বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

সম্পাদকীয় - ৩য় বর্ষ ১২তম সংখ্যা






সম্পাদকীয়



“লিখছি, অথচ বাড়ির ঠিকানাটা জানা নেই
তুমি ক্রমশ দূরের দিকে ফুটে ওঠো
এমনই কি হওয়ার কথা ছিল?
রুপু...রুপু...দ্যুলোকের মতো দূরে
তুমি কি নীলাভ পা ছুঁয়ে আছ কারো?
তোমার বাড়ির ঠিকানা জানি না রুপু, তবে কি ‘অনন্ত’ লিখে দেবো?”

                                                                      - শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রিয় কবিরা সব ফেসবুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে – শাশ্বত আকাশের দিকে কিংবা অ্যারিজোনায়, নাকি না জেনে দুদিনের শীতঘুম দিচ্ছে।

আর আমায় ঘুম হয়ে ভালোবেসে যাচ্ছে মা- ভালোবাসা সন্দেহ জমাচ্ছে দিনদিন।

ক্যালেন্ডার বলছে তারিখগুলোর শীত থেকে গ্রীষ্মের দিকে হাঁটার সময়টাই প্রেম এদিকে আমরাও হয়ত প্রতিটা ফুলের মানে আমরা অন্যভাবে বুঝে নিয়েছি।

সময় নিয়ে সমস্যা হলেও তাকে ভুলে গিয়ে আমাদের লিখতে হচ্ছে – ব্যাস্ততায় – ঘুম থামিয়ে একটানা বড় কোনো লেখা নামিয়ে দিচ্ছি দিব্যি। লেখার চাপ কমছে – সময়টা বয়ে যাচ্ছে প্রেম হয়ে।

লেখারা আসলে প্রতিটা হাঁটায় আমার সঙ্গে থাকে আর এরই মধ্যে দুমদাম চলে আসছে ভাষা দিবস, বইমেলা, হলদে শাড়ি ... আমি প্রতিবারের মতই চয়েস করে উঠতে পারছিনা।

লেখারা আমায় অস্থিরমনস্ক ভেবে চলে যাচ্ছে। এভাবেই কি প্রেম যায়? অস্থিরতা আমাদের স্বভাব বদলে ফেলে।

কাটাকুটির খাতায় একটা পরিষ্কার সংখ্যা রেখে গেলাম আপনাদের জন্যে। গদ্য, গপ্পো আর অজস্র কবিতায় ভরে। পুরনো নতুন সব্বাই লিখেছেন। আমার মতন মনখারাপে আচ্ছন্ন না থেকে মনে প্রাণে সংখ্যাটি পড়ুন ...আর আমি চোখ বুজে দেখতে থাকি সেই দেশ – মা ঘূম পাড়াতে ডাকছে যেখানে, কবিতার পাশে অপূর্ব এক ক্লান্তির ঘুম দিচ্ছি আমি... ভালোবাসা সমস্ত লেখায় মিলেমিশে গেছে।


ফেব্রুয়ারীর ভালোবাসা এবং ভালভাষা।




ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষে
রাজর্ষি মজুমদার

উত্তর সম্পাদকীয় – চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য





পর্ব-১
অবিশ্বাসযোগ্য যৌনহেনস্থার অভিযোগে ক্ষতি মেয়েদেরই




“ঠোঙ্গা ভরা বাদাম ভাজা, খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না।” কি অনবদ্য লাইনটাই না লিখেছিলেন সুকুমার রায়! এতদিন পরও দেখা যাচ্ছে তাঁর বলা লাইনটা এক্কেবারে চুল-টু-পা ট্রু। আমাদের মাথার উপরে স্ব-মনোনীত অবিভাবকের মত বসে থাকা মিডিয়া-মনোহরেদের সম্পর্কে সুকুমার রায় কত বছর আগেও বিন্দাস আজকের হাল মানসচক্ষে দেখে আকাশবাণীর মত বলে রেখে গেলেন, ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। ইদানিং মিডিয়াই কেবল খাওয়ায়, আরে সুকুমার রায় কতদিন আগে এদেরকেও খাইয়ে গেছেন, ভাবা যায়!

কিছুদিন আগে শতবর্ষে পা দেওয়া এক সাংবাদিকের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কলকাতার এক সিনিয়ার সাংবাদিক বলছিলেন, “মিডিয়ার এখন নতুন নতুন বিট হয়েছে, যার মধ্যে পড়ে ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ। কোথায় কে কি মন্তব্য করল, তাঁর জন্যেও সতর্ক থাকতে হয়।” তারি সর্বশেষ এক মনহারক নিদর্শণ দেখা গেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আশোক গাঙ্গুলীর বিরুদ্ধে এক ল’ইন্টার্নিকে যৌনহেনস্থার অভিযোগে। অভিযোগ সত্যি না মিথ্যে, তা প্রমাণের অপেক্ষা না রেখেই মিডীয়াবাগীশরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিচার করতে। বিচার বলে বিচার, এক্কেবারে পঞ্চায়েতী রাজ। গাঁয়ের খবর পত্রিকা পেলে লুফে নিত! অভিযুক্তের মতামত শোনার দরকারই নেই। “অহম গাঁয়ের পঞ্চজন, মনে করিয়াছি, অভিযোগ সিত্য এবং অভিযুক্তই অপরাধী। ব্যস” হয়ে গেল পঞ্চায়েতের রায়। রায় মানলে সম্পত্তি ছেরে পালা, না মানলে গাঁয়ের বার করে দেব। অর্থাৎ, সোজাই যাও আর বাঁকা, তুমি যাও ঢাকা কিংবা মক্কা।

মামলাটার পূর্বাপর একটু ভেবে দেখুন, বেশ মজা পাবেন। ঐ মহিলা ইন্টার্নি ঘটনার এক বছর পর এ-বছর নভেম্বরে নিজের ব্লগে এঁকে লিখলেন ‘সম্প্রতি’ ঘটা এক কাহিনী বলে। সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারপতি ২০১২-র ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিজের হোটেলের রুমে তাঁকে ওয়াইন অফার করেছিলেন, মাথায় ও পিঠে হাত দিয়েছিলেন, হাতে চুমু খেয়েছিলেন। মহিলার মনে হয়েছিল এগুলি “আনওয়েলকাম বিহেভিয়ার’। তাই চলে আসতে চেয়েও ঐ বিচারপতির সঙ্গেই সে রাতে ডিনার খেয়ে তারপর ফেরেন। বিচারপতিই তাঁকে বাড়ি ফেরার গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন এবং গাড়ি পর্যন্ত তাঁকে ছেড়ে যান। সেখানেই তাঁর মনে হল, বিচারপতির আচরণ ‘অনওয়েলকাম বিহেভিয়ার, কিন্তু তিনি সেটা ব্লগেও প্রকাশ করলেন ২০১৩-র নভেম্বরে’, ১১ মাস বাদে।

এবার সূত্রগুলি মেলান। ঐ মহিলা খ্রিস্টান, তাই ২৫ ডিসেম্বর তাঁর উৎসবের রাত। উচ্চশিক্ষিতা ঐ মহিলা অন্য পার্টিতে যাওয়ার কথা ছিল। সে-রাতে খ্রিস্টান্দের ওয়াইন খাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। কেউ তা অফার করলে তা বরং তাঁদের রীতি মানার ভদ্রতা বলে গণ্য হওয়ার কথা। কোনও খ্রিস্টান বাড়িতে পৌষ সংক্রান্তির দিন যদি আপনাকে পিঠে খেতে দেয়, আপনি কি ভাবতেন? আনয়েলকাম বিহেভিয়ার হলে তো তাঁর তখনই চলে আসার কথা! তিনি সেখানে বসে ২৫-৩০পাতা টাইপ করার পর ডিনার খেয়ে বিচারপতিরই আনা গাড়িতে বাড়ি ফিরতেন না। এবং এ-সবই যদি মেনে নেয়া হয় যে মহিলাটিও ভদ্রতার খাতিরেি তৎক্ষণাৎ রিঅ্যাক্ট করেন নি, তাহলেও সেই অভিযোগ জানানোর জন্যে ১১ মাস! বিশ্বাস্য? এক জন আইনজীবির আচরণ কি বলছে?

আইনের ছাত্রী হিসাবে তিনি ভালই জানেন, যে কোনও ফৌজদারী অপরাধের অভিযোগ তখনই গ্রাহ্য হয়, যখন পুলিশে অভিযোগ এফআইআর বা জেনারেল ডায়েরি হিসাবে দায়ের করা হয়। পুলিশ তাঁর তদন্ত করে, মামলা হয়য় নিম্ন আদালতে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে জেলা আদালত, হাই কোর্ট তারপর সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে যায়। নদীর জল যেমন পাহাড় থেকে গড়িয়ে এসে সমুদ্রে এসে মেশাই তাঁর স্বাভাবিক পথ, উল্টোটা নয়; মামলার ক্ষেত্রেও ওটাই তাঁর স্বাভাবিক নিয়ম, উল্টোটা নয়। কিন্তু, বিচারপতির গাঙ্গুলীর বিরুদ্ধে অভিযোগের ঘটনায় দেখা গেল সমুদ্রের জল নদী বেয়ে পাহাড়ে যাচ্ছে।

