মঙ্গলবার, ১৪ আগস্ট, ২০১২

সম্পাদকীয় - ৩য় সংখ্যা

সম্পাদকীয়

ক্ষেপচুরিয়াস গ্রুপম্যাগের আরেক রূপভেদ - “ক্ষেপচুরিয়ানস” - ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যার ব্লগ প্রকাশিত হ’ল। কিন্তু অনেকের কাছেই প্রশ্ন হঠাৎ ক্ষেপচুরিয়ান নাম কেন। হ্যাঁ আমরা ক্ষেপচুরিয়ান , অন্তত বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে গত একবছরে আমরা সেই নামেই পরিচিত । যাইহোক, কিছুটা দেরীতে হলেও, আশা রাখি, ভিন্নমাত্রার কবিতাবিষয়ক উন্মাদনা আশ্রয় ক’রে ক্ষেপচুরিয়ানস সাহিত্যের ব্লগ এখন থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হবে। এই সংখ্যার বিপুল কর্মকাণ্ডের দায়ভার অনেকটাই স্বস্কন্ধে নিয়ে আমাদের বাধিত তথা নিশ্চিন্ত করেছেন কবি সুমিত রঞ্জন দাস। দীর্ঘদিনের প্রায় একক প্রচেষ্টায় তিনি সাজিয়ে তুলেছেন এই ব্লগ। তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। একই সাথে ধন্যবাদ মেঘ অদিতি, কৌষিক বিশ্বাস এবং অমিত বিশ্বাস, পার্থপ্রতীম রায় – ব্লগের ক্ষেত্রে অলংকরণ তথা অন্যান্য আনুষঙ্গিক সহায়তাদানে আমাদের ভার লাঘব করবার জন্য। বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্ত সুমিত রঞ্জন দাস, জুবিন ঘোষ ও অয়ন দাশগুপ্ত অভিভাবকত্বে ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই অভিনব পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপদানে এবং অবশ্যই কৃতজ্ঞতা জানবেন ক্ষেপচুরিয়াসের বিরাট পরিবার, আমাদের সুহৃদ কবি, সাহিত্যিক ও সাহিত্যমনস্ক সদস্য-সদস্যারা, যাদের সৃষ্টিসম্ভারে সেজে উঠেছে ক্ষেপচুরিয়ানস – ১ম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যার ব্লগ। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, ক্ষেপচুরিয়াস ছাপা পত্রিকাও এসে যাচ্ছে পুজোর আগেই। এই সংখ্যার লেখা আমরা জমা নিয়েছি ডাকে ও ই-মেলে। ক্ষেপচুরিয়াসের সকল সদস্যকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, আবারও।

যদিও, আমরা সকলে একটিই পরিবার – ক্ষেপচুরিয়াস। সুখে- দুঃখে- আমোদে- বিবাদে বাঁধ বেঁধে আছি, বিশেষতঃ কবিতায়। সারাদিনে অন্তত একটিবার গ্রুপে ঢুঁ না মারলে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের সাহিত্যটান ঢিলে হয়ে আসে। প্রায় আটশতাধিক সদস্যের যে বিরাট ও সক্রিয় কমিউনিটি গড়ে তুলেছে ক্ষেপচুরিয়াস – তা বাংলাসাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে, তাবৎ ফেসবুকেই বড় দুর্লভ। প্রতিটি সদস্যের অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করা অবশ্যই বাতুলতা, কারণ ব্যস্তবাগীশ সাহিত্যিকদের সাথে সাথে গ্রুপে রয়েছেন এমন অনেকেই, যারা নিছক কবিতা পড়তে বা আলোচনার স্বাদ নিতে আসেন এইখানে। এদের নিশ্চুপ যোগদান, বলাবাহুল্য, গ্রুপের এবং ব্লগের অক্সিজেনবৎ।

তবে, এ তো নিছকই আনুষ্ঠানিকতা। ক্ষেপচুরিয়াস স্বোপার্জিত ডিগ্রি (অথবা পেডিগ্রি) হ’ল “কবিতার পাগলামি গ্রুপম্যাগ”। পাগলামি কেন ? এর উত্তরে, কোনো সাবেকী পাশ্চাত্য দার্শনিকের উদ্ধৃতি-উদ্ধারের জটিল জঞ্জালে হাত না ডুবিয়েই বলা যায়, WE ARE LIVING IN MAD TIMES ! এক অসাধারণ উন্মাদনা ছেয়ে ফেলেছে আমাদের চারদিক, আচ্ছন্ন করেছে মূল্যবোধ-বিচারবোধ থেকে শুরু করে সাহিত্যবোধ অবধি সবকিছু। কী এর প্রকৃতি, কী এর অভিমুখ – এসব জটিল প্রশ্ন চাপিয়ে দেওয়া যাক চিন্তাবিদদের কাঁধে। আমরা শুধু প্রজাপতির জাল দিয়ে ধরতে থাকি এই সময়কে ; স্টাফড্ করে বসার ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য নয়, বরং রাস্তার মাঝখানে টাঙিয়ে দিই শিল্পচর্চার মহান তাগিদে। কেউ কেউ সময়ের ভাঙা আয়নার টুকরো দিয়ে নিজেকে চেরেন, ক্ষতবিক্ষত করে তুলে দেন ক্রুশবিদ্ধ দগদগে শরীর পরিপন্থী সভ্যতার হাতে – কাঠ ফেটে রোদ সেঁকে চামড়া !

এই যে বিপুল ও ব্যাপক পাগলামি, তার একটি আপাত শান্ত উপরিতল রয়েছে। এই গভীর অসুখগুলিরও রয়েছে কিছু চেনা সমস্যার নিজস্ব রূপক। ফেসবুকের গ্রুপে গ্রুপে সাহিত্যচর্চা একটি ভিন্ন ও নতুন ট্রেন্ড বটে, তবে ক্ষেত্রবিশেষ ছাড়া, আমরা লক্ষ্য করছি, এর মাধ্যমটি নতুন হলেও পুরাতন কিছু সমস্যায় আজও জর্জরিত এবং পরস্পরের ওতপ্রোত। এমন এক উপমহাদেশে আমরা সাহিত্যচর্চা করছি, যা সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ ও নিও-কলোনিয়াল কালচারাল স্টাডিজ-এর ঘানিঘর হয়ে তার বহু বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রায় বিস্মৃত হয়ে রিফিউজি তকমা পেতে বসেছে। এর সাথে যোগ হয়েছে সাম্প্রতিক বিশ্বায়িত অর্থনীতির অবশ্যম্ভাবী লেজুড় হিসেবে শিকড়বিহীনতা ও পরমুখাপেক্ষা, প্লাগিয়ারিজম ও অনুকরণের নোংরা জঘণ্য প্রবণতা। একটি শির ও শিরদাঁড়া সোজা করা সাহিত্য আন্দোলনের এই সময়ে একান্ত প্রয়োজন, যা লাথি মারতে পারে এইসব ঘুনধরা বিকৃতির মুখে। কোনো ধ্বজাধারণে বিশ্বাসী নই আমরা, এই মুহূর্তে বরং তার অপব্যবহারগুলিই চোখে পড়ছে বেশি। পাগলামির নিজস্ব দ্যোতক এই কলম, যা আমরা সাজিয়ে তুলেছি নতুন বর্ণসম্ভারে – তা কতটুকু নিতে পারবে এই সময়ের কষ্টকে, সে তো সময় নিজেই জানাবে। কিন্তু সংবেদনের সঙ্গে সঙ্গে বেশিটাই আমাদের সংগঠিত সংহত প্রতিবাদ (সংশোধন নয়) – কোনো কোনো ব্যর্থ পিকাসো-গ্যালিলেও-কে নিশ্চুপে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে দূর থেকে, কোনো কোনো সার্ধশতবর্ষকে সযত্নে এড়িয়ে প্রদীপ জ্বালাচ্ছে কুঁড়েঘরের ভিতর, কোনো কোনো লাথি খাওয়া কবির পায়ে জোর করে পরিয়ে দিচ্ছে কাঁটাওয়ালা বুট – সে ফিরিয়ে দেবে আজ নিজের অপমানকে, পদলেহীর মুখের উপর !

