শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
সম্পাদকীয়
বড় বড় সাহিত্য পুরস্কারের নেপথ্যে কোন ব্রেন ইটিং অ্যামিবা
কেরালায় নেগলেরিয়া ফাউলিয়া নামক এককোষী নিছক একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব আমাদের মতো বহুকোষী জীবশ্রেষ্ঠ মানবদের মস্তিষ্ক শুনছি ইদানীং ভক্ষণ করে চলেছে। বাংলাতেও এ ভারি চিন্তার ব্যাপার। চিন্তা? যন্তরমন্তরে ঢুকে যাওয়া বঙ্গে চিন্তা-টিন্তা কোত্থেকে আসে? ‘সকল দেশের রানি সেজে’ এই বঙ্গভুমে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কোথায় -- না আছে তার ব্যবহার, না আছে ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতা, না আছে প্রশ্ন তোলার মতো ফ্রন্টাল লোবের উৎপীড়ন। মস্তিষ্কের যদি নিজেদের ভালোমন্দ বোঝার মতো পীড়াই না থাকে তাহলে মস্তিষ্ক থেকেই বা লাভ কী! অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিক ‘হুলি গান-ইজম’-এর গানের কলিগুলি তাই সত্যি – “সুতরাং মরুক মরুক মরুক যত শুকনো পাতা ঝরুক / ঝরে যাক।”
এই অণুজীবটি কিন্তু যে সে ব্যক্তি নয় হে, জীব সৃষ্টির প্রথম রূপগুলির মধ্যে একটি। অর্থাৎ বলা যায় বিবর্তনের সৃষ্টিকর্তা কিন্তু যখন তখন পারে বিবর্তনের নিশান মিটিয়ে দিতে। যাইহোক, ৮৬ বিলিয়ন নিউরন সমন্বিত মস্তিষ্ক স্রেফ খেয়ে ফেলা মুখের কথা নয়। তা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে এই ব্রেন-ইটিং অ্যামিবা যেন কবেই প্রবেশ করে গেছে বঙ্গীয় সমাজের মস্তিষ্কে, এখানে আমাদের বিষয় যেহেতু সাহিত্য তাই বিষয় কেন্দ্রিকতা আনতে বলা যায় ব্রেন ইটিং এর কুফল ভোগ করছে বর্তমান সাহিত্যসমাজ। নইলে এই যে প্রত্যেকবার বিবিধ সাহিত্যসংস্থাগুলি থেকে যে সব সাহিত্য পুরস্কারগুলি ঘোষিত হচ্ছে, তার প্রকৃত মূল্যায়ন নিয়ে কীভাবে যেন নীরব থাকছে পাঠক-পাঠিকা গোষ্ঠী, পত্রিকাগোষ্ঠী, লেখক-কবি গোষ্ঠী, সর্বোপরি সমালোচক গোষ্ঠী। একবার ফেসবুক কমেন্টে পড়েছিলাম, পুরস্কার হল শিশুকে নতুন জামা পরানোর মতো, পরিধান করলেও ভালো লাগে আবার না করলেও ভালো লাগে। একজন প্রকৃত যোগ্য লেখকের ক্ষেত্রে একদম সত্যি। কিন্তু এখানে একটা ব্যাপার আছে, বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত এইসব পুরস্কারগুলির নিরিখে প্রত্যহ সংগঠিত হচ্ছে একটা বৈষম্য। তাৎক্ষণিকভাবে আধা মস্তিষ্কের পাঠকদের কাছে তৎসহ আধা মস্তিষ্কের সম্পাদকের কাছে এই পুরস্কারপ্রাপ্তির বৈষম্যের নিরিখে তৈরি হচ্ছে উচ্চবর্গের লেখক ও নিম্নবর্গের লেখক – উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আদম খুঁজছিল ইভকে। এখন একজন সুশীলা তিনি একটি কহ-তব্য পুরস্কার পেলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে আদমবাবুও খুঁজে পেলেন তাঁর কাঙ্খিত ইভকে, আর বাকি সব হয়ে গেল ক্লীব। সুতরাং এই কথা সহজেই অনুধাবনযোগ্য-- বৈষম্যের একদিকে থাকছে স্টারকাস্ট আর অন্যদিকে তিলে তিলে তৈরি হচ্ছে স্টারডাস্ট। এখন মনে রাখতে হবে এই নক্ষত্র আর নক্ষত্রচূর্ণ মিলিয়েই আমাদের সাহিত্যসম্পদ। কখনও সখনও সম্ভাব্য নক্ষত্র অবহেলায়, অনালোচিত হয়ে নক্ষত্রচূর্ণে পরিণত হয় যা আগামী দিনে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে একটা ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি করবে। অন্তত বিগত কয়েক বছরের প্রদত্ত সাহিত্যসম্মানগুলির গতিপ্রকৃতি যেদিকে ধাবিত হচ্ছে তাতে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে -- যেসব সাহিত্যসৃষ্টিগুলি সম্মানিত বা পুরস্কৃত হচ্ছে তা আদৌ গুণগত মানসম্মত কিনা? কিন্তু বিবেচনা করার মানুষ কোথায়, প্রশ্ন কোথায়!
