সোমবার, ১ অক্টোবর, ২০১২

সম্পাদকীয় - ৬ষ্ঠ সংখ্যা


থিম আল্ট্রামর্টাল


বিগত তিন-চার দশকের কবিতা ছেঁড়াকাটা পেরিয়ে সমসাময়িক বাংলা ডায়াস এক মুক্তহরিৎফিল্ড। বৈচিত্রের কমা-পূর্ণচ্ছেদ-সেমিকোলনহীন একটা দুরন্ত সিস্টেম পাগল গায়কের মতো আঁচড়ে চলেছে অন্ধত্বকে - ম্যান্ডোলিনের সোহাগ টপকে গেছে লুনাটিক মতিভ্রম। এই অন্ধত্বের নাম প্যাশন -জুনুন -পাগল্‌পন্‌-ম্যাডনেস -ব্লাইন্ড দৌঁড় দৌঁড় দৌঁড়বাজ। প্রসার এর দিক দিয়ে মাধ্যমগুলি সান্দার অলিভ গালিচা পায়নি, দীর্ঘকালীন একরোখা মেলোডি এনেছে সফরে।

অনলাইন ক্ষেপচুরিয়াসের সাথে পরিচয় এর জন্মলগ্ন (২০১১ র সেপ্টেম্বর) থেকে। একের পর এক এর ক্রাস্ট-ট্রাফ গুলোয় ভেসেল-এ থেকেছি আমিও। ঝড়-ঝাপটা র প্রকারভেদ দেখেছি। ক্ষেপচুরিয়াসের সার্কুলেশন এই মুহূর্তে বিস্তর - এর অ্যাক্টিভ বডি গড়ে উঠেছে এবং উঠছে পিঠোপিঠি। পাগলদের এই অভয়ারণ্য এই পাগলাগারদে পাগলামোর মানে কিন্তু অসুস্থ আলাপচারিতা নয়,পাগলামো মানে এখানে 'ফ্রিডম অফ ক্রিয়েশন',একটি সৃষ্টি আসলে একটি চেন রিয়্যাকসান -সেই নির্ভীক ফ্লেক্সিবেল সৃষ্টির লাইসেন্স ক্ষেপচুরিয়াস। আমরা গড়ব-আমরা ভাবব-আমরা বলব এবং এগোব,এই এগোনোর অর্থ নতুনেরও আগে এগোনো -একটা অজানা ভবিষ্যতের স্পন্দন বুকে চেপে যাবতীয় হুলাল্লা। ভালো-খারাপ দিক সবকিছুরই থাকে, খারাপ দিক দেখবার অধিকার সকলের আছে ,তাই ক্ষেপচুরিয়াস ভালো র সাথে সাথে খারাপ কবিতার ও সাম্যাবস্থায় গতিশীল। এই গতিশীলতার একটা এক্সট্রিম পয়েন্ট থাকে,যেখানে পৌঁছে শূন্যের আনন্দ এবং ক্রমশ ত্যাগের মাধ্যমে স্টেবিলিটি অর্জন বোধগ্রস্ত হয়- হ্যাঁ আমরা কথা বলছি মৃত্যুর, ভালো-খারাপ নির্বিশেষে সকলের মৃত্যুর বা অস্থায়ীত্বের। দৌঁড়নোর এই এফেক্টিভ পর্যায় টুকুই অবদান রেখে যায়,অমর কেউ না,প্লাস্টিকের ফুল হয়তো চিরকালীন কিন্তু আমরা ভালোবাসি পাঁপড়ির মিষ্টত্ব –তার শুকিয়ে যাওয়া ও একটা বোধ – ফ্রয়েডীয় মায়ার সান্দ্র স্যাণ্ডউইচ কেটে এভাবেই আমাদের গতিশীল গতিশীলতা য় চড়াই-উতরাই। আমরা কেউ বিখ্যাত হতে আসি না –প্রকৃতির নিয়মে বা অনিয়মে হয়ে যাই ,একটা স্রোত তাই খুব মূল্যবান। ঘুরে-ফিরে একই কথার ভিড়ে আজকাল বেঁচে থাকা এক চ্যালেঞ্জ –অহরহ পালটে যাওয়া ফ্রেমকে আটকে রাখার গ্র্যাভিটিলেস প্রচেষ্টা এক উন্মাদনা – এই উন্মাদ ঝুঁকি প্রবণতাই অমল সঞ্জিবনী আবিষ্কার।
যেখানে চাঞ্চল্য নেই-খিদে নেই – চাহিদা নেই সেখানে জল জমে অ-বায়োবিক ক্রমান্বয়ে যা দূষিত এবং মহাদূষিত করে তোলে আবহ।

ক্ষেপচুরিয়াস এর পরিসর অহরহ সেই টার্বুলেন্সে বয়ে যাক এই আশাই রাখি।

মূলধনের ব্যাপারে আমার হয়তো বলা সাজে না ,তবুও একজন মেম্বার হিসেবে একটা দাবি রাখি, ক্ষেপচুরিয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের পরবর্তী ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সাহায্য দরকার হবে – তাই আমরা প্রতি মাসে যদি নির্দিষ্ট পরিমাণ রুপি (যতসামান্য ২০-২৫ রুপি) করে জমা করি নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট ফাণ্ডে তাহলে রেগুলার এগজিস্‌টেন্সে কোনো সমস্যা হবে না। কিভাবে কোথায় সেই ফান্ড হবে তা পরের ব্যাপার আগে আমাদের দেখতে হবে আমরা রাজি আছি কিনা,যে গ্রুপের সদস্য এতোজন তাদের যতসামান্য এই সাহায্যও ক্ষেপচুরিয়াস কে তুমুল গতিশীল রাখবে এবং ইউনিটির এ এক অনন্যোপায়। তাছাড়াও বহু সদস্যের পার্সোনাল কন্টাক্ট এবং স্পনশরশিপ বা পার্টনারশিপ কেও এখানে কাজে লাগানো যায়। নিজের কথা বললাম-এভাবেই একটি অ-বাজারী প্রাইভেট পত্রিকার উত্থান আমি কল্পনা করি! এটা শুধুই প্রস্তাব। ভিত্তিপ্রস্থর আপনাদের হাতে। আগামী পুজোর মধ্যেই আশা করি আমাদের প্রিন্টেড সংখ্যা আসছে। প্রুফ দেখা শেষ, টাইমের মধ্যে করে তলার চেষ্টা করা হচ্ছে।


ক্ষেপচুরিয়ানস্‌ সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে - ঋষি সৌরক

অমলেন্দু চন্দ

তোতাকাহিনী

মুনেস্বর ঝা তো আমায় ভর্তি করে দিলেন। মনে আছে তার দাপট, প্রিন্সিপ্যাল নিজেই আমার ফর্ম ভর্তি করতে আরম্ভ করলেন, আমি তখন অদুরে দাঁড়িয়ে নাম কা ওয়াস্তে একটা পরীক্ষা দিচ্ছি, মানে লিখতে পড়তে পারি তার প্রমাণ দিচ্ছি আর কি। কেলাস সিক্স। পাঁচ কেলাস আমার আর দেখা হয় নি কখনো। ওহ হ্যাঁ আরও মনে আছে এর মধ্যেই আমার জন্য দুটো সন্দেশ এসে গেছে, আর ঝা’জী আর মায়ের জন্য চা। বয়েস কম ছিল তাই জামাই আদর বলা যাবে না, তবে হ্যাঁ বকলমায় ইম্পরট্যান্স টা পেয়েছিলাম আর সে বয়েসে সেসব ভাবার তো কোন জায়েগা ছিল না ফলে নির্দ্বিধায় সন্দেশে কামড় দিতে দিতে লিখছিলাম। তো সেটা নাকি আমার স্মার্টনেসের নমুনা ছিল, স্বয়ং প্রিন্সিপ্যাল বলেছিলেন।

১৮৩৫ সালে ইংরেজ বাহাদুর – বিহার বাংলা উড়িষ্যা তখন এক প্রদেশ, সেই তখন ইংরেজ বাহাদুর ইংরেজির প্রচার আর প্রসারের জন্য – কেরানিকুল এর সাপ্লাই যাতে বজায় থাকে, তার জন্য যেটুকু ইংরেজি শেখা দরকার তার প্রসারে স্কুল চালাল। সময়ের নিরিখে আজকের বিহার প্রদেশের সবচাইতে পুরানো ইস্কুল, ১৮৬২ সালে আজকে যে বাড়িটায় স্কুল চলে সেখানে উঠে এল। বাড়িটায় সর্বাঙ্গে সেই ইউরোপীয় স্থাপত্যের ছাপ, অনেক এক্সটেন্সান হয়েছে সময়ের প্রয়োজনের নিরিখে, কিন্তু মুল বাড়িটার উঁচু উঁচু খিলান আর বিশাল থামগুলো গোটা বাড়িটার আর্কেড সামনের টানা ঝুল বারান্দা কে তুলে ধরে রেখেছে, দারুন মেজাজি।

১৯৪২ এর কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট এ তৎকালীন ইংরেজ বাহাদুরের আফিসের - যেখানে আজকের সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং – ওপরে পতাকা তুলতে গিয়ে এই স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র ঁসতীশ প্রসাদ ঝা গুলি খায়। আজকের সেক্রেটারিয়াট বিল্ডিং এর সামনে মার্টারস মেমরিয়াল সে স্মৃতি ধরে রাখবার একটা চেষ্টা, ১৯৫৬ সালে দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরীর তৈরি ব্রোঞ্জ এর স্কাল্পচার – সাত টা তরতাজা কিশোর গুলি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে একে অপরকে সাপটে ধরে দাঁড়িয়ে থাকবার প্রানপন চেষ্টায় একটা ঝাণ্ডা তুলে ধরে রাখতে চাইছে। ওই নামগুলোর বাইরে ওই ছেলেগুলোর ব্যাপারে আজ – নিঃস্পৃহ ইতিহাস।

জয় প্রকাশ নারায়ন এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন – সেটা বোধহয় ১৯১৭ – ১৮ এরকম সময়ের মধ্যে। সেই সব সময়ে হনার মানে Honour শব্দটার একটা ভিন্ন ঋদ্ধ অর্থ ছিল। জেপি পরে পাটনা কলেজ’এর ছাত্র থাকাকালীন গান্ধী’র নন কো অপারেসান মুভমেন্টে যোগ দ্যান – কিন্তু তখন তার মনে হয় – তার বায়ো গ্রাফির লেখকের ভাষায় যিনি তার অভিন্ন হৃদয় বন্ধুও ছিলেন – যে পাটনা কলেজ ইংরেজের পয়সায় চলে, সুতরাং স্কলারশিপ পাওয়া ছাত্র কলেজ ছেড়ে দ্যান আর একটি বিহার কংগ্রেস পরিচালিত বিহার ভিদ্যায়তন নামের ইন্সতিতিউসানএ গিয়ে ভর্তি হন। সেটি সদাকত আশ্রমের সৌজন্যে পরিচালিত একটি কলেজ ছিল। হনার এর এই সংজ্ঞা অনেকটাই হারিয়ে গেছে আজকের দিনে। পরে অবশ্য চৌরি চৌরার ঘটনার পর গান্ধী মুভমেন্ট প্রত্যাহার করে নেওয়ায় জেপি নাকি ডিসিলিউসন্ড হয়ে যান আর তারপর ইউ এস এ তে চলে যান ডিগ্রি আহরন করতে। তার সেই যাওয়াতে তার শ্বশুরের যথেষ্ট ভুমিকা ছিল।

সেই পাটনা –মনে আছে জেপি আন্দোলনের জেরে আমাদের সমস্ত পরীক্ষা টরীক্ষা প্রায় পনেরো মাসের মত পিছিয়ে যায়, সেসন গোলমাল, ঠিক হতে অনেক সময় লেগেছিল আমার ১৯৭৫ এর সেসন বা ব্যাচ ১৯৭৭ এ ইউনিভারসিটি তে পৌঁছেছিল। আমরা থাকতাম নওল কিশোর রোডে, মনে আছে এমারজেন্সি’র সময়ে – যেহেতু জে পি’র বাড়ি কাছাকাছি ছিল, গোটা এলাকাতে যখন বিশেষ পুলিস প্রহরা থাকত আর প্রচুর জিপ টিপ সারাদিন টহল দিত বুঝতাম জে পি পাটনাতে বাড়িতে রয়েছে জেলে নয়। তখন তো জিপ বলতে একমাত্র ক্যানভাস ঢাকা উইলিস জিপ, আর গাড়ি বলতে অ্যাম্ব্যাসাডর আর ফিয়েট। আর চোখে পড়ত প্রায় ছোটখাটো স্টিমার সাইজের ডজ গাড়ি, সে কি তার চাল।

গান্ধীর পরে জে পি’ই একমাত্র মাস লিডার যার ডাকে এক জায়গায় মিটিঙে মিছিলে যোগ দিতে দু লাখ লোক জড় হয়েছে। সে সময়ে তখন এমারজেন্সি’র পর ইলেক্সান ঘোষণা হয়েছে। তবে গান্ধীর কপালেও যা হয়েছিল, জে পি’র ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয় নি, পাওয়ার স্ট্রাগল’এর সুত্রে যাদের এক করেছিল তাদের নিজেদের মধ্যের পাওয়ার স্ট্রাগল এর সমাধান সেও করতে পারে নি, এও না।

আমাদের সেই পাড়ায় ছিল আর এক নামধন্য পরিবারের বাড়ি, বাচ্চা বাবু বলে আমরা জানতাম, জমিদার পরিবার, জাহাজের মালিক, এছাড়া আরও সব অনেক কিছুর ব্যাবসা, আর জমিদারি তো ছিলই। গঙ্গার একপাড়ে পাটনা কে ওপাড়ের সঙ্গে যোগ করার নিয়ারেস্ট ব্রিজ ছিল মোকামা, সে প্রায় পাটনা থেকে নব্বই কিলোমিটার কাছে, আর গঙ্গার ওপারে মুজফ্ফরপুর এর দুরত্ত্ব সত্তর কিলোমিটার, কিন্তু সেই সত্তর কিলোমিটার হয়ে যেত দেড়শ কিলোমিটারের বেশী, আর তাই গঙ্গা এপাড় ওপাড় করার বড় বড় লঞ্চ চলত, সে পারাপারের পাটনার দিকের ঘাটের নাম হয়ে গেছিল বাচ্চা বাবু কা ঘাট, কারন বাচ্চা বাবুদের স্টিমার চলত সারাদিন, এ পাড়ে গিলে ওপাড়ে ওগরাত সারাদিন, তারপর ওপাড়ে ট্রেন থাকত, বার কয়েক গেছিও। তারমধ্যে একটা তো ভীষণ মেমরেব্ল, কারন সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম খেলতে বাইরে যাওয়া, আমি নাইন টাইন এ পড়ি তখন।

বাচ্চাবাবুদের অবস্থা কিন্তু সেই জলসাঘরের বিস্বম্ভর রায়ের মত হয়নি, প্রজন্ম সময়ের সাথে বদলেছে, স্টিমার আজও চলে, তবে সারাদিনে বার কয়েক। বাচ্চাবাবুদের সেই দু আড়াই বিঘা জমির প্রাসাদ এখন মালটিস্টোরিড, কিন্তু সেই আমার দেখা ছেলেবেলার জাফরান গন্ধী একটু সময় একঝলক সেখানে আজও আটকে আছে – দুটো গাছ আর একটা মন্দির। একটা বট আর একটা অশ্বত্থ জড়াজড়ি করে এমন ভাবে বড় হয়েছিল, যে কান্ডে আলাদা করে চেনা যায় না কিন্তু পাতা একে অপরের মধ্যে মিশে আছে আর তার তলায় একটা শিব মন্দির। আমি সেই ছেলেবেলাতেও বড় গাছ দেখেছি, তার মানে গাছ পাথর নেই একরকম সে গাছের বয়েসের।

ছেলেবেলা – সবার ছেলেবেলাই তার কাছে এক অভ্রভেদী মালভূমি, শুধু তার বুনটের উপাদান একের থেকে অপরের আলাদা আলাদা। কারুর মালভূমি তার কাছে সেই তিব্বতের মালভুমির মত দুনিয়ার সবচাইতে উঁচু এক বিস্ময় যার সবটুকু সে নিজেও এক্সপ্লোর করে ফেলতে পারে নি, আবার কারুরটা যেন ভেনেজুএলা’র কুকেনান তেপুই – বৈচিত্র কম সৌন্দর্য অসাধারন। সেই নিয়মে আমার ছেলেবেলাও একটা বেশ মালভুমি টুমি তো বটেই, কিছু না হলে সেই ঘরের কাছের মাথেরান বা নিদেন পুরুলিয়ার লাল লাল টাঁড়। স্মৃতিচারণের সততা বজায় রাখলেও ছেলেবেলাকে অপছন্দ করা খুবই কঠিন, যদিও অনেকেই চেষ্টা করে অদ্ভুতভাবে তাতে কৃতকার্য হয়ে যান। আমি সেই সব ক্ষমতাধরদের মধ্যে পড়ি না। তবে এটাও সত্যি যে সবার ছেলেবেলা দীঘিদাঁড়ির পাড়ের বা গৌরনদীর ধারের পাতিঘাসের মতো নরম নধর চেহারার হয় না।

আসলে তখন দিনগুলো অন্য রকম ছিল মানুষগুলোও। এ দেশের ইতিহাসে করাপ্শন তো সত্তর’এর পরের দিকের থেকে শুরু হওয়া এক এপিডেমিক, তার আগে তো করাপশন নিয়ে কথা হলে উঠে আসত হরিদাস মুন্দ্রা’র নাম আর তার বেশি বলতে হলে খুঁজতে হত নামধাম আর করাপশন এর ইতিবৃত্য । আসলে পাব্লিক লাইফ’এ করাপশন ইন্সটিটুসনালাইস’ড হয়েছে গেল চার দশকে বেশিটাই আশি বা তার পরে। আজ তার ডালপালা বা মাটির নিচে শেকড়ের কোন সীমা পরিসীমা নেই। তাছাড়া বুকে হাত রেখে কি বলা যাবে আমরা কতটা আনকরাপ্ট রয়েছি?