ক্ষেপচুরিয়ানসের পক্ষে অত্রি ভট্টাচার্য

অমলেন্দু চন্দ

আমার বাইজ্যান্টাইন অবশেষ – আমার গোবেকলি  টেপে
 -- অমলেন্দু   চন্দ

যখন ছাব্বিশ ছিল নীল কষ্ট বিস্তীর্ণ জলার মতো তরল বয়েছে
করুন সংশয় বার বার নিয়েছে সে অন্ধকার ঘ্রান
অদ্ভুত রূপপাখী ব্যাথা হয়ে মেলেছে তার ঈগল পাখনা

          The secret of life is living, but the problem of life is to live. অতর্কিতে সমাধান হয়ে গেলে জেতার মজা পেতে পেতেই অস্থির সময়ের পাখার ঝাপটানি, সে এক অদ্ভুত অ্যালিয়েনেসান। সেই তো শুরু পাথর ভাঙার খেলা। আর একবার সে খেলায় পা দিতেই চালু হত নিবেদিত প্রাণ জীবনবাবুর  খেলা – খেলা তো নয় নিবেদন।  কত সব পাথর আর কি তার গড়ন পেটন। The innumerable vistas of alien feelings, sometimes charming, sometimes painful.  অদ্ভুত অসহ্য সব সবুজ পাগলামি। কত চাপেই না চাপা পড়া প্রতিদিন, আসে পাশের শুধীজন হেঁকে যেত – চাপ নিও না হে, পার যদি যা কিছু ভালো বোঝো তা নিয়ে নেচে যাও, যা খোঁজো সোজাসুজি সে নিয়ে নেচে যাও। তো ছাব্বিশ নাচতে জানে, কিন্তু বৈপরিত্যের কষ্টের নীল বাতাস তার ডানায় চাপ ফেলবে না – তা কি হয়? নীল বাতাস! হ্যাঁ, নীল তো বিষেও হয়। ফলে নিষাদ বিষাদ জীবনসঙ্গী, অন্তত সেই ছাব্বিসের সঙ্গী তো বটেই। কিছু  রূপটান আজীবন থেকে যায় যতই মিলিয়ে যাও সুরবেঁধে পাথর ভাঙার ছন্দ কষ্টের উল্লাসে।


               সব সুর বেঁধে যদি হাহাকারে ফোটানো যেত মেঘ মল্লার, কিম্বা জয় জয়ন্তী। বেশীর ভাগ অনুভুতির কাঁটা ঝোপ চিবিয়ে উঁটের মত পেরিয়ে যাওয়া আভুম বেছানো সময় বেছান, জিভে লেগে থাকা রক্তের নোনা স্বাদ গলা শুকতে দেয় নি।  বুকের মধ্যে সুগন্ধী রুমাল রেখে যারা একদিন আনন্দ দিয়েছিল, হঠাৎ নিঃস্পৃহ  হয়ে এলে অনুভবে ছাব্বিসের অনুভাষ - বরুনা, তুমিও। Strangely it’s not an isolation of choice, rather an acute form of mental  aloneness.  যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের জানা অজানা সমীকরনের ধারাপাত। সেই সব অধ্যায়ে চাওয়ার ঘরে ছিল তুমিই এসো আকাশ ছেয়ে আগুন দেহে মেঘ মল্লার একটু খানি বিদ্যুৎ, আর পাওয়ার নিকেষ জানান দিত ভাবনায় এ কোন প্রেমের নরক, যেন ছাল চামড়া তোলা রুদ্ধবাক স্বপ্ন আর সরব ভর্ৎসনা । 


              জলছবিতে ঠিক ভুল ভালো খারাপের পাওনা গন্ডার হিসেবের রঙে অনেক অন্ধকার ছিল। ছাব্বিসের বুকে ঘুমন্ত শিশুর স্বপ্নস্বর তান ধরত সাঁওতালি মাদলের ধ্রুপদ ধামার, আর তার পরেই ছন্দপতন। গোলাপের থ্যাঁতলানো কুড়ি। দরজায় ঝোলান ভারী পর্দার আড়াল দুলে দুলে মুচকি হাসত, বৃক্ষ পারে, পাখী পারে, ইস্তক পোষা খরগোস পারে, শুধু তুমিই পারনা। তেতে উঠে পর্দা সরিয়ে পারি আমি পারি বলতে গেলে যে প্রাক ছাব্বিশ ভ্রান্ত ধারনার নির্মোক টা ছেঁড়া দরকার, সে চুপি চুপি গান গাইত – দেওয়ালে আলোর ধারে টিকটিকি গুলো দেখেছ, কিরকম নিঃশব্দ স্বস্তিতে থাকে, আলোর কাছাকাছি, চুপচাপ, কোনো টিকটিকিকে আলোর ওপরে চড়ে শিকার ধরতে দেখেছ কখনো?

           ব্যাস, ছাব্বিশ অমনি বিনীত মোমবাতির শিখা, আলো আছে জ্বালার দেখা নেই, ওইটাই তো মন্ত্র, মনের ঘরে সব আলাদা আলাদা - মেঘ, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ - সব আছে শুধু একসাথে ঝড় তোলার এক আকাশ ইচ্ছে টাই গরহাজির। সে বয়সে কবিতা লেখার শুরু। আজও চলছে, শুধু তফাৎ একটাই – মাঝে মাঝে মৃত্যু এসে কবিতার ভাষা উপহার দিয়ে যায়। আর টিকটিকিটা চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে।



           ছাব্বিশ পেরিয়ে তাই ছাপ্পান্ন তে আজ ভাগচাষীর অবস্থা। হায়রে, সে ভাগচাষীর চোখে তো স্বপ্ন ছিল। সোনালী ধানের গন্ধে সুধন্যা পৃথিবী – ফসল উঠবে ঘরে – মাঠে থেকে যাবে নিড়ানির স্তুপাকার – শস্যের শিল্পীরা এসে আলের ধারেতে বসে তামাকে দেবে সুখটান – হল না, আমরা  তামাটে জাতি, অনার্য দ্রাবিড়। ভাগের মা, সম্পন্ন চাষী আর হবে কি করে।

                ভারী পর্দা আবার দোলে। এবার আর দুলে দুলে নয়, বেশ ভারিক্কি গম্ভীর আলতো নড়া সরা। সত্যি, কত জারিজুরি ওর হাতে। ম্যাজিক জানা ফকির যেন। বলল তাকাও তাকাও, আয়েসের দুঃখ নিয়ে ভরে আছ, শুধু নিজের নাভির গন্ধে ভুত হয়ে, সাধের কোম্পানিবাগানে চুমুর চু নিয়ে চু কিৎ কিৎ। কেউ ছুঁয়ে দিয়ে মোর বলবে না। ছ্যাঃ। চেয়ে দেখো সত্যিকারের ভাগচাষীদের দিকে। একটু মিন্ মিন্ স্বরে বলি ওঁরা তো একভাগ পেয়েছে। 


