথা। ধর্ষণ, শ্লীলতাহানী, যৌন অত্যাচারের কথা রোজ কাগজে পড়তে পড়তে এখন বিবমিষা হয়। কারও কারও কাছে ব্যাপারটা এখন গা-সওয়া। মেয়েদের জন্মই যেন যৌনতার জন্য, এমনটাই ভেবে বসেছে সমাজের একাংশ। এই ভয়ানক রোগ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হবে। মেয়েদের দুর্ভাগ্য, পরিবর্তনের পর এই রাজ্যে ধর্ষণের, নারী নির্যাতনের বন্যা বইছে। ধর্ষকের সাত খুন মাফ। পার্ক স্ট্রিট থেকে বীরভূমের আদিবাসী মেয়েকে গণধর্ষণ সর্বত্র এক হাল। ধর্ষকরা বেঁচে যাচ্ছে রাজনৈতিক রঙে। মুখ্যমন্ত্রী মহিলা, তা বলে ধর্ষকদের অসুবিধা হয় নি, হয়েছে মহিলাদেরই। সুপ্রিম কোর্ট ন্যায্যতই বলেছে, এই সরকার গণধর্ষণ রুখতে ব্যর্থ।
          কিন্তু, ধর্ষণটাই তো মেয়েদের একমাত্র সমস্যা নয়! সমস্যা বাইরে, সমস্যা ঘরেও। যে যে সমস্যায় সাধারণ মানুষ জেরবার, সেগুলি মেয়েদেরও আঘাত করে। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, আইন-শৃংখলার অবনতি, নাগরিক সুবিধার ক্রমাবনতি, সরকারি পরিবহনের অদৃশ্য হওয়া এসব মহিলাদেরও সমস্যা। শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যে মেয়েরা কতটা আক্রান্ত, তা রবীন্দ্রভারতীর ছাত্রীটির অভিজ্ঞতা হয়েছে। তারপরেও শ্লীলতাহানীকারী সেই ছাত্রনেতাকেবছরের সেরা ছাত্রপুরস্কার তুলে দিয়েছেন উপাচার্য, কারণ, তৃণমূল ছাত্র সংসদ সেটাই চেয়েছে।
          এমন ঘটনা একের পর এক ঘটছে। ভাঙ্গরের শিক্ষিকাকে জলের জগ ছুঁড়ে দলের কাছে হিরোহয়েছেন তৃণমূলের নেতা আরাবুল। তারপর পরীক্ষার হলে বে-আইনীভাবে আরাবুল ঢুকে পড়ায় অভিযোগকারী সেন্টার ইনচার্জ’-ই সরকারের তোপের মুখে। মালদহে তৃণমূল কর্মীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন ইটাহার কলেজের মহিলা অধ্যক্ষা স্বপ্না মুখার্জি। তাঁর অপরাধ, তিনি সিপিআই সমর্থক এবং তাঁর স্বামী ডঃ শ্রীকুমার মুখার্জি রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন। জেলায় জেলায়, ব্লকে ব্লকে সর্বত্র এমন ঘটনা ঘটছেই। বিরোধী দলের সমর্থক তো ছাড়, দলের মহিলা সাংসদও রেহাই পায় নি। জেলা সভাপতি দিদির প্রিয় কেষ্ট-র কথা না শোনায় সাংসদ শতাব্দী রায়ের বীরভূমের দফতরে তিন বার তালা ভেঙে চুরি হয়েছে, কম্পিউটারের নথিপত্র নষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু কেউ গ্রেফতার হয় নি। ধনেখালির টিএমসি কর্মী কাজি নাসিরুদ্দিনের বিধবা স্ত্রী মনুজা বেওয়া জানেন, কি চলছে এই রাজ্যে। জানেন, সেখানকার মহিলা বিধায়ক অসীমা পাত্র কিভাবে তাঁর স্বামীকে পুলিশ দিয়ে হত্যা করিয়েছে। গুড়াপের হোমের শিশু গুড়িয়ার ঘটনায় কিভাবে ধর্ষণ করে হোমের ওই শিশুগুলিকে মেরে নদীর চরে পুতে রাখা হত।
         বাইরে তাকান। আয়লার পর সুন্দরবনে এখনও ত্রাণ যায় নি। সরকার উলটে বাঁধ বানিয়ে আয়লা জাতীয় ঝড়ের মোকাবিলার করতে গ্রামের মানুষের জমি দখল করছে। অন্যদিকে, ত্রাণ না পাওয়া পরিবারের মেয়েরা নিরন্ন সন্তান, ভাইবোন বা বাবা-মায়ের অনাহার সহ্য করতে না পেরে হারিয়ে যাচ্ছে। একজন-দু-জন নয়, হাজারে হাজারে। কেউ যদি বা ফেরে, তাঁদের ফের যেতেই হয়, কেন না  তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা সরকার করে নি। আর, পরিবারও পাছে লোকে কিছু বলের ছুতোয় খাবারের ভাগ বাঁচায়। তাই, খবরের কাগজের পাতায় নারী পাচারের জমজমাট কাহিনী পাওয়া যায়। সুন্দরবনের মতই মালদা, মূর্শিদাবাদের, জলপাইগুড়ির মেয়েদের প্রতিদিন পাচার হওয়া এখন জলভাত। কোনও পাচার হওয়া মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে শুনবেন রোজগারের তাগিদেই তাঁদের ঘর ছাড়ার কাহিনী। নিজেদের জীবন বিপন্ন করেই তাঁরা যাচ্ছেন, কারণ সরকার তাঁদের কাজের ব্যবস্থা করে দিতে ব্যর্থ। চায়ের বাগানে লাভের বদলে বাগান বন্ধ করে লোভের খেলা খেলছেন মালিকেরা। বন্ধ বাগানের অশক্ত নারী-পুরুষ অনাহারে মরছে। নয়তো, মৃত্যুর থেকে বাচতে অনিশ্চিতের পথে যাওয়া। দুঃখের অবসান চেয়ে অন্ধকার গলির জীবনে আদিম পেশায় চলে যাওয়া। প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতায় ছাপে, ভিন রাজ্য থেকে উদ্ধার বাংলার ঘরের মেয়েদের কথা। তাতে সরকারের লজ্জা পাওয়ার কি আছে?  
         শিক্ষিতদেরও কাজের সংস্থান নেই। পাস করে, পরীক্ষা দিয়েও চাকরি পেতে হলে ধরতে হয়য় শাসক দলের নেতাদের। তাতেও চান্স কম, মন্ত্রী-বিধায়ক-পুরপিতা-পঞ্চুদাদার আত্মীয় হলে সম্ভাবনা আছে। টেট-এর টেটিয়া শিক্ষা এটাই। ফলে, ক্ষতিগ্রস্তদের বাইরেও ক্ষুব্ধ যুবসমাজের অর্ধেক তো মেয়েরাই। ভোটের আগে মন ভোলাতে ফের টেট নেওয়ার চেষ্টা আপাতত আদালতের নির্দেশে জলে। গত তিন বছরে রাজ্যে শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগটাই প্রায় নেই, চাকরির সুযোগও নেই। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত মেয়েরাও তার শিকার।
          রাজ্যের এক সাংসদ বলেন, “ভারতের সর্বত্র কালিয়াচকের লোক পাবেন। তাঁরা নির্মাণশ্রমিক।লক্ষ লক্ষ যুবক এমন পেশায় কাজের তাগিদে রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে গিয়েছে। কারণ অভাব। তাঁরা রোজগারের তাগিদে অমানবিক উপায়ে জীবন কাটান। যাপন করেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভাসমান শ্রমিকের যাযাবর জীবন। এঁদের একটা অংশ নারী শ্রমিক, তাদেরও জীবন ভাসমান। কারও সঙ্গে ঘর বাধার পর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো দু-জনকে দুই প্রান্তে বদলী হতে হয়। এঁরা জাতীয় আয়ের বিরাট অংশ এনে দিলেও এঁরা আসলে গৃহহীন। এভাবেই ঘর ছেড়ে গুজরাত, মহারাষ্ট্র, রাজস্থানে যাচ্ছেন হিরে কাঁটার, সোনার কাজের, জরির কাজের, সুতোকলের মজুর হয়ে যাওয়া গ্রামীণ বাঙালিরা।
          স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ব্যাঙ্কের মহিলা কর্মীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়িয়ে এক বছর করার প্রস্তাব দিয়েছেন। মূর্শিদাবাদের মেয়ে বিড়ি শ্রমিক, মালদার ডোকরার মেয়ে শ্রমিক, চা-বাগিচার মেয়ে শ্রমিক, গ্রামে গ্রামে মাঠে কাজ করেন যে মেয়ে শ্রমিকেরা, রাস্তা ও ভবন নির্মাণ শিল্পে যুক্ত মেয়ে শ্রমিকরা এক বছর করে মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন? সরকার কি দায় নেবে? তাঁদের দেহে পুষ্টি নেই, কারণ পুষ্টিকর খাওয়ার মত মজুরি তাঁরা পান না। তাদের সন্তানরা রুগ্ন শিশু হয়ে জন্মান। সেই সব সদ্যোজাতদের নিয়ে যেতে হয় মালদায় বা কলকাতায় বিধান শিশু হাসপাতাল, খবরের কাগজে দৌলতে যেগুলি এখন সদ্যোজাতদের মৃত্যুর কেন্দ্র। সমাজের নিচের তলায় থাকা মায়েরাও বুঝছেন, শাসক দলের প্রশ্রয়ে থাকা উপরের লোকেরা খাবে নারকেলের জল আর শাঁস, নিচের লোকেদের জন্য খোলাটা! যেমন, দলের কর্মীরা এখন বুঝছেন, সারা বছর খেটে দল করবেন তাঁরা, আর ভোটের সময় ক্ষির খাবেন বলিউড-টলিউঁডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।
          ইদানিং না কি কাজের লোকের বড় অভাব। পরিচিতা এক পুরানো ঠিকে কাজের ঝি জানালেন, কেরালায় ঠিকে কাজের ঝিদের দৈনিক মজুরি প্রায় ২৫০ টাকা। সরকার বেঁধে দিয়েছে। কেউ কম দিলে, পুলিশে জানালে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা হয়। এটা শুরু করেছিল প্রাক্তন বাম সরকার। কেরালায়ব সবাই শিক্ষিতা, তাই ঠিকে ঝি সাপ্লাই দিচ্ছে এই রাজ্য। মনে মনে ভাবি, এই রাজ্যে থেকে পোড়ারমুখীরা এক বাড়িতে কাজ করে মুখঝামটা ছাড়া মাসে পাবেন তো ৮০০ কি ১০০০ টাকা। কেন তাহলে ওখানে যাবে না ওঁরা?”
         চোখের সামনেই আরেকটা সমাজ আছে, যাদের পছন্দ করি বা না করি, অস্বীকার করতে পারি না। এঁরা নিজেদের এলজিবিটিবলে। আছেন হাজার হাজার যৌনকর্মীরাও। তাঁরা বিরাট কিছু চান না, চান সমাজের একজন হিসাবে সম্মান আর স্বীকৃতি। চান, বেঁচে থাকার সমান অধিকার।
          পুরুষতন্ত্র সেই অধিকার দেবে না। দিতে পারে, নারীবাদই। সেটার জন্য ক্ষমতার আসনে নারীকেই বসতে হবে, তার কোনও অর্থ নেই। মার্গারেট থ্যাচার এইডস রোখার নামে বৃটেনে এক নিয়ম চালু করেছিলেন। এশিয়ান কোনও মহিলা এয়ারপোর্টে নামলে তাঁকে বলা হত, “টেক অফ ইয়োর পেটিকোট। লেট আস সি ইউ আর ভার্গো ইনট্যাক্টা।নিশ্চয় তাঁকে নারীবাদের প্রমাণ বলবেন না কেউ। ইন্দিরা গান্ধী, সিরিমাভো বন্দরনায়েক, বেনজির ভুট্টো, খালেদা জিয়ারা নারী হলেও তাই নারীবাদী নন। নারীবাদ অর্থ সৃজনশীলতা, সহভাগী হওয়া। পাড়ার পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করাটা, গাছ বাঁচানো, নদী বাঁচানো, শ্রমের অধিকারের, মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় লড়াই করা তাই নারীবাদী কাজ। সেই কাজ পুরুষ করলেও তা নারীবাদী কাজই।
https://mail.google.com/mail/images/cleardot.gif












