মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ৩য় বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা

সম্পাদকীয় ১




এবছরের শীত হল শুরু । হিমস্পর্শের এই আবহে ‘ক্ষেপচুরিয়ান’–এর নতুন সংখ্যা । মরশুমি ফুলের মতো এখন চারদিকে অসংখ্য ছোট পত্রিকা ফোটার সময় । হাতে লেখা যুগ থেকে পত্রিকার আধুনিক মুদ্রণ যুগে ক্রম উত্তরণ হয়েছে । বর্তমানে তা পৌঁছেছে আধুনিকতম ইন্টারনেট বা ওয়েব যুগে । ওয়েব ম্যাগাজিন এখন অন্যতম বিনোদন মাধ্যম । হাতের মুঠোয় মোবাইলে যখন তখন দেখে নেওয়া যায় এই পত্রিকাগুলি ।

‘ক্ষেপচুরিয়ান’ এখন প্রায় সম্পূর্ণ পত্রিকা । টক, ঝাল, মিষ্টি নানা স্বাদে পরিপূর্ণ । রসিক পাঠক-পাঠিকাদের মনের খোরাক যোগানের দিকে সবসময়ই সচেষ্ট । বাজারি পত্রিকার থেকে এই পত্রিকার বিশেষত্ব আলাদা । বাণিজ্যিক কাগজের মতো জমাখরচের মাথাব্যথা নেই । তাই পত্রিকার সমস্ত শরীর জুড়ে আছে ভালোবাসার ছোঁয়া । একদঙ্গল হৃদয়ের স্বপ্নিল ভালোবাসা মিশে আছে এই প্রচেষ্টাতে । ‘ক্ষেপচুরিয়ান’–এর এই সংখ্যা হয়ে উঠুক শীতের উষ্ণতা । সোনা রোদের ঝলক ছড়িয়ে পড়ুক অন্তর্জাল দুনিয়ায় । সবাই ভালো থাকুন সবখানে সবসময় ।

একগুচ্ছ কাব্যিক উষ্ণতাসহ ‘ক্ষেপচুরিয়ান’–এর পক্ষে

কবিরুল ইসলাম কঙ্ক

সম্পাদকীয় ২ - মধুরিমা দত্ত

সম্পাদকীয় ২





গত সংখ্যায় কথা হচ্ছিল সার্কাস সাম্রাজ্যে দাপাদাপি নিয়ে। আসুন, রেশ না হারিয়ে বরং এই মাঝ নভেম্বরে সার্কাস ভ্রমণ সেরে আসি। সার্কাস বলতে মনে পড়ল ট্রাপিজ, সার্কাস বলতে মনে পড়ল বাঘ। আমাদের ভারসাম্যহীন শহরে ট্রাপিজ দেখতে আমরা শিখেছি সেই স্কুলবেলা থেকে। শিখেছি কীভাবে অনেক উপর থেকে নীচে দেখতে হয়, কীভাবে কারো ফেলে আসা জায়গায় পৌঁছে যেতে হয় দ্রুত। রঙ বদল দেখতে গিয়ে দেখেছি খাঁচার পাস দিয়ে গড়িয়ে গেছে টিফিনবক্স, বয়ে গেছে রেইনি ডে শেষ পিরিয়ড পর্যন্ত। আমাদের ট্রাপিজের ক্লাস তবু শেষ হয়নি। ক্লাসের পর নিয়ম করে দেখাতে হত অনবদ্য সব জাগলারি। শব্দের সাথে বেঁচে থাকার, কফিনের সাথে পায়রার, পালকের সাথে গিলোটিনের। বাড়ি ফিরে দেখতাম, কীভাবে মাংসের খণ্ড মুখে নিয়ে এগিয়ে আসছে সময়। ভয়ে হাত পা সেঁধিয়ে যেত। কাঁপতে কাঁপতে বুঝতে পারতাম নাকের উপর লাল রঙের মস্করা বসে আছে। চোখের নীচে কুণ্ডলী পাকিয়ে হাঁপাচ্ছে গত জন্মের ইয়ার্কি। মাথার থেকে খসে পড়ছে জাগলারির ক্রাউন। এইভাবে প্রতিরাতে আমাদের জোকার জন্ম ঘটে। রোজ সকালে দেখতাম লক্ষ লক্ষ ক্লাউন পেরিয়ে যাচ্ছে জেব্রা ক্রসিং।


এই সার্কাস সাম্রাজ্যে বলাবাহুল্য কিছু দর্শকও আছে। যারা জাগলারির ক্লাসে লুকিয়ে লিখতাম কবিতা, যারা খাঁচার পাশ দিয়ে পেরোতে পেরোতে কুড়িয়ে নিতাম ছোটবেলা, আর নদীর পাশে গিয়ে, জঙ্গলের কাছে গিয়ে চাইতাম ‘ভালো হোক’। আমরা এই দর্শক জন্ম নিয়ে লিখে যেতে চাইছি সময়, লিখে যেতে চাই আয়না। নভেম্বরের শেষ ব্লগেও তাই টুকে রাখছি পাগলামি। এগিয়ে যাচ্ছি ভোরবেলার দিকে।


ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষে
মধুরিমা দত্ত

নভেলেট - সুবীর সরকার

সোনা পাড়ার হাঁস
সুবীর সরকার


১।

আকাশে মেঘ জমছে। মাসুদ ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো। শান্ত উঠোন। উঠোনময় মায়া। হাঁসেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাল নিকরদীঘি থেকে কিনে আনা ধলা মোরগটা বেশ টুকটুক খুঁটে খাচ্ছে কি যেন। মেঘের ডাক। মেঘের ডাকের নিচে আশ্চর্য

পৃথিবী। মাসুদের মন ভালো হয়ে গেল। মাসুদ আড়মোড়া ভাঙলো। মাসুদ অন্যমনস্ক হয়। তার চোখ কেমন দূরাগত হয়ে ওঠে। আঙিনা পেরিয়ে দূরের ধানমাঠের দিকে হাঁটতে থাকে। এখন সে মাইল মাইল হাঁটবে।শালিক চড়ুই ঘুঘুর ডাক শুনতে শুনতে একসময় কোকিলের ডানাঝাপটে তার ঘোর কাটবে। ভোরপেরনো সকালটা তার খুব প্রিয়।যত রাজ্যের ভাবনার জাল বুনতে বুনতে আশ্চর্য এক খেলাই খেলতে থাকে মাসুদ এইসময়। তার চোখের ভিতর সর ফেলতে থাকে আরো আরো মেদুরতা। আর মেদুরতার বাঁকে বাঁকে কেমন দলা পাকানো কুয়াশার মতো বিষণ্ণতাও। বিষণ্ণতা থেকে কি চাইলেও মুক্তি মেলে মানুষের!এতসব ঘটনাপরম্পরার ভিতর দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরে মাসুদ।গাছের ছায়ায় ছায়ায় তার এই হেঁটে যাওয়াতে প্রথাগত কোন ছন্দ থাকে না যদিও,তবু কেমনধারা ছন্দবদ্ধতায় নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে মাসুদ বাড়ির খোলানে এসে দাঁড়ায়। সে একা একাই হাসে। হেসে ফেলে।এক গ্লাস পানি খায়। এসবের ভিতর কখন যেন ইমামা চা নিয়ে আসে। আকাশে আরো আরো মেঘ জমে। আজ বুঝি রোদ উঠবে না আর!



২।

মাসুদের আজ স্কুল যাওয়া হবে না।মিঠুভাই আর বিউটি বেরিয়ে গেলে মাসুদ আব্বার ঘরে ঢোকে। কিন্তু আব্বা ঘরে নেই।মাঠকোটার দিকে গেছে বোধ হয়। উঠোনে কামলাকিষাণেরা গোল হয়ে বসে নাস্তা সারছে।আম্মা আর ইমামার তদারকীতে।লালন চলে এল বুঝি।গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।মাসুদকে আজ যেতে হবে পাঁচবিবি।সুজন হাজারীর কাছে।ওখান থেকে জয়পুরহাট।লালন সঙ্গে যাবে।মাসুদ বাইরে আসে।আশমানপানে তাকায়।আজ কি বৃষ্টি হবে!গাভীন মেঘ

দেখে যুগপৎ সংশয় ও পুলক জাগে তার।ভারি পোষাক চাপিয়ে প্রস্তুতিও শুরু করে। আর একসময় বেরিয়েও যায়।মোটরযান,পিছনে লালন বসে।পাঁচবিবি যাওয়াটা জয়পুর যাওয়াটা মাসুদের কাছে আর কেবল যাওয়াই থাকে না।উপাদেয় এক ভ্রমণ হয়ে ওঠে।নন্দীগ্রাম বাজার পেরিয়ে মাসুদকে সামান্য থামতে হয়। হঠাৎ চকিত চলে আসা কবিতার লাইন সে টুকে রাখে ডাইরিতে;পাছে হারিয়ে না যায়।মাসুদের মোটরযান এগিয়ে চলে সরু গ্রাম্য পথে।দু’পাশে চিরায়ত নিসর্গ।মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের টুকরোটাকরা।মাসুদের ঠোঁটের ভাঁজে হাসি মাখা।পিছনে বসে থাকা লালন গান ধরে।চটুল সুর।পাগলপারা।বোধহয় মমতাজ।না কি বেবী নাজনিন! এইভাবে একপর্বে মোটরযান ও লালন সমেত মাসুদ ঢুকে পড়ে,তাকে ঢুকে পড়তেই হয় পাঁচবিবি শহরের পেটের ভিতর।বৈদ্যদার বন্ধ দোকানঘরের পাশ দিয়ে ফেরদৌস-এর কম্পুটার সেন্টারের মোড় পেরিয়ে মাসুদ সুজন হাজারীর বাড়ির রাস্তা ধরে।আকাশের মেঘ একচুলও নড়ে না।মেঘ থেকে বৃষ্টিও গড়ায় না।পৃথিবীটা বরং গুমোটের গুমঘরের ভিতর সেঁধিয়ে পড়ে।আকাশের যাবত মেঘকে মাসুদ একপ্রকার

উপেক্ষাই করে।



৩।



‘একটি জলের খনি তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি,চেয়েছিলো

একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!’

(আবুল হাসান)

ফুটফুটে জ্যোৎস্না।চাঁদরাত।মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে এল মাসুদ।আজ সে একা একাই হাঁটলো।অন্যদিন কখনো লালন, কখনো মিঠু,কখনো বা ইমামা সঙ্গী হয় তার।চাঁদের রাত হোক ,আন্ধার রাত হোক এই রাত্রিভ্রমণ মাসুদের আবশ্যিক

যাপনাংশ।শুধু বর্ষা,খুব শীতে বেরোন হয় না।ইমামা বেরোতে দেয় না।মাসুদের যে তীব্র অসুখ আছে।যে বুকের অসুখ বারবার মৃত্যুর খুব কাছে নিয়ে যায় তাকে! চাঁদমাখা শরীর নিয়ে মাসুদ হাঁটতে থাকে।আজ তাকে ভর করেছে আবুল হাসানের কবিতা।অকালপ্রয়াত বরিশালের এই কবি বাড়ি ফিরবার কথা বললেই বলতেন একেবারেই যাবার কথা।আবুল হাসান–এর কবিতা,তাঁর দর্শন,বিষাদ মাসুদের খুব প্রিয়।আরো কিছু প্রিয় কবিদের মতো।কবিতার ভিতর দিয়ে বারবার জীবনেই ফিরতে চায় মাসুদ।টুকরো মেঘের মতো কবিতা জড়িয়ে থাকে।কবিতাই তো আশ্রয় তার। কি এক আকুতি যেন ঘুমঘোরের মতো তাড়িয়ে বেড়ায়।জীবনে তো কিছুই পারে না সে!কিছুই তো করা হল না তেমন।অনন্ত শোক নিয়ে সে বসে থাকে।ব্যর্থতাবোধ নিয়ে সে কেবল হেঁটে যাওয়াটাই পারে।কেউ বোঝে না তাকে।সে কি বাতিল নোটের মতো বাতাসে উড়ে বেড়ানো প্রত্নমানুষ!কিছুই বোঝে না মাসুদ।ভুতগ্রস্থ হয়ে অনন্তের দিকে সে তার যাত্রাবিন্দুটিসহ এগিয়ে যায়।তাকে পীড়িত করে পুরাতন স্মৃতি।ঢাকার উজ্জল কবিতাস্রোতের দিনগুলি।কবিতায় নিবেদিত হবার প্রস্তুতিপর্বের বীজবপন।একমাত্র ইমামাই তার জীবনের টাটকা বাতাস।খোলা জানালা।ইমামা হিলি সীমান্তের মতো উন্মুক্ত তার জীবনে। প্রিয়তম নারী। অনবদ্য বান্ধবী।শান্ত মেয়েটির দু’চোখে খেজুরগাছের নান্দনিক সৌন্দর্য।ইমামার জন্যই তো তার ঢাকা থেকে ফিরে আসা এই কবিতাগ্রাম সোনাপাড়ায়।ইমামা তাকে স্বপ্ন দেখায় আর মাসুদ নির্মাণ করতে থাকে কবিতাগ্রাম সোনাপাড়া।মাসুদকে পথ দেখায় চাঁদআলো।সামনে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে চকিতখরিস,শেয়ালেরা।জ্যোৎস্নায় বাঁশপাতা কাঁপে।শূণ্য চাতালের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মাসুদের মাথায় ভর করে আবারো আবুল হাসান-এর কবিতার পংক্তি,



‘ মা বকুক,বাবা তার বেদনা দেখুক!

অতটুকু চায়নি বালিকা!’



৪।



এক একদিন রাতে মাসুদের ঘুম ভেঙে যায়।অন্ধকার ঘরে সে উঠে বসে।পাশে বাবু।ইমামা।সন্তর্পণে মাসুদ মশারীর বাইরে আসে।দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।নিশুত রাত।উঠোনের পশ্চিম পাকে গোয়ালঘরে গোরুগুলির নড়াচড়া। খসরমসর। লেজ নাড়িয়ে মশা তাড়াবার শব্দ।ঘুমন্ত চরাচরে মিটমিটে আলোর স্ফূরণে রহস্যময়তা জাগে।এই কি জীবন!দিনের পিঠে দিন টপকে যায়। মাসুদের স্মৃতিকাতরতা জাগে। পানির পিপাসা পায়।না পড়া বইগুলির কথা ভাবতে ভাবতে মাসুদ দূরের কাছের সব জনপদ্গুলিকে নিবিড়নৈকট্যে টেনে আনে।তার খুব খালিদ ভাইএর কথা মনে পড়ে। খালিদ থাকে আদিতমারিতে। খালিদ মানেই গল্পের তোড়ে ভেসে আসা আদিতমারির ডোরাকাটা বাঘ।মাসুদ যেন দেখতে পায় ঘোড়াঘাট পরগণার ইতিহাসের ভিতর দৌড়তে থাকা বাদশাহী সেনাসমাবেশ।করতোয়া সেতুতে জড়িয়ে ধরা দোস্তের ম্লান মুখ।সুখের দিনগুলি নূপুরের মতো বাজে।দোস্তরা আসে,চলেও যায়।আসাযাওয়ার ভিতর বারবার জেগে ওঠে মোলান বাজার,তুলসিগঙ্গা নদী,ডুগডুগির হাট।দোস্তকে নিয়ে ঢেকি ও কচুশাক কিনেছিল। ছোট মাছ কিনেছিল।জিলিপি খেতে খেতে গল্পগাছা হয়েছিল। স্মৃতির ভারে ভারাক্রান্ত হতে হতে মাসুদ রাত্রিজাগরণের অভ্যেসটাকেই আয়ত্ব করে ফেলতে থাকে। জীবন নিয়ে,একটা আস্ত রক্তমাংসের জীবন নিয়ে কি করে মানুষ! চলে যায়,ভেসে যায় সব।নিয়তিতাড়িত যাতায়াতে আটকে না গিয়ে মাসুদ নিজেকে সংশয়ের দিকে,ঢালে গড়িয়ে দেয়।রাতপাখি ডেকে ওঠে। খোপরার হাঁসমুরগিও। মাসুদকে ডাকতে থাকে জোড়াপুকুর হেলেঞ্চাঝোঁপ কলাবাগান ইলিয়াসের লালদিঘী। মাসুদ বারান্দা থেকে ঘরে ফেরে। আলো জ্বালায়। আলমারি থেকে বের করে পড়তে শুরু করে মাসুদুল হক এর বই-‘আবার কাৎলাহার’। এইভাবে একসময় মাসুদ আর মাসুদ থাকে না। মাসুদার হয়ে ওঠে।



৫।



জীবনমরণ নিয়ে আলোআন্ধার নিয়ে ভাইবেরাদর নিয়ে বিবিবাচ্চা নিয়ে ময়মুরুব্বি আস্ত এক জীবন যাপন করতে হয় মানুষকে।মাসুদ সাইকেল চেপে কখনো বেড়িয়ে পরে।পথে পথে সাইকেল ছোটে।মাসুদ সারাজীবনজুড়ে কি যেন খুঁজে চলে।তার সবকিছুই সে ভরে দেয় সাদা পাতায়;শব্দে,অক্ষরে।তাড়িত এক দুঃখের মত তার এই প্রশ্নোত্তরহীন খুঁজে চলা।মাসুদ কখনো চলে যায় সাঁওতালপাড়ায়।লাল মাটির ধূলো ওড়া পথে।কখনো মহিপুর হয়ে চলে যায় পাখামেলা ব্রিজের কাছে।এতকিছু দিয়ে এতসব নিয়ে আস্ত একটা জীবন নিজেরই মতোন যাপন করতে চায়।ব্যর্থতাবোধের গ্লানি কচুর পাতের পানির মতো তার মধ্যে স্থির হয়ে থাকে। থাকা না থাকার পরিসীমা মুছে গিয়ে মাসুদ তার জীবনযাপনকে হালকাপলকা কোন বাদ্যযন্ত্রের মতো বাজাতে থাকে।আশমানমাটির মধ্যবর্তী শূন্যতায় ফাঁকা মাঠঘাট গাছপালার সারি নদী পুষ্করিণী বাজারহাট বাড়িটাড়ি যেন সাজানোই থাকে।মাসুদ নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতে গিয়ে এক ধরণের প্রস্তুতিহীন পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়ে পড়ে যেন আর সে তার ভিতরকার সংশয়সংকটজাত অস্বস্তিগুলি থেকে বেরিয়ে আসতে চায় প্রানপণ।অথচ জীবনমরণঘেরা অসুখবিসুখময় দিনকালের ভিতর নেমে গিয়ে মাসুদ তার অসহায়তাকেই যেন দিবালোকের মতো প্রকট করে তুলতে থাকে।সে দিনকালগুলিকে বহুরৈখিক বহুবর্ণ করে তুলতে চাইলেও শেষাবধি তা আর হয়ে ওঠে না।এই ব্যর্থতায় তার ভিতর পুনশ্চ বিষাদ জেগে ওঠে।ঘনিয়ে ওঠা আকাশময় হাড়িয়া ম্যাঘের মতোন।পাখামেলা ব্রিজ থেকে নেমে সে বিড়বিড় করে আওড়ায়-‘আমার হবে না,আমি বুঝে গেছি,আমি সত্যি মূর্খ,আকাঠ’।এত এত পরাজয় নিয়ে এত গ্লানিময় দৈনন্দিন নিয়ে কিভাবে সার্থক করে তুলবে সে তার জীবনযাপন!



৬।



যাবতীয় স্মৃতিরা ফিরে আসতে থাকে।স্মৃতিকুয়াশার ঝাপসায় মাসুদ কেমন সচকিত হয়ে ওঠে। চর ভিতর ডুবে গিয়ে স্মৃতিকে কুকুরে টানা স্লেজগাড়ি মনে হতে পারে; তবুও মাসুদকে স্মৃতিসমগ্রতাকে মান্যতা দিতেই হয়। মাসুদের মনে পড়ে রাজশাহী শহরের কথা।শহীদ ইকবাল রাজু আতাউর সৈকত আরেফিনের কথা। শহীদ ভাইএর ছোট কি অদ্ভুত সব ছবি আঁকে। মনে পড়ে আবহমানের দোস্তের কথা।রাজশাহী শহর।পদ্মাবাঁধ।পদ্মায় নৌকোভ্রমণ । গানে গানে ভরে ওঠা নদীর পানিতে ঢেউ জাগে।সেই সন্ধ্যেরাত, শীত ফুরোন শহরের রাস্তা, সাহেববাজার, সম্রাট স্বপনের টানারিক্সা। জুবেরি ভবনের সামনের মাঠে একা একা হেঁটে যাওয়া।দিনগুলি স্থিরতর হয়।স্থিরতা থেকে চঞ্চলতা জাগে।কবিতার পর কবিতায় বুঁদ হয়ে থাকা মাসুদের।জীবন এমন কেন!সাবানের ফেণায় লেগে থাকা বিজ্ঞাপনবুদবুদ।উৎসবকালীন উন্মাদনা সরে গেলে একটানা বিষাদ।জীবন বুঝি কারবালার প্রান্তর।কোথাও বুঝি মেঘ থাকে।মনকেমনের গায়ে বরফকুচির মতো লেগে থাকা মেঘ। মাসুদ সবসময় কেমন যেন সন্ত্রস্ত থাকে। ভয়ভীতি এড়িয়ে কিভাবে সে নিজেকে মেলে ধরবে। আত্মগত হয়ে উঠতে উঠতে তার খুব ঘুম পায়। মাসুদ স্মৃতিময় হয়ে ওঠাটাকে মান্যতা না দিলেও তার স্মৃতিগুলি দিবালোকের স্পষ্টতায় মাথা তুলে দাঁড়ায়। মাসুদের মনে পড়ে পারিবারিক সব সুখস্মৃতির কথা।সেই জয়পুর পাহাড়পুর মহাস্থানের কথা।ইমামাকে নিয়ে সেই সব স্মৃতি।মহাস্থানে গেলেই করতোয়া অতিক্রম করলেই মাসুদের স্মৃতিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।কতবার খোয়াবনামায় ডুবে থেকেছে সে।মজনু শাহ মুন্সি বরকতুল্লাহ সন্নাসীফকির টেলর সাহেব!কতবার মাসুদকে যেতে হয়েছে পোড়াদহ মেলায়। মাসুদ স্মৃতিতে নিমজ্জিত হতে হতে দু’হাতে তুলে আনতে থাকে জনমুনিষ্, কিসানপাট, খিয়ার অঞ্চলের কৃষিকথার আসর। মাটির ঢেলা ভাঙতে ভাঙতে ইতিহাসের ইতিহাস হয়ে উঠতে চাওয়া দেশকালখণ্ডগুলি কখন কিভাবে যেন শিকড় খোঁজে। দাঁড়াবার জায়গা খোঁজে।এতসব আত্মীকরণ ও প্রকরণের আলিসা থেকে একসময় মাসুদ উড়িয়ে দেয় স্মৃতিমুখর পাখিগুলিকে।



৭।

কবেকার সেই এক বাঘ একা একা চলে এসেছিল বারকান্দি থেকে সোনাপাড়ায়। সে অতিপুরাতন কালের কথা।সেই ডোরাকাটা বাঘের গায়ের বোটকা গন্ধ শুকতে শুকতে ভয়লহরীর মত ত্রাসের মত গ্রামের পর গ্রামে গুজবের বেগে ছড়িয়ে গিয়েছিল। কবেকার শোনা গল্প। মাসুদ তার আব্বার কাছে শুনেছিল। তার আব্বা শুনেছিল তাঁরও আব্বার কাছে। বাঘটি কিংবদন্তির বাঘে রূপান্তরিত হয়েছিল। বাঘটি ঘনকৃষ্ণরাতগুলিতে যথেচ্ছ বিচরণ করলেও বাঘটিকে দেখা যেত না।

সেই অদৃশ্য বাঘের গল্প মাসুদকে নাড়িয়ে দিয়েছিল তুমুল। মাসুদ একধরণের সংক্রমণতায় পীড়িত হতে হতে বেড়ে উঠেছিল। যতদূরেই সে যাক, যেভাবেই যাক; সে হিলি যাক দিনাজপুর যাক নীলফামারী যাক সবখানেই যেন তাকে অনুসরণ করত সেই দূরাগত অদৃশ্য বাঘটি। ইমামাকেও সে শুনিয়েছিল সেই বাঘের গল্প। খুব বাল্যকালে নানাবাড়ি যাবার পথে শীতরাতে গরুর গাড়ির দুলুনির ভিতর কেমন ঘোর লেগে যেত। আম্মার কোলের কাছে ঘেঁষে যেতে যেতে গাড়ির ধোঁয়ায় দুলতে থাকা লন্ঠনপ্রীতি জাগলেও সে কিন্তু চঞ্চলতা থেকে সরে আসতে পারতো না। তাকে অতিকায় সেই বাঘের গায়ের বোটকা গন্ধ আবিষ্ট করে তুলতো। খুব ঘুম পেত তখন মাসুদের। বারকান্দির সেই বাঘ; দেশকাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে তার চলাচল মাসুদ কে সুদুরবর্তী করে দিতে চাইলেও মাসুদ কিন্তু তার মজ্জাগত একাগ্রতায় প্রতিরোধপ্রবণতা নিয়ে কালখণ্ডটাকে বর্তমানেই এনে ফেলতে চায়।এ তার স্বত্বালগ্ন স্বভাবজতা; যা দিয়ে অদৃশ্য সেই বাঘের মিথটিকে ব্যবহার করা যায়। মিথের জালক ভেঙে বারবার কুহককুয়াশাই হয়তো উড়ে আসে। মাসুদ তার অবসাদ নিয়ে বিষাদ নিয়ে চিরনুতন সব জীবনবৃওান্ত বলে যেতে থাকে। বলেই যায়। ভাঙা গলায় স্বরক্ষেপনের ওঠানামায় সে কি তবে অনবদ্য এক জাদুকর হয়ে উঠবে! মাসুদ তার জীবন নিয়ে বারবার তো জীবনযাপনের ছন্দেই ফিরতে চেয়েছিল! মাসুদ কি তার পরাজয়ের পাশে আবারো ডেকে নেবে আব্বার মুখে শোনা বারকান্দির সেই অদৃশ্য বাঘটিকেই।



৮।



আজকাল মাসুদ খুব একাকীত্ব টের পায়। তার ভিতরকার অস্থিরতায় উত্যক্ত হতে হতে সে গাছপালার ছায়ায় ছায়ায় কলাবাগানের ভিতর ময়মুরুব্বির কবরের দিকে নেমে যায়। শ্যাওলাসবুজ কচুপাতার মাথাল মাথায় কখনো হেঁটে যায় বৃষ্টির দুপুরে। তার সঙ্গে লালন থাকে। পোষা কুকুর ভুলুয়া থাকে। কবিতায় কবিতায় ভ্রমণসঙ্গীত লিখতে চায় সে। একাকীত্ব নিয়ে একাকীত্বকে বহন করতে করতে মাসুদ এক একদিন সোনাপাড়ার বৃষ্টি দেখে। বৃষ্টি পান করে। তার হাঁচিকাশি হয়। হাঁচিকাশির পৃথিবীতে নির্জন হতে হতে নির্জনতার কাঁথা জড়িয়ে মাসুদ তার মৃত্যুচেতনার খুব নিকটেই চলে যায়। একাকীত্ব নিয়েই মাসুদ লিখতে থাকে হাটের কবিতা। কখনো ইমামাকে পিছে বেঁধে সে উড়েই চলে হিলির দিকে। মহামান্য এক জীবনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এই যে অপেক্ষাগুলি,যা অপেক্ষারত আসবার; পৌঁছবার তৈরি করে দিতে থাকে। বইপত্র আসে। শব্দের পর শব্দে সেজে ওঠে ভাষাপালকি। একাকীত্ব দিয়েই মাসুদ টের পায় কিভাবে রচিত হয়ে চলেছে পালকিযাত্রার উপাখ্যান। তার খুব খালিদের কাছে যেতে ইচ্ছে করে। ইমামাকে বলেও ফেলে খালিদ ভাইএর আম্মার হাতের বিচিত্র পিঠেপুলি, তেলকই-এর কথা। খালিদ আর সে যেন ঘুরে বেড়াতে থাকে রংপুর লালমণি কুড়িগ্রাম আদিতমারি তিস্তা ঘাঘট স্বর্ণামতীর মায়াবী চালচিত্রের ভিতর। যেমন, ঢাকা যেতে যেতে যমুনা সেতু থেকে সে দেখে ফেলেছিল শীতের বিস্তারিত চরাঞ্চল, তরমুজখেত, চরুয়াদের ঘরবসতি। একাকীত্বভরা জীবন আছে বলেই মাসুদ জীবনটাকে জীবনযাপনের অন্তর্ভুক্ত করতেই চায় যেন অন্ধকারের দেশগাঁয়ে জোনাকিআলোর স্তরবিভক্তির ম্যাজিকছায়া। মৃত্যুশাসিত পল অনুপল জুড়ে দীর্ঘ তাঁতের শাড়ির বিস্তারিতে মাসুদ তার কবিতাকে তার হাটবাজারকে স্থাপিত করতে চায়। ফের আসবার সম্ভাবনাকে জিইয়ে রেখে তার একাকীত্ব দূরে সরে যায়। আর মাসুদ হেঁটে চলে ইদ্গাহ ময়দানের পাশ দিয়ে গন্তব্যহীন গন্তব্যে।



৯।



কোথাও কি যাবার থাকে মানুষের! গাছপালার ভিতর রৌদ্রপ্লাবিত দিগদিগরে নদীর কূলে কূলে বাতাসের প্রবহমানতায় কিছু কি অনুভব করা যায়। মানুষ তার জীবনের ভিতর প্রাত্যহিকতায় দিনকালের রূপান্তরিত হয়ে পড়বার ধারাবাহিকতায় কেমন বিমোহিত হয়। মাসুদ তার অসুখশয্যা থেকে বারবার ফিরে আসে।এই ফিরে আসার ভিতর সে তার বেঁচে থাকাটাকে ভীষণ টের পায়। শীতের রোদ তাকে ইশারায় ডাকলে সে রোদে পিঠ দিয়ে বসে পড়ে। এ যেন ভীষণ পুনরুত্থান। আশ্চর্য এই ফিরে আসার ভিতর দিয়ে মাসুদ আবহমানের এক জীবনযাপনকে মেঘনদীভাসানগানের সারিজারিভাটিয়ালির গানে গানে যেন বড় গাঙে দুলে দুলে এগিয়ে চলা কোষাডিঙিনৌকো; যার ভিতর বাদ্য বাজে নাচ হয়, নাচবাদ্যের পৃথিবীতে যেন নেমে আসেন হাসন রাজা। মাসুদের মনে পড়ে কুষ্ঠিয়ার কথা। কুমারখালির লালনের মাজারের কথা। কবি তানজিন তামান্নার কবিতার কথা। মানুষের যাওয়াআসা দিয়ে হাঁটাচলা দিয়ে আস্ত এক জনপদের যাপনকেই বুঝি এঁকে ফেলা যায়। বারবার থিতু হতে চেয়েও পারে না মাসুদ।তার মনে হয় কবিজীবন আদতে অভিশাপের জীবন।তার মনে হয়, সে যেন কাঁধে পাখি নিয়ে হেঁটেই চলেছে। কোথাও যাবার থাকে না, গন্তব্যহীনতার সুত্র খুঁজতে গিয়ে মাসুদ সামান্য হোঁচট খায়। সে বাল্যকাল থেকে নানাবাড়ি থেকে সোনাপাড়ার মাঠঘাট থেকে পুকুরের খুব গহীনে ডুব দিয়ে মহার্ঘ সব চিরাগবাতিই যেন তুলে নিয়ে আসে। খুঁজতে খুঁজতে তাকে হাতে তুলে নিতে হয় ইলিয়াসের ‘দোজখের ওম’, আবুল কালামের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ কিংবা জাকির তালুকদারের ‘কুরসিনামা’। কোথাও যাবার থাকে না মানুষের। কেবল ঘুরে ঘুরে আসে মহরমের তাজিয়া। হায় হাসান হায় হোসেনের আহাজারি। মাসুদ কোথাও যেতে চায়। হাড়হিম শীতসন্ধ্যের দিকে তার চোখ মেদুর হয়ে ওঠে। সে তার জীবনযাপনের অন্তহীনতায় মাঘনিশীথের কোকিলের মতো দিগভ্রান্ত হতে হতে খড়ের চালাঘর দিয়ে সাজানো গ্রাম্যদৃশ্যের নিস্তরঙ্গতায় আত্মগোপনই করে ফেলে। অনেকানেক নদীর পানির ছলাৎছলে যেন

ভাসিয়ে দেয়া কলাপাতার নৌকো। কোথাও যাবার থাকে না মানুষের এটা যেমন ঠিক তেমনি ফ্রেমের বাইরে আসা জীবনের পরতে পরতে কিভাবে হেঁটে যেতে থাকে দূর চরাঞ্চলের চরুয়া সব মানুষেরা।




১০।




কত কথাই তো বলতে হয় মাসুদকে।কথা বলতে বলতে সে বুঝি এক কথোয়ালই হয়ে ওঠে। কথার রকমফেরে বাঁকবদলে পালটে পালটে যাওয়া সবকিছু। মাসুদের মনে পড়ে সোনালি আপার কথা। সোনালি বেগম। দূরদেশের হাওয়ায় বুঝি ভেসে যায় সোনালি আপার কবিতা। হাণ্টিং ট্রিপ। কথা বলবার প্রস্তুতি না থাকলেও কথারা অন্তর্জগত থেকে হাউই-এর মত উড়ে আসে। মাসুদের খুব স্বজনসুজনদের কথা মনে পড়ে। কথার পিঠে কথা সাজালেও কথার কোন ভাষ্যপাঠ হয় না জেনেও গম্ভীর মেঘের সঞ্চরণশীলতায় সে কেবল পীড়িত হয়ে ওঠে। আত্মরক্ষা করতে চায়। জীবনের সকল অবসন্নতায় গ্লানিময়তায় তীব্র আকুলতায় মাসুদ তার জীবনের অস্তিত্বকে অস্তিত্বহীনতার প্রশ্নোত্তরপর্বের ঢালে আলগোছে টেনে নিয়ে আসে। মহামহিম এক জীবনকে ইতিহাসেরও ইতিহাস হয়ে ওঠার বাস্তবতাটাকেই সামনে এনে ফেললে মাসুদের আর কিছুই করবার থাকে না। সে কেবল তার কবিসত্তায় বহুকালের তীব্র সেই তাগিদ আর আলোড়নটুকু টের পায়; যা ধ্বনিময় সোনাটার মতো গমগম করে ওঠে।



১১।



মাসুদ তার জীবনের ভিতরকার সকল সংশয় সংকট নিয়ে তার কবিতা তার সৃষ্টিকর্ম বইপত্তর যাপন নিয়েই তিরতির কাঁপতে থাকা নদীপুস্করিণীর পানির স্বচ্ছতায় আশ্চর্যময় এক জীবনকেই যেন দেখতে পায়! সে তার স্মৃতিস্বত্বায় নবীকৃত খণ্ডবিখন্ডকে জড়ো করতে করতে রোদমেঘবৃষ্টির দিনগুলির ভিতর বিমর্ষতার ফ্রেমে যেন আটকেই দিতে থাকে সব। তার ব্যাকুলতা কি সে নিজে টের পায়! না কি আকুল হয়ে খুঁজতে শুরু করে জীবনের হর্ষউল্লাসবেদনার ধারাবাহিক নিমগ্নতাকে। জীবনের দিকে নিক্ষিপ্ত প্রশ্নগুলিকে ফিরিয়ে আনবার আপ্রাণ প্রয়াসটুকুন জারি রেখেও মাসুদ আলোআন্ধারময় এক নতুন রূপকথাই বুঝি লিখে ফেলে।নতুন কবিতার দিকে এ এক নতুন জার্নি। মাসুদ দুপুরের রৌদ্রে এসে দাঁড়ায়। পুরনো সব চিঠির স্তূপে মুখ গুঁজে বসে পড়ে।কতো কতো চিঠি। মূহুর্ত। জীবনের গল্পগুলি ধারাবর্ষণের মতো ঝরে পড়তে থাকে।উঠোনের হাঁসগুলি পাকঘর গোহালিয়া মহিষধোয়া পুকুর জুম্মাঘর ফুফুনানীর হেঁটে যাওয়া ; অন্তহীন অন্তহীনতায় এগোতে থাকলেও মাসুদ দু’চোখে যেন গভীরতা তৈরি করে ফেলে। তার প্রিয় পাখিগুলি তাকে ঘিরে ধরে। তার চোখে আম্মার বহুবর্ণ শাড়ির প্রান্ত দুলে ওঠে। লালন মিঠু মেহেদি উঠোনের দিকে ছায়ার পাখির মতো এগোয়। ইমামার হাসির মৃদুশব্দে পরিবেশে প্রবীণত্ব এসে পড়ে। মাসুদ তার জীবনকে নতুনভাবে সজ্জিত করবার প্রয়াসে উঠে বসে। তার ভিতর থেকে কবরখানার হাহাকারমাখা বাতাসের মতো শীতল শ্বাস বেরিয়ে এলে জীবনের সদ্যরচিত সংজ্ঞাটিকে মাসুদের মতো করে মাসুদ অনুমোদন করে। এইভাবে তার কবিস্বত্বা সংশয় সংকট অতিক্রমণ করতে থাকে।




১২।



আলোঅন্ধকারের ভিতর বসে থাকতে থাকতে মাসুদ একসময় বিনধারা সরাইলের দিকে চলে যাবার কথা ভাবে। তার ভাবনারা স্থির থাকতে পারে না। তখন মাসুদকে তো আর অগ্রপশ্চাৎ ভাবলে চলে না; তাকে ভরতপাখির মতো নিশিবকের মতো চঞ্চল হতে হয়। একপর্বে সে পাঁচগাছির দিকে চলে যাবার কথা ভাবে। এত কিছুর রকমফেরে দিকভ্রান্তির ভিড়ে মাসুদকে সমাগত দুঃখরাশির ওপর খরবায়ুবেগে ছুটেই আসতে হয়। সে তার অসুখবিসুখ ভুলতে পারে না। বড় অসুখের পর, অসুখমুক্তির পর তাকে সিলেট যাবার কথা ভাবতে হয়। রংপুর বেতার থেকে প্রচারিত তার গানের সুরে কথায় কান পাততে হয়। সে সকল প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিকে সবলে আঁকড়ে ধরতে চায়। শালিকের নরম হলুদ পা, বকের শুভ্রতায় মৃত্যুময় এক জীবনের হাওড়ে কি তবে ডুবে মরতে হবে তাকে! না কি মৎসশিকারী পানকৌড়ির উচ্ছাসের অনুবাদকর্মে নিজেকে নিয়োজিত করবার প্রাণান্তকর প্রয়াসে ঘনায়মান দিনের অবসাদক্ষণ তার জন্য বিশেষ কিছু একটা হয়ে ওঠে। এইরকমভাবে মাসুদ তার পরিক্রমণটাকে পরিভ্রমণের সাথে যুক্ত করে দিলে ফকিরের আলখাল্লা নিমকাঠের এস্রাজ মুশকিল আসানের লম্ফ হয়ে কেমনধারা মুক্তির স্বাদ বয়ে আনে। মাসুদের চোখে আজন্মের বিষাদ লেপ্টে থাকে। প্রশ্নে প্রশ্নে নিজেকে বিক্ষত করেও সে আর্তি ও বিপন্নতা থেকে কিছুতেই রেহাই পায় না। জীবন বুঝি তাকে আর অবসরই দেবে না! স্বপ্নে স্বপ্নে উড়ালপঙ্খির উড়ে চলাটাকে ভীষণরকম বালির গর্তের ঘূর্ণীতে আটকে গিয়েও সরলবক্ররেখাময় পথঘাটকে টেনে নিতে থাকে বাওড়ের হা হা শূণ্যতায়। মাসুদ তার কবিস্বত্বায় কিংবা কবিস্বত্বাটিকে দার্শনিকতায় জড়িয়ে ফেললে তার নান্দনিক বোধের বিচ্ছুরণে ভাঙা ভাঙা বাক্যের ফাঁকে গুঁজে দেওয়া শব্দরাশির মতো ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া নিয়েই আজন্মের স্বপ্নবৃত্তান্ত দিয়েই যেন ধাঁধাগোলকে ঘুরতে থাকে। মাসুদ নিজের সবকিছু দিয়ে সংশয়ী হয়ে পড়লে তার কপালের ভাঁজগুলি গভীর হয়ে উঠলে সে চিরদিনের সব চিরদিনগুলিকেই শ্বাসপ্রস্বাস দিয়ে নিজের ভিতর টেনে আনতে থাকলে হাজার পাখি, মাসুদের প্রিয় পাখিরা উড়ে যায় প্রান্ত ও প্রান্তিকের দিকে।



১৩।



ধানের দেশ। খালের দেশ। ফড়িং ওড়ে। ফুলের গুচ্ছে গুচ্ছ ভ্রমর। কত বৃক্ষ। কত পাখি। দেশ আদতে কি? দেশতো একটা বাড়ি। নদীজলবাহিত কোন আখ্যানের ভিতর চুপ করে বসে থাকা। গভীর ঘুমের মধ্যে স্বপ্নেরা ঝাঁপায়। সোনার রোদে ভেসে যাওয়া চরাচর। আর্ট গ্যালারীর প্রেক্ষিতটা থাকলে দেশ যেন দেশকালের রূপ ধরে ফিরে ফিরে আসে। নিকরদীঘি থেকে নিয়ে আসা ধলা মুরগিটার একা একা দাঁড়িয়ে থাকবার দৃশ্য বিষ্মরণ নিয়ে আসে। অথচ আকাশের নীল ছড়ানোটাকে মায়াময় মনে করলেও সোনাপাড়া কখন যেন পুরাকল্প বয়ে আনে প্রত্নপৃথিবীর সব রঙ রস গন্ধ মুছে ফেলে। তখন গ্রাম্য পথে কবিরাজী ঔষধবিক্রেতা যায়। মুর্শিদী গানের দল ঘোরে। মিসকিনেরা আসে। হাজিসাহেবের অস্তিত্ব অনস্তিত্বকে ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে হাজিসাহেবের খড়মের শব্দকম্পনটুকু। শিকারফেরত সাঁওতালপুরুষ তার পেশীময় শরীর নিয়ে গর্বিত হয়ে পড়ে। কৃষিবউ ধান ঝাড়ে। কুলোর বাতাস দিয়ে ঘনায়মান সন্ধ্যেটুকুন যেন সাজিয়ে রাখা হয়। কবেকার, কতকালের সুখটুকুন ধানের বুকে জমে ওঠা দুধের আহ্লাদে চিরদিনের ধানের দেশের মায়াময়তায় হামলে পড়ে। শীতশুরুর দিনগুলি থেকে রওনা হয় কুয়াশারা। হিমে শিশিরে কার্তিকের মাঠ ভিজে গেলে করুণ গানের মতো কোন বৃষ্টিদিন এসে পাখিদের পালক খসে পড়া উঠোনের কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে। রাত্রির রহস্যে শেয়ালের ডাক নতুন বাছুরের ক্ষুরের সচলতাকে উস্কে দিতে চেয়েও কিন্তু জিনপরিদের নিজস্ব দিনদুনিয়ায় ভুলক্রমে এসে পড়া চিরকালিন সব মানুষের জমায়েত যেন হাওড়ের ডাক শুনতে পায়। এইভাবে ত্রাস জাগে। পরিত্রানহীন ত্রাস এসে তছনছ করে দেয় সবকিছু। নৈশভ্রমণকালে বেশ দেখে ফেলা যায় নৈশ বাদুড়। পেঁচার চোখের ধাতবতা। তক্ষকের শিস। করতোয়ার রেলপুল পেরোতে থাকে রাতের মেল। অনেক অনেক যাপন পেরিয়ে ধানের দেশে বেঁচে থাকতে থাকতে বেঁচে থাকাটা আদতে একধরনের অভ্যেস হয়ে যায়। উদ্দেশ্যহীন বেঁচে থাকাটাই তখন মুখ্য। বেঁচে থাকবার ভিতর আরো আরো বেঁচে থাকা। খালের দিকে নদীর দিকে খেতের দিকে তখন কেবলই যেন বেঁচে থাকবার আকুলতার তীব্রতা।



১৪।



পাখি এসে ফিরে যায়,ভিজে উঠোনে। এক একদিন খুব উড়তে ইচ্ছে করে মাসুদের। তার খুব আলোয় থাকতে,ভালোয় থাকতে ইচ্ছে করে। সে তার কবিজীবনকে পাখিশাবকের মতো লালন করে চলে। সে কি চূড়ান্ত কোন প্রস্তুতি নিয়েই সাদামাটা এক জীবনের চালচিত্র বুনতে বুনতে চলে যাবে নদীপার্শ্বের জনপদগুলিতে! সে কি ঢেঁকিছাটা চালের ভাত খেতে খেতে অশ্রুসজল করে তুলবে নিজেকে!কবিতার শব্দে শব্দে তার যাবত দার্শনিক সঙ্গ অনুষঙ্গ দিয়ে সে চিরদিনের গানগুলি নাচগুলি দিয়ে ভরিয়ে তুলবে তার খোলান। ফসলের মাঠে মাঠে তার অন্তহীন হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য অতিকায়ত্বাকারে মূর্ত হয়ে উঠলেও সে কিন্তু একধরণের বিমূর্ততাই এনে ফেলতে চায় তার বোধের মহাজগতে। যেখানে মরণবাঁচন নিয়ে সমযোগে বেঁচে থাকাটাকে উদযাপিত করা হয় চিৎকারসমগ্রের অসামান্য কোরাসে। দর্শনকে ভেঙে ভেঙে অর্থ পালটে দিয়ে দর্শনের ভিন্নমাত্রায় বুঝি দার্শনিক তত্ত্বজট ছাড়াতে থাকে। তার চোখের তারা চকচক করে ওঠে। শীতবর্ষা অতিক্রম করতে করতে বেঁচে থাকবার বৃও কি সম্পূর্ণ করা যায়! আসলে মানুষের মৃত্যু নেই। মরণবীজ ফেটে শিমুলতুলোর মতো নতুন নতুন জন্ম এসে ধাক্কা মারে। তখন ইতিহাসটাকে পরিসর দিতে হয়। শূন্যতাকে মান্যতা দিতে হয়। ভূতগ্রস্থের মতো বসে থাকা আর হয় না মাসুদের। সে বেরিয়ে পরে। গাছপালার ছায়ায় মায়ায় জড়িয়ে যেতে যেতে মাসুদ কি কোন মহাশুণ্যতাকে নিবিড়ভাবে টেনে আনতে থাকে পটভুমির ভিতর! সে আশ্চর্য পুলক বোধ করে। পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতে থাকে আকাশভরা আলো। আলোয় ভাসতে ভাসতে জীবনযাপনের কোন সংজ্ঞাকে সে সংজ্ঞায়িত করতে চায় তা বোঝা না গেলেও সে তার একাগ্রতা দিয়ে প্লাবনকাল বহন করে। জানা অজানা দিয়ে সে খুঁজতে থাকে তার অস্তিত্ব,মানুষের বেঁচে থাকবার উদ্দেশ্যটিকেই। ভ্রমভ্রান্তির ভিতর কেমন ধন্ধ ঘনিয়ে আসে। আশ্চর্য এক শীত বোধ করতে থাকে মাসুদ ঘনায়মান দিনকালগুলির ভিতর।



১৫।



‘অসম্ভব কিছু ঘটছে,যার চারদিকে বসে

আমরা দেখছি বিড়ালনৃত্য,প্রেতের মস্করা’

(ওবায়েদ আকাশ)





মাসুদ ঘরে ফেরে। কবিতা লেখার কথা ভাবে। কবিতা পড়ার কথা ভাবে। মাথায় ঘুণপোকা নিয়ে সে একা একাই হাসে। তার হাসির ভিতর অনুপ্রবিষ্ট হয় ক্ষয় ও বিষাদ। জীবনের গূঢ় কোন বেদনাবোধকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেও বেদনার বোধ

আর যায় না। জীবনের অর্থহীনতার ভারে সে কিঞ্চিত ক্লান্তি বোধ করে। ক্লান্তি কাটাতে হাই তুলতে হয়। লালন এসে, মিঠু ভাই এসে মাঠঘাটের কথা শোনায়। পরিপার্শ্ব নিয়ে গড়ে ওঠা দেশগাঁয়ের গল্প শোনায়। ক্লান্তিবোধ কাটাতে চাইলেও পরিপার্শ্বের সংকটগুলি মাথার কোষে ঘাই মারতে থাকে। সে ইমামাকে ডেকে আনে। ইমামার চোখের স্নিগ্ধতা পান করে। বাইরের নিসর্গে সব কিছুর অবস্থিতি। বৃক্ষ গাইবলদ হাঁসমোরগ দৈনন্দিন হয়ে পরম্পরাগত হয়েই জাগরুক থাকে এই সারসত্যের ভিতর মাসুদ তার জীবন ও যাপনকে কবিতার স্রোতে মিশিয়ে দেয়। তার ক্রোধ তার হর্ষ তাকে সীমা পরিসীমার একটা বোধে আত্মস্থ করে তোলে। এইভাবে আত্মগত হওয়াটাকে সে বেশ উপভোগ্য করে তুলতে চাইলেও তার চূড়ান্ত

কোন মুক্তি মেলে না। সে তার দর্শনবোধের পৃথিবীতে ডুবুরির দক্ষতায় সঞ্চরণশীল থাকলেও ঘুমের আর্তি নিয়ে বারবার তার বিপন্ন হয়ে পড়া। সে তার ব্যর্থতাবোধের কথা কখনো বিস্মৃত হয় না। কিছু হতে চাইলেও আদতে কি আর কিছু হওয়া হয়ে ওঠে! এইসকল দার্শনিক প্রশ্নের তোড়ে মাসুদ ভেসে যায়, ভেসে যেতে থাকে। সে বিস্মরণ থেকে ফিরেও আসে। জীবন থেকে সরে থাকা আর হয় না। অসুখবিসুখ সমেত গোরআজাবসমেত সে বরাবরই ঢুকে পড়ে আস্ত গোটা এক জীবনের জায়মানতায়। যেখানে প্রিয় পাখিরা তাকে সঙ্গ দেয়। পুকুরের হাঁসেরা তাকে নিঃসঙ্গ করে দিলেও মাসুদ সমগ্র স্বত্বা দিয়ে কেন যেন বুঝিবা জীবনেই ফিরতে থাকে।



১৬।


আবার মেঘ জমছে আকাশে। আবার মেঘ ডাকছে আকাশে। মেঘনদীপানিবাতাসের বেষ্টনে আটকে গিয়েও তীব্র প্রতিরোধ দিয়ে মাসুদ,মানে মাসুদার তাকে প্রতিহত করে। তার বেদনাবোধ জাগে। সে বাহিরউঠোনে এসে দাঁড়ায়। সদ্য জাগা পৃথিবীতে ভোরের স্নিগ্ধতায় মাসুদ জীবনকে, জীবনযাপনকে নতুনভাবে ফিরে দেখতে থাকে। মৃত্যুময়তার বোধ যা আঁঠার মতো আটকে থাকে তার সঙ্গে সে কি তা থেকে মুক্ত হতে পারবে! সকল অসুখ ডিঙিয়ে জীবনের বহমানতায় প্লুত হয়ে উঠবে এবার! মানুষ বেঁচেবর্তে থাকে ,মানুষকে বেঁচেবর্তে থাকতে হয়; প্রজন্মতাড়িত জনমানুষের চিরকালীনতায় মানুষ বারবার জীবনকে চিরজীবিত করে তুলতে থাকে। মাসুদ কি সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায়! না কি জীবনের ভরকেন্দ্রে শেষ পর্যন্ত জীবনমরণমায়া উন্মোচনের চিরদিনের এক খেলায় পর্যবসিত করে দিয়ে তাকে চলে যেতে হয় আবারো মাঠের শূন্যতায়! ফসলহীন রিক্ত মাঠে হেঁটে যেতে যেতে সে ভরা ফসলের আসন্ন সম্ভাবনায় উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। জীবন তার কাছে তখন অনন্তের এক গান। সম্ভাবনার অঢেল প্রাচুর্যে মোহমায়ায় মাসুদ নিজের সমগ্র স্বত্বাকে বিনির্মিত করে তুলতে থাকে। চোখের মণিতে বিস্ময় মাখিয়ে সে দেখে বকের ডানার ছন্দময়তা, ভরত পাখির ঝাঁকের উড়ে চলা। জীবন তো দিকভ্রান্তি দিয়ে ভরা কোন দানাফসলের দেশ যার আবশ্যিক অংশ হয়ে জেগে থাকে স্বপ্নের মতো, ছায়াছবির মতো এক সোনাপাড়া। মাসুদ জীবনেই ফেরে। মেঘলা আকাশের নিচে অগণন নদীনালার খালবিলের পাখপাখালির এক দেশে সে ঘুরে বেড়াতে থাকে অন্তহীন জীবনের খোঁজে। শাপলাশালুকের খোঁজে। শিউলিবকুলের গন্ধে সে ভরিয়ে তোলে নিজেকে। সোনাপাড়ায় আলো জ্বলে নিশিরাতে। সোনাপাড়া জেগে থাকে। জেগে থাকাটা নিয়তি। বেঁচে থাকতে থাকতে মাসুদ একসময় বেঁচে থাকাটাকেই চিরকালীন করে তোলে। তার দিকে তখন এগিয়ে যায় লালন ভাই,বংশীধ্বনি ও সোনাপাড়ার হাঁস।

দীর্ঘ কবিতা - পীযূষকান্তি বিশ্বাস

দম
পীযূষকান্তি বিশ্বাস



অ্যাংকলেট বুট্ পায়ে জমেছিল এতদিন যতটা মার্চ
হাঁটছি আর হাঁটছি,
হয়না শেষ তবু লেফট রাইট লেফট
পরিবর্তনের হাওয়া নাকি আনবে স্বাধীনতা,
হয়ত আনবে একদিন
আমাদের তবু
ঘড়ির কাটার মত
শুধু ঘুরে যাওয়া যান্ত্রিক
দুপায়ে জমানো শেষ হয়ে গেলে মার্চ
আবার ভরে দেওয়া হবে ‘দম’...

তাকাই সম্মুখে বিস্তর প্রান্তর
সময়ের সমতলে দ্বিমাত্রিক ওরা
কালের ঊর্ধে ওরা ওঠায়নি মাথা
আরো দূরে , বহুদূরে মহাকাশ পারে
ওদের সহোদর বুঝি এমনি আগ্নেয়গিরি
ধোয়া ভরা আগুনে লাভা উগরায়...
আল্পসের পাদদেশে জীউসের সিংহদ্বার
ম্যাসিডোনিয়ার রণভূমি পার হয়ে
উঠে আসে আলেকজ্যান্ডার
উচু শির, ঋজু দেহ, লৌহকঠিন পদযুগলে
ধেয়ে আসে ওরা লেফট রাইট লেফট
র‍্যাংক ও ফাইলে ।

শতদ্রু দাঁডিয়ে দেখে, দুচোখ ডুবিয়ে দেখে সিন্ধু খরস্রোতা
রোদ-ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে, ওদের ক্লান্ত দুপায়ের হাঁটা
করেছে মার্চ ওরা ভরা বর্ষার রণভূমি জুড়ে
পৃথিবীর জল কাদা লেগেছে শরীরে

কখনও বা ওদের ঘোড়ার খুরে ওড়া ধুলোর মেঘে
ঢেকে যায় দু চোখে ঘুমিয়ে নেবার স্বপ্ন,
স্বপ্ন - গঙ্গার দুপারে গড়ে ওঠা সামাজিক জীবন
গঙ্গার ঘাটে ঘাটে তারা গল্প শোনায়
এলোমেলো আকাবাঁকা বোকা ঢেউ গুলি
স্যালুট করে ফিরে যায় ইতিহাস ঘুমে

স্বপ্নেরা ফিরে আসে, বাহিনী সারি সারি
পানিপথ সেজেছে আজ দেখ কুচকাওয়াজে,
চল চল চল , উর্ধগগণে সহশ্র মাদল বাজে
গগন ভেদী রনভেরী মেঘসম গর্জায়
সারিসারি অশ্বারোহী আধুনিক রণসজ্জায়
আধুনিক আরো, অত্যাধুনিক, আর্টিলারী ব্যাটেলিয়ন,
সমরসজ্জায় সৈন্যবাহিনী
তরাইন ধুয়ে বর্ষা এনেছে দুজোড়া বিশ্বযুদ্ধের কাহিনী
যুদ্ধ দেখেছে যুদ্ধ প্যারেড, যুদ্ধ পারমানবিক
মানুষ দেখেছে প্রানীদের ছোটা, প্রানপণে চারিদিক
দিকবিদিক শূন্য করে হতভম্ভ হাহাকার
সৃষ্টির বুকে আগুন জ্বালিয়ে পদাতিক অহংকার
হাঁটছি তবু পৃথিবীর বুকে মহাকাশ পথে মার্চ
সামরিক জীবন সামাজিক জীবনে
কিভাবে মিলাবে পা ?

চন্দ্রপৃষ্ঠে হাঁটছি আমরা , পায়ে জমে আছে পথ
দিবারাত্রি প্রতি শতাব্দী গড়ে তুলি জনপদ
আঁধারের বুকে প্রাণিদের সাথে প্রাণিদের সংগ্রাম
প্রতিটা শতাব্দী যোগ্যতমের উদবর্তনে হাঁটলাম ।

প্রতিটা শতাব্দী তবুও খুঁজে যায়, মানুষের বিবর্তন
স্বাধীন জীবন , সামাজিক জীবন , মানুষের স্বাধীনতার,
একদিন শতাব্দীও শেষ হয়ে যায়
একদিন ডুবে যায় নক্ষত্রও ,
হয়ত একদিন
স্বাধীনতা ফিরে পাবে সে কাল - ইতিহাস
নক্ষত্রের মৃত্যুর সাথে হয়ত থেমে যাবে মার্চও একদিন
পথ শেষ হবে কোন এক ব্লাকহোলের প্রান্তে ।
ব্লাকহোলও হিম হয়ে যায়...
হয়ত বা আবার কোনদিন
উল্টে হিমের চাদর
নতুন ব্রম্মান্ড ফের জ্বলাবে নব উষা ভোর
নতুন সময়, নতুন টাইম, নতুন এক ডেট
ঘড়ির কাঁটা আবার শব্দ করে চলবে
লেফট রাইট লেফট,
লেফট রাইট লেফট ।

গুচ্ছ কবিতা - গোলাম মোশের্দ চন্দন

গুচ্ছ কবিতা
গোলাম মোশের্দ চন্দন




অন্ধকারের বাতি

প্রতিনিয়তই ছুটছি এক অন্ধকার থেকে আরেক অন্ধকারে
কখনও মেঘ কখনও বৃষ্টি হয়ে
আলোহীনতার নিগূঢ়তায় ঝাঁপ দিচ্ছি অন্ধকার গহ্বরে
হাঁটছি যান্ত্রিক সভ্যতার আগুন বুকে নিয়ে
অতিমুনাফার লোভে নিঃস্ব হয়েছি নিজের ভুলে
আজ সুদাসলসহ সব গেল চলে, শ্রাবন বৃষ্টির ঢলে
এখন আমি বেঁচে আছি তুমিহীন তোমারই স্থলে


সুইসাইড নোট


বিকেলে তোমার ঘরে ঢুকতেই পদার্গুলো
বন্ধ হয়ে যেত নিজেই নিজে
আমরা লাল নীল আর সবুজ বাতি জ্বালাতাম
সন্ধ্যার ঠিক আগেই নীরব কোলাহলে
কখন যে রাত এসে যেত প্রস্থানের টেরই পেতাম না
এখন ভাবলে বিমর্ষ হয়ে ফিরে যাই বার বার
ফিরে ফিরে যাই, না চাইলেও যাই
এমনই যাওয়া আশার ভারে এক আমি থেকে
আরেক আমিতে আমার রূপান্তর ঘটে ।
আর তুমি ঘটনাবিহীন নিদর্য় ঘটনার জন্ম দাও
বারংবার আমি নীহত হই নিজেই নিজের আদালতে
এভাবেই খুনি হয়ে উঠি নিজেই নিজের


বৈকুণ্ঠ পাখি হবো ভোরের


মৃত্যুকে পূণমুর্দ্রণ করে হেঁটে যাবো নূতন জন্মের ঘরে
আবার জন্ম নিয়ে জ্যোৎস্নার বাকলে বসে ভুলে যাবো
পুরনো জন্মের দাগ । ইচ্ছের দেয়ালটাকে বানির্স দিবো
স্বপ্নবিভুর কর্পূরে । জানি আমার পৃথিবীটা সেদিন
ঝর্ণাজলের উৎসবে তোমাকে স্নান করাবে মোহময় আবেশে ।
আমরা সেদিন মোহনার অতল গহ্বরে একাকার হয়ে
উৎসবে উৎসবে বৈকুণ্ঠ পাখি হবো ভোরের ।

গুচ্ছ কবিতা - হাসনাত শোয়েব

গুচ্ছ কবিতা
হাসনাত শোয়েব



চকলেট ফলের জীবনী

বিতিকিচ্ছিরি মেঘ তোমার স্তব গাঁথা আর কতো শুনাবে। এবার শুনব চকলেট ফলের আত্নজীবনী। ফুলের পরাগায়নে নতুন প্রাণ স্পন্দন। মধুবাস ছড়িয়ে যায় বনস্পতির শিরায় শিরায়। শুরু হয় প্রজননের দীর্ঘ প্রলাপ। ব্যর্থ প্রণয়কাল হয়তো এবার শেষ হবে। তোমকে ছুঁতে চাই প্রিয় চকলেট। একটু সহজ হও। তুমি এক অভেদ্য ফল গাছ!


মুনলাইট সোনাটা


পকেট ভর্তি মুনলাইট সোনাটা
বিপন্ন বিস্ময়ে কখনো পাখি হতে নেই
আমি মেঝেতে অসুখ ছড়িয়ে রাখি
তুমি দুটো আঙ্গুল খুলে রেখো।

চিলের কণ্ঠে মানুষপোড়া সুর
আমার সাথে বাঘের সংসার
আরও একবার ডুব দিয়ে আসি জলে
হায়! তুমি এখনো মানুষ বুঝনি।


রোদছাতা ও নক্ষত্র পতন


ঘুমুতে যাওয়ার সময় ছাতা নিয়ে যাওয়া ভাল। আকাশ ভেঙে মরে যাওয়ার ভয় থাকেনা। আমিও যাই। ম্যাগনোলিয়ান বন থেকে শঙ্খ নদীর তীর বরাবর। ডারওইনের সরীসৃপ হয়ে কিছুটা রোদ মেখে নেই। রোদেরও নিজস্ব ছাতা থাকে। মূলত সমস্ত বিপ্রতীপ সম্পর্কের একটা করে ছাতা থাকে। আমার ছাতাটা আকাশের দিকে খুলে দিই।

নক্ষত্রের পতন ঠেকানো গেল বলে!

মুক্তগদ্য - সৈয়দ শাখাওয়াৎ

তুমি একটা আড়াল খুঁজছসৈয়দ শাখাওয়াৎ



জানি, তুমি একটা আড়াল খুঁজছো, একটা পুঁথিপাঠ সন্ধ্যাবেলায় অল্প আলোর ভেতর কারো দিকে গোপনে চেয়ে দ্যাখা আড়ালের মতো। আড়ালটা মুক্তোর মতো চিকচিক চিকচিক করতে করতে ক্যামন যেন একটা দুঃখ তৈরী করবে, দূর থেকে দূরে ল্যাম্পপোস্ট থেকে ছিড়ে ছিড়ে আসা আলোর মতো...তা তুমি যেভাবে দ্যাখতে চাও-আলোটা তোমার মুখের উপর একটা আবছায়া তৈরী করবে, একটা বাড়তি সৌন্দর্য। এরকম মায়া মায়া আলোর ভেতর তুমি সারাটা দিন থাকতে চাও, সে আমি জানি। সেদিন বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায়, একটা পুরো আকাশ ভেঙে জল ভাঙার শব্দ তুমি একা একা শুনেছ, একটা ঝুপঅলা গাছের নিচে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি। এটা এক ধরণের স্বার্থপরতা, তাই না ? কেন তুমি এতটা স্বার্থপর হবে বলো? ধর, এরকম বারবার তুমি একটা আড়ালের ভেতর থেকে বের হয়ে একটা নতুন আড়ালে ঢুকে যাবার তীব্র বাসনায় নতুন আড়ালে ঢুকে যাবার তীব্র বাসনায় তুমি আর কত আড়াল হবে। প্রকৃতঅর্থে নিজের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা ছায়ার সাথে কি আর আড়াল আড়াল খেলা যায়?

এইযে দলে দলে মানুষ হেঁটে যায় একেকটা বিদ্রোহের আগুন বুকে নিয়ে, তাদের মুখগুলো দ্যাখো, ওখানে শেষ বিকেলের রোদ এসে উঁকিঝুঁকি দ্যায়। একটা বাড়তি ক্ষোভ ওদের চোখে মুখে খেলা করে। তোমার সিনেমা শরীর থেকে রোদ ঝরে না কখনো। শুধূ ল্যাম্পপোস্ট আলোর বাড়তি সৌন্দর্য ছাড়া। এমনটা ভাবা কী খুব যৌক্তিক নয়? সন্ধ্যেবেলা ছাড়া যে তোমার ঘুম ভাঙে না! তুমি জানো না, এই বিকলাঙ্গ সময়ের ভীড় ঠেলে যেকজন মানুষ উঠে দাঁড়ায় বিপুল সাহসে তাদের হাতের উপর হাত রাখা কতটা সহজ! কতটা সহজ একটা রুটি চায়ে ভিজিয়ে খেতে না খেতেই একটা সিগারেট হাতে পুরোটা রোদ ঢুকে যায় মুখের ভেতর।কেননা একবুক আগুন না জ্বলে উঠলে এরকম আগুনখেকো বুক হয় নারে!তুমি একটা আড়াল খোঁজো। বিছানা বালিশ ঠেলে ঠেলে তুমি একটা বৃহন্নলা প্রেম খোঁজো।

তুমি কি জানো এই আড়ালে আবডালে কতগুলো মৃত্যু কথা বলে? অজস্র ঘুমের ভেতর আলো যা সঞ্চিত উজাড় করে করে একটা রক্তঝরা দিন আসে। ওখানে শুধু হুইসেল বেজে বেজে ওঠে-লংমার্চ!লংমার্চ! একটা দেয়াল ঘড়ি ছিটকে পড়লে অনেকগুলো কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তুমি একটা আড়াল খুঁজছো, ভাঙা কাঁচে মুখ দেখলে বুঝতে পারতে মানুষ আসলে কতবড় একটা মুখোশ! রাগ করলে, চলে যাচ্ছো? এসব কথার কোনোটাই যে তোমাকে বলা হয়নি....বড় স্বার্থপর মনে হয় তোমাকে। তোমার এনক্রিপ্টেড চেহারায় এর কোনো ছাপই পড়ে না । আমি জানি, একটা নম্বরের জন্য বারবার ডিজিট ফেল করছো তুমি। স্মার্টফোনে ঘা দিয়ে এখন তুমি চলে যাবে ;জানি। আরো জানি তোমার আড়ালটুকু ইদানিং হারিয়ে যায়...শত সহস্র তোমার মতো সবাই -ই চলে যায়! আর এদিকে লুট হয়ে যাচ্ছে শস্যের ক্ষেত, ফলবতী রোদের আঙুল, বেদনাবহুল ধারাপাতে। পুড়ে যায় দূর্বাদল, বনের চিরল বুক কেটে কেটে উবে যায় নদী-আর তুমি একটা আড়াল খুঁজছো!

ছোটগল্প - মুস্তাইন সুজাত

শূন্যতায় দোলা দেবশিশু
মুস্তাইন সুজাত



কবির সাহেবের নিত্য ফেরার পথ কমরেড মনি সিংহ রোড । এই রোড ধরে ঠিক একটু সামনে এগিয়ে, দৈনিক বাংলা মোড়ের চার রাস্তার জ্যামে সেদিনও আটকে ছিল গাড়িটা প্রতিদিন যেমন থাকে । ইট-সুরকির দালানের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যটা উঁকি মারছিলো অভ্যেসমত । কয়েক গোছা তির্যক রশ্মি ওপাশের বিরাট বিরাট বিল্ডিঙের জানালার কাচে প্রতিফলিত হয়ে সরাসরি পরছে কবির সাহেবের চোখে । তিনি অতিশয় বিরক্তি নিয়ে ভুরু কুচকে এদিক সেদিক তাকিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিটা সামলানোর চেষ্টা করছিলেন । ঠিক এই সময় গাড়ির জানালা গলিয়ে একটা ছোট চিরকুট এসে পড়লো তার হাঁটুর উপর । এই এক নিত্য উৎপাত ঢাকা শহরে । প্রতিটা সিগন্যাল কিংবা যাত্রী ছাউনিগুলোর সামনে, আশপাশে কিছু নেকাব-বোরখা পরা মহিলা দাঁড়িয়ে থাকে হাতে বিভিন্ন কোম্পানির চিরকুট নিয়ে । অধিকাংশই কোন না কোন গোপন রোগ নিরাময় মহৌষধ কিংবা ঝাঁর ফুঁকের বিজ্ঞাপন । গাড়িগুলো পাশে এসে দাঁড়াতেই খুব তৎপরতায় তারা যাত্রী বরাবর অদ্ভুতভাবে ছুড়ে মারে চিরকুট । আবার কেউ কেউ চলন্ত গাড়ির জানালা লক্ষ্য করে চিরকুট ঠেলে দেয় অব্যর্থভাবে । আশ্চর্য তাদের হাতের নিশানা !

হাঁটুর উপর থেকে নিচে পরার আগেই কাগজটা হাতে তুলে নিয়েছিলেন কবির সাহেব । জানালা দিয়ে বাইরে ফেলতে গিয়েও কেন যেন আবার হাতটাকে পেছনে এনে চিরকুটটা মেলে ধরেন চোখের সামনে । তার চোখ আটকে যায় চিরকুটের একটা বিজ্ঞাপনে এবং বিজ্ঞাপনের ঠিক নিচেই লেখা ঠিকানায় ।

যে কোন সমস্যা’র (ইহ ও পর’জাগতিক) সমাধান (ইনশাআল্লাহ্‌)

মুশকিল আসান হুজুর,

আস্তানা ঃ দেওরাকান্দা মোড় খানকাশরীফ, বাতুইলতলা, জয়গুনাগুনপুর ।

কবির সাহেব একবার ড্রাইভারের দিকে চটজলদি তাকিয়ে পকেটে চালান করে দিয়েছিলেন চিরকুটটা । রাতে বাসায় ফিরেই কথাটা জানিয়েছিলেন নিতুকে । নিতু বেশখানিকটা অবাকই হয়েছিলো সেদিন । জীবনের সব ক্ষেত্রে কবির সাহেব অসম্ভব প্রাকটিক্যাল ধরনের মানুষ । হঠাৎ এই মানুষটা কিনা ওখানে ধরনা দেবে ? পরক্ষনেই ভেবেছে , এছাড়া আর কিই বা করার আছে ওদের । অপেক্ষায় অপেক্ষায় দীর্ঘ দশটা বছর কেটে গেছে । ডাক্তার-বদ্যি দেখিয়েছে অগুনতি । যে যেখানে বলেছে সেখানেই গিয়েছে । কিন্তু ফল ওই একই, শুন্য হাতে ফেরা । শেষমেশ আশাই ছেড়ে দিয়েছে তারা । অথচ এই একটা চিরকুটে ওসিলায় যদি নিরাশা কেটে যায় ! কত কিছুইতো ঘটে পৃথিবীতে, ক্ষতি কি শেষ চেষ্টায় !

আজ খবরটা শোনার পর থেকে কবির সাহেবের মনটা বেশ ফুরফুরে । প্রজাপতির মত ভেসে বেড়াতে ইচ্ছে করছে তার । প্রতিদিনকার মত আজও বার কয়েক কথা হয়েছে বাসায় । তবে খবরটা একদমই চেপে গেছেন, বলতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত বলেন নি । নিতুকে সরাসরি একটা সারপ্রাইস দেবেন বলে মনঃস্থির করেছেন তিনি । অন্য কোন দিন হলে অফিস থেকে গাড়ি করে সোজা বাসায় ফিরতেন । খেয়ে দেয়ে একটু টেলিভিশন দেখা, অতঃপর ঘুম । কিন্তু আজকে বাসায় ফিরে বাকি রাতটুকু তিনি নিজের মত করে সাজাতে চান । গাড়ি নিয়ে চলে যান সোজা শাহবাগ । মোড়ের দোকান থেকে একটা বিরাট ফুলের তোড়া কিনে বাসার পথে । ভর সন্ধ্যায় কবির সাহেবকে ফিরতে দেখে নিতু বেশ অবাক হয় । আরও অবাকের পালা যখন ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দেয় নিতুর দিকে । বিবাহিত দশ বছরের জীবনে এই প্রথম রুটিনের ব্যতিক্রম কবির সাহেবের । সন্ধ্যে করে বাসায় ফেরা আর এই ফুলের তোড়া, দুটোই ।

মনে রাজ্যের উৎফুল্লতা নিয়ে বাসায় ঢুকার পরও অনেকটা সময় কেটে যায়, এখনো তিনি কিছুই বলেননি নিতুকে । খাবার সেরে বেডরুমের দিকে পা বাড়ান কবির সাহেব । নিতু আসে ঘণ্টা খানেক পর । পাশে বসতেই কবির সাহেব নিতুকে জড়িয়ে ধরেন । খুশিতে আত্মহারা কবির সাহেব সোহাগে গদগদ করছেন আবেগে । পরনের শাড়ির মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছেন নিতুকে । ডাক্তার কবিরাজ, শালার কারো ঔষধেই কাজ দেয় নি । অথচ কোন অজপাড়া গায়ের এক গেঁয়ো হুজুরের কারিশমা মাত্র তিন মাসের মাথায় ! কবির সাহেব নিতুর কানের কাছে মুখ নিয়ে এতটা চুপিসারে কথাটা জানান যেন পাশের দেয়ালও শুনতে না পায় ।

মফঃস্বলের মেয়ে নিতুর বরাবরই স্বপ্ন ছিল ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ালেখা করার । মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে যথারীতি ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয় । উচ্ছল প্রাণবন্ত পরিবেশ, বিস্তীর্ণ-বিস্তৃত পরিধি, সিমাহীন স্বাধীনতা কোন কিছুই নিতুকে পড়ালেখা থেকে দূরে রাখতে পারে নি । দেখতে অত্যধিক সুশ্রী না হলেও একেবারে মন্দ বলা চলে না কোন দিক দিয়েই । ছিপছিপে গড়ন, মায়াবী মুখমণ্ডল অনেকেরই মন কেড়ে নেয় প্রথম দেখায় । সহপাঠী এক ছেলে অনেক দিন নিতুর প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে যখন মরিয়া প্রায় তখন নিতুর বেশ মায়া জন্মেছিল ছেলেটির উপর । প্রথমে বন্ধুত্ব । আস্তে আস্তে ছেলেটি নিতুর ভাবনার জগতে হানা দিয়েছে স্বাভাবিক নিয়মেই । এক সময় নিতুর মনে হয়েছে আসলে ছেলেটি খুব একটা খারাপ না । মননে এবং বাহ্যিক গঠনে দুই দিক দিয়েই চলনসই । আর দশটা ছেলে যা হয় ঠিক সেরকমই । বিশেষত কোন পাথক্যও খুঁজে পায় নি অন্যদের সাথে । তবে একটা গুন ছিল ছেলেটির । ভবিষ্যৎ গণনা করা । সে হাত দেখে অনেক কিছুই আগাম বলে দিতে পারত । আন্দাজে কিংবা ঢিল যাই হউক তার কথা মাঝে মাঝেই ঠিক হয়ে যেত । যদিও নিতু একদমই বিশ্বাস করত না এসব । সেদিনের অতি সাধারন ছেলেটির নাম শফিক হাযারিকা । সেই হাযারিকার সাথে দীর্ঘ পাঁচটি বছর বন্ধুত্বের ছলে সকাল-দুপুর-বিকেল, ভার্সিটি-টিএসসি-শাহবাগ-নীলক্ষেত-নিউমার্কেট ঘুরতে ঘুরতে কখন যে ঠিক ঠিক প্রেমে পড়েছিল বুঝতে পারে নি নিতু । টের পেল অনেকদিন পর, যেদিন ভার্সিটির পাঠ চুকিয়ে বিদায় নেয় । কিন্তু তখন অনেক দেরি করে ফেলেছে ওরা । আস্তে আস্তে জীবনচক্রের বেড়াজালে বন্দী হয়ে যে যার মত ছিটকে পড়লো দূরে । হাযারিকাও একদিন মিশে গেল লক্ষ মানুষের ভিড়ে । কিন্তু নিতু তাকে ভুলে নি কিংবা ভুলতে পারে নি মুহূর্তের জন্য । মনে মনে অনেক খুঁজেছে । ঢাকা শহরের যেখানেই গিয়েছে হাজার মানুষের ভীরে একটি মুখই খুঁজে বেড়িয়েছে সে প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষণ । এমনকি ঢাকার বাইরেও । অজান্তেই চোখ পরেছে নানান যায়গাতে । আজও খুঁজে চেতনে-অচেতনে ।

এরই মাঝে আরও তিনটা বছর কেটে যায় । পারিবারিক সিদ্ধান্তে কবির সাহেবের সাথে বিয়ে হয় নিতুর । কবির সাহেব সুদর্শন, স্মার্ট, শিক্ষিত । বংশগুনে বেশ নামডাক আছে । উচ্চ বেতনে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন । এমন ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার । তাই ভেবে চিন্তে নিতু এ বিয়েতে রাজি হয় । বিয়ের পর বেশ কিছুদিন ঢাকার বাইরে থাকতে হয়েছিল নিতুদের । সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ঘুরে গত পাঁচ বছর ধরে ঢাকায় থাকছে । নাম-জশ-খ্যাতি সব কিছু পাওয়া কবির সাহেবদের একটাই অপূর্ণতা ছিল । সেটিও আজ হুজুর সাহেবের ওসিলায় পূর্ণ হতে চলল ।

মুশকিল আসান হুজুরের ঠিকানা নেয়ার পরদিন অফিসের এক বিশ্বস্ত কলিগকে কথাটা বলেছিলেন কবির সাহেব । কথায় কথায় জানতে পারেন ,কবির সাহেবের সেই কলিগ মুশকিল হুজুরের দূর সম্পর্কের আত্মীয় । আরও অনেক অজানা খবর বেরিয়ে আসে হুজুর সম্পর্কে । অনেকেই সেখানে গিয়ে উপকার পেয়েছে । ভদ্রলোক একখানা চিঠি কবির সাহেবের হাতে দিয়ে বলেন এই চিঠিটা হুজুরকে দিলে একটু ভাল ব্যবস্থা হবে । পরের সপ্তাহেই কবির সাহেব আর নিতু গিয়েছিলেন হুজুরের আস্তানায় ।

সেদিন ছিল বুধবার । অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলেন কবির সাহেব । বেশ সকাল সকাল রওয়ানা দিয়েছিলেন তারা নিজস্ব গাড়িতে করে । পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে হুজুরের সাক্ষাৎ পান নি সেদিন । পরের শনিবার বেশ ভোরে ঠিক ফজরের আজানের পরই রওয়ানা দেন তারা । গাছপালায় চারদিক ঘেরা বিশাল বাড়িতে হুজুরের আস্তানা । এই সকালেও হাজার হাজার মানুষ চারদিকে । তাদের হৈ চৈ আর ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দৌড় ঝাপ, এক এলাহি কাণ্ড । হুজুরের আস্তানা সুবাদে রাস্তার একপাশে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী দোকানপাট । খাবার-দাবার, খেলনা-পাতি থেকে শুরু করে নিত্য দরকারি অনেক কিছুই বিক্রি হচ্ছে দোকানগুলোতে । সমান্তরালে বেশ ক’খানা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে মানুষজন । নিতু এগিয়ে গিয়ে মহিলাদের একটা লাইনে দাঁড়ায় । একদিকে মাইকে কে একজন ঘোষণা দিচ্ছে হুজুরের কেরামতির কাহিনী । কয়েক’শ স্বেচ্ছা সেবক এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে । কবির সাহেব তাদের একজনের হাতে একখানা শ’টাকার নোট গোঁজে দিয়ে চিঠিটা ধরিয়ে দেন হুজুরের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য । ঘণ্টা কয়েক পেরিয়ে গেছে । ততক্ষনে সকালের কুসুম রঙ্গা সূর্য ঠিক মাথার উপর ফুল্কি ঝরাচ্ছে । তীব্র রোদের সাথে ভ্যাপসা গরম । হঠাৎ মাইকে কবির সাহেবের নাম উচ্চারিত হয় দুই তিন বার পরপর । নিতু এগিয়ে যায় হুজুরের আস্তানার দিকে । পাশে পাশে কবির সাহেবও । হুজুরের রুমে ঢুকার মুখে এক সেচ্ছাসেবক এসে কবির সাহেবকে আটকে দেয় । কারন জিজ্ঞাসা করতেই অন্য একজন এগিয়ে এসে বলে,

-জি সাব, আফনে বিত্রে যাইতে পারতেন না । হুজুরের বিশেষ মানা আছে । যে তদ্বির করাইতে আইসে, হের একলাই যাওন লাগবো ।

কবির সাহেব অনুনয় করেও অনুমতি পান না ভেতরে ঢুকার । অভিবাবকদের বাইরে অপেক্ষা করতে হয় যতক্ষণ না চিকিৎসা শেষ হয়, এটাই এখানকার নিয়ম । অবশেষে নিতু একাই হুজুরের রোমে ঢুকে । একটু পর একজন স্বেচ্ছাসেবক হুজুরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসলে কবির সাহেব তাকে জিজ্ঞেস করেন,

-এই যে ভাই, চিকিৎসা কতক্ষণ চলতে পারে ?

-নিবর্র কারতাসে গিয়া আফনের রোগের উফর । ধরুইন এক ঘণ্টা তো লাগবোই । উত্তর দিয়েই হন হন করে হাঁটা দেয় সামনের দিকে । এক ঘণ্টা হতে কবির সাহেবের ঘড়িতে আরও চল্লিশ মিনিট বাকি ।

কাঁচা পাকা দাঁড়ি । বেশ লম্বা দেহের অধিকারী মুশকিল আসান হুজুর একা বসে আছেন আসন করে দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে । মেঝের পুরুটা জুড়ে সাদা ফরাশ পাতা । আলোছায়ার মায়াবী খেলা সারা ঘরময় । দরজা বন্ধ, কোন জানালা নেই । আগরবাতি জ্বলছে ঘরের কোনে কোনে। আতরের মিষ্টি গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ । হুজুরের মাথা সামনে নুয়ে আছে । বাবরি চুলে চেহেরা ঢাকা । হাতে তাজবীহ । রেডিয়ামের সাদা গোটা থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে । একটা অজানা ভয় ঢুকে নিতুর মনে । মিনিট খানেক নীরবতার ভেঙে হুজুর নিতুকে নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে । নাম বলতেই হুজুর এক ঝটকায় মাথাটা উপরে তুলে চোখ রাখে নিতুর দিকে । কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোটা । হুজুরের এই অবস্থা দেখে নিতুও বেশ অবাক হয় । ভালভাবে চোখ পরতেই নিতু চমকে উঠে । খানিকটা আশ্চর্যের সুরে শুধু বলে, হাযারিকা তুমি !

এক হাতে নিতুকে জড়িয়ে ধরে কবির সাহেব অন্য হাতে পাশের টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলে নেন সুখবরটা হুজুরকে জানানোর প্রয়োজনবোধ থেকে ।

খবরটা শোনার পর থেকেই নিতু ভাবলেশহীনভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মাথার উপর ঘূর্ণায়মান পাখার দিকে । এই বাতাসেও নিতুর শরীর ঘামছে শঙ্কায় কিংবা সুখানুভূতিতে । তার চোখে ভেসে উঠা দুটি পরিনত মুখাবয়বের ঠিক মাঝখানে একটি নিষ্পাপ শিশুমুখ দোল খায় অনবরত । শুন্যতায় দোল খাওয়া দেবশিশুটির দোলা থামাতে নিতুকে মনচক্ষু বুজতে হবে একাগ্রতায় অনেকক্ষণ কিংবা জীবনের বাকিটা সময় ।

কবিতা - নাসের হোসেন

কথা
নাসের হোসেন



তোমাদের পোষা বেড়াল ছানাটাকে মনে পড়ে
সে কি এখনও সেরকম মজার-মজার
খেলাধুলো করে, সে কি এখনো ভাত খাওয়ার সময়
তোমার হাত থেকে মাছ নিয়ে খায়
কিন্তু সে তো এখন বাচ্চা থাকার কথা নয়
তারো এখন বাচ্চা হওয়ার কথা, বাচ্চাকাচ্চা
মানুষ করার কথা
কিন্তু সে তো ওনেকদিন আগেকার ব্যাপার
বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করার পর সে কি আর বেঁচে আছে ।

কবিতা - আনসার উল হক

চোখ দিয়ে
আনসার উল হক



তোমার বাদামি চুলের দাপাদাপিতে
বাতাসে পাই কাঁচমাটির গন্ধ
রঙিন রুমালের ভাঁজে
আলুথালু জীবনকে দেখি অর্ধশায়িত
তোমার পুষ্প পেলব হাতের স্পর্শে জাগে
বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ।
ধুলো নিয়ে ঘামে ভিজিয়ে
তুমি ঘর বানাও,
আবার কখনও এলোমেলো তপ্ত প্রশ্বাসে
খানখান হয়ে ভেঙে পড়ে
সাধের তিলোত্তমা ।
পাতা ঝরা পৌষের বিধবা বিকেল
মনে করিয়ে দেয়
তোমার অহেতুক-শঙ্কিত আগমন ।

কবিতা - সৌভিক বন্দোপাধ্যায়


কবিতা - জুবিন ঘোষ

পরিবর্তন ও তৃতীয় লিঙ্গ জুবিন ঘোষ



এই পরিবর্তন আসলে তৃতীয় লিঙ্গ ।
তোমাকে ঘিরে এইসব নির্মেদ রূপান্তর
ওপাশ দিয়ে ছুটে আসছে বিশ্বস্ত সঙ্গী
উলুধ্বনিতে শুনি সন্ধির গুরুত্ব
বিছানায় কিচকিচ করছে বালি
জিভ উলটানোর চেয়ে ভয়ংকর
কাদম্বরীর মৃত্যুর ভেতর যেসব প্রবাদ লুকিয়ে ছিল
ভিড়ের মধ্যে ভ্রূক্ষেপ না করেই খুঁজি দীপিকা পাকরুন ।
#
সহজভাবেই একটা নুড়ি জুতোর ভেতর ঢোকে
বুঝতে পারি, আসলে পরিবর্তন ওই উঁচুটুকু থাকার মতোই
একপক্ষের ভয় অন্যপক্ষের কাছে বাধা হয় না । 


কবিতা - অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

যোগী অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়



কথিত মায়ার দলে আমি এক অভিশপ্ত যোগী।
তোমার অসুখ ছুঁয়ে নিভে যাই।পালাক্রমে বিষাদ সম্ভোগী
হয়ে পড়ি।কুয়াশার মত গ্রাস করে পাললিক জ্বর।
অনন্তে ভাসাও ছায়ার জাহাজ হে ব্যর্থ কারিগর।
হাওয়ার খোলস থেকে ডাক দ্যায় চন্দ্রাহত বাঁশী।
শ্বাসের আকাল জাগে।আমি সেই তীব্রতম মূঢ় সন্ন্যাসী
দিনক্ষয় করতে থাকি।কমন্ডলু ভরে যায় নক্ষত্র দুধে।
তোমার সখ্য বাড়ে মৃত মৌমাছি আর ব্যাথার ওষুধে।
এইসব ঋতাভরী মধু ডুবে যাবে প্রতিবিম্ব জলে
ভেসে উঠবে অভিশপ্ত যোগী কথিত মায়ার কারুদলে।


কবিতা - নীলাব্জ চক্রবর্তী

তটরেখা
নীলাব্জ চক্রবর্তী


২৯/০৬/২০১৩

মোমের গভীর দিয়ে নেমে যাওয়া এই নরম আয়নাটার কথা ভাবি। ঐ গলে যাওয়া হাওয়াকলের সড়কযোজনার কথা। ফেলে আসা ফুটনোটে জুতোদাগের নতুন নীল পা। কাঁচের শরীরে স্থির হয়ে ফোটা জুলাইচেতনার ফোঁটা। আবার ফ্ল্যাশব্যাক। বালি সরে যাওয়ার দৃশ্যে ঝিনুকরেখাদের জন্য যথেষ্ট মনে হচ্ছে কোনও কোনও সমাপতন ...



৩০/০৬/২০১৩

আর খোসা খোসা দুপুর। কোয়া উড়ছে। লিনিয়ার একটা স্বপ্নদৃশ্যের জন্য বারবার রিটেক। আলো। সিঁড়িঘরে জড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তিগত মনোটোনি। নুনছাপের অর্ধেক নিয়ে ফিরে এলোনা আপনার পোষা রোদ। ফ্রেম করছে আরও একটা সিম্ফনী। একটা গাঢ় হচ্ছে দূরের হাইওয়ে। যেন বাড়িটার মধ্যে ঢুকে যাওয়া অনেকটা আকাশ। ফেডেড আস্তানা। গুঁড়ো হচ্ছে এই ঝুঁকে আসা তামাম মন্তাজ। দেখি দীর্ঘ হয়ে আসে সরাইখানার আলোরূপ ধাতুরূপের লিনিয়ারিটি। ব্যাকস্পেস। একটা ছায়া পেরিয়ে যাওয়ার শব্দের ভেতর দিয়ে ...



০১/০৭/২০১৩

সিল্ট। উপনিবেশ। চাকার নরমে আসলে গেঁথে যাচ্ছে সেইসব স্তনরেখায় কুড়িয়ে নেওয়া ডাকনামদের ব্যস্ততা। শাটারে লেগে রইলো ফিরিয়ে আনা কিছু জলবায়ুর উচ্চতা আর অজস্র বোতামের ভেতর বাড়ি ফেরার একটা ব্লাইন্ড লেন ডুবে যাওয়া। আমাদের এ’ঘর ও’ঘর। দুপাশের সমস্ত পালকই স্কার্টফেরত বারান্দা ফেলে গ্যাছে ...

কবিতা - মধুরিমা দত্ত

আত্মজৈবনিক মধুরিমা দত্ত


এসব আত্মজৈবনিক কথা
আমাদের লোডশেডিং এর দেশে মানায় না।
তার চে’ বরং যদি শুকনো পাতা ঝরিয়ে
আরো কিছু নগ্ন হতে পারতাম
তোমার সাথে হেমন্তের বিকেলে দেখা হতেও পারতো।
সন্ধ্যা হলেই জানো, বড়ো বেশি
নড়বড়ে হয়ে ওঠে কলকব্জা,
রাস্তায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকি,
মাথার মধ্যে ঝনঝন করে ওঠে প্ল্যাটফর্ম।

আমি জানতে চেয়েছিলাম,
জ্যোৎস্নার সাথে তোমার সম্পর্ক,
জানতে চেয়েছিলাম অস্থিরতার ফোনেটিক্স।

ভালোবাসার পাশে এখন জোনাকি বসিয়ে রেখেছি,
শীতকালের চোখ দিয়ে এখনো তোমাকে দেখিনি আমি,
ইতস্তত বেঁচে আছি বলেই রোজ এতো প্রশ্ন পায় আমার।
কাঁপতে কাঁপতে জানলা তুলে দিই,
দেখি, সকলেই সকলের অভ্যাস নিয়ে কুলকুচি করে।
সকাল বিকেল এভাবে বোধিবৃক্ষের
এঁটো হয়ে যাওয়া দেখতে আমার বেশ লাগে।

কবিতা - সাঁঝবাতি

সে7ন – ৩
সাঁঝবাতি



কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছে একটা ট্রেন
আর একটা মেয়ে, উলটো দিকে ফিরে দূরে সরে যাচ্ছে

চলে যাওয়া আর ফিরে যাওয়ার মধ্যে
রোদ পড়ে চকচকে হয়ে উঠছে জলরঙের পারফিউম

নাকের পাটার নিচে শুয়ে শুয়ে
গন্ধরা জমে উঠছে ঘামের মত
সুতীব্র হুইসেল শুনতে শুনতে দুরিয়া’রা টানেলে ঢুকতেই
বারবার ঘুমের গুঁড়ো সাদা বালিশ অন্ধকার করে দিচ্ছে ...



কবিতা - মেঘ অদিতি

গন্তব্য
মেঘ অদিতি



ঘুম এক ছায়া।আশ্চর্য রাতের আড়াল।

গাঢ়তার ঢাল বেয়ে নেমে এলঘুমের চিবুক
গোপন শব্দে রাখা বিষণ্ণ আদরে, অকারণ
জ্বলে ওঠে হাওয়ার শরীর
বৈধতা ভেঙে দিলে
দাবদাহে নিভে যায় মৃতপ্রায় প্রহর

এই তো বাতাস, ছড়াল দীর্ঘশ্বাস, হেফাস্টাস-
কেঁপে গেল বন্ধ দু’চোখ
নৈঃশব্দ্য কেবল।

তোমার গন্তব্য স্থির হতে চায় এইখানে-
নিবিড় নিবাসে

তুমি জানো?


কবিতা - দেবব্রত কর বিশ্বাস


কবিতা - আহমেদ তানভীর

দুটি কবিতা
আহমেদ তানভীর


বায়বীয় , পথের পাথরে প্রেম


বৃষ্টির মিছিলে মিশে যাবো বলে-
মেঘে মেঘে ছাপা হয় অজস্র জলজ পোস্টার!
মাটির মেয়েরা রোজ রোজ হাঁটে ইটের শহরে;
ক্ষণে ক্ষণে ভীষণ বদলায় রূপ-রস-ঘ্রাণ!

অঙ্গে অঙ্গে অনন্ত ঢেউ, আহা...
চোখের যুগল পুকুরে সাঁতরায়-
পুতুল, প্রজাপতি, পরী অথবা পাপের পাহাড়!

কেউ কি জানে? কেউ কি ভাবে?
বায়বীয় আর্তনাদ নীরবে লুকায়-
লোকাল বাসের চাকার হৃদয়!



পথের পাথরে প্রেম

কৃষ্ণপক্ষের এক টুকরো আকাশ কোলে নিয়ে-
সারারাত ভেবেছি ভীষণ!
কিছু কবিতা লিখবো এবার গল্পের আদলে।

নিশিজাগা অবুঝ তৃষ্ণায় তুমি-আমি পাশাপাশি,
নদীর বাঁকের মতো তোমার অদ্ভুত কোমরে-
আমার জড়ানো দুহাত চুপচাপ লিখে দিলো-
দু’চার লাইন প্রেমের কবিতা।

চাঁদহীন শেষরাতে থোকা থোকা আঁধার-
বাতাসের সাথে গড়াগড়ি খায়।
জড়াজড়ি তুমুল তুফান আমাদের বিছানায়!
ভোরভরা জানালায় রোদভরা ভোর দোর খুলে দিলে-
ফিরে ফিরে দেখি, ছিঁড়ে যাওয়া নরম চাদরে-
লেগে আছে উত্তাল রাতের পরম আদর!

রোদ এসে কেড়ে নিলে যাবতীয় বোধ,
পথে নেমে মনে হয়- পথের পাথরেও বুঝি
আজকাল লেখা থাকে নাগরিক প্রেম।


কবিতা - সৌরভ বিশ্বাস

আলো সৌরভ বিশ্বাস


সকালের সমর্পণ পলকা হয়ে আসে মাঝরাতে
ভাড়াটে খুনির নখে ঝলসে ওঠে কর্তব্য।
শব্দচোর সেই যুবতীর পাশে বসা হয়না আর--
ভারী এক স্পঞ্জের ভিতর তলিয়ে যেতে থাকি, ক্রমশ।

লেশমাত্র উদ্বেগহীন আমি,
মেখে নিই প্রিয়তম শব্দের ঘ্রাণ।
রাস্তা ছুঁয়ে থাকা ধানক্ষেতে
ঢুকে যায় বেয়াড়া সাইকেল।
রাতের বাগান থেকে টুপ করে
খসে পড়ে একটি সাময়িক অক্ষর।


কবিতা - সৌমেন্দ্র দাস

আজন্ম শোক
সৌমেন্দ্র দাস

এইটুকু না আরেকটু হোক।
দু’হাত ভরা আজন্ম শোক,
ঢালবো কোথায়?
কোন দীঘিতে?
কোন মেঘেদের গল্প শেষে
ভাঙবে দেওয়াল
তার কথা হোক।
না যদি হয় গোপন পালক
রাখবো কোথায়?
কোন চিঠিতে?
সেই চিঠিতেই মূর্খ আমি,
ভাসিয়ে যাব অনন্তকাল,
ডুবতে এবং বাঁচতে শেখার
সব ইতিহাস সন্ধ্যা সকাল।
ফিরতে পারো ইচ্ছা হলে
যখন তখন খেয়াল খুশি,
দেখতে পাবে নষ্ট আমি
ডুবছি কেমন, কেমন ভাসি।

কবিতা - পাভেল আল ইমরান

চোখের ভেতর থিয়েটার লাগিয়েছি
পাভেল আল ইমরান



মুগ্ধ চোখের বস্তা ডুবেছে তোমার বাড়ির চৌহদ্দির ঘাটে। এক নৌকা বোঝাই করে
শুধু খর টেনেছ , বৈঠাতে রক্ত লেগে আছে মরুর বালুতে বিষ্ঠা লুকিয়ে রেখেছে দুষ্টু শিয়াল।
আঁচল থেকে জাহাজের কোলাহল কি শুকিয়ে নিবে নাকি চাবির থোঁকার মতই বেঁধে রাখতে পারবে
ময়ুরের ধর্মঘট। উঠোনে এসব কুমড়ো গাছের মাংসগুলো আর্তনাদে একদফা এনেছে তোমার নাকফুলের স্বাধীনতা দিবস পালনের দাবিতে। এদেরকে বাটার লাগানো একপিছ করে আকাশের টুকরো দিয়ে দাও যেসব ফটোগ্রাফি তুমি এক্ষনি সেরেছ ...
ভাবছ কেন যেদিন থেকে চোখের ভেতর থিয়েটার লাগিয়েছি তুমি শুধু উলঙ্গ নাচকেই শিরোনাম বানিয়েছ।
সারা শরীরের লালা জমা আছে ঠোঁটের হিমালয়ে। এটাকে হিমালয়ই বলি কারণ ভাঙ্গা কাঁচের প্রতিশব্দ উচ্চারণ করতেই কেমন হিজল গাছের নিচে পুকুরটা থেকে সব মাছরাঙ্গা ত্রিগোল রচনা করে ।

কবিতা - রাজকুমার শেখ

এই অবুঝ বিকেলে ছিঁড়ে যায় ঘুড়ির ডানা রাজকুমার শেখ



তোমার একুশ পূর্ণ হলে
বিছিয়ে দেব ফুল
অথবা মুঠো ভরে রেখে দেব কবিতা
যেখানে তোমার আঁচল খোলা আকাশ
আমার বিকেল
বাদামের গায়ে তোমার চুলের গাঢ়তা
খুশবু মেখে শিশিরে
সে আমার প্রেম
আমার মৃত্যু রঙের ভালোবাসা

তোমার এই একুশে---
রেখেছি একটি বিকেল
আর দু ফোঁটা অশ্রু
মাখিয়ে দিয়েছি আমার নীল রঙের
ঘুড়িতে ....

কবিতা - দেবাশিস তেওয়ারী

ইন্দ্রপ্রস্থের কাছাকাছি দেবাশিস তেওয়ারী



অলকানন্দের সেতু পার করে আজ
দাঁড়িয়েছি বিষাদ প্রান্তরে
এ সময়ে আকাশে কে ওড়ে ?
অ তো ঘূর্ণি, ওর কালো সুতো
রাতের অন্ধকারে ব্ল্যাক লাইটের মতো
চাপ ধরে আছে
আমি নীচে সুতো ধরে আছি ।
সেও যেতে চায়,
সেও তৈরি করতে চায় আরেক ইন্দ্রের ঘর ইন্দ্রপ্রস্থের কাছাকাছি

কবিতা - রাখী খাতুন

অধরা রাখী খাতুন



ঘন অন্ধকারে একটুখানি আলোর আভাস,
দৃষ্টিহীন চোখে দেখ না কিছুই ।
শুধুই আন্দাজে পথ চলা,
না বুঝেই কিছু বলা
ভাব লেশ হীন মুখ আর রুদ্ধ কণ্ঠ ।

কবিতা - ইন্দ্রজিৎ মণ্ডল

প্রেমের উল্টো পিঠ
ইন্দ্রজিৎ মণ্ডল




অজুহাতের শিরা কাটা
অশরীরী মানুষটার মৃত্যু পদবি কি প্রেম ?

পায়ের নীচে সিঁড়ির তরঙ্গ

ভেতরে তরঙ্গ আছে জাপানের মাটির মতো
সুতরাং মাটিও প্রেমের পথিক হতে পারে
বা, পথিকও প্রেমে মাটি হতে পারে



কবিতা - গার্গী মুখার্জী

দুটি কবিতা
গার্গী মুখার্জী


আজ সারাদিন

আজ সারাদিন বাগানে ফুটেছে ফুল
আকাশে মেঘের লুকোচুরি
বসন্ত রঙে ভরে গেছে পৃথিবী
আজ শুধু ভালোবাসার দিন

ভালোবাসার কথা শুনলেই
ছুটে আসে সূর্যের ঝাঁক
মাটি আকাশ জল চত্বরে
ফুটে ওঠে ভালোবাসা



সুন্দরতা

তোমাকে দেখলে
সুন্দর হয়ে ওঠে পৃথিবী
বসন্ত রঙ আকাশ জুড়ে
হিমেল বাতাসে কোকিলের সুর
হৃদয়ের কথা মাথা ছাড়া দেয়
প্রতি কোষের অনুভূতি
সুন্দর করে তোলে পৃথিবী

সুন্দরের ছটায় অস্তিত্ব
সব রূপ খুলে দেয়


কবিতা - স্বপন দত্ত

আবহমান রূপকথা লতা তোমাতেই মরে বেঁচে উঠতে চাই
স্বপন দত্ত



আমি প্রতিটি মেয়ে মানুষের সমতলে গভীর অরণ্য সহচর হতে চাই । হাভাত-তৃষা-রাস্তা পেরোতে চাই ঘুমবীজ ধোয়া শরীরীমন্ত্রে হাতুড়ি-কুড়ুল-কাস্তে-ধনুক অসংখ্য ঝুরিনামা আকাশ ভাসন গানে চাঁদডোবা দীঘল শীষ আদর ডাকা ভোর । চাই একটি অন্তহীন প্রাচীন প্রার্থনা ধ্বনি ভায়োলিন বেজে ওঠা নিষেধের রক্ত চেতনায় উন্মাদ কার্নিভাল। মাতাল তোমাদের আবহমান জড়াজড়ি থাকা বড় দুঃখ নষ্ট সহবাস ক্ষিপ্ত রক্তছেনে নিবিড় অতুল গাঢ় শরীর দুধে নিজে নিজের গুহায় খুলতে খুলতে কেমন এক ভুবন ভিক্ষা অবিরাম আত্মহত্যায় বেঁচে থাকা পর্যটন বেদুইন উলঙ্গ দোদুল স্থির ঈশ্বরে ফুটে ওঠায় ...

কবিতা - অমিতাভ বিশ্বাস

বিহ্বলতা অমিতাভ বিশ্বাস



রাত ঠোঁটে করে ছুটে চলে
অন্বেষী পেঁচা ...

মরা চাঁদ ঝোলে ষন্ন আকাশে
চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে

তবুও নিদ্রাহীন আলাদিন ...
আশ্চর্য । রাতের ভিতর মাদলের বীন

মৌন অন্ধকারের
অরব শব্দ কুড়িয়ে
ঘরোয়া সুখ-দুঃখকে
বাতাসে ছড়িয়ে বেঁচে থাকি ... ।



কবিতা - সুমন পাল

উত্তর সুমন পাল



অনেকদূর চলতে চলতে হঠাৎই এসে
থেমে যাই,
সামনে ধূ ধূ করছে মাঠ,
খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে একা আমি
অজস্র প্রশ্ন এসে ভিড় করছে ম্নের জানালায় ।
তখন রোদের তীব্র আলো চোখের তেজ যেন
কমিয়ে দিতে চাইছে,
সেই আলো আমার মনের প্রশ্নগুলোকেও
দমিয়ে রাখতে চাইছে মনের চিলেকোঠায়,
কিন্তু সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও তো
আমি পেলাম না ।

কবিতা - দেবব্রত সরকার

অনন্তডাক
দেবব্রত সরকার



সমস্ত দিন একলা ঘরে তাই অবসর

অতীত রোদ কাব্য কথায় মিথ্যা ধূসর




ভুলের শব্দ জীবন ঘোড়ায় খুব ছুটছে

সিঁড়ির শব্দ কফিন বোঝায় তাই ছুটছে


এই পৃথিবী নীরবতার শ্যামলা আদল

ভাবতে পারি নিজের কথা আমরা কেবল


কিন্তু কেন খাপছাড়া মন ছায়ার ভেতর

আড়মোড়া সব নিহত সমর শেষ, রাস্তা সদর


কেবল আমরা না । ভাবি না । পরের কথা
ঘোড়সা মেঘে ব্জ্র-বাতি ওড়ে বৃষ্টি ছাতা


পরের কথা ভাবতে গেলে এই ভগবান

প্রেমটা জবর থাকতে হবে সব অবসান


নিহত হার তুলতে পারি কবর খুঁড়ে

আমরা বাহির গাছের শরীর পাতাল ফুঁড়ে


কিন্তু সেসব হার খসে যায় ন্র কঙ্কাল

বিদ্যে বুদ্ধি গিঁট মেরেছি ঐ পাঠশাল


একটি কেবল মিথ্যে কথা লিখতে পারি

হয়নি যেন তোমার সাথে আমার আড়ি


শুধুই আমি রাস্তা হারাই হাজার সে বাঁক

তাকিয়ে থাকি আসবে কবে অনন্তডাক

কবিতা - সুদীপ দত্ত

নৈঋতকোণসুদীপ দত্ত



মৃত্যু মানে পলক ও নিস্পলকে সেতুবন্ধন।

মৃত্যু মানে কয়েক গ্যালন তরলের ফাঁকা আধারে মুখ ঢোকালে যে শূন্যতা।

মৃত্যু মানে অচিরেই জীবনকে ছেনে ফেলার সাহস,

মৃত্যু মানে নিজেকে শূন্য ভাবার কপর্দকশূন্যতা।

মৃত্যু মানে জ্ঞানত যা হচ্ছে- যা চাইছি না।

মৃত্যু মানে মানুষের মধ্যেকার আদিম ইচ্ছে-যা বলার ছিল

যা আদৌ বলছি না।

কবিতা - শর্মিষ্ঠা ঘোষ

জাদু
শর্মিষ্ঠা ঘোষ



ভুঁইফোঁড় অনুরাগদের জন্য চমৎকার কলার এবং টুপি
মিহিন কথাসুতোয় নকশাদার আলগা আলাপচারিতা
রাত উপচানো গেলাস থেকে ফোঁটা ফোঁটা শব্দ শ্যাম্পেন
কাঁচের দেয়ালের দুপারে বিন্দুবিন্দু ঘাম , অধরা মাধুরী টেনশান

এরি মধ্যে বুকে বেজে ওঠে মাঝেসাঝে সেই কাঙাল ভায়োলিন
সেই জাদু বাদককে ঘরে ডাকতে মানা কোর না কেউ
করলেও শুনছি না ...


কবিতা - মনোরঞ্জন বর্মণ

সর্ম্পক
মনোরঞ্জন বর্মণ



আকাশ আর পাতালের মধ্যে একটা সর্ম্পক আছে ,
সেটা অদৃষ্টের সর্ম্পক;
মেঘ থেকে বৃষ্টি, বৃষ্টি থেকে বাস্প ,আবার মেঘ ।
নর চুম্বন আর নারী চুম্বের মধ্যে একটা সর্ম্পক আছে ,
সেটা কটাক্ষ বা সুস্বাস্থ;
সম সম বা বৈশ্যমের আবেগ ।

এই সর্ম্পক চির নশ্বর ,স্থায়ী!
ঠিক নর গৃহে নারীর মতন ।