             পর্দা বলল ছ্যাঃ। ভাগের মা। সত্যি হল - ভাগচাষীর ঘরে ওঠে কিছু, বাকি যায় মহাজন সঙ্কাশে, ধার শুধতে ধান কাবার - সারের দাম থাকে বাকি, ভূমিস্বর ভাগের মায়ের ক্লান্তিহীন চেষ্টার ভেতরে যে সুখের প্রেমের স্বপ্নের খুঁটিনাটি, কে রাখে হিসাব, চাষা শুধু শুধে চলে ঋণ।

              হায়রে তেভাগা - মালিক আজ মহাজন - প্রথমে ধার দেয় ফসল ফলাবে, বীজ কিনে দেয়, সে ঋণ শুধতে যায় আর্ধেক, তারপর বাকির ফসলের বেচা কেনায় মহাজন ব্যবসাদার। শুধু ধান কেন সারাদেশ চেয়ে দেখো আখ, আলু, তুলো, পেঁয়াজ – সব সব জায়গায়, ব্যাবসাদার কেনে যে দামে তাতে যে কি হয়, আত্মহত্যাগুলো রাখে তার ইতিহাস - আর আমরা বর্গা আর বর্গের হিসেবের গল্পের অহঙ্কারি নিঃশ্বাসে মহাদেশ কাঁপাই, মালিকানা আর মালিক শুধু বদলেছে, ভাগচাষী ভাগ আজও পায় না।

            পর্দা এরপর মোক্ষম কাব্যি ঝাড়ল ইঞ্জিরিতে - It is impossible, with respect to any grief indelibly impressed upon time, to adequately exhibit and express so as to indicate the enormity of the convulsion which causes the grief. শালা কোথাকার বেনো জল কোথায় গড়িয়ে দিল।

           বললাম – সময়ের উদোম বুকে লেখা সব ঐতিহাসিক ভুলের তলায় কিছু তো আরম্ভের স্বপ্ন ছিল।  লড়াইয়ের স্বপ্নে তো ঐ সোনালী ধান আর আলে বসে হুঁকোয় সুখটানের রূপটান ছিল - কোথায় হারাল কোন বাঁকে?  পর্দার ম্লান স্বর - কত লক্ষ কোটিবার মানুষ শব্দটা ব্যবহার হলো তবু সুঠাম রোদের মতো উজ্জ্বল মানুষ শুধু কবিতায় থেকে গেল। কে নেয় হিসেব।

                কবিতায় আর শ্লোগানে থেকে গেছে ধানের রঙের গন্ধ না কি রঙ্গের গন্ধ - রঙ্গ বটে হে ঈশ্বর, তোমার তুলনা তুমি প্রাণ ...আজও তাই রোজদিন ঈশ্বর খুজে যাই ভয়ে ভয়ে ... সেও তো বদলে যায় সময়ের থামে! তাই বুঝি ভক্তি নেই দেখে বিরক্ত পুরোহিত প্রায় গলা ধাক্কা দিয়ে হরিজনের মতোই বের করে দেয়। শিবের লিঙ্গ আর ছোঁয়া হয় না, বুকে জড়িয়ে ধরা তো দুরের কথা। শেষমেশ দুঃখকে বাঁচিয়ে রেখে সেই নিষাদ বিষাদের শরীরের ওম্‌ নিই। 


                কি কথায় কি কথা । ঐ শালা এক মনের দোষ।  যতবার মোছো ওই এক বিষাদ নিষাদের মতো চোখ রাঙায়। শেষ রাতের কালপুরুষ, মধ্য যামের সপ্তর্ষির আঁচ, কুয়াশামাখা ঠাকুরদালান, ভোরের তুলশী তলায় পাতা ম্লান ফুলের বিছন, গাংচিলের ডাক সব সব জুড়ে বিষন্নতার দ্রিমিক দ্রিমিক স্বর। দেবতায় ভরা এই আদিগন্ত দুনিয়ায় একা রাগি উলঙ্গ সন্যাসি হওয়ার সাহস – নাহ, সেই বিষাদ আবার নিষাদ।

                 মন তুমি কৃষিকাজ জাননা। সত্যিই পারিনা ।  পারিনি মানুষ হতে, পারিনা ভিখিরী হতে, নগ্নতার গৌরবে উলঙ্গ রাজার মত। পর্দা হাসে -

“দিনের শেষে তৃপ্ত দেশের রাজা
সভার মাঝে সোনার মুকুট মাথায়,
শুধু চারণ কবির একতারাটি বলে
রাজা তোর কাপড় গেলো কোথায় !”

                 কৃষিকাজ করতে নেমে মাটিকে ভালবাসলাম। মাটি বলল আকাশকে ভালোবাস। সে তোমাকে দেবে সব – মেঘ, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ।  হয়ত সে বিদ্যুৎ হবে চেতনার সোনালি চাবুক। শুনতে পেলাম পর্দার মৃদু হাসির কষাঘাত – রাজা তোর কাপড় গেল কোথায় ।

উদয়ন ঘোষচৌধুরি

পোড়ামাংস, কুকুর, হাতঘড়ি, অন্যান্য


[ অনেক জায়গায়তেই দেখিঃ ‘কবিতা কেন লিখি?’-র ওপর কাঁড়ি কাঁড়ি পাতা খরচ। যদি এটাই কাউন্টার হয়ে যায়? বলা হয়ঃ ‘কেন পড়ি?’ সত্যিই তো, আমি কেন পড়ি কবিতা? ]
এই যে চারপাশে তাপ্পি-মারা জীবন – ওই যে লোকটা – প্রচুর তেল মেরেও প্রোমোশনের গুড়টা পিঁপড়ে চেটে নিল বলে, মুখ গোঁজ করে আছে অফিসে; ওই যে ছেলেটা – টিউশনির টাকায় মাসে একদিন মুরগির মুরোদ হয় না বলে, প্রেমিকা বলেছে ‘ধুত্তোর’; ওই যে বুড়োটা – উদাস ব্যালকনিতে অপেক্ষা করছে, ছেলের বৌ কখন সিরিয়াল-শেষে এক কাপ চা বানিয়ে দেবে; ওই যে বউটা – লেডিস স্পেশালে ঝুলতে ঝুলতে চার্চগেট যায়, সন্ধে উতরোলে ধুঁকতে ধুঁকতে ফিরে বানায় রাত্তিরের রুটি ও বিছানা; ওই আরেকটা ছেলে – পঞ্চাশ টাকা বেশি পাবে বলে, সুপারভাইজারের পেছুপেছু ঘোরে; আর এই যে আমি – সর্বঅক্ষমতা-সমন্বিত চার হাত-পায়ের মানুষ, নানা জায়গা থেকে নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে, সারা দিন (বা রাত) পরে হাঁ-করা
একটা বিল্ডিং-এ ঢুকি, নির্দিষ্ট একটা নাম্বার মুখস্থ করে বুঝতে পারি, এই চার দেয়াল ও দরজাটি আমার, যার ভেতরে একটা হলুদ বাল্ব দমবন্ধ তাকিয়ে আছে, দিনান্তের খাবার নিয়ে বসছি তার মুখোমুখি, এতটাই বিরক্ত যে চিবোতেও জুত পাচ্ছি না – আর কেউ যেন এসে থালার পাশে লিখে যাচ্ছে -
“যে ছেলেটা দিন আনে
সে কি করে দিন খেয়ে ফেলে?
একটা আস্ত দিন তার কাছে
হেরে গিয়ে অন্ধকার হয়েছে তাহলে?”
(তনুজ নিয়োগী)
দিন আনি, দিন খাই – এরকম কতজনই তো বলেন। দিন কি সত্যিই খেয়ে ফেলা যায়? হ্যাঁ, যায়। দিন তো আমারই বেঁচে থাকার অংশ। আর সেটা বিক্রি করেই তো আমার আজকের ভাত ও তরকারি। আজকের দিনটা আমি কেন বাঁচলাম? কেন নানা জায়গায় লাথি-ঝ্যাঁটা-গালমন্দ মেখে ঘুরলাম? উত্তর খুব সহজ – খাওয়ার জন্যে। ওপরে রেখে যাওয়া লাইনগুলোতে দেখি, দিন হেরে গেছে ছেলেটার কাছে। গোটা একটা দিন মুখ লুকিয়েছে কালো অন্ধকারে। অন্ধকার হয়ে-যাওয়া গতদিন ছেলেটাকে দিচ্ছে আহার্য। বিনিময়ে ছেলেটা হয়ে উঠছে আলোময়। প্রস্তুত হচ্ছে আগামী দিনটাকে খেতে। পাচ্ছে পরবর্তী আরেকটা লড়াইয়ের স্পর্ধা। ‘অন্ধকার’ শব্দটির এত পজিটিভ রং এর আগে কেউ তো বলেনি আমায়!
এই যে অমোঘ খাওয়া – খেতে বসা – কেমন সেই ছবিটা? কেমন দেখতে এক ক্লান্ত ক্ষুধার্ত?
                 “আমারই মাংস পুড়ে
                               লাল লাল ভাত হয়, ভাত
                 পাগল যেভাবে খায়
                               আমার মাংস খাই আমি
                 আহা ভাত, প্রিয় ভাত
                              তোমাকেই খাব বলে, পুড়ি”
 (প্রবীর মণ্ডল)
আমারই মাংস পুড়ে ভাত? হ্যাঁ, তাইই তো। শ্রম তো আমারই মাংস। মেধা তো আমারই অংশ। সেইসব বিক্রি করেই তো জুটেছে এই আহার্য। চরম খিদের মুহূর্তে যেটুকুই জোটে, তাই অমৃতভোগ। সুস্থতার মূল উপকরণ যে খাদ্য – তা না জুটলে আমি তো পাগল হবই। আর যখন জোটে? খুশিতেও কি পাগল হয়ে যাই না? আর পাগল যখন খায়, তখন তার খেয়াল নেই
দিগ্বিদিক। সে লাল লাল ভাত খাচ্ছে। ভাত ‘লাল’ কেন? কারণ, ওটাই আমার পোড়া মাংসের রং। সহজ ভাবে, কিছু গ্রাম্য চালের ভাত এমন রঙের হয়। কিন্তু, আমি যদি তা না জানি? অসুবিধে নেই। আমি কি দেখিনি, ফুটপাথের ওপর একটা নোংরা লোক, হোটেলের ফেলে দেওয়া ঝোল আর এঁটো ভাত পেয়েছে একটা প্লাস্টিকে, হামলে পড়েছে সে ওই রগরগে লালের ওপর, সাপটে নিয়ে খাচ্ছে? অথবা, এই ছবিটাঃ
        “যখন ভাতের জন্যে এতো লড়াই
        দুমুঠো ভাত পেলে গপগপ খাই।
        কেউ কেউ সারমেয় ভাবে।”
(প্রবীর মণ্ডল)
ক্ষুধার্তের খাওয়ার ভঙ্গিতে এসে গ্যালো একটি কুকুরের মুদ্রা। কুকুর যেমন খিদের সময় খাদ্য ছাড়া আর কিছুই দেখতে চায় না, আমিও তেমনই। শেষ লাইনের আগে এখানে যে স্পেসটা বসানো হল – মনে হল, খেতে খেতে কুকুরটা একবার যেন ঘাড় তুলে দেখে নিল আশেপাশে। যেমন আমিও ক্রমশ দেখে নিতে শিখি - পরীক্ষার হলে, ইন্টারভিউ টেবিলে, কফিশপের ডেটিঙে – কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই তো? আচ্ছা, ওই স্পেসটা কি কাউকে চুপ থাকতে বলে? যারা অক্লেশে নিয়মিত খেতে পায় – তাদের কি বলে, চুপ করে দ্যাখো, খাওয়ার ছবিটা ঠিক কিরকম? না কি, কবি নিজেই একটু চুপ থাকলেন, একটা অবজ্ঞার দীর্ঘশ্বাস নিলেন? অথবা, স্পেসটা রেখে বোঝানো হল, মানুষ এভাবেই খায়, এই শূন্যস্থানে - যে জায়গার কোনও ক্যাটালগ হয় না, ঠিক ওখানেই খায় মানুষ - নিজেরই শ্রম পুড়িয়ে। কি কি ভাবে পোড়ায় সে?
        “গরম ভাতের স্বপ্ন দেখে ঘুমিয়ে পড়ে ছেলে
        মা গেছে তার নুন আনতে পান্তাভাতটি ফেলে।
        ......
        তোরা কে জামাই দেখবি জামাই আয়
        সোমত্ত সব মেয়েগুলো ধর্মতলায় যায়”
(তনুজ নিয়োগী)
নিজের খাওয়ার পাশাপাশি এসে যায় পরিবারের প্রতিপালন। সন্তানের খিদে। না-চাইতেও চলে আসে যে সন্তান, নিজে অভুক্ত থেকেও খাওয়াতে হয় তাকে। এই লাইনগুলো আমাকে বলছে এক সহজ ও আদি বাস্তব – পেট চালাতে মা যখন নিজেকে বিক্রি করতে যায়। আর অদ্ভুত স্যাটায়ার করে এখানে বসানো হল ‘ধর্মতলা’-র নাম, যা প্রতিফলিত করল আমারই অবস্থানকে। অরুনেশ ঘোষের ‘যাত্রা’ অথবা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অন্নপূর্ণা’ গল্পের মা যেন দাঁড়িয়ে এই ঢাকঢাক গুড়গুড় ধর্মতলার হাটে। অরুনেশ তার ডাইরিতে লিখছেনঃ “যৌনতার কাছে সব সম্পর্কই বোধহয় ফিকে হয়ে যায়, বিশেষত বোধহীন মানুষের যৌনতা।” মানুষ মূলত কোথায় বোধহীন? কোন কোন খানে? আদি ও অকৃত্রিমতায়, খিদের কাছে - যখনও যৌনচেতনা জাগেনি, তখন থেকেই। এখানেই মা বিক্রি হয়ে যায়। সন্তান বিক্রি হয়ে যায়। শুধুই কি শরীর? প্রতিনিয়ত নিজের চেতনা, বোধ, যাপন, সময়, সম্পর্ক – আরও আরও অনেক কিছু বিক্রি করি না কি? মনে হয়, দারিদ্র্যই জন্ম দ্যায় প্রকৃত নীতিহীনতার, মূল্যায়ন অবক্ষয়ের – দিদির দয়িতকে আত্মসাৎ করে ছোটবোন (‘মেঘে ঢাকা তারা’ / ঋত্বিক ঘটক); তরুণী মেয়েকে টাকা ধার করতে পাঠায় মা আর বেড়াতে-আসা আত্মীয়ের সামনে আপ্রাণ লুকোয় (‘কলকাতা ’৭১’ / মৃণাল সেন); বন্ধ মিলের অসহায় শ্রমিক আফশোস করে, যদি তার বউটা কারও কামনা কাড়তে পারত, হয়ত কটা রুটি জুটে যেত (‘সিটি অফ গোল্ড’ / মহেশ মঞ্জরেকর); অদৃষ্টের টাইর্যা নি বাবাকে বাধ্য করায় পঙ্গু মেয়ের খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে (‘কাঞ্জিভরম’ / প্রিয়দর্শন); বা, সাদামাটা মধ্যবয়স্কা সংসারী বেছে নিতে চায় খুনি মালিকের অবৈধ প্রেম (‘থ্রি মাঙ্কিস’ / নুরি বিলজে সিলান)। অস্কার ওয়াইল্ড যেমন বলেনঃ “There is no such mystery so great as misery” - খিদের বা অভাবের আসল রূপ কতটা ভয়ঙ্কর ও নির্মম হতে পারে, তা হয়ত আমরা কেউই এখনও জানি না। আমাদের যাবতীয় সমাজ, শিল্প, বিপণন, বুদ্ধি, চাতুর্য, আইন, প্রেম – সব কিছুই উলঙ্গ করে দেয় এই সারমেয় ক্ষুৎসত্তাঃ
   
        “দামোদরের হাঁড়িকুঁড়ি ধর্মে রাখে মতি
        হাটের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে সন্তান-সন্ততি।”
(তনুজ নিয়োগী)
আর এই খেতে খেতে, খাওয়াতে খাওয়াতে, প্রতিপল মরতে মরতে - যখন সত্যিই ছেড়ে যায় প্রিয়জন? তখন কি বলে আমার সুবিধাবাদী মন?
   
        “আমার ভাতের জন্যে পুড়ে গেলে তুমি,
        এখনও ভাতের গন্ধে এত লালা আসে!”
(অঞ্জন চক্রবর্তী)
এতক্ষণ দেখছিলাম, নিজের মাংস পোড়ানোর গল্প। কিন্তু আমার কোষকে পুষ্টি দেওয়ার জন্যে আমার পিতার মাংসও তো পুড়েছে। বাবাকে তো কতভাবে দেখেছি, অভাবকে আনন্দের মোড়কে মুছিয়ে দিতে – নিশ্চিত ধসের সামনে দাঁড়িয়েও ছেলেকে খুশি রাখতে সে ঢুকে পড়ে রইস রেস্তোরাঁয়, পরোয়া করে না পকেটের (‘বাইসাইকেল থিফ’ / ভিত্তোরিও দে সিকা); অথবা, একবাটি জলে পাউরুটি ডুবিয়ে খেতে খেতে ছেলের সঙ্গে দিব্যি চালিয়ে যায় সুস্বাদু মাংসের গল্প (‘চ্যাপলিন’ / অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়)। এখন আমি এই যে খেতে বসেছি, থালায় ছড়িয়ে আছে যে শস্য – সেখানেও কি লেগে নেই জন্মদাতার অস্থি-মজ্জা-মেদ? আর সেই গ্রাস গলা দিয়ে নামাতে লালা ঝরছে আমার। কি সাংঘাতিক বাস্তব, তাই না? যতই শোকাতুর হই, যত প্রিয়জনই হারিয়ে যাক না কেন – খিদেই আবার আমাকে সব ভুলিয়ে দ্যায়। খিদেই কি তাহলে আসল সান্ত্বনা? আচ্ছা, এখানে ধরা যাক, কবি নয় - শুধুই আমআদমি। কি বলছে সে পিতৃবিয়োগের পর?
“বাপের থেকে টাকা বড় – মানতেই হবে! আগুন নিবতে না
নিবতেই আমাকে বেরোতে হয় সম্পদ সন্ধান ও নবীকরণে।”
(অঞ্জন চক্রবর্তী)
সম্পদ সন্ধান থেমে যায় না। যেতে পারে না। কারণ, আমাকে যোগাতে হবে নিজের ও পরিবারের আহার। যেভাবে আমার পিতা পুষ্ট করেছেন আমাকে, সেই একইভাবে খাওয়াতে হবে আমার সন্তানকে। আমার মৃত্যুর পর সেও আর দেরি করবে না নবীকরণে। কারণ, দেরি করলে চলে না। দেরি করলে পিছিয়ে যেতে হয়। পিছিয়ে যাওয়া-টা লজ্জা। সামাজিক ও পারিবারিক – দুভাবেই। তাই, যেমন করেই হোক, হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে চলি আমি। বাঁচতে-থাকার এই বাস্তবতায় একটা হেঁচকি কি উঠে আসে? হেঁচকি ও কান্না সামলে আবার সেই লোকটারই চলমানতা -  
“দেখি বেশ দিন কেটে যায়
কেটে যায়, রক্ত কই?
তোমাকে ভুলতে হবে
একথা স্বীকার্যই।”
(অঞ্জন চক্রবর্তী)
আচ্ছা, আমি যখন ছোট ছিলাম? মনে হতো, কবে বড়ো হব! বাবার মতো বড়ো! এই ‘বড়’ কনসেপ্টটা একটি শিশুর কাছে বাবাকে দেখেই জন্মায়। দেয়ালে টাঙানো বাবার জামা, আলমারির নিচে রাখা জুতো, ছাইগর্ভের সিগারেট – এসবই খুব লোভনীয় লাগে। তার কাছে এসবই এক পৃথিবী।
    “মৃত্যুর পর আমার হাতঘড়ি খুলে নেওয়া হবে
    কেননা মৃত্যু হলেও আমার হাতঘড়ি থেমে যাবে না
    ......
    ঘোড়া আর কচ্ছপের মত আচরণ করে ঘড়িটা
    টিটুর মজা হবে”
(অতনু ভট্টাচার্য)
আন্দাজ করি, ‘টিটু’ এখানে সন্তানের নাম। বাবার ঘড়ির দিকে তার খুব লোভ, যেমন ছিল আমারও। বাবা এখানে বলে যাচ্ছে, তার অনুপস্থিতিতে ‘টিটু’কে হাতঘড়িটা দিতে। বাবা জানে, কেউ না থাকলেও সময় কখনও থামে না। প্রথম দু’লাইনে এখানে সেই অমোঘ উচ্চারণ। তারপরই বলা হচ্ছে, ঘড়ির অদ্ভুত আচরণের কথা। দুই বিপরীতধর্মী প্রাণীর তুলনা রাখা হল একইসঙ্গে। সত্যিই তো, ঘড়ি কি নিজের নিয়মে চলে? সে তো শুধুই যন্ত্র। আমারই পুতুল। তাই সে কখনও ধাবমান, কখনও মন্থর – মালিকের মর্জিমাফিক। এরপর “টিটুর মজা হবে।” পিতার মৃত্যুতে সে কেন আনন্দ পাবে? এখানে কি বাবা নিজেই একটু মুখ টিপে হাসল? কেননা, বাবা জানে, এবারই শুরু হবে সন্তানের আসল ক্যারিশমা। এবার সে আসল পৃথিবীর মুখোমুখি। সময়কে যখনই যন্ত্রে বেঁধে দেওয়া হল – মানুষ শুরু করল যন্ত্রের দাসত্ব – ভুলে গ্যালো রং রস রূপ – তখন থেকেই আরম্ভ ‘বড়’ হওয়ার নামে আসলে ছোট হতে থাকা। বাবা তা জেনে গেছে। আর ‘টিটু’ যতদিনে জানবে - তখন?
        “অভিভাবকহীন হওয়ার মজা
        টের পাচ্ছি, স্বাধীন, ধেই ধেই,
        বিস্মরণকারণবারি ঢালি
        তোমার, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমার খুলিতেই!”
(অঞ্জন চক্রবর্তী)
রাগ কি হত না বাবার ওপর? ছোটবেলায়? খুবই হত। নানা আদেশ উপদেশ নির্দেশের ঠ্যালায় ওষ্ঠাগত। কিন্তু এখন আমি স্বাধীন। এই স্বাধীনতার কষ্ট বোঝাতে বসানো হল “মজা টের পাচ্ছি”। বিস্মৃতির মদ ঢেলে নিতে হচ্ছে পিতারই খুলিতে। এই খুলি কোথায় পাবো? নিশ্চিত, শ্মশানে। ওই চিতার পাশ থেকেই শুরু আমার স্বাধীন ধেই ধেই – যে স্বাধীনতার মানে খোলা আকাশ, মানে ছাদ নেই, আবরণ আচ্ছাদন বর্ম নেই – এবার পৃথিবীর মুখোমুখি আমি একা। এই একাকীত্ব মুছতে আসছে আমার সন্তানঃ
    “......
    ভালবাসা জমা হলে যে সন্তান হয়।
    হা ঈশ্বর দুটো ভাত চাইব না, শুধু
    আমারই মত সোজা আয়ুরেখা দিও।”
(প্রবীর মণ্ডল)
চিরাচরিত দুধভাতের কথা নয়, আমার প্রার্থনা – “আমারই মতো সোজা আয়ুরেখা”। কারণ, বোধ হয়, মূল বিশ্বাসে, আয়ুরেখা সটান থাকলে মানুষ জুটিয়ে নিতে পারে আহার। এর থেকে বেশি আর কি চাই? ওই যে লোকটা, ওই যে বউটা, ছেলেটা, বুড়োটা – ওদের সকলের জ্যালজ্যালে জীবনে ওরা আর কি চায়? আমিও তার বেশি কিছুই চাই না। আমি কবিতা বুঝি না। কবিতার গোষ্ঠী-আন্দোলন-দশক – এসব কিছুই বুঝি না। আমি বুঝি, নিরন্নের গ্রাসে লেগে থাকে যে চিরন্তন তৃপ্তি – ওটাই সত্যি, ওটাই কবিতা। আমার ভাতের গায়ে ওদেরই তৃপ্তির দাগ লেগে থাকে।
মেনু কার্ডঃ
• নিরাকৃত ভ্রাম্যমাণ তুমি / অতনু ভট্টাচার্য / অরন্ধন, পুরুলিয়া
• সান্ধ্যশিলালিপি / তনুজ নিয়োগী / কণিকা, কলকাতা ১৪৬
• দগ্ধ পদাবলী / অঞ্জন চক্রবর্তী / অদিতি, উঃ ২৪ পরগণা
• আহা ভাত প্রিয় ভাত / প্রবীর মণ্ডল / রূপকথা, দঃ ২৪ পরগণা