যেমন আমরা যদি এই বছর শুধুমাত্র যুবাদের দেওয়া হয়, এমন একটি বাংলাভাষায় সর্বভারতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কাব্যগ্রন্থের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, বিস্ময়চিত্তে দেখি, একবিংশ শতকের এক চতুর্থাংশ যেখানে শেষ হতে চলেছে তখনও পুরস্কারপ্রাপ্ত সেই কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায় অপরিপক্ক লেখনীতে ‘আমি’–‘তুমি’ এর প্রবলমাত্রায় আধিক্য। অবাক হতে হয় এই দেখেও যে পুরস্কৃত কবি এই বিষয়ে হয়তো অবহিতই নন যে কীভাবে ক্রিয়াপদকে ব্যবহার করে কবিতার পঙক্তি থেকে সর্বনাম পদ অবলুপ্ত করতে হয়। বহু কবিতায় অনুজ্ঞাবাচক পঙক্তি সমন্বিত, ‘মতো’ শব্দের সরাসরি অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, চিত্রকল্প নির্মাণে অপারদর্শীতা বারবার পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোন স্বতন্ত্র স্বর উপহার পেল বাংলা সাহিত্য। তাহলে এই বইতে কী আছে? শান্ত ভাসিয়ে দেওয়া স্বর? চিরুণি তল্লাশি করেও পুরস্কৃত হবার মতো শান্ত মোহময় আবহ নির্মাণ খুঁজে পেলাম না, প্রায় প্রতিটা কবিতাতেই শেষে আমিত্বের অবস্থান, আধুনিক কবিতার মুক্ত সম্প্রসারণ বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। বুঝতে পারলাম না তাহলে তাঁকে কোন নিমিত্তে পুরস্কৃত করা হল! বাংলা সাহিত্য এই পুরস্কার বা উৎসাহ প্রদানে কী লভ্যাংশের অংশীদার হল!
শুনছিলাম, নেগলেরিয়া ফাউলেরি রোগ আক্রান্তকারী ঘাতক অ্যামিবাটি জলের মধ্যে থেকে মানুষকে আক্রমণ করছে। লোকজনকে বলছি নোংরা জল, পচা জল, ভালো জল কোনও জলেই বাবা নেবো না। কোন জলে যে অ্যামিবাটি আছে বোঝা মুশকিল। কেস সেই একই -- যোগ্য জল, অযোগ্য জল আলাদা করা যাচ্ছে না। তেমনই যোগ্য পুরস্কার, অযোগ্য পুরস্কারও এখন আর কেউ আলাদা করছে না। কিন্তু তা বলে কি যোগ্য ব্যক্তি পুরস্কার পাচ্ছেন না, অবশ্যই পাচ্ছেন। আর পাচ্ছেন বলেই সাহিত্যসমাজ নিজে নিজেই তার পাপমুক্তির নিজস্ব প্রকরণ চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আনন্দ পাচ্ছি স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কার প্রাপ্তিতে, আমরা আনন্দ পাচ্ছি শমীক ঘোষের ‘যুব পুরস্কার’ (২০১৭) প্রাপ্তিতে, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার’ প্রাপ্তিতে।
যেহেতু ক্ষেপচুরিয়াস মূলতই একটি সমালোচনামূলক পত্রিকা ও সাহিত্যগোষ্ঠী সুতরাং নিঃসংকোচে কণ্টকময় পথে পদচারণায় আমাদের পদযুগল কম্পিত হবে না, এমনকি আমাদের সেই লেজুড়ও অবলুপ্ত যেখানে কেউ পদপৃষ্ট করতে পারবে। অতীতে আমরা যখন এই পত্রিকাটি প্রকাশ করতাম তখনও একটা পরিষ্কার উদ্দেশ্য ছিল। মধ্যে বেশ কিছুদিন আমরা নিজেরাই সরে ছিলাম। বর্তমান সময় আবার যখন এতবছর পর আমরা ফিরে আসছি, কিছুর তাড়নাতেই ফিরে আসছি, এখনও আমাদের মনে হচ্ছে পত্রিকা যখন হচ্ছে তখন তার উদ্দেশ্যও নির্দিষ্ট হোক এবং আমাদেরও আশু সেই লক্ষ্যে ধাবিত হবার প্রয়োজন। এই শারদ সংখ্যায় যা হবার হলো, তার সাহিত্যগুণ পাঠক বিচার করবে, কিন্তু আগামী দিনে ক্ষেপচুরিয়াস নিজেদের একটি কঠোর সমালোচনামূলক ভীতিহীন পত্রিকা হিসাবেই নিজেকে উপস্থাপিত করবে। আর তরুণ প্রজন্মের সামনে থাকবে একটি খোলা দ্বার। না না কোনও সিংহদরজা নয়, কবিতার পাগলা গারদে ঢোকার গুপ্ত দরজা। হ্যাঁ আবার।
