বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সম্পাদকীয় - ৩য় বর্ষ ১১তম সংখ্যা

সম্পাদকীয়



যাদের স্বপ্ন ছিল রবীন্দ্রনাথের
‘বাঁশিওয়ালার’ চেয়েও সুন্দর
একটি কবিতা রচনা করার,
সেই সব শহীদ ভাইয়েরা আমার
যেখানে তোমরা প্রাণ দিয়েছ
সেখানে হাজার বছর পরেও
সেই মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন
মুছে দিতে পারবে না সভ্যতার কোনো পদক্ষেপ।
('আজ আমি এখানে কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি...')
-এভাবেই কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী ১৭ পৃষ্ঠার দীর্ঘ একটি কবিতা লিখেছিলেন ৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ওইদিন রাতেই, যা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ইতিহাস হয়ে আছে।
এমন পাগল আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনো। ভাষার জন্য পাগল। কথার জন্য পাগল। নিজ সত্তার জন্য পাগল। একটা নোংরামির মত করে , কিছুটা বুদ্ধি হীনতার মত , খামখেয়ালীর বশে ছোটলোক পাকিস্তানি গোষ্টি বাংলায় কথা বলতে বাঁধা দিয়েছিল ডানপিঠে বাঙালি জাতিকে। সে কি আর হয় ! দুরন্ত সুনামীকে কোন বাঁধ ঠেকাতে পারে ! পারেনি সে দিন। তাজা রক্তের বিনিময়ে বাংলায় কথা বলা!
বাংলার মানুষ এই দিনটিকে এতই শ্রদ্ধা করে যে , ২১ ফেব্রুয়ারী প্রাতে খালি পায়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। প্রভাত ফেরি করে শহীদ মিনারে ফুল দেয়। আজ এই দিনটি একটি উত্সবে পরিনত হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মূলত সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, সফিউল প্রমূখ দামাল ছেলেদের আবেগকে সম্মান জানানোর জন্যই এই আয়োজন।
কিন্তু ,বেদনার বিষয় হচ্ছে , বাংলাদেশ ছাড়া অন্যকোথায়ও এই সংস্কৃতিটা ধারণ করতে দেখা যায়না। বাংলাদেশের পথে প্রভাত ফেরিতে নেমে পড়া তরুণ-তরুনীদের মনে কতটুকু পুলক জাগে ,তা ভালবাসা দিবসে নাইটক্লাবে নাচা ছেলেমেয়েরা কখনই বুঝতে পারবেনা।
তা যাগগে, আমাদের বাংলা ভাষাভাষীরা-ইবা বাংলাকে কতটুকু ধরে রাখছি। কলকাতার লোকজন হিন্দিতে কথা বলতেই গর্ব বোধ করে। বাংলাদেশিরাও কখনো হিন্দী ,কখনো ইংরেজি মিশিয়ে জগাখিচুড়ি ভাষা ব্যবহারে নিজেকে স্মার্ট হিসেবে জাহির করছে। অমৃতসম বাংলা ভাষা পুরান সুতি কাপড় হয়ে যাচ্ছে বাঙালিদের কাছে। সৃজন সেন তাঁর কবিতায় তাই লিখেছেন -
সেবার লন্ডনে
এক জাপানি শিল্পপতিকে
বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে
তার মাতৃভাষা জাপানিতে
অন্যদের সঙ্গে যখন অনর্গল কথা বলতে দেখেছিলাম
তখন আমার বুকের ভেতরে
কেমন যেন একটা কষ্ট হচ্ছিল,
ইংরাজিতে কথা বলতে না পারার জন্য
ওই মানুষটির ভেতরে কোনও লজ্জা ছিল না,
বরং মাতৃভাষায় কথা বলতে পারার অহমিকায়
মানুষটিকে যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখেছিলাম,

(--মাতৃভূমির জন্য-সৃজন সেন)
যাইহোক , ধন্যবাদ আমার শ্রদ্ধ্যেয় সাহিত্যিক ভাইদের ,যাঁদের অসামান্য সাহিত্য সৃষ্টির জন্য ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় এই ভাষার উপস্থিতি ছিল বেশ জোরালো। ফেব্রুয়ারী আমার কাছে বেহেস্তের জানালা মনে হয় যা খুলে দিতেই পৃথিবী সাজতে শুরু করে। বসন্ত - ভালবাসা দিবস ,সবই এই ফেব্রুয়ারিতে। এই ঋতুতে যেন সবার মন হালকা হয়ে উঠে পায়রার পালকের ন্যায়। রবীন্দ্রনাথ তাইতো গেয়েছেন -

আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,
আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,
এই সংগীতমুখরিত গগনে
তব গন্ধ করঙ্গিয়া তুলিয়ো।
তরুণ তরুনীরা অভিসারে মিলে এই ঋতুতে। নানান কবি নানা ঢঙে রচনা করেছেন বসন্তকে। আমাদের এই সংখ্যায়ও লেখকরা লিখেছেন বসন্তের কথা। লিখেছেন বইমেলার কথা।

বাংলার মাঠে বইমেলা আজ আর নিছক মেলা নয়, আমেজ,উদযাপন আর উত্তেজনায় ঈদের খুশির মত। বইমেলা নয় "ঈদুল বইমেলা" এর নতুন নাম। বাংলাদেশে বইমেলা অনেককিছুর দিক ঘুরিয়ে দিতে পারে। রাজনীতিও তার বাইরে নয়।রাজনীতির কথা মনে পড়ল। অনেক দুর্গন্ধ ছড়ানো শেষে দেহের ক্ষতে শুকনো চর্মের প্রলেপ পড়ল। থমথমে পরিস্থিতে উতড়ে ঝর শেষের আকাশের মতই এই মুহুর্তের বাংলাদেশ। শুধু ৭১' এর রাজাকারদের বিচার কার্যকর হলেই হয়। রাজাকারহীন বাংলাদেশ দেখার অনেকদিনের স্বপ্ন। আমি বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই।



ক্ষেপচুরিয়ানস্ সম্পাদকমন্ডলীর পক্ষে
পাভেল আল ইমরান

বাংলা ভাষা বিষয়ক - রাখাল রাহা

বাংলা ভাষা বিষয়ক :রাখাল রাহা



'দুখিনী বাংলা বানান' ও সুখী/সুখি বানানবিদ (!)


ঢাকার একটি দৈনিকের সাহিত্য-সাময়িকীতে গোলাম মুরশিদের বানান-বিষয়ক একটি লেখা 'দুখিনী বাংলা বানান' পাঠ করে প্রথমে দুটি বিষয়ের কথা মনে হলো/হল। কিছুদিন আগে ঢাকা শহরে একটি প্রতিষ্ঠানের বড় বড় কিছু বিলবোর্ড দেখা গিয়েছিল, যেখানে 'গাড়ী ভরে বাড়ী যান' এমন একটি বাক্য ছিল। এটি বিজ্ঞাপন আকারেও অর্ধপৃষ্ঠা-সিকিপৃষ্ঠা জুড়ে কিছু দৈনিকে ছাপা হয়েছিল। কিন্তু 'গাড়ী-বাড়ী'র বিকল্প বানানের বিধান সেই ১৯৩৬ সালে দেওয়া! তার হীরক-জয়ন্তী পার করেও মানুষ (পণ্ডিত নন) আজও ওখানেই রয়ে গেল কেমন করে? আরেকটি হচ্ছে, গত ১০ বছর ধরে কিছু সরকারী/সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর/শ্রেণির প্রথম দিকের রোলনম্বরধারী শিক্ষার্থীদের, অর্থাৎ ভালো ছাত্রদের, বর্ণমালা লিখতে দিয়ে আমি কিছু তথ্য পেয়েছি। তার একটি হচ্ছে অনেকেই বর্ণ হিসাবে 'ক্ষ' লিখেছে যা তাদের বাবাদের পাঠ্যপুস্তকেও, অন্তত সরকারী/সরকারি পাঠ্যপুস্তকে, ছিল না। অন্যদিকে ২০০২ সালে অন্তঃস্থ-ব বর্ণমালায় সংযুক্ত হলেও দেখা গেছে প্রায় কোনো শিক্ষার্থীই বর্ণটি লেখেনি।

এগুলোর সমাজ-ভাষাতাত্ত্বিক তাৎপর্য রয়েছে নিশ্চয়। এই তাৎপর্য অনুসন্ধান করা বানানবিদদের (!) কাজ নয়। লেখাটি যিনি লিখেছেন তিনি বানানবিদ (!) নন, সত্যনিষ্ঠ গবেষক বলে তাঁর পরিচিতি। বাংলা বানান নিয়ে সাম্প্রতিক নিরীক্ষার কিছু প্রকৃতি তিনি উপলব্ধি করেছেন। লেখাটিতে তিনি বাংলা বানান নির্ধারণের ইতিহাসের আদিকাল হয়ে ইংরেজী/ইংরেজি বানান সংস্কারের বিভিন্ন প্রচেষ্টা উল্লেখ করেছেন, এবং পরিশেষে 'শ্রেণী'কে 'শ্রেণি'করণ ও 'চীন'কে 'চিন'করণ করার দৃষ্টান্ত্ তুলে ধরে একরকম হাহাকারই করেছেন।