বলার কারণ, মামলাটা নিম্ন আদালতে এলই না। কারণ, পুলিশে আজও কোনও অভিযোগই দায়ের হয় নি। ফলে জেলা আদালত, হাইকোর্ট ইত্যাদি সব ফালতু হয়ে গেল। সোজা গেল সুপ্রিম কোর্টে… না সেখানেও কোনও মামলা হয়য় নি, কেউ করেনি। প্রধান বিচারপতি স্বতপ্রণোদিত হয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটি করলেন অভিযোগের সত্যতা খতিয়ে দেখতে। সেই কমিটি আসলে প্রশাসনিক তদন্তের, বিচারবিভাগীয় নয়। রিপোর্টে সেই মহিলা ‘আনওয়েলকাম বিহেভিয়ার এর কথাই পুণরুক্তি করে প্রাথমিকভাবে তারাও অভিযোগের খানিকটা সত্যতা পেয়েছেন, যদিও বিচারপতি গাঙ্গুলী তা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের কমিটি বলে দিন, “যেহেতু ঘটনার সময় বিচারপতি গাঙ্গুলী সুপ্রিম কোর্ট থেকে অবসর নিয়েছেন, তাই এই অভিযোগের বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার এক্তিয়ার সুপ্রিম কোর্টের নেই।” তা ছাড়া ‘এই ল’ইন্টার্নি স্টেলা জেমসও সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে যুক্ত নন’ বলে সর্বোচ্চ আদালত এ নিয়ে কিছুই করতে পারে না। দেখুন, একথা বলছেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বের কমিটি, যিনি নিজেই বিচারপতির গাঙ্গুলীর অবসর উপলক্ষে প্রদত্ত পার্টিতে ছিলেন। তিনি কি এই কমিটি গড়ার আগে জানতেন না যে উনি ঘটনার আগেই অবসর নিয়ে নিয়েছেন? জানতেন না যে অভিযোগকারিনী সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাক্টিশ করেন না? সে অজ্ঞানতার দায় কার? অজ্ঞানতাপ্রসূত একটি মন্তব্য যে গোটা ঘটনায় একজন বিচারপতির মর্যাদায় কালি ছেটাল, তাঁর কি হবে? সুপ্রিম কোর্ট এমন মন্তব্য করার ফলে মামলাটি আর নিম্ন আদালতে গেলেও সুবিচার দূর অস্ত। ফলে, গোটা বিষয়টাই কেচিয়ে এল। যদি, সত্যি বিচারপতি গাঙ্গুলী অপরাধীও হন, তাও তো তাঁর ন্যায্য বিচার সম্ভন নয়!

তাহলে এমনটা হল কেন? এর উদ্দেশ্যই বা কি? এর পিছনে কি কোনও কোট-আনকোট ষড়যন্ত্র আছে বা ছিল?

এগুলিই এখন জরুরি প্রসঙ্গ। এই লেখা লেখার সময়েই জানা গেল, এত দেরিতে অভিযোগ জনসমক্ষে আনায় সুপ্রিম কোর্টও বিরক্তি প্রকাশ করেছে। কিন্তু, সত্যি বললে, মেয়েটি কিন্তু কোনও অভিযোগই জানায় নি। সে ব্লগে লিখেছিল তাঁর কথা – তা সে ঠিক বা বেঠিক – যাই হোক। তাকে মুখোরোচক করে খবরে এনেছে নির্দিষ্ট একটি সংবাদপত্র। তারপর অন্য মাধ্যমগুলি ঝাঁপিয়ে পড়ে। কি ছিল সেই সংবাদ মাধ্যমের উদ্দেশ্য? প্রাপ্ত অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই না করে ব্লগের ভিত্তিতে খবর কতটা যুক্তিসংগত? এ সব নানা প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। তারপরই দেখা গেল, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিচারপতি গাঙ্গুলীর অপসারণ চাইলেন। তিনি অবশ্য এক বচর আগে থেকেই বিচারপতি গাঙ্গুলীর উপর ক্ষুব্ধ। রাজ্যের মানবাধিকার কমিশনের প্রধান হিসাবে তিনি পার্ক স্ট্রিট ধর্ষোণ থেকে অম্বিকেশ মহাপাত্র মামলা, শীলাদিত্যকে মাওবাদী বলে অন্যায় গ্রেফতারের মত ঘটনা সহ বহু ক্ষেত্রে সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মনোভাব গোপন রাখেন নি, বরং বলেছিলেন, ““মানবাধিকার কমিশনে একজনকে আমরা বসালাম, তিনি এসে আমাদের বিরুদ্ধে রায় দিচ্ছেন।” যেন মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিয়োগে সুপারিশ করেছেন বলে তাঁকে রায় দেওয়ার সময় ধামাধরা হতে হবে! এ কেবল হাস্যকর দাবীই নয়, বিপজ্জনকও। কোনও রাজ্যের বা দেশের প্রধান যদি এই দাবী করেন, তাহলে ধরে নিতে হবে সে রাজ্যে বা দেশে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটেছে। যে বিচারপতি শ্রীমতী গান্ধীর নির্বাচনকে অবৈধ রায় দিয়েছিলেন, তাঁর নিয়োগও কিন্তু শ্রীমতী গান্ধীর সরকারি দিয়েছিল। তিনি কিন্তু এমন উদ্ভট তর্ক তোলার কথা স্বপ্নেও ভাবেন নি।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পদত্যাগ চেয়েছিলেন। এছাড়া কলকাতার আইন বিশ্ববিদ্যালয় এনইউজেএস-এর একদল অধ্যাপক সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর পদ থেকে বিচারপতি গাঙ্গুলীকে সরাতে কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়েছেন। এতেও আশ্চর্যের কিছু নেই। আইনজীবি কল্যাণবাবু তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ এবং দুর্মুখ, এটা সকলেই জানেন। মুখ্যমন্ত্রী ইস্তফা চাইলে সভাসদেরা যে ‘বলে তাঁর শতগুণ’, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ইস্তফা চেয়েছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের শীর্ষকর্তারাও, কারণ বিচারপতির সেদিনকার রিপোর্টে ক্লাবের বিপুল টাকা জরিমানা হয়েছিল। এই শীর্ষকর্তা আবার একই দলের রাজ্যসভা সাংসদ, অর্থাৎ সভাসদ। তাঁরা যে অপসারণ চাইবেন, এতে বিষ্ময়ের কি আছে!

বিষ্ময়ের বিষয় এল কেন্দ্রীয় সরকারের অতিরিক্ত সলসিটার জেনারেল (এএসজি) ইন্দিরা জয়সিংহ কলকাতায় এসে অভিযোগকারিণীর লিখিত বিবৃতি প্রকাশ করে এবং দিল্লিতে সংসদে বিরোধী নেত্রী বিজেপির সুষমা স্বরাজ বিচারপতির ইস্তফা চাওয়ায়। অভিযোগকারিনী সুপ্রিম কোর্টের তিন-সদস্যক কমিটিকে যে মৌখিক বিবৃতি (কেন মৌখিক, তাও প্রশ্নবোধক) দিয়েছিল, তাঁর কপি অভিযুক্ত বিচারপতি গাঙ্গুলীও পান নি, কারণ সেটি ছিল আদালতের সম্পত্তি। আদালতের সম্পত্তি কিন্তু সরকারের নয়। দি-তিন দিন পর সেটাই মুখ্যমন্ত্রীর প্রসাদধন্য কলকাতার এক বাণিজ্যিক কাগজে ছাপা হয়ে গেল! তাতে লেখা হল, কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মন্ত্রকের মাধ্যমে তাঁরা ঐ বিবৃতি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক এমন কাজ করতে পারে কি? আইন মন্ত্রক বেআইনি কাজ করে বসে নি তো? সেখানেই জানা গেল, অভিযোগকারিনী ম্যেটির নাম স্টেলা জেমস। নাম তো প্রকাশ তো বেআইনি! হল কেন? কারা করল? এএসজি ইন্দিরা জয় সিং কি করে সেই বিবৃতি প্রেস কনফারেন্সে প্রকাশ করলেন, যা সুপ্রিম কোর্টের ভাষায় ছিল গোপনীয়’?

এমন বহু প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য। ইতিমধ্যে আরেকজন বিচারপতির বিরুদ্ধেও অভিযোগ এসেছে, এবং এ-ক্ষেত্রেও অভিযোগকারিনী কলকাতার আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ইন্টার্নি। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আবার কেন্দ্রীয় গ্রিন ট্রাইবুনালের প্রধান বিচারপতি, যিনি পূর্বাঞ্চলের পরিবেশ আদালতটি কলকাতায় খোলার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন। তা ছাড়া, তাঁর দফতরে গিয়ে আটকে আছে এমন বহু বিনিয়োগের প্রকল্প, যেগুলি আদতে পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। এমনই এক প্রকল্পে বাঁধা দেওয়ার ফলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে জয়ন্তী নটরাজনের মত স্পষ্টবক্তা মন্ত্রীকে সরে যেতে হয়েছে।

ফলে প্রশ্ন উঠেছে, যৌনহেনস্থার এ-সব অভিযোগ কি আসলে বিচারপতিদের বিচার প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার একটি কৌশল হিসাবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হল? এখনই এই নিয়ে চূড়ান্ত মতামত না দিলেও এমন প্রশ্ন ওঠাকে কিন্তু আটকানো যাচ্ছে না। নিম্ন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্টের অনেক আইনজীবিই, যঅধিকাংশই মহিলা, এখন এই নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করেছেন। তাঁরা চিন্তিত, এর পর বিচারপতিরা মহিলা ইন্টার্নদের আর সুযোগ দেবেন তো? এমনকি চেম্বার অ্যাডভোকেট হিসাবেও মহিলা আইনজীবিদের সুযোগ সত্যিই কমে গেল কি না! যদি একটি ঘটনাতেও প্রমাণিত হয় যে, অভিযোগটি কেবল মিথ্যাই নয়, ষড়যন্ত্রমূলক; সে ক্ষেত্রে অভিযোগকারিনীর পরিচয় গোপন রাখা যাবে তো? অভিযোগকারিনী যদি বয়ান বদল করে থাকেন, তাহলে আইনের চোখে তিনিই হয়ে যাবেন ‘কন্ডেমন্ড লায়ার’, বা স্বঘোষিত মিথ্যাবাদী। গুজরাত দাঙ্গার বেস্ট বেকারী মামলায় এই কারণে শাস্তি পেয়েছেন তিনি, যার পরিবারের প্রায় সবাই দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন। এমন হলে কিন্তু সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হবে মহিলাদেরই। স্বার্থের ষড়যন্ত্রে আর কেউ জড়িয়ে পড়ার আগে, এই পরিণতিটাও মনে রাখা ভাল।







পর্ব-২
ধর্ষণের হ-য-ব-র-ল ঘটিয়ে দিল সর্বোচ্চ আদালত




মাঝের একটি সংখ্যায় আর আপনাদের জ্বালাতে আসিনি। বইমেলা নিয়েই মেতে ছিলাম। তাই এই লেখার শেষাংশ পাচ্ছেন এক মাস পর। আগের সংখ্যায় খেপচুরিয়ান-এর সম্পাদকমণ্ডলী এই লেখার উপর বিতর্কের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। দেখলাম, দুজন এই লেখা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। এক বন্ধু মিলন চ্যাটার্জি লিখেছেন, “বেশ ভালো লাগছে পড়তে । দেখা যাক আরও :)।” আরেক বন্ধু গৌতম চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “বিচারপতি গাঙ্গুলির কি দরকার ছিল ৩-জি স্ক্যামে রায় দেবার যেখানে অনেক দলের সংযুক্তি থাকতে পারে অথবা বাংলার জনবন্ধু সরকারের বিরাগভাজন নির্দেশ দেবার তাহলে এই অমূলক অভিযোগ উঠতই না!!!”

ধন্যবার মিলনবাবু, পরের অংশটা এবার দেখে নিন। মতামত জানান। আর, ধন্যবাদ গৌতমবাবু! আপনিই ঠিক। শাসনও সেটাই চায়। সরকারের পদলেহনকারী বিচারক এবং বিচারের রায়। এমনিতেই যে কোনও সরকার অ্যাডভোকেট জেনারেল, সলিসিটার জেনারেল ও অ্যাডিশনাল সলিসিটার জেনারেল পদে তাঁদেরই নিয়োগ করে, যারা সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থ বহন করবে। মামলায় তাঁরা সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থকেই রক্ষা করার চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কাজেই, অ্যাডিশনাল সলিসিটার জেনারেল পদে ইন্দিরা জয় সিং-এর নিয়োগ পুরোপুরি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ-কারণেই আশোক গাঙ্গুলীর বিরুদ্ধে তাঁর উষ্মা প্রকাশ স্বাভাবিক। মুম্বাইয়ের বাসিন্দা শ্রীমতি জয় সিং কিন্তু মূলত আইন-বিশেষজ্ঞ নন, নারীবাদী আন্দোলনের একজন এক্টিভিস্ট। ইউপিএ সরকার বর্তমান পদে তাঁকে নিয়োগ করে চেয়েছিল ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করাতে। কিন্তু, তাঁর অনভিজ্ঞতায় সেটি বর্তমানে নানা আইনী বাধায় আটকে গিয়েছে। এক্টিভিজম এক বিষয়, আর আইন প্রণয়ন আরেক বিষয়। এই দুইয়ের মেলবন্ধন অসম্ভব না হলেও বড়ই যে কঠিন, তা শ্রীমতী জয় সিং ভালই বুঝতে পারছেন। বর্তমান পদে তাঁর রাজনৈতিক নিয়োগে তিনি সচেতন । তাই সর্বোচ্চ আদালতেই বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজুর একটি মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছিলেন, “আমরা ল-অফিসার, সরকারের মুখপাত্র না। আশা করি, আমি যদি কোনও বিচারকের ন্যায্য সমালোচনা করি, সরকার আমার পাশে থাকবে”।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেওয়ার আগের দিন, অর্থাৎ ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ তারিখে বিচারপতি আশোক গাঙ্গুলীর বেঞ্চ ২-জি মামলার ১২২টি লাইসেন্স বাতিল করে রায় ঘোষণা করেন।
এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশী যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁরা দেশের বড় বড় কর্পোরেট হাউস – যার মধ্যে টাটা ও আম্বানীরাও আছে। তাদের কোচড়ে রাখা থাকে গুচ্ছ গুচ্ছ মিডিয়ার ম্যানেজার থেকে মালিক। টাটাদের নিজস্ব বৈষ্ণবী কমিউনিকেশনের নীরা রাডিয়ার ভূমিকা নিশ্চয় কেউ ভুলে যান নি। যতদূর জানা যায়, আম্বানীদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক আছে ইন্দিরা জয় সিং ও তাঁর নারীবাদী সংগঠনের। ফলে, প্রতিশোধ নেওয়ার এমন একটা সুযোগ কেউ ছাড়তেও চান নি।

আর কংগ্রেসের খেপে যাওয়ার আরও অনেক কারন আছে। জব্বলপুরের এডিএম বনাম শিবকান্ত শুক্লা মামলায় বিচারপতি আশোক গাঙ্গুলী ও বিচারপতি আফতাব আলমের বেঞ্চ রায় দিয়েছিল যে, ১৯৭৫-এ জরুরী অবস্থার সময়ে সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় জনগণের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করেছিল। তাঁদের মতে, জরুরি অবস্থার সময় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ-সদস্যক সংবিধান বেঞ্চ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার স্থগিত রেখে এই অন্যায় করেছিল। তা ছাড়া, এক রায়ে তিনি বলেছিলেন, মানবিক কারণে দণ্ডপ্রাপ্তের শাস্তি মকুব বা কমাতেই পারেন রাষ্ট্রপতি বা এই মর্মে রাজ্যপাল সুপারিশ করতেই পারেন। কিন্তু, তাঁরা কেউই আইনের দায়রায় থাকা বিষয় নিয়ে কোনও বিরূপ মন্তব্য করতে পারেন না। এমন ঘটনা ঘটলে সেই মন্তব্য সেটি আইনী বৈধতা পাবে না এবং সেক্ষেত্রে আইনের হাতকেই অহেতুক লম্বা করার প্রশ্ন আসবে।

সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি আইনী ব্যাখ্যায় দেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার দায়রায় প্রবেশ না করেও তাঁর মন্তব্যের অধিকারের আইনী বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এমন ঘটনার নজীর অতীতে নেই। ফলে, কংগ্রেসের পক্ষে সহজে বিচারপতি গাঙ্গুলীকে মেনে নেওয়া কঠিন ছিলই। সামান্যতম সুযোগকে তাই ব্যবহার করার জনে উঠে পড়ে লাগেন সলিসিটার জেনারেল বাহনাবতী ও শ্রীমতী জয় সিং। বিষয়টি সরাসরি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে চাপ সৃষ্টি করেন, যা একেবারেই কাম্য ছিল না। তাঁরা আসলে যা করেছেন, তা বস্তুত কেন্দ্রীয় ক্ষমতার নগ্ন অপব্যবহার। তাঁরা সহজেই পারতেন, মামলাটি দিল্লিরই নিম্ন আদালতে দায়ের করে বিচারপতি গাঙ্গুলির বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু, তাঁরা তা করেন নি। কারণ, সেক্ষেত্রে অপমানজনক পরাজয়ের নিশ্চিত রায় তাঁরা আগেই পড়তে পেরেছিলেন।

এবার আসি বিজেপির প্রসঙ্গে। তাঁদের পক্ষ থেকে ইস্তফার দাবীর পিছনে আছে বাণিজ্যিক মহলের অস্বস্তি। বিজেপি এখন ভারতের কর্পোরেট দুনিয়ার প্রশ্রয়ধন্য। তাঁদের ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদিকে পূর্ণত মদত দিচ্ছেন মুকেশ আম্বানীর রিলায়েন্স গোষ্ঠী। আম আদমি পার্টির অন্যতম শীর্ষ নেতা তথা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ তো সরাসরি নরেন্দ্র মোদীকে আম্বানীদের সংস্থা ‘রিলায়েন্সের হাতের পুতুল’ বলে মন্তব্য করেছেন। কর্পোরেট লবি চায় মোদীকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে দেখতে। প্রকাশিত তথ্যে প্রমাণ, কর্পোরেটের সবচেয়ে বেশী দান ঢুকছে বিজেপিরই ফাণ্ডে। তাঁদের মধ্যেও অন্যতম আম্বানীরা। কেবল তাই নয়, গুজরাতে অন্যায়ভাবে বিদ্যুৎ বন্টনের বরাত কম দর দেওয়া সরকারি সংস্থার বদলে বেশী দর দেওয়া আদানী গ্রুপ-কে দেওয়ার অভিযোগ আগেই এনেছিলেন। এবার গ্যাসের দাম নির্ধারণ নিয়ে মোদীর নীরবতার প্রসঙ্গ টেনে নীরা রাডিয়া ও সংযুক্ত জনতা দলের এন কে সিং এর সঙ্গে কথোপকথনের উল্লেখ করেন। ওই কথাবার্তাতেই রিলায়েন্সকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রধান বক্তা অরুণ শৌরীকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আম্বানীদের বিরুদ্ধে রাজনীতির অঙ্গনে অর্থ ও নানা উপঢৌকনে নিজের স্বার্থে কাজ করানোর অভিযোগও নতুন নয়। শেয়ার কেলেঙ্কারির সময়ে গুরুদাস দাসগুপ্ত তাঁর বাড়িতে আম্বানীদের পাঠানো ঝুড়ি ঝুড়ি আলফান্সো আম ফেরত পাঠিয়ে সরকারি স্তরে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। কংগ্রেসের একটি সূত্রে প্রকাশ, ইন্দিরা হত্যার পর নির্বাচনে চরম আর্থিক টানাটানির কারণে রাজীব গান্ধী প্রার্থী পিছু দু-লাখ টাকার বেশী দিতে পারেন নি। তখন আম্বানীরা এসে রাজীব গান্ধীকে কয়েকশো কোটি টাকা দিতে চেয়েছিলেন। রাজীবকে তাঁরা বলেছিল যে, এই টাকা শ্রীমতী গান্ধীর একটি গোপন একাউন্টের, যা তাঁদের কাছে রাখা ছিল। রাজীব তাঁকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরে, বলিউডের এক নামী অভিনেতার মাধ্যমে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর বাংলার এক নামী কংগ্রেস-ত্যাগী রাজনীতিবিদ নিজের দল তুলে দিয়ে ফের কংগ্রেসে ঢুকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করেন, নরসীমা রাওয়ের সরকারে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীত্বও পান। বর্তমানে সেই নেতা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও কংগ্রেসে আর নেই। বস্তুত, আশোক গাঙ্গুলীর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় চক্রান্তে তাঁকেও জড়িয়ে দেওয়ার পরই বিচারপতি গাঙ্গুলী ইস্তফা দেন।

এবার বাকি রইল শেষ একটি প্রশ্ন – অভিযোগকারিনী কেন এতবড় একটা ঝুকি নিলেন? তিনি আইন্সের ছাত্রী হয়েও আইনের পথে যান নি। আবার সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যক কমিটি বেআইনি জেনেও তিনি সেখানে মৌখিক বিবৃতি দিয়েছেন। আবার তাঁর দেওয়া ৬০ পাতার মৌখিক বিবৃতির সঙ্গে তাঁর ব্লগে লেখা বিবৃতির আকাশ-পাতাল ফারাক। আইনের ছাত্রী হিসাবে তিনি নিশ্চয়ই জানেন, আদালত গেলে বয়ান বদলের কারণে তাঁকে ‘হোস্টাইল’ ঘোষণা করে দিত আদালত। তিনি এও জানেন যে, কারও মর্যাদাহানী করাও সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ২১ ধারার পরিপন্থী। তা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে কেন যে রাজনীতির খেলার পুতুল করে ফেললেন, সেটাই রহস্যের। তথ্যে জানা যাচ্ছে, খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী অভিযোগকারিনী যিনি নিজেই লিখেছেন যে ২৫ ডিসেম্বর তাঁদের ধার্মিক অনুষ্ঠান এবং তাঁর সেদিন তেমন এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল) আসলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্যের অত্যন্ত ঘনিষ্ট আত্মীয়। পশ্চিমবাংলা থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্যসভায় নির্বাচিত সেই সাংসদের নাম ডেরেক ও-ব্রায়ান বলেই প্রকাশ।

আরেকবার দেশের প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্তের দ্বিচারিতার প্রসঙ্গটি দেখা যাক। স্টেলা জেমসের তোলা অভিযোগ নিয়ে জলঘোলার পর সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি স্বতন্ত্রকুমারের বিরুদ্ধেও এমনই যৌনহেনস্থার অভিযোগ আনেন আরেকজন মহিলা। দুটি মামলার মধ্যে তফাৎ হল, ঘটনাটির সময় স্বতন্ত্রকুমার সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি হিসাবে কর্মরত ছিলেন। আর মিল হচ্ছে, বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় পরিবেশ ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান, যার কাছে গিয়ে আটকে গেছে অনেকগুলি পরিবেশ ধংসের শিল্পায়ন ও নগরায়নের প্রস্তাব। সেক্ষেত্রেও ক্ষতি হচ্ছে কর্পোরেট লবির। এবং, অভিযোগকারিনী স্টেলার মতই কলকাতার এনইউজেএস-এঁর স্নাতক। কিন্তু, এবার প্রধান বিচারপতি সদাশিবম পত্রপাঠ সেই ইন্টার্নকে বিদায় করে বলেছেন, প্রাক্তন বিচারপতিদের বিরুদ্ধে বিচার করার কোনও এক্তিয়ার সুপ্রিম কোর্টের নেই। তাঁর এই বোধোদয় অশোক গাঙ্গুলীর সময় হয় নি কেন? নাকি, তিনি নিজেই আইনের এক্তিয়ার জানতেন না? শেষেরটি হলে তো দুশ্চিন্তার বিষয় – কার হাতে রয়েছে সর্বোচ বিচারের ভার! তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, এমন মামলার কোনও ‘মেকানিজম’ সর্বোচ আদালতের নেই। সেই মেকানিজম সম্পর্কে পরামর্শ দানের জন্য দু-জনকে ‘আদালত-বান্ধব’ (এমিকাস ক্যুরি) নিয়োগ করেছেন। তাহলে, অশোক গাঙ্গুলির ক্ষেত্রে তিনি কোনও মেকানিজম ফলো করেছেন? তা ছাড়া, প্রধান বিচারপতি কি বিচারের মেকানিজম তৈরি করতে পারেন? সে তো আইনসভার কাজ।

এই ক্ষেত্রে অভিযোগকারিণীর পিছনে কারা টাকার থলি নিয়ে দাড়িয়েছিলেন, সেটি এখনও অন্ধকারে। কিন্তু, তাঁর ছায়া দেখা যাছে। অভিযোগকারিণীর আইনজীবি হিসাবে প্রকাশ্যে এসেছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবি হরিশ সালভে। তাঁর এক দিনের ফি ছয় লক্ষ টাকা বলে শোনা যায়। তাহলেই ভেবে দেখুন! অভিযোগকারিণীর হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, সিএনএন-আইবিএন। বিচারপতি স্বতন্ত্রকুমার এই সংবাদমাধ্যমগুলির বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের মানহানীর মামলা ঠুকে দিয়েছেন। আদালত বাধ্য হয়েই এই সংবাদমাধ্যমগুলিতে বিচারপতি স্বতন্ত্রকুমারের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই মামলার রায় প্রকাশ্যে এলে ষড়যন্ত্রের পর্দা ফাঁস হলেও হতে পারে।

কিন্তু, দ্বিতীয় ঘটনাটিকে বাতিল করে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, এতদিন পর কবর খুঁড়ে এসন মামলা সামনে আনার কোনও যৌক্তিকতা নেই। বিশেষ করে মেয়েটি নিজেই যেখানে আইনের ছাত্রী এবং তাঁর কি করণীয় ছিল, তা তিনি জানতেন; তবু তা করেননি। ঠিক বলেছেন প্রধান বিচারপতি সদাশিবম। কিন্তু, অশোক গাঙ্গুলির বেলায় এই সামান্য যুক্তি তাঁর মাথায় আসে নি কেন, তা যে বোঝা গেল না! এমনকি, প্রধান বিচারপতি স্বতন্ত্রকুমারের বিরুদ্ধে মেয়েটির দায়ের করা হলফনামার গুণাগুণ নিয়েও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন। সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু, অশোক গাঙ্গুলির ক্ষেত্রে শুধু হলফনামার ভিতিতেই যে তিনি বিচারপতি গাঙ্গুলিকে দোষী ঠাউরে ফেলেছেন? কোনও তদন্তের ধার দিয়েও যান নি! তবে কি তিনি নিজেও আইনের প্রাথনিক শর্তটাই লঙ্ঘন করে ফেলেছেন? সেখানে তো বলা হয়েছে, শত অপরাধী মুক্তি পেয়ে যেতে পারেন, কিন্তু একজনও নিরাপরাধ যেন শাস্তি না পান। স্টেলা জেমসের ঘটনায় ইন্দিরা জয় সিং দিল্লি থেকে উড়ে এসে সাংবাদিক সম্মেলন করে অশোক গাঙ্গুলির ইস্তিফা দাবি করলেও স্বতন্ত্রকুমারের ঘটনায় ‘নারী আন্দোলনের এক্টিভিস্ট’ হওয়া স্বত্ত্বেও তিনি ততোধিক নীরব। কেন?

অতএব বোঝা যাচ্ছে, গোটা ঘটনাতেই একটা হ-য-ব-র-ল হয়ে গিয়েছে। সুকুমার রায় থাকলে বিশেষজ্ঞ্র মতামত দিতে পারতেন। আমরা বুঝি, রাজনীতিকেই সব কিছুর নিয়ন্তা ভাবতে গিয়ে ক্ষমতাসীনরা ধর্ষণের মত লজ্জাজনক ঘটনাকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছেন। এই অপ-রাজনীতির অবসান হওয়া জরুরি।

গল্প - তন্ময় ভট্টাচার্য

ম্যাডাম
তন্ময় ভট্টাচার্য



(১)

সল্টলেক আমার ভালো লাগে না। চারদিকে একই মাপের বাড়ি,বেশিরভাগই ফ্ল্যাট। প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটের নীচে পুরু ধুলোয় মোড়া গাড়ি দাঁড় করানো। সমান মাপের রাস্তা এদিক থেকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আধখেঁচড়া গাছ আর পার্কের হুজ্জতি। সকাল-বিকেল গলায় আইডি ঝোলানো মেয়েরা ছোটাছুটি করছে চাকরির ঠ্যালায়। তবে ওখানকার বেশিরভাগ মেয়েরই ফিগার যে একদম আইডিয়াল,মানতেই হয়। খটখট করতে করতে চুলখোলা মেয়েরা কাঁধে বা পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে আইল্যান্ড প্রদক্ষিণ করছে,যেন বা কোনো মন্দিরের গর্ভগৃহ! ফ্ল্যাটগুলোও বলিহারি! একটা জানলা দিয়ে তাকালে পাশের ফ্ল্যাটের জানলায় ঝোলানো গামছা হামেশাই চোখে পড়ে। খুব প্রয়োজন না হলে ওদিকের ছায়া মাড়াই না আমি। আজ আসতে হয়েছে নিতান্ত ইলিনা’র কথায়। বলেছিলাম কফি হাউসে মিট করতে,রাজি হয়নি। সিটি সেন্টারের কে.এফ.সি.-তে না ঢুকলে নাকি জাত চলে যায়। অগত্যা বিধাননগর স্টেশনে নেমে দাঁড়িয়ে আছি অটোস্ট্যান্ডে।



ইলিনার সঙ্গে এই প্রথম দেখা হবে আমার। অবশ্য এর আগেই মুখ দেখেছি ফেসবুক ঘেঁটে, চ্যাট,ফোন,মেসেজ ইত্যাদি পূর্বরাগও কমপ্লিট। এখন জাস্ট মুখোমুখি পটিয়ে ফেলার পালা। আঁতলামি করে জিনসের সঙ্গে নীলচে একটা কুর্তা পরে এসেছি,চোখে ঠাকুরদা টাইপ ফ্রেম। হাজার হোক,কবিতার লেজ ধরে যখন আলাপ, প্রথম ইম্প্রেশনে লুকটাও সেইমতোই হতে হবে বইকি! ও বলেছে স্কার্ট আর ব্লু টপ পরে আসবে( আমার নীল কুর্তা পরার এটাও একটা কারণ)। ও আসবে লেকটাউনের দিক থেকে। তারপর একসাথে মিট করে যাবো।



(২)

কাল টুপুসের সাথে দেখা করেছি। আমি নড়িনি বিশেষ। ও-ই ছুটে এসেছে বেলঘরিয়ায়। হাজার হোক,মেয়েটা তো আমার ওপর ফিদা! এ’কদিনে বার আষ্টেক প্রপোজ করেছে আমায়। ঝুলিয়ে রেখেছি। এতো সহজে ধরা দিলে ফেঁসে যাবো নির্ঘাত। সন্ধ্যায় টেক্সম্যাকোর রাস্তায় হাঁটছিলাম দু’জনে হাত ধরে। ও বিড়বিড় করে অনেক কথা বলে যাচ্ছিল। বকতেও পারে মাইরি! আমি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে হুঁ-হাঁ করে যাচ্ছি, এমন সময় সৈকতের বাবা দেখে ফেলে আমাদের। বড়বড় চোখ করে আমায় গিলতে গিলতে সাইকেল নিয়ে চলে যায় সামনে। আমার ইচ্ছে করছিল দৌড়ে কেরিয়ারটা ধরে নাড়িয়ে দিই। শালা তোমার ছেলে তো একটা আতাক্যালানে, বাপের বগলের নীচে গন্ধ শুঁকে বেড়ায়,আমার প্রেমে তোমার এত হুড়কো দেয়া কেন! জানতাম নির্ঘাত আমার বাড়ি বয়ে মা’র কানে তুলবে কথাটা। ভয়ে টুপুসের হাত আস্তে আস্তে ছেড়ে দিতেই উঁচু হয়ে আমার গালে চুমু খেল মেয়েটা। আমি সাথেসাথে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছি। পা পিছলে ফুটপাথ থেকে পড়ে গিয়ে সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। বাকি পথ মেয়েটা একটাও কথা বলেনি। ওকে ট্রেনে তুলে দিয়ে মেসেজে ‘সরি’ বলেছি বহুবার,নো রিপ্লাই। সৈকতের বাবার জন্য কাল সন্ধ্যেটা ব্ল্যাক স্পট হয়ে রইল লাইফে। আজ তাই রিফ্রেশমেন্টের জন্য ইলিনার সাথে মিট করাটা বড্ডো জরুরি।



(৩)

ইলিনা ফোন করল জাস্ট। ওর আঙ্কেলের দূরসম্পর্কের শ্বাশুড়ি মারা গেছে। আসবে না তাই। মন খারাপ নাকি! রাগে সিগারেটটা এত দূরে ছুঁড়লাম যে একটা কুকুর কেঁউকেঁউ করে পালিয়ে গেল। একটা বাস ধরে চলে গেলাম রবীন্দ্রসদন। ওখানে রোজ কিছু না কিছু লেগেই থাকে। গিয়ে দেখি সুচিত্রা সেনের স্মরণসভা। ধুর ধুর! কবেকার কোন ধুমসি সাদাকালো অ্যাকট্রেস,মরেছে বেশ হয়েছে। তা নিয়ে এত আদিখ্যেতা কিসের! পাবলিক পারেও বটে! মান্না দে মরল তো রুমাল ভেজাও,সুচিত্রা মরল তো রুমাল ভেজাও...মোমবাতির কোম্পানিগুলো এদের আর রেপের জন্যেই টিকে আছে! যদিও এভাবে অবজ্ঞা দেখান ঠিক না। লোকে আমায় অল্প অল্প করে চিনছে এখন কবি হিসেবে। মুখ বেঁকিয়ে যদি চলে যাই আর চেনা কেউ দেখে ফ্যালে, ফেসবুকে প্রেস্টিজ পাংচার। চোখ বুজে একমিনিট হাতজোড় করে দাঁড়ালাম,প্রাণপণে খিস্তি মেরে নাক টেনে একাকার দশা। একটা সলিড মাল তখন থেকে আমার ওপর লক্ষ্য রাখছিল। এখন এগিয়ে এসে মুখের সামনে মাইক তুলে জিজ্ঞেস করল – “ মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের মৃত্যুতে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?” কান গরম হয়ে গেল আমার। শালা এর জন্য বুক দুলিয়ে ছুটে এসেছে ওই প্রান্ত থেকে! নাকে সর্দি ঘড়ঘড় করে বললাম, “আমি শোকস্তব্ধ। বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না”। আবার প্রশ্ন – “আপনাদের ইয়ং জেনারেশানের কাছে উনি কতটা জনপ্রিয় ছিলেন প্লিজ আমাদের সাথে যদি শেয়ার করেন!” আমি বললাম – “উনি তো কোনো টাইমে বাঁধা পড়েননি। সব বয়েসের সব বাঙালির কাছে উনি সমান পপুলার”। “থ্যাঙ্কস” বলে সরে গেল মেয়েটা। উফফ! ওর সাদা শার্টের ভেতরে লাল স্ট্র্যাপটা বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার। এও নিশ্চয়ই সল্টলেকের মাল! বিরক্তি আর ভালোলাগার চানাচুর মেশানো একটা মুখ করে তাকালাম সুচিত্রা সেনের দিকে। ছোটবেলায় ঠাম্মার সাথে বেশ কয়েকটা ছবি দেখেছি ইনার। শাড়ি পরে ল্যাতপ্যাত করতে করতে সে এক যাচ্ছেতাই ব্যাপার। আজকাল ডাক্তাররা কেন যে ঘুমের ওষুধ হিসেবে সে-আমলের সিনেমা দেখতে বলে না সেটাই আশ্চর্যের!



নন্দনে ঢুকলাম। সেখানেও ছবি,মালা পরাচ্ছে অনেকেই। দূর থেকে একটা মেয়েকে খুব চেনা-চেনা লাগলো। কোথায় যেন দেখেছি। মোবাইলে ফেসবুক খুলে ইলিনার প্রোফাইলে যেতেই থ মেরে গেলাম। মেয়েটা এখানে কি করছে! দিব্যি সানগ্লাস আর টিশার্ট পরা একটা ছেলের হাত আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে সুচিত্রা সেনের সামনে। ওর না আজ আঙ্কেলের শ্বাশুড়ির... আর ভাবতে পারলাম না। মেট্রো ধরে দমদম,সেখান থেকে ট্রেন ধরে সোজা বেলঘরিয়া। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে শুনলাম মা কম্পিউটারে গান চালিয়েছে – “কিছুক্ষণ আরো না হয় রহিতে কাছে!”

ব্যক্তিগত গদ্য - সুপ্রভাত রায়

আনটাইটেল্‌ড
সুপ্রভাত রায়



সহজ পাঠে আঙিনা প্রসঙ্গটা অনেকবার এসেছে দেখেছি বড় হয়ে। আঙিনা মানে যে উঠোন সেটা আমায় কে প্রথম বলে দিয়েছিল কে জানে। ক্লাস টু এর রুমু পড়া নিতে এসে বলল স্যার তোমাদের বাড়িতে উঠোন আছে ? উত্তরে আমাদের বাড়ির উঠোনটার সাইজে যেটুকু ছোট্ট করে হ্যাঁ বলা যায়; বললাম। আর পড়াতে গিয়ে ওকে আমাদের স্কুলের ডবল এক্সএল উঠোনটা দেখিয়ে উদাহরণ টেনেছিলাম। ও বলল ওদের বাড়িতেও আছে। যেন সেই সময়ের কালার টিভি, তোমাদের বাড়িতে আছে ? আমাদের বাড়িতেও আছে। উঠোন শব্দটা হয়ত আমাদের বেঁচেটেঁচে থাকতে থাকতেই টেঁশে যাবে। আর স্টিফেন স্পিলবার্গ যদি উঠোন নিয়ে কোনো ছবি না বানান তা হলে তো আর পরের বাকিরা চোখে চেখে দেখতেও পাবে না টেকনিক্যালি উঠোন জিনিসটা ঠিক কি রকম দেখতেটেখতে ছিল। একটা হেব্বি উঠোন ছিল আমাদের সেই পুরনো মাটির বাড়িটায়। ঝড়ের পূর্বাভাসে আতঙ্ক ভেসে উঠত যখন আমাদের সব্বার মনের স্ক্রিনে, বা ঝড়টা যখন নেট প্র্যাক্টিস করত—ঠিক সেই রকম সময়ে জেমা (জেঠিমা) আমাকে একটা পিঁড়ে দিয়ে মন্ত্র শিখিয়ে দিত ‘পবনদেব শান্ত হও পবনদেব শান্ত হও পবনদেব শান্ত হও’। মাঝ উঠোনে এই মন্ত্রটা বলে পিঁড়েটা পেতে আসতাম আমি। পবনদেব শান্ত হয়ে খুব একটা বসতেন না পিঁড়েতে। উনার বোধ হয় পিঁড়ে পছন্দ ছিল না, ঘোরানো চেয়ার পছন্দ ছিল।

ব্যক্তিগত গদ্য – আলোকপর্ণা

বন্ধ কারখানা
অলোকপর্ণা



আইসি সফেদি অউর কাহাঁ


পুরনো ফটোফ্রেম তুলে নিয়ে গেলে দেওয়ালে যেমন তারই সাদা অবয়বটুকু পড়ে থাকে, আমি আমার হাতের পাতায় তাকাই, বুঝি, এইখানে কাউকে ধরতে চেয়েছিলাম। এখন সমগ্র পাতা জুড়ে শুধুমাত্র তারই ছোঁয়াচ লেগে আছে। মুঠো খুলে হাওয়ায় ছোঁয়াচগুলো উড়িয়ে দিতে শূন্য হাতে আকাশ থেকে বৃষ্টি নেমে এল, যেন সব সাদা ধুয়ে ফেলার প্রচেষ্টায়। আমি জানি, এসব কিছুই নয়, এখন শুধুমাত্র নিরীহ বর্ষাকাল।

ভীড়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। একেকটা গল্প ঘাড়ে বৃষ্টির ফোঁটারা নেমে আসছে মাটিতে, আমায় পাশকাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে একে অন্যের হাত ধরে, গল্প তৈরি হচ্ছে। গল্পে ঠাসা শহরে আমি আমার গল্প খুঁজতে বেরিয়েছি, আমার নামে কি একটাও বৃষ্টি নামল কোথাও? রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথে উঠে এলাম। এছাড়াও এখানে কুকুরের বাচ্চা, নোংরা ভিখারি, প্লাস্টিকের চায়ের কাপ দাঁড়িয়ে আছে, গল্প খুঁজে পাওয়ার আশায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি গল্পের ট্রাম চলে গেল গঙ্গার দিকে, দেখছি ফুটপাথের পসরা থেকে তুই ঘড়ি তুলে নিচ্ছিস, হাতে পরে নিচ্ছিস ‘হরেক মাল একশোর’ আমার সস্তা সময়। তোর ইচ্ছেয় মিনিটের কাঁটা দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে স্টেশনের দিকে, আর তুই একলাফে ট্রেনে উঠে পড়লি, তোর ট্রেন তোর গল্প নিয়ে দূরে... চলে যাচ্ছে।

আমি পরের পাতা ওলটালাম। সমস্তটা সাদা। হাতের পাতায় মা প্রথম অন্ধকারে কিছু আদুরে ক্রিসক্রস এঁকে দিয়েছিল, কিন্তু এখানে- একটা অক্ষরও নেই।





আমি জিভ দিয়ে দাঁত গুণে দেখলাম... তিরিশ। আর মাত্র দুবার, তারপর নতুন আর কিছুই তৈরি হবে না আমার শরীরে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বন্ধ কারখানা হাতড়ালে, বালিতে ডুবে আসবে হাত, ঝিনুক ফেলে গেছে কারা যেন, এখানে সেখানে ভেজা পায়ের ছাপ। নিজেদের সমুদ্র ছেড়ে কেউ কেউ উঠে চলে গিয়েছে। পড়ে আছে শাঁখের শূন্য খোলস, সাদা।



দর্দ আচ্ছে হ্যায়

ছোটবেলার কষ্টগুলো ফার্স্টবেঞ্চে বসা, আড়ি- ভাব, বেস্টফ্রেন্ড, কারেন্ট চলে গিয়ে মিকিমাউস ক্লাব হাউস দেখতে না পারা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ওরা টের পায়নি কখন আমার জামাগুলো গায়ে ছোট হতে শুরু করল বা ওরাও তুচ্ছ হতে থাকল আমার কাছে। এমনকি আমিও বুঝতাম না মাঝরাতে কিসের জন্য অন্ধকার ছাদে গিয়ে দাঁড়াতাম, অন্ধকার দেখে যেতাম একনাগাড়ে। আঁকার স্যর বললেন, “তুই কিছু খুঁজছিস আসলে।” আমি ‘আসলে’ কি খুঁজছি? বড় বড় কষ্টদের এড়াতে ছোট হয়ে যাওয়া কষ্টদের খুঁজে ফিরছি, অন্ধকারে?

ঘরের কোণায় প্যান্ডোরার বাক্সটা রাখা, ততদিনে আমার টেক্সট বইয়ে ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’ শব্দটা যুক্ত হয়ে গেছে। আমি বাক্স খুলে তোকে বার করে আনি, অ্যালবামে তুই হাসছিস, দ্বিতীয় পাতায় তুই আমার দিকেই তাকিয়ে, যেন আলতামিরা গুহাচিত্রের মত আজন্মকাল থাকবি!! (হাস্যকর), তৃতীয় পাতায় কোনো ছবি নেই, ব্ল্যাংক। আমি আর্তনাদ করে উঠি, দেখতে পাইনা কিচ্ছু, চেঁচিয়ে বলি, “এটা কি হল! কেন এরকম হয়...”



তোর ছবিরা বাক্স থেকে দ্রুত বেরিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে যায়, ওড়াউড়ি করে, ওদের সঙ্গে লড়াই করে একসময় আমি অবসন্ন হয়ে পড়ি, দেখি বাক্সের তলায় পড়ে আছে আমার ছোট ছোট কষ্টগুলো। আমি ওদের নিয়ে জোর করে ব্যস্ত হই এবার। ভাবি অভি কেন আমায় খেলায় নিল না, ভাবি অনন্যা কেন গ্রিটিংস কার্ড দেয়নি ১৯৯৮এ, বাবা কেন কোলকাতায় দুর্গাপুজো দেখাতে নিয়ে যায়নি কোনোদিন, কেনই বা জন্মদিনে কেক আসেনি কখনও... আমি খেয়াল করি,- তুই ছোট হয়ে আসছিস এতদিন ধরে জমে থাকা অন্যসব ‘কেন’র পাশে। প্যান্ডোরার বাক্সে মাথা রেখে ঘুম নেমে এল। চোখ বুজতে বুজতে যে দীর্ঘশ্বাসটা এসে দাঁড়াল আমার সামনে, গায়ে বিষণ্ণতার চাদর টেনে দিয়ে সে বলে গেল, “দর্দ আচ্ছে হ্যায়।”





আই হ্যাভ এ ড্রিম

একদিন মনে হল জিভ আটকে আসছে। আমি কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি। কলেজ স্ট্রীট মোড়ে তখন সন্ধ্যে নেমেছে, জোর গলায় নিজের নিজের কথা বলে যাচ্ছে কোনো এক পলিটিকাল পার্টি, অথচ আমার কথা বন্ধ হয়ে আসছে। অসহায় অবস্থায় বাস ধরার চেষ্টা করলাম, “দাঁড়াও!” -আওয়াজ বেরোল না।
রাজনৈতিক অধিবেশন শেষ হল কলেজ স্ট্রীটে, তকমা লাগানো মানুষেরা রাস্তায় নেমে ভীড়ে মিশে সাধারণ হয়ে গেলেন। শুধু দেখলাম ফুটপাথে প্রৌঢ় এক পাগলি বসা, দুহাতে খুচরো ভর্তি বাটিটা তুলে সেও বক্তাদের উদ্দেশ্যে অকাতরে হাততালি দিয়ে চিৎকার করছে, “আই নিড এ চেঞ্জ! আই নিড এ চেঞ্জ!” দুর্ভাগ্যবশত আমি তার সাথে গলা মেলাতে পারিনা, আমার জিভটা ততক্ষণে ভীড়ে হারিয়ে ফেলেছি। আর সেই ভীড় কত শব্দ হয়ে হাতিবাগান, শিয়ালদহ, ধর্মতলা অথবা হাওড়ার দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে, একা একা ঘরে ফিরে যাচ্ছে, সন্ধ্যেবেলায়।

রাত তিনটে নাগাদ দেখলাম খয়েরি কার্ডিগান আমায় জড়িয়ে বলছে, “আমি জানি...” ট্রেনের দমকে জানি না তখনও মোঘলসরাই পার করে চলে গেল কি না আমার স্বপ্নটা, সে বলছে, “আর কেউ থাকুক না থাকুক, তুই থাকবি...” আমি ঘুম ভেঙে ভেঙে রেল ট্র্যাকে ছড়িয়ে দিচ্ছি যেন মুড়িমুড়কি, যেন মৃতদেহ নিয়ে গেছে কেউ এপথে, “...তুইই থাকবি।” উঠে বসে দেখলাম রাত তিনটে আমার জানালায় আমারই ছায়া তৈরি করে পিছিয়ে দিচ্ছে বিহার, মধ্যপ্রদেশ, গাছ, অন্ধকার। ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় জেনে আমার ঘুম আসেনি আর। পরে, প্রায় একজন্ম পরে জেনেছিলাম, স্বপ্নে আমরা অচেনা কাউকে দেখিনা।
আমি দ্বিধায় পড়লাম, আমার পড়ে পাওয়া গোটা তিনেক ‘তুই’-এর কোন ‘তুই’ আমায় অপেক্ষায় রেখে গেলি তাহলে?





বন্ধ কারখানা


আমাদের ছোট নদীরা এখন আঁকে বাঁকে চলছে। রেল লাইনের তারা মত একটিবার কাছে আসছে, কাটাকুটি করে আবার চলে যাচ্ছে দূরে। এমতাবস্থায় আমি টের পাই একটা দ্বীপ তৈরি হচ্ছে আমার মধ্যে। সেখানে সমুদ্র থাকবে, বালুচর থাকবে, শালবন, ঝিনুক, কাঁকড়ার দল থাকবে, থাকবে নারকেল গাছ, দূরে ভেসে থাকা নৌকো, থাকবে শয়ে শয়ে বালির প্রাসাদ,- ঢেউয়ের আঘাতে বারংবার ভেঙে পড়ার জন্য। আর আমি, এসব জেনেও দাঁড় টানতে থাকব, শরীরে বন্ধ কারখানার কঙ্কাল নিয়ে, প্রাণপণ চেষ্টা চালাবো ওই দ্বীপ ছোঁয়ার।

অথচ প্রশ্ন করবেনা কেউ যে, একদিন একা এই দ্বীপে আমি একমাত্র কাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইব... কারণ প্রশ্ন করার মত এ লক আউটের বাজারে এখন আর কেউ নেই।

মুক্তগদ্য - সূর্য্যস্নাত বসু



















বাস ইত্যাদি
সূর্যস্নাত



বাসের জানলা দিয়ে অনেক ইত্যাদি লাফিয়ে পার হন । শেষবেলার সিগারেট থেকে থু থু, ভাঙা আসবাব, রেসের বেটন থেকে ঘড়ির ব্যাটারী, কিংবা হালফিলের কবিতার বইএর কিছু ছেঁড়া পৃষ্ঠা; এরা সর্বতভাবে কিছু না কিছু ইত্যাদিই বটে । এ ইত্যাদি মাঝেসাঝে পাশের পাড়ার নান্টুদার সাথে ডেটিং এ বেরোয় । আমি কিছুই বলিনা । মা জলখাবার আনার আগে টুক করে তাদের একটু সজাগ করে দিই । আর মার পা’দুটো যখন প্রায় ঘর অব্দি চলে এসে থেমে যায় পাপোশে, আমি আবার ওই ইত্যাদিকে যথাস্থানে রেখে দিই । স্কুলে পড়ার সময় থেকে বন্ধু সায়ন্তন আমায় হলুদ মলাটের ওই ইত্যাদি সাপ্লাই করত, আর ফিরে যাওয়ার আগে বলত; “নে জানলার সিটটা ছেড়ে দে;” আমিও তখনকার মত বাসের আলোয় মাখা ইত্যাদিগুলোকে বাইরে বার করে উঠে দাঁড়াতাম, কাজেই ইত্যাদির আরেক নাম যে অন্ধকার; তা আমার স্কুল লেভেল থেকেই জানা ।

অবশ্য এখন জানলার ধারে বসেই বাড়ি ফিরছি । ভিড় বাস । রোগা কণ্ডাক্টর । মোটা ড্রাইভার । ঘোলা চোখ খালাসি, ভোলা চোখ সহযাত্রী । কাকিমার বোগল, লালচে লোম, কাকুর কালো ঘেটি; হাতে একমাত্র বেটি আর বাদবাকি যত আছে; মুখে খিস্তিখাস্তা; একেবারে কাচা যাকে বলে ; এই বুঝি কামড়ে দিল; এই বুঝি মশাল জ্বালালো; খুরপি বার করলো; তারপর সজোরে চালালো পেটে এই বুঝি । এছাড়া কনুই মারা থেকে আরও যত যত ইয়ে ইসে মারা যায় সব চলছে । সারাদিনের ক্লান্তি, ঘাম গন্ধ দুর্গন্ধ, এরাও যে ইত্যাদি এবং এদের পারাপার করার মধ্যেও শালা ঘ্যাটাং ঘ্যাটাং করে চলা, চুলের স্টপেজ, তার মধ্যে দুএকটা পেট্রোল পাম্পসহ মানে একাকার যা বলি; কন্ডাক্টর বারবার কথায় কথায় থেকে থেকে আস্তে লেডিজ; কোলে বাচ্চা, এ এ এ আআইইয়োওও করে মানে কি সব বলছে ; এটাও ইত্যাদি, অর্থাৎ সব না বলা কথারাও যে শুধু ইত্যাদি , তা নয় । এরপর কেউ হুড়মুড়িয়ে পড়ল, কারো হাতে কি কারো পায়ে কি কারো ওখানে কি কারো মুখে কি কারো বুকে হেব্বি লাগল; ওরে বাবা রে বাবা গেলাম গো করে অজস্র ইত্যাদি চেঁচিয়ে ঊঠল; পিছনে প্রতিবন্ধীর সিট আর লেডিজ সিট আর সিনিয়ার সিটিজেন উফফ মাগো মাগো ইত্যাদির আবার ইমারজেন্সি এক্সিট ; অথচ ইত্যাদি এন্ট্রি নেই, তারপর সারাদিনের খবরাখবর, তেলের দাম বৃদ্ধি থেকে ইষ্টবেঙ্গল কি মোহনবাগান; সে যাই বলো চম্পক লোয়ার ইন্ট্যালেকচুয়ালিটি আর কাঁধে হেলান দিয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে ফের জেগে যাওয়া, আপনার ওটা আমার ওখানে লেগেছে, জুতোয় গোবর মাথায় ঘাড়ে আলু নিয়ে হেলে দুলে বসে আছেন তারাই যারা ইত্যাদি । এই আকালে হায় বাসদেবতা কেন যে ইত্যাদি করে বাড়ি ফিরছি, অটো বা ট্যাক্সি বা হেঁটে; হায় রে; যদিও একদল যুবক-যুবতী পেছন সিটে তাক করে গান শুরু করছে; মাটির গান, বাতাসের গান, আকাশের গান, স্নানের গান, পাইখানার গান, পাখির গান, ভেঁপুর গান, ফুলের গান, মেহেন্দির গান, পুজোর গান, আজানের গান ; কিন্তু এত কছু সত্ত্বেও কেউ যদি একবার ইত্যাদির গানখানিও গেয়ে দিতেন; আমি নিশ্চিত, বাসযাত্রী সকলেই একে অপরকে আর কিছু নাই করুক, অন্তত চুম্বনটুকু করতেনই ।

গুচ্ছ কবিতা - তনভীর হোসেন

গুচ্ছ কবিতা
তনভীর হোসেন



ফু-৩


পাখি হাঁটে গ্রীলের ফাঁকেফাঁকে
নিজের বাইরে কোন গন্ধেই তার
স্বস্তি নেই-উড়ে যায় বিবর্তন পড়ে থাকে
মানুষেরা শুধু প্লেন বানিয়ে দেয়
নিজেদের –
সান্ত্বনা পুরস্কার


কুকুর

পরম রাস্তা-ঘনিষ্ঠ কুকুর সরায়না মানুষ
জীবিতরা ডাকেনা কুকুর বন্ধন,
প্রেসক্লাব শান্ত থাকে
সর্বোপরি কোন গোলমাল নেই
প্রাণিবিদ্যার ইতর অধ্যায় মৃত্যুতেই নতজানু
ইতিহাসবিশ্রুত অনাড়ম্বর মিথ

শুধু আরো এক মরদেহ
পৃথিবীর ব্যস্ত মোটরঅলাদের
চিনিয়ে দেয় স্পিডব্রেকার...


মা


কিছু টব উৎসরিত হচ্ছে
সূর্যের লোভে
গ্রীলের খাঁচা পরম যত্নে ওদের
বুকে জড়িয়ে দেয় মহাশূন্যচারী কোট

রোদ-বৃষ্টির রসায়ন মরচেধরায় আর
ভাঙ্গারি দোকানের ঠিকানা লিখে দেয়
গ্রীলের বুকে

এই সম্পর্ক মা আর সন্তানের মতো
তার বুকের চিরস্থায়ী দাগ-তো আমারই
ছোট ভাইটা যখন টব ছিল

গ্রীলের অসুখ করেছিল মা'র
আমি আর বাবা টবের পুলসেরাত হয়েছিলাম
গ্রীলের মতো মা হয়েছিলাম।


কার্টন

কার্টন ফিরেছে লোহিত শৈবাল-
দ্বীপ-উপদ্বীপ মানচিত্র হেঁটে

মাঝবয়সের ক্রাইসিস নেই
গড় ওজন মোট ওজন দেশ শহরের নাম-ধাম
জন্ম-মৃত্যু তারিখ নির্মেদ কলেবরে

তার বুকের দিকে তাকালে মনে হয়
তাড়া খাওয়া ইঁদুর চালান
হয়ে গেছি জরুরি কুরিয়ারে জাহাজে
বন্দরে

তবু গন্ধ খুঁজে পায় জালিম বেড়াল
কাকেদের পৃথিবীখেকো ঠোঁটে
নিভৃতবাস করে তুখোড় গুপ্তচর

আমাকে সন্দেহপ্রবণ করে তোলে
কালেভদ্রে নিজেকে পেরিয়ে
নিজকে ধরার এই মানবিক প্রতিজ্ঞা

সুতো কাগজের ঘুড়ি উড়ে গেলে
হৃদয় ভারী হয় আমিতো ঘুড়ি নই
পাখিও বিস্ময়

পায়ে নেমে এসো দেবী
গড়িয়ে যাই অবশিষ্ট জলভাগ

দুটি কবিতা - সুপ্রিয় মিত্র


দুটি কবিতা
সুপ্রিয় মিত্র

১৫.
পড়শিরা খুব চালাক,
মেনে নিয়েছি সেই কবেই
তোমাদের মত পরিস্কার মন
আমাদের নেই.
    তবু, যতজন মানুষকে ভালোবেসেছিলাম
যারা আমাদেরও ভালোবেসেছিল -
      প্রত্যেকের রং মেপে মেপে
আমাদের বুকে মাখা আছে.
    সবুজ - নীল সুতোয় বাঁধা
           খয়েরী - সাদা কাগজে
    মুড়ে  রাখা    আছে
                             ঘরের চিলেকোঠায় ...

     বিকেল হলে যখন ছাতে এসে
ঘুরতাম, তোমরাই পুঁচকে চোখগুলোকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছিলে -
                          " ওই দেখ!!
       ছোট্ট ছাতটা থেকে
            রামধণু বেরিয়েছে.... "



২৫.
কিছু কিছু পার্থিব দুঃখ,
বয়সের সাথে, পোড়োবাড়ির মতো
জানলা - দরজার কপাট হারিয়ে ফ্যালে
ঝরে যায় চুন সুরকির বাঁধন
ইঁটের গাঁথুনি ...
রহস্যময়ী কবিতা হয়ে ওঠে.
    পাঠক - শ্রোতার চোখে ভাসে
  টেরাকোটা মন্দির, অজন্তার গুহাচিত্রের কথা.
 

   কোথাও বা পাঁজর - কঙ্কাল হারাতে
   হারাতে, অজুহাত হয়ে যায়
      বেঁচে থাকার, বা নিজের মৃত্যু টুকু
     সাক্ষী হওয়ার একমাত্র কারন.

  আমার ভয় করে বলতে....  কিন্তু,
শুধুমাত্র নিপাট ভালোবাসার কথা, আমার একতলা বাড়িকে ভালোবেসে যাওয়ার
কথা, - বোবা ছাদ জানে.
           কত কত রাত তার বুকে হেঁটে
পার করেছি
               অসংখ্য ছায়াপথ
           কত কত দুপুর, ভোরে ক্লান্তিকে
পুষেছি, দাঁড়ি দিয়েছি তারই
                   ছায়ার জঠরে....

  যাবৎ কেউ তোমার নামে
   অভিযোগ - অভিমান করলে স্মিত হাসি.
 আর প্রশ্নের বদলে
                        প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই -
   গাছের উপকারিতা বলতে কি
 আমাদের শুধু বটগাছের ছায়া আর
 গুল্মের গুনে অসুখ উধাও -
    যৌন তৃপ্তির কথাই মনে পড়ে ? আমরা
কি কোনোদিন, বটের ফল দিয়ে
 গুলি খেলিনি, অর্থের অভাবে?
  গুল্ম - ঘাসফুলে ঠেকাইনি গাল
    কারোর আদরের কথা
                                  ভেবে?


   তারপর চোখ ঘুরিয়ে নিই...
ইদানীংক্ষনিকের মৃত্যু  দেখতে
   আমার গা গুলিয়ে ওঠে...

দুটি কবিতা - মধুমঙ্গল বিশ্বাস

মধুমঙ্গল বিশ্বাস




কৃষিকথা



এসো
নেমে এসো চাঁদ এইখানে কাঁদাজল লাঙলের যত্ন লেগে আছে

একদিন চূর্ণী এসে নিয়ে যাবে হয়তো বা সব

ছাদের কার্নিস ধ'রে মিনতি জানাবে সভ্যতার বীজ

আলো-ছায়া বাতাস-আগুন সবই পাবে, শুধু

                            পাবে না স্নেহ, বাৎসল্য আয়ুধ

ফেরারি হবার আগে এসো চাঁদ লুঙ্গি গামছা ছেঁড়া ব্লাউজের সাথে মেশো

এখানে জীবন আছে এখানে জীবন চুরি যায়

          স্বর্গ-নরক এইখানে, অনন্ত ভেলিভারিঘর

এসো চাঁদ তুমি এলে একটি কাঁথার নিচে জীবন জড়াবো ...





চন্দ্রমা



ভাঙা চাল ।

মাটিতে শয্যা ।

ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখি প্রতিরাতে

সারাদিন সূচসুতো । রঙিন সেলাই

সারাদিন অশ্রুমোচন । ছেঁড়াখোড়া । তাপ্পিমারা

যেন ছেঁড়া কাঁথাটির আনাচে কানাচে চাঁদ রুয়ে রুয়ে যায় আমাদের মা

যেন চাঁদ বাচ্চা ছেলেটির মত কলকল খলখল হেসে হেসে ওঠে

মা'র হাত

ফুটো ফুটো হয়

চাঁদ ফুটে ফুটে ওঠে

                    মাটির শয়ানে

মা বলে-

মানুষ মরে না

সে তো চাঁদ ভালবাসে

একদিন তাবৎ প্রক্রিয়া শেষ হ'লে ঋণ শোধ করে চাঁদ :

মা আমাদের প্রতিদিনের চাঁদ হ'য়ে ওঠে

দুটি কবিতা - ঋষি সৌরক

ঋষি সৌরক


(১)
দিন গড়ানো শুরু হলেই
যে যার রঙ সতর্ক গুটিয়ে নাও
অন্যমনস্কসব সংসার
বাড়তি ভাতের মত
তোমার দরোজা খোলে অন্যলোক

অনিবার্য বসন্ত ভাংগে উত্তর
কানায় কানায় মেশে একান্ত অসুখ
সহস্র উদগারের তাচ্ছিল্য
অতিস্বাভাবিক প্রশ্বাস পেরিয়ে
আমরা সেই স্বাগতমের সামনে ঠায় -

রহস্যমকুব হবে কি হবে না বড়কথা নয়

অনিশ্চয় চুরি করে পালাচ্ছে কালোবেড়াল

(২)
স্তন্যপায়ী বলে ওরা পাঁচিল টপকে যায়
পাশের বাড়ির লোভে

সেখানে ছড়ানো-ছেটানো কাঁচ
তদন্তের চিড়িয়া তখনো বুলি শেখেনি
অবাধে বাড়ছে মৃতের হাতে নখ

খুনে সুগন্ধ আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে
খাবার হোক বা ঠোঁটপালিশ
রক্তে আমার ভুবনভোলানো নেশা
কিছুতেই কাটছে না বিগত প্রেমের জের

পালানোর সব ছিদ্র এখন বন্ধ
একপশলা আগুন খুঁজছি
মহানগরীর বুকে

দুটি কবিতা - অভিদেব মুখোপাধ্যায়

অভিদেব মুখোপাধ্যায়


স্বর্গ



প্রেমের কবিতা আর পোষায় না। কাউকে যদি চুমু খেতাম তা’লে অন্য। এখন ঘরবন্দি থাকি। দেওয়ালভর্তি খিস্তি লিখেছিঃ চারঅক্ষর পাঁচঅক্ষর ষোলোঅক্ষরের। হ্যাঁ মাঝেমধ্যে স্বপ্ন দেখি। দেখি সেই আশ্চর্য পথ যার শেষে একটা কাফে। ভেতরে হলুদ আলো। সেই আলোয় সব্বাইকে জন্ডিসরোগী মনে হয়। ঐ টেবিলে আমি নিজেকে দেখতে পাই- যেখানে সাজানো ছিল তাস, সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছিল অঁরিকে জোচ্চুরি করছিল ব’লে, ধার করা হয়েছিল তিনবোতল মদ, ক্রমাগত হাসি হোহোহোহো ক’রে, যেখানে হিঙের গন্ধ ভেসে আসছিল আর সেই গন্ধে বারবার চেপে ধরছিলাম নাক, আর ততোবার বাঁ হাতে আমার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছিল কেউ...



আশ্চর্য সাইকেল চড়ে


আশ্চর্য সাইকেল চড়ে বনভূমে গেছি। টনটন করেছে ব্লাডার- চেপে রাখা পেচ্ছাব স্নায়ুকে দিয়েছে নিষেধ- টাটিয়ে উঠেছে খুলি। দেখেছি মুখের সারি- তারা কী অনুপম খিঁচিয়ে রয়েছে আমায়। ভৌতিক লেগেছে স্বর- যেভাবে অন্ধকারে বেজে ওঠে তীক্ষ্ণতর সাইকেল বেল। নিজের ভেতর যদি ভ্যাকুয়াম কল্পনা করে নেওয়া যায় তবে যে চিৎকার উঠে আসে অনেক ফ্যাদম নিচ থেকে- তার চেয়ে মহান সংগীত আর ধারণায় নেই। - আশ্চর্য সাইকেলে চড়ে গেছি বনভূমে, আলো আঁধার, বৃক্ষ, পাতার খসখস- (এদের কী মানে আছে, এক সাংঘাতিক মানে, ওহহ) -অথচ কিছুই বুঝিনি। টনটন করছে ব্লাডার- চেপে রাখা অনেকক্ষণ- হুহু করে বয়ে গ্যালো প্রান্তবর্তী বাতাস। -এদিকে ইউরিনাল কোনো...







আবার ঘুম পেয়ে গ্যালো। এইমাত্র শেষ হয়েছে ‘এইট অ্যান্ড হাফ’, অব্যর্থ ঘুম পেয়ে যায়। কুঁকড়ে মুকড়ে আমি শুই- শোবার সময় থাই দিয়ে ঘষে ঘষে মাস্টার্বেট করি। নিজেকে বলিঃ ‘এই শেষবার, আর ককখনো খেঁচব না’। আস্তে আস্তে খসে যায় জল- নিহত ক্রৌঞ্চের মতো পড়ে থাকি বিছানায়। আবার জেগে উঠে ছিঁড়ব কাগজ, কলেজের ফর্ম (মুছে নেব হাত) আর হাতড়ে হাতড়ে যাব ডাস্টবিনের দিকে। - কোন অনশ্বর স্বর্গে তুমি রয়েছ তোমার কাছে যেতে পারছি না যে... বহুদিন দেখিনি তোমায়।।



প্রথমে যেতে হবে কাঁকড়াবিছের কাছে। সে আমাকে দেখিয়ে দেবে কোথায় পাওয়া যায় গুপ্তঘাতকের খোঁজ। তারপর খুঁজতে হবে আর্তনাদ। তার জন্যে চলে যাব কোকিলের প্রতি। হ্যাঁ ঐ কোকিল যা ডাকে তা আর্তনাদ ছাড়া কিছু না। সবচে’ বিভীষিকাময় আর্তনাদ কারণ তা মধুর শোনায়। - আমি দেখেছি ম্যানহোল খুলে বেরিয়ে আসছে দেবদূত, তার সর্বাঙ্গে ঝরছে ডালিমের রস। আমি দেখেছি ছুঁচের মধ্যে দিয়ে উটেরা আর সহজে গলে যায় না। আমি দেখেছি অক্টোপাস পেয়ে গ্যাছে তার কাঙ্ক্ষিত ডানা কিন্তু সে ট্রপোস্ফিয়ার দিয়ে উড়তে চাইছে না। - ইদানীং স্যারিয়াল পদ্য লেখা আমি ছেড়ে দিয়েছি যেহেতু ডাক্তার বলেছেন আমার টিবি হয়েছে। (এলাইনটা কোথথেকে টোকা রে, যাহ্‌ ভুলে গেছি) - ভালো থেকো। আমেন।



যৌনতা সম্বন্ধে আমি কিছু বলব না। ইউরো কাপ সম্বন্ধেও না। আমি চাই সেই অলৌকিক শব্দদের যারা আমাকে একসময় চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছিল- সেই কবর খুঁড়ে আমি উঠে এসেছিলাম। আজকাল সারল্যের বড়ো অভাব বোধ করি। ঘুম আসবে বলে ট্রাংকুইলাইজার খেয়ে শুয়েছিল– কে? (‘এইট অ্যান্ড হাফ’; লুইসা।) -সর্বদা চশমা পরে থাকা কোনো কাজের কথা নয়। আমি ডাইরিতে লিখেছি, এখন থেকে শুধু ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতাই পড়ব। - পরপর দু’বার মাস্টারবেট করে যারপরনাই ক্লান্ত। এখন ঘুমোবো।



সাইকেলের চেন পড়ে গ্যাছে। বনভূমে কোনো সাইকেল সারানোর দোকান দেখি নি। সারাবছর এখানে বিরাজ করে আর্দ্রতা, ভূত, সবুজ পাতা, ও অন্ধকার। এখানে কোনো চিৎকার নেই, ফিসফিসের শব্দ নেই। সন্ধে নেমে এলে সব অরণ্যই কেমন ভৌতিক দ্যাখায়। যা দেখছি সব স্বপ্ন অথচ কী বাস্তব লাগে! আমি নিজের গায়ের গন্ধ পাচ্ছি- নতুন কারো শরীর শুঁকছি মনে হয়। প্রাণপণ টেনে যাচ্ছি চেন ধরে, কে দাঁড়িয়ে দেখছে। আশ্চর্য হাওয়া বয়ে যাচ্ছে বনভূমে। আমার পেছনে যে দাঁড়িয়ে আছে- ভলকে ভলকে তাকে ঢেকে দিচ্ছে অন্ধকার। - একসময় ঘুমের মধ্যে আমি অসাড়ে পেচ্ছাব করে দিই...