মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৪

সম্পাদকীয় -

অনিবার্য কারণ বশত এই সংখ্যায় সম্পাদকীয় প্রকাশ করা গেলো না।


                                 ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষে - শুভেন্দু দেবনাথ

উত্তর সম্পাদকীয় – চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

       খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না

      ধর্ষণের মানসিকতা নিয়ে সরকার চলে?


মানুষ বড় আশা নিয়ে নতুন একটা সরকার এনেছে। দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির সরকার তৈরি হয়েছে। ২৫ বছর পর একটা একদলের সরকার এসেছে, জোটের নয়। তাই মানুষের আশা আরও বেশি। যে সব কাজ এতদিন মানুষ শুনেছে যে জোট রাজনীতির কারণে করা যাচ্ছে না, এবার সেগুলি হতে পারবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনও মমতা-জয়া-মায়ার দিকে তাকাতে হবে না। সরকার সেগুলি সহজেই করে দেবে।
        দেবে তো বটেই। ভোটের আগেই তা তাঁরা বলেছে, সুদিন আসছে। আচ্ছে দিন আনেবালা হ্যায়। ভোটের থেকে মাত্র কয়েকটা দিন পরেই আর কাউকে জল আনতে যেতে হবে না। জল আপনি আসবে। পেটড়ল-দিজেলের দামের জন্যে চন্তা করতে হবে না, দাম কমে যাবে। বাজারের তরিতরকারির দাম তো একেবারে জলের মত সস্তা হয়ে যাবে। সুদিন আসছে যে! ‘আচ্ছে দিন আনেবালা হ্যায়না!
        খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না-র মতো সেই দিন এল, কিন্তু আচ্ছেহল না! পেট্রল-ডিজেলের দাম এরই মধ্যে একাধিক বার বেড়েছে। গ্যাসের দাম এক ধাক্কায় ১৬.৫০ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। অর্থাৎ, গ্যাসের দাম বেড়েছে কেজি প্রতি এক টাকারও বেশি। আনাজপাতি, তরিতরকারির দাম কমাতো দূরস্থান, আলুর কেজি ২৫ টাকা হয়েছে। বাড়তে চলেছে কেরোসিনের দামও। পেয়াজের দামের ঝাজেই লোক বাজার থেকে পালাচ্ছে। কেজি প্রতি ৪০ টাকা পার হয়েছে আগেই, সামনে ৪৫ এর গণ্ডী। খোলা বাজারে যে যেমন পারছে, লুটে নিচ্ছে।
        লুটে নিচ্ছে। বাজার তো লুটছেই। সরকারও পাল্লা দিয়ে লুটছে। রেলের টিকিটের দাম যে হারে বেড়েছে, তা অতীতে কখনও হয় নি। শুধু উচু ক্লাসের ভাড়াই বাড়েচি, একেবারে তৃতীয় শ্রেণির টিকিটের দাম, এমনকি মাসিক টিকিটের দাম পকেটের গতিতে বাড়ল। সরকার বাজেট পেশ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছে, অর্থাৎ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, রেল বাজেটে কমতে পারে বা অন্য অর্থে নাও কমতে পারে। কড়া দাওয়াইয়ের সুপারিশ যে মানুষের পেটে আঘাত করছে, নরেন্দ্র মোদির সরকারও সেটা বুঝল। ফলে, বিপদ আসছে ঘরের ভিতর থেকেই। শরিকরাও এতটা বৃদ্ধি মানতে পারছে না। বিশেষ করে মাসিক টিকিটের ভাড়া ১৫ বার চড়ার বদলে ৩০ বারের এবং সঙ্গে সঙ্গে ১৪.২ শতাংশ হারে জ্বালানী তেলেজ দাম সংগতি শুল্ক। বাপ রে বাপ! ১০০ টাকার মান্থলির দাম বেরে হচ্ছিল ২৩০ টাকা। অথচ, টিকিট না কেটেও উপায় নেই। মানুষ বাধ্য হয়েই চড়া হারে মাসিক টিকিট কাটল। পকেট লুট হয়ে গেল। পরে অবশ্য কিছুটা রহাই দিয়েছে, তবে ঐ ৮০ কিমি দূরত্ব পর্যন্ত। তাঁর চেয়ে দূরে থাকলে চড়া হার দিতেই হবে।
     রেলের মাল পরিবহনের ভাড়াও যে জ্যামিতিক হারে বাড়ল। অর্থাৎ, আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট যা যা কিছু রেলের মাধ্যমে স্থানীয় বাজারে আসে, তাঁর প্রতিটির দাম বাড়বে। কোনও পণ্যের এক কেজি ওজনের রেলের মাশুল যদি ১.৮৭ পয়সা পড়ে,  বাজারে তাঁর দাম বাড়বে আরও ৩ টাকা ১৩ পয়সা, ‘রাউন্ড ফিগারকরার তাগিদে। ফলে সব জিনিষেরই দাম ইতিমধ্যেই বেড়েছে, খাদ্যশষ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার আগের চেয়ে পাঁচ শতাংশ বেড়েছে। সরকারের নতুন দাওয়াইয়ে সব পণ্যের আরেক দফা দাম বাড়বে। লুট হবে সাধারণ মানুষের পকেট।  সঙ্গে সঙ্গে গেল মানসিক শান্তি। নতুন সরকার এনে যে শান্তি এসেছিল, তা এখনই উধাও।
         আসলে এই লুট ব্যাপারটা সবার দ্বারা হয় না। তাঁর একটা মানসিকতা চাই। চেঙ্গিস-তৈমুরের বংশধর মোগলরাও সীমানা পেরিয়ে ভারতে এসেছিলেন, আবার নাদির শাহও এসেছিলেন। মোগলরা এদেশ শাসন করেছে দুই দশক, অনেক কিছু দিয়ে গেছে এই দেশকে অনেক স্থাপত্য, অনেক কীর্তি। খেয়াল, কাওয়ালি থেকে সেলাই করা জামাকাপড়ের রেওয়াজ, মশলা দিয়ে রান্না আরও কত কি। কিন্তু নাদির শাহ এসেছিলেন লুট করতে। তিন্মাস দিল্লিতে ছিলেন। যাওয়ার সময় ৭০০০ ঘোড়া, ৮০০০ হাতি আর ১০০০০ উট বোঝাই করে মূল্যবান সম্পদ নিয়ে গিয়েছিলেন। তৎকালীন শায়েরদের ভাষায়, দিল্লির সিথির সিঁদুর যেন মুছে গিয়েছিল সেদিন। এই তফাৎ আসলে মানসিকতার। এই সরকারের ক্ষেত্রেও তাঁর একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছি।