হারিদাস মুন্ধ্রা’র স্ক্যাম ছিল মাত্র সোয়া কোটি টাকার । হাসি পেতে পারে আজ কারন টাকার পরিমাণ মাত্র যা বললাম তাই। অবশ্য ঊণীশশো সাতাণ্ণ’র নিরিখে সোয়া কোটি টাকার মূল্য খূব কম বলা যাবেনা তাহলেও কিন্তু সেই স্ক্যাম এর দিমেন্সিওন টা ছিল অনেক বড়। স্ক্যাম এর পেছনে মুল পেট্রন ছিলেন তৎকালীন ফাইন্যান্স মিনিস্টার টি টি কৃস্নমাচারি । তার অঙ্গুলিহেলনে সেই সময়ের Nationalized Public Sector Company - সদ্য সদ্য ন্যাস্নলাইজড হওয়া গভর্নমেন্ট প্রপারটি লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন হরিদাস মুন্ধ্রা’র কম্পানি’র শেয়ার কিনতে বাধ্য হয়েছিল – কম্পানি ডুবে যায় আর তাই পারলামেন্টে ফিরোজ গান্ধী’ রা প্রশ্ন তুললে তুমুল গোলমাল হয় কারণ ফিরোজ ততদিনে নেহেরু পরিবারের কাছে পাড়ীয়া’ড় মত হয়ে গেছেন। ফলশ্রুতিতে এম সী চাগলা কমিশন এর নিযুক্তি যার রিপোর্ট এর ভিত্তিতে হরিদাশে’র যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় কারণ রিপোর্ট প্রমাণ করে হরিদাশ এল আই সি কে ভুও শেয়ার বিক্রি করেছেন। টি টি কে পরে আবার ফাইন্যান্স মিনিস্টার হন উনিশশো চৌষট্টি সালে। সে সময় আই ডি বি আই, আই সি আই সি আই, শুরু হয় ।

তবে একেবারে যে আর কোন স্ক্যাম হয়নি এটা বলা ঠিক নয় । ঊণীশশো ষাঠে’র বিরাট বা তদনান্তিন সবচাইতে বড় ফাইন্যান্সিয়াল স্ক্যাম – তেজা লোন স্ক্যাম – বাইশ কোটি টাকার – জয়ন্তী ধরম দাস তেজা – জয়ন্তী শিপিং কম্পানির মালিক – ওই নামে কম্পানি শুরু করে আর বিভিন্ন ফাইন্যান্সিয়াল কম্পানির থেকে নেওয়া লোন এর থেকে বাইশ কোটি টাকার তছরুপ করে – তারপর ফাঁস হয়ে গেলে দেশ ছেড়ে পালায় । বলা হয়ে থাকে যে ধরম জয়ন্তী তেজা’র পেছনে নেহরু ‘র পেত্রনেজ ছিল । একটা ক্যাম্পের বক্তব্য নেহেরু তখন দেশ গড়ছেন আর তেজা’র স্বপ্ন স্কিম তার ভালো লেগেছিল, তার থেকে পেট্রনেজ। হতেই পারে । ঈটস নট এ ক্রাইম তো মেক মিস্টেক্স, বাট ইটস এ ক্রাইম টু ডিসিভ। তেজা’কে উনিশশো বাহাত্তরে মরিশাস থেকে ধরা হয় । ততদিনে নেহরু নেই ইন্দিরা’র ছবি মধ্যগগনে সবে ইস্ট পাকিস্তান যুদ্ধ শেষ হয়েছে । সুতরাং তেজা মরিল আর কেহ নহে।

করাপশন যেন এখন শামুকের পিঠের ঘরবাড়ির মতন – সারাক্ষণ চেপে আছে আমাদের ওপর কোন না কোন ভাবে, ভাবের কথা বলতে গেলেও অজান্তেই তাই সে খোলের নাকি শ্রীখোলের মধুর আওয়াজ বেরিয়েই আসে। তবে যৌবনের স্পর্ধা নেই আর, না আছে রাস্তায় নামার আগ্রহ, না রয়েছে পথ খোঁজার উন্মুখ ইচ্ছা। বরং চাঁদের আলোয় ত্রিজগৎ ঘুরে এসে ম্যাজিকওয়ালা সাজবার ইচ্ছেটাই বেশী, ম্যাজিক থাক আর নাই থাক। হ্যাঁ আর একটা বিচিত্র হাওয়া বুকের মধ্যে ঘোরাফেরা করে – সেই এক অনন্ত রাখালের মত যেন এক শেয়ালকাঁটার ঝোপে আটকে আছি, বায়ুভুক নিরালম্ব আত্মার মত লটকে আছি বঁইচি ঝোপে । বেশ এক মেরে আনা নিরুপদ্রব জীবনের আজ কাল পরশুর গল্পের মধ্যে হঠাৎ এক নিবু নিবু উনুন থেকে নামান কালি পড়ে পুড়ে যাওয়া ভুট্টায় লঙ্কা নুন মাখানর মতন স্বাদ নেওয়া। হ্যাঁ রোমন্থন। সে রোমন্থনের পরিধি তে আমি আছি আর আমাকে ঘিরে হয়ে ওঠা সেই সব সময় আর তাদের জাঙ্গাল।

বেশ কিছুদিন আগে এই সব অবস্থার জেরে একটা কবিতা লিখেছিলাম – দু চারজনকে শুনিয়েছিলাম, এক আধজন তো ভীষণ দারুন দারুন বলেছিল, তাতে একটা ব্যাপার খুব আশ্বস্ত করেছিল, আমরা সবাই এখনো বাঙ্গালিই আছি। কবিতাটা এইরকম ছিল -

উলুধ্বনি খই আর খঞ্জনি

খাটখানা কাঁধে নিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে গেল চারজন লোক

সঙ্গে গেল এক পাল কচি কাঁচা জোয়ান মানুষ

শ্মশানের দিকে,

বলো হরি হরি বোল –

লাশটাও কালা হয়ে যেতে পারে

এমন চীৎকার শুনে ঘাড় ফেরাতেই

বাতাসে ছিটকে এল একমুঠো খই আর

খুচরো পয়সা,

ইজের নেংটি আর ন্যাংটোর হুটোপুটি;

আস্টে পৃষ্টে দড়ি বাঁধা লাশটার নিশ্চিন্ত বিশ্বাস

এমন হরির নাম এমন হরির লুঠ,

স্বর্গ তো আনবেই - নাগালে!

আজকের সময় যেন সেই হেক্টরের মতই – অনেক সম্ভাবনা ছিল, গ্লোরি ছিল, উত্তরাধিকার বহন করে উত্তরাধিকার দিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু নিয়তির পরিহাস – আকিলিস নাকি বলেছিল তোমার মাংস হাড় আমি চিল শকুন দিয়ে খাওয়াব। আর হেক্টরের শেষ আকুতি ছিল নাকি তাকে যেন একটু সম্মান আর মাটিটুকু দেওয়া হয়। সম্ভাবনা কে নিয়তি দিয়ে ভাগ দিলে সেই শূন্য শুধু শূন্য থেকে যায়, চেষ্টা বদলে গুণ করলেও তাই। ওইটাই নিয়তি।


প্রলয় মুখার্জী




বাস্তবিক প্রেমের বিস্তর ফারাক !


১৫ এর প্রেম

সুদীপ স্যারের টিউশন মঞ্চে সেদিন তুই টাইটানিক। শাহরুখ-কে কিছুটা নকল করতে চাওয়ার প্রয়াসে বোধহয় একটু হেসেছিলি।জিন্স-টা তখনও আয়ত্তে আসেনে রে।সেই শূন্যস্থান পূরণ করতাম গাছে উঠে পিয়ারা ছিঁড়ে অথবা ঢিল ছুঁড়ে আম পেরে।সুরজিত তো এত কসরত করতনা।তবু বুঝিনা গোলাপের গ্রিটিংসটা ও কি করে পায়?? আমি বরাবরই নদী আঁকা গ্রীটিংস পেয়েই খুশি।



১৮ এর প্রেম

ডিও-ড্রেন-টা কিনেই ফেললাম রে।কিছুটা বাবার পকেট কেটে কিছুটা ছাতুর পয়সা বাঁচিয়ে।বলেছিলি না গায়ে বোকা-পাঁঠার মত গন্ধ
ছাড়ে?পরের দিন প্রায় সবটাই গায়ে ঢেলে এসেছিলাম ক্লাসে।পঙ্কজ-বাবু বলেছিলেন 'ইন্দ্র-দেবের পাঠা'।আর তুই?? নাকে রুমাল চেপে বসেছিলি!! একবারও তো বলতে পারতিস গোপাল কোন ডিও-ড্রেন
মাখে???



২১ এর প্রেম

প্রেসিডেন্সীতে রাত-দুপুর দাঁড়িয়ে আছি ভর্তির ফর্ম তোলার জন্য।খিদে পেয়েছিল খুব।ভাড়ার পয়সা বাঁচিয়ে দু গ্লাস আঁখের রস খেয়েছিলাম।ঘরে এসে দেখি তোর খাওয়া হয়ে গেছে।ফর্মটা হাতে দিয়ে দুটো বাতাসা আর এক গ্লাস জল খেয়ে বেড়িয়ে আসতে চেয়েছিলাম।তোর ডাকে আবার ফিরে আসি।আমার হাতে পাঁচশ টাকা গুঁজে বলেছিলি “শাড়ির দামটা মা দিল,বাট্ আমার ইচ্ছা ছিল রে নেওয়ার”..................

পরের দিন অনুষ্ঠানে সেই শাড়ি পড়েই লাইব্রেরী
এলি!!কেন জানি না রঙটা নীল ছিল না। বোধহয় পিতাভ হলুদ শাড়িটা সৌরভ দিয়েছিল.......


৩৯ এ প্রেম

ডিভোর্সের পেপারটা টেবিলের ওপরই রাখা আছে গত তিনদিন ধরে।তাতে মেঘার সইটা আজ বড়ো উজ্জ্বল লাগছে অন্যদিনের থেকে।সপ্তাহের বাকি দিন-গুলোয় কাজের মধ্যে সময়টা কি ভাবে যেন কেটে যায়।শুধু রবিবারের দুপরটা কিছুতেই কাটতে চাইছেনা।যদিও উঠোনের বুকে দুটি কোকিল ফড়িং ধরে চলছে অবিরাম।তবু ওর অনুপস্থিতিটা আজ পাখির আওয়াজেও জেগে উঠছে বার বার।

ভাল-লাগছিল না বনিবনা হীন সংসারটাকে জোর করে টিকিয়ে রাখতে।কখনও মনে হয় সব কিছু থেকে মুক্তি নিয়ে সম্পূর্ণ একলা হয়ে যাই কিছুটা বেহিসাবির সাথে। মাঝে মধ্যে অঙ্কে ভুল করা ভালো।অন্তত বে-হিসেবির কিছুটা সাধ আস্বাদন করা যায়। অবশেষে সুযোগটা তো এলো। অথচ এই একলা দিনে আজ মেঘাকেই অনেক বেশি করে মনে পড়ছে! তবে একলা হতেই বা চেয়েছিলাম কেন কে জানে??হয়ত এই না চেনার কৌতূহলটাই জীবনকে কালকের জন্য বাঁচিয়ে রাখে। হয়ত বা তাই............


ঘুঘুর অবিরাম চলাফেরায় উঠোনের খয়েরী রঙটা একটু একটু প্রাণ পাচ্ছে।মেঘা ঠিক এমনই, অনেকটা নিকানো উঠোনের মত। কখনও একসারি পিঁপড়ের সাথে কঠোর ভাবে শৃঙ্খলিত,কখনও পিয়ারা ফুলের মত নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে ঈশান কোণে।আবার, সকালের দিকটায় নিজেকে শালিকের কোলাহলে ব্যস্ত করে তোলে প্রতিদিন।অথচ দুপুরে ঘুঘুর ডানা ভর্তি ধোঁয়াশা ছন্দে বড়ো আপন করে নেয় নিজেকে।এই প্রান্তিক ছোঁয়া কিছুটা আমিও পেয়েছি।এমন দ্বন্দ্বের মাঝেই জীবনের উনচল্লিশটা বছর কোথা থেকে বয়ে গেছে কে জানে?? থাকার মধ্যে শুধু শুধুই একলা আছে এই নিরালা দুপুর খানি। আচ্ছা দুপুর কি সত্যি একলা হয়?? নাকি এই একাকীত্বের বোঝা জোর করে দুপুরের ঘাড়ে চাপাতে চাইছি?? জানিনা রাত-টা কি করবে??তবে মাঝে মাঝে এই ধরণের অনুভূতির প্রয়োজন আছে বোধহয়।আবার সেই প্রয়োজনের ঘরেই আশ্রয়!! মানে বেহিসাব আদপে একটা হিসেবই!! ঠিক অন্ধকার যেমন একটা শক্তি।


জানিনা আমার মত করে মেঘাও এই কথা গুলো ভাবছে কিনা??তবে ডিভোর্স পেপারটা আরও কিছুদিন টেবিলের ওপরেই থাকুক।নিশ্চয় আরও অনেকদিন থাকবে।ধীরে ধীরে পুরু আস্তরণ পড়ে যাবে ধুলোর।সব কিছু ঢেকে যাবে।শুধু ঢাকবেনা মেঘার উজ্জ্বল সই টা...............নিশ্চিত............




ষাট এ প্রেম

এই বেশ ভাল আছি। একাকী।আশ্রমের গাছপালা গুলো আমারই হাতে বড় হচ্ছে রোজ। বড় হচ্ছে আর এক চরম সত্যি একটু একটু করে। তফাত্টুকু গড়ে দিচ্ছে আরও একদিন বাঁচার ইচ্ছা।গাছ পালা গুলোও নিজের ইচ্ছায় বাঁচতে চায়।কিন্তু আমার হাতে কাঁচি আছে।বড় ডাল ছাঁটার।দুটি কচি ডাল একটু আমোদ করে বাড়তেও পারবেনা।উপর মহলের কড়া নির্দেশ, সুন্দরতা বজায় রাখুন। চোখের নান্দনিক কৃপায় প্রতিনিয়ত ক্ষত বিক্ষত হয় বাহারে ডাল গুলি।বুঝি, ভালোলাগাও কত দানবিক হতে পারে। সব সুন্দরতাই বুঝি কিছু ক্ষত বহন করে।যেমন তাজমহল করে চলেছে।

গোলাপের কুঁড়িগুলি ফোটেনে কেন? ইনজেকশন মারো।কে দেখছে গোলাপ বিশুদ্ধ কিনা?স্বতন্ত্র কিনা?আমরা তো সুন্দরের পূজারী।বেশি দাম দিয়ে সবচেয়ে লাল গোলাপটি কিনতে চাই।

কেমন যেন সুন্দর গুলোও ব্যবসা হচ্ছে নিয়ত।কাকাতুয়াকে নিজস্ব আওয়াজ ভুলিয়ে শেখানো হচ্ছে রামকৃষ্ণের বাণী।পাখির পালক গুলোও চাহিদার স্বীকার হচ্ছে।ভুল করেও গোলাপ বাগানে শিশির পড়বেনা।এর পর ঠিক হবে শিশির মুক্তোর মত জমবে না প্লাটিনামের মত??
আর ভাল লাগছেনা এই কাজ।যেখানে শান্তির চেয়ে নিয়মের প্রাধান্য বেশি সেখানে আমার মত বৃদ্ধ পাঁজরের প্রেম খোঁজা প্লাটিনামের শিশির স্পর্শের সামিল।এর থেকে পাতি কাক ঢের বেশি স্বাধীন।ওদের পালক গুলো ঝোড়ো হাওয়ায় ইচ্ছে মত উড়তে পারে।ভিজতে পারে প্রথম বৃষ্টিতে।শ্যাওলা ধরা দেওয়ালের কোণ থেকে খাবারও খুঁটে নিতে পারে অবলীলায়।ভাগ্যিস ওরা রঙিন নয়??ভাগ্যিস আমি সুন্দরী যুবতী নয়!!

আজ কাল ভোর বেলায় দেওয়ালের দিকে এক মনে চেয়ে থাকি।মাকড়সা গুলো কেমন সারিবদ্ধ সুন্দর।ওদের ছোট্ট কালো শরীর আর আটটা পা গভীর রাতে কালপুরুষের তারার মত লাগে।টিকটিকি গুলো যেন ধূমকেতু।বদ্ধ ছাদটা আকাশ।কালো কালো ঝুল গুনো ছায়াপথ থেকে নীহারিকার আমোদ রচনা করে চলে অবিরাম।পৃথিবী থেকে এক ছুট্টে মহাকাশে পারি।

পরপর দুটো সেরিব্রাল অ্যাটাকে ডানদিকটা প্যারালাইজড।মাস-খানেক হল বিছানাতেই শুয়ে।আশ্রমের কৃপায় ফ্রি-তে চিকিত্সা চলছে।তবু ভাল লাগছেনা একটুও।এখানকার দেওয়ালে টিকটিকিরা দৌড়ে বেড়ায় না।মাকড়সা জাল পাতে না।কেমন যেন ব্যবসায়িক ন্যাকা ন্যাকা সৌন্দর্যতা ছিটিয়ে আছে রক্ত আমাশার মত।আমায় আকাশ দেখতে হবেই।ভোরের আগেই কালপুরুষ দেখতে হবে।ছায়াপথেরা নীহারিকার বুকে ঘুরবে স্বাধীন ভাবে।পৃথিবী থাকুক তাদের প্লাটিনামই শিশির নিয়ে।

অনেক কষ্টে টেনে হিঁচড়ে শরীরটাকে টেনে আনলাম দশতলার ছাদে।কাছাকাছিই ছিলাম।শুধু দরজাটাই খুলতে একটু কষ্ট হয়েছে।

আহা এ কষ্ট সার্থক।প্রাণ খুলে আকাশ তো দেখছি।সত্যি কারের তারা দেখছি।এক ফালি চাঁদ ও ভয়ঙ্কর কাস্তে!!আশ্চর্য!নীহারিকা কোথায়??? আর ছায়াপথ??

