মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ৩য় বর্ষ ১ম সংখ্যা

সম্পাদকীয়

বিশেষ বাংলাদেশ সংখ্যা



১৯০৫ সালে বড়লাট কার্জনের আদেশে প্রথমবার বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার পর সবচে' প্রকট প্রতিবাদ আসে পশ্চিম বাংলা থেকে। কার্জন জানত -"বাঙ্গালিরা নিজেদের এক মহাজাতি মনে করে এবং এক বাঙ্গালি বাবুকে লাট সাহেবের গদীতে বসাতে চায়। " বৃটিশ আমলা রিজলি স্বীকার করেছেন -"সংযুক্ত বাংলা শক্তিশালী, বিভক্ত বাংলা বিভিন্ন দিকে আকৃষ্ট হবে। " তাদের উদ্দেশ্য ছিল "বৃটিশ রাজত্বের বিরোধী একটি সুসংহত দলকে টুকরো করে দুর্বল করে দেওয়া।" যা তারা করেছেন ভীত আত্মায়। কিন্তু সাহসী ভুখন্ডের বিপ্লবী 'অরবিন্দ ঘোষ'রা ঠিকই ওদের কালো ইচ্ছা রহিত করেছেন। শুধু তাই নয় , পশ্চিম বাংলার সেই রুখে দাড়ানো থেকেই ভারত ছাড়তে ব্রিটিশদের বাধ্য করার শক্তি পরিনতি পেয়েছে। পরাক্রমশালী বঙ্গবাসীর তোপ থেকে বাঁচতেই চালাক ব্রিটিশরা বাংলাকে কলা দেখিয়ে বিভক্ত করে পঙ্গু করে দিয়েছে। সেদিন বঙ্গভঙ্গ রহিতের স্লোগানকে শক্তি যোগাতে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন "আমার সোনার বাংলা "র মত কালোত্তীর্ণ সংগীতের আগুন। হেমচন্দ্রের বানানো বোমা ক্ষুদিরাম বিস্ফোরিত করেছেন ,যা ভারত ইতিহাসের প্রথম।রদ হয়েছে প্রথম বঙ্গভঙ্গ ;কিন্তু ৪৭' এ কেমন একটা নিরবতার মাঝেই যেন আলাদা হয়ে গেলো দুই সহোদর ! বৈষম্য আষ্ঠে-পিষ্ঠে ধরেছিল জমিদারির লোভ আর শাসন করার কালো আনন্দে।মনের ভেতরই যেন পৃথক হওয়ার তাড়না সৃষ্টি হয়েছিল। দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশ হয়ে গেল একা। অগোচরেই পিছে চলে গেল ভাই হারানোর অভাব।

রাজনৈতিক প্যাঁচাল অফ দেই। বাংলা সাহিত্যে তখন সুদিনের সূর্য। ফুটফুটে নবসাহিত্যজাতকের আগমনী কান্নার আওয়াজ রণিত হচ্ছিল বঙ্গ ঘরের কোনা থেকে অনেক দূরতক। 'বন্দ্যোপাধ্যায়' , 'চট্টোপাধ্যায় 'দের নাম জ্বলজ্বল করতো সাহিত্য পাতায়। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বললেন , “তৎকালীন সাহিত্য গুলোতে যত গুলো চরিত্র আছে তাদের নাম পাশাপাশি রেখে পরিসংখ্যান করলেই দেখা যাবে রাম শাম যদু মধুদের সংখ্যা কত আর রহিম করিমের চরিত্রের সংখ্যা কত।" এর বদৌলতে লাভ করছি আমরা পাকিস্তান হিন্দুস্তান। হায় কপাল !