        সরকারে এসেই মোদির মন্ত্রী-সান্ত্রীরা তাঁদের গোপন এজেন্ডাগুলি রূপায়নের জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। কৌশলটা নেওয়া হল পরোক্ষে দাবি তোলার। ৩৭০ ধারা বাতিলের দাবি উঠল। সরকারের কেউ না, তুলল দল আর সঙ্ঘ পরিবার। দিন পাঁচেক কাগজে টিভিতে তাই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হল। তাঁর মধ্যেই আকালি দল ও অন্য শরিকদের কেউ কেউ সরকারকে সতর্ক করল, ধীরে চলার পরামর্শ দিল। বোঝাল, সেই ধারা বাতিল হলে কাশ্মীর ভারতে থাকবে না। তাহলে বিজেপিকেই লোকে ভারত-বিরোধী বলবে। চেপে গেল ৩৭০ ধারা বিতর্ক। এ যেন, ‘আয় ছুরি, তোর কাপড় খুলিবলে তেড়ে যাওয়া। যেই না সে চিৎকার করল, অমনি দে হাওয়া চাগিয়ে কাপড়
শুধু কি ৩৭০ ধারা? এক সঙ্ঘ কর্মী ইউনিফায়েড সিভিল কোডবা অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দাবিতে দিল্লি হাই কোর্টে মামলাই করে বসলেন। সে নিয়ে বাজার গরম করতে গিয়ে ধাক্কা খেল বিজেপি। আদালত বলে দিল, ‘এই দাবী সংবিধান বিরোধী। রণেও ভঙ্গ দিতে হল। তার পরেই ইউপিএ সরকারের একটি পচা ডিমের ঝুড়ি মাথায় চাপিয়ে মোদি বাজারে বেরোলেন বিক্রি করতে। আইবি-র রিপোর্ট দেখিয়ে সরকার বলল, দেশের উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা পরিবেশ কর্মীরা। তাঁরা নাকি বিদেশের অর্থে পুষ্ট। কারা তাঁরা? একজন এস পি উদয় কুমার, যিনি মতস্যজীবী ও সাধারণ মানুষকে নিয়ে কুড়ানকুলামে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লড়ছেন এবং আমেরিকা-রাশিয়া-ফ্রান্সয়ের পরমাণু প্রযুক্তি বিক্রির বিরোধিতা করছেন। আরেকজন গান্ধী ভাবাদর্শে বিশ্বাসী মেধা পাটকার, যাকে বিদেশী অর্থে পুষ্ট বলার আগে কল্কে নয়, একবস্তা গঞ্জিকা সেবন প্রয়োজন হয়। তেমনই গ্রিন পিস, যারা সরকারের কোকাকোলা,পরমাণু নীতি সহ বহু পরিবেশ-বিরোধী পদক্ষেপের বিরোধিতা করে। ক্ষুব্ধ পরিবেশ কর্মীরা চেপে ধরলেন। উদয়কুমার মাওম্লার হুমকি দিয়ে তাঁর সম্পর্কিত আই বি রিপোর্টের কপি চাইলেন। চুপ হলেন প্রবল প্রতাপশালী নরেন্দ্র মোদি। হয়তো এ-সব কিছুর জন্যেই তাঁকে আবার উদ্যোগ নিতে হবে, অন্য পথে এগোতে হবে, এমনকি ফের সঙ্ঘ পরিবারকে কাজে লাগিয়ে বাবরি ভাঙার মত মব (mob) কে ক্ষেপিয়ে মবোক্র্যাসি-র পথ ধরতে হবে। অথচ, আগের সরকারের পচা মাল বাতিল করার শপথ নিয়েছিলেন মোদি।
সেতা করেছেন বা করতে চলেছেন, সেগুলি ওই ধর্ষণের মানসিকতাকেই সামনে আনে। যেমন, ক্ষমতায় এসেই এয়ার ইন্ডিয়া, কোল ইন্ডিয়া, ভারতীয় রেল এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে বেসরকারিকরণের ঘোড়া ছোটানোর ঘোষণা করেছে। আরও বিপজ্জনক, দেশের সেনাবাহিনীর জন্যে প্রয়োজনীয় বন্দুক, কার্তুজ, গোলাগুলি, কামান, সাঁজোয়া গাড়ি বা ট্যাঙ্ক বানানোর অধিকার সরকারি কোম্পানির থেকে নিয়ে বিদেশি বেসরকারি কোম্পানির হাতে দেওয়ার পথ ধরতে চলেছে। এমনিতেই দেখা যাচ্ছে, খনিতে বেসরকারি পুজির পথ খুলে দেওয়ার পর খনিতে ব্যবহৃত ডিনামাইট সহজেই যাচ্ছে মাওবাদী থেকে জঙ্গীদের হাত। আর এই সব অস্ত্রশস্ত্র যে সরাসরি তাঁদের হাতে যাবে না, তাঁর গ্যারান্টি কে দিতে পারে! তা না গেলেও, দেশের সেনাদের কেন অস্ত্রশস্ত্রের জন্য টাতা-বিড়লা-আম্বানি-আদানিদের মুখের দিকে চাইতে হবে? এঁকে কি দেশের স্বার্থ রক্ষা বলে না কি? যা খাওয়াবেন, তাই খেতে হবে? বাধ্য করলে খাবো হয়ত, গিলবো না। ভুলে তো যায় নি মানুষ যে, পৃথিবীতে একটি মাত্র দেশে সরকারি কোম্পানী জলের দরে ব্যক্তিপুজির মালিকদের হাতে তুলে দিতে একটা মন্ত্রক তৈরি হয়েছিল। সেটা ভারত। আর বাজপেয়ী আমলের সেই মন্ত্রকের মন্ত্রী ছিলেন বিজেপির অরুণ শৌরী। সেন্টুর হোটেল থেকে বহু সরকারি কোম্পানির বেসরকারিকরণে দুর্নীতির কাহিনীও মানুষ ভোলে নি।
