সোমবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৩

সমালোচনা - শুভেন্দু দেবনাথ


সমালোচনা 

শুভেন্দু দেবনাথ


মহাকাশে ফিরে এসো লেখা

 

মধ্যরাত্রি। নোয়াপাড়া মেট্রোর অফিসে ডিউটি করছেন এক যুবক। হঠাৎ কাছেই জঙ্গলে ডেকে ওঠে শেয়াল। নির্জন অফিস, খাঁ খাঁ রাস্তা। শেয়ালের ডাকে তাঁর নেশা হয়। একা একাই সে বেরিয়ে আসে অফিস থেকে নেশাগ্রস্তের মতো শেয়ালের ডাক শুনতে। মোবাইলের আলোয় খুঁজে ফেরে ডাকের উৎস। আবার কখনও ঠাকুর নগরের বাড়ির কাছেই ঝাঁ ঝাঁ রোদে গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে সে অনেকদিন পর শুনতে পায় ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। এসব ডাক তাঁকে নেশাগ্রস্ত করে, নিশির মতো হাতছানি দেয় তাঁকে। এভাবেই যখন তখন বেরিয়ে পড়ে সে, যেখানে সেখানে। শিশুর মতো, অথবা কবির কৌতুহল নিবারণে। আবার এই যুবকই বাড়ি ফিরে তার শিশুকন্যাকে গল্প শোনায় ঝিঁঝিঁদের, শেয়ালের অথবা রাজকন্যে রাখাল বালকের।  ইতি উতি শোনা গল্প, জীবনানন্দ দাশ নাকি মধ্য রাত্রে বাড়ির কাছের গাছে ঢিল ছুঁড়তেন পেঁচার ডাক শুনবেন বলে, অথবা মধ্যরাতে পাখিদের ডান ছটফটানির আওয়াজ শুনবেন বলে। এই যুবককেও তেমনি তাড়া করে বেড়ায় মধ্যরাতের শেয়ালের ডাক, দুপুরের ঝিঁঝিঁ পোকা অথবা টল টলে পুকুরে মাছেদের টুপ শব্দ। মাথাটা খারাপ বোধহয়, অনেকেই ওই যুবক সম্পর্কে মনে করতে পারেন। আদপেই মাথা খারাপ। আসলে তার মাথাটা খেয়ে ফেলেছিলেন আরও একজন বয়স্ক বৃদ্ধ। একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যদি ফিরে যাওয়া যায় তাহলে ঠাকুরনগরের এক ভাঙাচোরা বাড়ির জানলা দিয়ে দেখা যাবে তক্তপোষের উপর খাতার উপর ঝুঁকে পড়েছেন এক বয়োঃবৃদ্ধ মানুষ। উস্কোখুস্কো চুল, গালে অবিন্যস্ত দাড়ি, লোলচর্ম। খারার উপর ঝুঁকে পড়ে অঙ্ক কষছেন তিনি। নাহ আসলে অঙ্কের ফর্মুলায় কবিতা লিখছেন। এ তার নতুন খেলা। অসুস্থ সে বৃদ্ধ। শারীরিকভাবে, কিছুটা মানসিকভাবেও। প্রায় দু-তিন দশক আগে যার একটা বই বদলে দিয়েছিল বাংলা কবিতার ইতিহাস। আমুল বদলে ফেলেছিল কবিতার গতি প্রকৃতি। ‘গায়ত্রীকে’ অথবা ‘ফিরে এসো চাকা’ সে বইয়ের নাম যাই হোক না কেনো, নাড়িয়ে দিয়েছিল বাংলা কবিতার ভিত। তিনি বিনয় মজুমদার। যার শেষ জীবনের আশ্রয় ছিলেন ওই যুবক। সুকৃতি সিকদার।

বিনয় যখন মানসিকভাবে অসুস্থ অথবা বলা যায় আত্মমগ্ন, তখন সুকৃতিই দেখভাল করতেন কবির। কখনও দিনের পর দিন জামা পরিয়ে দিয়েছেন, পরিচর্যা করেছেন, আবার অবাধ্য কবিকে জোর করে জামা পড়াতে গিয়ে শুনেছেন অকথ্য গালিগালাজ। কিন্তু ধৈর্য্য হারাননি সুকৃতি, কারণ কবির মানসিক বৈকল্যের খবর তাঁর অজানা নয়, সেবা করতে করতে সে নিজেও তো প্রায় মোহগ্রস্ত। পাশে বসে দেখেছেন খাতার পর খাতা জুড়ে অঙ্কের জটিল সূত্রের কাটাকাটি। জটিল সূত্র ধরে অঙ্কের ফর্মুলায় কবিতা লিখছেন বিনয়। আবার কখনও বা বিনয় বিকেলবেলা একা একা বসে আছেন ঠাকুরনগর রেলস্টেশনে। চারদিকে কেউ নেই, ট্রেন চলে যাচ্ছে একটার পর একটা। পাশে চুপ করে বসে আছে সুকৃতি। দুজনের মধ্যে কথা নেই, নাকি আছে। দুই কবির নীরবতার ভাষা একে অন্যের মধ্যে পালাবদল হয়ে যাচ্ছে কবিতার ভাব ভাষা। এসব গল্প সুকৃতির কাছেই শোনা। আর অনেকেই হয়ত জানেন না দুই অসমবয়স্ক কবির এই সখ্যতাই গত দশকে ঘটিয়ে ফেলেছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সুকৃতি শিকদারের প্রথম বই ‘দূরত্ব মানি না আমি’ র প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন অসুস্থ বিনয় মজুমদারই। যে কোনো তরুণ কবির কাছে এ এক অমোঘ পাওয়া বৈকি! কবি বিনয় মজুমদারের কাছ থেকে পাওয়া উত্তরাধিকারই সুকৃতির মধ্যে জন্ম দিয়েছিল এক অদ্ভুত পাগলামির। প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখা, রাতের গভীরে শেয়ালের ডাক শোনা, অথবা গাছেদের ঝরা পাতায় শিরশির শব্দের উৎস খোঁজা। আর এই খোঁজ থেকেই তো জন্ম হয় – ‘গেটের সামনে এসে মনে হল এইখানে থেমে গেছে পথ/ একা তুমি চলমান তাই জলের নিজস্ব আত্মা উড়ে গেছে/ সুদূর বৈরাগে, তারারাও পরিচিত হবে বলে পৃথিবীতে / রাত নেমে আসে। তবু যার শুধু চাঁদই সম্বল সে-তো মানে / উৎপাদনের আসল সময় হল রাত। তরল হলেও / পারদে ধাতুর গুণ; হলইবা দিন, চোখ থেকে তীব্র আলো / সরতেই স্বাভাবিক আলোক মূহূর্তে ঘর অন্ধকার লাগে” (৩৪, দূরত্ব মানি না আমি)।

 

বিনয়কে পুরোপুরি পেয়েছিল সুকৃতি, অথবা সুকৃতিকে পেয়েছিল বিনয়। অনেকটা ভুতে পাওয়ার মতো। সকালে বিনয়, দুপুরে বিনয়, রাতে বিনয়, শয়নে বিনয়, জাগরণে বিনয়, এমনকী স্বপনেও বিনয়। আসলে সুকৃতির জীবনটাই বিনয়ময়। যেনো বিনয় ছাড়া সুকৃতি অচল, অতীতে ঠিক যেমন শেষবেলায় সুকৃতি ছাড়া অচল ছিলেন বিনয়। বিনয় হারিয়ে গেছেন মহাকাশের পথে। কিন্তু সে তো আম পাঠকের কাছে, সুকৃতির কাছে আজও বিনয় বিদ্যমান। আর তারই প্রমাণ মেলে সুকৃতির সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ ‘মহাকাশে এসে লেখা’-র মধ্যে। এ বইটির কবিতাগুলো যেনো বর্তমান সুকৃতি নয়, বিনয়ের জীবিতকালে তার দেখভাল করা তরুণ সুকৃতির লেখা। অথবা মহাকাশে বিলীন বিনয় সুকৃতির মধ্যে ভর করেছেন। আত্মায় পাওয়ার মতো করে সুকৃতিকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছেন সেসব বেহিসেবী দিন। এই কাব্যগ্রন্থটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শুধুই বিনয়। যে বইয়ের প্রথম কবিতার নাম ‘প্লেটোর বিনয়’ আর শেষ কবিতার নাম ‘বিনয়ানন্দ ঠাকুর’। নাহ এই বই বিনয়ময় হলেও শুধু বিনয়ে থেমে থাকেনি, বরং বিনয়ের আড়ালে রয়েছে এক অদ্ভুত যাপন, রয়েছে বর্তমান বাংলা সাহিত্যের সিন্ডিকেট রাজের বিরুদ্ধে প্রচ্ছন্ন ব্যাঙ্গও। আর যা আছে তা হলে বড় বড় নক্ষত্রের সমাবেশেও কীভাবে তাদের আলোর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে প্রকৃত কবি হতে হয় তার উদাহরণ। এই বইয়ের প্রথম কবিতাটি যেমন। ‘প্লেটোর বিনয়’ নাম শুনলেই পাঠক ভাববেন ভীষণই গুরুগম্ভীর কিংম্বা দর্শনের কথা থাকবে কবিতায় তাহলে অশোক মিত্রের লাইন ধার করে বলি, 'রে অর্বাচীন, তুমি একশোতে শূন্যেরও কম পেলে'। “অথচ কচ্ছপ ভাল প্রেমিক হয় না, / প্রেমিকের খোলস হয় না / মুখোশ থাকতে পারে কোনও। / এই দ্যাখো যেরকম আমি/ রাত নেই, দিন নেই… ঘষাঘষি করে হাত / বোকা চণ্ডালের মতো আয়নার পথে / বেরিয়ে পড়েছি নায়কদের পাড়ায় / মৃত্যুঞ্জয়দের বাড়ি মাঠের ভিতরে / ঘাসবনে অমিতের খাটিয়ায় শুয়ে / পড়েছি দাঁড়িয়ে… “( প্লেটোর বিনয় / মহাকাশে এসে লেখা)। দীর্ঘ এ কবিতায় সুকৃতি বিনয় থেকে চলে যান সেই দশকের কবিতার নক্ষত্রদের চলাফেরায়। দূর থেকে তাদের চলাচল প্রত্যক্ষ করেন, আবার ফিরে আসেন প্রকৃতির কাছে, আবার ফিরে আসেন বিনয়ের কাছে, যা তার নিজের জায়গা, যা তার একান্ত কবিতা যাপন। স্রোতের টানে নয় বরং বিপরীতে। এই কবিতায় এক জায়গায় এসে সুকৃতি ফেরেন শিকড়ের কাছে। “আসলে তো ছিঁড়েই ছিলাম। / খুব বেশি ছেঁড়ার ভিতর জুড়ে যাওয়া। / পাতার আড়ালে চোখও তো / একটু জুড়িয়ে গেলে দ্যাখে / তপনের সাথে তারাপীঠে / চোখ লাল রাতের বেলায়, / নায়কের সাথে বাঁশি নিয়ে / ঘুরেছি শ্মশানে আর আভাসের সাথে ঘাটশিলা… / ফুলডুংরি পাহাড় জানে তার / সবুজ শরীর জুড়ে টেম্পল অফ / লাভের সামনে শালের জঙ্গল আর জঙ্গলের / সামনে আবার সেই লাভ অফ টেম্পলের বেলা”।

 

যার যাপনে বিনয় তার কবিতায় বিনয় আসবে না তা প্রায় অসম্ভব। বিশেষত বর্তমান বিনয়হীন পৃথিবীতে। তাই অবধারিতভাবেই এই কবিতায় বারে বারে বিনয় এসেছেন। “আমি চোখ খোলা রাখতেই চাই / মৃত্যুর পরেও যেরকম / অনেকের  চোখ খোলা থাকে। / চারদিকে সাদার ভেতরে / মাঝখানে ঠিক কালো মণির মতন / বিনয়দা আর আমি পৃথিবীর বারান্দায় বসে / দেখছি একটি পাখি যেই / গরুটির শিং-এ এসে বসে / গরু তার মাথাটি দোলায়। / তবুও পাখিটি আসে বারবার ফিরে! / আমরা দুজন হাতে দানাপানি নিয়ে / বাড়িয়ে রেখেছি হাত কতদিন হয়ে গেল বসে… / কোনও পাখি এসে তো বসেনি হাতে আর। / হাত তবু লম্বা হতে চেয়ে / আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেছে”। গরুর শিং-এ পাখি এসে বসা, খুবই তুচ্ছ ঘটনা, কখনও চোখে পড়ে আবার কখনও পড়েও না হয়ত। তবু এই অতি তুচ্ছ ঘটনার ডিটেলিংও কিন্তু নজর এড়ায় না কবির; বরং এই তুচ্ছ তুচ্ছাটি ঘটনাকেও বিনয় যাপনে মিশিয়ে সুকৃতি ফিরে পেতে চায়, আর সেই চাওয়ার আকুলতাই তাকে এখনও হাঁটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই হয়ত মাঝরাতে শেয়ালের ডাক শুনে অফিস থেকে ছুটে বেরিয়ে যায় সুকৃতি নেশাগ্রস্ত পাগলের মতো। বিনয় যাপন সুকৃতিকে এমন পাগল করে রেখেছে এখনও যে বিনয়ের না থাকার শূন্যতা তাকে বিষাদ এনে দেয় জীবনে। তাই সুকৃতির কলমে ছলকে ওঠে হাহাকার, “আমার তো বিনয়দা ছাড়া কেউ নেই! / এমনকী আমিও ছিলাম না যখন / বিনয়দা আমার মতো ছিল। / একে একে দু হাজার সাতের মেলায় / দেখা হল অনেকের সাথে। / অজস্র ধুলোর মাঝে হাওয়া / চোখে নিয়ে জলের আশ্বাস”। বইমেলার ভীড়ও বিনয়হীন সুকৃতিকে একাকী করে রেখেছে। কারণ বন্ধুরা এসেছে তার কাছে বিনয়ের সঙ্গ লাভের লোভে। সুকৃতিকে ভালবেসে আসেনি তো কেউ। তাই পরের স্তবকেই সেই ক্ষোভ বেরিয়ে যায় সুকৃতির কলমে অজান্তেই, “বন্ধুকে অনেকবার নিয়ে গেছি বিনয়ের বাড়ি। / কিন্তু তার মনে পড়ে বেশি ওই / ওই দিনটির কথা, / যেদিন আমাকে বিড়ি দিয়ে / কাঁপা হাতে একটা বিড়ি ওকেও দিলেন। / বন্ধুটির কোষাগারে আজও / সেই বিড়ি সুরক্ষিত আছে। / কিন্তু বিনয়দা নেই! ফাঁকা ঘর / খাটটা আগের মতো শুয়ে, / পাশে তার দাঁড়িয়ে টেবিল, / চেয়ারটা বসে আছে একা”। সুকৃতির জীবনে সব আছে। বিনয়ের বাড়ি, বিনয়ের স্মৃতি নিয়ে চেয়ার, টেবিল খাট কিন্তু নেই কেবল সুকৃতির আত্মীয়জন আপনার জন তার বিনয়দা। বিনয়ের লেখা, বিনয়ের অঙ্কের সূত্র ধরে শেষ দিকে লেখা পাগলামীগুলো রোজ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে সুকৃতি, “জ্যামিতির কাটাকুটি গেম / ছবির প্রণালী কিছু আর / পুনর্যৌবন প্রাপ্তির সূত্রটি / রাখা আছে একটা ফাইলে। / এসব ঘাঁটাঘাটি করতে গিয়েই / বন্ধুদের সাথে বন্ধুদের ঘষাঘষি / চকচকে করে তোলে আরও। / বন্ধুরা আড়ালে বন্ধুকে / জাতকের ছায়া বলে ডাকে / বলে ওকে ছন্দের বাহক”।

 

পাঠক ভাবছেন, সুকৃতির কবিতা বা বলা ভাল সাম্প্রতিকতম বইটির কবিতাগুলো শুধুই বিনয় নিয়ে প্যানপ্যানানি কিংম্বা বিনয়কে ভাঙিয়ে খাওয়া? কিংম্বা বিনয়ের সঙ্গে কাটানো সময়কে ভাঙিয়ে সস্তা গিমিক। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলার লোভ সামলানো গেলো না। কোনো এক বইমেলায় সুকৃতির সঙ্গে আড্ডা প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল বিনয়ের সঙ্গে কাটানো সময় নিয়ে। কেনো সে গদ্যে সেই অনন্য অভিজ্ঞতার কথা লিখবে না। লাজুক সুকৃতির জবাব ছিল, আমি ওসব লিখতে চাই না, লোকে ভাববে আমি বিনয়দাকে হাইলাইট করে লাইমলাইটে আসতে চাইছি, আমার কবিতা ঢাকা পড়ে যাবে আমারই তৈরি করা মোড়কে। অবাক হয়েছিলাম। আমাদের বয়সী বা  সমসাময়িক যে কেউই এমন অনন্য অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলে তা লিখতে চাইবে। কিন্তু সুকৃতি বিনয়কে সযত্নে রক্ষা করতে চায়। যারা ভাবছেন এই বই শুধু বিনয়কে বা বিনয়ের জীবন নিয়ে তারা ভুল ভাবছেন। সুকৃতির কবিতার এক নিজস্ব ভাষা আছে। আর তা এই সময়ের সকলের চেয়ে আলাদা, স্বতন্ত্র। যে কবিতার স্বর খুব উচ্চকিত না হয়েও জোরালো, আবার তার যেমন বিপ্লব চেতনা আছে তবে তা খুব উঁচু স্বরে নয়, বরং সুকৃতির স্বভাবের মতই নরম কিন্তু দৃঢ়। সুকৃতির কবিতা তাই মিশে যায় না ভিড়ে বরং ভিড়ের মধ্যে তা আলাদা রকমের স্বতন্ত্র। সময় সাময়িক অনেককেই বলতে শুনেছি ধুর আজকাল কবিতার বই বিক্রি হয় না, কবিতা লেখা হচ্ছে না। হচ্ছে খুব দৃঢ়ভাবেই হচ্ছে। প্রকৃত পাঠক সেসব আলাদাভাবে খুঁজে নেয়।

 

শূন্য দশক নিয়ে কবিতার যে এক জোয়ার এসেছে তা অনেকটাই বানের টানে বেনোজলের মতো। সকলেই লিখছে কিন্তু কেউ পড়ছে না। বহু বহু লেখক, বহু বই। কিন্তু তা কতটা কবিতা হয়ে উঠছে সে কথা লেখকও জানেন না। তিনি লিখবেন, মঞ্চে উঠবেন ব্যাস লেখা হল কী হল না তা নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। কিন্তু প্রতিটি দশকের মতোই বর্তমান দশকেও হাতে গোনা কিছু লেখা বা কবি আছেন যাদের পাঠক খুঁজে পড়েন। সুকৃতি সেই তালিকায় একদম প্রথম দিকে থাকবেন। এই প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় অশোক মিত্রকে উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। কবিতা থেকে মিছিলে প্রবন্ধ সংকলনের প্রথব প্রবন্ধটিতেই তিনি লিখছেন, “অনেক কবিতা লিখে 'লে যায় যুবকের দল। চল্লিশ বছর আগেও যেত, তিরিশ-কুড়ি বছর আগেও, ১৯৫৮ সালেও; সুতরাং বাংলাদেশের--এই খন্ডিত, বিজীর্ণ, হেজে -যাওয়া বাংলাদেশের--পটভূমি বদলায়নি। শুধু সন্দেহ, যুবকদলের সংখ্যা বেড়েছে, জনসংখ্যাবৃদ্ধির হারের চেয়ে দ্রুততর গতিতে বেড়েছে। এবং আরো যা, পৃথিবীর পথে-পথে যে-সব সুন্দরীরা মূর্খ সসম্মানে যুবকদলের কবিতা একদা গ্রহণ করতো কি করতো না তারাও ঠিক বধির-নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে নেই, সেই সোনার পিত্তল মূর্তিগুলি পর্যন্ত কবিতা লিখছে।

আশৈশব কবিতা ভালোবাসি, অথবা ভালোবাসতাম। এবং সুন্দরীবিদ্বেষী নই। তবু বাংলাদেশের এই কবিতার প্রপাতে আমি ঘাবড়ে যাই, অবসন্ন বোধ করি, ন্যাক্কারে আমার শ্লেষ্মা 'রে ওঠে। গড়িয়াহাট-রাসবিহারী এভিনিউ- মোড়ে দাঁড়িয়ে গাল পাড়তে ইচ্ছে করে আমার, ওভারটুন হলে বাচ্চা-বাচ্চা কবিদের চতুরালিকে বিশুদ্ধ ন্যাকামি 'লে মনে হয়, এঁরা যখন পরস্পরকে বোদলেয়ারের বদহজমের ওগ্রানি পরিবেশন করেন, দু-কান আঙুলে বুঁজে পাশ থেকে উঠে আসি। অন্তত উঠে আসার প্রবণতা হয় আমার। হয়তো উঠে আসতে পারি না।কারণ আমার মধ্যেও বাঙালি ন্যাকামি, এই ক্লীব কবি-কবিনীদের সঙ্গে তাই দেখা 'লে হাত তুলে নমস্কার করি, হেসে একটা-দুটো কথা বলি, সেই চিরাচরিত আবহাওয়া নিয়ে ভাবনাহীন কথা। এমনকী এঁরাও যখন সৌজন্যবশত নিজেদের পত্রিকার জন্য প্রবন্ধের অনুরোধ করেন, রাজি হয়ে যাই। চেতনার দোষ, মধ্যবিত্ত বাঙালি চেতনার।

ঈষৎ উষ্ণ ভঙ্গিতে কথাগুলি বললাম,কারো-কারো তাই ধারণাভ্রম হওয়া সম্ভব-- যেহেতু বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রসমাজের রূঢ়বাচনের ঐতিহ্য নেই--- আমি রঙ্গ করছি না। না, রঙ্গ আমি করছি না, কৌতুকের প্রস্তাব আমার কল্পনার বাইরে। আমি গাল পাড়বার জন্যই গাল পাড়ছি: এই সব কবির পালের কাব্য মক্শো করার খাতা যদি আমার হস্তগত হতো, আমি নির্দ্বিধায় প্রত্যেকটি কবিতার নীচে মন্তব্য জুড়ে দিতাম 'রে অর্বাচীন, তুমি একশোতে শূন্যেরও কম পেলে'"

 

আমি নিশ্চিত যে সুকৃতির কবিতার খাতা যদি অশোক মিত্রের হস্তগত হত তাহলে তিনি নিঃসন্দেহে একশোয় একশো না দিলেও অন্তত ৭০ থেকে ৮০ নম্বর দিতেন। কারণ সুকৃতির কবিতার বিষয়, তার কবিতার ভাবনা, স্ট্রাকচার, এবং শব্দের ব্যবহার। এখনকার কবিতায় আমি সময়কে পাই না, পাই শুধু প্রেম, গ্যাদগ্যাদে যৌনতা, আমি তুমি তুমি আমির প্যানপ্যানানি সমাহার। তবে তারও নিশ্চিত পাঠক আছে নইলে তাদের লেখা বিকোচ্ছে কী করে, আর না বিকলেই বা পত্র পত্রিকা, বই হচ্ছে কেন। কিন্তু বিষয় বৈচিত্রে এখানেই অনন্য সুকৃতির। তার লেখায় সময়কে ধরা আছে, তার পরিবেশ ধরা আছে, ধরা আছে ঘটনাবলীও। বর্তমান কবিতা গ্রন্থটিতে বিনয় যেমন বিদ্যমান, তেমনি বিদ্যমান বিনয়হীনতার হাহাকারও, আবার বিদ্যমান সমসাময়িকতাও। “শামুও তো তার গায়িকাকে নিয়ে / বন্ধুটির ঘরে ঢুকে যায়। / যাওয়াযায়ি ভাল লাগে খুব, তবু আমি / কোথাও না গিয়ে দেখি বিনয় মজুমদার / কীরকম ভাবে একা একা মজায় আছেন। / তবুও আমরা সব, বিনয়দার কাছে যেতাম / কবিতা শোনাতে, শুনিয়ে অপেক্ষা করতাম”। এই যে এত কবি, এত লেখা কিন্তু সেসবের মধ্যে কবিতা কই? এ ক্ষোভ আমাদের গুটিকয়ের মধ্যে যেমন দানা বেঁধে আছে তেমনি রয়েছে সুকৃতির মধ্যেও। আমরা লেখায় সেসব আনতে পারিনি, কিন্তু সুকৃতি আনতে পেরেছে। “তবুও সফল অভিযান শেষে / দুধ চা-টা ভাল লাগে বেশ। / জ্বলে ওঠে গোবিন্দ কাকার / মনমরা চায়ের দোকান / রমণের স্টল জমে ওঠে / কলকাতা থেকে তারা এলে / নারী ও পুরুষ কবি, বৃদ্ধ ও তরুণ কবি সব। / কবিতে কবিতে ছয়লাপ / জগৎ আবিষ্ট হয়ে আছে, / শুধু একা কবিতায় আচ্ছন্ন বিনয়। / বিনয়দা কল টিপছেন আর মুখে গুনছেন, / “এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়”, / নয় বলতেই মনে কবির ‘আমি তো বিনয়। / অর্থাৎ নয়ের পরে বিনয়। বিনয় হল দশ’। / আমরাও শূন্য দশক আর / আমাদের আগে অভিনয়”।

 

শূন্য দশক, শূন্যের কবি, শূন্যের কবিতাকে সুকৃতি এক অসাধারণ ভঙ্গিমায় ধরেছে তার ‘বুদ্ধের গণিত কবিতায়’। “বন্ধুরা খোলস থেকে বেরিয়ে পড়লে / তবুও বন্ধুই থেকে যায়। / আমিও কি ঈশ্বরের খোঁজ / পাইনি তাদের সাথে ঘুরে? / বন্ধুদের সাথে ঢুকে গোলাপ বাগানে/ শুঁকেছি পাপড়ি থেকে ঘ্রাণ, / কাঁটা খেয়ে ফুটিয়ে আঙুল / করেছি একটু কাঠি ফুলের পেছনে। / লিখেছি কাগজে সেইদিন - / বইমেলা কবিদের প্রজনন কাল”।  অথবা বইমেলার এক আড্ডার সন্ধ্যাও যেভাবে এই কবিতায় উঠে আসে, “ ঠেকের সামনে এক সময় রিপন/ আরও এক রিপনকে ধরে নিয়ে আসে। / তখন বিকেল শেষ, সন্ধ্যায় এসেছে সুপ্রভাত। / চুনকাম করা দেওয়ালে / কাম কাম চুন জমে আছে/ আমাদেরও হাড়ের ভিতরে। / আমরা ভাবছিলাম নায়কের সাথে / বুঝি এই মালামালি হয়ে যাবে দিশারী কণার, / বাওলামি হয়ে যাবে দুই রিপনেরই। / অথচ প্লেটোর সাথে দেখা হয়ে গেল/ ওদের সবার/ স্টলের পেছনে/ অন্ধকার গলিতে বন্ধুরা / বন্ধুদের পিন্ডি চটকাচ্ছে আর/ সিগারেট খালি করে ভরছে তামাক।/ এবড়োখেবড়ো রঙের বন্ধুরা/ কবিতা পড়ছে আর দীপাংশু সেখানে/ করে গান চুমু খায় অতনুর গালে, / ঠোঁটে ঠোঁট জ্বলে ওঠে সিগারেট ধ্বনি / আঙুলে আঙুল গুঁজে দিলে”।

 

“মহাকাশে এসে লেখা” বইটির সবকটি লেখাই দীর্ঘ কবিতা। প্রতিটি কবিতাই কিন্তু এক জায়গায় থেমে নেই। বরং যেভাবে গল্প এগোয়, ঘটনা থেকে ঘটনা প্রবাহে ঠিক সেইভাবেই কবিতাও এগিয়েছে কখনও একই কবিতায় বিনয় এসেছে, সেখান থেকে এসেছে সমকালীন কবি বন্ধুরা, আবার ক্ষোভ এসেছে এসেছে তরুণ কবির বিরুদ্ধাচারণের স্পর্ধাও। দীর্ঘ কবিতাগুলি আলাদা আলাদা হলেও আসলে পুরো বইটিই একটি মাত্র কবিতা যেনো। যেভাবে অধ্যায় ভাগ হয় নভেল বা গল্পে ঠিক সেভাবে যেনো আলাদা আলাদা কবিতা আলাদা আলাদা নামের অধ্যায় হয়ে ধরা দিয়েছে এই বইটিতে। যেমন ধরা যাক “বিড়ালের চোখের সন্দেহ’ কবিতাটি। “মরে আছি, মরে মরে শেষে / নিঃস্বতার নামে গেছি বেঁচে। / তক্তা জানে পেরেকের উচ্চতা / মাপে না হাতুড়ি। / সময় ফুরিয়ে গেলে ঘড়িও বেবাক / পেরেকের কাছে এক বোঝা হয়ে যায়। / বাদুড়ের সাথে চোখাচুখি হতে হতে / এখন রাতকে আর খারাপ ভাবি না। / কিছুটা দিনের মতো ভাবি,  এই সব/ রাত আর দিন আর মেঘলা সময় / ঘড়িকে মানে না কোনো শীতে, তার শুধু / দেওয়া ঠেকিয়ে পিঠ চিত হয়ে থাকা; / কাঁটা দুটো দুই পা-র মতো দুই দিকে…/ কেবল কেন্দ্রটি পেরেকের খিদে ছুঁয়ে/ ইশারা করতে থাকে, আয়…/।

 

১৯৮০ সালে জন্মানো সুকৃতি এক প্রকৃত কবি। অথবা কবিতার সাধক। আ কৈশোর বিনয়ের সঙ্গ তার ভেতরকার কবিতার বীজকে আরও মজবুত করে তুলেছে। বহু পুরস্কারে ভূষিত হলেও তার ভেতরকার কবি শহুরে ধুলোবাতাসে দূষিত হয়ে যায়নি। আস্ত এক মফঃস্বলকে এখনও বুকে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। সুকৃতির কবিতার সবচেয়ে বড় অস্ত্র সারল্য, আর সেই সারল্যের ভেতর থাকে ক্ষুরধার এক মস্তিষ্ক। যে পরিত্রাণ চায় বইমেলাধুলোকাদাদূষণ থেকে। কবিতার দূষণ থেকে। আর কবিতার কাছে তাই একা হয়ে যায় সুকৃতি সিকদার। অথবা মানসিক বৈকল্যাক্রান্ত বিনয়কে সামলাতে সামলাতে সুকৃতিও সংক্রমিত হয়ে যায়। অথবা দুই অবোধ শিশু যেনো একা একা গিলে খেতে চায় কবিতাকে। তাকে রমণ করতে চায় প্রতিনিয়ত। জ্যামিতির সূত্রে মগ্ন বিনয়ের কবিতার চাকা তাই অনায়াসে সুকৃতির চাকা হয়ে ওঠে। আর সুকৃতির হাতে সে কবিতার চাকা যেনো আরও আরও গতি পায়। গ্রাম নগর বন্দর পেরিয়ে সেই চাকা চালাতে চালাতে সুকৃতি যেনো বিড় বিড় বিড় বিড় করে চলে চরৈবেতী চরৈবেতী।

 

মহাকাশে এসে লেখা

সুকৃতি সিকদার

প্রকাশক: কবিতা আশ্রম

প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০২২

মূল্য: ২০০ টাকা