ও হ্যাঁ, এবছর অন্যান্য যে সব শারদ পত্রিকাগুলো আন্তর্জাল বা মুদ্রিত প্রকাশ পেয়েছে তাদেরকেও আমাদের শুভেচ্ছা ও ভালোলাগা জানাই।
- জুবিন ঘোষ
বিষাদের ঘেরাটোপে - শমীক জয় সেনগুপ্ত
বিষাদের ঘেরাটোপে: বিদিশা সরকারের কবিতা
শমীক জয় সেনগুপ্ত
অবিচুয়ারি লিখতে আমার ভালো লাগেনা। মনে হয় যে মানুষটাকে দুদিন আগেও ছুঁতে পারতাম হঠাৎ করে তার না থাকাটা কেমন যেন চাপ সৃষ্টি করছে মনে মননে ও চিন্তায়। কিন্তু সময়কে আমরা টেক্কা দিয়ে বলতে পারি না...
"এখন তো সব ইচ্ছা সব লেখা আকাশ তোমাকে,
বৃষ্টি এসে মুছে দিয়ে
যাবে
তোমার মসৃণ নীলে পাল তুলে..."। (ঐচ্ছিক)
কারণ যে লিখছে তার ইচ্ছেরা অনিচ্ছেরা সব বড় বেশি জাগতিকভাবেই এখনো আছে। আর যাকে নিয়ে লিখছে তার থেকেই শব্দের ভাণ্ডার কিছুটা চুরি করে এনে সাজাচ্ছে এই মর্বিডিটির মোনোলগ। ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার দেখা আমার শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের দোরগোড়ায়। যতদূর সম্ভব বেহালা কিংবা টালিগঞ্জের কোন এক সাহিত্য বাসরে যেখানে আমি গেছি বাচ্চাদের দল থেকে একটা ছড়া শোনাবার জন্য। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে ওইদিন দেখা হলেও আলাপ হয়নি এবং পরবর্তী কোন সময় যে আলাপ হবে তেমন কোন সম্ভাবনাও ছিল না। কলেজে পড়তে পড়তেই আমি চাকরি শুরু করি এবং সেই চাকরির দুনিয়া আমাকে এতটাই গ্রাস করে নিয়েছিল যে ব্যক্তিগত সময় লেখালেখি এগুলো চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটা একটা বড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। ততদিনে আমরা অর্কুট করতে শিখেছি। অর্কুট বন্ধ হয়ে গেলে ফেসবুক এল। এবং এই ফেসবুকেই আবার দেখা এবং তখন থেকেই রীতিমত আলাপ। কথা বলছি কবি বিদিশা সরকারকে নিয়ে। আমাদের বিদিশা'দি।
মানুষ মারা গেলে লোকে তাকে নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতি এবং ভাল ভাল কথা লিখে রাখে। কিন্তু একজন কবি কী শুধু এই স্মৃতি ও প্রশংসার কাঙাল! আমার তো মনে হয় সব কবি তার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য উদগ্রীব থাকে। আর যে কথাগুলো ব্যক্তিগত যে ভাব শুধুমাত্র পারিবারিক বা বন্ধু মহল বিশিষ্ট তাকে অনাবশ্যকভাবে লিপিবদ্ধ করে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার পক্ষপাতি আমি নই। বরং আসুন আজ আমরা একটু কবি বিদিশা সরকারের কবিতার সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত মুহূর্ত বা পড়বার কিছুটা সময় ভাগ করে নিই। আমাকে বিদিশা'দি অনেকগুলো বই উপহার দিয়েছিলেন কিন্তু কাজের সময় শুধুমাত্র অভিজয় প্রকাশনীর"নির্বাক টকিজ" ছাড়া অন্য কোন বই হাতের কাছে পেলাম না। যদিও ওর "হুক্কাবার" কাব্যগ্রন্থটি আমার বেশ পছন্দের একটি বই, কিন্তু আপনারা আমাকে চেনেন, আমি নিজের কবিতার লাইনই মনে রাখতে পারি না, এক্ষেত্রে স্মৃতি থেকে ভুলভাল কোটেশন করা মোটেই উচিত কাজ হবে না।