কিন্তু বঙ্গসাহিত্যের মহীরুহরা ঠিকই ছায়া ঢেলেছেন অকুন্ঠভাবে সাম্প্রদায়িকতা ভুলে। নজরুল চষে বেরিয়েছেন দুই বাংলা কোনো সীমানার চিহ্ন দেখেন নি। রবীন্দ্রনাথ পূর্ব বাংলার গরিব প্রজাদের কষ্টগুলোকে শিল্পের আঁচরে গেঁথেছেন। জীবনানন্দ , বুদ্ধ দেব আর তারপরে সৈয়দ শামসুল হক, মলয় রায় চৌধুরী , সুমীর রায় চৌধুরী , কাজল চক্রবর্তী , হাসান আজিজুল হক, সনত্ কুমার সাহা , রফিকুর রশীদসহ প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকগণ।

আজকের তরুণ প্রজন্মের চোখ এঁদের পায়ের মুড়ালিতেই রাখতে চাইছেন, আর এই দৃষ্টিকে সর্বদা পাহারা দেওয়া ও একনিষ্ঠ রাখার দ্বায়িত্বটা পালন করে যাচ্ছেন কিছু কাঁশফুল হৃদয়ের মানুষ -কালিমাটির কাজল সেন , আদরের নৌকার অভিক দত্ত , অন্যনিষাদের ফাল্গুনী মুখার্জি , বাক'এর অনুপম মুখোপাধ্যায় , কবিতা পাক্ষিকের মুরারি সিংহ , অনুপ্রাননের সরসিজ আলিম , সৃষ্টির বি ভি রঞ্জন , উত্তরাধিকারের সরকার আমিন , রচয়িতার আরিফুল ইসলাম, দ্রোহের ফয়সল অভি'সহ অনেক সাহিত্য পাগল।

আর এই সখের পাগলামিতে যেন সামনে থেকে স্লোগান টানতেই ভালবাসেন কবিতার পাগলাগারদ ক্ষেপচুরিয়াস। দুই বাংলার সাহিত্যিকদের মিলন উত্সব করার জন্য খেটে যাচ্ছেন ক্ষেপুর কতগুলো ক্ষেপা। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই বিশেষ "বাংলাদেশ সংখ্যা "র আয়োজন। দুই বাংলার সাহিত্য পিয়াসীদের এক টেবিলে সাহিত্য পান করার নিমিত্তে। বাংলাদেশের সাহিত্যরূপ তুলে ধরার চেষ্টায় অতিসাম্প্রতিক তরুনদের লেখার প্রাধান্যতা পেয়েছে এ সংখ্যায় । মূলত আজকের কবিতা ও কবিতা ভাবনার চিত্র অংকনে ব্রত হয়েছি।

আরেকটু সময় অপচয়ের স্পর্ধা করি। একান্নবর্তী ভারত থেকে নতুন বসত গড়া বাংলাদেশ শৈশব ফেরিয়ে যুবকে পরিনত। তাঁর এক হাত ভাঁজ করে নূড়ি পাথর, অন্যটি ছুড়ে মারে দুরে। তাঁর এক কান শুনে সত্য আর অন্যটি মিথ্যা।সত্য-মিথ্যার সংকরে নতুন একটি ব্যাধির নাম অভিধানে যোগ হচ্ছে ,এটা প্রচন্ড গতিতে মহামারীর প্রতিশব্দে বদল পাচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা , ধর্মান্ধতা ,মূর্খতা ,স্বার্থবাদিতা'কে পুজি করে এক ঝাঁক ভেড়ার পাল উঠোনটাকে করে দিচ্ছে নোংরা । কোমরটা সোজা করতে করতেও নুয়ে পড়ছে পিচ্ছিল এই ভয়ানক কালো পথে।স্বাধীনতার চার দশক পরে আমজনতার পরম চাওয়া "যুদ্ধপরাধীর বিচার" চালাচ্ছে সরকার। হিংস্র হয়ে উঠছে ৭১'এর সেই নরপিশাশের দল আবার। বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে হেয় করে সৃষ্টি করছে দুর্যোগ। সামনে বাংলাদেশের আরেকটি যুদ্ধ অপেক্ষমান। আজ আর বঙ্গবন্ধু নেই , কিন্তু আছে ভাই প্রতিম কলকাতা, যে পূর্বেও রোদ্রদুপুরের বটগাছ হয়েছিল। আরেকবার একই মিছিলে থাকি দুজন। বিশেষতঃ সাহিত্যিক সিপাহীরা , একেক করে ছুড়ে মার কলমের বারুদ। বাংলার আকাশ থেকে কুলক্ষী সূর্যগ্রহণ কে তাড়াতে আর কে হতে পারে এত বিশ্বস্ত!




ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষে পাভেল আল ইমরান
বিভাগীয় সম্পাদক,সাহিত্য পাতা
মাসিক বিচরণ,মালেশিয়া।

ছোটগল্প - সাইফুল্লাহ সাইফ

ঘরের ছেলে ঘরে ফেরা
সাইফুল্লাহ সাইফ


ওর নামের মূল শব্দটি মাছুদ কিংবা মাছুম জাতীয় কিছু একটা ছিল । তারপর বিবর্তনের বহু পথ পাড়ি দিয়ে নামের বিকৃতিতে যা সাধারণত হয়- ওর নামটি প্রথমে রূপ নিলো মাছু, তারও দিন কয়েক পর মাছু শব্দের সাথে মানুষের মুখে মুখে কোথা থেকে যেন হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিতভাবে উড়ে এসে যুক্ত হল আ-কারান্ত ‘অন্তঃস্ত’ । অর্থাৎ নামটি দাঁড়িয়ে গেলো- মাছুয়া এবং সর্বশেষ বিধ্বস্ত রূপ মাউচ্ছা ।

মাউচ্ছা শব্দটি গল্পের ক্ষেত্রে একটু বেশি বেমানান দেখায় বলে গল্পকারকে মাছু নামটিই ব্যবহার করতে হল । তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মাউচ্ছা ব্যবহার করা যেতে পারে ।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে দূরদেশের একটি অজপাড়াগাঁ থেকে বিদেশ-বিভূঁইয়ে এসে উপস্থিত হল মাছু ওরফে মাউচ্ছা । ওদের গ্রামের চেয়ারম্যান আব্দুর সাত্তারের মতো তারও একটি মোটরসাইকেল থাকা চাই- সকাল বিকেল মোটরসাইকেলে তার সোনাবউটিকে পেছনে বসিয়ে হাওয়া খেতে কিংবা বিলাস সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া । বউটি তার সুঢৌল স্তনযুগল মাছুর পিঠের সাথে এঁটে দিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে মোটরসাইকেলে বসে থাকবে । বাতাসে সিনেমার নায়িকাদের মতো ওর খোলা চুলগুলো এসে মাছুর নাকে মুখে লাগবে । মালতীর (বউয়ের নাম) সারা গাঁ থেকে সে মাদকতাময় পাগল করা একটি শীতল গন্ধ শুষে নেবে । মালতীর শরীরের গন্ধটি মাছুকে গাঁজার ধোঁয়ার মতো নেশা ধরিয়ে দেয় । কিন্তু সবসময় এই গন্ধ পায় না মাছু- সারাদিন অমানুবিক খাটুনিতে ঘামের গন্ধ ও ধুলো-ময়লা মিলে মালতীর শরীরের স্বাভাবিক গন্ধটিকে আটশে দুর্গন্ধময় করে তোলে । যেদিন মালতী একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে সেদিনই কেবল মাছু মালতীর শরীরের পাগল করা গন্ধটি পায় ।

মালতীকে দামী দামী পোশাকআশাক কিনে দেবে, দামী সুগন্ধি কিনে দেবে ।

একটি পাকা বাড়ি থাকবে ওদের, বাড়ির সামনে থাকবে একটি বড় পুকুর । পুকুরে থাকবে শানবাঁধানো ঘাট । ওরা দুজন ফকফকা মাখনের মতো জোছনা রাতে পুকুরঘাটে এসে আদর-আহ্লাদ করবে, সুখ-দুঃখের কথা বলবে । আর আমিনপুর বাজারে মাছুর থাকতে হবে একটি ঢেউটিনের আড়ত । আজকাল ঢেউটিনের খুব কদর । লোকজন এতো টাকা যে পায় কই! গ্রামের শনের ঘরগুলো সব টিনের ঘর হয়ে যাচ্ছে । ঢেউটিনের ব্যবসায় একবার নামতে পারলে টাকায় টাকায় জিন্দেগী পার!