ধারাবাহিক – সৌমিত্র চক্রবর্তী

ধারাবাহিক

বহুগামীতায় থাক হে ঈশ্বর
সৌমিত্র চক্রবর্তী


(৭)

বাবা শিবের চরণে সেবা লাগে মহাদেএএএএএএব…’
সাদা ধুতি গলায় কাছা গেরুয়ার চিহ্ন নিয়ে এক লাইনে হেঁটে যাওয়া মূর্তিগুলোর দিকে চেয়ে দেখলো সে। চৈতী গাজনের বোলানের দল বেরিয়েছে। এরা আশেপাশের সব গ্রামের বাড়িতে যাবে। চেয়ে নেবে যাপনের আপাত রসদ। একবেলা নিরামিষ খেয়ে, একাদশী অমাবস্যা আরো বহু হাবিজাবি নিয়ম কানুন মেনে চৈত্র সংক্রান্তির দিন মাতবে গাজনে। ফসলের এই বন্ধ্যা সময় এদের দিয়েছে নিরাকার অবসর। গ্রামীণ কাঠামোয় শহরের মত হাজার বিনোদন ফাঁক ফোকর নেই এখানে। আর তাই এরা ধর্মকেই আশ্রয় করেছে। যদিও এই বোলানের দল আস্তে আস্তে গ্রামীণ সংস্কৃতির একটা শাখা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুধুই ধর্মীয় বাকবিতন্ডা নয়, এরা সমকালীন সামাজিক,রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে গান বাঁধে, সেই গান গেয়ে ফেরে গ্রামে গ্রামান্তরে। সরল সাধাসিধে মানুষগুলো প্যাঁচ শেখেনি এখনো, তাই সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে কোনো দ্বিধাই হয়না এদের। যেখানে শহরের কাঁড়িকাঁড়ি টাকাওয়ালা সমাজের মাথার মনিরা প্রচারের আলোয় থাকার জন্যে, ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার জন্যে রাজনৈতিক দলগুলোর পদলেহন করতে ব্যাস্ত, সেখানে এরা সত্যি কথাটা সোজা বলতে পিছপা হয়না।

চটকা ভেঙে নিজেই হেসে ফেলে লোকটা। গভীর ক্ষোভের তলায় তলিয়ে গেছিল সে। তার এইসব ভাবনার কারো কাছে কোনো গুরুত্বই নেই। কোনো পথের প্রান্তে দাঁড়িয়ে সে স্ট্রীটকর্নার করে চিৎকার করে এসব বলতেও যাবেনা। বলবে সে নিজের মনকেই, আর শুনবেও সে নিজেই। তবুওচৈত্র শুরুর এই সময়ে এবার হঠাৎ দাবদাহ বেড়ে গেছে। অন্যবছর ঠিক এতটা গরম পড়েনা। ইতিমধ্যেই হু হু করে বইতে শুরু করেছে লু। গরম হাওয়ার দাপট বেলা বাড়লেই চামড়ার সাত স্তর জ্বালিয়ে দিতে শুরু করেছে। নিজের দুহাতের দিকে তাকাল সে। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে হাতের চামড়া। তার ঢেকে রাখা গায়ের রঙ একরকম, আর দুহাতের রঙ অন্য। অবশ্য এসব নিয়ে কোনদিনই মাথা ঘামায় না সে। তার বহিরজীবনের অনিয়ন্ত্রিত হাঁটাচলায় নিজের শারীরিক সৌন্দর্যকে পাত্তাই দেয়না সে। তবু এই লু এর থেকে বাঁচতে ঝোলা থেকে গামছা বার করে ভালো করে নাক মুখ মাথায় জড়িয়ে নেয়। এই সময় কিছুতেই শরীর খোলা রাখতে নেই। শরীরের ভেতরের তাপমাত্রার শেকল ভেঙে তছনছ করে দেয় বাইরের আগুন। চলার এই সময়ে অকারণ অসুস্থ হতে চায়না সে।