আমার মতে বিদিশা সরকার ছিলেন আধুনিক সময়ের সেই সমস্ত কবিদের একজন যারা শুধুমাত্র কবিতাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজেছেন জীবনে। ওর কবিতায় নাগরিক জনজীবন এবং তার বিচ্ছিন্নতা এবং সেখান থেকে ক্রমশ প্রকৃতির কাছে আশ্রয় খোঁজা এবং আবার এই শহুরে জীবনে প্রত্যাবর্তন, সম্পূর্ণ সার্কেলটি বারবার দেখা গেছে। কিন্তু এসবের মধ্যেই এক অদ্ভুত রকম বিষাদ ঘন আচ্ছাদন ওর লেখাকে আদ্যোপান্ত গ্রাস করেছে। আনন্দ দুঃখ বন্ধুত্ব প্রেম সব রকম অনুভূতি আসলে এক বিষাদের চাদরে নিজেকে ঢেকে ওর কবিতার মাধ্যমে বারবার পাঠকের কাছে ফিরে এসেছে।
"তুমি খুশি দিলে
মুহূর্ত উন্মার্গগামী
তারপর সমতল ছুঁয়ে
এবড়ো খেবড়ো ব্রণই তো শুধু-
একটা খালি খামে
কি জানি কি নেবে ভেবে
ফেলে রেখে গেছ
আমি তাকে নৌকা বানালাম
অন্যনামে
যদি পারো আলো কিনে দিও
কত কি হারিয়ে যাচ্ছে
নখগুলো উপড়ে দিলো কে যে!
কে সেই এমন নিষ্ঠুর
ঘুমের অতল
থই থই জল
ব্রণ খুঁটে খুঁটে কিশোরী আয়নায়" (আরশি)
এটা হয়তো এক ধরনের অবিশ্বাসসূচক আত্মবিশ্লেষণ। জীবনে যে দুঃখগুলো যে কষ্টগুলো মানুষকে বিদীর্ণ করে দেয়, একটা সময়ের পর তারা যে কেবলমাত্র গা সওয়া হয়ে যায় তা কিন্তু নয়, তারা ক্রমশ অভ্যাসে রূপান্তরিত হয়। যারা বিদিশা দিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন তারা জানেন যে মানুষটার ভেতরে একটা থমকে যাওয়া কিশোরীবেলা সব সময় ঘুরপাক খেতো। আমরা হেসে বলতাম, "আমাদের দিদি বুড়ো হবে, বড় হবে না"। সেই ছটফটে তরুণীকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য নিজের পরিণত বয়সে পাওয়া দুঃখ কষ্টগুলোকেও অনেক সময় ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে, আবার ওই কিশোরীবেলাকেই অবলম্বন করে জারণ করেছে, তার পরিণত বয়স্ক অনুভূতিদের। আসলে কবিমাত্রই লেখালেখির বাইরে হয়তো একটু অপরিণামদর্শী ও ছেলেমানুষ হয়ে। আবার কখনো কখনো বুঝতেও পারতো যে সামনের মানুষটি এত ভালো ভালো কথা বলছে আসলে সবই ছদ্ম অনুরাগ। একটা জায়গায় লিখছেন -
"আমাকে শুনবে বলে কেউ কেউ হলমার্ক প্রত্যয় শোনায়। সেলফিতে সহজ হয় বাথরুম - আয়নার নিজস্ব বয়ান। দূরে কোন আগুন সংবাদ শুনে দমকল এক- চতুর্থাংশটুকু নিভাতে পারে না।
........ বানানো খবর আর খবর বানানো নিয়ে কিছু কারিগর অনিচ্ছুক শব্দগুলো প্রকাশ্যে সাজায়। বাকি অংশ পাঁচের পাতায়-" (আমাকে শুনবে বলে)
বিদিশা সরকারের কবিতায় যে ভাষা ব্যবহৃত হতো, তা ছিল অত্যন্ত স্মার্ট এবং সময় সচেতন একটি ভাষাশৈলী। এটা আমাদের ৯০ দশকের বেশিরভাগ কবিরই স্বকীয় ভাষা খোঁজার প্রবণতা থেকেই এসেছে। নয়ের দশকের বেশিরভাগ কবি, কবিতাতে একটা সিগনেচার স্টাইল ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বারবার। শূন্য ও পরবর্তী দশক কবিতার গঠনকে ভাঙচুর করার দিকে যতটা মন দিয়েছে নয়ের দশক সেখানে বারবার খোঁজ করেছে স্বকীয় স্বর।
"পাখি আসবে না ভেবে
বেচে দিলে হরিয়ালি খেত
অথচ পাখালি শব্দে ঘুম ভাঙ্গে অসফল ভোরে
স্বপ্নের শতাব্দী কোনো স্টেশনে থামে না
কখন পৌঁছে যায় রাজধানী" (রবিশস্য)
সবুজাভ বা শ্যামলী খেত নয়, হরিয়ালি। কারণ ওই যে আগে বলেছি নগর জীবন থেকে পালিয়ে প্রকৃতির বুকে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব এক প্রাণ। কিন্তু সেই প্রকৃতি সবসময় যে বঙ্গ জননীর বুকে খুঁজে পাবে আশ্বাস তা কিন্তু নয়। সে সর্বত্র বিচরণ করে। নিজের ভাষাকে অবজ্ঞা করে না কিন্তু অন্যের ভাষা কি গ্রহণ করতেও দুবার ভাবে না। সেখানে সবসময় "গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ" না বেজে মাঝের মধ্যে "তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সনম" ও শোনা যায়। এখানে চুপিচুপি বলে রাখি শাহরুখ খান আমার ও বিদিশাদির দুজনেরই খুব প্রিয় অভিনেতা। যদিও ব্যক্তিগত কথা বলব না বলেছি কিন্তু তাও যখন নিজের মানুষকে নিয়ে কথা বলতে বসা হয় একটা দুটো স্লিপ অফ টাং হয়ে যায়। আবার এই প্রিয় অভিনেতা যাকে ধরা ছোঁয়া যায় না বা এমন অনেক প্রিয়জন যাদের সঙ্গে চাইলেই কথা বলা যায় না তাদের উপর অভিমানও জমে উঠতো।
"এমন তাচ্ছিল্য করে প্রেম হয় নাকি
এমন গোয়ালা ভোরে..." (তর্কে বহুদূর)
তখন যদি কেউ একটু হাসি ঠাট্টা করত, অমনি বকুনি দিয়ে দিত। আবার ওখান থেকেই শুরু হতো অন্য কোন কবিতার প্রেক্ষাপট। সবসময় থেকে লেখাগুলো তার ব্যক্তিগত যাপন থেকে উঠে আসছে তা কিন্তু নয়। যারা মানুষ বিদিশা সরকারকে চেনেন, তারা জানেন সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গেই সমানভাবে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতো এই মানুষটি। ফলে তাদের গল্প তাদের জীবন গভীরভাবে রেখাপাত কাটতো। আর রেখাপাত কাটতো ওইসব মানুষগুলোর যন্ত্রণা। নিজের কষ্টগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে নিতে সুবিধা হতো হয়তো, এবং অনেক সময় বলতো, "ওরা যে কষ্টে আছে তার কাছে আমাদের দুঃখ কিছুই না..."
হয়তো সত্যিই কিছু না আবার হয়তো অনেক কিছুই। কিন্তু না বলা সংলাপগুলো শখের বাগান থেকে যে শ্রীমতি টনিক দিয়ে গুছিয়ে রাখত তার কি বিষাদ আঁকড়ে বসে থাকলে চলে। শ্রীমতি টনিক কবিতাতে নিজেই লিখছে
"বৃষ্টি নামবে এইবারে সরযু অস্থির
ছাদে মেলে রাখা সব রঙিন
বসন ধুয়ে যাবে
ধুয়ে যাবে সব রং
তুমিও তো এখন দেখছি নকল
হইতে সাবধান"
এই বৃষ্টির জলে রং ধুয়ে যেতে যেতে আর সব নকল মেকি মুখগুলোকে সরাতে সরাতে সত্যিই কি এই শ্রীমতিরও ধুয়ে যাওয়া উচিত হয়েছে? একেক সময় ভাবি আর তখনই দীর্ঘশ্বাস পড়ে।