তাই, গিলতে পারব না। ধরুন, ভোটের আগে মোদিজী দামাদ জিনিয়ে কত কথাই না বললেন। তাই মেনে বিমান পরিবহন মন্ত্রকের কর্তারা দামাদ জিরবার্ট ভদেরার গিন চ্যানেল দিয়ে যাতায়াতের অধিকার প্রত্যাহার করলেন। পালটা চিঠি দিলেন প্রিয়ঙ্কা ভদেরা। মোদিকে চিঠি দিয়ে গত ১০ বছরে রবার্ট কতবার গ্রিন চ্যানেল দিয়ে গিয়েছেন, তা জানাতে বললেন। সেই সঙ্গে বললেন, তাঁর নিজের প্রাপ্য গ্রিন চ্যানেলের অধিকারও যেন প্রত্যাহার করা হয়। আমি আমার স্বামীর সঙ্গেই সাধারণ চ্যানেল দিয়েই যাই। সেখান দিয়েই যাব।পর্দার আড়ালে খেলা শেষ। মোদি নির্দেশ দিলেন, যেমন ছিল অধিকার, তেমনই থাকবে। হল? লোক ক্ষেপিয়ে ভোট, তারপরেই নজর ব্যবসায়ীর নোটকি করে ভুলবেন, রবার্ট যে ব্যবসায়ী!
এঁর পর যেটা করলেন, সেই ভুল গত ৪৪ বছরে কেউ করেনি। ১৯৬০এর দশকে সুপ্রিম কোর্টে এক বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষপাতিত্ব দেশ জুড়ে নিন্দার স্রোত বিয়ে দেয়। সেই সময় থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ হয় একটি কলেজিয়ামের সুপারিশ মেনে, যার নেতৃত্ব দেন দেশের প্রধান বিচারপতি। এবারও সেই নিয়ম মেনেই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কলেজিয়াম প্রাক্তন সলিসিটার জেনারেল গোপাল সুব্রহ্মণ্যম এঁর নাম সুপারিশ করে। এই গোপাল সুব্রহ্মণয়মই সোহরাবুদ্দিন-কৌশর বি, তুলসিদাস প্রজাপতিদের ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার মামলায় মোদির ডান হাত অমিত শাহ-এঁর বিরুদ্ধে চার্জ শিট দিতে বলে। তাই তাকেই বলির পাঠা করলেন মোদি। কলেজিয়াম তৈরির পর থেকে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কখনও হয় নি, এবার হল।
সব নিয়মকে উল্টেপাল্টে দিতে চায় এই সরকার। দেশের সব সম্পদকে বেচে দিতে চায়। (এতে কাটমানির কথা না হয় বাদই দিলাম।) মানুষের পকেট কেটে য়াম্বানী-আদানীদের জন্য আচ্ছে দিননিয়ে আসতে চায়। যারা মানুষের হয়ে লড়ে, তাঁদের শত্রুনিহ্নিত করতে চায়। এই মানসিকতাটাই গণ্ডগোলের। এটাই ধর্ষকের মানসিকতা। ধর্ষক কখনও প্রতিপক্ষকে যৌন সঙ্গমের জন্য প্রস্তুত করে নেয় না, জোর করেই করে। বেশির ভাগ সময় জোর করে ঘরে ঢোকে বা তুলে নিয়ে যায়, কখনও কখনও পরিচিতের ছদ্মবেশে আসে। তারপর জোর করেই বিবস্ত্র করে এবং সবকিছু লুট করে। ডাকাতরাও এমনটাই করে। অষ্টাদশ-উনবিংশ শতকের আগাম খবর দিয়ে আসত, ডাকাতেরা ধর্ষণ করত না। এখনকার ডাকাতেরা খবর দিয়ে আসে না, ধর্ষণ করে। নন্দীগ্রাম করে, সিঙ্গুরে তাপসীর ঘটনা ঘটায়, লালগড়ের গ্রামে আদিবাসী মেয়েদের ধর্ষণ করে। আর, তারপর ভয়ে কেউ আর তাদের বিরুদ্ধে যায় না।
মনে রাখুন, ভোটের আগে মোদি সরকারের ইস্তাহার বেড়িয়েছিল সবার শেষে, প্রথম দফার ভোটের দিন। কেউ সেই ইস্তাহার হাতে পেয়েছেন? পেয়ে থাকলে তিনি কোটি মে একবাকিরা কেবল মোদির কথা শুনেছেন। সেটাই ছিল সাধারণের জন্যে ইস্তাহার। তাতে কি একবারও ব্যাংক-বীমা-প্রতিরক্ষা উৎপাদন-কয়লা খনি-ভারতীয় রেল-এয়ার ইন্ডিয়াকে বেসরকারি করার কথা ছিল? আদিবাসীদের মাওবাদীতকমা দিয়ে আধা সামরিক বাহিনীর বন্দুকের সামনে দাঁড় করানোর কথা ছিল? ক্ষমতা এসেই কিন্তু জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, মাওবাদী আর উত্তর পূর্বের মানুষের উপর নজরদারি ও যুদ্ধের সুবিধার জন্য ঢালাও অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি ৩৭০০ স্যাটেলাইট ফোন দেওয়া হবে। আসলে, বস্তারের গোণ্ড সুন্দরী বা মণিপুরের মনোরমা-চানুর বোনেরা তো কাপড় খুলছে না! তবে এই দেখ আমার বন্দুক, খোল কাপড়আয় তোকে… ‘
এই নীতি নিয়েই সরকার চালাবেন মোদি, যিনি বিয়ের পর থেকে তাঁর স্ত্রীকে মর্যাদাই দেন নি। যে মহিলা তাঁর স্বামীকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চেয়ে সারা জীবন তিতিক্ষায় কাটালেন, তাঁর স্বামী প্রধান্মন্ত্রীর শপথের দিনেও তাঁকে ডাকেন নি। হায়! স্নাতক না হয়েই নিজের হলফনামায় যিনি নিজেকে স্নাতক বলেছিলেন, সেই অসত্যভাষণ দেওয়া স্মৃতি ইরাণি সামলাবেন শিক্ষা মন্ত্রক। জমি কেলেঙ্কারী ও নানা দূর্নীতিতে যুক্ত নীতিন গডকড়ি, ক্রিকেট-দূর্নীতির শিরোমণি শ্রীনির দোসর অরুণ জেটলিরা কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়েছেন। দল যাকে নৈতিক-মানসিক অধঃপতনের দায়ে বদিস্কার করেছিল, সেই উমা ভারতী গঙ্গার দূষণ মুক্তির দায় নিয়েছেন। হায়! ফের মুক্তি পাক রাম তেরী গঙ্গা ময়লিআর আছেন সার ও রসায়ন মন্ত্রকের রসিক মন্ত্রী নিহালচান্দ মেঘওয়াল, যিনি স্বামীকে বিধানসভার প্রার্থী করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁর সামনেই এক সদ্যযুবতীকে মাদক খাইয়ে তাঁর স্বামীর সামনেই ধর্ষণ করেছেন তিন বছর ধরে।