লেখক ১৯৩৬ সালের বানান-বিষয়ক সুপারিশকে 'গোঁজামিল' বলে উল্লেখ করেছেন। তবে তৎপরবর্তী পর্যায়ের বানান-সংস্কার প্রক্রিয়াগুলোর ইতিহাস জেনে, রবীন্দ্রনাথের সর্বপ্লাবী প্রভাবের কথা স্বীকার করে নিয়েও, নিশ্চিতভাবে বলা যায় - এগুলোর মধ্যে ১৯৩৬ সালের সুপারিশমালাই সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক ও যৌক্তিক পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হয়েছিল। তাই বাংলাদেশের শিক্ষিত সাধারণ মানুষ, পাঠক ও শিক্ষার্থীরা ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত্ মোটামুটি এটা অনুসরণ করেই পড়ে-লিখে-বুঝে আসছিল। এরপর এখানে যা হয়েছে তা 'সরকারি হস্তক্ষেপ', এবং যেটা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, 'সরকারি আদেশের ফলে যা হতে পারে, তা হলো : বানানবিভ্রাট।' এবং সেটাই ঘটেছে।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে এটা শুরু হয়েছিল ১৯৮৮ সালে তৎকালীন সামরিক-শাসক প্রবর্তিত সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচী/কর্মসূচি বাস্তবায়ন কৌশলের সাথে বাংলা লিপি-স্পষ্টীকরণ ও বানান-সহজকরণের ফর্মুলা জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে। তখন বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যায়ন গ্রহণের জন্য পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ৩ দিনের একটি কর্মশিবিরের আয়োজন করে। এর কৌশলী শিরোনাম ছিল 'সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার পটভূমিতে পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের সমতাবিধান-বিষয়ক জাতীয় কর্মশিবির'। ৩ দিনের সেই কর্মশিবিরে গৃহীত সিদ্ধান্ত্ ছিল বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা-উত্তরকালে গৃহীত সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত্।

প্রকৃতপক্ষে 'সমতাবিধান'-এর নামে যা করা হয়েছিল তা হচ্ছে 'পাঠ্যপুস্তক' এবং 'পাঠ্যপুস্তক নয়' এমন বিভাজন টেনে ব্যাপক লিপি-সংস্কার এবং কিছু বানান-সংস্কার। কারচিহ্ন ও যুক্তবর্ণ মিলিয়ে ৪২টির মতো টাইপ তাঁরা পরিবর্তন করেছিল। সেই ৪২টি টাইপ ব্যবহৃত হয় এমন শব্দসংখ্যা বাংলায় কয়েক হাজার। সুতরাং তখন থেকে এই সহস্রাধিক শব্দের পাঠ্যবইয়ে ব্যবহৃত রূপ আর পাঠ্যবইয়ের বাইরের জগতে ব্যবহৃত রূপ আলাদা। শুধু তা-ই নয়, ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত্ বোর্ডের সিদ্ধান্ত্ ছিল উক্ত টাইপগুলোর আদি রূপ - যেটা শিক্ষার্থীরা পথে-ঘাটে, পত্র-পত্রিকায়, অপাঠ্য বইয়ে, টেলিভিশনে পড়ে-দেখে সেটা - তাঁরা শেখাবেন না। কিন্তু ২০০৫ সালে এসে তাঁরা স্পষ্ট রূপটাকে চালু রেখেই আদি রূপটিও শিক্ষার্থীদের শেখানোর বিধান দিলেন। তাই আগে শিক্ষার্থীরা যুক্তবর্ণের অস্পষ্ট একটা রূপ শিখত, এখন তারা স্পষ্ট-অস্পষ্ট দুটোই শিখছে। স্পষ্ট শিখছে পাঠ্যবই পড়ার জন্য, আর অস্পষ্ট শিখছে 'অপাঠ্য' বই পড়ার জন্য।

লিপির পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বিকল্প বর্জন করে যেসব বানান গ্রহণ করেছিলেন তার কিছু দৃষ্টান্ত্ এরকম : খ্রিস্টান, পোস্টঅফিস, পেশি, শেফালি, আমদানি, গ্রিক, জানুয়ারি, লাইব্রেরি, নানি, বাঙালি, সোনালি ইত্যাদি। কিন্তু 'বহুলপ্রচলিত' বলে তাঁরা হাত দেননি শ্রেণী, পল্লী, রানী, একাডেমী, নবী, বীমা, লীগ, স্পীকার, শহীদ ইত্যাদি বানানে। তবে ২০০৫ সালে এসে তাঁরা বললেন, খিস্ট ও খ্রিস্টান শেখানো ভুল হয়েছে, কারণ খিষ্ট ও খ্রিষ্টান বাংলায় 'আত্তীকৃত' হয়ে গেছে!

অন্যদিকে বাংলা একাডেমী/একাডেমি ১৯৯২ সালে তাঁদের প্রণীত বানানবিধিতে বহুল প্রচলনের ছাড় দিলেন না। তাঁরা করলেন শ্রেণি, পল্লি, রানি, নবি, বিমা, লিগ, স্পিকার, শহিদ ইত্যাদি; একাডেমী-কে বাইরে রাখলেন। ২০০৫ সালেও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বহুল প্রচলনের বিধি অপরিবর্তিত রাখলেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের শিক্ষাবিভাগ একাডেমী/একাডেমির বানানকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করায় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড পিছিয়ে গেছে। তাই তাঁরা 'বহুল প্রচলনের' বিধি বাতিল করে একাডেমীর/একাডেমির 'শ্রেণি' ইত্যাদি বানান চালু করেছে পাঠ্যপুস্তকে।

এই যে ডামাডোল তাতে বানানবিদদের কারো পক্ষেই এখন বলা সম্ভব নয় তাঁরা কখন, কোনটা, কার জন্য, কেন করেছিলেন। বোর্ড ও একাডেমী দুটোরই বানানবিধি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন এমন একজন অধ্যাপকের সাথে কথা বলে এটা নিশ্চিত হয়েছিলাম। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ এর থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে দুবছর গবেষক হিসাবে কাজ করেছিলেন; লিখে, চিঠি লিখে, বক্তৃতা দিয়ে নিজের মত ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু এখন বানানবিদেরা অনেকটা শীত-গ্রীষ্ম বুঝে কাজ করেন। তাঁরা পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে গিয়ে বোর্ডের চাহিদামতো করেন, বাংলা একাডেমী/একাডেমিতে গিয়ে একাডেমী/একাডেমির মতো করেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনে গিয়ে ফাউন্ডেশনের মতো করেন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে মাদ্রাসা বোর্ডের মতো করেন, পত্র-পত্রিকা বা অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাদের মতো করেন, এবং নিজের বইয়ে নিজের মতো করেন!

তারই সর্বশেষ ধারাবাহিকতায় এসেছে প্রথম আলো ভাষারীতি। এটা শুধুই 'হাউজ স্টাইল' নয়, তার চেয়ে 'একটু বেশি/বেশী'। কারণ তাঁরাও বানান বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত্ গ্রহণ করেছে যা বাংলা একাডেমী/একাডেমি থেকে পৃথক। যেমন একাডেমীর বানান ঈগল, একাডেমী, ক্ষেত, ঘণ্ট, চাষী, ঠাণ্ডা, দেশী, নিশ্বাস, বন্দি (আটক অর্থে), মূলা, ইত্যাদি ভাষারীতির বানানে হয়েছে ইগল, একাডেমি, খেত, ঘন্ট, চাষি, ঠান্ডা, দেশি, নিঃশ্বাস, বন্দী (আটক অর্থে), মুলা, ইত্যাদি।

বাংলা বানান ও লিপি-সংস্কারের এই যে প্রক্রিয়া এর প্রভাব বিষয়ে গোলাম মুরশিদ এক প্রজন্মের সাহিত্য থেকে আরেক প্রজন্মের পাঠকের বিচ্ছিন্ন হওয়াসহ কিছু ক্ষতিকর দিক চিহ্নিত করেছেন। ভয়ঙ্কর/ভয়ংকর সত্য হচ্ছে - এখন অধিকাংশ মানুষ ভাবে, একটা কিছু লিখলেই হয়। কিন্তু তারও চেয়ে ভয়ঙ্কর/ভয়ংকর ক্ষতি যেটা হয়েছে আমাদের জাতীয়তার দ্বন্দ্ব, স্বাধীনতা ঘোষণার দ্বন্দ্ব, সমতল-পাহাড়ের দ্বন্দ্ব, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর দ্বন্দ্ব, সামরিক-বেসামরিক দ্বন্দ্ব, এনজিও-জিও দ্বন্দ্ব ইত্যাদির পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ের মধ্যেই প্রবেশ করেছে ই-কার ঈ-কার, উ-কার ঊ-কার, বর্গীয় জ অন্তঃস্থ য, দন্ত্য ন মূর্ধন্য ণ, দন্ত্য স মূর্ধন্য ষ, ২১-২১শে ইত্যাদির দ্বন্দ্ব। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যেন মনে হয় ই-কার, উ-কার, বর্গীয় জ, দন্ত্য ন, দন্ত্য স, ২১, ১৬, ২৬ এগুলো প্রগতিশীল - অনেকখানি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের; আর ঈ-কার, ঊ-কার, অন্তঃস্থ য, মূর্ধন্য ণ, মূর্ধন্য ষ, ২১শে, ১৬ই, ২৬শে এগুলো প্রতিক্রিয়াশীল - রাজাকার-টাজাকার হবে! কি/কী বিশাল সামাজিক সময় ও শক্তি আমরা ব্যয় করে চলেছি কিছুই না করার কাজে!

বাংলা ভাষা বিষয়ক - বীরেন মুখার্জী

বাংলা ভাষা বিষয়ক : বীরেন মুখার্জী



কবিতা ও গানে বাঙালির ভাষা আন্দোলন

একটি জাতির স্বকীয়তা প্রমাণ করে তার ভাষা। ভাষিক সংস্কৃতির সমৃদ্ধিই ভাষাগোষ্ঠীর একমাত্র পরিচয়বাহী। রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা ক্ষমতালোভীদের কূটচক্রান্তে এই ভাষা কিংবা ভাষিক জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ ও আন্দোলনই হয়ে থাকে সচেতন ভাষাগোষ্ঠীর স্বাধীন সত্তাকে জাগ্রত রাখার একমাত্র পথ। ভারত উপমহাদেশ জুড়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং তৎপরবর্তী সময় ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হলে তৎকালিন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব-পাকিস্তানের সাথে জুড়ে যায়। একমাত্র ধর্মের মিল ছাড়া একদেশভুক্ত দু’দেশের তেমন কোন মিল ছিলো না। না ভাষিক, না সাংস্কৃতিক। এমনই সন্ধিক্ষণে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের ওপর বিভিন্ন গণবিরোধী নীতি চাপিয়ে দেয় ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তান। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো রাষ্ট্রভাষা ঊর্দু করার নীলনকশা। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এক ভাষণে আবারো রাষ্ট্রভাষা ঊর্দু করার ঘোষণা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথমে ওই নীতির বিপক্ষে অবস্থান নেন। বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক, সচেতন জনগণ ওই নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে ছাত্রদের হাতকে শক্তিশালী করতে তাদের সমর্থন দেন। রুখে দেয়ার ঘোষণা দেন বাংলা ভাষা নস্যাতের সকল ষড়যন্ত্র। ফলে অমানুষিক নিপীড়নের খড়গহস্ত নেমে আসে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ওপর। শুরু হয় বাঙালি দমন ও নিধন প্রক্রিয়া। ভাষা রক্ষার দাবিতে সক্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়া ভাষিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে আসে ঢাকার রাজপথে। তারা প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। পুলিশ গুলি চালায় মিছিলে। নিহত হন তিনজন। পরদিন আবারো মিছিল। ২১ ফেব্র“য়ারির ওই মিছিলে গিয়ে পাকবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান রফিক, শফিক. বরকত, জব্বার, সালামসহ অনেক ছাত্র। ২৬ ফেব্র“য়ারি রাতে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ। শাসকরা সঙ্গে সঙ্গেই ওই স্তম্ভ গুড়িয়ে দেয়। ক্রমে ক্রমে এ আগুন সম্প্রসারিত হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান দেশের প্রগতিশীল কবি সাহিত্যিকগণ। লিখিত হতে থাকে একের পর এক প্রতিবাদী, স্মৃতিবাহী কবিতা। রচিত হতে থাকে অসংখ্য গান।

তবে ভাষা আন্দোলন শুরুর আগেও অবরুদ্ধ ভাষা নিয়ে কবি আবদুল হাকিম রচিত ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’ মাতৃভাষা আগ্রাসনের ওপর লিখিত একটি সার্থক কবিতা। আন্দোলন চলাকালে ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বসে ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে কলম ধরলেন মাহবুবুল আলম চৌধুরী। তিনি লিখলেনÑ ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি।’ মাহবুবুল আলম চৌধুরী লিখিত এই দীর্ঘ কবিতাটি একুশে ফেব্র“য়ারিতে ভাষার জন্য আত্মত্যাগকারী শহীদদের স্মরণে প্রথম এবং ভাষিক আগ্রাসনের ওপর লিখিত দ্বিতীয় কবিতা হিসেবে ধরা হয়।

‘যে শিশু আর কোনোদিন তার পিতার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না

যে গৃহবধূ আর কোনোদিন তার স্বামীর প্রতীক্ষায় আঁচলে প্রদীপ ঢেকে দুয়ারে আর দাঁড়িয়ে থাকবে না

যে জননী খোকা এেেসছে বলে উদ্দাম আনন্দে সন্তানকে আর জড়িয়ে ধরতে পারবে না

যে তরুণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে বার বার একটি প্রিয়তমার ছবি চোখে আনতে চেষ্টা করেছিল

তাদের সবার নামে আমি শাস্তি দাবী করতে এসেছি।’

(কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি/ মাহবুবুল আলম চৌধুরী)

এরপর আন্দোলনকালীন সময়ে আলাউদ্দিন আল আজাদ রচিত ‘ইটের মিনার ভেঙেছে, ভাঙুক/ একটি মিনার গড়েছি আমরা টারকোটি কারিগর/ বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায়।’ কবিতাটিকে দ্বিতীয় এবং ২৬ ফেব্র“য়ারি শহীদ মিনার ভাঙার দিনে লুতফুর রহমান জুলফিকার রচিত ৬৩ পঙ্ক্তির দীর্ঘ কবিতাকে তৃতীয় কবিতা হিসেবে ধরা হয়।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন আর্য সভ্যতায় বসবাস করেও আর্য ভাষার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ। তিনি অহিংসনীতি অনুসরণ করে স্থানীয় মুখের ভাষা ‘পালি’তে ‘ত্রিপিটক’ রচনা করে বিদ্রোহের জবাব দেন। ভাষিক বিদ্রোহের এ ধারা আমাদের বাংলা ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে বলেও অনেক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। তবে সত্য এই যে, সংস্কৃতিগত মিল না থাকায় হাজার মাইলেরও বেশি ব্যবধানের একই রাষ্ট্রভুক্ত দু’বঙ্গের মানুষের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিলো। কারণ দু’বঙ্গে ছিলো দু’টি পৃথক জাতির বাস, পৃথক ভাষা। পূর্ববঙ্গে বসবাসকারীরা স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। আর এ ভাষা ছিলো বাংলা ভাষা। সংখ্যাগরিষ্ঠের এই বাংলা ভাষা, যার রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। প্রায় দু’শ বছর শাসনের পর ইংরেজরা যখন এ উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হন তখন অলীক এই রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা পূর্ববঙ্গের ওপর যে ভাষিক নিপীড়ন শুরু করেছিলেন তা থেকে মুক্তি পাওয়া ছিলো বাংলা ভাষাভাষীদের বেঁচে থাকার প্রশ্ন। পরবর্তীতে বাংলাভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যে মৌল ভিত্তির ওপর আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে আছে তা আমাদের প্রাণের ভাষা, বাংলা ভাষা। দেশব্যাপী ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে কাব্যযোদ্ধারাও লিখতে থাকেন তাদের অমর পঙ্ক্তিমালাÑ

‘ফাগুন এলেই পাখি ডাকে

থেকে থেকেই ডাকে

তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো।

আমি যে তার নাম রেখেছি আশা

নাম দিয়েছি ভাষা, কতো নামেই ‘তাকে’ ডাকি

মেটে না পিপাসা।

(আসাদ চৌধুরী)

বস্তুত ইংরেজ শাসনামল থেকেই বাঙালি জাতি পরাধীনতার জিঞ্জিরে বন্দি হয়ে পড়ে। বাঙালির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা পরনির্ভরশীলতার ফাঁদে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় গোটা উপমহাদেশ জুড়ে ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলন তীব্রতর হয়। এদেশ থেকে ইংরেজ বিতাড়নের পর বলতে গেলে মানচিত্রে পেন্সিলের রেখা টেনে ভারত ভাগ হয়। তখন সে অলীক রাষ্ট্রে পূর্ববঙ্গ নামের বাংলাদেশকে একটি পরমুখাপেক্ষী অঞ্চলে পরিণত করা হয়। সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয় গণতন্ত্রের মূলভিত্তিকে। উপরন্তু বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতি। ফলে ঐতিহাসিক ২১ ফেব্র“য়ারি বাঙালির মানসলোকে সবল, স্বতঃস্ফূর্ততা ও সত্য নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। আর এই ভাষিক আন্দোলনে গণমানুষকে উজ্জীবিত করাÑ সাহসী করার শুদ্ধ উচ্চারণ এভাবেই উঠে আসে কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতেÑ

‘ওরা আমার মুখের কথা

কাইরা নিতে চায়।

ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায়

আমার হাতে পায় ॥’

(আবদুল লতিফ)

দেশব্যাপী ছাত্র-শিক্ষক-জনতাকে ভাষিক আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে লিখিত হতে থাকে গান। গান একটি শ্র“তি মাধ্যম। গান দিয়ে অতি সহজে মানুষের মননের কোষে ঝংকার তোলা যায়Ñ চেতনা জাগানো সম্ভব হয়। যে কারণে বাঙালির ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন নিয়েও রচিত হয়েছে অনেক গান। গানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বাঙালি জাতির মুক্তির বারতা। যশোরের কবি শামসুদ্দিন আহমদ রচিত ‘ভুলব না ভুলব না, ভুলব না আর একুশে ফেব্র“য়ারি ভুলব না’ গানটি ভাষার জন্য আত্মদানকারী শহীদদের ওপর প্রথম রচিত গান। তবে আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত গানটিই বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

ছেলেহারা শত মায়ের অশ্র“-গড়া এ ফেব্র“য়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি

আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্র“য়ারি

আমি কি ভুলিতে পারি ॥’

(আবদুল গাফফার চৌধুরী)

মাতৃভাষা আর রাষ্ট্রভাষার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। অঞ্চলভেদে মাতৃভাষার পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রভাষার পরিবর্তন হয় না। আর্ন্তজাতিক ভাষা হিসাবে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব থাকলেও আমাদের দেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে কতটুকু গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয়েছে সেটুকুুই আজ আমাদের বাঙালি জাতির সামনে এসে হাজির হয়েছে।

পরিশেষে এটুকু বলা বাহুল্য হবে না যে, বাঙালি জাতি হিসাবে আমাদের পরিচয়ের সার-সত্য অনিবার্যভাবেই একুশে নিহিত। মায়ের মুখের ভাষা রক্ষার্থে অকাতরে জীবন বিসর্জন দেয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল, যার একমাত্র দাবিদার বাঙালি জাতি। যে কারণে বাংলা ভাষা আজ সর্বজনীন ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৯ সাল থেকে ইউনেস্কোর কল্যাণে বিশ্বব্যাপী ২১ ফেব্র“য়ারি পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে। বাংলাদেশ আমাদের জন্মের অহঙ্কার। বাংলাভাষা আমাদের বেঁচে থাকার অলঙ্কার। জাতির ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় রচিত কবিতা ও গানে আত্মমুক্তির যে ঋদ্ধ উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছিলো, বুদ্ধিবৃত্তিক যে ধারা সম্প্রসারিত হয়েছিলো কাব্যচেতনার তা এখনো বহমান। বাঙালির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের নাম যেমন স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে তেমনি আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষাও জাগরুক থাকবে চিরকাল।



বীরেন মুখার্জী

কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও সাংবাদিক
সম্পাদক : দৃষ্টি (শিল্প-সাহিত্যের ছোটকাগজ)
সহ-সম্পাদক,সম্পাদকীয় বিভাগ
দৈনিক যায়যায়দিন, তেজগাঁও, ঢাকা।

ছোটগল্প - মুজিব ইরম

ইমাম
মুজিব ইরম



মশাহিদ আলীর সময় নাই কোলাকুলি করার। হোক না তিন বছর পর চাচাত ভাইয়ের এই বাড়ি ফেরা। এ-কাজ পরে করলেও হবে, কিন্তু বিচার তো আর পরে বসবে না। টাইম মতো মসজিদে না গেলে এতো দিনের অপেক্ষাই মাটি। এ তো আর গ্রামের লেতিপেতি বিচার নয় যে, গেলে গেলাম, না-গেলে না-গেলাম। এ যে গ্রাম থেকে ইউনিয়ন টপকিয়ে একেবারে জেলায় গিয়ে পৌছেছে! ইউনিয়ন-পৌরসভার চেয়ারম্যান তো অবশ্যই, জেলা শহরের বড় দু’দলের জানু লিডারদেরকেও আনা হয়েছে। এরকম বিচার কি আর তার মতো লোকের জন্য অপেক্ষা করবে, যেখানে মেম্বার, পাড়ার মোড়ল, পাঁতি নেতারাই আর পাত্তা পাচ্ছে না? তাছাড়া কাল ঈদ, এশার নামাজের আগেই বিচার শেষ হবেÑমাইকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কলমদর মিয়ার মাথায় বিষয়টি ঠিক খোলাসা হয় না। খোলাসা হবার কথাও নয়। ফিরেছে সে তিন বছর পর।

- সময় নাই ভাইসাব, কাহিনি মজার আছে। পাভেলে কইবোনে, আমি যাইগি...

মশাহিদ আলী তড়িগড়ি রওয়ানা দেয়। কাহিনি বলার ভার পড়ে ভাতিজা পাভেলের ওপর। বেচারা যেতে পারছে না, বা যেতে তার বারণ আছে। ক’দিন পরেই এসএসসি পরীক্ষা, তাছাড়া এতোদিন পর চাচার এই বাড়ি-আসা উপেক্ষা করে সে আর যায়ই বা কেমন করে? অবশ্য দায়িত্ব পেয়ে ক্ষতি তার পুষিয়ে যায়। সে আর দেরি করতে চায় না, কাহিনি তার ঠোঁটের ওপর বসে ছিলো, নাড়া পেয়েই উড়াল দেয়Ñউত্তর-মসজিদর মাইক চুরিত ইমাম সাব জড়িতো আছইন, আইজ তার ফাইন্যাল বিচার অইবো।

- ইমাম জড়িত আছইন, মাইক চুরিত! বিষয়টা কিতা পাভেল?

পাভেল এবার জুত হয়ে বসে। কাহিনির পেছনে যায়।

রোজার ঠিক আগে আগে উত্তরের মসজিদে নয়া মাইক দান করে লতিফ লন্ডনি। রোজার মাস শুরু হয় আনন্দে। মুসল্লিরা তাতে বড়োই খুশি। কিন্তু দিন দশেক যেতে না যেতে মাইক দু’টি চুরি হয়ে যায়। মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যান হুরমত উল্লার এককথাÑমাইক চুরিতে ইমাম সাহেবের হাত আছে। এই নিয়ে সারা রোজার মাস কাটে। ঘন ঘন বিচার বসে। পাশের জেলা থেকে ক’মাস আগে আসা কালা মিয়াছাব ১০০০ টাকার চাকরি হারানোর ভয়ে হাত-পা ধরেও রেহাই পায় না। বিচার তার হবেই হবে, মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যানের কথার দাম আছে নাÑতিন তিনটা ছেলে যার লন্ডনে থাকে? এক মিয়াছাব গেলে আরেক মিয়াছাব আসবে, ইমামের কি আর অভাব পড়েছে যে বেয়াদব ইমামকে রাখতে হবেÑযে খালি মুখে মুখে ফতোয়া দেয়, মসলা দেখায়?

হুরমত উল্লার হুমকি-ধামকিতে ইমামের জ্বর আসে।

জ্বর হলে কী হবে, তারাবি নামাজে ঠিকই তাকে হাজির হতে হয়। সিজদায় যেতে বড়ো সময় লাগে। এমনিতেই পেটের জন্য সিজদায় যেতে অনেক কষ্ট করতে হয়, কপালের আগে পেট মাটিতে চলে যায়। কষ্টেসৃষ্টে কালা মিয়াছাবের কপাল যেই মাটি ছুঁয়েছে, পেছন থেকে সুর ওঠেÑইমামসাব, পুলিশ আইছে!

পুলিশের ভয়ে সিজদা ফেলে উত্তরের ধানি বিলের দিকে দৌড় দেয় সে। লোকজন তাকে খুঁজে পেতে মধ্যরাত হয়ে যায়। ধানি জমির কোণায় মাছধরার গর্তে জলকাদায় লুকিয়ে থাকা কালা মিয়াছাবের কথা শুধু একটাইÑআমি মাইক চুরি করছি না, আমি মাইক চুরি করছি না...

ইমামের জ্বর দ্বিগুণ হয়।

কিন্তু পুলিশ আসবে কোথা থেকে, কেইস-টেইস হলে তো? আসলে সুর তুলে হুরমত উল্লার ভাতিজা একরাম। তার জন্য একরামের বিচার হওয়ার কথা, তা না, উল্টা বিপদ আসে কালা মিয়াছাবের। হুরমত উল্লার এককথাÑইমামের ঈমানে গলদ আছে। পুলিশের ভয়ে যে-ইমাম সিজদা ফেলে দৌড় দেয়, সেই কমজুরি ইমামের পিছনে নামাজ হয় না, হতে পারে না। তাছাড়া এতে প্রমাণ হয়, মাইক চুরিতে তার হাত আছে। এর জন্য কালা মিয়াছাবের শক্ত বিচার হতে হবেÑকী বলেন আপনারা?

হুরমত উল্লার ভাইভাতিজারা সমর্থন করে।

পাভেল কাহিনি আরো এগিয়ে নিতে চায় কিন্তু ইমামের ‘বড় পেট ঠেলে সিজদায় যাওয়া’ আর ‘পুলিশ আইছে’ শুনে ইমামের ‘দর্শনীয় দৌঁড়ের’ বর্ণনায় এতো হাসাহাসি করে যে, তাকে বেশ হয়রান দেখায়।

কলমদর মিয়া উঠে যায়। কাহিনি দাঁড়িয়ে থাকে।



মশাহিদ আলী বাড়ি ফিরে খবর দেয়Ñইমামের চাকরি খতম। ঈদের নামাজ পড়াবেন নোয়াখালির মিয়াছাব।

- ইবার দেখবায় নে চাচা দক্ষিনর মসজিদো কিতা হয়!

কলমদর মিয়া ঠিক বুঝতে পারে না, দক্ষিণের মসজিদে আবার কী হবে! পাভেলকে আর জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করে না। গ্রামটা কি এতো অল্পতেই পাল্টে গেলো? ছোট এক গ্রাম, মসজিদ আবার তিনটাÑউত্তরে, দক্ষিণে আর পুবে। পশ্চিমেও আছে একটা, তবে তা পাঞ্জেগানা নামাজের জন্য লন্ডনিবাড়ির গুষ্ঠীবদ্ধ। অতএব গ্রামে মসজিদ তিন, কমিটিও তিন।

পাভেল মসজিদ কমিটির গল্পে যোগ দিতে চায়, কিন্তু বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় প্রচ- গরম কলমদর মিয়াকে ঝাপটে ধরে। আজ আর বিদ্যুৎ আসবে নাÑ মশাহিদ আলীর কথায় কলমদর মিয়া অবাক হয়Ñকারেন্ট থাকে না কেন? লোকজন প্রতিবাদ করে না?

বিদ্যুৎ নিয়ে মশাহিদ আলীর কোনো অভিযোগ নেই। কী হবে অভিযোগ করে, যেখানে সারাদেশই জিম্মি হয়ে আছে? লন্ডন থেকে এসে দেশের অবস্থা বোঝা কি এতো সোজা? মানুষ কি প্রতিবাদ করে নাই? করছে। কিন্তু লাভটা হলো কী? কোনটা ছেড়ে কোনটা নিয়ে প্রতিবাদ করবে মানুষ, বাজারে বনডোলার সের যেখানে ৩০০ টাকা?

মশাহিদ আলীর কথায় রাগ ঝরে। বড় ভাই’র সৌদি থেকে পাঠানো টাকায় সংসার চালানোর কষ্ট তার কথায় আরো বাড়তে থাকে। একদা দক্ষিণের পুতায় ঘাস হয়ে থাকা বন ধনিয়ার সের ৩০০ টাকা শোনে কলমদর মিয়ারও ভাবনা হয় বটে। বিদুৎ নাই, বাজারে আগুন, হাওর-পাহাড় দখল করছে চেয়ারম্যান-মেম্বার-এমপিরা, হচ্ছে ফিশারি আর বাগান-বাড়ি, পাকা হচ্ছে রাস্তা, টেন্ডার পাচ্ছে এমপির ভাই-ভাতিজারা, চারপাশে উন্নয়নের জোয়ার চলছে, এর সাথে উড়ছে লন্ডনি টাকা, সাধারণ মানুষের কি এসবে মাথা ঘামানোর সময় আছে, যেখানে সারাদেশই ঘুমিয়ে আছে? এলাকার কথা বলে আর লাভ কী? একদা যে-জমিতে ২/৩ ফসল হতো, এখন হয় এক ফসল, তাও কেউ করে, কেউ তার তোয়াক্কাই করে না। কে আর দেশ নিয়া ভাবে? লন্ডনি টাকা যেখানে মেঘ ঝরায়, রোদ তোলে, শস্য ফলায়?

মশাহিদ আলীর গলায় ঝাঁঝ বাড়ে।

এলাকা না-হয় বাদ গেলো, কিন্তু দেশের মানুষের কি করার কিচ্ছু নাই! কলমদর মিয়া কথা তুলতে চায় কিন্তু পাভেল বড়-হাওরের ফিশারি প্রজেক্টের গল্প শুরু করলে বিষয়টি এখানেই চাপা পড়ে।

বড় হাওরের গল্পে কলমদর মিয়ার আগ্রহ থাকে। শৈশবের সেই হাওরটা যদি একবার দেখে আসা যেতো! কিন্তু এতো গভীর হাওরে যাওয়া যায় কীভাবে?

পাভেল অবাক হয়। বড় হাওরে যাওয়া কি আর কোনো কাজ হলো? কালই সে নিয়ে যাবে কিন্তু আগে মোবাইল ফোনের ওয়াদা করতে হবে, যেই সেই মোবাইল হলে হবে না, একেবারে ভিডিও-অডিও সব থাকতে হবে। চাচাকে নিয়ে সে বিপদেই পড়ে। লন্ডন থেকে আসা চাচার লগে শহরে যাবে, লাইটেস কিনে বাজার-মার্কেট করবে, তা না, যেতে হবে হাওরে। মোবাইলের কথা শুনে বলে কি না, এই বয়সে গ্রামে বসে এত দামি মোবাইল দিয়ে সে কী করবে? আজকাল শুটকি-ওয়ালাও মোবাইল রাখেÑপাভেল খবরটি দিতে পেরেও হতাশ হয়। এ গ্রামে হাতে হাতে যে মোবাইল ঘুরে, চাচায় তার খবরও রাখে না? আর দেখো হাওরের পর নদীনালা পাহাড়-পর্বতের খবর নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। আরে বাবা লন্ডন থেকে এসে এসব কেউ জানতে চায়? করবে লন্ডনের গপ, জানতে চাইবে টাউনের হাল-হকিকত, চারপাশে লন্ডনি টাকার গরম দেখাবে, তা নাÑকাল থেকে অজায়গা-কুজায়গা ঘুরতে হবে। এ আবার কী রকম লন্ডনি, যে খালি বই পড়ে, হাওর-বিল দেখে! কেনো যে চাচাটা লন্ডন থাকে। দেশে এতো পড়ালেখা করেই বা লাভটা হলো কী? অশিক্ষিতরা লন্ডন গিয়ে কোটিপতি হয়ে যায়, আর চাচার কি-না পরিবার নিয়া দেশে আসতেই ৩ বছর লাগে! তারচে দেশে থাকাই কি ভালো ছিলো না?

পাভেল বেজার মনে রাজি হয়।

- কিন্তু যাবো কী করে!

কলমদর মিয়ার অবাক হবার কারণ সে ধরতে পারে না। গাড়ি একটা ভাড়া করলেই তো একেবারে হাওরের পেটে নিয়ে যাবে। পাহাড়ের পেটে যাওয়া তো আরো সোজা।

- বলে কী সে! যে-হাওর বারমাস সমুদ্র হয়ে থাকে, তার পেটে যাবে মাইক্রোবাস! আর যে-গহীন পাহাড়ে দিনের আলো দেখা যায় না, সেখানে রাতেও যাওয়া যেতে পারে!

পাভেল আবার অবাক হয়। চাচার কথায় সে তাল মিলাতে পারে না। বড় হাওর কি আর হাওর আছে? সেখানে তো এখন ফিশারি আর ফিশারি। পাহাড় জুড়ে বাগানবাড়ি। ক্ষমতার হাতে পাহাড় আর হাওর। রাস্তাটাস্তা হয়ে একেবারে একাকার।

- এলাকা কিতা আর আগের মতো আছেনি, চাচা? গেলে দেখবায় নে। আর...

কলমদর মিয়া ‘আর’ বলা শুনেই বুঝতে পারে পাভেল এবার চমক দেবে অন্য গপে। মজই লন্ডনির ছেলে লন্ডন থেকে বাড়ি এসে খালের পাড়ে দুই কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি করছে। কাজ করছে ঢাকার সব মেস্তুরি-ইঞ্জিনিয়ার। যে-বাড়ি থেকে এই সেদিনও নৌকা ছাড়া বের হওয়া যেত না, সেখানে হচ্ছে দুই কোটি টাকার বাড়ি!

বিষ্ময় তাকে গিলে ফেলতে হয়।

- দক্ষিন পাড়ার মসজিদ-কমিটির নয়া চেয়ারম্যান হইছে মজই লন্ডনি। দক্ষিন-মসজিদো এবার কিতা অইবো, কইতামনি?

পাভেল আবার মসজিদে চলে আসে। কলমদর মিয়া আজ আর গল্প শুনতে চায় না। বরং কাল বা পরশু একবার হাওর দেখে আসার কথা পাকা করে উঠে যেতে চায়। কিন্তু দক্ষিণের মসজিদে কী ঘটবে আবার! ঘটুক যা ঘটার। পাভেলকে আর লাই দেওয়ার দরকার নাই। কোন গল্প থেকে কোন গল্পে যাবেÑরাতই তাতে জেগে থাকতে হবে। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে সে বিশ্রাম নিতে চায়। পাভেল দক্ষিণ-মসজিদের আগাম কাহিনি আর শুরু করতে পারে না।

পাভেলের কথা ফলে ঈদের নামাজের পরপর।

গ্রামের তিন মসজিদেই ঈদের নামাজ হয়। ঈদেচান্দেও হাতেগোনা ক’ঘরের গ্রাম এক হতে পারে না। তাদের চাই আলাদা ঈদগাহ। দক্ষিণ-মসজিদের সামনের ছোট জায়গা তাই ‘খলিলপুর বড় ঈদগাহ’। অন্যান্য মসজিদের সামনেও ঈদগাহ আছে। ঈদের নামাজে শরিক হতে পাভেলের সাথে দক্ষিণের মসজিদে সে ঠিক সময় মতো পৌঁছায়। ভোর থেকেই মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে নামাজ হবে সাড়ে আটটায়। তারা পৌঁছায় পনেরো মিনিট আগে। লোকজন তেমন নাই। কুমিল্লার মিয়াছাবের ওয়াজ শুনছে সবাই। পাভেল কানে কানে জানায়Ñবানিয়াচঙ্গের মিয়াছাবকে বিদায় করার পর কুমিল্লার মিয়াছাবের চাকরি হয়েছে ক’মাস হয়। তারও কাহিনি আছে। কলমদর মিয়া তাকে থামিয়ে দেয়, কাহিনি পরে শোনা যাবে। সবাই ওয়াজ শুনছে। পেছনের সারিতে জায়নামাজ বিছিয়ে চুপচাপ বসে থাকে তারা।

কুমিল্লার মিয়াছাব ওয়াজে সমাপ্তি টেনে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়েন ঠিক কাটায় কাটায়। চারপাশে নীরবতা নামে। নামাজ শেষ হয়। সালাম ফেরাতেই সামনের কাতার থেকে উঠে দাঁড়ায় মজই লন্ডনির হুরু ভাতিজা মঈনুÑমিয়াছাব জি, সহি নামাজের শর্ত কিতা কউকা চাই?

মঈনুর তর্জনী তোলা ধমকের সুর ইমামকে বিচলিত করে। পাভেল আড় চোখে কলমদর মিয়ার দিকে তাকায়।

- সহি নামাজের প্রধান শর্ত হইলো : জামা পাক, জাগা পাক, শরীর পাক...

- রাখইন আপনার জাগা পাক, জমিন পাক, ইতা আমরা জানি। আর কিতা কউকা?

- লাইন সোজা করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো। একবার হইলো কী, আরবের মাটিতে আমাদের প্রিয় নবী নামাজ পড়তে দাঁড়াইছেন, একটা বখরি এসে...

- রাখইন আফনার বখরি, আসল কথাই তো কইরা না!

ইমামের আর ইয়াদ হয় না, আসল কথা কোনটা। লোকজনও কিছু বলে না। বলবেই বা কে, সবই তো মজই লন্ডনির ভাই-ভাতিজা। তারাই তো ইমাম রাখে, ছাড়ে, মসজিদ চালায়। মঈনু এবার তর্জনী তুলে ইমামকে শাসায়Ñনামাজের টাইম হওয়ার সাথে সাথে সবাইকে না-জানিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ায় সে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারেনি, নিয়তও বাঁধতে পারেনি।

- এমলান নমাজ সহি হয়নি, কউকা চাই, মিয়াছাবজি? উপস্থিত মুরব্বিয়ানরা, আপনারাই কউকা নমাজ সহি হইছে কিনা?প

কেউ কিছু বলে না, শুধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। মঈনুর তর্জনী আরো দৃঢ় হয়Ñআপনার বিচার পরে অইবো, মাফ চাউকা, কুতবা আর দোয়া পড়উকা...

কুতবা শেষে ইমামের দীর্ঘ মোনাজাত চারপাশে হাহাজারি নামায়Ñহে আল্লাহ, হে পরওয়ার দিগার, হে রাব্বুল আলামিন, দুজাহানের মালিক, এই দ্বীনহীন, গরিব, মুর্খ ইমামকে তুমি মাফ করিয়া দাও, আমার ভুল হইলে, না-জানিয়া কছুর করলে আমারে তুমি মাফ করিয়া দাও, হে দুনিয়ার বাদশা, হে নাজাত দাতা...

ইমামের চোখ বেয়ে জল নামে। তার চোখ মাটিতে মিশে যেতে চায়।
- কইছিলাম নি চাচা, দক্ষিণ মসজিদেও কাহিনি ঘটবো?

পাভেলের কথায় কলমদর মিয়া কোনো উত্তর করে না। ইমামের কান্না তার কানে বাজতে থাকে।
- এ-ইমামরও কিতা বিচার হইবোনি?

- হইবিনি মানে? একবারে চাকরি খতম। এর আগেও এমলান অইছে। এলাকায় কয়দিন থাকো, দেখবায় নে।

- কেউ কিছু বলে না?

- কে কইবো? ঘরে ঘরে লন্ডনি টাকা, এখন কে কার কথা হুনে? বিচার পাঞ্চাত আর গ্রামে নাই, কিন্তু আবার আছেও। যারা এলাকায় থাকে, তারা করবো কিতা? গাউর মানুষর তো আর বিচার হয় না, এখন সকল বিচার হয় রিক্সার ড্রাইভার, কামলা আর মসজিদর ইমামর। এরা সকলেই বাইরের লোক। ধনে-জনে দুর্বল। এদের বিচার হলে মানুষের কিতা? তারা আছে নিজেরে লইয়া, লন্ডন লইয়া। লন্ডন বরফ পড়লে ইকানো ছাতা টাঙ্গায়। এর মাঝে এসব বিচার-আচার বিনোদন দেয়। করার কিচ্ছু নাই, ইমাম খেদাও। দেখবায় নে ইবার পুবের মসজিদো কিতা ঘটে!

- কিতা ঘটবো?

- উত্তর-মসজিদর ইমাম গেলে দক্ষিণর মসজিদ-কমিটি মনে করে তাদের ক্ষমতা কিতা কমনি? আর দক্ষিণ-মসজিদর ইমাম গেলে পুবের মসজিদ-কমিটিও তাদের ক্ষমতা দেখায়। খোদার ঘর লইয়া ভাগাভাগি, দলাদলি। লন্ডনি টাকায় এলাকা পাল্টাই লাইছে, চাচা। অন্য জেলা হইলে বুঝলো নে ঠেলা। ইমামর উপরে ইমামদারি!

ঘটনার জন্য তাকে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

রাতের খাবারে বসে পুবপাড়ার মওলা মিয়া তিন কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি বানানোর গল্প শুরু করলে ঈদের দাওয়াতে ভিন্নতা আনে। মজই লন্ডনির দুই কোটি টাকার বাড়িকে টেক্কা দিতে হবে। ভাই-ভাতিজা সকলেই লন্ডনে থাকে, টাকার কি আর কমতি আছে? চাচাত ভাইয়ের এসব কথায় কলমদর মিয়া মন বসাতে পারে না। তাছাড়া আসার পর থেকেই এই কাহিনি সে শুনে আসছে। ঢাকা থেকে ইঞ্জিনিয়ার এনে খালের পাড়ে দুই কোটি টাকার বাড়ি হচ্ছেÑএলাকায় এটাই একমাত্র আলোচ্য বিষয়। ফোর স্ট্রোকের ড্রাইভার থেকে, মাছ বিক্রেতা সকলেই খবরটি কলমদর মিয়াকে দিতে ভুল করে না। মওলা মিয়ার কাছেও তা একমাত্র খবর হয়ে আসে। মজই লন্ডনিকে টেক্কা দেবার বাসনা তার চোখেমুখে আলো ছড়ায়। হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। পুব-মসজিদের সেক্রেটারির ফোন। মওলা মিয়াকে এখনই উঠতে হবে। মসজিদ-কমিটির সভাপতি সে। তার একটা দায়িত্ব আছে না? বিচার তো তাকেই করতে হবে!