ফনীমনসার ঝোপের ফাঁকে একটা গিরগিটি মাথা নেড়ে যায় একমনে। একটু দাঁড়িয়ে ফনীমনসার পাতাগুলো দেখে সে। এত সুন্দর গোলগাল তেল পিছলানো পাতায় এত কাঁটা কেন? তার জীবনে কিছুই কি মসৃণ ভাবে আসেনা? কেন এত কাঁটা পায়ে পায়ে কেবল ফুটতেই থাকে-ফুটতেই থাকে! কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল এই নষ্ট জীবন। কিন্তু কাকেই বা দায়ী করবে এর জন্যে? হাঁটতে হাঁটতে যখনই কোনো মসৃণ রাস্তার মুখোমুখি হয় সে, হঠাৎই কোথা থেকে উদয় হয় জলহীন, রসহীন ধূ ধূ বালিয়াড়ি। রাস্তা গিয়ে মিশে যায়, শেষ হয়ে যায় সেই বালিয়াড়িতে। চ্যালেঞ্জ জানায় তার অস্তিত্বকে। কোনো আলাদা অপশন তার সামনে থাকেনা বেছে নেবার মত। চলতে বাধ্য হয়, পার হতে বাধ্য হয় সেই নিস্করুন বালির মরুভূমি। সারা চলনচক্রে তার যে নিস্তার নেই এ সার সে বুঝে গেছে। এখন আর এ নিয়ে আফশোষ বা চিন্তাও করেনা।

কাল ভোর রাতে স্বপ্ন দেখছিল, বিশাল এক হ্রদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে সে। অপরূপ সেই হ্রদের অন্য পাড় আবছা। নীল অতলান্ত ডাক দিচ্ছে তাকে। পাড়ে ভাসছে এক একাকী নৌকা, দাঁড়হীন হালহীন, মাঝিহীন। ন্যাড়া নৌকার মধ্যে তার জন্যেই অপেক্ষা করছে এক বিষন্ন নারী। হয়তো সারা জীবনের চলনসময়ে সেও বারবার ধাক্কা খেয়েছে। অপ্রাপ্তির বোঝা চেপেছে কাঁধে। সঙ্গে চেপেছে শুধুই অকারণ দায়িত্ব। হয়তো স্নেহ ভালবাসার সামান্য অস্পষ্ট দাগও তার দিননামচায় খুঁজে পায়নি সেই রমনী। পায়নি মন, মনের সঙ্গ দেবার মত সাথী। বঞ্চিত সেই একক সৌন্দর্য আজ তারই অপেক্ষায় বিষাদ মেখে বসে আছে নৌকার গলুই এ। অপূর্ব হ্রদের নরম পাড় বেয়ে ধীরে ধীরে সে উঠে বসে সেই কাঙ্খিত নৌকায়। দুহাতের তালুতে আলতো করে ধরে পরম স্নেহে দেখে সেই রমনীয় পানপাতা মুখক, গভীর টলটলে হ্রদেরই প্রতিরূপ চোখ, কপালের বিস্তীর্ণ মালভূমির ঠিক নিচে শুরু হওয়া নাক, দুই গোলাপী গাল আর উষ্ণতায় মোড়া দুঠোঁট। গভীর মুগ্ধতায় দুঠোঁটের গভীরে ডুবে যায় সে। হারিয়ে যেতে যেতে নিজেকে ফিরে পায় সে। আর বেরসিকের মত তখনই ঘুমটা ভেঙে যায়। গতরাতে একটু জ্বর নিয়েই শুয়েছিল লোকটা।