সাত্তার চেয়ারম্যানের মতো গ্রামের সবাই তাকে সমীহ করে চলবে । তার কথার একটি বড় রকম শক্তি থাকবে । ইত্যাদি..ইত্যাদি ।

নিজের জীবনটাকে পাল্টাতে মাছু তার জিগ্রি দোস্ত খোকনকে অনেক বলে কয়ে নানা শর্ত সাপেক্ষে এসে উপস্থিত হল আবুধাবিতে ।

ওর বাবার কিছু জমি-জমা বিক্রি করে, ওর বউকে চাপ দিয়ে শ্বশুরের কাছ থেকে কিছু টাকা আদায় করে খোকনের অর্ধেক পাওনা মিটিয়ে বাকি অর্ধেক বিদেশ গিয়ে কাজ করে শোধ দেবে- এই শর্তে মাছু তার স্বপ্নের পথে এক পা রাখে ।

ওর সোনাবউটা সহজে বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনতে রাজি হয়নি বলে তাকে কায়দা করতে হয়েছে- কয়েক দফা পিটিয়ে মাছু তাকে সোজা করেছে । বউকে পিটাতে ওর সত্যি খুব খারাপ লেগেছিলো । বহুদিন ধরে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিয়েছিল, বিকল্প উপায় ভেবেছিল । নানা জল্পনা-কল্পনা করে এর স্বাভাবিক কোন সুরহা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত এই নির্দয় কাজটিই করতে হল তাকে । বউ দীর্ঘদিন তার সাথে অভিমান করে কথা বলেনি । মাছু বউয়ের মন গলাতে কতো চেষ্টা-চরিত্র করেছিলো তখন! অবশ্য ওর মনে তেমন কোন দীর্ঘস্থায়ী অপরাধবোধও ছিল না, কারণ ও নিশ্চিত ছিল যে- ওদের একদিন খুব সুখের একটি সংসার হবে- কোনো না পাওয়ার হাহাকার থাকবে না, কোনো অতৃপ্তি থাকবে না । বউকে মারার যাতনাটা তখন পুষে যাবে । বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে ওর হাতে টাকা আসার পর ও ওর বউটার কাছে বারবার ক্ষমা চেয়েছিলো । যৌতুক নিতে মাছু নরাজ, এতো অমানুবিক সে নয়- সে ঠিকই শ্বশুরের টাকা শোধ করে দেবে বলে মনে মনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধও হয়েছিলো ।

ওর বাবাও সহজে টাকা দিতে চাননি । কারণ ওর অপরাধের জরিমানা এবং ধারদেনা শোধ করতে গিয়ে তাকে ইতোমধ্যে বেশ কিছু জমি-জিরাত খোয়াতে হয়েছে । তাই নিজের বাবার উপরও বিশেষ অ্যাকশন নিয়ে মোটামুটি অর্ধেক টাকা মাছুকে যোগার করতে হল । অবশ্য ও মনে মনে ভেবেছিলো, বিদেশ গিয়ে বাবাকে এর দ্বিগুণ জমি কিনে দেবে ।

ভিসা চলে এলো, মাছু টুপ করে প্লেন চেপে বসল- চলে এলো আবুধাবি, তার স্বপ্ন পূরণের শহর ।

এবার মাছুর বিদেশ গমনের আগের কিছু ঘটনার অবতারণা করা যেতে পারে ।

মাছু শৈশবে তার দুরন্তপনার জন্য কিছু উপাধি লাভ করেছিলো । প্রচণ্ড দুষ্ট ছিল বলে ওর জীবনের প্রথম উপাধিটা ছিল উল্লুক, উল্লুকের মতো একমুহূর্তের জন্য স্থির নয় । স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি খেত বলে নাম ছিল খাদক এবং বেশি খাবার ফলে পেটটা যথেষ্ট বড় ছিল বলে পেটুক ।

কৈশোরে শুরু হল পাড়াপড়শিদের দিনরাত এক করে দেয়ার মহড়া । ওর সাথে জুটেছিল আর কিছু সাঙ্গপাঙ্গ- খোকন, হামিদ, কালাম, আবুল এই চার জন । আজ আজিমুল্লার গাছের পেয়ারা, কাল হাকিম মিয়াঁর গাছের নারিকেল, পরশু কুদ্দুস ব্যাপারীর গাছের আম, পরদিন নুরুল্লার গাছের কাঁঠাল, সুরেশের গাছের বড়ুই ইত্যাদি । হাস-মুরগি চুরি করে বিশেষ আয়োজন করে খোয়াতি খাওয়া, আবার শীতের দিনে খেজুরের রস চুরি করে সিন্নি রাঁধা ।

ওদের জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে এসবের ভুক্তভোগীরা বারবার বিচার বসাত । সত্তার চেয়ারম্যান আমিন চৌকিদারকে দিয়ে একেকজনকে পিটিয়ে বস্তা বানিয়ে ফেলতো- জরিমানা তো সাথে ছিলোই । আমিন চৌকিদার গ্রামে বেশ নামকরা চৌকিদার । বলশালী লোক, ডাকাতি চেহারা । চোর পেটাতে তার বিশেষ খ্যাতি । টানা একশো বেত্রাঘাত করেও যেন হোস-ফোঁস নেই ওর মধ্যে । বেদম মার খেয়ে খেয়ে চারজোয়ান বারবার প্রতিজ্ঞা করতো জীবনে আর দ্বিতীয়বার এই কাজ করবে না বলে । কিন্তু ওদের এই প্রতিজ্ঞা থাকতো যতদিন পিঠে আমিন চৌকিদারের বেতের বারির ব্যথা থাকতো ঠিক ততদিন ।

এবার মাছুর যৌবন এলো । আরো কিছু নতুন উপাধি যুক্ত হলো- ষণ্ডা, গুণ্ডা । শুরু হল এই চারসঙ্গীর নতুন ধান্দা । এবাড়ি ওবাড়ি উঁকিঝুঁকি, মেয়েদের দেখলেই অশালীন মন্তব্য, সীৎকার, এমন কি আড়ালে আবডালে শিকারের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা আর সুযোগ মতো শিকারের দেখা পেলেই খেঁকশিয়ালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া । এর জন্যও বহুবার বিচার বসলো, আগের চেয়ে কঠিন শাস্তি হল ।

একসময় ওদের পরিচয় হয় গাঁজার জাহাজের সাথে । গ্রামে কাউল্লা চোরাকে বলা হয় গাঁজার জাহাজ । ওর মাধ্যমেই এ অঞ্চলে গাঁজার আদানপ্রদান হয় বলে ওকে সবাই গাঁজার জাহাজ বলে ডাকে । অনেক উপরতলার লোকজনের সাথে ওর উঠাবসা । ওর কাজ ছিল শহর থেকে গাঁজা নিয়ে এসে গ্রামে গ্রামে সাপ্লাই দেয়া । নতুন নতুন কাস্টমার তৈরি করা । একটি ছোট পান-বিড়ির দোকান ছিল ওর । সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে এই দোকান । গাঁজার জাহাজ বিড়ি-সিগারেট বিক্রির সময় সতর্ক চোখে তাকাতো নতুন নতুন বিড়ি-সিগারেট টানা কাস্টমারদের দিকে । ওদের হাবভাব, চোখমুখে জড়তা দেখে বুঝে নিত- কাকে কাকে গাঁজার সাগরে ভাসানো যাবে, কাকে কোন সূত্র এপ্লাই করতে হবে, বশে আনতে কতদিন সময় লাগবে । আর গভীর রাতে ওর বশে আনা সঙ্গীদের নিয়ে নেমে যেতো চুরিধর্ম পালন করার কাজে । গাঁজার জাহাজের সানিধ্য পেয়ে মাছুর জীবনে এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল । মাছু গাঁজা খেয়ে আর তাস খেলে খেলে দিনগুজরান করতে থাকে । গাঁজা এবং তাসের টাকা যোগাতে কাউল্লা চোরার সাথে মিলিত হয়ে চুরি আর ডাকাতি ।

মাছুর বাবা অনেক ভেবে চিন্তে এবার একটি সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে দিলেন তাঁর কুলাঙ্গার ছেলেটিকে । ওর বউটাও ছিল গ্রামের অন্য মেয়েদের চেয়ে আলাদা । বউয়ের মধ্যে কি এমন জাদুটানা শক্তি পেলো বোঝা দায় যে- বউকে পেয়ে মাছুর নারী আসক্তি একদম চলে যায় । যাবেইনা বা কেন? ওর বউয়ের মতো রূপে গুনে আর দ্বিতীয় কেউ কি চোখে পড়েছিল ওর? এমন বউয়ের চোখের দিকে তাকালে যেন বুকে কাঁপন ধরে যায় । চোখে ঘোর লেগে যায়, মনে আগুন ।

বউকে প্রচণ্ড রকম ভালবাসতে শিখে গেলো মাছু । বউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শিখে গেলো । বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন ততদিনে মাছুকে বেধে ফেলে স্বপ্নের জালে । বড়লোক হওয়ার উপায় খুঁজতে থাকে সে । চুরি-ডাকাতি করে যে মাছু জীবনে বড়লোক হতে পারবে না এ সত্যটিও তখন তার কাছে স্পষ্টভাবে উন্মোচিত হয় ।

ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু খোকনকে ততদিনে তার বড়ভাই আবুধাবিতে নিয়ে যায় । খোকন আবুধাবিতে যাওয়ার একবছর পর দেশে ফিরে এলে মাছুর চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় খোকনের বড়োলোকি হাবভাব । পাঁচগ্রাম ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে করলো খোকন । সেকি বিয়ে!- যেনতেন কোন বিয়ে নয় । তখন মাছুর মনে পড়ে তার নিজের বিয়ের কথা । খুব দুঃখবোধ হয় মালতীর জন্য । জীবনে কিছু দিতে পারেনি মেয়েটিকে সে ।

সেই থেকে মাছুর মনে মনে ঘোর লেগে যায় আবুধাবি..আবুধাবি ।

মাছু আবুধাবি যাবার কিছু দিন আগে থেকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে গেলো । প্রত্যেক ঘরে ঘরে গিয়ে সবার পা ধরে ক্ষমা চাইল । মা-বাবা এবং শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে ক্ষমা চাইল । ঠিক বিদেশ যাবার তিনদিন আগে ওর বউটা ফুটফুটে চাঁদের মতো একটি পুত্র জন্ম দিয়ে বসলো । এই ছেলে ছেড়ে দূরে কোথাও থাকা যায়? ছেলেকে পেয়ে ওর স্বপ্নটা ডানা গজিয়ে আকাশে-বাতাসে উড়তে লাগলো । সারাদিন ছেলেকে বুকে জরিয়ে বসে থাকতো মাছু- আসলে বসে থাকতো না, সে তখন উড়তো ।

মাছুর আবুধাবি জীবন শুরু হল । টানা খাটুনি- সেই তুলনায় পাওনা যৎসামান্য । বাড়িতে টাকা পাঠানো, নিজের খাওয়া-পরার খরচ, খোকনের বাকি টাকা পরিশোধ করার চিন্তায় মাছু চোখে সর্ষেফুল দেখতে লাগলো । অবশ্য বড়লোক হওয়ার চিন্তা তখনও মাথা থেকে গেলো না ওর ।

মাছু ওভারটাইম কাজ নিলো । বড়লোক হতে গেলে ওভারটাইম কাজ ছাড়া উপাই ছিল না মাছুর । চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দুই-তিন ঘণ্টার জন্য কাজ থেকে মুক্তি পেত । তখন কবুতরের খোপের মতো আলোবাতাসবিহীন একটি ছোট্ট ঘরে এসে দু’দণ্ড ঠাই নিত । এতো পরিশ্রমের পর ঘরে ফিরেও ঘুম হতো না মাছুর । ওর ফুটফুটে চাঁদের মতো ছেলেটার কথা মনে পড়ত । ভাবতো- রায়হান(ছেলের নাম) এতদিনে বসতে শিখে গেছে, এতদিনে হামাগুড়ি দিতে শিখে গেছে, হয়তো এতদিনে ছেলেটা মুখে ফেনা তুলতে তুলতে বলতে শুরু করেছে, ‘বা..আ...আ..., বু...উ....উ.. ।’

মাছুর মনে পড়ে তার সোনাবউ মালতীর কথা । ওর নাকে এসে লাগে মালতীর শরীরের গন্ধ । মাছু পাগল হয়ে যায়! ইচ্ছে করে সব ছেঁড়ে-ছুড়ে একছুটে গিয়ে পড়ে মালতীর বুকের উপর । তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বউ গো আমি বড়আলা হইতাম চাই না, হুদা তোমার পাশে থাকতাম চাই । আমগো পোলাডারে কোলে নিয়া একটু আদর করতাম চাই ।’

