শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

সম্পাদকীয় - ৪র্থ সংখ্যা

সম্পাদকীয়

অনেক বাঙালির মতোই আমারও বাল্যপাঠ হয়েছিল “ছুটব খেলব হাসব / সবারে ভালো বাসব / গুরুজনকে মানব / লিখব পড়ব জানব”।  তখন আমাদের বাড়ির কাছে সবুজ তীর্থের আসর বলে একটা ছোটদের খেলাধুলার আসর বসত প্রতিদিন। সেখানে যেতাম আর শুরুতেই পা’দুটো লেফট-রাইট করতে করতে আর বাঁ হাতটা কোমরে রেখে ডান হাতটার তর্জনি বাড়িয়ে একবার ডান দিকে একবার বাঁ দিকে ছন্দের সাথে সাথে নীচের দিক থেকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি পুনঃ পুনঃ প্রসারিত করে এই ছড়াটা বলতে হতো। কিন্তু তার কয়েক পঙক্তি পড়েই লেখা হল “দলের হয়ে লড়ব”। মানে গোষ্ঠীতন্ত্র সেই শিশুকাল থেকেই আমাদের শেখানো হল।  তারই সাথে যেন প্রোথিত হল দলতন্ত্রের বীজ। হিংসার বীজ। কেমন যেন আ মরি ইংরাজি ভাষায় সেলফ–কনট্রাডিকশন – সবারে ভালোবাসব আবার দলের হয়ে লড়ব! এই বীজ যে কত সাংঘাতিক তা তো আজ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘর্ষেই দেখা যাচ্ছে। শুধু কি রাজনৈতিক! সাহিত্যের আসরেও এই দলতন্ত্র প্রকট। নিস্তার নয়, আমরা এখনও গাছের ডাল পালা ধরে ওপরে উঠছি। দাঁত খিঁচাচ্ছি। “সবারে ভালোবাসব” কথাটাও আজ প্রায় সিঁদুরে অলংকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের চারপাশের নান্দনিকতা পাল্টে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বলতে যাচ্ছে এই সব কথাগুলোর সংজ্ঞা। ভালোবাসা ও বিনয় মানুষকে ছোট করে না, অথচ বিনয় করলে দেখা যায় মাথার ওপরে চেপে বসার ঝোঁক। এতে সামনের মানুষটি অবসম্ভাবী ভাববে এতো বেড়ালের মতোই পায়ে পায়ে লটর পটর করবে। আসলে এই ভাবনাই মানুষকে ছোট করে, যে বিনয়ী সে কোনোদিন ছোট হয় না। যথার্থই আমরা আজ ‘মেরা জুতা হ্যাঁয় জাপানি, ম্যায় হু পুরা হিন্দুস্থানি’। তবুও কোথাও না কোথাও এই ভালোবাসা এখনও টিকে আছে, ভালোবাসা ছিল বলেই না, প্রতিবারের মতো এই সংখ্যাতেও ব্যানার ও অলংকরণ করে দিলেন কবি কৌশিক বিশ্বাস, মেঘ অদিতি, অমিত বিশ্বাস, ভাস্কর লাহিড়ী। কবি সুমিতরঞ্জন দাস দিনের পর দিন অমানুষিক পরিশ্রমে সাজিয়ে তুললেন আমাদের সবার এই ব্লগ। তাঁদের প্রতি রইল আমাদের অসীম কৃতজ্ঞতা। ভালোবাসা ছিল বলেই, এই সংখ্যায় আমরা বেশ কিছু ধারাবাহিক গদ্য শুরু করতে পারলাম। যাইহোক, আগে যে কথা বলছিলাম, আমাদের এই বাংলা সাহিত্যের অন্দরমহলেও উষ্কে দেবার লোকজনের অভাব নেই। প্রতিনিয়তই দেখছি সীমিত মধ্যমেধায় ঋষি সেজে সাহিত্যে চলৎশক্তিহীন কিছু মানুষ বেছে বেছে মেধাবী তরুণ কবিদের বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত উসকে দিয়ে আড়ালে মজা লোটার কাজটা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন। আর সেইসব চলৎশক্তিহীন কিছু মানুষদের ‘এন্টারটেনমেন্ট’-এর খোঁড়াক হতে আগুনে ঝাঁপ মেরে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের সম্ভাব্য গ্রিন রিভোলিউশনকারীরা। কাজ আদায়ের প্রশংসা আর উস্কিয়ে মজা লোটার মধ্যে ভুলে যাচ্ছে পার্থক্য। এইভাবেই কত কত যুগ ধরে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে কুঁড়ি। তবুও আমরা বিশ্বাস রাখছি তাঁদের ওপর। আস্থা রাখছি ভুল বোঝার। কারণ আমরা কোনো গোষ্ঠী নই। আমাদের কাছে অছ্যুৎ বলে কিছু নেই। কারণ এখানে আমরা মানেই সার্বিক এক স্বত্ত্বা ।
ক্ষেপচুরিয়ানসের পক্ষে জুবিন ঘোষ ।

পীযুষ কান্তি ব্যানার্জী


 
No Escape From Escapism
 

Escapism আদতে একটি মনস্তাত্ত্বিক পরিভাষা যার অর্থ কঠিন বাস্তবকে এড়িয়ে চলার স্বভাব .শাহরুখ খান অভিনীত "My Name Is Khan" ছবিতে যে Autism কে আশ্রয় করে সাম্প্রদায়িক গৌরব প্রচারের চেষ্টা করা ,সেই দিবাস্বপ্ন সম আত্মরতি -Escapismএর জাতভাই কিনা তা মনস্তাত্ত্বিকরা বলবেন ,কিন্তু মনোবিদের পরীক্ষাগার থেকে তাকে সাহিত্য সমালোচনার রনাঙ্গনে টেনে আনেন যথাস্থিতবাদী (Naturalist) এবং বাস্তববাদী সাহিত্য সমালোচকরা কেউ কেউ এই ঘটনাকে শ্লীলতাহানি রূপে বর্ণনা করে এর আংশিক দায় মতান্ধ কমিউনিস্ট দের ঘাড়েও চাপান পূর্বসূরি সারস্বতদের নস্যাৎ না করলে নবোদিত মতাদর্শের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা ঠিক জমে না, তাই প্রথম যুগে রোমান্টিক ও পরবর্তী কালে সুররিয়ালিস্টিক ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও কোণঠাসা করার জন্যে তাদের সৃষ্টির গায়ে এসকেপিস্ট লিটারেচার এর স্টাম্প মেরে দেওয়া হয়  ইবসেন,বার্নার্ড শ প্রমুখ বাস্তববাদীরা কিংবা গ্ন্কর্ট, জোলা প্রমুখ যথাস্থিতবাদীরা তাদের সৃষ্টিতে মৃত্যুঞ্জয় কিন্তু বিশশতকের প্রথমার্ধে দু দুটি বিশ্বযুদ্ধ, তিরিশের দশকে মন্দা ও আর্থিক সঙ্কট ,বিশেষত ভারতবর্ষে ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ ,১৯৪৬ এর দাঙ্গা, দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা , আর্থ সামাজিক অবক্ষয় - একটি অদ্ভুতযুগের পটভূমি রচনা করেছিল সেই কঠিন কঠোর বাস্তব অনেকেই সহ্য করতে পারেননি, তার মধ্যে খুঁজে পাননি কোনো অনুকরণীয় আদর্শ দর্শন
এবং মনস্তাত্ত্বিক ফ্রয়েডের উদ্ভাবনায় চঞ্চল সেইসময় কেউ আশ্রয় নিলেন অভিব্যক্তিবাদে কেউ  ডাটাবাদ পরাবাস্তববাদে কিংবা কেউ অন্যতম মতবাদে

মানিক, শৈলজানন্দ,সমরেশ বসু,প্রেমেন্দ্র মিত্র,সমর সেন,সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দিনেশ দাস প্রমুখ প্রতিভাশালী নব্য সাহিত্যিকরা রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দকেও পলায়নবাদী আখ্যা দিতে পিছপা হননি ঠিক তার পরবর্তীকালে এদের অনুগামীদের প্রবেশের ফলে বাংলা সাহিত্যের আঙ্গিনা কুস্তির আখড়ার রূপ নেয়.সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার নামে বিকৃতি, অবক্ষয়, অশ্লীলতার কর্দ মতাই কালো হয়ে যায় তত্কালীন সাহিত্যসৃষ্টিঅথচ আজ সেই তথাকথিত এসকেপিস্টরাই আমাদের নয়নের মণি ,সাধনার ধন, প্রতি মুহূর্তের মানসসঙ্গী আর সাহিত্যের নামে রাজনৈতিক প্রচার, "শ্রেয় কে হেয়" করার জন্যে অবিরাম বিষোদ্গার , সাহিত্যের নামে যত অসাহিত্যিকতা -বিস্মৃতির খাদ্য হয়ে গেছে  

রোমান্টিক,সুররিয়ালিস্টিক,বা মিস্টিক দের বিরুদ্ধে এই নতুন প্রজন্মের মূলতঃ অভিযোগ ছিল এই যে পুরাতন ধারার সাহিত্যের সাথে নাকি সামাজিক জীবন ও চিত্ত সম্পর্কহীন , বাস্তবের মাটি ছেড়ে কল্পনার গজদন্ত মিনারে আশ্রয় নিয়েছেন ,তাই জগত ও জীবনের সাথে এদের সাহিত্য সৃষ্টির যোগসূত্র নেই !
কিন্তু বিচারকদের এটা খেয়াল ছিল না যে তারা কবির সামাজিক কর্তব্যের বিচার করতে বসেছেন, কাব্যের নয়ভবিষ্যতের শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন দেখা, তার জন্যে জীবন দিয়ে দেওয়া ,তাদের মতে পরম কর্তব্য .. কিন্তু তা কি সাহিত্যিক নাকি সামাজিক কর্তব্য ?

কল্পনা, প্রেম, স্বপ্নচারিতা, প্রকৃতিচেতনা ইত্যাদি কবিতার মূল উপাদান, তাকে তার মধ্যে আশ্রয় নিতেই হবে ! বাস্তবের নকল করা তার কাজ নয়, তাই স্বভাবোক্তিকে অলঙ্কারশাস্ত্রে অলঙ্কার বলে ধরাই হয়না
আসলে সকল সাহিত্যিকই কমবেশি পলায়নবাদী (ভোগবাদী নয়, অনেকে আবার পলায়নবাদ ও ভোগবাদ কে গুলিয়ে ফেলেন )

এটাও শ্বাশ্বত সত্য যে লৌকিক মন ও জীবন থেকে দূরবর্তী হয়ে গেলে সাহিত্য দুর্বল হতে বাধ্য, কারণ সাহিত্যের প্রধান উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলো মানুষের জীবন ,লৌকিক আনন্দ, বেদনা, বিত্ত ও সামাজিকতা মহাভারত থেকে গ্রিক ট্রাজেডি, শেক্সপিয়রের নাটক থেকে টলস্তয়ের উপন্যাস -রসোত্তীর্ণ সাহিত্য - হয়তো সেজন্যেই ভ্রম হয় যে সাহিত্যিকের কাজ শুধু বাস্তব চিত্রণই..

পলায়নবাদী সমাজের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে পালান না , এত সুবিশাল উপকরণ দিয়ে সাহিত্য সৃষ্টিতে তিনি অপারগ বলেই পালান.একে সাহিত্যিক চাতুর্য বলে ধরে নেওয়ায় শ্রেয়

আধুনিক সাহিত্যের বাজার যারা জগৎ ও জীবনের কুশ্রীতা ,নগ্নতা ,কদর্যতা আর তার সাথে ভোগবাদের মিশ্রণে মাতিয়ে রেখেছেন ,নারী মনের রহস্য কে উপজীব্য না করে তার মাংসল ভাঁজকেই কবিতার বিষয়বস্তু করেছেন , তাঁরাও কি এসকেপিস্ট নন?

রিয়ালিটি নয়, রিয়ালিজমের মুখোস পরা সস্তাসেন্টিমেন্টালিজ্ম-এর প্রদর্শনে এদের কবিতার পরতে-পরতে মল মূত্র , বীর্য , রজ্স্রাবের ছড়াছড়ি .. কিন্তু জীবন কি শুধু তাই ?
 
স্বাভাবিক সৌন্দর্য ,মান,অভিমান,বলে কিছুর অস্তিত্বই কি নেই ? বিপ্লবের রণধ্বনির মাঝে প্রেমের ফুল ফোঁটা কি কষ্ট কল্পনা ?

আসলে সমস্যাটা তা নয়এরা সৌন্দর্য-ভীরু, সত্য শিব সুন্দরের বিশালতায় ভয় পেয়ে এরা আশ্রয় নেই বিকৃতির বিবরে

জগৎ সংসারের অমৃত ও গরল যে একসাথে মিলেমিশে আছে , সেই বিস্ময় সেই বন্দনা কোথায়? নাকি সেই বিস্ময় থেকে বঞ্চিত হয়েই কুশ্রীর জয়গান !

সর্বোপরি বলবো যে ,সব কথার সারকথা একটাই - সারস্বত সাধনা - পথ যাইহোক না কেন।
"
কামনা অনলে প্রেম শতদল ফোটে"
মিথ্যে জনপ্রিয়তার লোভে যারা সেই সুন্দরকে ছেড়ে পাঁক ঘেঁটে মরে, তাদের মতো নির্বোধ কে ?
 
অলংকরণ – কৌশিক বিশ্বাস