আহম্মকের চিত্রাবলী
অমিত বিশ্বাস, কৃষ্ণনগর
অসহযোগ আন্দোলন চলছে প্রায় সারা ভারতবর্ষ জুড়ে। প্রায় বললাম কারণ শান্তিনিকেতনে তার তেমন প্রভাব, অসহিষ্ণুতার প্রমাণ মেলে না। একদিন শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় স্টুডিওতে বসে কাজ করছেন,এমন সময় তাঁর এক বন্ধু উপস্থিত হয়ে বললেন "দেশের এই দুর্দিনে আপনার লজ্জা করে না বসে বসে কাগজে রঙ লেপতে?" এখন প্রশ্ন হলো দেশে, রাজ্যে অথবা শহরে এইরকম রাজনৈতিক অথবা সামাজিক অবক্ষয়, আন্দোলন প্রভৃতি ইমার্জেন্সিতে শিল্পী/কবি প্রভৃতি বুদ্ধিজীবীদের করণীয় কি? তাদের কাজ কী হবে তা কে নির্ণয় করে দেবে? তাঁর সামাজিক বা রাজনৈতিক দায় আদৌ আছে? মাত্র কয়েক বছর আগে 'উন্নয়ণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে' শব্দগুচ্ছ জন্য রচয়িতা শঙ্খ ঘোষ মহাশয়কে মৃত্যুর পূর্বে ঠিক কি ধরণের ক্লেশ সহ্য করতে হয়েছিল, তাতো আমাদের সবারই জানা!
ঠিক এইরকম প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হয়েছিল বাংলাদেশের শিল্পাচার্য শ্রদ্ধেয় জয়নুল আবেদিন মহাশয়কে। জীবিত অবস্থায় নয়, তাঁর মৃত্যুর প্রায় চার দশক পর সম্প্রতি। প্রশ্নটি ছিল ভারী অদ্ভুত, একদল মানুষ হঠাৎ খুঁজে বের করলেন জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানী সেনা ও রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারের বিষয়ে নীরব ছিলেন। কোনো ছবি আঁকেন নি, কোনো মত প্রকাশ করেন নি । বর্তমান 'রুচির দূর্ভিক্ষ'এর সমাজে এই একটি নতুন ট্রেন্ড, বিখ্যাত ব্যক্তিকে দাগিয়ে দাও ... প্রমাণের দায় তো স্বয়ং তাঁর, বক্তার নয়! সম্প্রতি জয়নুল আবেদিনের একটি খেরোর খাতা খুঁজে পাওয়া গেছে, সেখান থেকে একটি স্কেচের বর্ণনা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করলাম।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল। পথমধ্যে একজন মানুষ মাটিতে মৃতবৎ পড়ে আছেন, একজন পাকিস্তানী সৈনিক তাঁর গায়ের উপর নিজের ভারী বুটজুতো চেপে ধরে হাতে ধরা রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে বাংলাদেশি মানুষটির মৃত্যু 'কনফার্মড' করছে। সৈনিকটির অপর হাতে ধরা রয়েছে অন্য একটি টেনে হিঁচড়ে আনা মানুষ ...এই মানুষটিকে হয়তো খেরোর খাতার আগের পাতায় আঁকা আহত মানুষটির স্কেচটির মতো নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে, জীবন্ত সলিল সমাধির জন্য। আপাত নিরীহ দেখতে যুগ্ম-রেখাচিত্রটির মধ্যে পাকিস্তানি সেনার যে বীভৎসতা ধরা রয়েছে তা এক কথায় অনবদ্য। এরজন্য শিল্পাচার্যের প্রয়োজন হয় নি কোনো এক্সপ্রেশনিজম আন্দোলনের মুখবিকৃতি প্রতিরূপ, শিল্পের নান্দনিকতা দিয়েই ফুটিয়ে তুলেছেন পাকিস্তানি পাশবিকতা। অপর পাতায় দেখি একজন মাকে তাঁর শিশুসন্তানের সামনে পাক-সেনারা জঙ্গলের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে... সেলফি তুলে ফেসবুক/ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করবার জন্য নয়, সেকথা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। এবার প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্কেচগুলি থেকে কোনো প্রকৃত শিল্পী কি পূর্ণাঙ্গ ছবি গড়ে তুলতে চাইবেন, যেখানে তাঁর দেশের সন্তান, তাঁর ভাইয়ের হত্যার দৃশ্য অথবা এক মাকে সামগ্রিকভাবে নষ্ট করবার ছবি চিত্রিত করবেন? অন্যদিকে কোনো দর্শক বা সংগ্রাহক সেই কাজটি যত্ন করে তাঁর ড্রইং রুমে টাঙিয়ে রাখবেন, যাতে প্রতিনিয়ত সেই ছবি দেখে তাঁর মনে বিবমিষার উদ্রেগ হয় !!! নিশ্চয়ই নয়। তাহলে আমাদের ঘরে ঘরে জালিওয়ালাবাগের হত্যার দৃশ্যের উপর নির্মিত ছবি স্থান পেত। তাই স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি আঁকলেন বাংলাদেশের সমৃদ্ধির ছবি, হাজার বছর ধরে চলে আসা গ্রামীণ চেতনার ছবি, বাঙালির এগিয়ে চলার ছবি। একই ধরণের অনুভুতি আমরা শিল্পী চিত্তপ্রসাদের সৃষ্টিতেও পাই। স্বাধীনতা পরবর্তীতে তাঁর আঁকা ছবিগুলিতে আর প্রতিবাদ ছিল না, ছিল শ্বাশত জীবনের সমৃদ্ধির ছবি, আনন্দের ছবি।
শিল্পী গণেশ পাইন মহাশয় একবার কলাসমালোচক মৃণাল ঘোষ মহাশয়ের নেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ' বাইরে ১৯৬৯,'৭০, '৭১,'৭২ যে সময়টা গেছে উত্তাল, সেগুলো আমি প্রত্যক্ষত দেখেছি, চিনেছি, কেননা আমার বাস যে অঞ্চলে নিত্যই সংগ্রাম এবং সংগ্রামের নামে প্রহসন, এই দুটোই প্রত্যক্ষভাবে দেখেছিলাম।' যেহেতু শুধু সংগ্রাম নয়, সংগ্রামের নামে প্রহসন তিনি দেখেছিলেন, তাই তাঁর পরবর্তীকালের ছবিতে এইধরণের প্রতিবাদ বিশেষ কিছু আমরা পাই না। সেইসময় আনন্দবাজার পত্রিকা ৭১' শিরোনামে আর্টিষ্টদের একটি সিরিজ করেছিল, সেখানে গণেশ পাইন এঁকেছিলেন হাঁ করে চিৎকার করার মত একটি প্রোফাইল আর ব্যাকগ্রাউন্ডে রক্তাক্ত হাতের ছাপ। এইছবিটি যন্ত্রনার ছবি, সরাসরি নয়, রূপকার্থে। গণেশ পাইনের জনপ্রিয় ছবিগুলির মধ্যে কিন্তু এর দেখা বা উল্লেখ নেই।
সমসাময়িক শিল্পী বিকাশ ভট্টচার্য মহাশয়ের ছবিতে বরং এই পর্বে বেশ কিছু ছবির সন্ধান পাই। একটি ছবিতে আমরা দেখি উত্তর কলিকাতার সে বনেদি সমৃদ্ধ গলি, যেখান থেকে দুইজন যুবকের আলো-আঁধারী ঘেঁষা মুর্তি দর্শকের দিকে এগিয়ে আসছে। লক্ষণীয় যুবকদুটির মাথা সম্পূর্ণ অদৃশ্য। এইছবিটি দ্বারা নকশাল আন্দোলনের একটি বিশেষ দিকের কথা এখানে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন শিল্পী। ওপর একটি ছবিতে আমরা দেখি ৭০এর উত্তাল দশকে গুলিবিদ্ধ তরুণের ইন্টারভিউ নেওয়ার ছবি। যেখানে আমরা দেখি বীভৎসার মধ্যে এক করুণাহীন পরাবাস্তব রয়েছে, যে পরাবাস্তব বশ্, দালি কিংবা মাগ্রিতের পরাবাস্তব দর্শন থেকে ভিন্ন। লক্ষণীয় আজকের নিউজ মিডিয়াগুলির সাম্প্রতিক কর্মকান্ড এই সত্যতা প্রমাণিত করবে।
কিছুদিন আগে এই সময়ের উল্লেখযোগ্য শিল্পী চন্দ্র ভট্টাচার্যের 'শান্তিনিকেতন' শিরোনামের একক প্রদর্শনীতে শিল্পী দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের আদর্শের উপর গড়ে ওঠা দেউল আজ আজ শহুরে গ্রাসে প্রায় বিলুপ্ত। পুরো চিত্রপটে সিমেন্টের সীমানা নির্নয়ক পিলার, ইটের টুকরো, পাথরের স্তূপ ভর্তি। বড় বড় গাছ কাটা অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। ঘাস,গুল্মের ঝোপের পাশে একটি জংধরা লোহার পিলার উপস্থিত ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। অত্যন্ত নির্বাচিত বস্তুসমন্বয় এবং দক্ষ রচনায় সারাবিশ্বের কর্পোরেট গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সামাজিক / নান্দনিক আগ্রাসন অতি সহজেই চিত্রপটে সঞ্চারিত করেছেন তিনি।
ফিরে আসি শুরুর প্রসঙ্গে। চল্লিশের দশকের প্রথমার্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, এইমধ্যে ১৯৪৩ মন্বন্তর ... ১৯৪৬ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ... এদেশের মানুষেরা যেন সব ধরণের মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়েছিল ... পর পর ধাক্কায় সাধারণ মানুষ দিশা হারা । শিল্পী বিনোদবিহারী তাই পরিকল্পনা করলেন এমন এক ম্যুরাল যাতে থাকবে মনুষ্যত্বের জয়গান ... এক পথের দিশা। বিশ্বভারতীর হিন্দীভবনের দেওয়ালে অনুমতি মিলল। শতাধিক রেখাচিত্র গড়লেন পরিকল্পনাকালে। বিষয়বস্তু মধ্যযুগের সন্তরা। রুইদাস, গুরগোবিন্দ সিং, কবীর, দাদু, তুলসীদাস ... আরো অনেকেই যারা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী থেকে উঠে এসেছে, বলেছেন মানবপ্রেমের কথা, সহজ সরল বেঁচে থাকার কথা। এনারা জাতপাত, ধর্মীয় ভেদাভেদ মানেন নি, উপেক্ষা করেছেন। শিল্পী এই সঙ্গে জুড়েছেন মানবের সনাতনী চরিত্র ... স্তনদানে ব্যস্ত মা, নৌকার চলমান জীবন, ভজনরত মানুষ, কর্মরত মহিলা-পুরুষের দল ইত্যাদি। দেখাতে চেয়েছেন মানুষ্যের কর্ম ও আধ্যাত্মিক জীবনই হলো তাঁর আসল পরিচয়... লক্ষ্য। হিন্দীভবনের সেন্ট্রাল হলে তিনটি দেওয়াল জুড়ে শিল্পী Fresco Buono পদ্ধতিতে ছবিগুলি এঁকেছেন কোনো প্রকার tracing ছাড়াই। শিল্পীর লেখা থেকে জানতে পারি এইপর্বে শিল্পীকে দেওয়ালের আস্তর ছড়ানো, দেওয়াল ভেজানোর কাজে সাহায্য করতে অন্য চারজন ছাত্রদের সাথে উপস্থিত ছিলেন সুব্রমন্যম নামে একজন ছাত্র,যাকে শিল্পী ডাকতেন মনি বলে। জীবনের শুরুতে অর্থাৎ সদ্য তরুণাবস্থায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। এই ঘটনার ফল স্বরূপ ইংরেজ আমলের সব ধরণের সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার অধিকার বিনষ্ট হয় এবং একপ্রকার বাধ্য হয়েই ১৯৪৪ সালে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ভর্তি হন। অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে অন্য সহকারী ছাত্র দেবকীনন্দনের সাথে Life of Medieval Saints ম্যুরালে শিল্পীকে সাহায্য করেছিলেন। বিনোদবিহারীর সাথে দীর্ঘ সময়ে থাকার ফলে তাঁর বৌদ্ধিক চেতনার উন্মেষ ঘটে, তিনি তাঁর পরবর্তী কর্মপদ্ধতি স্থির করে নিলেন। নিজেকে শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং শিল্পীর কি করা উচিত তা তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ছড়িয়ে দিলেন। তাঁর পুরো নাম কে. জি. সুব্রামনিয়ন (১৯২৮-২০১৬), শিল্পীমহল তাকে চেনে 'মানিদা' বলে। এক সৃষ্টি অনেক কথা বলে।
সর্বশেষ নিজের একটি ছবির কথা বলি, ছবির শিরোনাম The Shrine (Fallacy series) ... সাম্প্রতিক চিত্র। বর্তমান ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিবাদে একজন শিল্পী কি করতে পারেন ? নিশ্চয় হাতে অস্ত্র তুলে নেবেন না অথবা এমন কাজ করবেন না যা বিচ্ছিন্নবাদীদের সহায়তা হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। আমাদের সামাজিক চেতনা, নান্দনিক চেতনাও যেন কোনো কর্পোরেট গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে পরিষ্কার বোঝা যায় লোকে শো-অফ অথবা শেয়ারে ব্যস্ত অথচ কি করছেন, কেন করছেন সেই নিয়ে আলোচনা শুরুতেই সমাপ্ত ঘোষণা হয়ে যায়। বড় ব্যক্তি বলেছেন তাই সেটি সঠিক ... বিশ্লেষণের কিবা প্রয়োজন !!! এই ভ্রান্তি (Fallacy) থেকেই এই সিরিজের আবির্ভাব। ছবিতে একটি দেউল উপস্থিত, যাকে আমরা বাসা, নিজের মনজগত অথবা পবিত্র মন্দির ভেবে নিতে পারি। তার ঠিক মাঝ বরাবর সিমেন্টের সীমানা নির্নয়ক পিলার উপস্থিত। আমাদের ভাবনাও আজ বিভাজিত, অপরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
প্রত্যেক মানুষই একটি বিশেষ দেশ ও কালের মানুষ। তিনি যদি সৃজনশীল মানুষ হন, তাহলেও তার সৃষ্টিতা তাঁর দেশ ও কালের বিশেষ পরিপ্রেক্ষিত অবশ্যই ধরা পড়ে। কোনো সৃষ্টিই দেশকাল নিরপেক্ষ নয়। দেশকালের সাময়িকতা পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত । আজ যা সাময়িক, আগামীকাল তা ইতিহাস। প্রসঙ্গত জানাই এই শিল্পপাঠটি একান্তই ব্যক্তিগত পাঠ, পাঠকসাধারণ এই পথটিকে একমাত্র পথ বলে ধরবেন না নিশ্চয়। দুইবাংলায় অনেক মহান শিল্পী জন্মগ্রহণ করেছেন, এর মধ্যে থেকে মাত্র আটজন শিল্পীর ছবির পাঠ বা সিরিজচিত্র এখানে আলোচনা করা হয়েছে ... অনালোচিত রয়ে গেছে আরো অনেক মহৎ শিল্পীর শিল্পকর্ম।
1 comments:
ভাল লাগল। অনেক কিছু জানতে পারলাম। সমৃদ্ধ হলাম।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন