অন্তহীনেই অন্তমিলের খেলা
(১)
আজকাল প্রায়ই মনে হয় যা লিখতে চাই তা আর নতুন কী? নতুন করে কী আর বলার আছে আমার? মনে হয়, যা লিখি তা তো সকলেই জানে। সত্য যে স্বয়ং প্রকাশ! নতুন করে তাকে আর প্রকাশিব কী! এইসব ভাবতে ভাবতেই দিন চলে গিয়ে রাত আসে, রাত গিয়ে আবার নতুন একটি দিন। কাজের কাজ কিছুই হয় না।
অসংখ্য ভাবনা আজ-কাল প্রায়ই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই যে আমরা মানুষ, আমাদের চালায় কে? ...মস্তিস্ক? কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় মস্তিস্কের অধিক আরো কিছু আছে। মনে হয়... মনে হয়... নাহ! ঠিক ঠিক ধরতে পারি না। কিন্তু আমার পথ চলা থামে না। বরং আরো বেগ প্রাপ্ত হয়ে অসংখ্য প্রশ্নের মুখামুখি দাঁড় করিয়ে দেয় নিত্য নতুন ঢংয়ে। সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার বলে কী সত্যিই কিছু আছে? মানুষ চাইলেই কী অন্য মানুষের মনের কথা জানতে পারবে? অথবা সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে যে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ আজকের সভ্যতায় এসে পৌঁছালো এবং হারিয়ে গেল অস্ট্রালোপিথেকাস, রামাপিথেকাস সহ অন্যান্য যুগের মানুষের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, কেন হারালো? ইতিহাস বলছে বিবর্তনের প্রতিযোগিতায় অর্থাৎ প্রকৃতির উপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে না পারাই এর মূল কারণ। তাহলে যারা টিকে গেল তারা কোন শক্তির বলে প্রকৃতির উপর নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছিল? আবার এই সভ্য মানুষই বা ভবিষ্যতে বিবর্তিত হয়ে কী হবে? নাকি এখানেই আটকে যাবে বিবর্তনের এই সুদীর্ঘ অধ্যায়?
আমার প্রশ্নের উত্তর মেলে না। আমি অস্থির চিত্তে স্থিরতার ভান ধরি। শেষ-মেষ কোন কূল- কিনারা না পেয়ে অসহায় আত্মসমর্পন কার কবিতার কাছে। বসে বসে কবিতা পড়ি।
তুমি আমাকে নেবে? ঘাসফুল, নেবে? খেলায়?
আমি দিন ফুরিয়েছি ঘুরে ঘুরে মেলায়,
আমার যা কিছু আছে নাও,
তবু একবার স্পর্শ করো আমাকে, ছুঁয়ে দাও।
এসেছি তোমার কাছে বড়ো অবেলায়।
তুমি যদি ছুঁড়ে ফেলো হেলায়,
ভাসিয়ে দাও নিরুদ্দেশে ভেলায়
আমি ফিরে তোমার কাছেই যাব
শতবার নিজেকে হারাব
-দিলরুবা
কোন কোন কবিতার লাইন আমাকে ভীষণভাবে জাগিয়ে তোলে। তখন তাদের মধ্য থেকেই কোন টিকে মন্ত্রের মতো আওড়াই
কিছুটা সময় দিলে তবে দুধে সর ভেসে ওঠে
-বিনয় মজুমদার
আমি আশায় বুক বাধি। নিজেকে মহাকালের বৃত্তে ছেড়ে দিয়ে ‘সরের’ প্রত্যাশা করি।
০২.
