চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য
খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না
"মোদি-রাজ্যে মেয়েরা ও একটি নারীবাদী ইস্তাহার"
মেয়েদের জন্য গোটা একটা নির্বাচনী ইস্তাহার! ভাবাই কঠিন। যে দেশে অনাহার, অর্ধাহারে মৃত্যুর চেয়ে মুখোরোচক হয় নারীর শ্লীলতাহানী, ধর্ষণ ইত্যাদি; সেখানে মেয়েদের সমস্যা, মেয়েদের
দাবিদাওয়া নিয়ে একটা ইস্তাহার! উরে ব্বাস! কথাটা এক বন্ধুনী বলতেই মুফে নিলাম।
আপত্তি কি? রাজনৈতিক দলগুলির ইস্তাহার হয়।
এমন কি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলিও গোপন
ইস্তাহার পাঠায় দলগুলির কাছে – যে
যতটা মেনে নেবে, সেই অনুযায়ী টাকা পাবে। এবার
দেখলাম একটি বহুল প্রচারিত ইংরাজি পত্রিকাও নিজস্ব ইস্তাহার এনেছে। সেগুলি চেটে
দেখেছি, চিবিয়ে দেখেছি, গেলা যাচ্ছে না। খাচ্ছি, কিন্তু গিলতে পারছি না। অগত্যা… বন্ধুনীর
পরামর্শে এই ইস্তাহার লেখায় হাত দিলাম।
বন্ধুনী বলেছেন, ইস্তাহারটি
দুই অংশে ভাগ থাকবে। দ্বিতীয়াংশে থাকবে সেই ইস্তাহার আর প্রথমাংশে থাকবে দেশের
একমাত্র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর রাজ্যে মেয়েরা কেমন আছে, তাঁর একটা বিবরণ। কারণ, আর কেউ যখন প্রধানমন্ত্রীর জন্য ভোটে না লড়ে সাংসদ হতে চাইছেন, তাঁদের গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেনই, তা সে সাংসদ না হয়েও, তাঁর কথাকেই গেলার চেষ্টা করা যাক। ও হরি! এই যে সেই চিবানোই সার, গেলা যাচ্ছে না। কেন? তা নিজেই দেখুন…
প্রথম ভাগঃ মেয়েদের মরণদশা
“অপুষ্টির কারণে গুজরাতের প্রায় অর্ধেক শিশুই বয়সের তুলনায়
কম ওজনের’। নিজের ব্লগে এ-কথা
লিখেছিলেন প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন
বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু। তিনি লিখেছেন, “গুজরাতে অপুষ্টিতে ভোগা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর হার ৪৮ শতাংশ, যা শুধু জাতীয় হারের চেয়ে বেশীই নয়, সাব-সাহারা এলাকার সোমালিয়া এবং ইথিওপিয়ায় অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর হারের চেয়ে
অনেক বেশী। এই পরিসংখ্যানের যথার্থতা দিয়ে মোদী বলেছেন, ‘গুজরাতের মেয়েরা নিরামিশাষী এবং মোটা হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাঁরা দুধ খায় না।’ এ-সব ছেঁদো যুক্তি। গুজরাতের শিশুরা কি তবে মোদীর বানানো
কারখানা, সড়ক আর বিদ্যুৎ খায়! … গুজরাতে সদ্যজাতের মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৪৮ জন, যার ফলে ভারতের সবচেয়ে খারাপ রাজ্যগুলির মধ্যে গুজরাত দশম
স্থানে। … গুজরাতের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের
এক-তৃতীয়াংশের শরীরের বডি মাস ইন্ডেক্স ১৮.৫ এর চেয়েও কম, ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে খারাপের দিক থেকে সপ্তম। … গুজরাতে প্রসূতিদের মৃত্যুর হারও বেশি।”
অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী মোদি বলেছেন, ‘গুজরাতের মেয়েরা খুব বেশী ফ্যাশন সচেতন। তাঁরা তো মাছ খায়ই না , দুধটাও খায় না। তাঁরা আসলে স্লিম, রোগা নন।‘ তা, মোদির কথাকেই গুরুত্ব দিয়ে মেলাতে গিয়েই চিত্তির! ‘হিন্দু’ পত্রিকা গোষ্ঠীর ‘ফ্রন্টলাইন’ লিখেছে, অপুষ্ট শিশু জন্মের মূল কারণ মা-বাবাদের কম মজুরি। কম
মজুরির জন্য গুজরাতের শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা কম। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের ‘চিলড্রেন ইন ইন্ডিয়া, ২০১২’ বলছে, ‘এই রাজ্যের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়। গড়ে প্রতি ১০০০
সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে গুজরাতে ৪৪টি সদ্যোজাত মারা যায়, যা জাতীয় গড় হারের চেয়ে বেশী’। কেন গুজরাতের শিশুরা
অপুষ্টিতে ভোগে বা কেন সঠিক ওজনের সুস্থ শিশুর জন্ম নিচ্ছে
না, তা জানা যাচ্ছে গুজরাত সরকারের
সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প (আইসিডিএস) সম্পর্কে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল
(সিএজি)-এর রিপোর্টে। মোট ১.৮৭ কোটি মানুষ আইসিডিএস প্রকল্পের কোনও সুবিধাই পান
নি। এই প্রকল্পে চিহ্নিত ২২৩.১৫ লাখ নাগরিকের মধ্যে ৬৩.৩৭ লাখ কোনও পরিসেবা পায়
নি। রাজ্যে বার্ষিক ৩০০ দিন পুষ্টিকর খাবার সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে হয়েছে
২০৪ দিন। সদ্য-যুবতীদের পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের প্রকল্পে ঘাটতি ২৭ থেকে ৪৮ শতাংশ।
৩১ শতাংশ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রকে তৈরির অনুমোদনই দেয় নি সরকার। যেগুলি আছে সেগুলিতে
পরিশ্রুত পানীয় জল বা প্রস্রাবাগার নেই।
কাটজুর কথা মিথ্যে প্রমাণের ভার গেল মোদি ব্র্যান্ডের
প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ওয়েবজাইন ‘ইন্ডিয়াস্পেন্ড’-এর উপর ক্ষুব্ধ ‘বিকাশপুরুষ’ মোদীর নিযুক্ত ওয়েবজাইন বিচারপতি কাটজুকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ
করতে নিজেরাই জানিয়েছে, গুজরাতে
অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর হার ৪৪ শতাংশ আর, সদ্যোজাতের
মৃত্যুর হার হাজারে ৪৪ জন, ৪৮ জন
নয়। হায়, পোষা তোতাও শেষে নিজের মুখেই
ঝামা ঘষে দিল! মোদী সরকার সিএজি-র তথ্যের জবাবে জামিয়েছে, অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা ২০১৩ সালে হয়েছে ৪০ শতাংশ। আর, কম ওজনের শিশুজন্মের হার নাকি ২০০৭-এ ৭৩.০৪ থেকে ২০১৩-র
মার্চে লক্ষ্যণীয়ভাবে কমেছে! হাঃ হাঃ। ২০০৭এর চিত্রটি কত উজ্জ্বল! তাই না? মোদি তাঁর পাঁচ বছর আগেই মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তাহলে এই হাল
কেন?
আরও কিছু তথ্য দেখুন। আহমেদাবাদের ওমেনস অ্যাকশন গ্রুপ-এর
প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ডঃ ইলা পাঠক জানিয়েছেন, গুজরাতের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের ৫৫.৫ শতাংশই রক্তাল্পতায়
ভুগছেন। এনিমিক! এই বয়সী মহিলাদের প্রায় ৬১ শতাংশ গর্ভবতী নারী রক্তাল্পতার
পাশাপাশি অপুষ্টিতেও ভুগছেন। ‘ভাইব্র্যান্ট
গুজরাত’-এর মুখ ঝকঝক করছে! আগের বছরের
হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট বলেছিল, গুজরাতের
অর্ধেক শিশুই অপুষ্টিতে ভুগছে। আর, গ্রামে
যেহেতু চিকিৎসার দারুণ অভাব এবং তফশিলী জাতি-উপজাতির পিছিয়ে পড়া লোকেরাই যেহেতু
গ্রামে থাকেন, তাই তাঁদের মধ্যেই অপুষ্টি ও
শিশুমৃত্যুর হার রাজ্যের গড় হারের চেয়ে অনেক বেশী। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৮-৮৯ সালে দেখা গেছে, ৬ মাস থেকে ৩৫ মাস বয়সী দলিত ও আদিবাসী শিশুদের ৭৪.৫ শতাংশই অপুষ্টিতে ভুগছে।
২০০৫-০৬ সালের হিসাবে ৬ - ৩৫ মাস বয়সের দলিত ও আদিবাসীদের ৭৯.৮ শতাংশ অপুষ্টির
শিকার। ৪১ শতাংশ শিশুর জন্মের সময়ের ওজন কম, ৪৯.২ শিশু কম দৈর্ঘ্য নিয়ে জন্মাচ্ছে। এসব হল অপুষ্টিতে জন্মানোর প্রমাণপত্র।
মোদি তাঁর রাজ্যের এই হাল করেছেন।
গুজরাতে পুরুষ-মহিলার অনুপাত ক্রমেই কমছে। ২০০১ সালে ছিল
হাজার পুরুষ পিছু মহিলার সংখ্যা ছিল ৯১৮ জন, যা ২০১১তে হয়েছে ৯১৫ জন। জাতীয় স্তরে সংখ্যাটা এই সময়কালে ৯৩৩ থেকে বেড়ে হয়েছে
৯৪০। গুজরাত ছাড়া অন্য সব রাজ্যে অনুপাত বেড়েছে। অনুপাত কমা মানেরি কন্যাভ্রূণ
হত্যা। দেখা যাচ্ছে, ২০০১ সালে গুজরাতে ৬ বছর
পর্যন্ত বয়সী শিশুদের মধ্যে মেয়েদের অনুপাত ছিল প্রতি হাজারে ৮৮৬, যেটা ২০১১তে এসে আরও কমে হয়েছে ৮৮৩। ২০০১-র তথ্য সামনে আসার পরই মোদি দরকার ১০১টি সোনোগ্রাফি
পরীক্ষা কেন্দ্র সাময়িকভাবে বন্ধ করে। তাঁর পরের দু-বছর অল্প অল্প কিছু কেন্দ্র
বন্ধ করলেও কাউকেই পিসিপিএনডিটি আইনে সাজা দেয় নি।
তাঁর শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকার অসাধারণ কাজ করেছে, দাবী মোদির। মেয়েদের শিক্ষা এক্কেবারে ফ্রি। ঠিক, কিন্তু ফ্রিতে শিক্ষায় যে কিছুই শেখানো হয় না! লেখাপড়া
ঠিকঠাক শিখতে তাই ভরসা বেসরকারি স্কুল, দিতে
হয় বিপুল অঙ্কের ফিস। যারা পারেন না, তাঁদের
ঘরের মেয়েরা অশিক্ষিতই থেকে যান। প্রাথমিকে প্রতি একশো ছাত্র পিছু ছাত্রী ভর্তির
হার দশ বছর আগে ছিল ৯৪, এখন
সেটা আরও কমে হয়েছে ৮৮। আর, মাধ্যমিকে
এই সংখ্যাটা আরও একটু কমে ৮৪ জন। তাদেরও অধিকাংশই অল্প কিছুদিন পড়েই বিয়ের পিঁড়িতে
যান। কেউ কেউ একটু এগিয়ে কলেজে যান, চাকরি
পান, ব্যস। উচ্চতর শিক্ষায় আগ্রহ
হারাচ্ছে কুবেরের রাজ্য গুজারাতের মেয়েরা। ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশনের ‘একমাত্র কন্যা সন্তান’ প্রকল্পে কোনও পরিবারের একমাত্র কন্যা সন্তান যদি পোস্ট গ্রাজুয়েট পড়ে, ইউজিসি তাঁকে স্কলারশিপ দেবে। ২০১২তে সারা দেশের ২৪১৯ জন এই
প্রকল্পে আবেদন জানায়। তাঁর মধ্যে পশ্চিম বাংলার ৭০৬ জন, কেরালার ৫৭৭ জন, মহারাষ্ট্রের ৬০ জন, কর্নাটকের ৫৭৭ জন, তামিলনাডুর
৪৫৬ জন, অন্ধ্রের ১৬১ জন ছিলেন। আর
গুজরাটের মোট আবেদনকারী মাত্র ১৮ জন।
গুজরাতের মেয়েদের উদ্যমী। তাঁরা চাকরি করেন, নিজেরা ব্যবসায়ও করেন। আমুল সমবায়, শ্রী মহিলা গৃহ উদ্যোগ লিজ্জত পাপড় তো বিখ্যাত। সংগঠিত ক্ষেত্রে গড়ে দেশের ২০
শতাংশ কর্মী মহিলা, গুজরাতে তা ১৩ থেকে ১৫
শতাংশ। তাদের মজুরিও কম, ফলে
তারাও অপুষ্টিতে ভোগেন। আগে, এই
রাজ্যে নারীধর্ষণ শোনা যেত না। গুজরাত দাঙ্গার পর এই ব্যাধির প্রকোপ বেড়েছে। আগে, গরবা নেচে একটি মেয়ে মধ্যরাতে একা অটোতে চেপে নিশ্চিন্তে
বাড়ি ফিরৎ। মোদি আসার পর অবস্থা বদলাচ্ছে। ২০০১-এ এই
রাজ্যে ২৩৫টি ধর্ষণের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছিল, ২০১১তে তা বেড়ে হয়েছে ৪১৩। এঁর চেয়েও অনেক বেশী হল সেই সংখ্যা, যা পুলিশ রেকর্ডই করেনি। নারী অপহরণের সংখ্যা বৃদ্ধিও
লক্ষ্যণীয়। ২০০১ সালে রাজ্যে ৭৩১টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছিল, যা ২০১১ সালে বেড়ে হয়েছে ১৩২৯টি। প্রায় ১০০ গুণ বৃদ্ধি। ইলা পাঠক জানিয়েছেন, গুজারাতকে অপরাধ-মুক্ত শহর দাবী করার তাগিদে থানায় গেলেও
পুলিশ অভিযোগ নেয় না।
এর নাম মোদির সুশাসন। এই হল সুশাসনের বাস্তব ছবি। মোদি এই
সুশাসনকেই দেশে ছড়িয়ে দিতে চাইছেন।
আর আপনি যদি তা না চান, তাহলে
এই নারীবাদী ইস্তাহারটা পড়ে দেখুন। অন্যান্য ইস্তাহারের মত এক… দুই… করে
লেখা নয়, টানা লেখা। টানা পড়তে ভাল লাগবে
ভেবেই এভাবে লেখা। কেমন লাগল, দয়া
করে জানান।
দ্বিতীয় ভাগঃ আছি কোথায়
মেয়েদের অবস্থার কথা বললেই শোনা যায় ধর্ষণের কথা। ধর্ষণ, শ্লীলতাহানী, যৌন
অত্যাচারের কথা রোজ কাগজে পড়তে পড়তে এখন বিবমিষা হয়। কারও কারও কাছে ব্যাপারটা এখন
গা-সওয়া। মেয়েদের জন্মই যেন যৌনতার জন্য, এমনটাই
ভেবে বসেছে সমাজের একাংশ। এই ভয়ানক রোগ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হবে। মেয়েদের
দুর্ভাগ্য, পরিবর্তনের পর এই রাজ্যে
ধর্ষণের, নারী নির্যাতনের বন্যা বইছে। ধর্ষকের
সাত খুন মাফ। পার্ক স্ট্রিট থেকে বীরভূমের আদিবাসী মেয়েকে গণধর্ষণ – সর্বত্র এক হাল। ধর্ষকরা বেঁচে যাচ্ছে রাজনৈতিক রঙে।
মুখ্যমন্ত্রী মহিলা, তা বলে ধর্ষকদের অসুবিধা
হয় নি, হয়েছে মহিলাদেরই। সুপ্রিম কোর্ট
ন্যায্যতই বলেছে, এই সরকার গণধর্ষণ রুখতে
ব্যর্থ।
কিন্তু, ধর্ষণটাই
তো মেয়েদের একমাত্র সমস্যা নয়! সমস্যা বাইরে, সমস্যা ঘরেও। যে যে সমস্যায় সাধারণ মানুষ জেরবার, সেগুলি মেয়েদেরও আঘাত করে। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, আইন-শৃংখলার অবনতি, নাগরিক সুবিধার ক্রমাবনতি, সরকারি পরিবহনের অদৃশ্য হওয়া – এসব
মহিলাদেরও সমস্যা। শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যে মেয়েরা কতটা আক্রান্ত, তা রবীন্দ্রভারতীর ছাত্রীটির অভিজ্ঞতা হয়েছে। তারপরেও
শ্লীলতাহানীকারী সেই ছাত্রনেতাকে ‘বছরের
সেরা ছাত্র’ পুরস্কার তুলে দিয়েছেন উপাচার্য, কারণ, তৃণমূল
ছাত্র সংসদ সেটাই চেয়েছে।
এমন ঘটনা একের পর এক ঘটছে। ভাঙ্গরের শিক্ষিকাকে জলের জগ
ছুঁড়ে দলের কাছে ‘হিরো’ হয়েছেন তৃণমূলের নেতা আরাবুল। তারপর পরীক্ষার হলে
বে-আইনীভাবে আরাবুল ঢুকে পড়ায় অভিযোগকারী ‘সেন্টার ইনচার্জ’-ই সরকারের তোপের মুখে।
মালদহে তৃণমূল কর্মীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন ইটাহার কলেজের মহিলা অধ্যক্ষা
স্বপ্না মুখার্জি। তাঁর অপরাধ, তিনি
সিপিআই সমর্থক এবং তাঁর স্বামী ডঃ শ্রীকুমার মুখার্জি রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন।
জেলায় জেলায়, ব্লকে ব্লকে সর্বত্র এমন ঘটনা
ঘটছেই। বিরোধী দলের সমর্থক তো ছাড়, দলের
মহিলা সাংসদও রেহাই পায় নি। জেলা সভাপতি দিদির প্রিয় কেষ্ট-র কথা না শোনায় সাংসদ শতাব্দী
রায়ের বীরভূমের দফতরে তিন বার তালা ভেঙে চুরি হয়েছে, কম্পিউটারের নথিপত্র নষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু কেউ গ্রেফতার হয় নি। ধনেখালির
টিএমসি কর্মী কাজি নাসিরুদ্দিনের বিধবা স্ত্রী মনুজা বেওয়া জানেন, কি চলছে এই রাজ্যে। জানেন, সেখানকার মহিলা বিধায়ক অসীমা পাত্র কিভাবে তাঁর স্বামীকে পুলিশ দিয়ে হত্যা
করিয়েছে। গুড়াপের হোমের শিশু গুড়িয়ার ঘটনায় কিভাবে ধর্ষণ করে হোমের ওই শিশুগুলিকে
মেরে নদীর চরে পুতে রাখা হত।
বাইরে তাকান। আয়লার পর সুন্দরবনে এখনও ত্রাণ যায় নি। সরকার উলটে বাঁধ বানিয়ে
আয়লা জাতীয় ঝড়ের মোকাবিলার করতে গ্রামের মানুষের জমি দখল করছে। অন্যদিকে, ত্রাণ না পাওয়া পরিবারের মেয়েরা নিরন্ন সন্তান, ভাইবোন বা বাবা-মায়ের অনাহার সহ্য করতে না পেরে হারিয়ে
যাচ্ছে। একজন-দু-জন নয়, হাজারে
হাজারে। কেউ যদি বা ফেরে, তাঁদের
ফের যেতেই হয়, কেন না তাঁদের
পুনর্বাসনের ব্যবস্থা সরকার করে নি। আর, পরিবারও
পাছে লোকে কিছু বলের ছুতোয় খাবারের ভাগ বাঁচায়। তাই, খবরের কাগজের পাতায় নারী পাচারের জমজমাট কাহিনী পাওয়া যায়। সুন্দরবনের মতই
মালদা, মূর্শিদাবাদের, জলপাইগুড়ির মেয়েদের প্রতিদিন পাচার হওয়া এখন জলভাত। কোনও পাচার
হওয়া মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে শুনবেন রোজগারের তাগিদেই তাঁদের ঘর ছাড়ার কাহিনী। নিজেদের
জীবন বিপন্ন করেই তাঁরা যাচ্ছেন, কারণ
সরকার তাঁদের কাজের ব্যবস্থা করে দিতে ব্যর্থ। চায়ের বাগানে লাভের বদলে বাগান বন্ধ
করে লোভের খেলা খেলছেন মালিকেরা। বন্ধ বাগানের অশক্ত নারী-পুরুষ অনাহারে মরছে।
নয়তো, মৃত্যুর থেকে বাচতে অনিশ্চিতের
পথে যাওয়া। দুঃখের অবসান চেয়ে ‘অন্ধকার
গলির জীবনে আদিম পেশায় চলে যাওয়া। প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতায় ছাপে, ভিন রাজ্য থেকে উদ্ধার বাংলার ঘরের মেয়েদের কথা। তাতে
সরকারের লজ্জা পাওয়ার কি আছে?
শিক্ষিতদেরও কাজের সংস্থান নেই। পাস করে, পরীক্ষা দিয়েও চাকরি পেতে হলে ধরতে হয়য় শাসক দলের নেতাদের। তাতেও চান্স কম, মন্ত্রী-বিধায়ক-পুরপিতা-পঞ্চুদাদার আত্মীয় হলে সম্ভাবনা
আছে। টেট-এর টেটিয়া শিক্ষা এটাই। ফলে, ক্ষতিগ্রস্তদের
বাইরেও ক্ষুব্ধ যুবসমাজের অর্ধেক তো মেয়েরাই। ভোটের আগে মন ভোলাতে ফের টেট নেওয়ার
চেষ্টা আপাতত আদালতের নির্দেশে জলে। গত তিন বছরে রাজ্যে শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগটাই
প্রায় নেই, চাকরির সুযোগও নেই।
স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত মেয়েরাও তার শিকার।
রাজ্যের এক সাংসদ বলেন, “ভারতের সর্বত্র কালিয়াচকের লোক পাবেন। তাঁরা নির্মাণশ্রমিক।” লক্ষ লক্ষ যুবক এমন পেশায় কাজের তাগিদে রাজ্য ছেড়ে অন্য
রাজ্যে গিয়েছে। কারণ অভাব। তাঁরা রোজগারের তাগিদে অমানবিক উপায়ে জীবন কাটান। যাপন করেন
এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভাসমান শ্রমিকের যাযাবর জীবন। এঁদের একটা অংশ নারী শ্রমিক, তাদেরও জীবন ভাসমান। কারও সঙ্গে ঘর বাধার পর কিছুদিনের
মধ্যেই হয়তো দু-জনকে দুই প্রান্তে বদলী হতে হয়। এঁরা জাতীয় আয়ের বিরাট অংশ এনে
দিলেও এঁরা আসলে গৃহহীন। এভাবেই ঘর ছেড়ে গুজরাত, মহারাষ্ট্র, রাজস্থানে যাচ্ছেন হিরে কাঁটার, সোনার কাজের, জরির কাজের, সুতোকলের মজুর হয়ে যাওয়া গ্রামীণ বাঙালিরা।
স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান অরুন্ধতী ভট্টাচার্য ব্যাঙ্কের
মহিলা কর্মীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়িয়ে এক বছর করার প্রস্তাব দিয়েছেন। মূর্শিদাবাদের
মেয়ে বিড়ি শ্রমিক, মালদার ডোকরার মেয়ে
শ্রমিক, চা-বাগিচার মেয়ে শ্রমিক, গ্রামে গ্রামে মাঠে কাজ করেন যে মেয়ে শ্রমিকেরা, রাস্তা ও ভবন নির্মাণ শিল্পে যুক্ত মেয়ে শ্রমিকরা এক বছর
করে মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন? সরকার
কি দায় নেবে? তাঁদের দেহে পুষ্টি নেই, কারণ পুষ্টিকর খাওয়ার মত মজুরি তাঁরা পান না। তাদের
সন্তানরা রুগ্ন শিশু হয়ে জন্মান। সেই সব সদ্যোজাতদের নিয়ে যেতে হয় মালদায় বা
কলকাতায় বিধান শিশু হাসপাতাল, খবরের
কাগজে দৌলতে যেগুলি এখন সদ্যোজাতদের মৃত্যুর কেন্দ্র। সমাজের নিচের তলায় থাকা মায়েরাও
বুঝছেন, শাসক দলের প্রশ্রয়ে থাকা উপরের
লোকেরা খাবে নারকেলের জল আর শাঁস, নিচের লোকেদের
জন্য খোলাটা! যেমন, দলের কর্মীরা এখন বুঝছেন, সারা বছর খেটে দল করবেন তাঁরা, আর ভোটের সময় ক্ষির খাবেন বলিউড-টলিউঁডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।
ইদানিং না কি কাজের লোকের বড় অভাব। পরিচিতা এক পুরানো ঠিকে
কাজের ঝি জানালেন, কেরালায় ঠিকে কাজের
ঝিদের দৈনিক মজুরি প্রায় ২৫০ টাকা। সরকার বেঁধে দিয়েছে। কেউ কম দিলে, পুলিশে জানালে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা হয়। এটা শুরু করেছিল
প্রাক্তন বাম সরকার। কেরালায়ব সবাই শিক্ষিতা, তাই ঠিকে ঝি সাপ্লাই দিচ্ছে এই রাজ্য। মনে মনে ভাবি, এই রাজ্যে থেকে পোড়ারমুখীরা এক বাড়িতে কাজ করে মুখঝামটা ছাড়া মাসে পাবেন তো
৮০০ কি ১০০০ টাকা। কেন তাহলে ওখানে যাবে না ওঁরা?”
চোখের সামনেই আরেকটা সমাজ আছে, যাদের
পছন্দ করি বা না করি, অস্বীকার করতে পারি না।
এঁরা নিজেদের ‘এলজিবিটি’ বলে। আছেন হাজার হাজার যৌনকর্মীরাও। তাঁরা বিরাট কিছু চান না, চান সমাজের একজন হিসাবে সম্মান আর স্বীকৃতি। চান, বেঁচে থাকার সমান অধিকার।
পুরুষতন্ত্র সেই অধিকার দেবে না। দিতে পারে, নারীবাদই। সেটার জন্য ক্ষমতার আসনে নারীকেই বসতে হবে, তার কোনও অর্থ নেই। মার্গারেট থ্যাচার এইডস রোখার নামে
বৃটেনে এক নিয়ম চালু করেছিলেন। এশিয়ান কোনও মহিলা এয়ারপোর্টে নামলে তাঁকে বলা হত, “টেক অফ ইয়োর পেটিকোট। লেট আস সি ইউ আর ভার্গো ইনট্যাক্টা।” নিশ্চয় তাঁকে নারীবাদের প্রমাণ বলবেন না কেউ। ইন্দিরা
গান্ধী, সিরিমাভো বন্দরনায়েক, বেনজির ভুট্টো, খালেদা
জিয়ারা নারী হলেও তাই নারীবাদী নন। নারীবাদ অর্থ সৃজনশীলতা, সহভাগী হওয়া। পাড়ার পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করাটা, গাছ বাঁচানো, নদী
বাঁচানো, শ্রমের অধিকারের, মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় লড়াই করা তাই নারীবাদী কাজ। সেই
কাজ পুরুষ করলেও তা নারীবাদী কাজই।