মাত্র ২১ শতাংশ ভারতবাসীর সমর্থনপুষ্ট, অন্য অর্থে প্রদত্ত ভোটের মাত্র ৩১ শতাংশ পেয়ে) সরকার ১০০ শতাংশকেই যে শত্রু ভাবছে। সবাইকেই দাবিয়ে রেখে নিজের উল্লু সিধা করতে চায়। গোটা দেশকেই ধর্ষণ করতে চায়! শুরুতেই এত তেজ! এই মানসিকতা নিয়ে সরকার চলে না কি!

সাক্ষাৎকার-প্রবালকুমার বসু

“মর্ডান-পোস্টমর্ডান এসব ধারনা কবিতা বা গদ্যে বা গদ্যে কোনও ছাপ ফেলে না আদৌ। কোনও কবি লিখতে বসে তার সৃষ্টি মর্ডান বা পোস্ট-মর্ডান অঙ্কে হিসেব না করেই লেখে। কিছু কিছু লোক বা পত্রিকা তাদের এগজিসটেন্স বোঝানোর জন্যে এটা প্রচার করে বেড়ায়।”--- বললেন আশির বিখ্যাত কবি প্রবালকুমার বসুঅন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়।




[ আশির দশক থেকে লিখে যাচ্ছেন বাংলার বিখ্যাত কবি প্রবালকুমার বসু। তিনি আবার বিখ্যাত সম্পাদক ও প্রকাশক দেবকুমার বসুর আত্মজও বটে। তরুণ কবিদের কাছে প্রবালকুমার বসুর জনপ্রিয়তাও তাঁকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দেয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা, দীর্ঘকবিতা, গল্প, কাব্যনাটকের পাশাপাশি তরুণ কবিদের আগলে রাখতে যাপনচিত্র নামে একটি পত্রিকা ও প্রকাশনীও করেন। এছাড়াও ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশন’--এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। একসময় সূনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদিত বিখ্যাত কৃত্তিবাস পত্রিকার দুয়েকটি সংখ্যার সহকারী সম্পাদনাও করেন বর্ণময় এই মানুষটি। এই সময় তরুণ কবিদের মাথার ওপর যে বৃক্ষগুলি ছায়া দেয়, সেই একটি চিরতরুণ সবুজ বৃক্ষের নাম প্রবালকুমার বসু। যিনি মনে করেন ---“হৃদয়, মনন ও মস্তিষ্কের মহাসম্মিলনে তিনটি গ্রন্থি গ্রন্থি যখন এক লয়ে বেজে ওঠে ওঠে সেটাই কবিতা”---দীর্ঘ আলাপচারিতায় সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আর এক তরুণ কবি স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়। ]


স্বপ্না- কবিতা লেখার প্রথম ইনস্‌পিরেশন কোথা থেকে পেয়েছিলেন? আপনার বাবার কাছ থেকে নিশ্চয়ই?