লাল কালো একটা কুবো পাখি উড়ে এসে নতুন পাতা বেরনো নিম গাছে বসলো। এই পাখিটার ডাক শুনলে মনেই হয়না আসলে এতবড় হতে পারে এর শরীর। কেমন যেন মন উদাস করা টানে কুব কুব করে ডেকে যায়। থমকে গিয়ে ভালো করে একবার দেখে নিয়ে আবার চলতে শুরু করে লোকটা। থামলে হবেনা তাকে। চরৈবেতি-চরৈবেতি। যতদিন বাঁচবে এভাবেই চলতেই হবে তাকে। যেদিন থামবে, সেদিন ঘড়ির কাঁটাও থেমে যাবে। থমকে যাবে হাওয়ার স্ফূর্তি। নদীর জল। চাকার একটানা ঘূর্ণন। মাথায় ভিজে গামছা চাপিয়ে এক বৃদ্ধা হাতে সদ্য কাচা কাপড় নিয়ে স্নান সেরে ফিরছে। তার পথ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হয়তো এতদিন চলতে চলতে সেও এক যন্ত্র হয়ে গেছে। যা কিছুই করে সব করতে হয় বলেই।

ওপরে তাকিয়ে অদৃশ্য বাজীকরকে দেখার চেষ্টা করে লোকটা। চৈতি রোদ্দুরের ঝলকে চোখ ধাধিয়ে যায়। আকাশ টাকে মনে হয় ঘষা কাচ। ওপারে যা কিছুই আছে অদৃশ্য। কিন্তু ওপারে বসে থাকা সেই বাজীকরের খুকখুক হাসি স্পষ্ট শুনতে পায় সে। তার সাথে জন্ম বিবাদ ওই মহাশক্তির। যা কিছুই করতে চায়, যেভাবে চালাতে চায় তার রেখা, সব সবকিছু বাজীকরের আঙুলে বাঁধা সুতোর টানে বানচাল হয়ে যায়। এখন সেও প্রবল অনীহায় তাচ্ছিল্য করে ওই ভীরু ষড়যন্ত্রীকে। যা হচ্ছে তা হোক। যা করতে চেয়েছিল সে তার অনেক কিছুই করতে পারেনি, আর যা করতে চায়নি অযাচিতভাবে তাই যেন এসে টকটক করে কড়া নেড়েছে তার দরজায়। এখন আর কিছুতেই কিচ্ছু যায় আসে না তার। চলুক এভাবেই। তার হাঁটা তো কেউ থামাতে পারবে না। আর যখন থামবে, তা দেখার জন্যে সেও চোখ খুলে থাকবে না। অতএব

একটা অশ্বত্থ গাছের খোঁদলে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা নিশাচর এক প্যাঁচাকে ঘিরে কয়েকটা কাক তারস্বরে চিৎকার করতে করতে উড়ছে। বেচারা প্যাঁচা এই দাবদাহের ঝলকে এখন অন্ধ। আন্দাজে বিপদ বুঝে যতটা সম্ভব ভেতরে সেঁধিয়ে যাবার চেষ্টা করছে ওটা। কিন্তু গর্তটা মনে হয় তার শরীরের পক্ষে যথেষ্ট অকুলান। কাকগুলো অপেক্ষায় এক সময় না এক সময় এই আপাত প্রতিবন্ধী শিকারকে কব্জায় আনবেই তারা। এ যেন মানুষের চলনচক্রেরই এক প্রতিচ্ছিবি। সুযোগ পেলেই এ ওকে ঠুকরাচ্ছে, এ ওকে কামড়ে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। ভালবাসার তপ্ত যোনি চরম ভালবাসাহীনতায় ছিঁড়েখুঁড়ে ফর্দাফাই করে পাশবিক উল্লাসে পেশী ফোলাচ্ছে। আঃ! একি সভ্যতা! তাহলে কিসের মানুষ জন্মের গর্ব? কিসের সভ্যতার পেশী আস্ফালন? মধ্য অন্ধকার যুগের সঙ্গে কিসের তফাৎ আজকের এ দগ্ধ সময়ের? প্রবল ঘেন্নায় একটা ভাঙা গাছের ডাল দিয়ে কাকগুলোকে তাড়া করে সরিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।

আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে/তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে…’গলার কাছে একটা দলা পাকানো কষ্ট উঠে এসে টোকা দেয়। লু এর দাপটে চোখ খটখটে শুকনো নালা। একটা ঘষে যাওয়া যান্ত্রিক শব্দ কোথা থেকে যেন ভেসে আসে। দুপায়ের আঙুলের ওপরে ভর দিয়েও দিগন্ত প্রসারী আবছায়ায় খুঁজে পাওয়া যায়না শব্দের উৎস। ক্র্যাশার মেশিনের হৃদপিন্ড চিরে যাওয়া সেই আওয়াজ পাগল করে তোলে লোকটাকে। ঝোলাটা তুলে ধরে ছুটতে শুরু করে সে। পায়ের নিচে অমসৃণ গ্রামের অমসৃণ নাম কা ওয়াস্তে পথ প্রতিমুহূর্তে আঘাত করে তার শরীরবাহনের চামড়ায়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। পাগল হতে চলেছে নাকি সে? কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ছুটে যায় লোকটা। তাকে পালাতেই হবে এই বিসদৃশ যান্ত্রিকতা থেকে। পারবে না সে নিজেকে গতানুগতিকতায় ভাসিয়ে দিয়ে আরেকটা যন্ত্র হয়ে যেতে।


পালাও- ভাগো রে মুসাফির-খতরা ভিতর-খতরা বাহির-ভাগো-ভাগো রে মুসাফির-যব তক জিনা চাহতে হো-ভাগো… 

কবিতা - সুমন মল্লিক

মাঝরাতের উপলব্ধি 
সুমন মল্লিক


মাঝরাতে যখন গহীন ঘুমের ভেতর
নেশাতুর যৌনতা নোনা ঢেউ তোলে
ইচ্ছের ফ্লাইওভারে ধাবিত হয়
ড্রপ আউট প্রেমের মৌন ভ্রূণেরা ৷
নিঃশ্বাসের সুবাসে হঠাৎ ঘোর কাটতেই
দেখি আমার শরীর লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে
আরেকটা শরীর...
মুহূর্তে উপলব্ধি করি
বাস্তবের ক্রনিক কারনামা
আর ভাবি
জীবনের সমস্ত ব্লকেজ জীবনই সরিয়ে দেয়
তিগ্মতরঙ্গে ৷৷




কবিতা - ঊষসী ভট্টাচার্য

পিলসুজ 
ঊষসী ভট্টাচার্য


নর্দমার পাশে বিকেল গড়াচ্ছে
কেরোসিন বোতোলে,
ইচ্ছুক অনিচ্ছুক ক্রেতারা
রাতে ঘরে ফেরেনা।
তিনটে আলোর বিনিময়ে
চারটি নিভন্ত মাটির সলতে।
বলতে গেলে, এবার ও পৃথিবী
বন্দরে বন্দরে ঘাঁটি গড়বে
ডুগডুগি আলেয়ার!
শবের পাশে জীবন্ত আগুন পুড়ছে,
মশালেরা জ্বলছে মিছিল থেকে
রক্তমাংস অবয়বে।।।

কবিতা - সুচেতা বিশ্বাস

ব্যাথা
সুচেতা বিশ্বাস

এই যে রুদ্ধ দুয়ার খুললে
হাতের উপর হাত
সিঁদুর তোমার গালের রং
মেঘ আকাশের সাজ

ব্যাথায় ছিল নুনের কথা
জাফরানী রং দুপূর
চোখের তারায় পিটুনিয়ার
মরসুমী শীত আতুর

শ্বাস থেকে শ্বাস মৃদুল ভাষা
শান্ত কথার মালা
খোলা হাওয়ায় অনেকদিনের
জুরোলো বুকের জ্বালা