ও-ইতো মাটির কাছাকাছি অন্ধকার।ওখানেই সত্যিকারের মহাকাশ আছে।সত্যি কারের ভালোবাসা আছে। এবার শরীরটাকে কাছে আনতে হবে।কিনারায় রাখতে হবে।অবশেষ শক্তিটুকু পাঁজরে সঞ্চিত।অন্তত দশতলার কিনারা থেকে গভীর ছায়াপথে ছুঁড়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

জুয়েল মাজহার

ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকার কবিতা ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াসের জন্য বিলাপ

ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াসের কবরে স্থাপত্য


মূল: ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকা
ভূমিকা ও অনুবাদ: জুয়েল মাজহার

ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াসের জন্য বিলাপ
(Llanto Por Ignacio Sanchez Mejias)

১. জখম ও মৃত্যু
(La Cogida y la Muerte)

ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা।
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা।
এনেছে ছেলেটা শাদা এক থান
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
রয়েছে সাজানো লেবুর ঝুড়ি একখানা
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
বাকিটা মৃত্যু এবং কেবলই মৃত্যু সে।

বাতাস উড়িয়ে নিয়েছে উল কার্পাসের
যখন ঘড়িতে বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
আর অক্সাইড-গুঁড়ো-ছিটানো
উড়লো কাচ আর নিকেল
ঘড়িতে যখন বাজলো বিকেল পাঁচটা।
লড়াইয়ে এখন মেতেছে ঘুঘু ও চিতাবাঘে
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
গুঁতোগুঁতি করে ঊরুতে একটি একাকী শিঙ
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
আর উদারায় বাজলো তার
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
বিষের ঘণ্টা বাজলো আর উঠলো ধোঁয়া
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
কোনায় কোনায় জমাট নীরবতা
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
আর এলো ওই তুঙ্গ-হৃদয় একাকী ষাঁড়!
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
বরফ তখন অতিরিক্ত ঝরালো ঘাম
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা,
ষাঁড়-লড়াইয়ের বৃত্ত যখন আয়োডিনে ছয়লাপ
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
জখমের ’পর মৃত্যু তার পাড়লো ডিম
বিকেল পাঁচটায়।
বিকেল পাঁচটায়।
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা ।

চাকায় বসানো শবাধার এক শয্যা তার
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
কানে বাজে ওই বাঁশি ও হাড়ের অনুরণন
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
এখন তার কপাল ফুঁড়ে হাম্বা হাম্বা ডাকছে ষাঁড়
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
সারা ঘর করে যাতনায় ঝিলমিল
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
পচা-ক্ষত এক আসছে এখন দূর থেকে
ঘড়িতে যখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
সবুজাভ ওই কুঁচকি ফুঁড়ে জাগে পদ্মের একটি শুঁড়
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
ক্ষতেরা যখন সূর্যের মতো জ্বলছে, আর
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
ঘড়িতে তখন বেজেছে বিকেল পাঁচটা।
আহা, নিদারুণ সেই বিকেলের পাঁচটা!
[সকল ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা!]
গাঢ় বিকেলের ছায়ায় তখন পাঁচটা!

২. ঝরে-পড়া রক্ত
(La Sangre Derramada)

আমি তা দেখবো না!

চাঁদকে বোলো, আসুক সে,
ইগনাসিওর রক্ত আমি
দেখতে চাই না বালির ’পর।

আমি তা দেখবো না!

হাঁ-খোলা চাঁদ।
অনড় মেঘমালার ঘোড়া, আর
উইলোর বেড়া-ঘেরা
স্বপ্নের ধুধু ষাঁড়-লড়াইয়ের বৃত্তটা।

আমি তা দেখবো না!

স্মৃতি আমার উঠুক জ্বলে!
অমল ধবল হাস্নুহেনায়
ছড়াক তার উষ্ণতা!

আমি তা দেখবো না!

আদি পৃথিবীর সেই গাভীটা
বালিতে গড়ানো লোহু-ভেজা সেই নাকে
বোলালো তার বিষাদমাখা জিভ,
আর যতো ষাঁড় গিসান্দোর
মৃত্যু তারা অংশত, পাথর তারা অংশত,
যেন তারা তুলছে ঢেঁকুর দু’শো বছর ধরে
এই দুনিয়ার চ’রে বেড়ানোর সুখে
না,
আমি তা দেখবো না!

নিজের মৃত্যু নিজের কাঁধে নিয়ে
ইগনাসিও উঠলো ধাপে ধাপে।
সে করেছে ভোরের সন্ধান
কিন্তু সে-ভোর পেল না খুঁজে আর।
খুঁজলো সে তার দীপ্ত মুখচ্ছবি
স্বপ্ন তাকে করলো বিহ্বল
খুঁজতে নিজের সুন্দর দেহখানি
নিজ রক্তের দেখলো সে উদ্গার।
বোলো না আমায় দেখতে একে আর!
ক্রম-নিস্তেজ ফিনকি সে-রক্তের
চাইনে আমি শুনতে বারবার:
আসনের ধাপ রক্ত-আলোয় হাসে
আর সে-লোহু ছিটকে গিয়ে পড়ে
তর-না-সওয়া হাজার লোকের
পোশাকে ও পাদুকায়।
চেঁচিয়ে কারা আমায় কাছে ডাকে!

বোলো না আমায় দেখতে একে আর !

দেখলো যখন আসছে ধেয়ে শিঙ
তখনো চোখে পড়েনি পলক তার,
সর্বনাশী মায়েরা তবুও সবে
তুললো তাদের মাথা।
আর গোপন স্বরের এক হাওয়া
উঠলো আর পেরলো খামার ষাঁড়ের,
রাখাল যতো হাল্কা কুয়াশার
চেঁচাল দিব্য-ষাঁড়কে লক্ষ্য করে।
ছিলো না এমন রাজার দুলাল কোনো
তুলনীয় তার হতে পারে সেভিয়ায়
তারটির মতো এমন তরবারি
এমন খাঁটি হৃদয় ছিলো না কোনো।
সিংহযুথের মতোন প্রবল ছিল
অবাক করা শৌর্যবীর্য তার,
মার্বেলে গড়া যেনবা ধড় এক
পরিমিত আর ছিল সুনির্ণিত।
আন্দালুসীয় রোমের গরিমা তার
মোহন শিরে করলো ঝলমল;
যেখানে মেধা ও সরস কৌতুকে
হাসিখানি তার হয়েছে সুরভিলতা ।
লড়াই-রিঙে কতো বড়ো মাতাদোর!
পাহাড়ি দেশের সুজন কৃষাণ এক!
কতো না দক্ষ ফসলের গোছা হাতে!
ঘোড়ার পিঠে কেমন অকুতোভয়!
শিশির-ছোঁয়ায় কেমন পরিস্নাত!
কতো ঝলমল আনন্দ উৎসব!
অন্ধকারের বান্দেরিয়া হাতে
কেমন মোহন রূপের বাহার তার!

অথচ এখন দিয়েছে সে কালঘুম।
ধ্রুব আঙুলে শ্যাওলা আর ঘাস
ফোটায় আজ তার করোটির ফুল।
গান গেয়ে তার রক্ত বেরিয়ে আসে;
গায় তৃণভূমি এবং জলার সাথে,
হিমায়িত শিঙে সে-গান গড়িয়ে নামে,
আত্মারা টলে সেই ঘন কুয়াশায়
হাজার খূরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে,
যেন দীঘল, কালো, বিষণ্ন জিভ,
বেদনার এক গড়েছে পুষ্করিণী
পাশে তারাভরা গুয়াদাল্কিভির;
আহা, স্পেনের ধবল প্রাচীরখানি!
আহা, বেদনার কালোবরণ ষাঁড়!
আহা রে, জমাট ইগনাসিওর খুন!
আহা রে, তার ধমনীর বুলবুল !
না।
আমি তা দেখবো না!

একে বুকে ধরে এমন পেয়ালা নেই,
একে পান করে এমন চাতক নেই,
আলোর তুহিন পারে না জুড়াতে একে,
কোনো গান কোনো শাদা লিলির বান,
কোনো কাচ নেই রক্তকে ঢাকে রুপোর আচ্ছাদনে।
না।
আমি তা দেখবো না!

৩. শুইয়ে রাখা শব
(Cuerpo Presente)

বাঁকাজল আর তুষারজমাট সাইপ্রেস তরুহীন
পাথর এক কপাল যাতে স্বপ্ন কেঁদে মরে।
সময় ব’য়ে নে’য়ার মতো পাথর এক কাঁধ
অশ্রু, রিবন, গ্রহে সাজানো গাছগাছালি ভরা।

দেখেছি ধূসর বৃষ্টিধারা ঢেউয়ের পানে ছোটে
চালুনিময় কোমল হাত ঊর্ধ্বে তুলে ধরে,
রক্ত শোষণ না ক’রে যারা এলিয়ে দেয় তাদের
সেই পাথরে হঠাৎ সে যেন না ধরা পড়ে।

যেহেতু পাথর কুড়ায় বীজ এবং মেঘমালা,
ছায়ার নেকড়ে, কংকালেরা তামাশা ক’রে যায়:
দেয় না শব্দ একটুখানি ফটিক, কিবা আগুন
দেয় শুধু রিঙ এবং রিঙ, ঘেরহীন ওই ষাঁড়-লড়াইয়ের রিঙ।

পাথরে এখন নিথর শুয়ে সুজাত ইগনাসিও
সবই তো শেষ! হচ্ছে কী! ওর মুখটি মনে আঁকো:
মৃত্যু এসে ঢেকেছে ওকে অগুরু গন্ধকে
কৃষ্ণ মিনোতারের মুণ্ডু বসিয়ে দিলো কাঁধে।

সবই তো শেষ। বৃষ্টি ওর মুখের ভেতর ঢোকে
চুপসানো ওর বুক ছেড়ে যায় হাওয়া যেন উন্মাদ,
আর বরফের অশ্রুভেজা প্রেম
দিচ্ছে ওম নিজেকে নিজে পালের অগ্রভাগে।

ওরা কী বলে? এসেছে নেমে আবিল নীরবতা।
শুইয়ে রাখা ক্রম-পাণ্ডুর শবকে ঘিরে আছি,
সেই নিরূপম তনুর গড়ন যেনবা পাপিয়ার
আর দেখি তা কতো না অতল গর্তে ভরে যায়।

কে করে ভাঁজ লাশের কাপড়? ওর কথা সব ঝুট!
গায় না কেউ এখানে গান, কাঁদে না ঘরের কোণে,
জুতোয় কেউ পরায় না নাল, দেখায় না ভয় সাপে।
চাইনে কিছু এখানে, শুধু পটলচেরা চোখে
দেখতে চাই ওর দেহটা কেবল নির্নিমেষে।

এখানে চাই দেখতে তাদের, যাদের কড়া গলা।
ঘোড়াকে যারা মানায় বশ, শাসন করে নদী;
শীর্ণ-পাঁজর যাদের গলা গানের সুরে মাতে
তাদের মুখ আগুনে পাথর, সূর্য দিয়ে ভরা।

এই পাথরের সামনে, আমি দেখতে চাই তাদের
ছিন্ন-লাগাম এই দেহের, এরই সম্মুখে ।
মরণে বাঁধা এই সেনানী, তার মুক্তির পথ
বাৎলে দিক তারা আমায় এখন, এইবেলা।

চাই তারা দেখাক আমায় নদীর মতো শোক
থাকবে যার গভীর তট, মধুর কুজ্ঝটি,
না শুনে আজ এসব ষাঁড়ের দ্বিগুণ ঘড়্‌ঘড়্‌
ইগনাসিওর লাশ ব’য়ে নিতে
যেখানে সে ফানা হবে।

নিজেকে হারাবে চাঁদের গোল ষাঁড়-লড়াইয়ের রিঙে
যে চাঁদ তার তরুণ-দিনে শান্ত-দুঃখী ষাঁড়ের ভাব করে,
মাছের গান-রিক্ত-রাতে হারায় নিজেকেই
আর জমাট ধোঁয়ার শাদা ঝোঁপের ওই আড়ে।

চাইনে আমি মুখটি ওর রুমালে ঢেকে দিতে
যেন যে-মরণ ব’য়ে সে বেড়ায়, মানিয়ে নিতে পারে।
ইগনাসিও! রেখো না মনে এসব কিছু, এসব হাম্বারব
যাও গে ঘুমোও, ওড়ো, জিরোও; সাগরও তো যায় মরে!

৪. গরহাজির আত্মা
(Alma Absente)

তোমাকে ষাঁড় চেনে না, ওই ডুমুরগাছও না,
নয় ঘোড়ারা, তোমার ওই বাড়ির পিঁপড়েরাও।
শিশুটি আর ওই যে বিকেল তোমায় চেনে না
কেননা তুমি গিয়েছ মরে চিরকালের তরে।

ওই পাথরের শক্ত কাঁধ তোমায় চেনে না
কালো রেশম, যেখানে তুমি বন্দি হ’য়ে আছো।
তোমার স্মৃতি নীরব, সে-ও তোমাকে চেনে না
কেননা তুমি গিয়েছ মরে চিরদিনের তরে।

আসবে শরৎ ছোট্ট শাদা শামুক সাথে নিয়ে,
তুষারে ভেজা আঙুর আর পাহাড়শ্রেণী নিয়ে,
কেউ তবুও রাখবে না তো তোমার চোখে চোখ
কেননা তুমি গিয়েছ মরে চিরকালের তরে।

যেহেতু তুমি গিয়েছ মরে চিরকালের তরে,
তাদেরই মতো এই দুনিয়ার গিয়েছে যারা মরে,
সেসব মৃতের মতো যারা মরা কুকুরদের
ভাগাড়ে লীন হওয়ার মতো হয়েছে বিস্মৃত।

তোমায় কেউ চেনে না। না, তবুও আমি গাই
তোমার তনুর রূপ-সুষমা ভাবীকালের তরে।
পরিণত তোমার মনের স্তব করে যাই গানে।
তোমার ওই মরণ-তিয়াস, তোমার মুখের স্বাদ
ছিলো যে-বিষাদ লুকিয়ে তোমার মুখর উল্লাসে।

এমন খাঁটি আন্দালুসি দুঃসাহসে ভরা
ফের যদিবা জন্ম নেয় তা-ও বহু যুগ পর
গুমরে-মরা কথায় আমি তার যশোগান করি
আর এসব জলপাইগাছ, ওদের ভেতর দিয়ে
বয়ে চলা করুণ হাওয়া স্মরণ করি আমি

(A . L. Lloyd-এর ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে)


ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকা
Federico García Lorca
(৫/৬/১৮৯৮ — ১৯/৮/১৯৩৬)



ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকা চরিত
গ্রানাদা জন্ম দিয়েছে বিশ্ববিশ্রুত অনেক কবি-লেখকের। কিন্তু জনপ্রিয়তা, খ্যাতি আর প্রভাবের বিচারে ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকার সঙ্গে কারোরই তুলনা চলে না। জীবৎকালেই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি। আর মৃত্যুর পর তার খ্যাতি স্বদেশ স্পেনের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সপ্তসিন্ধু দশদিগন্তে। সবচে’ বেশি সংখ্যক বিদেশি ভাষায় অনূদিত হিস্পানি ভাষার এই কবি-নাট্যকারের ভক্তের সংখ্যা উত্তরকালে কেবলই বেড়েছে। অন্যভাবে বললে স্পেনে ও স্পেনের বাইরে, আবিশ্ব নিখিলে, গার্থিয়া লোরকা আজ এক জাদুনাম।

লোরকার জন্ম ১৮৯৮ খিস্টাব্দের ৫ জুন, গ্রানাদা থেকে মাইল কয়েক দূরে গেনিল নদীতীরবর্তী ফেন্তে ভাকেরোস (Fuente Vaqueros) নামের এক ছোট্ট গ্রামে। জায়গাটা গ্রানাদার বিস্তীর্ণ উর্বর ভেগা অঞ্চলের ঠিক কেন্দ্রস্থলে। গ্রাম ঘিরে আছে নিবিড় পপলারকুঞ্জ। লোরকার বাবা দন ফেদেরিকো গার্থিয়া রদ্রিগেস (Don Federico Garcia Rodriguez) ছিলেন সে গ্রামেরই এক সম্পন্ন কৃষক। আর মা দোনা ভিসেন্তা লোরকা রোমিয়েরো (Dona Vicenta Lorca Romero) ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। লোরকার জীবনের প্রথম ১১টি বছর কাটে এই ভেগা অঞ্চলে — জলপাইবন আর সঘন পপলারকুঞ্জ, সদা কলস্বরা স্রোতোস্বিনী, পাহাড়, উপত্যকা আর তৃণভূমিঘেরা মায়াবী গ্রামীণ নিসর্গের কোলে। নিজের চাষাভুষোমার্কা চেহারাটাও তার সেখান থেকেই পাওয়া — রসিকতা করে প্রায়ই বলতেন লোরকা।

১৯০৯ সালে লোরকার পরিবার তার পড়াশুনার জন্য পাড়ি জমায় গ্রানাদা শহরে। নিউইয়র্কে আট মাস, কিউবাতে তিন মাস (১৯২৯-৩০) আর বুয়েনোস আইরিসে পাঁচ মাস (১৯৩৩-৩৪) — এই সময়টুকু বাদ দিলে লোরকার ঝোড়ো আর স্বপ্লায়ু জীবনের পুরোটাই কেটেছে মাদ্রিদ আর গ্রানাদায়। ১৯৩৬ সালের জুলাইতে, স্পেনে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার ঠিক আগে, বন্ধুদের নিষেধ উপেক্ষা করে লোরকা ফিরে যান গ্রানাদায়। আর তার এক মাস পরেই ১৯ আগস্ট স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রাঙ্কোর খুনে ফালাঙ্গিস্ত (Falangist) বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে প্রাণ দেন। ঐতিহ্যবাহী যে-প্রিয় মুরিশ শহরে বেড়ে উঠেছিলেন লোরকা, যে শহর বারবার ঝিল্‌কে উঠেছে তার কবিতা ও নাটকে, সেই গ্রানাদারই অনতিদূরে ঘাতকের বুলেটে অকালে লুটিয়ে পড়েছে তার তরুণ মেধাবী প্রাণ।

বলা বাহুল্য, প্রাগ্রসর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীই কাল হলো লোরকার। এ নিয়ে কোনো রাখঢাক ছিলো না তার। আর সেটাই ক্ষেপিয়ে তোলে উগ্র ডানপন্থিদের। তারা তাকে দুষমণ হিসেবে চিহ্নিত করে। গ্রানাদার উত্তর-পুবের আল্‌ফাকার (Alfaqar) নামের পাহাড়ঘেরা স্থানে একটি জলপাইগাছের নিচে গুলি করে মারা হয় ৩৮ বছর বয়সী লোরকাকে। আজও সেই জলপাইতরু ঠায় দাঁড়িয়ে। অবশ্য সেটি এখন ‘লোরকা স্মৃতিউদ্যান’-এর ভেতর দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সেখানটায় আরও তিন হতভাগার সঙ্গে সমাহিত করা হয় তাকে। ওদের একজন স্কুল শিক্ষক, বাকি দু’জন মাতাদোর (ষাঁড়-লড়িয়ে )।

রাফায়েল আলবের্তি ও মারিয়া তেরেসার সঙ্গে লোরকা, ১৯৩৪


তার কালের মহান ফ্লামেঙ্কো (Flamenco) গায়ক হুয়ান ব্রেভা’র (Juan Breva) প্রশস্তি করে একটা কবিতা লিখেছিলেন লোরকা। সে কবিতারই কয়েকটি চরণ হতে পারতো সদা-হাসিমাখা-মুখের-কবি লোরকার নিজেরই এফিটাফ :
`…Era la misma
pena cantando
detrás de una sonrisa.’

উপরের তিনটি চরণের ইংরেজি ভাষান্তর হাতের কাছে নেই। স্প্যানিশ ভাষায় আমার হাঁটুভাঙা যেটুকু জ্ঞান তাতে বাংলা করলে অনেকটা এরকম দাঁড়ায় (?):
‘নিজের অসহ যাতনা
ছিলো সে নিজে
হাসিতে তা ঢেকে গেয়ে গেছে নিজ গান’

বহু সংস্কৃতির ঐকতান-ধ্বনিত গ্রানাদা, বহু শতাব্দীর বিস্ময়-খচিত গ্রানাদা এমন এক উন্মুক্ত স্বর্গের নাম একদা যাতে এসে মিশেছিল নানা জাতির রক্ত আর মেধা, পশ্চিম ভূমধ্যসাগরের ঢেউয়ের কলতান আর নিকটপ্রাচ্যের বহুবর্ণিলতা, গ্রিক, আরব আর রোমানদের নানা গরিমা আর জিপসিদের অনিকেতবৃত্তি। এসব কিছুকেই সাঙ্গীকৃত করে এগিয়েছেন লোরকা। আন্দালুসিয়ার লোক-ঐতিহ্যের উদ্দীপক ইডিয়ম আর মেটাফরকে তিনি খুঁজে ফিরেছেন তার কবিতায় নাটকে। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার এমন সংরাগদীপ্ত মেলবন্ধন স্পেনের আর কোনো কবির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজো, তার মৃত্যুর এতোকাল পরেও, স্পেনের মানুষ লোরকার কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেদের চেনাতে ভালোবাসে। সম্ভবত আধুনিক কালে তিনিই একমাত্র কবি যার কবিতাকে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত আর অশিক্ষিত সবাই ভালোবাসে;`…a poet whose worth is loved and acclaimed by the illiterate and the sophisticated alike.’ এ সত্ত্বেও লোরকা ছিলেন আধুনিক কালের সবচে’ জটিল কবিদের একজন। কেননা ব্যক্তিগত কাব্যভাষা ও ইডিয়ম তৈরির জন্য ক্রম অপসৃয়মান এক লোকজীবনের ভাবাবেগের সঙ্গে ক্রম আগ্রাসী, ক্রম জটিল আর শিল্পায়িত এক পৃথিবীর মূল্যবোধের মেলবন্ধন ঘটাবার প্রায়-অসম্ভব কাজে হাত দিতে হয়েছিল তাকে। কবিতার টেকনিক আর উপাদানের জন্য সমসাময়িকদের দিকে যেমন, তেমনি তিনি অকুণ্ঠিতভাবে হাত বাড়িয়েছেন মধ্যযুগের আরব কবিদের দিকে, গ্রিক-রোমান কাব্যের অতীত ঐতিহ্যের দিকে, পুরাণ-উপকথার দিকে ।

প্রেম, ভাবাবেগ আর সহিংস মৃত্যু — সর্বদাই এ তিনটি তার কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। সবকিছু ছাপিয়ে বারংবার নিজের মৃত্যুর প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তার কবিতা ও নাটকে। এমনকি লঘু রচনায়ও তার দেখা মেলে। তার নিতান্তই হাল্কারসের একটি লেখা শেষ হয়েছে মৃত্যুর অনুষঙ্গ দিয়ে: “Take me by the hands, my love, / for I come quite badly wounded / Dying of love!’’

লোরকার চোখে মৃত্যু এক নীরব আগন্তুক, সর্বদা মুখোশ-পরে-থাকা মনোলিথিক এক শক্তি, যে বিনা বাধায় জীবনের টুঁটি টিপে ধরে মেতে ওঠে অনিবার উল্লাসে। তার তীব্র নখরে বন্দি জীবনের ত্রস্ত বুলবুল:“…Three thousand men came armed with shining knives to assasinate the nightingale.’’

এ রকম অসংখ্য ভয় জাগানিয়া, রোমহর্ষক চিত্রকল্প ছড়িয়ে আছে তার কবিতায় কবিতায়। ‘নিউ ইয়র্কে কবি’ (Poeta en Nueva York) নামের কবিতায় এভাবেই নিজের মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেন লোরকা:
“ ..I sensed that they had murdered me.
They swept through cafes, graveyards, churches,
They opened the wine-casks and the closets,
They ravaged three skeletons to yank the gold teeth out.
But they never found me.
They never found me?
No, they never found me.’’

(Edwin Honig-এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত)

লোরকা হয়তো ফালাঙ্গিস্তদের দিক থেকে নিজের ঘনায়মান বিপদ আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ডানপন্থি এক বন্ধুর কাছে। তবু শেষরক্ষা হয়নি। বন্ধুটির অনুপস্থিতির সুযোগে খুনে ব্ল্যাক গার্ড বাহিনীর লোকেরা সিভিল গভর্নমেন্ট বিল্ডিংয়ে তার বন্ধুর বাসা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। তার পরের ঘটনা সবার জানা। বিনা বিচারে পরদিন ভোরে গুলি করে মারা হয় স্পেনের সর্বকালের সেরা কবিরত্নটিকে। এক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, খুন করার আগে লোরকাকে তার নিজের কবর খুঁড়তে বাধ্য করে ওরা।

‘‘ওর (লোরকার) পায়ুপথে দু’দুটো গুলি ছুড়েছিলাম আমি…’’ — খুনিদের একজন পরে গর্ব করে বলেছিলো।

এমনই নৃশংস, বীভৎস সে মৃত্যু! খুন করার আগে লোরকাকে দিয়ে একটি চিরকুট লিখিয়ে নিয়ে বাহকের মাধ্যমে তা পাঠানো হয় তার বাবার কাছে। সেই চিরকুটে লোরকা লিখেছিলেন: ‘প্লিজ বাবা, এই লোকের হাতে আর্মির জন্য চাঁদা হিসেবে ১০০০ পেসেতা দিয়ে দিও।’’

তার বাবা দন ফেদেরিকো অশুভ সেই চিরকুট নিজের ওয়ালেটে বাকি জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। জনকের কাছে পুত্রের লাশের চেয়ে কম ভারি ছিলো না তা।

লোরকার মা দোনা ভিসেন্তা ছিলেন সুশিক্ষিত, সাহিত্য-সঙ্গীতের সমঝদার, কল্পনাপ্রতিভাধর এক নারী। ছেলে লোরকাকে সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন তিনি। মায়ের যাবতীয় সদগুণ জন্মদাগের মতো সঙ্গী হয়েছিলো লোরকার। শৈশবে অসুস্থতা ছিলো নিত্যসঙ্গী। চার বছর বয়স পর্যন্ত হাঁটার ক্ষমতা ছিলো না। পরে হাঁটতে শিখলেন বটে, তা-ও আবার খুঁড়িয়ে। খেলাধুলা করার মতো শারীরিক সামর্থ্য ছিলো না বলে মেতে থাকতেন অন্যসব শিশুতোষ আনন্দে, নতুন নতুন উদ্ভাবনের নেশায়। দু’বছর বয়সেই আধো আধো গলায় গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দিতেন আশপাশের সবাইকে। তিন বছরে পা দিতে না দিতেই কল্পিত চার্চ মাস (Imaginary Church Mass)-এর আদলে মিনিয়েচার থিয়েটার সাজানো ছিলো শিশু লোরকার প্রিয় খেলাগুলোর একটি। বাড়ির পাশের গির্জার পাদ্রীকে নকল করে চলতো ‘খুৎবা পাঠ’ (Sermon)। আর সেটা এমনই উপভোগ্য হতো যে পাড়াসুদ্ধু লোক শুনতো নরম-নীরব হয়ে। তবে ফেদেরিকো নামের ছোট্ট সে পাদ্রী আগেভাগেই শর্ত দিয়ে রাখতো, ‘খুৎবা’ শুনে সবাইকে কাঁদতে হবে। অন্যরা কান্নার অভিনয় করলেও, গৃহকর্মীদের একজন সত্যি সত্যিই কাঁদতো। সে কান্না সহজে থামতো না। এমনই অভিনয়প্রতিভা ছিলো লোরকার।

ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলেন না। তবে তার সঙ্গীতপ্রতিভা বোদ্ধাদেরও প্রশংসা কুড়ায়। পিয়ানো আর গিটার বাদনে তার পারদর্শিতা ছিলো ঈর্ষণীয়। পিয়ানোতে বেটোফেনের (Bethoven) সোনাটা বাজিয়ে সেন্ত্রো র্আতিস্তিকো দ্য গ্রানাদার তৎকালীন প্রধান ফার্নান্দো দ্য লস রিয়োসকে পর্যন্ত তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। রিয়োসের ভাষায়, লোরকা এক অসাধারণ সঙ্গীতপ্রতিভা (Extraordinary Musical Talent)। বলা বাহুল্য লোরকার কবিতার সাঙ্গীতিক বৈশিষ্ট্য ও গীতলতার পেছনে তার এই সঙ্গীতপ্রেমের ভূমিকা অনেক।

উচ্চশিক্ষার জন্য লোরকা প্রথমে গ্রানাদা, পরে ভর্তি হন মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

লোরকার বন্ধুবৃত্তটা ছিলো অনেক তারায় ভরা। কে না ছিলেন সেখানে! কবিতা, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নাটক থেকে শুরু করে বুলফাইটের দুনিয়া-মশহুর নায়কেরা ছিলেন তার বন্ধু। চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি, চলচ্চিত্রনির্মাতা লুই বুনুয়েল, কবি পাবলো নেরুদা, রাফায়েল আলবের্তি, হোর্হে গিয়্যেন, হুয়ান রামোন হিমেনেথ, পেদ্রো সালিনাস, দামাসো আলোনসো, লুইস সেরনুদা, বুলফাইটার-কবি-নাট্যকার ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াস — কতো কতো প্রোজ্জ্বল নাম!

সালভাদর দালির সঙ্গে তার ঘটনাবহুল বন্ধুত্ব নানা কারণে আলোচিত। দালি-লোরকার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ১৯২৩ সালে। দালির প্রখর ব্যক্তিত্ব আর সুন্দর চেহারা দুটোরই প্রেমে পড়েছিলেন লোরকা। আর লোরকাও গভীরভাবে আলোড়িত করেছিলেন দালিকে। কিন্তু সে বন্ধুতায়ও ফাটল ধরলো যখন কিনা দালি আর বুনুয়েল মিলে নির্মাণ করলেন স্পল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র Un Chien Andalou (১৯২৮)। লোরকার ধারণা, তাকে নিয়েই বানানো হয়েছে এ ছবি। সমকামিতার প্রসঙ্গ ছিলো তাতে। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, দালির সঙ্গে তার বন্ধুত্বের প্রেরণায় আধুনিক শিল্পকলা ও সমকামিতার সাফাই গেয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন লোরকা। এছাড়া সমকামিতাকে উপজীব্য করে নাটকও লিখেছিলেন যা ছিলো তার সময়ে এক বিরাট ট্যাবু।


দালি ও লোরকা

ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিক থেকে দালি-লোরকা যেমন ছিলেন মানিকজোড়, তেমনি শিল্পের সাধনায়ও ছিলেন যুগলবন্দি। সুবাদে কবিতা, নাটক আর চিত্রকলা হয়ে উঠেছিল একটি অন্যটির পরিপূরক।

দালি তার আত্মজীবনী Secret Life-এ লোরকার প্রশস্তি গেয়েছেন:
“The poetic phenomenon in its entirety and `in the raw’ presented itself before me suddenly in flesh and bone, confused, blood-red, viscious and sublime, quivering with a thousand fires of darkness and subterranean biology, like all matter endowed with originality of its own.’’

আর ‘Oda a Salvador Dali’ ( Ode to Salvador Dali) কবিতায় লোরকা লেখেন:
“O,Salvador Dali, voice steeped in olives!
I speak of what your person and your art tell me .
I praise not your imperfect adolescent brush,
but sing in the firm direction of your arrows.

I sing your handsome energy full of light.
Your love of what has a possible explanation.’’

(Edwin Honig-এর ইংরেজি অনুবাদ )




‘‘ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াসের মৃত্যু’’ প্রসঙ্গে
ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াস লোরকার প্রিয় বন্ধুদের একজন। ছিলেন একাধারে সুদক্ষ মাতাদোর (ষাঁড়-লড়িয়ে), কবি ও নাট্যকার। পরাবাস্তব ……
ইগনাসিও সানচেস মেহিয়াস (৬/৬/১৮৯১ — ১৩/৮/১৯৩৪)
……
একটি নাটকও আছে তার। মাতাদোর হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে তখন গোটা স্পেনে। অবশ্য মাঝপথে ষাঁড়-লড়াইয়ে বেশ কিছুদিন ক্ষান্ত দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অন্যসব সৃষ্টির নেশায়। পরে আবার রক্তের টানে ফিরতে চেয়েছিলেন রিংয়ে। আর সেটাই শেষ। ষাঁড়-মানুষের লড়াইয়ে এ যাত্রা জয়ী হয় ষাঁড়।

রিংয়ে প্রিয় বন্ধু ইগনাসিও মেহিয়াসের মৃত্যু তীব্রভাবে নাড়া দেয় লোরকাকে। বন্ধুর মৃত্যুকে উপজীব্য করে লোরকা ১৯৩৫ সালে যে দীর্ঘ কবিতাটি রচনা করেন অনেক সমালোচকের চোখে তা লোরকার সর্বোত্তম কবিতা। হিস্পানি ভাষার শ্রেষ্ঠ ৪টি শোকগাথার একটি হিসেবেও গণ্য করা হয় একে। কবিতাটি ৪টি ভাগে বিভক্ত। তবে এদের আলাদা আলাদা মোটিফগুলো আবার একসূত্রে গ্রথিত। এ কবিতায় নিজের প্রথম দিককার কবিতার গীতলতার সঙ্গে ব্যালাডের বর্ণনাত্মক রীতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন লোরকা। সেই সঙ্গে ট্রাজেডির গভীর আবহ সৃষ্টির জন্য তাতে যোগ করেছেন জিপসি বিলাপগাথার রিদম, ব্যবহার করেছেন নাট্য আঙ্গিক আর লোকগাথার উপাদান।

‘‘ত্রাদিত্তোরে ত্রাদুত্তুরে’’ — অনুবাদক বিশ্বাসঘাতক। এই বদনাম মাথায় নিয়েও ‘তোমাকে শিকার করে ফিরি যেন, যদ্যপি না পাই’ — ভিন্ন ভাষার মধুরতাকে আপন ভাষায় শিকার করার নাছোড়, দুর্মর চেষ্টাটি সতত চলমান। যেহেতু ‘অনুবাদ আসলে একটা চমৎকার ছল, নিজেকে আবিষ্কার করার বিনীত উপায়’ — যেমনটি বলেছেন শক্তিমান দুই কবি-অনুবাদক শঙ্খ ঘোষ আর অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। তবে একথা মানছি, নিতান্ত আবেগ-সম্বল আমার মতো অক্ষম, বেলায়েক অনুবাদকের ‘স্থানে স্থানে প্রকাশিত নিজ মন উক্তি’ প্রায়শই মূল রচনার বারোটা বাজায়। বিশ্বাসহন্তাই শুধু নয়, বোধ করি অনুবাদক কখনো কখনো হয়ে ওঠে আততায়ী।

আবার অনুবাদ যদি রসোত্তীর্ণও হয় তবুও কি সবার মনপসন্দ হয় তা? মূলের আত্মা কি ধরা দেয় অপর ভাষায়? বিশেষত কবিতায়? দুটি ভাষার তীব্র চুম্বনের মাঝখানেও কি থেকে যায় না অদৃশ্য কাচের দেয়াল?

উল্টো পিঠেও কথা থাকে, এ ব্যবধানও ঘুচিয়ে দিতে পারেন কেউ কেউ, কঠিন নির্মোক ভেঙে এনে দেন মণি ও মুকুতা। করাঙ্গুলিগণনীয় তারা। আমার সময়ে, আমার প্রজন্মের কারো কারো মধ্যেও পেয়ে যাই এমন প্রায়-অলৌকিক গুণপনা। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ নামের একজন আছেন; মিদাসের স্পর্শ নিয়ে হস্ত তার সতত ফলিয়ে যাচ্ছে সোনা। ওর অনুবাদে কোলরিজের ‘কুবলা খান’ বারবার পড়ি। অবাক হয়ে ভাবি, কী করে ‘সারাক্ষণ কলস্বর রণিত আবেশে!’ আমারও উড়িবার হয় সাধ। আমা হেন তাঁতীরও ফার্সি পড়বার খায়েশ জাগে।

লোরকার এ দীর্ঘ ব্যঞ্জনামধুর, বিয়োগবেদনাদীপ্ত অসামান্য কবিতাটি অনুবাদ করতে গেছি ক্ষমতা নয়, শুধু প্রেম সম্বল করে। তাতে বালখিল্যতা আছে, আছে ভাবাবেগ আর নিজেকে পরখ, আবিষ্কার করে নেয়ার চেষ্টা। কবিতাটির আভা ও গরিমা বাংলায় আমার করা অনুবাদে কতোটা ধরা পড়েছে সে বিচার সংবেদী পাঠকের। অনুবাদকর্মটির (কাণ্ডটির?) প্রথম পাঠক আমার দুই গুণী বন্ধু। প্রথম জন কবি শরিফ শাহরিয়ার, দ্বিতীয় জন কবি-অনুবাদক সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। সুব্রতর বিস্তারিত মন্তব্য ও পরামর্শ আমার অনুবাদকর্মটির প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জনে দারুণ কাজে লেগেছে। অবশ্য অনেক স্থানে ওর পরামর্শ মানা সম্ভব হয়নি। সেটা কিছুটা আমার ব্যক্তিরুচি আর বাকিটা আমার ক্ষমতার দৌড়ের সীমাবদ্ধতার কারণে। যেসব স্থানে ওর পরামর্শ মানা সম্ভব হয়েছে, বোধ করি, সেখানটায় এসে অনুবাদ যৎকিঞ্চিৎ উৎরে (?) গেছে। বন্ধু হয়ে ওকে স্রেফ ধন্যবাদ জানানোর মতো ছোটোলোকি আমায় মানায় না। আমেন!!!


পার্থপ্রতিম রায়

ঋপণ আর্য-এর কাব্যগ্রন্থের আলোচনা করলেন
পার্থপ্রতিম রায় 

প্রত্যাবর্তনের সথে আমি


আমাদের নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক বৈচিত্র্য অনুযায়ী ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতির বিশ্লেষণ করে থাকি। 'এলিমেণ্ট', ' বৈপরীত্য', ' ভাবনা' - এই সবই ঘোরগ্রস্থ দৃশ্যের বায়োস্কোপ । আসলে কবিতা হল একটা স্বাধীন সচলায়তন। এই অশরীরী সেলফরিওয়াডিং সিস্টেম ঈশ্বরের অন্যান্য সৃষ্টির চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আর 'মুহূর্ত' হল এই সিস্টেমের কর্ণধার। একটা আড্ডায় ঋপণদা ক্যাপ্টেনকে বোলে- "লক্ষবছর পাড় হলেও তোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকবে" - এই হয়তো মুহূর্তযাপন... 'মোমবাতি ও স্বপ্নের প্রত্যাবর্তন' বইটিতে 'সময় ও মুহূর্ত' নিয়ে খেলার প্রবণতা। খেয়াল করলে দেখা যাবে কবিতাগুলিতে অসম্ভব মুহূর্তের যত্নছাপ। যেমন- " সিঁড়ির ভাঁজে ভাঁজে তির্যকরেখা, ভাঙা কাঁচের গুঁড়োর মতো /অহংকার... সরলরেখা হয়ে খোলা দরজায় আত্মমোচনে / শিখে নেয় চুম্বনের বুনন ! ..." । আবার- " কিছু সত্যের ভুমিকায়, কিছু মিথ্যের প্রশয়ে / প্রতিশ্রুতিরা দেওয়াল-লিখন হয়ে যায় । / যার সাশ্রয় মুল্য নেই, তার অধিকার মূল্য / আমাদের গ্রাস করে... " - বাস্তবতার সংজ্ঞা নির্ধারণে ব্যর্থ মানুষকে এই বাক্যগুলির মাধ্যমে একীভূত করা যায় । এরপর ৬ থেকে ১০ নম্বর কবিতাগুলিতে, কবিতার ছায়াখণ্ডগুলি ছায়াছবিতে পরিনত । ভাবনার ভিতর 'ঘোর' সময়কে আবদ্ধ করে রাখে, এই অসাধারণ যাপন প্রকাশে কবি ও পাঠকের মধ্যে যোগসুত্র স্থাপন করে। জীবনের প্রবাহমানতায় ছোটখাটো গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত টুইস্ট এনেছে কিছু কিছু কবিতায় ; যেমন-- " পাঠক" কবিতায়- “ ফিনিক্স হয়ে মরে/ কুয়াশায় সমুদ্রের/আলো হেঁটে গেছে...' ; "কাহিনি বন্ধু ছিল" কবিতায়- “ কাহিনি মরচে ধরা, জানালার শিকে চোখ গলে যায় / তবে কি চোখ অ্যাসট্রে, খুনির মতো মৃত্যুকুড়ায় !...' এছাড়াও 'কেলাসিত সূত্র', 'প্রেম বিষয়ক অন্য গল্প' কবিতায় ভাঁজকাটা অনুভূতি আমার সঙ্গি হয়, যা যুগপৎ আনন্দের প্রলেপ । আর "ফেরা" কবিতাটি আমার একটি প্রিয় কবিতা হয়ে থাকলো, অন্তর্ভেদী এই কবিতাটি আসলে নিজেকে ভেঙেচুরে উপলব্ধি করার প্রচেষ্টা অথবা অজানা ইশারায় নিজের সম্পূর্ণতাকে বাড়ায় । টুকরো টুকরো জীবনের ছবি নিয়ে তৈরি হয় আবছা অবয়ব । "...... স্বপ্নের প্রত্যাবর্তন" দেখার সময় আমার ভাবনার দরজা খোলা রাখি; কিন্তু ভাবনা থেকে / "প্রত্যাবর্তন" গুলো একটু বেশি সচেতন । অনুভূতির সৌন্দর্যময় পুলকবোধ মনকাড়ে রঙিন স্বপ্নের জগতের দিকে ... "প্রেম- মুহূর্ত- অনুভূতি আসলে আমাদের অতিপরিচিত আবার অতিঅপরিচিত দৈত-চেতনা..."


মোমবাতি ও স্বপ্নের প্রত্যাবর্তন ▀ ঋপণ আর্য ▀ অভিযান পাবলিশার্স ▀ মূল্য- ১৫ টাকা



বিধান সাহা


অন্তহীনেই অন্তমিলের খেলা

(১)

আজকাল প্রায়ই মনে হয় যা লিখতে চাই তা আর নতুন কী? নতুন করে কী আর বলার আছে আমার? মনে হয়, যা লিখি তা তো সকলেই জানে। সত্য যে স্বয়ং প্রকাশ! নতুন করে তাকে আর প্রকাশিব কী! এইসব ভাবতে ভাবতেই দিন চলে গিয়ে রাত আসে, রাত গিয়ে আবার নতুন একটি দিন। কাজের কাজ কিছুই হয় না।

অসংখ্য ভাবনা আজ-কাল প্রায়ই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই যে আমরা মানুষ, আমাদের চালায় কে? ...মস্তিস্ক? কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় মস্তিস্কের অধিক আরো কিছু আছে। মনে হয়... মনে হয়... নাহ! ঠিক ঠিক ধরতে পারি না। কিন্তু আমার পথ চলা থামে না। বরং আরো বেগ প্রাপ্ত হয়ে অসংখ্য প্রশ্নের মুখামুখি দাঁড় করিয়ে দেয় নিত্য নতুন ঢংয়ে। সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার বলে কী সত্যিই কিছু আছে? মানুষ চাইলেই কী অন্য মানুষের মনের কথা জানতে পারবে? অথবা সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে যে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ আজকের সভ্যতায় এসে পৌঁছালো এবং হারিয়ে গেল অস্ট্রালোপিথেকাস, রামাপিথেকাস সহ অন্যান্য যুগের মানুষের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, কেন হারালো? ইতিহাস বলছে বিবর্তনের প্রতিযোগিতায় অর্থাৎ প্রকৃতির উপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে না পারাই এর মূল কারণ। তাহলে যারা টিকে গেল তারা কোন শক্তির বলে প্রকৃতির উপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছিল? আবার এই সভ্য মানুষই বা ভবিষ্যতে বিবর্তিত হয়ে কী হবে? নাকি এখানেই আটকে যাবে বিবর্তনের এই সুদীর্ঘ অধ্যায়?

আমার প্রশ্নের উত্তর মেলে না। আমি অস্থির চিত্তে স্থিরতার ভান ধরি। শেষ-মেষ কোন কূল- কিনারা না পেয়ে অসহায় আত্মসমর্পন কার কবিতার কাছে। বসে বসে কবিতা পড়ি।

তুমি আমাকে নেবে? ঘাসফুল, নেবে? খেলায়?
আমি দিন ফুরিয়েছি ঘুরে ঘুরে মেলায়,
আমার যা কিছু আছে নাও,
তবু একবার স্পর্শ করো আমাকে, ছুঁয়ে দাও।
এসেছি তোমার কাছে বড়ো অবেলায়।
তুমি যদি ছুঁড়ে ফেলো হেলায়,
ভাসিয়ে দাও নিরুদ্দেশে ভেলায়
আমি ফিরে তোমার কাছেই যাব
শতবার নিজেকে হারাব
-দিলরুবা

কোন কোন কবিতার লাইন আমাকে ভীষণভাবে জাগিয়ে তোলে। তখন তাদের মধ্য থেকেই কোন টিকে মন্ত্রের মতো আওড়াই

কিছুটা সময় দিলে তবে দুধে সর ভেসে ওঠে
-বিনয় মজুমদার
আমি আশায় বুক বাধি। নিজেকে মহাকালের বৃত্তে ছেড়ে দিয়ে ‘সরের’ প্রত্যাশা করি।

০২.
এই যে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আমরা দেখি। ফর্সা, কালো, বেটে, লম্বা, মোটা, চিকন- সত্যিকার অর্থে এর মধ্যে কতজন প্রকৃতমানুষ? এঁদের মধ্যে কতজন উর্ধ্বতর চেতনায় উত্তীর্ন? আবারও অর্ন্তগত প্রশ্নের মিছিল আমাকে তাড়া করতে থাকে। কোথায় যেন পড়েছিলাম- পৃথিবীতে আমরা কেউই স্বতন্ত্র নই। অন্যান্য মানুষের চিন্তাতরঙ্গ দ্বারা আমরা প্রভাবিত হই, ত্বারিত হই। সুতরাং আমি বা আমরা যা এই মুহুর্তে ভাবছি বা করছি তা আমাদের আগে কেউ একজন ভেবেছে বা করেছে। যার ভাবতরঙ্গ বা চিন্তাতরঙ্গ এই মুহুর্তে আমার বা আমাদের চিন্তাতরঙ্গকে প্রভাবিত করছে। এই প্রসঙ্গে কমরেড চারু মজুমদারের একটি কথা মনে পড়ছে। হুবহু বলতে পারবো না। তবে কথার মূল অংশটি এ রকম- তিনি তাঁর অনুসারিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আমাদের কোন প্রচারণাই ব্যর্থ হবেনা। এর প্রতিটি কথাই পৃথিবীতে থেকে যাচ্ছে। শক্তির কোন ক্ষয় নেই। তা কোন না কোন সময় কাউকে না কাউকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে, এবং সেদিন আমাদের বিজয় নিশ্চিত হবে।

...তার মানে আমরা প্রতিনিয়ত সকলের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি! কিন্তু প্রভাবিত তো কেবল শক্তিশালী চিন্তাতরঙ্গ বা ভাবতরঙ্গই করতে পারে অপেক্ষাকৃত দূর্বল ভাবতরঙ্গকে। তার মানে যদি আমার ভাবতরঙ্গ শক্তিশালী না হয় তাহলেই প্রভাবিত হয়ে যাব? ভাবনাটা আরো গভীর থেকে গভীরে পৌঁছে যায়। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করি। হাঁটি। মানুষের মুখের দিকে তাকাই তার ভেতরটা দেখার জন্য। চা খাই। মুখ ভর্তি সিগারেটের ধোঁয়া নিয়ে কুন্ডলি পাকিয়ে আবার ঠেলে বের করে দেই। দেখি ধোঁয়ার কুন্ডলী গুলো স্বাধীন ভাবে উড়তে উড়তে হারিয়ে যাচ্ছে। আমার এ ভাবনাটাও কি এভাবেই হারিয়ে যাবে; উত্তরহীন? উদ্দেশ্য নিয়ে নিরুদ্দেশে ঘুরে বেড়াই প্রতিদিন।

০৩.
এক সময় মনে হতো মেয়েরা একটা নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতার উপর উঠতে পারেনা। এখন মনে হয় প্রতিটি মানুষই তো সীমাবদ্ধ। সে নারী-পুরুষ যেই হোক। সীমাবদ্ধ মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতারও সীমাবদ্ধতা থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। নইলে মানুষ আর মানুষ কেন? মানুষ আর দেবতার পার্থক্যই বা করা হতো কিভাবে? তাহলে কী এই সীমাবদ্ধ মানুষের ভাবতরঙ্গ দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে আছে পুরো পৃথিবী? আর অন্যসকলে এই সাধারণ ভাবতরঙ্গ দ্বারা প্রতিনিয়ত প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছে? আমার ভাবনায় আরো শক্তিশালী জট পাকিয়ে যায়। তবে কী এই সীমাবদ্ধ ভাবতরঙ্গকেই আমরা মায়া বলি? হঠাৎ আমার চোখে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কিছু একটা জ্বলে উঠে আবার মিলিয়ে যায়। হতে পারে নতুন কোন পথের দিশা অথবা দিশাহীন এক অন্যতর সংকট। এইসব সংকট আর সম্ভাবনার ভেতর দিয়ে চলতে চলতে দেখি প্লেটোর নন্দনত্বাত্তিক দর্শনের ‘থিওরী অব আইডিয়া’ তে বলা হচ্ছে- আমরা যা কিছু দেখি অর্থাৎ এই যে দৃশ্যমান জগৎ, এ আসলে প্রকৃত জগৎ নয়। প্রকৃত জগৎ আছে এই দৃশ্যমান জগতের বাইরে। আমাদের অন্তর্গত যে ভাবের জগৎ বা অনুভূতির জগৎ আছে দৃশ্যমান জগৎটি সেই জগতেরই ছায়ামাত্র। আবার আমাদের প্রচ্যের দর্শনও এই একটি কথাকেই সমর্থন করে আসছে। আমাদের বৈষ্ণব দর্শন, বাউল দর্শনও বলছে সেই প্রকৃত জগতের কথা; সমস্ত লৌকিকতার উর্ধ্বের সেই অতিমানস জগতের কথা।

কিন্তু সমস্ত লৌকিকতার উর্ধ্বেই যদি প্রকৃত জগত থেকে থাকে তবে কবি কেন বলেছেন-‘মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুরাসুর’? তাহলে নিশ্চয়ই এই মানুষের মাঝেই আছে শ্রেণী ভাগ। আমার ভাবনা গুলো চৈতালী বাতাসে উড়ে ওঠা ধুলোর মতো শূন্যে উঠে হাওয়ায় মিলায়। গুম হয়ে বসে থাকি। আরো গভীর কোন মৌনতায় খুঁজি শব্দের কোলাহল। আবারও রাত্রি নেমে আসে। বিছানায় যাই। আমার চোখে ঘুম নেই। শব্দ নেই। কবিতা নেই। চা, মদ, নারী নেই। কাম নেই। প্রেম নেই। কেবল অসংখ্য প্রশ্ন সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরে ছোবল মারতে চায়। আর আমি একা, এই সমস্ত কিছু থেকে পালাতে চাই। আমি পালাই। দৌড়াই। আশ্রয় নেই আমার ভেতর।

মাত্র একটু তন্দ্রাভাব এসেছে। ঠিক তখনই, কে যেন ভেতরে ভেতরে অনর্গল বলতে লাগলো-
‘এই প্রকৃতিতে সমস্ত শক্তিই আছে। মানুষ তার চাওয়ার সাথে সঙ্গতি রেখে চেতনে অথবা অবচেতনে এই শক্তির সাথে সংযোগ স্থাপন করে এবং সেই শক্তি অর্জন করে। এভাবে একেকজন একেক শক্তি সঞ্চয়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে সেই শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে । এভাবেই মানুষ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যায়। মানুষের এই শ্রেণীভাগ দেবতা থেকে অসুর পর্যন্ত অথবা তারও বেশি। অর্থাৎ একই শারীরিক কাঠামোর ভেতরে একেকজন লালন করে একেক ধরণের শক্তি। কেউ ধনাত্মক শক্তির প্রতিনিধি আর কেউ ঋণাত্মক শক্তির। এখানে দেবতাকে যদি ধনাত্বক শক্তির সর্বোচ্চ প্রতিনিধী আর অসুরকে ঋণাত্বক শক্তির সর্বোচ্চ প্রতিনিধী ধরে নেওয়া হয়, তাহলে দেবতা আর অসুরের মাঝামাঝি যারা যারা অবস্থান করছে তাদেরও আরো কিছু সাধারণ শ্রেণী আছে।

এই ভিন্ন ভিন্ন সাধারণ মানুষগুলোর চেতনাতরঙ্গ বা ভাবতরঙ্গ স্বাভাবিক ভাবেই বেশি ক্রিয়াশীল। কারণ তাঁরাই সংখ্যায় বেশি। এই বেশি সংখ্যক মানুষের ভাবতরঙ্গ প্রতিনিয়ত অপেক্ষাকৃত দূর্বল চেতনাতরঙ্গ বা ভাবতরঙ্গকে প্রভাবিত করছে। আবার অপেক্ষাকৃত উন্নত ভাবতরঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে সাধারণ ভাবতরঙ্গ। এই ভাবে সবচেয়ে উচ্চতম ভাবতরঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে নিম্নতম ভাবতরঙ্গ আবার ক্ষণিকের অসতর্কতায় নিম্নতম ভাবতরঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছে উচ্চতম ভাবতরঙ্গ। কিন্তু যদি প্রতিনিয়ত এই নিম্নতম ভাবতরঙ্গ দ্বারা উচ্চতম ভাবতরঙ্গ প্রভাবিত হয়ে যায় তবে সেটা হবে মানুষের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু সাধারণ ভাবতরঙ্গ বেশ শক্তিশালী হওয়ার ফলে প্রতিটি মুহুর্তে উচ্চতম ভাবতরঙ্গ প্রভাবিত হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। যখন এই নিম্নতম ভাবতরঙ্গ দ্বারা উচ্চতম কোন ভাবতরঙ্গের প্রতিনিধি প্রভাবিত হয়ে যায় তখনই সেই ব্যক্তির পদ স্খলন ঘটে। সেই মানুষটির ব্যক্তি জীবনে কিংবা সামাজ জীবনে বিভিন্ন অসংগতি তথা বিচ্ছন্নতা দেখা দেয়। এই ভাবে ব্যক্তি থেকে এই সকল অসংগতি ছড়িয়ে পড়ে পরিবারে, সমাজে, দেশে, রাষ্ট্রে, পৃথিবীতে। সুতরাং পৃথিবীর ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য উচ্চতম ভাবতরঙ্গ, বলা যায় উচ্চতম চেতনায় উন্নিত হওয়া খুবই প্রয়োজন। কিন্তু যেহেতু পৃথিবীময় একটি শক্তিশালী সাধারণ ভাবতরঙ্গ সর্বদা ক্রিয়াশীল সুতরাং উচ্চতর ভাবতরঙ্গের প্রতিনিধিদের প্রতিমূহুর্তে অনেক বেশি সচেতন থেকে হতে হবে উচ্চতর চেতনার ধারক। তাহলেই ক্রমাগত নিম্নতর ভাবতরঙ্গের প্রতিনিধিরা রুপান্তরিত হতে হতে গড়ে উঠবে এক অন্যতর পৃথিবী। মহাকালের খেরোখাতায় কেবল তারাই বিজয়ী হিসেবে টিকে থাকবে।’

যেন মুহুর্তে আলোর বন্যা বয়ে গেল মনের মধ্যে। আহা! এ কী কেবলই তন্দ্রাঘোর! একে একে যেন সমস্ত প্রশ্ন গুলোর জট খুলে যেতে লাগলো। তাহলে এই যে প্রতিদিন আমারা মানুষ দেখি এর মধ্যে একেকজন একেক শক্তির প্রতিনিধি! আর সেই সব মানুষ, যারা বিবর্তনের প্রতিযোগিতায় টিকে গিয়েছিল তারা নিশ্চয়ই এক উন্নত চেতনায় উত্তীর্ন হয়ে প্রকৃতির উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছিলো। আর এভাবেই বুঝি বিবর্তনের পরবর্তী ধাপে আজকের এই আধুনিক মানুষ উন্নত চেতনার ধারক হয়ে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠবে মহা মানব! অর্থাৎ মানুষের মধ্যে প্রবেশ করবে সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার!

আমার ভাবনা এবার মানুষ ছাড়িয়ে চলতে লাগলো কবিতার দিকে, শিল্পের দিকে। তাহলে কালোত্তীর্ন শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে মানুষকে কোন চেতনার ধারক হতে হবে? অথবা যারা মহাকালের আলফা নগরীতে টিকে আছে, তাঁরা কোন চেতনাকে লালন করেছেন আত্মার গভীরে?

...প্রশ্ন আমাকে ছাড়ে না। আবার আমিও প্রশ্নকে না। অবচেতনে সম্ভবত আমিই এইসব প্রশ্নগুলোকে সযত্নে আগলে রাখি আমাকে জানার জন্য। কখনো উত্তর পাই, কখনো পাইনা। তবু মাঝে মাঝে মনে হয় যা কিছু পৃথিবীতে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, যে ক্ষমতার বলে ভরে উঠছে শিল্পীর ক্যানভাস, কবির খাতা, লাভ হচ্ছে সাধকের সিদ্ধি, গায়কের কণ্ঠ হয়ে উঠছে সুরেলা, এই সব কিছুর পেছনে আছে মহাজাগতিক এক অন্যতর মহাশক্তি। মনে হয়, এই বিশ্বজগতের, এই বিশ্ব প্রকৃতির অন্তহীনে প্রতিনিয়তই চলছে এক অন্তমিলের খেলা।

কল্পনা দাস


‘বাংলা গানে - নারী’


“ আমি মারের সাগর পাড়ি দেব, বিষম ঝড়ের বায়ে
আমার ভয় ভাঙা এই নায়ে।

'মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে .”............।।

রবীন্দ্রনাথের এই গানটি কিংবদন্তী শিল্পী সুচিত্রা মিত্রকে ভীষণ ভাবেই মনে করিয়ে দিচ্ছে। তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তিনি একজন পরিপূর্ণ শিল্পী। বাংলা গানের গায়নের ইতিহাসে নারীরা আজ সমাদৃত, শুধু তাই নয় ভাবতে ভাল লাগে সাদরে গৃহীত। মহিলা শিল্পীদের স্বাধিকার বোধ সমাজে বেশ ভালভাবেই স্বীকৃত, মাথা তুলেছেন নারী তাঁর গানের দাপটে। নির্ভয়ে নিজেই অর্জন করেছেন,আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার।

সংগীত বাঙালী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, সংগীত এনে দেয়ে মুক্তি-র স্বাদ। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় মোহর কনিকা তাই গাইলেন, “আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাবো”...শুনে মুগ্ধ হতে হয়। সম্প্রতি রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী মায়া সেন কে হারালাম, সঙ্গে একটা যুগকে । প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, আমার বন্ধু অপালা সেন মায়াদির প্রিয় ছাত্রী। “ অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রান”—এই গান আমার বন্ধুর গলায়ে শুনি আর গর্ব বোধ করি। প্রশ্ন জাগে মনে, কবিকে তাই জিজ্ঞেস করি, কে দেবে আলো, কে দেবে প্রান? মায়াদির আরও একজন সুযোগ্যা শিষ্যা স্বাগতালক্ষ্মী দাসগুপ্ত। তাঁর কণ্ঠে “অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো”---এই গানের গায়কিই বলে দেয় এই তমসাবৃত আকাশ, ব্যপ্ত চরাচর, আসন্ন সংশয়, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কে আর আমাদের ত্রাণ করবেন?

শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের গানেই নয়, নানা বর্ণের গানে মাহিলা শিল্পীদের মহিমা প্রকাশ পেয়েছে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়,আরতি মুখোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত , নির্মলা মিশ্র, উৎপলা সেন, প্রতিমা বন্দ্যপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরী, রুমা গুহঠাকুরতা(Calcutta Youth Choir), আরও অনেকে শিল্পী যাঁদের স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ এক স্বর্ণ যুগের সৃষ্টি করেছিল। বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন তারা। ওপার বাংলার শিল্পী ফিরোজা বেগমের নাম উল্লেখ করতেই হয়। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই, অনবদ্য তাঁর নজরুল গীতি পরিবেশনা। দরদী , মরমী কণ্ঠ। রেজয়ানা চৌধুরী বন্যা আর একজন বাংলাদেশের শিল্পী। অসাধারন তাঁর গানের গলা, রবীন্দ্র সংগীত যার রক্তে। বন্যাদিকে আমি শন্তিনিকেতনে পেয়েছি। এই সব শিল্পীদের প্রতিষ্ঠা প্রগতি পন্থার চেহারা ও চরিত্র প্রকাশ পায়, নতজানু আমরা।


বহু নারী কণ্ঠ আছে, সব উল্লেখ করা সম্ভবপর হলো না। এতদসত্ত্বেও কিছু কথা বলতে চাই। যাঁদের কথা বললাম তাঁরা সবাই পুরুষের লেখায়ে নিজের কথা ব্যক্ত করেছেন। একজন নারীর নিজের কলমের গানের জন্য আমরা অপেক্ষা করেছি । নারী কণ্ঠের সংলাপ, তাঁর নিজস্ব ভাবনা, যে লিখবে তার নিজের কথা। ব্যক্ত করবে তার অনুভব। আনেক নারী কবির কথা জানি, যাদের নিজস্ব স্বর আছে, কথা আছে। জানি শাঁওলী মিত্রর “নাথবতী অনাথবৎ”, ঊষা গাঙ্গুলীর নাট্যদল, সোহাগ সেনের নাট্যদল , সীমা মুখোপাধ্যায়ের নাট্যদল, অপর্না সেন পরিচালিত চলচ্চিত্র, ক্রীড়াজগতে জোতির্ময়ী শিকদার, ঝুলন গোস্বামী, দোলা গাঙ্গুলী, আরও অনেকের কথা জানি। হ্যাঁ নিজের কথা, নিজের সুর নিয়ে আত্ম প্রকাশ করলেন মৌসুমি ভৌমিক, স্বাগতালক্ষ্মী দাসগুপ্ত।এরা সুর দিয়ে গান গাইতে স্বক্ষম, নিজস্ব স্টাইলে। তবে মৌসুমীর বিখ্যাত গান “ শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউ-এ চেপে নীল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ”...... মন ছুঁয়ে যায়, নতুন করে ভাবতে শেখায়ে জীবনের কথা।


বাংলা গানের জগতে নারীদের এগিয়ে চলা , আমরা তাতে গর্ব বোধ করি। আর কয়েকজনের জন্য গর্ব বোধ করি , তাঁরা হলেন--হৈমন্তী শুক্লা, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় , ইন্দ্রানী সেন, শ্রাবণী সেন, রমা মণ্ডল (তিনি অকালে চলে গেলেন), শম্পা কুণ্ডু, শুভমিতা, নীপবিথি ঘোষ, অনুসূয়া চৌধুরী, লোপামুদ্রা মিত্র। এদের গলার স্বর, পরিবেশনায় প্রকাশ পায় আত্মপ্রত্যয়। লোপামুদ্রা-র গাওয়া জনপ্রিয় গানটিতে জয় গোস্বামী-র কবিতার বেনীমাধব দ্বারা প্রতারিত এক নারীর জবানিতে করুণ আত্মবেদনা ফুটে উঠেছে, “বেনীমাধব, বেনীমাধব, তোমার বাড়ি যাব, তুমি কি আর আমার কথা ভাব”............লোপামুদ্রা নয়, যেন গাইছে প্রবঞ্চিত আর্ত বহু নারী।


এখনকার গানে প্রকাশ পায় সমসাময়িক নারী কণ্ঠের বলিষ্ঠ বয়ান। বাংলা গান শোনার উৎসাহও যোগায়।


সেই গানে আছে স্বপ্রতিভ, প্রখর, শহর সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজ, রোমান্টিকতার প্রকাশ। শিক্ষারুচি , মুল্যবোধ, মানবিকতা, যে গানের ভাষায় আছে প্রতিবাদ, মানবপ্রেম, দুর্গত বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের জন্য সহানুভূতি। আর আছে লড়াই সংগ্রামে সামিল হওয়ার আহ্বান।।

ঋষি সৌরক


অনুপমের হাইওয়ের চতুর্দিকের অনিশ্চয়তা লিখলেন
ঋষি সৌরক

পোস্টমর্ডান কবিতাগুলি মর্ডান নয় - কারন তারা পোস্টমর্ডান (আসল কারণটা পরে বলছি...)। এবং এই পোস্টমর্ডার্ন ধারাটিকে কবিতার জগতে বিভিন্ন কবি এনেছেন বিভিন্ন ভাবে,আকৃতি-প্রকৃতিতে বিপ্লব তো সেই কবে থেকেই ঘটে আসছে,নতুনত্বের সন্ধান করতে করতে আজ নতুনত্ব যখন ফুরিয়ে যাওয়ার মুখে, কবি অনুপম এক বিরাট হাইওয়ে র পেটে ছেড়ে দিলেন একা বোকা।

খুব চেনা চেনা শব্দভাণ্ডার,এক-দুটি শব্দ ছাড়া সবগুলিই কুড়িয়ে পাবেন হাইওয়ের পাশে।এরপরও কিন্তু একটা 'কিন্তু' থেকেই যায় – “কারণ ছাড়াই মনের মতো হয়ে উঠছে পথ এবং পথ” । অদ্ভুত ফ্যাণ্টাসি- অচেনা পথে ছড়িয়ে আছে চেনা ছাপ, অথচ লিঙ্ক খুঁজতে যাওয়া মূর্খামো,কিছুটা মিল...কিছুটা অমিল...অমিল..অমিল...মিল...যুক্তিবাদীরা দূরে থাকুন-চুপ করে দেখুন কবি অনুপম হাতে যাদুদণ্ড- আকাশজোড়া ক্যানভাস-'পর্দাতুলে রোদ আসছে /বিছানায় সাঁতার শেখার দাগ'- 'ঘসেটি বেগমের মাথার ওপর সাতটা সবুজ টিয়া -এইমাত্র উড়ে গেল'-কবি বললেন,'পুরো ছবিটাই একটানে এঁকে ফেলতে চাইছি'।একটানে আঁকা ছবিটি রেখায় রেখায় জোড়ে না; অসীমের দিকে সমাপ্তি নেয়। বিমূর্ততা এক অন্য জিনিস,তারও মূর্তরূপ আমরা দেখেছি,কবি অনুপম দেখালেন সহস্র বিচ্ছিন্ন ভাবনার সমায়ন, যেখানে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাবনাগুলিও শার্পলি পয়েণ্টেড হয়েছে,আবার গুরুগম্ভীর চিন্তার ক্যাসুয়াল এণ্ডিং ও দেখানো

এভাবেই কবি অবিরত আপডেট এবং বিনোদন ঘটিয়েছেন দৃশ্যবদলের,ধ্রুবর কন্সেপ্টে বিশ্বাস নেই তার,তিনি সমস্ত কিছুর সেন্টার অফ গ্র্যাভিটি কে ছুঁতে, চান,একটা জিনিস কে সেই জিনিসটার মত করে একবারই পেতে । অনুপমের কবিতায় ভাবনাগুলিকে মার্জ করানোর অহেতুক প্রচেষ্টা নেই,বরং ছবিতে রঙ ছেড়ে উনি খেলা দেখেন,রঙ্গের খেলা অথচ পরিমিতি বোধ তার সুদক্ষ শিল্পীর মতোই সদা তৎপর । ওই যে বিমূর্ততার কথা একটু আগেই বললাম,অনুপমের ছবিতে কোনো রেখা নেই,তাহলে? আছে এলোমেলো নানা ব্যাসার্ধের বিন্দু -অস্থিরতম বিন্দু,অনুপমের কবিতাকে ছেয়ে রেখেছে তারা অবিরাম অনিশ্চয়তায় ,গতিপথের আকস্মিক বাঁকে -অজানা সাসপেন্স ও রোমাঞ্চে - “মেঘ ছাড়াই সরে যাচ্ছে পাথরের দিকে।ঠোঁট ছাড়াই ডুবে যাচ্ছে জলের গেলাস।যে দেওয়ালে বারণ নেই - বিজ্ঞাপন লিখছে না কেউ।খিঁচুড়ির হলুদটাই ভ্যান ঘগের হলুদ।নদীতে ভেসে যাচ্ছে নকল একটা নদী।দীঘিতে ডুবে আছে আসল একটা দীঘি” ।

'টুসকির দুঃখু' একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য খণ্ড,প্রথম কবিতাতেই টুসকির বর্ণনা কবি দিয়েছেন এভাবে “টুসকি এখানে ফুল তুলছে। সূর্য এখন ডুবছে /টুসকি যখন তুলতে যায় রোদ তখনই পড়ে । / আমার মেয়ে।ফুলে ফুলে মুছে দিচ্ছে / পারফিউমের নাম।গন্ধ হওয়ার দুঃখ।" অর্থাৎ প্রথম কবিতাতেই কবি আভাষ দিলেন,টুসকি তার মেয়ে...পরবর্তী কবিতাগুলিকে এক অদ্ভুত স্নেহে লালন করেছেন কবি,'টুসকি খেলার রাণী'-'টুসকির চোখ খুব বড়।আমার আকাশে ও /আকাশ দেখতে পায়'-'টুসকি হয়তো আমার কাছে নেই!' 'টুসকি আমার মেয়ে।/উত্তরের বাতাসে দক্ষিণের হাওয়ায়' কখনো 'রাস্তাতে ওই গড়িয়ে গেল টুসকির মার্বেল' কিম্বা 'দুধের গেলাস ছুঁড়ে ফেলে পালাচ্ছে টুসকি' ...টুসকির বাচ্পনা এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কবিতায়।এখন কথা হল,টুসকি আদতে কতটা বাচ্চা ? এই টুসকি ই কিন্তু কবির সিজনগুলির এক-একটি রঙ -দিনের বিভিন্ন সময়ের বিভাজিত অবচেতন-কবির মনের অন্তরমহলে চলতে থাকা কয়েককোটি নিষ্পাপ অভিব্যক্তির নিপুণ কারুকাজ-কবির স্বাধীনচেতা কবিতা-টুসকি ! টুসকিকেও কবি নিজের মাধ্যমে জেনারালাইজ করে দিলেন অবশেষে এবং এখানেই টুসকি চরিত্রটি যেনো আরো ব্যাপ্তি পেলো,'টুসকির দুঃখু' গুলো চিরন্তন হয়ে রইলো ...'বাউল বদল' এবং 'অদৃশ্য পেয়ালা ও সিলভারলাইনস্ বইটির প্রচ্ছদ করেছেন প্রিয় অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নামাংকন করেছেন দেবাশিস সরকার ... রঙ্গিন প্রচ্ছদে বইটির আভ্যন্তরীন সৌন্দর্য্যের সম্যক আভাস পাওয়া যায়,ছবিটিতে রয়েছে আধুনিক মনস্কতা এবং সুরিয়ালিস্টিক ছাপ,নামাংকনের ফন্টটি বেশ তীক্ষ্ণ ও সুস্পষ্ট,যা বইয়ের চরিত্রের সাথে সহজাত ভাবেই যায় ।

কাব্যগ্রন্থ - হাইওয়ে ▀ অনুপম মুখোপাধ্যায় ▀ নতুন কবিতা


সরদার মেরাজ


ছোটগল্প

শীত, ক্ষুধা, অত:পর…

 
আজ সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে। রাতেও বৃষ্টি থামার নামগন্ধ নেই। তার উপর শীত পড়েছে প্রচণ্ড আকারের। সন্ধ্যার আগেই লোকজনের চলা চলতি কমে গেছে। তাই হোটেলের ব্যবসায় আজ একদম মাইর খাওয়ার জোগাড়। গ্রামের মধ্যে, চৌরাস্তার মোড়ে, ভ্যানস্ট্যান্ডটির পাশের ছোট একটি হোটেল। হোটেলটির কোন নাম নেই। হোটেল চালক এবং মালিক একজনই। তার নাম আব্দুল। বয়স বিশ হবে। অবিবাহিত তরুণ।

রাত তখন ১০টা অথবা এরকম একটা সময়। আব্দুল হোটেলের ঝাঁপ নামিয়ে কেবল খেতে বসেছে। ছোট ঝাঁপটি খোলা রেখেছে। খাওয়া শেষে থাল ধোয়া পানি ফেলবার জন্য। বাইরে সজোরে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি দেখে আব্দুলের মনে পড়ে গেল।