বাণীব্রত কুন্ডু

কাব্যগ্রন্থ পর্যালোচনা:
 ‘ব্রহ্মকমল অত উঁচু থেকে নীচে পড়লে বাঁচে না।’
রোদবসতির উঠোন / সুবীর ঘোষ
যাঁর কবিতার কাছাকাছি পৌঁছাতে প্রথমেই পার হতে হয় ‘কবির দরজা’ তিনি হলেন কবি সুবীর ঘোষ। ‘কবির দরজায় বৃষ্টিফলক’এ লেখা ‘এসো গোপনে অন্ধগলির শীতধন্দে/টুকে রাখছি হৈ-ভাবনা’। হ্যাঁ, তিনি এভাবেই একের পর এক কবিতা নির্নাণ করে গেছেন কী বিচিত্র ভঙ্গিমায়। যেহেতু সমকাল ছাড়া সাহিত্য হয় না তাই কবিও অপারগ তাকে এড়িয়ে যেতে। তাঁর কবিতাসমূহের অর্ধেক আকাশই রচিত হয়েছে প্রেম, প্রেমে শরীর, সমাজ, সমাজের নানান অন্তর্দ্বন্দ প্রভৃতি। কবির দৃপ্ত লেখনি তাই প্রতিবাদ জানায় ‘দাঁত বসাচ্ছে সমাজ কোথায়? কার গায়?’। আবার অন্য একটি কবিতায় কবি বলছেন -‘জন্ম থেকে যারা খ্যাংরাখ্যাপন বোঝে না তাদের জন্য / চাই কার্বাইড’, ‘আমি এখন হাঁচোড়পাঁচোড় ক’রে বাঁচছি’-প্রভৃতি। ‘নেচে বেড়াচ্ছে পাথর’ কবিতায় কবি বড়ো অদ্ভূতসুন্দর ভাষায় জানিয়েছেন নিভৃত প্রতিবাদ! সেখানে তিনি বলছেন-‘পরের অন্ন খেতে খেতে / ছেলেটি মারা গেল / আর তখনি এল মেঘ / গাছে গাছে নেচে বেড়ালো / পাথর’। অন্য একটি কবিতায় কবি নির্মাণ করেছেন অপুর্ব আচ্ছন্নতা - ‘আজ দুঃখে শিলাবৃষ্টি নামে রাতের গভীরে,/ বুদ্বুদ মিসাইল / ফসলবঞ্চিত মাঠে পড়ে থাকছে চোখের খোলস / সাপঘুমে নিরক্ষর / আমার হরিণগুলো ঘাস ভেবে খেতে চায় / ভালোবাসা স্মৃতি’। অভিনব চিত্রকল্পনা রচনায় কবি সিদ্ধহস্ত, ‘উষ্ণ পৃথিবীর কবিতা’য় লিখছেন – ‘হরিণ মাংসাশী হলে আমিও অশ্বক্ষুরে পদচিহ্ন ঢেকে / কুসুমে কুসুমে হেঁটে চলে যেতে পারি দূরে...’ অথবা, - ‘আমি কখনো খেটে খাচ্ছি কখনো আগুন জ্বেলে নাচছি টইটম্বুর; / একুশিকার জঙ্ঘা ছুঁয়ে ঘাসমুড়োনো যন্ত্র ঘুরছে, ফিরছে, এগিয়ে যাচ্ছে / গড়জঙ্গলের দিকে – টিলা সাজছে উৎসবে, ছাতা খুলে দিয়ে ঢাকছে / আকাশের ছায়া।’ ‘দেহবান্ধবী’ কবির এক আসামান্য শব্দবন্ধনির্মাণ। কুশলী কলমে রূপরচনা করেছেন দেহবান্ধবীর। - ‘ভাতের গন্ধ বড়ো সনাতন...বয়েজ হস্টেলের খাটে পড়ে থাকে দেহবান্ধবীর ঘর।’। ‘আমার বসন্ত নিংড়ে তোমাকে বর্ষার শিল খাইয়েছি বহুবার...’  কবিতার মধ্যে স্বাভাবিক হতাশাব্যঞ্জক চরণও উঠে আসে যেন আধুনিক সমাজের জঠরে মোচড় দিয়ে, - ‘আমরা আর কিছু চাইব না / কেননা দেয়ার মতো কোনো লোক নেই। / কোনোদিন কি ছিল? কর্ণ শিবিরাজা বা হর্ষবর্ধন?’ অথবা, ‘দু-কদম এগিয়ে যাবার ফাঁকে উঁকি মেরে দেখি / কেউ বুঝি পিছু নেয়; বানচাল করে দেয় শৈশবের / হংসকল্প শ্লোক।’ যে কবিতা নিজেই নারী সেই কবিতাকে দিয়েই কবি তাঁর ‘নারীবিষয়ক কিছু ভাবনাচিন্তা’ উগ্‌রে দিয়েছেন। - ‘নারী আসলে হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো তুলো বা খই ভূমি স্পর্শ করার আগেই যে দিক পরিবর্তন করে।...নারী যেন সেই চিল, দেখা পাওয়া মুশকিল।’ এভাবেই কবি একের পর এক কবিতা সাজিয়েছেন আপন কৌশলে। শুধু অর্থগতভাবে নয়, কবিতায় নতুন ভাববিষয়ের সঞ্চার, শন্দমাধুর্য়, শব্দবিন্যাসের যথাযথ প্রয়োগ, নতুন শব্দকল্পদ্রুম-প্রণয়ন; সবমিলিয়ে ‘রোদবসতির উঠোন’ এক অনন্ত সময়ের কোমলকঠিন জ্যোত্স্নামাধুরিমায় আপ্লুত, আচ্ছন্ন। কবির সৃজন অমর হোক।

সুবীর সরকার


মেইলবক্স


১.
আর অসুখ না থাকলে গান
গোড়ালির ব্যথায় হাঁটতে পারি
                  না
উরুতে ঘা নিয়ে শুয়ে থাকা
শালিক হারাচ্ছে শোলকচুর ভুঁই
প্রচুর ঘাস হবে নদীখাতে
হলুদবর্ণ দিনকাল
মরচেধরা রেললাইন

২.
প্রায় শেষ হচ্ছে শীতকাল
জলে মিশে যায় বাসি
                  রুটি
কুয়াশা নেই,চালতাছায়ায়
হেডলাইটের আলোয়
                  পিচ পথ
ফুরিয়ে আসা শীতে হোঁচট খায়
কাঁকড়া, কাছিম ও বনবিড়াল

৩.
এলোখোঁপায় চিরুণী। চিরকালীন বর্ষাজল
স্বরের ওঠানামা,মেঘশিকারের দিন
বারান্দা নির্জন মানে ঠেঁটে কামড়
টানা হাসির লহর,টুপি নেমে আসছে
                  কপালে
#
পায়ে পায়ে ধানকলএক মাইল জঙ্গল



অনিন্দ্য সুন্দর রায়


আমার কথা  
 
সামনের বাড়ির লোকটা একদৃষ্টে আমার ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে আছে
ঝুঁকে পড়া মেয়েটার দিকে দেখছে ঘনঘন
বুক দেখছে
ভাবছে মা এলে আমার আমার নামে যা-তা বলে দেবে
ওই কালো চশমাটা মাকেও এভাবেই দেখে 


চশমার ভিতরটা ভীষণ অন্ধকার
চোখ বলে কোনো বস্তুই নেই সেখানে...



জুবিন ঘোষ


গ্রাম থেকে শহরে   
 
এখানে কোথাও কাঁচের চুরি পাওয়া যায় না
এমন কী অনেক জনপদেও খুঁজেছি
আসলে এখানে তেমন কোনো মেলাও নেই  

প্রিয়তমাষু, এভাবেই আমি সভ্যতা থেকে সভ্যতা
তোমায় খুঁজি ; শেক্সপিয়ার সরণি ধরে চলে যাই
খোলা ম্যানহোল  আর মনে রাখা ইঁটের ধাপগুলো গুণে গুণে
      ভিজে কলকাতা ছেড়ে
মফস্বলের কাক-ডাকা গলির মোড়ে

প্রিয়তমাষু , এখন আমি কলকাতা চিনি
ভিক্টোরিয়া অথবা শহীদমিনারের আশেপাশে
আমার ময়নাতদন্তের লাশখানা শুয়ে থাকে
কুকুর শুয়ে থাকে
চায়ের দোকানের সামনে গঙ্গাজল ছিটিয়ে
চলে যায় ঝাড়ুদার, কলের লাইন , বার্থরুমের ঠেলাঠেলি , এঁদোগলি
এখানে প্রতিদিন অনেক কবিতা লেখা হয়
এখানে প্রতিদিন অসংখ্য মিছিল এগিয়ে যায়
এখানে এলে বিজ্ঞাপনে তোমার দু'চোখ ধাঁধিয়ে যাবে
এই শহরেই আজ কবিতা পড়তে এসেছি

প্রিয়তমাষু , এখন আমি কলকাতা চিনি
অলিগলি, রাজপথ, ভিক্টোরিয়া, নন্দন, রবীন্দ্রসদন
মেট্রোর দরজায় একাই টিকিট কাটতে পারি
লাফিয়ে নামতে পারি চলমান সিঁড়ি দিয়ে
আমাদের ওখানকার যাত্রার মতো, এখানেও
শহরের শিরা-উপশিরায় পথনাটক ঘুরে বেড়ায়
তবে, এখানে ডাং-গুলি বা কিত্‌কিত্‌ খেলা হয় না  
বদলে এখানকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যায় আইনক্স বা সিটিসেন্টার
এখানে সবাই বাংলা ভাষাতেই কথা বলে
অথচ আশ্চর্য ! এখানে আমি সবার ভাষা বুঝি না !
এখানে কেউ কাঁচের চুড়ি পরে না প্রিয়া
এমন কী অনেক জনপদেও খুঁজেছি

প্রিয়তমাষু , এখন আমি কলকাতা চিনি
একটা সোজা-সাপ্‌টা কলকাতা চিনি
তোর বর্ণমালায় যে রঙিন কলকাতার স্বপ্ন ছিল, তাকে চিনি

এখানে গাড়ি হাত দেখালেই দাঁড়ায় না
এখানে আকাশ দেখি না নিচু থেকে
এখানে কেউ কাদা খেলে না , দুপুর হলেই নেমে পড়ে না পুকুরে 
সেই ভয়ে, ট্রাফিক জ্যামে সিটকে যায় আমার লালচে হৃদপিণ্ড
দৈত্যাকার লোকগুলো নেমে নেমে আসে তারপরেই ; -        
তাদের দাদা বলতে হয় , দিদি বলতে হয় , নইলে
রাক্ষস হয়ে ওঠে মুহূর্তেই, ঘোড়ার মধ্যে জন্ম নেয় কবিজাত সন্তান-সন্ততিরা    
এখানে কোথাও এতটুকু বিকেল হয় না প্রিয়া

প্রিয়তমাষু , আমাদের ও'গ্রামে
এখনও একটু বিকেল হয় তো ?

আমাদের সেই গ্রামে এখনও একটু সকাল হয় তো ?  



অনুপম মুখোপাধ্যায়


দুটি কবিতা


পৃথিবী যত ঝাপসা হয়ে আসে
কাচ কি ততই নরম হতে থাকে
#
কাঁচ ...তোমার থেকে আমি মধ্যযুগের চেয়েও দূরে সরে আছি


কনসোনেন্ট ... কত সতর্ক এক শব্দ !
একটাও স্বরবর্ণ পালিয়ে যেতে পায় না
#
আর্ত  অবধি চুঁইয়ে আসছে ও
#
এবং আআআআআ ...




গোপাল লাহিড়ী


গ্যালাক্সির গল্পকথা

  
 ভাবে ভাবা যেতে পারে কখনো কখনো-
তোমার চোখ থেকে হঠাৎ সর্বনাশ মুছে গিয়ে 
এখন জলরঙে আঁকা নির্মাণসৌধ জেগে উঠেছে.  

বয়ে  যাওয়া নদী এখনও সেইরকম ধারালো- 
দুপাশে ঝরে যাওয়া পাতার পুরু কার্পেট,
স্বপ্নগুলোকে বান্ডিলে বেঁধে নেওয়া.

ঘরদোর ছেড়ে একেবারে খোলা প্রান্তরে-
সাঁজি ভরে যায় ছোট ছোট ফুলে
প্রবল শোক , মাটি ও খড়ের আয়োজন.

যা হারাবে বলে এত কাছে এসেছিল-
সারা রাত কারা যেন জ্বালায় ম্যাজিক লন্ঠন
পুরোটা নয় খানিকটা যেন তারার সংঘর্ষ.

গনগনে আগুন পুড়িয়ে দিক রূপের চিত্রগুলো-
রক্তমাংসের মানুষ আর কাঠের জ্যামিতি,
পৃথিবীর পথ একটু একটু করে বেঁকে যায়.

গাছেদের শাখায় সরু নীলাভ  আগুন-
চারিদিকে সময়ের উচুনিচু ঢেউ  তরঙ্গ
শোনাবে অজানা গ্যালাক্সির গল্পকথা । 



কচি রেজা


জুতোর বাক্সে ঘুমোই

সংসারের নিয়মে আমি এখন জুতোর বাক্সে ঘুমোই
জুতোর বাক্সে ঘুমোতে ভালো লাগে না তখন পুতুলগুলোর কথা মনে পড়ে
পুতুলগুলো একদিন একবাক্স থেকে আরেক বাক্সে স্থানান্তরিত হয়েছিল
সেদি ওদের কান্না কিন্তু আমি শুনিনি

অথচ হঠাৎ একদিন বিসর্জনের বাঁশি বেজে ঊঠলে
আমার মায়ের ভারি আঁচলে রপোর চাবি দুলে ওঠে
মণ্ডপের ছায়ায় নিভে যায় হাজার নীলবাতি
প্রতিমার অসহায় কান্না কেউ শুনতে পায়নি, আমিও পাইনি
বরং কাঁধে আঁচল ঘুরাতে শিখেছিলাম
আমিও সেদিন সেজেছিলাম মিথ্যে মা

আসলে সব মা-ই মিথ্যে

পুতুলের কান্না কিন্তু আমি আজও শুনি
নতুন শাড়ি,ব্রোকেড ব্লাউজ,নতুন খোঁপা,কিশরি চুল কতটা লম্বা এখন
পুতুলগুলো কি মরে গেছে?
জানি, মানুষই তো মরে,আর জানি,আমার মা যা জানে না
পুতুলগুলো আমার বুকে ঘুমতে ভালোবাসতো

আজ যখন একটি হাত আমার ঘুমন্ত মুখ হাতড়ায়,চুল বেঁধেছি কি না
চোখ ভিজে কি না -----  তখন কবরের সবকটা বাতিই নিভে যায়
দম আটকে মা যখন বলে, 'খেলবি,পুতুল বানিয়ে দেব আবার ?'

আমার ছেঁড়া কাপড়ের পুতুল কি এত কেঁদেছিল সেদিন

আমার মায়ের ভাঙা পুতুলের মতন! 


রমিত দে


ওইপাশে অনুক্ত
ও ছড়িয়ে পড়ুক
সংখ্যাহীন মুকুলের দিকেই ওর স্থিতি

লাল সাদা জামা পরে ঝুমকোলতা
ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ঝুমকোলতা                                          
চিনেমাটির হাতল ভেঙে ওই ওর বিষাদ

দুলতে দুলতে ভেসে চলেছে
সাত টুকরো হয়ে ভেসে চলেছে...

বেত ঝোপ সরিয়ে
হলদে মতো দুঃখকে সরিয়ে  
শোক আবার এক গা গয়না পড়েছে

দুঃখের কাছে দাঁড়ালে
শোকের কোনো ছলাকলা নেই
পূর্বাভাস নিয়ে তার কোনো প্রশ্ন নেই

পাখি বসিয়ে
গাছ বসিয়ে
ছুঁতে না পেরে কেউ কিনে রাখছে
          সামান্য যোগাযোগ!
প্রথার ভেতর লাফিয়ে নামছে মাছ...

সুবাতাসের সাথে ও ফিরে যাক
ডিম খুঁজতে খুঁজতে
জলের সাথে বিয়ে হয়ে যাক মাছের...


মেঘ অদিতি


প্রস্তাবনা

ভূমিকা
এই তবে নাও-
শুরুতে রাখছি রোদ
সাথে ধূপমিশালি ঝড়-
রাখছি মুঠোভর্তি জলপাই বনসবুজ
প্রদর্শনীর দেয়ালে দেয়ালে যত পাখি
তার চেয়ে আরো কিছু
এমন বিরল সখ্য পাখিডানা

এবার মাটি মেখে মেখে বড়ো হোক  
না দেখা মেয়েটি



রত্নদীপা দে ঘোষ


জন্মদিন

তাঁর পায়ে ইশ্বরের শব্দ
#
তিনি বললেন যুদ্ধ করো মানুষ ...এই রক্ত , এই বারুদ , অসংখ্য কুরুক্ষেত্র
সব ময়ূরের মতো ডানাওলা মিহি মেঘ
#
যুদ্ধ শুরুর আগে তিনি মানুষ কে দিলেন সমুদ্রের পোশাক
করতলে আয়ুশাখা আর গাছ থেকে খসে পড়ার সংকেত

অতঃপর নদীর পালাগান গাইলো অরণ্য মেরু
#
আগামী পূর্ণিমায় তিনি পরিপূর্ণ আকাশ হবেন , সেতারের মতো কথা বলবে চোখ ,
মাটির মতো উজ্জ্বল কাঁধ , অলৌকিক পাখিময় চুল
দিগন্তে বিলীন হয়ে থাকবে প্রার্থনা
#
আর ওইদিন নৈশ ভোজের পর
তিনি মানুষকে ছবি আঁকতে শেখাবেন
#
তিনি বাঁশী বাজালে চাঁদও রাখাল



সূরজ দাশ


জটায়ু


প্রতিটি ভোরই মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায়
অলিখিত পতনের দিকে
#
ছিন্নশির প্রাচীন জটায়ু
#
লোকাল বাসের ছাদে দুর্বল তীর্থের কাক
দিন গোনে, ঘণ্টা গোনে, মিনিট সেকেন্ড পল অণুপল
#
গুনতে গুনতে ভেঙে যায় বানানো গল্পের পাহাড়
#
ভোরের প্রথম গানে সেই কবে বেজে উঠেছিল হাওয়ার উৎসব
আজ কেবল জেগে থাকা শূন্য পথঘাট
#
ভয়ের রোদ্দুর মাখা দু-একটা তীব্র দুপুর 

 

 

 

রাহুল বিদ


দশমহাবিদ্যা

কেষ্ট বলে গেছে
শ্রেষ্ঠ কথাগুলি !
বেশ তো শোনো বলি
বিদ-দা ব্রজবুলি

    
অগ্নি সুস্বাদু
ভগ্নি তারও চেয়ে
লগ্নি বেড়ে যায়
আখেরে তাকে পেয়ে

    
বসতি ছারখার
অসতী এসো বুকে
শতটি গ্রাম দেব
বদলে বন্ধুকে

    
শিশ্ন রোদ্দুরে
উষ্ণ চারিদিক
প্রশ্ন করা মন
প্রত্নতাত্ত্বিক

    
বুদ্ধ হাসে রোজ
যুদ্ধ বারোমাস
রুদ্ধ দলে দলে
ছন্দ কাটে ঘাস
      
    
আর্ত সারা দেশ
পারতো বেঁচে যেতে
শর্ত একটাই 
আত্ম বেচে খেতে...

    
মুক্ত তরবারি
যুক্ত কারবার
ভুক্তভোগী মালা
ছিন্নমস্তার

    
উৎস হারিয়েছি
সূত্র খুঁজে পেতে
পুত্র হারিয়েছি
ভিন্ন জনমতে

    
কোনটা ঠিক ভুল
মনটা খুঁজে মরে
কুণ্ঠা কাছে এসে 
কণ্ঠ চেপে ধরে

    
খণ্ড সংঘাত
অণ্ড কোষে কোষে
মুণ্ড কাটা জিভ
ব্যক্তিরস চোষে

     ১০
অস্ত ঠিকই যাবে
মস্ত শুঁড়িখানা
সুস্থ স্বপ্নের
হাতটা ছাড়ছি না

হালটা ছাড়ছি না