এই যে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আমরা দেখি। ফর্সা, কালো, বেটে, লম্বা, মোটা, চিকন- সত্যিকার অর্থে এর মধ্যে কতজন প্রকৃতমানুষ? এঁদের মধ্যে কতজন উর্ধ্বতর চেতনায় উত্তীর্ন? আবারও অর্ন্তগত প্রশ্নের মিছিল আমাকে তাড়া করতে থাকে। কোথায় যেন পড়েছিলাম- পৃথিবীতে আমরা কেউই স্বতন্ত্র নই। অন্যান্য মানুষের চিন্তাতরঙ্গ দ্বারা আমরা প্রভাবিত হই, ত্বারিত হই। সুতরাং আমি বা আমরা যা এই মুহুর্তে ভাবছি বা করছি তা আমাদের আগে কেউ একজন ভেবেছে বা করেছে। যার ভাবতরঙ্গ বা চিন্তাতরঙ্গ এই মুহুর্তে আমার বা আমাদের চিন্তাতরঙ্গকে প্রভাবিত করছে। এই প্রসঙ্গে কমরেড চারু মজুমদারের একটি কথা মনে পড়ছে। হুবহু বলতে পারবো না। তবে কথার মূল অংশটি এ রকম- তিনি তাঁর অনুসারিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আমাদের কোন প্রচারণাই ব্যর্থ হবেনা। এর প্রতিটি কথাই পৃথিবীতে থেকে যাচ্ছে। শক্তির কোন ক্ষয় নেই। তা কোন না কোন সময় কাউকে না কাউকে অবশ্যই প্রভাবিত করবে, এবং সেদিন আমাদের বিজয় নিশ্চিত হবে।
...তার মানে আমরা প্রতিনিয়ত সকলের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি! কিন্তু প্রভাবিত তো কেবল শক্তিশালী চিন্তাতরঙ্গ বা ভাবতরঙ্গই করতে পারে অপেক্ষাকৃত দূর্বল ভাবতরঙ্গকে। তার মানে যদি আমার ভাবতরঙ্গ শক্তিশালী না হয় তাহলেই প্রভাবিত হয়ে যাব? ভাবনাটা আরো গভীর থেকে গভীরে পৌঁছে যায়। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করি। হাঁটি। মানুষের মুখের দিকে তাকাই তার ভেতরটা দেখার জন্য। চা খাই। মুখ ভর্তি সিগারেটের ধোঁয়া নিয়ে কুন্ডলি পাকিয়ে আবার ঠেলে বের করে দেই। দেখি ধোঁয়ার কুন্ডলী গুলো স্বাধীন ভাবে উড়তে উড়তে হারিয়ে যাচ্ছে। আমার এ ভাবনাটাও কি এভাবেই হারিয়ে যাবে; উত্তরহীন? উদ্দেশ্য নিয়ে নিরুদ্দেশে ঘুরে বেড়াই প্রতিদিন।
০৩.
এক সময় মনে হতো মেয়েরা একটা নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতার উপর উঠতে পারেনা। এখন মনে হয় প্রতিটি মানুষই তো সীমাবদ্ধ। সে নারী-পুরুষ যেই হোক। সীমাবদ্ধ মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতারও সীমাবদ্ধতা থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। নইলে মানুষ আর মানুষ কেন? মানুষ আর দেবতার পার্থক্যই বা করা হতো কিভাবে? তাহলে কী এই সীমাবদ্ধ মানুষের ভাবতরঙ্গ দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে আছে পুরো পৃথিবী? আর অন্যসকলে এই সাধারণ ভাবতরঙ্গ দ্বারা প্রতিনিয়ত প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছে? আমার ভাবনায় আরো শক্তিশালী জট পাকিয়ে যায়। তবে কী এই সীমাবদ্ধ ভাবতরঙ্গকেই আমরা মায়া বলি? হঠাৎ আমার চোখে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কিছু একটা জ্বলে উঠে আবার মিলিয়ে যায়। হতে পারে নতুন কোন পথের দিশা অথবা দিশাহীন এক অন্যতর সংকট। এইসব সংকট আর সম্ভাবনার ভেতর দিয়ে চলতে চলতে দেখি প্লেটোর নন্দনত্বাত্তিক দর্শনের ‘থিওরী অব আইডিয়া’ তে বলা হচ্ছে- আমরা যা কিছু দেখি অর্থাৎ এই যে দৃশ্যমান জগৎ, এ আসলে প্রকৃত জগৎ নয়। প্রকৃত জগৎ আছে এই দৃশ্যমান জগতের বাইরে। আমাদের অন্তর্গত যে ভাবের জগৎ বা অনুভূতির জগৎ আছে দৃশ্যমান জগৎটি সেই জগতেরই ছায়ামাত্র। আবার আমাদের প্রচ্যের দর্শনও এই একটি কথাকেই সমর্থন করে আসছে। আমাদের বৈষ্ণব দর্শন, বাউল দর্শনও বলছে সেই প্রকৃত জগতের কথা; সমস্ত লৌকিকতার উর্ধ্বের সেই অতিমানস জগতের কথা।
কিন্তু সমস্ত লৌকিকতার উর্ধ্বেই যদি প্রকৃত জগত থেকে থাকে তবে কবি কেন বলেছেন-‘মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুরাসুর’? তাহলে নিশ্চয়ই এই মানুষের মাঝেই আছে শ্রেণী ভাগ। আমার ভাবনা গুলো চৈতালী বাতাসে উড়ে ওঠা ধুলোর মতো শূন্যে উঠে হাওয়ায় মিলায়। গুম হয়ে বসে থাকি। আরো গভীর কোন মৌনতায় খুঁজি শব্দের কোলাহল। আবারও রাত্রি নেমে আসে। বিছানায় যাই। আমার চোখে ঘুম নেই। শব্দ নেই। কবিতা নেই। চা, মদ, নারী নেই। কাম নেই। প্রেম নেই। কেবল অসংখ্য প্রশ্ন সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরে ছোবল মারতে চায়। আর আমি একা, এই সমস্ত কিছু থেকে পালাতে চাই। আমি পালাই। দৌড়াই। আশ্রয় নেই আমার ভেতর।
মাত্র একটু তন্দ্রাভাব এসেছে। ঠিক তখনই, কে যেন ভেতরে ভেতরে অনর্গল বলতে লাগলো-
‘এই প্রকৃতিতে সমস্ত শক্তিই আছে। মানুষ তার চাওয়ার সাথে সঙ্গতি রেখে চেতনে অথবা অবচেতনে এই শক্তির সাথে সংযোগ স্থাপন করে এবং সেই শক্তি অর্জন করে। এভাবে একেকজন একেক শক্তি সঞ্চয়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে সেই শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে । এভাবেই মানুষ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যায়। মানুষের এই শ্রেণীভাগ দেবতা থেকে অসুর পর্যন্ত অথবা তারও বেশি। অর্থাৎ একই শারীরিক কাঠামোর ভেতরে একেকজন লালন করে একেক ধরণের শক্তি। কেউ ধনাত্মক শক্তির প্রতিনিধি আর কেউ ঋণাত্মক শক্তির। এখানে দেবতাকে যদি ধনাত্বক শক্তির সর্বোচ্চ প্রতিনিধী আর অসুরকে ঋণাত্বক শক্তির সর্বোচ্চ প্রতিনিধী ধরে নেওয়া হয়, তাহলে দেবতা আর অসুরের মাঝামাঝি যারা যারা অবস্থান করছে তাদেরও আরো কিছু সাধারণ শ্রেণী আছে।
এই ভিন্ন ভিন্ন সাধারণ মানুষগুলোর চেতনাতরঙ্গ বা ভাবতরঙ্গ স্বাভাবিক ভাবেই বেশি ক্রিয়াশীল। কারণ তাঁরাই সংখ্যায় বেশি। এই বেশি সংখ্যক মানুষের ভাবতরঙ্গ প্রতিনিয়ত অপেক্ষাকৃত দূর্বল চেতনাতরঙ্গ বা ভাবতরঙ্গকে প্রভাবিত করছে। আবার অপেক্ষাকৃত উন্নত ভাবতরঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে সাধারণ ভাবতরঙ্গ। এই ভাবে সবচেয়ে উচ্চতম ভাবতরঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে নিম্নতম ভাবতরঙ্গ আবার ক্ষণিকের অসতর্কতায় নিম্নতম ভাবতরঙ্গ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছে উচ্চতম ভাবতরঙ্গ। কিন্তু যদি প্রতিনিয়ত এই নিম্নতম