শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩

ক্ষেপচুরিয়ানস্ - অক্টোবর ২০২৩ সংখ্যা



শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৩

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়


"আমরা হতভাগা।
বন্ধুত্ব দিয়ে আমাদের সম্পর্ক শুরু হয়
শেষ হয় খিস্তিখেউড়ে।
"

 ঠিক এতটা গ্রাফিক না হলেও, প্রায় কাছাকাছি কিছু এক্সপ্রেশন দিয়ে ব্যাখ্যা করে দেওয়া যায় আজকের আধাশিক্ষিত তথা উচ্চশিক্ষিত শ্রেণীর আপামর কনট্যুর। বাঙালী হিসেবে (কম্যুনিটি নয়, ভাষাভাষী) আমাদের ভাষা নিয়ে সেলিব্রেশন প্রায় আমাদের পরিচয়ের খুঁটির মত একটি ইঙ্গিত। এই প্রবৃত্তির তাগিদ অদৃশ্য, কিন্তু ধারালো। তার নিয়ত খোঁচায় রক্তাক্ত হয়ে যখন গুটিকয় তরুণ ক্ষেপচুরিয়াস নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ শুরু করে শূন্য দশকের শেষে, তখন তার লজিকাল শেল্ফ লাইফ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। ওয়েল, তার প্রয়োজনও ছিল না। কারণ, পরিস্থিতি এ দেশ বা বৃহত্তর বাঙালী সমাজকে যে মেরুকরণের দিকেই ঠেলুক না কেন, তার সাময়িক উত্থানপতন তথা বোহেমিয়ানিজমকে ম্যানিফেস্ট করে ক্ষেপচুরিয়াস, আমাদের আদরের ক্ষেপু এখনোও, বাংলাকবিতার এই পোস্ট-ট্রুথ কালকল্পে বিদ্যমান।


বাংলা সাহিত্যে ফেসবুকের অনলাইন আধিপত্যের বয়স ব্লগের তুলনায় কম। এবং ব্লগ ম্যাগাজিন (আদরে ব্লগজিন) হিসেবে ক্ষেপুর কৌলিন্য হয়তো বয়সে অতটা নয়, গুণে ও বৈচিত্র‍্যে যতটা। কিন্তু ক্ষেপু ব্লগ, তার অল্প ক'টি সংখ্যায় গ্রুপম্যাগের থেকে সামান্য হলেও ভিন্ন এক অস্তিত্বব্যঞ্জনা সাজিয়ে নিয়েছিল। ২০১৪-য় এসে, মূলত: আমাদেরই রুজিরুটির মুঠোয় পিষে এ উদ্যোগ ছুটি নেয়।


এতে করেও যে ক্ষেপুর প্রতি উত্তরবর্তী কবিতাপ্রজন্মের আত্মিকতা লোপ পায়নি, তার প্রমাণ আমরা পেলাম বাইশের শীতে, এক ছোটমাফিক জমায়েতের ডাক দিয়ে। ক্ষেপুর আজন্মের সুহৃদেরা হৈ হৈ করে কলকাতা পাড়ি দিয়েছিল গত ডিসেম্বরে। কমবেশী ত্রিশজন ক্ষেপুর মনখোলা রেসপন্স প্রমাণ করেছিল এই ভার্চুয়াল পাগলাগারদের প্রতি তাদের এখনোও অক্ষুন্ন টান।


তারপর বছর ঘুরতে চলেছে। ইতিমধ্যে ভেটেরান থেকে কনিষ্ঠতম কয়েকজন ক্ষেপুকে এ মরজগৎ থেকে খুইয়েছি আমরা। বিষাদ ব্যক্ত হয়েছে কবিতার উদযাপনে। গ্রুপ চলছে যেমন চলে থাকে রোজকার কবিতায় বিকল্প নিখিল খুঁজতে খুঁজতে। তারই মধ্যে ক্ষেপু সুদীপ ব্যানার্জী, প্রস্তাব দেন ব্লগের রিভারবেড আবার খুঁড়ে জল তোলবার। মার্জিনাল, নামমাত্র সময়ে সবকিছু গুছিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে ক্ষেপুর নিজস্ব পরিবারের বাইরেও আমন্ত্রিতরা। যারা পারেনি তাদের দোষ দিইনা। আমরাই এ ফিরে আসার নামতায় যথেষ্ট আমতা আমতা। তবে ব্লগনির্মাণের আঙ্কিক, কারিগরি দিক ধরে রাখার দায়িত্ব এবারেও একা হাতে সামলালেন সর্বংসহা ক্ষেপু সুমিতদা, সুমিত রঞ্জন দাস। তাকে অশেষ আলিঙ্গন।


এই প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগে আমাদের সীমাবদ্ধতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী নই৷ বাংলা কবিতা যে সুবিশাল ট্র‍্যাশ ও ফাঁকা আওয়াজে ভরে উঠেছে, তার মধ্যে ক্ষেপু বরাবরই ছিল সিলেক্টিভ, ক্রিটিকাল। আমাদের পাগলাগারদের একমাত্র ট্র‍্যাডিশন সমালোচনার প্রতি নোয়ানো মাথা, তাতে কারোও মাথা নিচু হয়না তা আমাদের চিরকালীন বিশ্বাসে থাকবে।


যদিচ আমন্ত্রিত লেখাগুলির কিছু কিছু ক্ষেপুর সমোচ্চে অন্যূন হবে তা বলাই বাহুল্য। এও এক পরীক্ষা, পাঠকের, বৃহত্তর ক্ষেপুবৃত্তে আমাদের জল মাপবার মার্ক টোয়েন। লেখা যেমনই হোক, পাঠকের অবাধ স্বাধীনতা লেখাকে ব্যাক্তিগত মাপকাঠিতে যথেচ্ছ অনুশীলনে ফেলা। সে আহ্বানের ট্যাটু আজন্ম জ্বলজ্বল করুক ক্ষেপুর শরীরে।


এ সংখ্যায় পেইন্টিং বিভাগের হাল যথারীতি ধরেছেন অমিত বিশ্বাস, দশক পেরিয়েও যার উপর আমাদের ভরসা কন্টিন্যুইং। কবিতায় আমন্ত্রিতরাই শুধু, ইনক্লুডিং গৌতম চট্টোপাধ্যায়, যার কাছ থেকে লেখা পাওয়ার সাফল্য এ সংখ্যার জয়ধ্বজা। এছাড়া নিয়মিত বিভাগ, পরিমিত সামর্থ্যে, অটল। নতুন বিভাগ হিসেবে ফটোগ্রাফি,  যার আদরের নাম দৃশ্যখেলনা। আর একঝাঁক খুদে ক্ষেপুকে মাঠ ছেড়ে দেবার প্রয়াস-ও শুরু করেছি আমরা। এ সংখ্যায় আঁকিবুকি দিয়ে ধন্য করেছেন শ্রীযুক্ত প্রমিত রায়।


ক্ষেপুর সাবেকী পরিচয় সেল্ফ-এক্সপ্ল্যানেটরি৷ এতে এখনোও একচুল ঘুণ ধরেনি। পুরনো লেখাকে নতুন দিয়ে যুঝে উঠবার ছেঁদো খেলায় নয়, আমাদের বরাবরের বিভব ও বৈভব একঘেয়েমী ভাঙিয়ে নতুন ভাষার সন্ধান। এবং পাঠকের সর্বব্যাপী স্বাধীনতা।


এ সংখ্যায় পাশে থাকুন। মতামত দিন যার যেমন খুশি। ব্লগের সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকের কমেন্টবক্স-ও খোলা রইল। পরবর্তী সংখ্যার আহ্বান দেখতে না দেখতেই লাফ দেবে।


সবাইকে ধন্যবাদ।

 

-- অত্রি ভট্টাচার্য এবং মিলন চট্টোপাধ্যায়

সোমবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৩

আর্কাইভ - অয়ন দাশগুপ্ত


জৈবনিক শব্দের প্রতি একটা ভীষণ আকুতি ছিল সারাজীবন, কবিতায় এবং আলোচনাতেও।সারাজীবন একটা আফসোস থেকে গেল, কবি অয়ন দাশগুপ্তের একটাও ইন্টারভিউ নেওয়া হল না। যার কাছে যেটুকু থাকল পুরোটাই স্মৃতিতে। এই স্মৃতিই বাঁচিয়ে রাখবে ক্ষেপচুরিয়াসের অন্যতম প্রাণপুরুষ, কবি-সমালোচক অয়ন দাশগুপ্তকে। আর তার যাবতীয় কবিতা ছড়িয়ে থাকবে সামাজিক মাধ্যমে। সমালোচনার এমন শক্তিশালী হাত আমি আগে দেখিনি, হঠাৎ করেই যেন বাংলা সাহিত্যের অন্দরে মানুষটাকে প্রবেশ করতে দেখলাম স্যোশাল মিডিয়ার হাত ধরে। প্রথমে ছোট ছোট অভিব্যক্তি তারপর ক্রমশ পেলাম তাঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার। গভীর আত্মদর্শন কীভাবে পঙ্‌ক্তিগুলিতে ছেয়ে আছে সেটাই বিস্ময়ভরে দেখলাম। পরে যেন কালের নিয়মে অয়নদা ক্ষেপচুরিয়াসের সঙ্গে কখন যুক্ত হয়ে পড়লেন। আমার মতে অয়নদার কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য বিষাদ বিলাস। অণু কবিতা ও ছোট কবিতায় বার বার তাঁর  বিষাদ  ফিরে আসে। একাকীত্ব-ই  এই কবির নিরাপদ আশ্রয়। কবিতা তাঁর কাছে যাপন ভিন্ন অন্য কিছু নয়। অয়নবাবুর কবিতায় তাই আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি বারবার পুনরাবর্ত করে বিষাদ, শ্বাপদ, নিষাদ, মন, পোড়া, জৈবনিক প্রভৃতি শব্দ। প্রত্যেকটা কবিতার মধ্যে দেখা যায় একধরণের অনস্তিত্ববাদ। তাঁর মধ্যে সহবাস করেন কবি, বিলাস করেন শ্বাপদের সঙ্গে , সেই শ্বাপদের তীক্ষ্ণ নখরকে ভয় করেও দেখেন অন্তরে সেই শ্বাপদের চলাচল। 

অয়নদা ক্ষেপচুরিয়াসের বাইরে খুব কমই লিখেছেন, দুই একটা ওয়েব ম্যাগাজিনে তাও সামান্য। অয়নদা ছিলেন প্রকৃতার্থে ক্ষেপু। একটা সচল, অচল উভয় টাইপের = তাঁর আসা এবং যাওয়া, তাঁর অন্তিমযাত্রাটাও যেন সেইরকম। 

ক্ষেপু পরিবার থেকে অয়ন দাশপ্তকে হারানোর পর এই প্রথম ক্ষেপু বেরোচ্ছে। তাই এই সংখ্যায় থাকল তাঁর ক্ষেপুতে প্রকাশিত দুটি কবিতা। সামনের সংখ্যায় আমরা প্রত্যেকে কবি অয়ন দাশগুপ্তের কবিতা নিয়ে অনেক কথা বলব, এখন কেবল এক টুকরো নীরবতায় ক্ষেপু লালন করে যাক তার প্রিয় সন্তানকে, কবিতা পাগল এক বিষাদ পুরুষ অয়ন দাশগুপ্তকে। 


-- জুবিন ঘোষ

 

আর্কাইভ 

অয়ন দাশগুপ্ত


শোধন

 

হাজার জোনাকের অন্ধকার আত্মসাৎ করেছো

আর ওরা তাই ভেবেছে

এখন দু-দশদিন অক্লেশে গড়িয়ে নেবে আলোর মোচ্ছবে...

 

এতদিন এই যে আশ্চর্য ফুলের মত নির্ভুল একটা ব্রত রেখেছিলে -  

এযাবৎ ভেবেছে ওরা

সবার অলক্ষ্যে, নিশ্চিত বাসিফুল বদল করেছো প্রতিরাতে

 

মানুষ তো কত কি ভাবে -

হাওয়ার নিষেধ ভেঙে

ভেবে থাকে তৃপ্তি পায় ক্ষণিকের তৃষা

নিষেধাজ্ঞা জারি করে স্বপ্নে আস্বাদন করে দেবভোগ্য ফল 

 

মাঘের উঠোন জুড়ে

জ্বলুক না মাঝরাতে চাঁদের আগুন - 

আজ নির্গুণ আঁধারের তুমিই বা কতটুকু শোধন করেছো !

 


তুরুপ

 

একেকটি অন্তরঙ্গ মুহূর্ত যেন ঘূর্ণির মত বাস্তবিক

পাথরে পাথরে ফুল্‌কির শুদ্ধতায় অম্লান,

ছিন্ন অনুপল...

 

ওটুকুই ক্ষীণ আয়ু অমৃত জানি

শূন্য আধার জুড়ে সাক্ষাত অশনি,

নির্মোক অবশেষ... অসময়ে হাতের তুরুপ -

অবাধ অসাড় পড়ে থাকে...

 

আজ মনোলোভা ছকের উপান্তে বসে আছি

 

নেপথ্যে শব্দময় রাষ্ট্রীয় ঘর্ষণে

নির্মম সময় প্রয়াসবন্দী পড়ে আছে;

 

দলবদ্ধ ক্রীড়ায় দিনগত শুধু মাঝে মধ্যে দেখি,

নিকষ আঁধারে জ্বলন্ত উল্কা সব

শব্দহীন খসে পড়ে...

ছোটগল্প - সেলিম মণ্ডল


ছোটগল্প 

সেলিম মণ্ডল


সব রাতের আকাশে চাঁদ ওঠে না

সব রাতের আকাশে চাঁদ ওঠে না। যে রাতে চাঁদ ওঠে না, সেই রাতে মোহন চিঠি লিখত। চিঠি লিখত আকাশে। আকাশের কোন ঠিকানায় পাঠাতো তা একমাত্র মোহন জানতো। আকাশের কি পিনকোড আছে? কীভাবে পৌঁছোতো চিঠি? মোহন জানতো না। একদিন মোহনের চিঠিগুলো পাওয়া গেল— বাড়ির পুরোনো অব্যবহৃত একটি কালোবাক্সে। সাতটি চিঠি পড়ার মতো রয়েছে। বাকিগুলো নষ্ট। মোহন-ই নষ্ট করেছে। কোনোভাবে পড়া যাচ্ছে না। কালো স্কেচপেন দিয়ে ঘষে ঘষে কেটে দিয়েছে। চিঠিগুলো অমাবস্যার রাতে সে লিখত, তার চিঠিগুলো পড়ে সেটা জানা যায়। ওই সাতটি চিঠি আপনাদের পড়ে শোনাবে সাগরিকা। মোহনের পাড়াতুতো বান্ধবী। সে মোহনকে মনেপ্রাণে চাইত৷ মোহন তার প্রেমে সাড়া দিত না। সাগরিকা সুন্দরী। ভালো নাচ করে। গান করে। ফরসা ধবধবে নাকের নীচে কালো তিল তার সৌন্দর্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কোনো ছেলে সহজে চোখ ফেরাতে পারে না। কিন্তু মোহনের কোনো আগ্রহ নেই... মোহন মেয়েদের থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করতো সাগরিকাকে সে বান্ধবীর বেশি কিছু ভাবতো না। মোহনের বাড়িতে তার অবাধ যাতায়াত ছিল। আজ অনেকদিন পর সাগরিকা এল। প্রায় তিন মাস পর। সে প্রথম চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করল—

 

প্রিয় এস,

      আজ আকাশে চাঁদ ওঠেনি। দীর্ঘক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে দেখলাম, কয়েকটা তারা খসে পড়ল। তারাখসা দেখলে, আমার খুব ভয় করে। তুমিও যদি কখনো খসে পড়ো! রাতের আকাশের দিকে না-তাকালে আমার স্বস্তি হয় না। কিন্তু এই তারাখসা আরও অস্বস্তিতে ফেলে। কী করব বলো? আকাশের কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। আমার মনখারাপগুলো কি সে নগদে নেবে?

                                                                                                                                                ইতি

তোমার মোহন

 

চিঠিটা পড়ে সাগরিকার ভীষণ কষ্ট পেল। এই চিঠি যদি সে আগে পড়ত, আকাশের পিনকোডে বাড়ি বানিয়ে নিত। মোহনের চিঠি একদিন না একদিন উড়ে আসত তার বাড়ি। সে উত্তর দিত। মোহন কি পড়তো না? না পড়লেও সে নিয়মিত চিঠি দিত। তার কোনো খামতি রাখতো না। মাঝেমাঝে সাগরিকার মনখারাপ হতো, এতো ছেলে তার পিছন পিছন ঘোরে! মোহন কেন তাকে চাইতো না? সাগরিকা বিশ্বাস করতো, একদিন না একদিন মোহন ঠিক তার কাছে আসবে। মোহন আজ আকাশের তারা। আকাশে এত তারা সাগরিকা কীভাবে মোহনকে খুঁজে নেবে? জিজ্ঞাসা করবে, তার গলার দাগ মিলিয়ে গেছে কিনা। সে কি এখন ঢোক গিলতে পারছে?

 

সাগরিকা দ্বিতীয় চিঠিটা খুলল—

 

প্রিয় এস,      

আমার শরীরে কি ফুল ফুটবে না? বলে, পাঁকে পদ্ম ফোটে। আমার শরীর কি তার চেয়েও জঘন্য? পদ্ম না-ফুটুক, দুটো ঘাসফুল ফুটুক। বুটের দাগ পড়ুক। তবুও তো ফুটুক। এই মরুর মাঝে তপ্তবালুকা নিয়ে ছুটি। একা একা ছুটি। তোমার জন্য ছুটি। রাতের কাছে কান্না করি। রাত আমাকে মরতে দেয় না। তারারা হাসে। একমাত্র চাঁদ সান্ত্বনা দেয়— মোহন, তোর বুকে ফসল ফলবে। তুই হাহাকারে জল দে। এই আশাতেই আমি চেয়ে থাকি প্রিয় ‘এস’।

                                                                                                                                           ইতি

তোমার মোহন

 

দ্বিতীয় চিঠিটা পড়ে সাগরিকার মন খারাপ দ্বিগুন হল। মোহনের কীসের এত কষ্ট। কেই-বা এই ‘এস’? তৃতীয় চিঠিটা সে আর পড়তে পারল না। চোখের কোনায় জল চিকচিক করছে। বাইরে কার যেন পায়ের আওয়াজ পেল সাগরিকা। ঘর থেকে বেরোতে দেখে, মোহনের মা।

—সাগরিকা, তুই কখন এলি?

—কিছুক্ষণ আগে কাকিমা। মোহনের ঘরে বসেছিলাম।

— ওই ঘরটাতে আমরা আর কেউ ঢুকি না। মোহনের কোনো জিনিসেই হাত দিই না। কাজের মেয়েটা খালি দিনে দু-বার ঢুকে ঝাঁট দেয়।

 

কথাটা বলতে না বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল মোহনের মা। সাগরিকা তিনমাস পর মোহনদের বাড়ি এল। বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। সাগরিকা তার মনখারাপটা বুঝতে দেয়নি। চিঠিগুলোর কথা তাঁদের বাড়ির কেউ জানত না।

 

এরমধ্যে চলে এসেছে মোহনের বাবা। তাদের কান্নাকাটি দেখে বুকে পাথর রেখে বলল, কান্নাকাটি করে কী হবে। যে গেছে সে তো আর ফিরবে না। ব্যাগে মাংস আছে। রান্না চাপাও। সাগরিকা আজ খেয়ে যাবে। কারও গলা দিয়ে হয়ত মাংস নামবে না। রান্না হবে একটা অভ্যাসে। এই অভ্যাস আর নতুন কী? দুঃখ ভোলাও একটা অভ্যাস হয়ে যাবে।

 

কারো গলা দিয়ে ভাত নামবে না। মোহনের বাবা-মা দু-গাল দেওয়ার চেষ্টা করবে ঠিকই, কিন্তু অতিথির আসনে বসে সাগরিকা কীভাবে পারবে! সাগরিকা পারল না। চিঠিগুলো একটা বইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল।

 

সাগরিকার মাথার মধ্যে ওই চিঠিগুলো সবসময় ঘুরতে থাকে। কে ওই ‘এস’? মোহন কেন আত্মহত্যা করল? চিঠিগুলো লিখে কেন-ই বা সে দেয়নি। অজস্র চিঠি কাটাকুটি করে ছিঁড়ে রেখেছে কিছুই ওর মাথায় ঢোকে না। আরও পাঁচটি চিঠি আছে। সবগুলো চিঠি পড়ে নিশ্চয় কোনো রহস্য উদঘাটন হবে। মোহনদের বাড়ি গিয়ে ওভাবে চিঠি পড়া খুব রিস্ক হয়ে যাবে। কোনোভাবে নিজের বাড়িতে আনতে হবে। মোহন আত্মহত্যা করেছে ডিপ্রেশন থেকে। কী ডিপ্রেশন কেউ জানে না। মাঝেমাঝে মনখারাপ করে বসে থাকত। মা জিজ্ঞাসা করলে শুধু বলত, মা আজও আকাশে চাঁদ ওঠেনি। চাঁদ উঠলে বলত— মা, মেঘে কি আকাশটা ঢেকে যাবে?

 

একদিন সবগুলো চিঠি নিয়ে সাগরিকা চলে আসে। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর চিঠিগুলো নিয়ে বসে। সেদিনও রাতের আকাশে চাঁদ নেই। তারা নেই। সাগরিকা তৃতীয় চিঠিটা খোলে—

 

প্রিয় এস,      

আজ কি আকাশটা পুড়ে গেছে? এত অন্ধকার! চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করে। আমার শরীরে কি কোনোদিন চাঁদ উঠবে না? তুমিও চাঁদের জন্য হাহাকার করো। আমাদের মিলনবেলায় গোধূলিতে কে আঁকবে? সব রংতুলি নিয়ে পালিয়েছে ঈশ্বর। নিষ্ঠুর ঈশ্বর। সে মূর্তি হয়ে আমার মূর্তিতে অবিবেচক! আমাকে সময় দাও। আমিও মূর্তি হয়ে উঠব। তুমি হবে একমাত্র দর্শনার্থী। পুজো দেবে। শুধু তুমি

                                                                                                                                           ইতি

তোমার মোহন

 

মোহনের চিঠির ভাষা পুরোটা সাগরিকার কাছে পরিষ্কার হয় না। তবে অস্থিরতা কাজ করে। একটানা চিঠি পড়তে পারে না। এই চিঠিগুলো সাগরিকাকে দ্রুত পড়ে ফেলতে হবে। যত কষ্টই হোক। কে এই ‘এস’? এই চিঠির সঙ্গে তার মৃত্যুর একটা যোগ আছে। সাগরিকা পরের চিঠিটা পড়তে শুরু করে—

 

প্রিয় এস,

      দূরে কেউ বেহালা বাজাচ্ছে। এই অন্ধকারে আমি যে পুড়ছি সম্রাট নীরোর মতো সেও কি খোঁজ রাখেনি পাশে কোথাও পুড়ছে। তুমি কি টের পাচ্ছ? এত দাউ দাউ আগুন! সুরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে ধোঁয়া। চারিধার সাদা। বিধবার শাড়ির মতো ঢেকে দিয়েছে। আমাকে বলছে, পরে নাও। পরে নাও। মুক্তি পাবে। ওই বেহালার সুর তোমাকে আশ্বস্ত করবে না

                                                                                                                                                               ইতি                                                                                                                                                           মোহন

 

 

সাদা শাড়ির ব্যাপারটা সাগরিকাকে পুরো ঘেঁটে দিল। সে বারান্দায় বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ ভাবতে লাগল। মোহন সাদা শাড়ি পরলে কেন মুক্তি পাবে? কিছুতেই কিছু বুঝতে পারে না। সব যেন ঘেঁটে ঘ হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার আকাশে সাগরিকা একটানা তাকিয়েই আছে। অনেকটা রাত হয়েছে। এইসময় সচরাচর রাস্তায় কাউকে দেখা যায় না। দু-জনের চিৎকার করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। কথা শুনে মনে হল, দু-জনেই ছেলে। এই রাতে কেন তারা চিৎকার করছে বোঝা গেল না। শুধু একটি শব্দ শোনা গেল ‘তোমাকে চাঁদের মতো ভালোবাসি’। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা এগিয়ে গেল। বলা যায়, মিলিয়ে গেল বা অন্ধকার গিলে নিল। কিন্তু, সাগরিকা কোথাও যেন একটা আলো দেখল। সে তৎক্ষণাৎ ঘরে ঢুকে পঞ্চম চিঠিটা খুলল—

 

প্রিয় এস,

      প্রথমে বুকটা দুরুদুরু করলেও এখন আর ভয় করে না। কারণ, তুমি আছ। তুমি থাকবে তো এভাবেই? আমার বুকে ফসল ফলবে। যে ফসলভরা মাঠ তুমি চেয়েছ তেমন। কোনো ভাগচাষি থাকবে না। এই মাঠ তোমার। তুমি খেলবে। তুমি জিরোবে। তুমি রোপন করবে। এই মাঠের প্রাক্‌প্রস্তুতি শুরু করেছি।  

                                                                                                                                                               ইতি                                                                                                                                                              মোহন

 

সাগরিকার কাছে বিষয়টা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসলেও জট খুলছে না। কে এই ‘এস’। পরের চিঠিতে কি আছে তার সম্পূর্ণ নাম বা পরিচয়? সে পরের চিঠিটা পড়া শুরু করে—

 

প্রিয় এস,

      আজ আকাশে চাঁদ আছে। আজ চারিদিকে আলো আর আলো। এই আলো আমি যতটা উপভোগ করছি, অন্য কেউ করবে না। আজ কোনো তারাই খসে পড়বে না। আমি একটা লাল টুকটুকে বেনারসি কিনেছি। পরে জোছনার নীচে দাঁড়িয়ে আছি। চাঁদ আমাকে আদর করছে। তারারা সেই আনন্দে আরো বেশি জ্বলে উঠছে। এই রাতে তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ? আমার চিঠি কি তুমি পাও? আমাদের কি কোনোদিন দেখা হবে না? প্রথম যেদিন স্বপ্নে এসেছিলে, আমাকে হাত ধরে নদীর ধারে নিয়ে গিয়েছিলে। বলেছিলে, নদীর মতো জীবনকে বইতে দাও। সব বাধা অতিক্রম করতে হবে। এই কচুরিপানায় আটকে গেলে নিজের জলে নিজে ডুববে। পাড় ভেঙে যাবে। কেউ কারো না। তুমি যা তাই ধারণ কোরো। শরীরকে মনের রূপ দাও। মন একটা আস্ত পৃথিবী। মনকে তালা দিয়ে বাঁচা যায় না। সেদিনই আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তোমাকে চেয়েছি। তুমি আর আসোনি। কিন্তু আমার ভিতরের বাঁধ ভেঙে দিয়েছ। আমি বাঁধ ভাঙা এক নদী, তা বাবা-মা-বন্ধু-বান্ধবী কাউকে টের পেতে দিইনি। শুধু তোমার কাছে উন্মুক্ত হয়েছি।

                                                                                                                                                              ইতি                                                                                                                                                              মোহন

 

 

 

বিষয়টা সাগরিকার কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে এলেও ‘এস’ ব্যাপারটা কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছে না। আর তার আত্মহত্যার কারণ। সাগরিকা ঘামছে। আর একটিই চিঠি পড়ে আছে। কী আছে তাতে? তার বন্ধু, মনেরমানুষ মোহনের মৃত্যুরহস্য কি উন্মোচিত হবে? না, মোহনকে পাওয়ার তার অপেক্ষা এই চিঠি জিরিয়ে রাখবে। সাগরিকা একবার চিঠি হাতে নেয়। একবার টেবিলে রাখে। হঠাৎ, কারেন্ট চলে যায়। বাইরে শোনা যায়, কিছু পড়ার শব্দ। জানালা খুলতে দেখে ঝড় উঠেছে। মোবাইলের লাইটটা জ্বালিয়ে শেষ চিঠিটা পড়তে শুরু করলো সে—

 

প্রিয় এস,

     এবার থেকে আমি মোহনা নামেই তোমায় চিঠি লিখব। কিছুদিনের মধ্যে মোহনের শরীরে মোহনার আকার আসবে। সেদিন কি তোমার দেখা পাব? যদি তার আগেই আমার কিছু হয়ে যায় শরীর রূপান্তরের এই প্রক্রিয়া তো সহজ নয় এমনও তো হতে পারে এটাই শেষ চিঠি। লেখা শেষ হলে আবার সেই আকাশের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেব। এতদিন যাবৎ সব চিঠিতে তোমায় ‘এস’ বলে উল্লেখ করেছি। তুমি তোমার নাম বলোনি। কিন্তু এই ‘এস’ কেন জানো? ‘এস’ ফর ‘শক্তি’। আসলে তুমি আমার শক্তি। একুশটা বছর আমি এই শক্তি পাইনি। কুঁকড়ে থাকতাম। সকলের থেকে দূরে থাকতাম। আমার ভিতরটাকে কাউকে বুঝতে দিতাম না। শোনো শক্তি, চিঠিগুলো সব যত্নে রেখো। আর যদি কখনো চিঠি পাঠাতে না-পারি মনখারাপ কোরো না।

 

                                                                                                                                                                   ইতি                                                                                                                                                                              মোহনা     

 

‘এস’-এর ব্যাপারটা ক্লিয়ার হলেও মোহনের মৃত্যুর ব্যাপারটা এখনো স্পষ্ট হল না। সাগরিকার কাছে আর কোনো চিঠি পড়ে নেই। এই রহস্য কি উন্মোচন হবে না? মোহন নিজের মতোই যখন বাঁচতে চাইছিল তাহলে আত্মহত্যা কেন করল? সে অনেকটা পথ অতিক্রম করে আলো খুঁজে নিয়েছিল সাগরিকা আবার মোহনের বাড়িতে যায়। সারা ঘর খুঁজতে থাকে। তার নতুন একটি ডায়েরির ভিতর থেকে কয়েক টুকরো কাগজ ছাড়া কিছুই পায় না। ডায়েরিটাতে সে কখনো কিচ্ছু লেখেনি। প্রথম পাতায় গোলাপি কালিতে লিখে রেখেছে ‘এস’। সাগরিকা খেয়াল করে দেখে, প্রতিটা টুকরোতে একটি করে শব্দ লেখা। এটিই হয়ত তার শেষ চিঠির প্রস্তুতি ছিল। হয়ত-বা জীবনেরও  সেগুলো জোড়া দিয়ে দেখা যায় তাতে লেখা আছে— ‘খালি পায়ে বেশিদূর এগোনো যায় না’