প্রবালকুমার বসু- নাহ্‌ ইনস্‌পিরেশন ব্যাপার ভিতর থেকে আসে ওটা ঠিক বাইরের লোক দিতে পারে না। তাগিদ। ভিতরের উথাল-পাথাল তাগিদ লেখাটাকে লিখিয়ে নেয়। বাইরের লোক, সে যেই হোক, হয়তো সাপোর্ট দিতে পারে। বাবা ছিল সেই সাপোর্ট।


স্বপ্না-দেবকুমার বসু ছিলেন প্রখ্যাত সম্পাদক ও প্রকাশক। তাঁর কবিতার কাগজে লেখার উৎসাহ দিতেন? ‘সময়ানুগ’-এ নিশ্চয়ই আপনার লেখা কবিতা প্রকাশ হয়েছিল?


প্রবালকুমার বসু-বাবা দুটো কাগজ করতেন। একটি পাক্ষিক। নাম “দর্শক” অন্যটি মাসিক “সময়ানুগ”। এই দুটো কাগজের সূত্রেই আমাদের বাড়িতে আসতেন সুনীল, শক্তি, বিনয়, সুভাষ, সমরেশ বসু, তারাপদ রায়েরা। শৈশব থেকেই এদের সঙ্গে মিশেছি। কলেজস্ট্রিটে বাবার যে বইঘর ছিল সেখানেও ওরা যেতেন। ‘সময়ানুগ’ পত্রিকাতেই আমার প্রথম কবিতা প্রকাশ হয় ১৯৭৮/৭৯ সালে। আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ফ্যান ছিলাম তাই ঐকান্তিক ইচ্ছে ছিল যদি আমার একটা কবিতাও প্রকাশিত হয় কোনও পত্রিকায় সেখানে যেন শক্তির একটা কবিতা অন্তত থাকে। যেমন ইচ্ছা তেমন কাজ, কবিতা তো লিখলাম বাবাকেও দেখালাম; কিন্তু বাবা সে কবিতা প্রকাশই করেন না। অবশেষে ‘একটি কবিতা’ নামের একটা কবিতা বাবা প্রকাশ করলেন ‘সময়ানুগ’-এ। অবাক হয়ে দেখলাম সে সংখ্যায় শক্তির কোনও কবিতাই নেই। খুব হতাশ হলাম। প্রতিবছর জুন মাসে সারাবাংলা কবিসম্মেলন হতো। সেবার প্রেসিডেন্সি কলেজের বেকার হলে ‘প্রবাহ’ পত্রিকার হয়ে সম্মেলনে আমিও ছিলাম। আমার কবিতাও অন্যসব প্রবীণ ও নামী কবির সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল। সুতরাং সেই সম্মেলনে কবিতাও পড়লামেবং উপস্থিত শ্রোতা ও কবিদের প্রভূত প্রশংসা পেলাম। কবিতা লিখে এত ভালোবাসা পাওয়া যায় ভেবে অবাক হলাম। এরপর থেকেই নিয়মিত লেখালিখি শুরু করলাম।


স্বপ্না- আপনি তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন জলপাইগুড়ি থেকেও একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, তাই না?


প্রবালকুমার বসু- হুম ১৯৮০ সালে জলপাইগুড়িতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছিলাম। জলপাইগুড়ির সুন্দর পরিবেশ, চা-বাগান, কাঞ্চনজঙ্ঘা আমার কবিতাকে আরও প্রাণিত করল। ফলে আশির শেষ দিকে নিয়মিত কবিতা তো লিখতামই, সম্পাদনাও শুরু করলাম। পত্রিকার নাম ছিল ‘আলিঙ্গন’, পরে অবশ্য নাম পাল্টে হয় ‘সাতকর্ণী’। আজকাল পত্রিকায় ‘সাতকর্ণী’ নিয়ে একবার কিছু লেখাও বেড়িয়েছিল।


স্বপ্না-   কবিতা দিয়ে পাঠকের কাছে পৌছনো কি সহজ? আপনার কী মনে হয়?


প্রবালকুমার বসু- মোটেই সহজ নয়। দেখো, যেকোনও কবির কবিতাকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার একমাত্র উপায় লেখা দিয়ে তাঁকে স্পর্শ করা। পাঠকের অন্তরে অনুরণন তৈরি করাস্পর্শ না করলে পাঠক মনে রাখবে কেন সেই কবিতা?


স্বপ্না- কবিতায় কারুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন কি প্রাথমিকভাবে? মোট ক’টা কবিতার বই এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে?


প্রবালকুমার বসু- প্রথমেই বলেছি আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার দারুণ ভক্ত ছিলাম। আর শক্তি পারিবারিকভাবে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেনও বটে। আমার প্রথম কবিতার বই ‘তুমিই প্রথম’ (১৯৮৯)-এর ম্যানুস্ক্রিপ্ট শক্তিই দেখে দিয়েছিলেন এবং বলতে বাঁধা নেই অনেক শব্দ বা পঙ্‌ক্তি মানানসই করেও দিয়েছিলেন। বইটি গৌরী ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছিল। পুরস্কারমূল্য ছিল ৫০০০ টাকাএরপরই শক্তি থেকে সচেতনভাবে বেড়িয়ে এসে নিজস্ব ভাষা খোঁজার চেষ্টা শুরু করি। আমার আরও কবিতার বই হল ‘ব্যক্তিগত স্মৃতিস্তম্ভের পাশে’ (১৯৮৭), ‘জন্মবীজ’ (১৯৯৩), ‘যাপনচিত্র’ (১৯৯৮), ‘যেমন করে গাইছে আকাশ’ (২০০২), ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (২০০৭), ‘অধর্ম কথা’ (২০০৯) ইত্যাদি।


স্বপ্না-এখন যে নতুনভাষা বা ভাবনা আসছে তা জরুরী। বাংলা সাহিত্যে নতুন জোয়ারের মতো। আস্তে আস্তে বাংলা কবিতা আন্তর্জাতিকতার। ট্রিপিক্যাল ন্যাকা ন্যাকা মধ্যবিত্ত ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসছে একটা আশাপ্রদ। নতুন প্রজন্মরা বলিষ্ঠ লেখক এদের ভাবনা চিন্তা বেশ প্রগাঢ়। এরা প্রত্যেকেই নিজস্ব জায়গা থেকে লিখে নিজের শৈলী তৈরি করেছে।


স্বপ্ন- যুগবিভাগ কি বাংলা কবিতার বাঁক বদল করেছে?


প্রবালকুমার বসু- উহু মর্ডান-পোস্টমর্ডান এসব ধারনা কবিতা বা গদ্যে বা গদ্যে কোনও ছাপ ফেলে না আদৌ। কোনও কবি লিখতে বসে তার সৃষ্টি মর্ডান বা পোস্ট-মর্ডান অঙ্কে হিসেব না করেই লেখে। কিছু কিছু লোক বা পত্রিকা তাদের এগজিসটেন্স বোঝানোর জন্যে এটা প্রচার করে বেড়ায়। ‘কবিতা ক্যাম্পাস’ একসময় ‘ভাষাবদলের কবিতা’ নাম দিয়ে এমনই কিছু একটা করার চেষ্টা করেছিল। ওরা যে ধরণের ভাষা ব্যবহার করা শুরু করল।  তা চলল না বলাবাহুল্য। ওই নবনির্মিত ভাষার সঙ্গেও কয়দার সঙ্গে বাংলাভাষার ঐতিহ্যের যোগসূত্র ছিল না, তাই তা পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হল না। কিন্তু এঁদের অনেকেই খুব শক্তিমান কবি ছিলেন। শুধু ছবি তৈরিই না, চিত্রকল্পের ঝলকানি দিয়ে নয়, কোনও শব্দে কোনও চিন্তায় পাঠককে একবার ছুঁয়ে দিতে হবে ব্যাস্‌ ; ওটাই মির‍্যাকল, ওটাই কবিতা। আইওয়া থেকে ফিরে সুনীল যা লিখতে শুরু করলেন পাঠক তা সাগ্রহে মেনে নিল।


স্বপ্না-কবিতাকে কেউ কেউ আবেগ ও বুদ্ধির স্ফূরণ মনে করে কবি হিশেবে আপনার মতামত কী?


প্রবালকুমার বসু-  কবিতার কোনও আবেগের জায়গা নেই। আবেগ কবিতাকে নষ্ট করে সুচারু শিল্পে পরিণত হতে দেয় না। হৃদয়, মনন ও মস্তষ্কের মহাসম্মেলনে তিনটি গ্রন্থি যখন যখন এক লয়ে বেজে ওঠে সেটাই হয়ে ওঠে কবিতা।


স্বপ্না- তবে কি বুদ্ধিজীবী এই কাগুজে শব্দটা এখন কবি-সাহিত্যিকদের উপমা হয়ে গেছে?


প্রবালকুমার বসু- বুদ্ধিজীবী অর্থাৎ বুদ্ধি লাগিয়ে জীবিকা। তুমি কী বলতে চাইছ বুঝেছি। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী মানেই যে বুদ্ধিজীবী তা নয়। বরং এঁদেরকে এঁদেরকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য করাটাও আমাদের সমাজের সমস্যা। আমাদের পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে তবু এখনও বাংলা সাহিত্য পড়ে বাংলার ছাত্রছাত্রীরা কবিতা লেখে। সেটার জায়গাটা এখনও সংকীর্ণ হয়ে আছে। বাংলা কবিতা লিখতে গেলেও আন্তর্জাতিকমানের লেখা পড়া উচিৎ।


স্বপ্না- বিষাদ থেকে, অপূর্ণতা থেকে, না পাওয়ার জানালা থেকেই কি কবিতারা উঠে আসে?


প্রবালকুমার বসু- আমার লেখার মূল জায়গা হল ‘সম্পর্ক’। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা থেকে উঠে আসে বিষাদবিষ অথবা আনন্দধারা। ধরো, এই সম্পর্ক আমার সঙ্গে বর্হিজগতের, বা আমার সঙ্গে স্মাজের, বা আমার সঙ্গে আমার বা অন্তরজগতের।


স্বপ্না- নিজের লেখা এমন কোনও কবিতার কথা মনে পড়ছে কি যেটা বিশেষভাবে আপনার কাছে উল্লেখযোগ্য?


প্রবালকুমার বসু- হ্যাঁ, ‘দক্ষিণ আফ্রিকা’ নামের একটা কবিতা লিখেছিলাম নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে। ১৯৮৯ সালে। দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ম্যান্ডেলা এদেশে আসলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে ওই কবিতাটা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল ইংরেজিতে অনুবাদ করে।


স্বপ্না- এখন তো খাতার পাতায় লেখার লোক কমে গেছে। বেশিরভাগ লেখকরা কম্পিউটার মাধ্যমে লেখেন এমনকি প্রিন্টেড ম্যাগের পাশাপাশি ওয়েব ম্যাগাজিন এসে গেছে এবং জনপ্রিয়ও হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামত কী?


প্রবালকুমার বসু- ছাপা বইয়ের জন্য উৎকণ্ঠিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। এখনও বিদেশে নতুন বই বেরোলে ১০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়। ওখানে তো আরও অনেক আগেই কম্পিউটার এসেছিল। টিভি বাড়িতে আসার পরেও কি নাটক বা সিনেমার কদর কমে গেছে?


স্বপ্না-আমি একবার সুনীল’দার (গঙ্গোপাধ্যায়) সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে এমনই একটা প্রশ্ন করেছিলাম। সুনীল’দার উত্তর ছিল উনি চান ছাপা পত্রিকা বন্ধ হোক, কারণ তাতে নাকি গাছেরা বাঁচবে।


প্রবালকুমার বসু- সুনীল’দা জানতেন না এখন আর গাছ থেকে কাগজ তৈরি হয় না, কৃত্রিম উপায়ে কাগজ তৈরি করার উপায় বহুদিন হল আবিষ্কৃত হয়েছে।


স্বপ্না- কৃত্তিবাসের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা যদি বলেন...


প্রবালকুমার বসু- সুনীল’দাকে পারিবারিক সম্পর্কের থেকে যে আগে থেকেই চিনতাম তা তো বলেইছি। কৃত্তিবাসের নবপর্যায় শুরু হয় ৯৮ সাল থেকে। ২০০০ সাল থেকে সুনীলদার সঙ্গে নিয়মিত আদানপ্রদান হত। ওই সময় থেকেই আমি কৃত্তিবাসের ঘরের লোক হয়ে উঠি। একবার কৃত্তিবাসের গল্পসংখ্যার সম্পাদনার ভার সুনীল’দা আমাকে দিয়েছিলেন আর একবার শিল্পীদের লেখালেখি নিয়ে কৃত্তিবাসের একটা সংখ্যা হয়েছিল তার সম্পাদনা আমি ও সুনীল’দা যুগ্মভাবে করেছিলাম এবং সম্পাদকীয় লিখেছিলাম।


স্বপ্না- শুধু কবিতা নয় আপনি তো গল্পও লেখেন। আপনার দুটি গল্পের বইও আছে তাই না?


প্রবালকুমার বসু- আসলে অনেক সময় মনে হয় যা বলতে চাইছি সেটা হয়তো অন্যভাবেও বলা যেতে পারে সেখান থকেই গল্প লেখার প্রয়াস। তবে আমি কখনই গতানুগতিক গল্প লিখতে চাইনি একটু নিরীক্ষামূলক বিশেষতঃ অ্যাবস্টার্ড গল্প লেখার চেষ্টা করেছি। আর খুব অদ্ভুত ব্যাপার, কবিতার বইয়ের প্রকাশক পেতে অনেক চেষ্টা করতে হয় কিন্তু গল্পের বইয়ের প্রকাশক সহজেই পেয়ে গেছি। আমার গল্পগ্রন্থদুটির নাম—‘আমার গল্প আমার সময়’ (পুনশ্চ-২০০৮) এবং ‘গল্পই গল্প’ (কারিগর-২০১১)।


স্বপ্ন- আর কাব্যনাটক? সেও তো প্রচুর লিখেছেন...


প্রবালকুমার বসু- তুমি জানো? বাহ... আমার কাব্যনাট্য চর্চার একটা জায়গা ছিল। বাংলায় প্রবল কাব্যনাট্য প্রযোজনা হয় ১৯৫৭-৫৮ সালে আমার বাবা দেবকুমার বসুর প্রযোজনায়। বাবাই প্রথম বাঙলায় কাব্যনাট্য প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন। নাটকটির নাম ছিল ‘নীলকণ্ঠ’। নাটকের লেখক রাম বসু। পরবর্তীতে ‘গন্দর্ভ’ নামে একটি নাট্য পত্রিকার কাব্যনাটকের উপর একটি সংখ্যা আমার হাতে আসে। আমি টি.এস. এলিয়টের ‘মার্ডার ইন দ্যা ক্যাথিড্রাল’ ও ‘ফ্যামিলি রিইউনিয়ন’ এই কাব্যনাটকদুটি পড়ে ফেলি। এরপর সেসময় বাঙলায় যত কাব্যনাটক লেখা হয়েছিল সেগুলো পড়তে শুরু করি তারপর আধুনিক সাংস্কৃতিক পরিষদ নামে আমাদের যে সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ছিল সেখান থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘একা গেল’ কাব্যনাটকটি প্রযোজনা করি। আমরা গিরিশংকরের একটি কাব্যনাটক প্রযোজনা করেছিলাম। এরপরে এগুলোই আমাকে কাব্যনাটক লেখার প্ররোচনা যোগায়। আমার কাব্যনাট্যসংগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে এই বইমেলায়, যার ভূমিকা লিখছেন শ্রদ্ধেয় আনিসুর জামান। আমার বেশিরভাগ কাব্যনাটকই ‘বহুরুপী’ ও ‘স্যাস’ নাট্যপত্রে প্রকাশিত।


স্বপ্না- আপনি এইসময়ের অন্যতম একজন কবি যিনি প্রচুর দীর্ঘকবিতা লিখেছেন। আপনার দীর্ঘকবিতার বই ‘জন্মবীজ’ বাংলাসাহিত্যে অন্যতম দীর্ঘকবিতার কাব্যগ্রন্থ। দীর্ঘকবিতা সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাই।


প্রবালকুমার বসু- ‘জন্মবীজ’ লিখেছিলাম যখন আমার ২৭-২৮ বছর বয়স। সে বয়সে যা হয়... ইচ্ছে ছিল মহাকাব্য লিখব, সেটা হয়ে উঠল ‘জন্মবীজ’। এই বইটি নিয়ে ক্রমাগত তরুণ কবিদের আগ্রহ এতদিন অরেও আমাকে বিস্মিত করে। ‘জন্মবীজ’-এর তৃতীয় সংস্করণ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। যদি জিজ্ঞেস করো, কেন দীর্ঘকবিতা লিখেছিলাম, তবে বলি, ১৯৭৮ সালে দেবকুমার বসুর সম্পাদনায় প্রথম দীর্ঘকবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাভাষার নাম করা কবিদের সঙ্গে নিজের লেখা জায়গা পাবার আকাঙ্ক্ষায় আমি প্রথম দীর্ঘকবিতা লিখি এবং পিতৃদেব পুত্রস্নেহবশত সেটি প্রকাশও করেন। অন্তত এরকমই আমার ধারণা। কিন্তু ওই সংকলনে আমার কবিতা প্রকাশই আমাকে উজ্জীবিত করে আরও দীর্ঘকবিতা লিখতে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরে আসার পর শক্তি আমাকে বলেন আমার উত্তরবঙ্গে চার বছর থাকার অভিজ্ঞতা আমি যেন এক দীর্ঘকবিতায় ধরে রাখি। লিখেছিলাম। ১৯৮৪ সালে ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছিল। কবিতাটি অনেকদিন পরে ‘কোথা থেকে শুরু করবো’ বইতে স্থান পেয়েছে।

স্বপ্না- স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছরের ইংরেজি কবিতার তর্জমা সম্পাদনা করেছেন আপনি। বইটার নাম ‘সাইন পোস্ট’। অবাঙালি ও প্রবাসী বাঙালি (যারা বাংলা পড়তে পারেন না) পাঠকের কাছে এই বইটি পরম আদৃত। এই বইটি সম্পাদনার ব্যাপারে কিছু বলুন?


প্রবালকুমার বসু- অফিসের কাজে ভারতের নানান জায়গায় আমাকে যেতে হয়। দেখেছি, অনেক প্রবাসী বা অবাঙালি আছেন যারা বাংলা পড়তে না পারলেও বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে খুব আগ্রহী। এদের কথা ভেবেই এই কাজটা করার কথা মাথায় আসে। আমাকে সর্বতভাবে সাহায্য করলেন বর্ণালী রায়। দিল্লীর রূপা প্রকাশনীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন নির্মলকান্তি ভট্টাচার্য। সুনীল’দার উপস্থিতিতে গুলজার দিল্লীতে এই বইয়ের উদ্বোধন করতে এসে বলেছিলেন, “যে আমরা বাংলা কবিতাকে আগে চিনতাম গীতাঞ্জলী দিয়ে, এখন চিনব এই বই দিয়ে।” 

স্বপ্না- কলকাতা আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আপনি। এই প্রথম সাহিত্য-শিল্প-চলচ্চিত্র-নাটক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বিভিন্ন মানুষের সমস্ত লোকেরা একত্রিত হয়ে কিছু চেষ্টা করেছিল...


প্রবালকুমার বসু- শোনো, আমার বরাবরই ইচ্ছে ছিল কবিতা নিয়ে একটা একাডেমি তৈরি করা যেখানে আর্কাইভ থাকবে, লাইব্রেরি থাকবে, সমস্ত কবিতার বইয়ের প্রথম সংস্করণ রক্ষিত হবে, কবিতা পড়ার জায়গা থাকবে। এইরকম একটা ভাবনা ভিতরে ভিতরে যখন কাজ করছিল শিল্পী যোগেন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ হল। জানতে পারলাম তিনিও শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে এরকম কিছু একটা ভাবছিলেন। এরপর দীর্ঘদিন আমাদের মতো বিনিময় চলতে থাকে এবং আমি, যোগেন চৌধুরী ও বর্ণালী রায় এই তিনজন প্রায় একবছরের উপর মতামত আদানপ্রদানের পর এটাকে একটা রূপ দিই তারপর সূনীল’দা, শঙ্খ ঘোষ, গণেশ হালুই, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি বিদগ্ধজনদের আমন্ত্রণ করি। এই প্রয়াস থেকেই ‘কলকাতা ফাউন্ডেশন’-এর জন্ম। আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার এই সংস্থা নির্মাণের জন্যে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন এবং আমরা এই কেন্দ্র নির্মাণের জন্য যাযা করণীয় তা করেছি।


স্বপ্না- শেষ প্রশ্ন, আপনার অণুপ্রেরণায় ‘যাপনচিত্র’ তরুণদের কবিতার বই প্রকাশ করার অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে যেখানে অন্যান্য প্রকাশনী নতুন কবিদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে বই প্রকাশ করছে সেখানে ‘যাপনচিত্র’ তরুণ কবিদের প্রথম বইটি নিজ দায়িত্বে প্রকাশ করবে---এমন সিদ্ধান্ত, এমন ভাবনা কেন এলো?



প্রবালকুমার বসু- নিজে কবিতা লেখার সুবাদে একজন তরুণ কবিকে তার বই প্রকাশের জন্য কী সমস্যার সন্মুখীন হতে হয়, তা আমি বুঝি। বহু প্রকাশক নানা প্রলোভন দেখিয়ে বহু অর্থ আত্মসাৎ করে বই প্রকাশের যে প্রথা তৈরি করেছেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই এ সিদ্ধান্ত। কোনও তরুণ কবি ভালো লিখলে তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশের জন্য তাকে আর ভাবতে হবে না, সে দায়িত্ব ‘যাপনচিত্র’ নেবে।