কলমদর মিয়া অবশ্য কিছুই বুঝতে পারে না। পাভেল শুধু মুচকি হাসে। মওলা মিয়া তড়িঘড়ি করে হাত ধুয়ে রওয়ানা দিতে চায়।

- কারেন্ট থাকে না, ইতা কিতা ইমাম বেটার জানা নাই নি? ভাটি দেশর ইমাম, হারাজীবন কুপি বাতি জ্বালাইছে, আর আইজ আল্লার ঘর আন্ধাইর রাখে, সাহস দেখছোনি! এখন আল্লার আন্ধাইর ঘরে মাইনষে এশার নামাজ পড়বো কেমলান! বেয়াদব ইমাম, খোদার ঘরর লগে বেয়াদবি, ইমামর কিতা অভাব আছেনি?

মওলা মিয়ার সদ্য-কেনা মোটর সাইকেলে জোরে কিক দিলে নির্গত ধোঁয়ায় কেচমা কচুগাছগুলো বড়ো কেঁপে কেঁপে ওঠে।

ছোটগল্প - পিয়াস মজিদ

নিঝুম মল্লার
পিয়াস মজিদ



এবার বর্ষাটা কেমন যেন! হুটহাট বৃষ্টি এসে চলেও যায় হুটহাট। কোন কুহক নেই, দীর্ঘ মেঘ করে আসা নেই; ফলে কালো মেঘের বিদ্যুতের তালে তালে মন কেমন করা অনুভবও নেই। অথচ আশৈশব আমি ভালোবেসেছি বৃষ্টির চেয়ে বৃষ্টিপূর্ব প্রাকৃতিক প্রস্তুতিকে। বৃষ্টি এলেই তো সব রহস্য চুরমার হয়ে গেল আর রহস্য চুকে গেলে কী মূল্য উজ্জয়িনীর, কালিদাসের, মেঘদূতের? প্রেম যেমন জীবনে আমার। প্রেম এসে যাচ্ছে এই অনুভবটাই আনন্দের কিন্তু এসে গেলেই তো শেষ হয়ে গেল। তাই এ জীবনে প্রেমের কুঁড়িগুলো পরিচর্যা করে ফুলে রূপান্তর করা হলো না। কিন্তু তাতে কি ? প্রেমঘন অনুভব নিয়ে মন্দ তো নেই আমি। রফিক আজাদ বলে রেখেছেন বর্ষণে-আনন্দে মানুষের কাছে যেতে। আচ্ছা, জনতায় কি বর্ষাময়ূরী পেখম মেলে?

হ্যাঁ, আজকাল অবশ্য মিলতেও পারে। যেই হারে আইসিডিডিআরবিতে পানিবাহিত রোগীর ভিড় হয় তা দেখে তৃষা সেদিন ভুল বলেনি যে বর্ষা এখন একটা জলজনিত শহুরে সমস্যায় পর্যবসিত। তবে আমি লোকটা মোটের উপর যেহেতু নিজস্ব নির্জনতাকে অলংকারে মুড়ে রাখতে অভ্যস্ত সেহেতু নিজের প্রাণমহলের বারান্দায় বসে বর্ষাযাপন করতে চাই। কিন্তু একটা গল্প লেখার জন্য বর্ষা আমাকে আলাদা করে সময় দেয় না। কারণ অনেক সামাজিক সম্পৃক্ততায় সময়ক্ষেপ হয় বর্ষার। ঊষর ফসলি জমিকে আর্দ্র করে তোলা আমার মত মধ্যাহ্নের অলস গায়ককে দু’ফোঁটা ভিজিয়ে দিয়ে যাওয়ার চেয়ে ঢের দরকারি তার কাছে। ঠিক এই জায়গাটিতে আপত্তি আমার। বর্ষা কি প্রয়োজনের তন্তুতে বাঁধা থাকবে চিরকাল নাকি মন থেকে ধানক্ষেতে একই ধারায় বেজে যাবে! এই প্রশ্নের উত্তর যে দেবে সে অবশ্যই আমি নই। কারণ আমার সব রুখাসুখা প্রশ্ন-উত্তর তো ভেসে গেছে অঝোর শ্রাবণে। কেঁদেও পাবে না তারে বর্ষার অজস্র জলধারে। বৃষ্টির সন্ত্রাস আমাকে দিয়ে গেছে সোনালি নিঃস্বতা। এখন জীবনের খরা-উপদ্রুত উপকূলে বসে ভাবছি এই জুলাইয়ে হ্যামলেট কী বলেছিল ওফেলিয়াকে। হা হা, আজ রাতে কাব্য এল মোর মনে; জুলাই মাস / তেরছা বৃষ্টি / মেঘের হামলায় ত্যক্ত আকাশ / কোথায় পাব আমার স্নানের সাবান?

হুম; তৃষা বলেছিল সেই বৃষ্টিব্যস্ত দুপুরের পর- বর্ষা এলে সাবানগুলো কেমন পানিতে থিক থিক করে, ঘেন্না হয় আমার। তৃষার ঘেন্না কার প্রতি ছিল আসলে ? সাবানটা তো অজুহাত মাত্র। বর্ষায় ইতিউতি জমে ওঠা শ্যাওলাপ্রতিম পাপের প্রতিই যে ইঙ্গিতটা তা বুঝতে বেগ পেতে হয়না আমাকে কারণ এই পাপে যোগ আছে আমার। আসলে পাপের পদ্মপুরাণ খুলে বসা ব্যতীত আমার কোন বর্ষাকতব্য ছিল না কি এবার ! তবে বলি শাওন রাতের সেইসব অভিসার একলা ছিল না। ছিল না মানে কি একলা আবার অভিসার জমে নাকি কি। একজন গাবে খুলিয়া গলা আরেকজন মনে মনে তবেই না রিমঝিম রজনী বিকশিত হবে পূর্ণ শ্রাবণকলায়। দেখে যাও বিভাবরী তার; দু’টা উঁচা উঁচা পাহাড়।

২.

বর্ষা চলে গেল। তৃষার ফেসবুক- টুইটার সব বন্ধ। সংযোগবিরহিত আমি বসে বসে ভাবি তৃষা কি তবে ছিল বর্ষাবাহিত ফুলমাত্র? না না, ফুলের তো মৃত্যু হলেও শুকনো পাপড়ি থাকে স্মৃতি হয়ে। তৃষা তবে কাদাপানির ভিড়ে বেঁচে যাওয়া একটা নিঝুম মল্লার। বর্ষা চলে গেলেও বাকি বছরটার নির্জন রাত্রিদিন যে ভরে তোলে অপার নিঃসতার বিধুর ধ্বনিতে।

শীত-গ্রীষ্ম-বসন্ত ভুলে বৃষ্টির নামতা গুনি;

রিম ঝিম রিম।

তুমি শুনছো তো ?

সাক্ষাৎকার - মুজিব ইরম


আমি তো কবিবংশের লোক, হাজার-কোটি বছর আগেও আমি ছিলাম, এখনও আছি, হাজার-কোটি বছর পরেও থাকবো।
                                      মুজিব ইরমএর সাথে কথোপকথন


বইমেলা চলছে। সবচে' বেশি সংখ্যক বই এই সময়ই প্রকাশ পায়। লেখকরাও অপেক্ষায় থাকে এই মুহুর্তটির জন্য। সবাই চায় তাঁর বইটি রিলিজ হয়েই যেন পাঠকের হাতে হাতে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রকট থাকে। নতুন বই প্রকাশ হয়েছে এমন কয়েকজন লেখকের সাথে আমরা কথা বলতে চেয়েছি। কথা বলেছি কবি মুজিব ইরমএর সাথে। প্রশ্ন করেছেন  পাভেল আল ইমরান।






মুজিব ইরম: কবিবংশ ১টি সহজিয়া কবিতার বই

[মুজিব ইরম-এর জন্ম মৌলভীবাজার জেলার নালিহুরী গ্রামে, পারিবারিক সূত্র মতে ১৯৬৯, সনদ  পত্রে ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাসাহিত্যে স্নাতক সম্মান সহ এমএ। নব্বই দশকের আলোচিত এবং সনাক্তযোগ্য কবি। মূলত লিটলম্যাগের প্রথা বিরোধী লেখক। পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার ১০টি কাব্যগ্রন্থ : মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান ১৯৯৬, ইরমকথা ১৯৯৯, ইরমকথার পরের কথা ২০০১, ইতা আমি লিখে রাখি ২০০৫, উত্তরবিরহচরিত ২০০৬, সাং নালিহুরী ২০০৭, শ্রী ২০০৮, আদিপুস্তক ২০১০, লালবই ২০১১, নির্ণয় জানি ২০১২ এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে শিশুসাহিত্য : এক যে ছিলো শীত অন্যান্য গপ ১৯৯৯ উপন্যাস/আউটবই: বারকি ২০০৩, মায়াপির ২০০৪, বাগিচাবাজার ২০০৫ সম্প্রতি ধ্রুবপদ থেকে বেরিয়েছে মুজিব ইরম প্রণীত কবিতাসংগ্রহ: ইরমসংহিতা ২০১৩, এবং বাংলা একাডেমী থেকে নির্বাচিত কবিতার বই: ভাইবে মুজিব ইরম বলে ২০১৩

পুরস্কার: মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান-এর জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমী তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৬ বাংলা কবিতায় সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছেন সংহতি সাহিত্য পদক ২০০৯]

পাভেল: আপনার নতুন কবিতার বই বেরুচ্ছে শুনলাম। খুব খুশির খবর। অভিনন্দন!

মুজিব ইরম:আপনাকেও অভিনন্দন এই অধমকে উসকে দেওয়ার জন্য। প্রতিবারই যখন বই বের হওয়ার প্রস্তুতি চলে, মনে হয় এই বুঝি ১ম বই বের হচ্ছে, বড়ই বই-আনন্দে থাকি। কিন্তু বই প্রকাশের এই শিহরণ মিইয়ে যায় বই প্রকাশের পরপরই। বড়ই নিরানন্দ হই, মনে হয় কিচ্ছু হলো না! ১ম বইটা আবার লিখতে হবে। তবে এখনও আনন্দেই আছি, বই-আনন্দে, কীর্তনানন্দে, যেহেতু ১১তম ১ম বই প্রকাশের প্রক্রিয়া চলছে। এই বইমেলায় ধ্রুবপদ প্রকাশনী, রুমী মার্কেট, ৬৮-৬৯ প্যারীদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে আমার নতুন কবিতার বই কবিবংশ। প্রচ্ছদ করেছেন চারু পিন্টু৷

পাভেল: গ্রন্থের নাম 'কবিবংশ'! এরকম নামকরণ কেন করলেন? এর পেছনের কথা কি কিছু বলবেন?

মুজিব ইরম: কবিতা নামক এক কুহকের ভিতর দৌড়াতে দৌড়াতে সেই যে হঠাৎ ২০০৭ সালের কোনো এক মধ্যরাতে মনে হয়েছিলো, পৃথিবীতে আর কোনো ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নেই, আর কোনো পরিচয় নেই, আমি তো কবিবংশের লোক, হাজার-কোটি বছর আগেও আমি ছিলাম, এখনও আছি, হাজার-কোটি বছর পরেও থাকবো। সেই থেকে রক্ত সম্পর্ক, ধর্ম সম্পর্ক, ভৌগোলিক সম্পর্ক ত্যাগ করে হয়ে উঠি এক অলৌকিক বংশের লোক, কবিবংশের লোক।

সেই মধ্যরাতে এক ঘোরের ভিতর লিখতে শুরু করি কবিবংশটানা ১০/১২ পৃষ্ঠা লেখার পর কয়েক দিনের পর হঠাৎই ঘোর কেটে যায়, মনে হয় শেষ, আর কিছু বলার নেই দীর্ঘ কবিতাটির কয়েকটি রূপ লিটলম্যাগে ছাপা হয়। পরে এর চূড়ান্ত রূপ আদিপুস্তক গ্রন্থে গ্রন্থিতও হয়। তারপরও পয়ারের চোরা স্রোতে হারিয়ে যাওয়া সেই রাতগুলো আমাকে বড়ো আউলা করে করে রাখেকিছুতেই রেহাই দেয় না। আর রেহাই দেয় না বলেই ৭/৮ বছর ধরে লিখতে থাকি এই অলৌকিক ঘোর, কবিবংশের ঘোর।   

পাভেল: কতোটি কবিতা আছে আপনার এই বইয়ে?

মুজিব ইরম: ৪ ফর্মার এই গ্রন্থে ২টি দীর্ঘ কবিতা সহ মোট ৪৯টি কবিতা আছে ছোট ১টি ভূমিকাও এতে যুক্ত হয়েছে। এই ভূমিকা-রচনা আসলে ৪/৫ বছর আগে ছোট কাগজ শুদ্ধস্বর-এর আমন্ত্রণে লিখেছিলাম। এ-পর্বের কিছু কবিতা সহ কাব্যভাবনা রূপে রচনাটি শুদ্ধস্বরে বেরিয়েছিলো। পরে পান্ডুলিপি করতে গিয়ে ভূমিকা রূপে সে হাজির হয়। কবিবংশ উৎসর্গ করেছি আমার প্রিয় ৩ মহাজন কবি, কবিবংশের উজ্জ্বল বাতি-রাধারমণ, হাসন রাজা ও শাহ আব্দুল করিম-কে।

পাভেল: কোন ঘরানার কবিতা নিয়ে সাজিয়েছেন কবিবংশ? কবিবংশ নিয়ে আপনার মতামত কী?

মুজিব ইরম: আমার নিজের কোনো মতামত নেই। কবিতাগুলো মনানন্দে লিখেছি। শুধু বলি, কবিবংশ ১টি সহজিয়া কবিতার বই পাঠকেরাও মনানন্দেই পড়বেন বলে আশা রাখি। কবিবংশের জয় হোক, আপনাদেরও জয় হোক।


মুজিব ইরম বিরচিত
কবিবংশ থেকে
২টি কবিতা

কবিবংশ

আদিপুস্তকোত্তর ১লা কুলজি

লিখিয়াছি কবিবংশ আদি সে-কিতাব, তবুও তো ধরে রাখি অতৃপ্তি অভাব। বংশ বংশ করি বেশ কেটে গেলো কাল, রক্তে জাগে সেই ভাষা যাবনী মিশাল। শ্রীকর নন্দীর বাণী দেশী ভাষা কহে, কবি শেখর এ-বংশে লৌকিক বিছারে। বঙ্গবাণী নাম ধরি আব্দুল হাকিম, ভাষাবংশে আদিগুরু আমি সে তো হীন। কী প্রকারে তার নামে প্রণামিব হায়, আতারে-পাতারে খুঁজি মনে ন জুয়ায়। সেই তো হয়েছে শুরু আমাদের দিন, ভুসুকুপা তস্য গুরু বাঙ্গালী প্রাচীন। আরো এক বংশবাতি সগীরের নামে, বৃন্দাবন দাস নমি চৈতন্য প্রচারে। বড়ুচন্ডী দাস ভনে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মুকুন্দ রামের নামে পরাই চন্দন। রামাই পন্ডিত রচে পাঁচালি সঙ্গীত, প্রভুর চরণে মজে নিজ মত্ত চিত। সেই যে বাঁধিল গীত কানা হরিদত্ত, -মূর্খ রচিবে কী যে ভবেতে প্রমত্ত। বিজয় গুপ্তের নামে বংশবাতি পায়, ইরম মাগিছে দয়া বংশগরিমায়।

পরিশিষ্ট প্রণাম: প্রণামে-সুনামে গড়ি শব্দ-বাক্য-মিথ, পয়ারে-খেয়ালে শুধু গাই বংশগীত। অন্ধকার যুগে বাঁধি গয়েবি কামোদ, পটমঞ্জরীতে সঁপি সেই সুদবোধ। আমি যে বাঁধিবো তাল কুলিন রাগিনী, ভূর্জপত্রে নতজানু দয়া কী মাগিনী! তুমি কন্যা বেঁধো সুর মর্জি যদি হয়, এই বংশে জেগে থাকে চর্যাবিনিশ্চয়।


কবিবংশ

২য় ও সর্বশেষ কুলজি

সেই কবে ভাববশে ভুলিয়াছি ধাম, বিপ্রদাশ পিপিলাই ধরিয়াছি নাম। জয়দেব হয়ে রচি গোবিন্দের গীত, ছিটিয়েছি পুষ্পঢেউ কামের কিরিচ। রচিয়াছি চম্পুকাব্য কোনো এক কালে, বন্দনা করেছি কতো আনে আর বানে। আমিও শ্রীহট্টে জন্মে রাধারূপ ধরি, কবেই ছেড়েছি বাড়ি শব্দ শব্দ জপি। জৈন্তা পাহাড়ে ইরম দেখিয়াছি রূপ, বামেতে বন্ধুবাড়ি ডানেতে অসুখ। তবুও আলোর ডাক তবুও স্বপন, শ্রীহট্টে জন্মিয়া ভ্রমি বিস্তীর্ণ ভুবন। রচিতে প্রেমের শ্লোক তুচ্ছ করি কাম, বলেছি সহস্র বার নারীকে প্রণাম। জমিয়েছি দূরবাসে একজন্ম ঋণ, অকূল পাথারে ভাসি দলহারা মীন। সন্ধ্যাভাষা ভুলি নাই গুহ্য অন্তমিল, আমারও রক্তে ছুটে চর্যার হরিণ।

মোনাজাত: তুমি পুত্র কবিবংশের লোক...ধরিও বংশের খুঁটিজন্মভিটা যেনো আর না থাকে বিরান তোমার তরিকা যেনো সত্য হয় প্রেমদ্বিধাহীন করে যেও বংশের বয়ান...পুত্র তুমি, পিতা তুমি, তুমি বংশের মান- তোমাকে স্বাগত বলি, জানাই সেলাম!