ভাবতরঙ্গ দ্বারা উচ্চতম ভাবতরঙ্গ প্রভাবিত হয়ে যায় তবে সেটা হবে মানুষের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু সাধারণ ভাবতরঙ্গ বেশ শক্তিশালী হওয়ার ফলে প্রতিটি মুহুর্তে উচ্চতম ভাবতরঙ্গ প্রভাবিত হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। যখন এই নিম্নতম ভাবতরঙ্গ দ্বারা উচ্চতম কোন ভাবতরঙ্গের প্রতিনিধি প্রভাবিত হয়ে যায় তখনই সেই ব্যক্তির পদ স্খলন ঘটে। সেই মানুষটির ব্যক্তি জীবনে কিংবা সামাজ জীবনে বিভিন্ন অসংগতি তথা বিচ্ছন্নতা দেখা দেয়। এই ভাবে ব্যক্তি থেকে এই সকল অসংগতি ছড়িয়ে পড়ে পরিবারে, সমাজে, দেশে, রাষ্ট্রে, পৃথিবীতে। সুতরাং পৃথিবীর ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য উচ্চতম ভাবতরঙ্গ, বলা যায় উচ্চতম চেতনায় উন্নিত হওয়া খুবই প্রয়োজন। কিন্তু যেহেতু পৃথিবীময় একটি শক্তিশালী সাধারণ ভাবতরঙ্গ সর্বদা ক্রিয়াশীল সুতরাং উচ্চতর ভাবতরঙ্গের প্রতিনিধিদের প্রতিমূহুর্তে অনেক বেশি সচেতন থেকে হতে হবে উচ্চতর চেতনার ধারক। তাহলেই ক্রমাগত নিম্নতর ভাবতরঙ্গের প্রতিনিধিরা রুপান্তরিত হতে হতে গড়ে উঠবে এক অন্যতর পৃথিবী। মহাকালের খেরোখাতায় কেবল তারাই বিজয়ী হিসেবে টিকে থাকবে।’
যেন মুহুর্তে আলোর বন্যা বয়ে গেল মনের মধ্যে। আহা! এ কী কেবলই তন্দ্রাঘোর! একে একে যেন সমস্ত প্রশ্ন গুলোর জট খুলে যেতে লাগলো। তাহলে এই যে প্রতিদিন আমারা মানুষ দেখি এর মধ্যে একেকজন একেক শক্তির প্রতিনিধি! আর সেই সব মানুষ, যারা বিবর্তনের প্রতিযোগিতায় টিকে গিয়েছিল তারা নিশ্চয়ই এক উন্নত চেতনায় উত্তীর্ন হয়ে প্রকৃতির উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছিলো। আর এভাবেই বুঝি বিবর্তনের পরবর্তী ধাপে আজকের এই আধুনিক মানুষ উন্নত চেতনার ধারক হয়ে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠবে মহা মানব! অর্থাৎ মানুষের মধ্যে প্রবেশ করবে সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার!
আমার ভাবনা এবার মানুষ ছাড়িয়ে চলতে লাগলো কবিতার দিকে, শিল্পের দিকে। তাহলে কালোত্তীর্ন শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে মানুষকে কোন চেতনার ধারক হতে হবে? অথবা যারা মহাকালের আলফা নগরীতে টিকে আছে, তাঁরা কোন চেতনাকে লালন করেছেন আত্মার গভীরে?
...প্রশ্ন আমাকে ছাড়ে না। আবার আমিও প্রশ্নকে না। অবচেতনে সম্ভবত আমিই এইসব প্রশ্নগুলোকে সযত্নে আগলে রাখি আমাকে জানার জন্য। কখনো উত্তর পাই, কখনো পাইনা। তবু মাঝে মাঝে মনে হয় যা কিছু পৃথিবীতে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, যে ক্ষমতার বলে ভরে উঠছে শিল্পীর ক্যানভাস, কবির খাতা, লাভ হচ্ছে সাধকের সিদ্ধি, গায়কের কণ্ঠ হয়ে উঠছে সুরেলা, এই সব কিছুর পেছনে আছে মহাজাগতিক এক অন্যতর মহাশক্তি। মনে হয়, এই বিশ্বজগতের, এই বিশ্ব প্রকৃতির অন্তহীনে প্রতিনিয়তই চলছে এক অন্তমিলের খেলা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন