খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না
কেমনে নাচি তোমার কথায় মোদি বাবা
ভোট আসছে। আসছে মানে এই এসে গেল বলে! তাই এখন হল আমাদের মত ছা-পোষা কেরানি-ঘরণী হকার-বেকার গেঁয়ো এবং ঘেয়োদের কিছু পাওয়ার সময়, কিছু খাওয়ার সময়। খাওয়ানো অবশ্য শুরু হয়েই গেছে। আমরাও আনন্দিত, আনন্দে ভুলেই যাচ্ছি আজকাল না প্রতিদিন না বর্তমানকে গুরুত্ব দেব, নাকি ৩৬৫দিনই গুরুত্ব পাবে? নিজেদের সকাল-বিকাল ঠিক রাখাই দায়, তা কেন সময়কাল কে পাত্তা দেব, ভাবার সময় কই। আমাদের কানের কাছ দিকে জনমত সমীক্ষার মিসাইল ছুটে চলেছে মুহুর্মুহু। এই বলে গেল মোদি ১৫০, তিন দিন পর সেটাই হয়ে গেল ১৭০, আরও কিছুদিন যেতেই সেটা ১৯০। আরে ব্বাস! বাড়ছে তো বাড়ছেই! হাউই যেন! এ-ভাবে বাড়তে থাকলে ভোত পর্যন্ত দেখা যাবে মোদির দল যে ৬০০ আসনে জিতে যাবে! ভাবা যায়! সংসদের ৫৪২টি আসনের মধ্যে মোদির দল ৬০০র বেশী আসনে জয়ী! ভাবতেই শিহরিত, রোমাঞ্চিত, পুলকিত… আরও কতি না ‘ইত’ হয়ে গেছি। কত খেয়ে ফেলেছি ভাবতে গিয়েই দেখি, হু হু বাবা, খেয়েছি বটে… কিন্তু গিলেছি কই…! সব যে উগরে আসছে…
এতদিন ভাবছিলাম, এ-ভাবে আর বাঁচা যাবে না। বাংলার তো আগেই দফা রফা হয়েছিল। একটু বনয় বদলে যদি হাল ফেরে। হল যা, সেটা আধীর চৌধুরির ভাষায়, “হটালাম হার্মাদ/ আনলাম উন্মাদ” হয়ে বসে আছে। ছা-পোষা কেরানিবাবু থেকে পুলিশ এবং ‘ফুলিশ’ টিচারদের ডিএ আর বাড়ে না। সব গেছে আটকে। ঘরণীর কলকণ্ঠ এখন হৃদয়ে বাজায় ভাঙা বাঁশি। তাই বাভছিলাম ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনওখানে’ যদি বাস করা যায়, তাহলে বোধ হয় বাঁশ খাওয়া কমানো যাবে। তা খোঁজ করে এক গাঢ় হিন্দু বন্ধু জানালেন ‘গুজরাত যাও। দেশের সেরা রাজ্য। বিকাশপুরুষ আছেন সে দেশের মাথায়। চিন্তা থাকবে না।“
আমি মশাই, বড্ড ভীতু মানুষ। তাই সবার কথাতেই গুরুত্ব দেই। এক পাবাড়ানোর আগে, দশ বার ভাবি – ‘ট্রেনের নাম নম্বর তো মিলছে, কিন্তু এটাই সেই ট্রেন তো? যেখানে যাওয়ার সেখানেই যাবে তো? টিটিকে জিজ্ঞাসা করি, কুলিকে জিজ্ঞাসা করি, হকার পেলে হকারকেও… তবে উঠি। তা অন্য রাজ্য বাছাইয়ের সময় ভাববো না? সেই বন্ধু ভাবার অবকাশ দিতেই রাজি না। এক গুচ্ছ খবরের কাগজ এনে হাজির করল… দেখ দেখ… ভাইব্র্যান্ট গুজরাত। সব শিল্পপতি মোদির পক্ষে। সবাই সেখানে কারখানা গড়ছে। গুজরাত সরকারের ভিডিও দেখাল… কি ঝকঝক করছে রাস্তাঘাট! শিশুদের হাসিতে ভরা নিটোল মুখ… স্বাস্থ্যবতী মায়েরা… মোদির প্রায় ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে ফেলেছেন মুকেশ আম্বানী… মোদির যাতায়াতের জন্য একটা প্লেন দিয়ে দিয়েছেন আদানী গ্রুপের মালিক গৌতম আদানি। টাটা তাঁর ন্যানো কারখানা নিয়ে গিয়েছেন।
গিন্নিকে সব বললাম। আরে কী কুক্ষণেই যে বললাম! গিন্নি তো প্রায় মারমুখী! কি বলেন জানেন? বলেন, “মোদির রাজ্যে…? জানো, তিনি একটা মেয়েকে বিয়ে করে আর তাঁর সঙ্গে খর করে নি। তাঁর শিক্ষা কম, এই অজুহাতে পাঁকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই মহিলা লেখাপড়া শিখে স্নাতক হলেন। কিন্তু মোদি তাঁকে আর সংসারে নিলেন না। বাধ্য হয়ে নিজের খরচ নিজে চালাতে তিনি একটি স্কুলে টিচারি নিলেন। এদিকে, মোদি নেতা হলেন, মন্ত্রী হলেন, মহানেতা হলেন, মুখ্যমন্ত্রী হলেন, এখন প্রধানমন্ত্রী হতে চান… কিন্তু সেই মহিলা পড়ে রইলেন বাপের দেশে। একটা মেয়ের স্বামী-সংসার করাি হল না। অথচ, মোদি কিন্তু ডিভোর্স দেন নি! তিনি অনেক মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্ট হলেও, তাঁর স্ত্রীর তো আর তা সম্ভব ছিল না। তিনি উপেক্ষিতই রইলেন। আরে বাবা, রামচন্দ্রও সীতার বিরুদ্ধে অযথা সন্দেহ করেছেন, অগ্নিপরীক্ষার কথা বলেছেন। আর এই কলির নেতা! তিনি নাকি সাক্ষাৎ সত্যবাদী যুধিষ্ঠির! তা বিধান্সভার ভোটে দাঁড়ানোর সময় তিনি তো হলফনামায় লেখেনই নি তিনি বিবাহিত, না অবিবাহিত না কি বিবাহবিচ্ছিন্ন বা বিপত্নীক। আরে বাবা, কোনও পুরুষ তো এই চারটি ভাগের বাইরে নয়! তিনি সত্যটা লিখলেন না কেন? ও দেশে যাব না, শেষে তুমিও অমন কর…!”
খবর নিলাম, দেখি গিন্নিই সত্যি বলেছেন। নরেন্দ্র মোদী ১৯৬৮ সালে মেহসানা জেলায় ভাড়নগর গ্রামের বাড়িতে বিয়ে করেছিলেন যশোদাবেন চিমনলাল মোদীকে। যশোদাবেনের জন্ম হয়েছিল ১৯৫১ সালের ১৫ জুন। বিয়ের সময় মোদীর বয়স ছিল ২০ এবং যশোদাবেনের ১৮। এই নিয়ে কলকাতার এক ব্যবসায়ী সুনীল সারাওগি ভারতের নির্বাচন কমিশনে একটি মামলা ঠুকেছেন আহমেদাবাদের মনিনগর কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর বিরুদ্ধে। তাঁর আগে তিনি সুপ্রিম কোর্টের দরজায় গিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু মোদিকে ক্লিন চিট না দিয়ে নির্বাচন কমিশনে মামলা করার কথা বলে মন্তব্য করে যে, রিটার্নিং অফিসার তো এই মনোনয়ন পত্র নেমেছেন। তা হলে মামলা তো হবে নির্বাচন কমিশনে। সুনীল সারাওগি বলেছেন, কেবল স্বামী/স্ত্রীর নামই নয়, তিনি কত টাকা আয় করেন ও তাঁর সঞ্চিত সম্পত্তি কত সেটাও প্রার্থীর হলফনামায় থাকা বাঞ্ছনীয়। এই তথ্য গোপন করা হয়ে থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনকে পদক্ষেপ নিতেই হবে। এই অভিযোগ প্রসঙ্গে মোদীর পেশ করা হলফনামাকে ‘মিথ্যাভাষণ’ বলে মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী কলিন গঞ্জালভেস বলেছেন, “যেহেতু, ওই হলফনামার বক্তব্যে অসঙ্গতি ও সন্দেহর কারণ আছে, তাই রিটার্নিং অফিসারেরই উচিৎ ছিল সেটি বাতিল করা।”
গিন্নির বোনটি আরও সরেস। বিয়ের সময় একবার ভেবেচিলাম মালাটা ভুল করে তাঁর গলাতেই দিয়ে দিই…। যাক, সে সব গোপন কথা, কাউকে বলবেন না যেন। তিনি এখন অন্যের ঘরণী, মাঝে মাঝে এখানে এলে হৃদয়ের শতছিদ্র বাশিটি আজও বেজে ওঠে, আর কি। তাঁর দিদিকে তিনি বলে দিলেন, “খবরদার দিদি, ও দেশে যাবি না।”। তারপর প্রায় একটি ভোটের বক্তৃতার মত একের পর এক তথ্য তুলে তুলে আমাকে ধরাশায়ী করে দিলেন।
তাঁর ঘোষণা, ভারত সরকারের পরিসংখ্যান মন্ত্রকের ‘চিলড্রেন ইন ইন্ডিয়া, ২০১২’-র তথ্য বলছে, এই রাজ্যের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ শিশুই কম ওজন নিয়ে জন্মায়। তাছাড়া, এই রাজ্যে গড়ে প্রতি ১০০০ সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে ৪৪ জন মারা যায়, যা দেশের গড় হারের চেয়ে বেশী। ‘বিকাশপুরুষ’ নরেন্দ্র মোদীর ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ এর ফুলিয়ে ফাপিয়ে রাখা ফানুসে পিন ফুটে গেছে, বুঝলি। গুজরাতের সঙ্গেই আছে মেঘালয়, ছত্তিশগড়, উত্তর প্রদেশ ও ওডিশা। আগের বছরের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট বলেছিল, গুজরাতের অর্ধেক শিশুই অপুষ্টিতে ভুগছে। সেই রিপোর্ট মোদীর কাছেও গিয়েছে, তিনিও জানেন। তিনি এও জানেন যে, গ্রামে যেহেতু চিকিৎসার দারুণ অভাব এবং তফশিলী জাতি-উপজাতির পিছিয়ে পড়া লোকেরাই যেহেতু গ্রামে থাকেন, তাই তাঁদের মধ্যেই অপুষ্টি ও শিশুমৃত্যুর হার রাজ্যের তুলনায়ও অনেক বেশী।”
আমার বন্ধুদের আমি বিশ্বাস করি, সেই গাঢ় হিন্দু বন্ধুকেও বিশ্বাস করি। তাই প্রতিবাদ করতে গিয়েই গিন্নির দাবড়ানি… “থামো, ওকে বলতে দাও। নিজে কিস্যু জানবে না, উল্টোপাল্টা শুনে এসে তাই নিয়ে ঘর গরম করবেন তিনি!” গিন্নি এই অবসরে এক কাপ চা বাড়িয়ে দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করল। আর শ্যালিকা বলে গেলেন, “আমার কথা না হয়য় বিশ্বাস নাই করলে জামাইবাবু, প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মার্কণ্ডেয় কাটজু কি বলেছেন জানো? তিনি লিখেছেন, “গুজরাতে অপুষ্টিতে ভোগা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর হার ৪৮ শতাংশ, যা শুধু জাতীয় হারের চেয়ে বেশীই নয়, সাব-সাহারা এলাকার সোমালিয়া এবং ইথিওপিয়ায় অপুষ্টির ভোগা শিশুর হারের চেয়ে অনেক বেশী। মোদী এঁর কারণ দেখিয়াছেন -- গুজরাতের মেয়েরা নিরামিশাষী এবং মোটা হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাঁরা দুধ খায় না। এ-সব ছেঁদো যুক্তি। গুজরাতের শিশুরা কি তবে মোদীর বানানো কারখানা, সড়ক আর বিদ্যুৎ খায়! … গুজরাতে সদ্যজাতের মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৪৮ জন, যার ফলে ভারতের সবচেয়ে খারাপ রাজ্যগুলির মধ্যে গুজরাত দশম স্থানে। … গুজরাতের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের এক-তৃতীয়াংশের শরীরের বডি মাস ইন্ডেক্স ১৮.৫ এঁর চেয়েও কম, ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে খারাপের দিক থেকে সপ্তম। … গুজরাতে প্রসূতিদের মৃত্যুর হারও বেশি…।”
এখানে না থেকে তাঁর দিদিকে বোঝালে, “শোন দিদি, কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে মোদির দল কতদিন পার্লামেন্টে ঝামেলা পাকালো , মনে আছে? সিএজি যেনো এঁদের এক্কেবারে বাপের ঠাকুর। আর দেখ, সেই সিএজি বলেছে, গুজরাত সরকারের সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের আইসিডিএস প্রকল্পে চিহ্নিত ২২৩.১৫ লাখ মানুষের মধ্যে ৬৩.৩৭ লাখকে কোনও পরিসেবা দেওয়া হয় নি। পুষ্টিকর খাবার রাজ্যে বছরে ৩০০ দিনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, ৯৬ দিন দেওয়াই হয়য় নি। সদ্য-যুবতীদের পুষ্টিকর খাদ্য দেওয়ার প্রকল্পে ঘাটতি আছে ২৭ থেকে ৪৮ শতাংশ। রিপোর্টে বলছে, মোট ১.৮৭ কোটি জনতা আইসিডিএস প্রকল্পের সুবিধা পান নি। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র যতগুলি দরকার, তাঁর ৩১ শতাংশকে তৈরির অনুমোদনি দেয় নি মোদি সরকার। যেগুলি তৈরি হয়েছে, সেখানেও ভবন, পরিশ্রুত পানীয় জল বা প্রস্রাবাগারের অভাব আছে। আর মোদির দলের টাকায় চালিত ওয়েবসাইট ‘ইন্ডিয়াস্পেন্ড’ লিখেছে, গুজরাতে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর হার ৪৪ শতাংশ। আর, সদ্যোজাতের মৃত্যুর হার হাজারে ৪৮ জন নয়, ৪৪ জন। কি রকম সত্যবাদীর রাজ্য ভেবে আজও পুলকিত হই… আ হা…!
বাংলাদেশ ঘুরে নিয়ে আসা একটা সিডি চালিয়ে দিদিকে ফকিরের গান শোনাবে বলে শ্যালিকা আমার গালে ঠোনা মেরে চলে গেল। বেজে উঠল আব্দুল করিম্ শাহ-র গান, “আগের মত খাওয়া যায় না/ বেশী খাইলে হজম হয় না…” ঠিক বলেছে আব্দুল করিম শাহ। তাই এখন আমি তাঁর পথ ধরেছি। খাচ্ছি, কিন্তু গিলছি না। মেরি বাবার গান শুনেছি অনেক আগে। তাই বলি, ও মোদি বাবা, কেমনে তোমার কথায় নাচি বল তো?