এইতো সেদিন। এমনই সময়। বৃষ্টি ঠেলে এল ঝড়। নাম দিয়েছে সিডর। পানি ফুলে উঠল পাঁচ-ছয় হাত। ভেসে গেল হাজার হাজার মানুষ, গরু, ছাগল, শস্যক্ষেত। গাছপালা উল্টে পাল্টে পড়ে থাকল। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল বিদ্যুতের তার। নেমে এল অভাব। বাসস্থানের অভাব, কাপড়ের অভাব, খাদ্যের অভাব, বিশুদ্ধ পানির অভাব, আরও কত কী যে! রোগে শোকে মানুষ দিশেহারা হয়ে থাকল। সরকার সাহায্য দিয়েছে। বিদেশ সরকারও দিয়েছে। তবে যে ক্ষতি হয়েছে তার কিছুই পূরণ হল না। এই গ্রামের ক্ষতি হয়েছে কিছু কম। সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে এই ইউনিয়নের সর্ব দক্ষিণের গ্রামে। জীবিতজনই সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় না।
ভাবছিল আব্দুল। এমন সময় চোখের সামনে একজন বৃদ্ধাকে দেখে শিউরে ওঠে সে। মুখটি ধীরে ধীরে তার ঝাঁপের কাছে এসে দাঁড়ায়। “কেডা কেডা তুমি,এত রাত্তিরি এই ঝড় বাদলার মধ্যি?” ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে আব্দুল। বুড়ি কাঁপতে কাঁপতে কী উত্তর দিল কিছুই বুঝতে পারল না সে। আবোল তাবোল মনে হল তার কাছে। আবার বলল, “কী চাও? যাও এহান দ্যা।” এবারও কোন উত্তর না পেয়ে সে বুড়ির আগাগোড়া একবার দেখে নিল। মেটে রঙের একটি কাপড় পরণে। ভিজে চুপচুপ। অনবরত কাঁপছে। যেন ব্যাটারি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টি তখনও তার গায়ে টপটপ করে পড়ছে। আব্দুল তাকে ঝাঁপের নিচে এসে দাঁড়াতে বলল। বুড়ি গিয়ে দাঁড়াল। লাঠি ভর দিয়ে আছে সে। ভাতের থাল থেকে খাওয়ার হাত গুটিয়ে অন্য হাতে একটি গামছা বাড়িয়ে দিল আব্দুল। বুড়ি একহাতে লাঠি ভর অন্যহাতে গা গতর কিছু মুছে নিল। আব্দুল তাকে পাঁচ টাকা দিতে দিতে বলল, “এই নেও, এহন যাও।” বুড়ি টাকা নিল না। জিজ্ঞেস করল, “কী নেও?” বুড়ি মাথা নিচু করে থাকল। আব্দুল বুড়ির জন্য মায়া অনুভব করল। সেও ভীষণ গরীব এক ছেলে। বুড়ির মত গরীব। তবে এ মুহূর্তে বুড়ির চেয়ে ঢের ভাল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বুড়ি যদি পাগল হয়। পাগল হলে তাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না সে। সেবার এক পাগল তার হারিকেনের চিমনি ভেঙে ফেলেছিল। তবে একে দেখে পাগল মনে হয় না। “কী পাগল টাগল নিকি আবার?” বুড়ি এদিক ওদিক মাথা নাড়ল। বোঝা গেল না বলছে সে। পাগল হলে হ্যাঁ না কিছুই বলত না। সম্ভবত হাসতো।

বুড়িকে ভিতরে আসতে দিল আব্দুল। টিনের চালে বৃষ্টির ছাট সাপের মত ছোবল মারছে। রাস্তাঘাটে কোন মানুষ জন নেই। সিডর ভয় ধরিয়ে দিয়েছে সবাইকে। মেঘ দেখলে ঝড় ভেবে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে যায়।


গরম কাপড় কোথায় পায় ভাবছে আব্দুল। গরম কাপড় যা আছে তা হচ্ছে একটি জ্যাকেট। তাতো তার নিজের গায়ে ওম দিচ্ছে। এটা খুলে দিলে ঠাণ্ডায় জমে যাবে সে। হোটেল ঘরের কাঠের ফাঁক দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছে ভিতরে। বুড়ি কাপছে কাঁদছে এবং আরও করুণ অবস্থা তার। তার একটি ছোট পুটলি ছিল। আব্দুল খুলে দেখল। একটি চাদর, একটি ব্লাউজ, একটি ছায়া, একটি মলম আর একটি পানের বাটা। কিছুই শুকনো নেই। শীত বাড়িয়ে দেবে, কমাবে না। মলম দিয়ে কী হয় কে জানে। মলম পার্টির লোক কি না ভাবল সে। একচোখে একটু মলম মাখিয়ে বুঝে নিল, অতি সাধারণ মানের মলম এটা। এর অন্য কোন ব্যবহার থেকে থাকবে।


আব্দুল একটি লুঙ্গি বুড়িকে পরার জন্য দিল। আজ গোসল করেনি সে। তাই শুকনো লুঙ্গিটা বুড়ি পেল। তা-না হলে এই বৃষ্টির দিনে ভিজে লুঙ্গিই পরতে হত তাকে।


বুড়ি ভিজে কাপড় ছেড়ে লুঙ্গিটা পরল। তার অবস্থা ভেবে আব্দুল তাকে গায়ের জ্যাকেট খুলে দিল। তাতেও বুড়ি আরাম পাচ্ছিল না। আব্দুল হারিকেনের পাওয়ার বাড়িয়ে দিল। বুড়ি দুই হাত হারিকেনের চিমনিতে ঠেষে দিয়ে উষ্ণতা পেতে লাগল।


আব্দুল আবার খেতে শুরু করল।বুড়ি বলল, “ঝড়ে ছাওয়াল বউ নাতি পুতি হগ্গল ভাইস্যা গ্যাছে।” বলতে বলতে দাঁতে দাঁতে ঠোকর খেল সে। তার কাঁপা থামছে না। আরও বাড়ছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে খুব। আব্দুল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “এহন থাউক, পরে কইও।” সে বুড়িকে একটি থালে ভাত ও মাছ বেড়ে দিল। এ মুহূর্তে বুড়ির শীত এবং ক্ষুধা আর কোন কিছুই না। মৃত্যুর কাহিনি শুনতে শুনতে আব্দুলের এখন বিরক্তি লাগে। আর কত!


মিনিটের মধ্যে বুড়ি তার থাল শেষ করে ফেলল। আরেক থাল বেড়ে দিল আব্দুল। নিমেষে বুড়ি তাও শেষ করে ফেলল। বুড়িকে এবার ডিসের সব ভাতগুলো বেড়ে দিল সে। তাতেও বুড়ির পেট ভরল না মনে হল। আব্দুল তার থালের সব ভাত বুড়ির পাতে তুলে দিল। বুড়ি তার দিকে চেয়ে নি:শ্বাস ছাড়ল, “বাঁইচা থাকো বাপু, আল্লায় য্যান্ তুমারে ম্যালা ধোন সম্পদ দ্যায়।” তার চোখে পানি এসে গেল। সে দিকে তাকিয়ে দেখল আব্দুল। মাথার চুল সব পেকে পাকা সনের মত হয়ে গেছে। বয়স ৭০-৮০′র কম হবে না। গায়ের চামড়া হাতির চামড়ার মত হয়ে গেছে। মুখে স্পষ্ট বলিরেখা। কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু তাকে ছাড়িয়ে গেল কেমন করে। যেখানে তার জোয়ান আত্নীয়েরা সব মরে গেল।


বুড়ির শোয়া নিয়ে ভাবছিল আব্দুল। কোথায় কেমন করে তাকে রাখবে সে। এত গরম কম্বল কৈ তার? সে ঝাঁপের বাইরে উঁকি মারল। কাউকে পেলে বুড়িকে তার সঙ্গে পাঠিয়ে দেবে। কাউকে দেখতে পেল না। আবার ঘরের মধ্যে ফিরল। বুড়ি খাওয়া শেষ করেছে। পেট ভরেছে কি না জিজ্ঞেস করল সে। বুড়ি একদিকে মাথা নেড়ে বলল, হুঁ। পেট না ভরলেও আর কিছু করার ছিল না আব্দুলের। আর ভাত নেই তার।


ঘরে পাটাতন নেই। মাটির পোতা। পুব দিকটায় একটা চৌকি পাতানো। একজন আরামে ঘুমানো যায়। তবে ছোট আর একজন হলেও তাকে নিয়ে ঘুমানো যায়।


ঠাণ্ডা খাটালের উপর দুইটা ছালা পাশাপাশি রেখে বুড়িকে শুতে দিল আব্দুল। একটি কাথা তাকে গায়ে জড়ানোর জন্য দিল। কাথা এই একটিই আছে। চৌকির উপর শীতল পাটি তার উপর কাথা বিছিয়ে আরামে ঘুমিয়ে থাকে আব্দুল। কিন্তু আজ আর সে আরাম হবে না। বুড়িকে কাথাটি দিয়ে দিয়েছে। শীতল পাটিতে ঠাণ্ডা বোঝাই। শীতল পাটি নিচে ফেলে দিয়ে চৌকির ময়লার উপর শুয়ে পড়ল আব্দুল। একমাত্র লেপটি গায়ে জড়াল।


কিন্তু ঘুম আর এল না। বুড়ি প্রলাপ বকছে। লেপ ছেড়ে বের হল আব্দুল। ঘরের মধ্যে শীত ঢালা হয়েছে কয়েক টন। বৃদ্ধের মত সেও কাঁপছিল। মেজাজ তার খারাপ হচ্ছে। একেতো ব্যবসা হয়েছে মন্দা তার উপর এসে জুটেছে ঝামেলা। একটু ঘুমাবারও জো নেই। “কী অইছে এত চিল্লাছ ক্যা? শুতি পাত্তিছি ন্যা, আর এট্টুও চিল্ল্যাবা না, গাল ফাঁক করবা না। বাইরি থুইয়া আসপো কিন্তু।”


হঠাৎ করে বুড়ি একদম নীরব হয়ে গেল। বাইরের কথা চিন্তা করে সে হয়তো ভয় পেয়েছে। আব্দুল আবার লেপের মধ্যে ঢুকে গেল। আবারও তার ঘুম এল না। বুড়ি আবারও কী সব আজেবাজে বকছে। তবে আগের মত জোরে নয়। আব্দুল দাঁত কড়মড় করে উঠে এল। ভাবল ঘুমাতে হলে বুড়িকে বাইর করতেই হইবো। হেঁটে এসে বুড়ির হাত ধরল। এত ঠাণ্ডা মানুষের দেহ হয় কখনও সে চিন্তা করে নি। ঠাণ্ডা বরফের রডের মত তার হাত।


বুড়ির গায়ে লেপ নামিয়ে দিল আব্দুল। তাতেও কোন পরিবর্তন নেই। নিচের থেকে ঠাণ্ডা আসছে। কী করা যায়? বুড়িকে কোলে ধরে চৌকির উপর শুইয়ে দিল সে। বুড়ির অস্পষ্ট প্রলাপ তাতেও থেমে গেল না। চৌকির নিচে বুড়ির মাথার কাছে হারিকেনটা বাড়িয়ে দিল আব্দুল। বুড়ি চোখ মেলে তাকাল। ভয়ঙ্কর তার চাহনি। আব্দুল তার কপালে হাত দিল। আরও ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে সে।


দরজা খুলে বাইরের দিকে তাকাল আব্দুল। ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি। কোন মানুষজন নেই।

বুড়ির কাছে এল সে। বরফ হয়ে যাচ্ছে বুড়ি। লেপের মধ্যে ঢুকে পড়ল আব্দুল। বুড়ির পায়ে পা দিয়ে, হাতে হাত দিয়ে মেসেজ করতে থাকল। বুড়ি তবু গরম হচ্ছে না। প্রলাপ বকা থামছে না তার। বুড়ির গায়ের জ্যাকেট খুলে তার কান ও মাথা ভাল করে মুড়িয়ে দিল। পরনের লুঙ্গিটাও খুলে নিয়ে তার এক পা ঢাকল এবং নিজের গায়ের গরম গেঞ্জিটা দিয়ে আরেক পা মোড়াল। বুড়িকে শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরল সে। “বুড়ি তোমার ঠাণ্ডা আমারে দিইয়া দেও, কোনোতা হবে না, আমার বয়স কুড়ি, আর তুমি বাঁইচ্যা যাও।”

তবু বুড়ির পরিবর্তন হচ্ছে না। নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে সে। তার প্রলাপ বকুনি অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হয়ে যাচ্ছে। ততক্ষণে জেগে উঠেছে আব্দুল। উত্তপ্ত কড়াইয়ের মত গরম হয়ে উঠেছে তার শরীর। এ গরম সে ছড়াতে চাইছে বুড়ির সারা গায়ে। যদিও তা অশীতিপর বৃদ্ধা। এতক্ষণে নিজের সতীত্ব হারিয়েছে আব্দুল। বুড়ি তাকে শক্ত করে চেপে ধরেছে। এত শক্ত যে দিশা ফিরে পেয়েছে সে। “বুড়ি!”বুড়ির প্রলাপ বকুনি বন্ধ হয়ে গেছে। রা-শব্দ নেই। শক্ত কাঠের মত হয়ে গেছে শরীর। কোন দিকে হেলে দোলে না। নি:শ্বাস নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে তার। মরে গেছে সে। আব্দুল ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে সে দিকে। এখন কী করার! ভয়ে কাঁপছিল সে। মাথায় কোন বুদ্ধি আসছিল না তার। হঠাৎ ভাবল। যা ভাবল তাই করল। বুড়ির শরীরে ভেজা কাপড়খান কোনমতে পেঁচিয়ে তার মৃত দেহটা নিয়ে মোল্লাদের কুটার পালার পাশে রেখে এল সে। হাতে পুটলিটা ধরিয়ে রাখল। বৃষ্টি পড়ছে ঝপঝপ করে। বাতাস হচ্ছে ঝড়ের মত।


দোকানে ফিরল আব্দুল। শরীর তার ধরে আসছে। দেখল, বুড়ির চাদরটি রুমের মধ্যে। তবু বাইরে বের হওয়ার সাহস হল না তার। ঘুমিয়ে পড়ল সে।


পরদিন ঘুম ভেঙে হোটেল খুলল আব্দুল। মিষ্টি রোদ উঠেছে। মোল্লাদের কুটার পালার পাশে ভীড়। ভীড় ঢেলে এগিয়ে গেল সে। জনৈক বৃদ্ধ মহিলা মরে পড়ে রয়েছে। কেউ তার খোঁজ জানে না।

বুড়িকে এলাকার গোরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হল। আব্দুল তার কাফনের কাপড় কিনে দিয়েছে। আতর লোবান ছিটিয়ে দিয়েছে।



মেহেদী হাসান


ইসরাফিলের হজ্জ্ব যাত্রা


পিঠ বাঁকা করে সামনে সামান্য ঝুকে সামাদ। ইসরাফিলের কোমড়ে কষে গিট দেয়। শক্ত বিষ গিট। উহ্! শব্দ করে ককিয়ে উঠে ইসরাফিল।

পেটে স্থায়ী জমাট বাঁধা নাদুসনুদুস চর্বির উপর প্যান্টের ফিতার তীব্র চাপ। আকস্মিক চাপে ব্যথা। ব্যথায় শব্দটা আপনা আপনি তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে।

সাফল্যের খুঁশিতে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সামাদ। আগে ইসরাফিলের মুখে এমন ব্যথার শব্দ উচ্চারিত হলে রক্ষে ছিল না। কিন্তু আজ সব ব্যতিক্রম। সামাদ উল্টো বুক চেতিয়ে বলে, দুলাভাই অহন আর চিন্তা কইরেন না। ব্যবস্থা এক্কেবারে পাঁকা। খাটি জিনিস। আপনার মান ইজ্জত আটকাইয়া দিছি! কেউ আর নিতে পারবো না। হাঃ হাঃ ..কী বলেন? হাঃ হাঃ...। সামাদের মুখের হাসি অফুরন্ত।

ইসরাফিল কিছু বলে না। মনে মনে বিরক্ত হয়। এমনিতে কম কথার মানুষ। কিন্তু বিরক্ত হলে না ঝেড়ে থাকতে পারে না। তার ব্যবসায়িক বিশ্বাস রাগ, ক্ষোভ, বীর্য এবং টাকা-পয়সা জমিয়ে রাখতে নেই। সঞ্চয়ে অপচয়! লগ্নি করতে হয়।

ইসরাফিল ব্যবসায়িক আদর্শের বাইরে। সামাদকে কিছু বলে না। সামনে তিন দিনের ‘ঐতিহাসিক’ অভিসার। বাকি দেড় কালের শেষ অভিসার! এমন আনন্দের মহাযজ্ঞে কাউকে গালি দিয়ে মন খারাপের মানে হয় না। আজকাল সামাদ না থাকলে ইসরাফিল এক ধরণের অচল। এটা দু’জনেরই জানা। কিন্তু সামাদের আচরণ কখনও সুযোগ সন্ধানী হয়নি।

ইসরাফিলের শরীরে সবুজ রঙের বেঢপ আকারের বাংলা হাফ প্যান্ট। নেতিয়ে পড়া পতাকার মতো ঝুলে আছে। খুব বেশী বেমানান। ততোধিক বেমানান ভুড়ির উপরে ফিতার গিট। তার কালো কুচকুচে উদোম গা। মনে হয় বিশ্বকাপে ক্যামেরুন দলের সেই রজার মিলার। তবে মধ্যপ্রদেশে ইসরাফিল মিলারের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে। অতিমাত্রার উঁচু পেট ট্যাপা মাছের মতো ফুলে আছে।

মাত্র এক ঘন্টার নোটিশে কাপড় কিনে এই হাফ প্যান্ট এবং পরিধানের আয়োজন। রির্জাভ করা বাসে বসে সামাদই প্রস্তাব দেয়। অগত্যা ঘাটে না গিয়ে ফরিদপুর থেকে রাজবাড়ীর নিউ মার্কেট। ইসরাফিলের সঙ্গে জনা বিশেক মানুষ। সবাইকে ঠিক মানুষ বলা যাবে না। অধিকাংশ মাসল্ম্যান। দল বেঁধে দৌলতদিয়া যৌন পল্লীতে ইরাফিলের শেষ অভিসারের সহযাত্রী।

নাচ। নগ্ন নাচ! এ নগ্নতার মধ্যে যৌনতা বা অশ্লীলতা নেই ঠিক। কিন্তু উন্মাদীয় আনন্দ আছে। আহ্লাদী আমোদ। এ দৃশ্য দেখার জন্য সমবেতরা গত দু’দিন অপেক্ষা করেছে। দু’রাত কেটেছে হতাশায়। হতাশার পিঠ উল্টে গেলে আশা হীম সকালে সূর্যের মতো উঁকি দেয়। এ সব বুজরকী কথাবার্তা জেনেই যেন সবার অপেক্ষা। ইসরাফিল এখন উদোম শরীরে নাচছে। সাহস পাচ্ছে না কেউ কাছে ঘেষতে। এমনকি নাচ থামিয়ে প্যান্টটা পরিয়ে দিতেও! সেটা তার থেকে পাঁচ-ছয় হাত দূরে অবহেলায় পড়ে রয়েছে।

চারদিকে হাসির রোল! হৈই হুল্লোড় শুনে যারা দূরে ছিল, ছুটে আসে। শিস্ দেয়। খিস্তি। খেউড়। চিৎকার। ঢোলের বাড়ি। নাচের সহযাত্রী। সব এক নিমিশে বেড়ে যায়। অনেক দিন পর ঘাটের এই পল্লী অন্য রকম আনন্দে খলখলিয়ে উঠে। মজা পুকুরের মাছ যেমন বাঁধ ভাঙ্গা বন্যার নতুন জল গায়ে মাখে। আনন্দে খলবল করে। ঠিক তেমনি লাফালাফি। তেমনি আনন্দে যৌনপল্লী মেতে উঠে।

পৃথিবীর তাবৎ পুরুষের শরীরবৃত্তীয় কীটেরা কামড় দেয় এবং কামনার কামুকতা জেগে উঠে নগ্ননৃত্য দেখার। আজ ব্যতিক্রম! এখানে ইসরাফিল উলঙ্গ হয়ে নাচছে! দূর থেকে মনে হয় এক খণ্ড লম্বা কুঁচকুঁচে অথচ তৈলাক্ত মাংসপিন্ড দ্রুত হেলছে। হেলতে হেলতে দুলে উঠছে। নাচে লয় নেই। তাল আছে। মদের নেশায় তালে তাল মিলে বেতালও হচ্ছে না। তাল মিলছে ঢোলের বাড়ির ছন্দে। ছন্দ আসছে দর্শক সাড়ির আমুদে উল্লাস থেকে। উল্লাস মেখে দর্শকের সাড়িতে উপস্থিত নারী-পুরুষ; এমনকি মানুষও। সবাই এক কাতারে। কেউ এসেছে ইসরাফিলের নাচ দেখতে। কেউ আনন্দের সঙ্গী হতে। আর কেউ বা অন্যের আনন্দ দেখে দেখে নিজেকে বিলীন করতে।

আনন্দের জোয়ার আসে না কেবল সুমীর মা’র চোখে-মুখে। দূর থেকে সে আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করেছিল। আতঙ্ক বাস্তবে এসে অপেক্ষার যতি টানে। সামাদ হাসতে হাসতে আশ্বস্ত করেছিল, বুবু কইস্যা গিট দিছি। মুত আইলেও খুলতো না!

সুমীর মা সামাদের কথা বিশ্বাস করেছিল। আবার শঙ্কাও ছিল। যদি সত্যি সত্যি ‘সেই সময়’ প্যান্ট না খুলে! সব তো ভিজে যাবে! আবার নতুন বিপদ। পাড়ায় নতুন মস্করার উৎপত্তি! ইসরাফিল চলে যাবার পর কম হলেও সাতদিন সরার টিটকেরি সহ্য করতে হবে। ঝিনুকের মতো সয়ে যেতে হবে। সুমীর মা কাউকে কিছু বলতে পারবে না। যুতসই উত্তরও দিতে পারবে না। মনে মনে সবার কথা আবার মেনেও নিতে পারে না। তখন ভেতরে কষ্ট হবে। এত কষ্ট যা গুণে শেষ হয় না। যেমন আকাশের তারা গুণে শেষ করা যায় না। সে রকম। কষ্ট। অনেক কষ্ট।

ইসরাফিল তার বান্দা কাস্টমার। সুমী একমাত্র সন্তান। কাছের মানুষ বলতে কেবল এই দু’জন। বছর দু’য়েক হলো সুমী ‘সেফ হোম’এ থাকে। এই যৌনপল্লী থেকে আশ্রিত সব শিশুরা সেভ হোমে পড়ালেখা শিখছে। মানুষ হচ্ছে। পতিতা(!)’র মেয়ে হয়েও সুমী ভবিষ্যৎ যৌনকর্মী হবে না। একজন যৌনপল্লীর মায়ের কাছে এর চেয়ে বড় স্বপ্নের আর কী হতে পারে? এমন আশার ঘরে-স্বপ্নের ঘরেও পিতার পরিচয় লাগে! আশ্রিত শিশুদের রেজিস্টারে নাম লিখতে হয়। সে নাম, নামের একক পরিচয় সন্তুষ্ট করতে পারে না ‘পঞ্চম প্রজন্ম’ নামের নতুন সভ্যতাকে! হোমে পিতার পরিচয় লাগে। ভর্ত্তি করাতে গিয়ে সুমীর মা চিৎকার করে বলতে চেয়েছিল, খানকীর মেয়ের আবার জন্ম কিসের? পরিচয় কিসের? পল্লীর সব মাইয়্যারা হলো এক একজন মা মেরী।

মিশনারীর লোকেরা একবার ছোট ছোট কিছু বই দিয়েছিল। সুমীর মা সেখানে ‘মা মেরী’কে আবিস্কার করে। কিন্তু সুমীর বাবার নাম কী? কে তার বাবা? জানে সুমীর মা। জানে আরও পল্লীর অনেকে। কিন্তু ভয়! পরিচয় দেবার অনুমতি কোথায়? রেজিস্টারের ঘর থাকে ফাঁকা। সুমীকে নিয়ে ফিরে আসেন একজন মেরীর মা।

ইসরাফিল কাস্টমার হয়ে আসার পর সুমীর মা অন্য কাউকে কোনোদিন নেয়নি। ইসরাফিল দেয়নি। কেউ সাহসও পায়নি সুমীর মার দিকে হাত বাড়াতে। বিনিময়ে লোকটা তার কোনো অভাব রাখেনি। আবার পল্লীর বাইরেও নিয়ে যায়নি। সুমীর মা বুঝতে পারে না কী করবে? ইসরাফিল ঘরে এলে ভয়ে ভয়ে কথাটা বলে। লোকটা কোনো উত্তর দেয়নি। সকালে যাবার সময় সুমীর হাত ধরে সেভ হোমে নিয়ে যান। পূরণ করে দেয় রেজিস্টারের ঘর। বিনিময়ে ইসরাফিল পায় দেবতার ভালোবাসা।

মানুষটা পল্লীতে এলে অন্য ঘরেও যায়। করুক না যা ইচ্ছে। সব কিছু মেনে নেয় সুমীর মা। মানতে পারে না কেবল মদ এবং নাচের নেশায় পাওয়া উলঙ্গ নাচ। লোকটা নাচতে গেলেই লুঙ্গি ঝরে পড়ে। প্রাগৈতিহাসিক উলঙ্গ নেশার আনন্দ পায় ইসরাফিল। আর বাজে কথা শুনতে হয় সুমীর মায়ের। শেষ অভিসারের শেষ রাতের সুমীর মা দূর থেকে মনে মনে প্রার্থণা করে। লোকটা আরও মদ গিলুক। মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ুক। কিন্তু সে জানে আকাশে আলো ফোটা পর্যন্ত এ নাচ চলবে। নাচ শেষে এ পল্লী ঢলে পড়বে। লোকটাও চলে যাবে। নাকি আর আসেব না? কথাটা বিশ্বাস করে সে। আবার করে না। সামাদও তাই জানিয়েছে। সামাদের কথা মনে হতেই তার মনে একা একা রাগ হয়।

সামাদ আপন কেউ না। কিন্তু কেন জানি সামাদ ছেলেটা তারে বোনের মতো মনে করে। ইসরাফিল টাকা-পয়সা যা দেয় সব সামাদের হাত দিয়েই পাঠায়। দরকার হলে সে সামাদের কাছ থেকেও চেয়ে নেয়। সামাদের মতো তার একটা ভাই কেন থাকলো না? ভাই কি বোনকে এই নরকে রেখে দিত? সুমীর মায়ের বুক টনটন করে উঠে।

সামাদ একাই না। কম চেষ্টা করেনি ইসরাফিলের সাঙ্গপাঙ্গরা। সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। চ্যুতি-বিচ্যুতি মাথায় রেখে চেষ্টারও কোনো ত্রুটি ছিল না। অবশেষে শেষ রক্ষা হলো না! ঘটনাটি সামাদকে লজ্জ্বায় ফেলে। সালু কাপড়ের উপর ইসরাফিলের সবুজ প্যান্টের দিকে তাকায়। লালের মধ্যে এক খণ্ড সবুজাভাব। জাতীয় পতাকার উল্টোপিঠ! পতাকার উল্টো পিঠ বলতে কিছূ আছে কি? মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে সামাদ।

সামাদের ইচ্ছেও হয় না প্যান্ট তুলে দুলাভাইয়ের হাতে দিতে। দিলেও লাভ হবে না। জানে তা। ফিতা নেই! সামাদ লাবুর কোমড়ের দিকে একবার তাকায়। রাগে গজ গজ করতে করতে সে বিভৎস নাচের রঙ্গিন চিৎকারের উল্লসিত মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসে। মঞ্চ বলতে দু’সারি বাঁশ দিয়ে ঘেরা চৌকোণা জায়গা। মাটিতে ত্রিপল। তার উপর মোটা সালু কাপড় বিছিয়ে ইসরাফিল এবং সাঙ্গদের যাবতীয় ফূর্তির ব্যবস্থা। বাঁশের ওপাশে সাজানো দশ/বারোটা জেরিকেনে ভর্তি বাংলা মদ। একজন সাবাইকে তা বিলিয়ে দিচ্ছে। বাঁশের ভেতরের দিকে টেবিলে সাজানো বিদেশী মদ। বাংলা মদ সমবেত দর্শকদের জন্য। ঘোষণা আছে তিন রাতের বাংলা মদ সবার জন্য এবং দলের সঙ্গীদের জন্য যত ইচ্ছে বিদেশী মদ ও যৌনকর্মী ফ্রি।

এবার আয়োজনটা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম হয়েছে ইসরাফিলের পোষাক আর টাকা ব্যায়ের উচ্ছৃঙ্খলতায়।

সপ্তাহ খানেক আগে সে বিস্ময়কর তথ্য দিয়ে বলেছিল, বুঝলি খানকী পাড়ায় এবার শ্যাষবার যামু। যত ইচ্ছা খরচা করবি। অনেক দিন পাড়ার সব্বাই যেন আফসোস করে ইসরাফিল বাপের ব্যাটা কাসটোমার আছিল একখান। কথা বলেই ইসরাফিল হুত হুত হুত করে হাসে।

সামাদ এমন কুৎসিত ভঙ্গির হাসি আর কারও দেখেনি। ইসরাফিল এমন হুত হুত করে হাসলে মাংসল চেহারা হয় হায়নার মতো। চোখা। শব্দওটা যেন কেমন! হায়নার মতো কি? যদিও সামাদ কখনও হায়না’র হাসি শোনেনি। কোনো বইতে পড়েছিল হায়নার হাসি নাকি ভয়ঙ্কর! যাই হোক ইসরাফিলের ইচ্ছার কথা শুনে সামাদ অবাক এবং একই সঙ্গে উৎকণ্ঠিত। কোনো ব্যামো? খারাপ কিছু? দুলাভাইয়ের এমন কথা বিচলিত করে দেয় তাকে। সে ইসরাফিলের গদির উপর পাশে উঠে আসে এবং নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করে, বস্ এমন কথা কইলেন ক্যান?

ঠিক করছি হজ্জ্বে যামু। পাক-পবিত্র হইয়া আসুম। তারপর কমিশনার গিরিও ছাইড়া দিয়া ব্যবসা-পাতি নিয়া জীবন কাটামু। এক সঙ্গে ঠিক করছি তোরে একটা বিয়াও দিমু।
বিয়ের কথা শুনে সামাদ কেমন একটু আনমনা হয়। গদি থেকে নেমে বাইরে যেতে যেতে বলে, দুলাভাই আপনের মন আজও বুঝবার পারলাম না।

সামাদ আড়তের বাইরে আসে। সিগারেট জ্বালিয়ে নদীর দিকে জলের দিকে হাটতে থাকে। পদ্মা পাড়ের সি এন্ড বি ঘাটে ইসরাফিলের বেশ বড় আড়ত। এখানে ধান-চাল কিনে রাখে। ঢাকার পাইকারী বাজারে পাঠায়। পৌরসভার কমিশনার হবার পর দুলাভাইয়ের ব্যবসা যেন বিশাল থেকে বিশালতা ধারণ করে। বর্তমানে তার ট্রাকের সংখ্যা এক কুড়ি। আড়তের ব্যবসা ছাড়াও আছে ডেকোরেটর এবং জমি কেনার নেশা। দরিদ্র মাস্টারের ছেলে সে। একমাত্র বোনের বিয়ে দেয়ার পাঁচ বছর পর বাবা মারা যান। মা সেই ছোট বেলায়। বাবার মৃত্যুর পর দুলাভাইয়ের সার্বক্ষনিক সঙ্গী। সে ইসরাফিলকে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আশ্রয়দাতা এবং মাতৃসম বোনের স্বামী। এ সব কিছু জীবনের বৈচিত্র্য বলে সামাদ মেনে এবং মনেও নিয়েছে। উপরন্তু সামাদের উপর ইসরাফিলের আকন্ঠ বিশ্বাস। সব কিছু মিলিয়ে বসবাসের একটা ক্ষেত্র এবং বলয়ও তৈরী হয়েছে। এ বলয় ভেঙ্গে বেরিয়ে যাবার ইচ্ছে তার আর নেই। কিন্তু ‘বিয়ে’ শব্দটা সামাদকে নতুন দিনের হাতছানি দিয়ে ডাকে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় আগামী নির্বাচনে কমিশনার প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার।

সামাদ সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক মতো করলেও মাত্র ক্ষুদ্র একটা ভুল। গত দু’রাতে নাচের আসর থেকে ইসরাফিল যতবার বাথরুমে গেছে সঙ্গে সে ছিল। কাজ শেষে প্যান্টে শক্ত গিটও দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এবার কি মনে করে যেন লাবুকে পাঠায়। হারামজাদা এতই মাতাল দুলাভাইয়ের প্যান্টের ফিতা নিজের কোমড়ে বেঁধে নিয়ে এসেছে!

রাত গভীর থেকে গভীর হতে থাকে। এক সময় গভীর তল স্পর্শ করে আবার উঠে আসতে থাকে। এ সময় একজনকে হাতের নাগালে পেয়ে ইসরাফিল মঞ্চে টেনে নেয়। চুমাচাট্টিও খায়। এমন ঘটনা দেখে অন্যান্য যৌনকর্মী-দর্শকেরা হুড়মুড় করে মঞ্চে ঢুকে পড়ে। মাতালদের উন্মাদীয় নৃত্যের তালে এবার যৌনকর্মীরাও অংশ নেয়।

সামাদ ভয় পায়! এখনই আবার ঘটবে কী নতুন কোনো কেলেংকারী? ধর্ষণ কিংবা কোনো নির্যাতন! তাকে বিস্মিত করে পুরো মঞ্চ যেন তালে তাল মিলিয়ে নাচতে থাকে। সমবেত নাচের তালে ঢেকে যায় ইসরাফিলের নগ্নতা। নগ্ন শরীর। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য সামাদের ছেলেবেলার কথা মনে করিয়ে দেয়। জৈষ্ঠ্য মাসের অলস দুপুরের ধান ক্ষেত। সামাদ দেখতে পেত ক্ষেতের উপর দিয়ে বাতাস কেমন ঢেউ তুলে পুরো মাঠ দুলিয়ে দিত। ক্ষেতের দুলুনী দেখলে মন কেমন চঞ্চল হতো। ঠিক তেমনি এই যৌনপল্লীর উল্লাসিত মাতাল নারী-পুরুষ এবং মানুষেরা অজানা বাতাসের ছন্দে দুলছে। নাচের মঞ্চটাকে সামাদের মনে হয় জৈষ্ঠ্যের ধান ক্ষেতের মতো ঐশ্বরিক।
ভোরের আলো ফুটতে ইসরাফিল অন্য মানুষ। যেমন অন্য মানুষ হয়ে আড়তে বসে। সুমীর মা’র ঘরে যায়। কেউ নেই। বিছানার স্ট্যান্ডে ঝোলানো পাজামা-পাঞ্জাবী নিয়ে পড়তে যায়। এই প্রথম খেয়াল করে তার শরীরে শাড়ী পেচানো। সুমীর মায়ের। পোষাক পাল্টে ঘরের বাইরে আসে। সামাদ অপেক্ষা করছে। কী রে সবাই বাসে উঠছে তো?
সামাদ ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়।
দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর শেষ সীমানায় আসতেই ইসরাফিল সুমীর মার মুখোমুখি। প্রত্যেকবার চলে যাবার সময় সে এ পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। এবার আগেই এসে দাঁড়িয়েছে। ইসরাফিল বলে, সুমীর মা আমার জন্য দোয়া করো। যেন বালা-মুসীবত কাটায় ফিরতে পারি। আর তোমার জন্য যা যা করা দরকার সব সামাদ করবো।
সুমীর মা কিছু বলে না। ইসরাফিল নিজের পথ ধরে। একটু এগিয়ে আবার ফিরে আসে এবং জিজ্ঞাসা করে, হজ্জ্বে যাইতাছি। বল, আল্লাহ’র ঘরে গিয়া তোমার জন্য কী চামু?
সুমীর মা যেন কিছু চিন্তা করে এবং বলে, আমার জন্য কিছু চাইতে হইব না। তয় আমার একটা কথা রাখবেন সুমীর বাপ?
ইসরাফিল সম্মতি দেয়।
বলেন রাখবেন? আবার প্রশ্ন করে সুমীর মা।
রাখবো। বলো তো। কিছুটা বিরক্তি।
আপনি হাজী হইয়া ফিরা আইবেন। আমার ভালা লাগতেছে। খুব ভালোলাগতাছে। তয় কথাটা হইল আপনি হাজী হইলে তো ফুর্তি করতে আর এই হানে আইবেন না। তয় একদিন আইবেন। আমি জানি। আইবেন এই পল্লী উঠাইয়া দিতে। আমার অনুরোধ সেই দলে আপনি থাইকেন না।