আবুধাবিতে এসে ওর মতো অনেকেই বউয়ের কথা মনে পড়লে ছুটে যায়- এখানকার পতিতালয়গুলোতে । একবার নেশা ধরে গেলে জলের মতো মেয়েদের পেছনে টাকা ঢালতে থাকে এরা । মাছুরও যে সেখানে যেতে ইচ্ছে হয়নি তা নয় । ও গিয়েছিলোও বেশ কয়েকবার । কিন্তু বউয়ের কথা, ওর ছেলেটার কথা মনে পড়লে সব মিয়য়ে যায় । কোথায় উধাও হয়ে যায় যৌন উত্তেজনা! তাছাড়া টাকার মায়াও মাছুকে আপত্তি তোলে ।

বাড়ি থেকে খবর আসে ওর ছেলেটা অসুস্থ- নিউমোনিয়া হয়েছে । ছেলের চিকিৎসার জন্য যেন মাছু বাড়তি কিছু টাকা পাঠায় । মাছু দিশেহারা হয়ে যায় । ছেলের জন্য টাকা পাঠায় । নিজে খেয়ে না খেয়ে থাকে । সে মাসে খোকনকে কিছু দিতে পারেনি মাছু । খোকনও ক্ষেপে যায় ।

একদিন খোকন এসে মাছুকে হিসেব দিলো মাছুর কাছে সে আর কতো টাকা পাওনা ।

খোকনের টাকার অঙ্কটা শুনে মাছু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘খোকইননা তুই তো আমাততেন আর পাবি চল্লিশ হাজার ট্যাকা! হালার পুত তুই এতো চাস ক্যান?’

খোকন উত্তর দেয়, ‘খানকির পোলা ট্যাকায় ট্যাকা পদাই করে- তুই জানোস না?’

‘তাই বইল্ল্যা চল্লিশ হাজার ট্যাকা ছয়-সাত মাসে আরো চল্লিশ হাজার ট্যাকা পদাই করবো? তুই যা কইবি আমি তা-ই মাইন্যা লোমু?’

‘তোর তো মানোন ছাড়া উপায় নাই রে মাউচ্ছা । আমার ইস্টামে সব কতা লেহা আছে যে! তুই ইস্টামের কতা ভুইইল্যা গেলি? দস্তখত করছস না ইস্টামে?’ খোকন কথাটি বলেই দাঁত বের করে খিক খিক করে হেসে উঠে । ওর পান খাওয়া ময়লাযুক্ত দাঁতের কালচে মাড়ি পর্যন্ত দেখা যায় । ওর এই হাসি দেখে দাঁতেদাঁত চেপে ধরে মাছু । চোখ দুটি আগুনলাল হয়ে উঠে ।

এককথায় দুই কথায় ওদের তুমুল ঝগড়া বেঁধে যায় । হাতাহাতি....মারামারি ।

পাশের ঘরে থাকে খোকনের বড় ভাই জোটন । ওদের চিল্লাচিল্লির শব্দে তার কাঁচা ঘুমটা তামাতামা হয়ে যায় । ব্যাপারটা কী! ব্যাপার দেখতে এসে ওর চোখ জ্বলে উঠে ।

‘মাউচ্ছা! আরে তুই হালার পুতের এতো সাওস আমার ভাইর গলা চাইপপা ধোওল্লি?’

জোটন দৌড়ে এসে বসিয়ে দিলো আধমন ওজনের এক ঘুসি মাছুর বুকের উপর ঠিক হৃৎপিণ্ড বরাবর । মাছু এক ঘুষিতে কাইত!

দুই ভাই মিলে মাছুকে চেপে ধরে মেঝেতে । প্রথমে একজন উঠে বসে মাছুর বুকের উপর । আরেকজন উঠে গিয়ে ওর ময়লা চিটচিটে বালিশটি নিয়ে মাছুর মুখে চেপে ধরে । মাছু কোঁকাতে থাকে ।

মাছুর আত্মাটা ওর শরীর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে শেষ মুহূর্তে নিজেকে নিজে বলে গেলো, ‘হায়রে মাউচ্ছা! কী করলি তুই? তোর না একখান দুধের পোলা, একখান অবলা সোনাবউ?’

ছোটগল্প - মুস্তাইন সুজাত

তুলিরেখার শেষ কল
মুস্তাইন সুজাত


-এক-


ট্রেনিংটা হয়েছিল অফিসের নির্ধারিত শিডিউল অনুসারে। ঢাকা থেকে সড়কপথেতিরিশ কিলোমিটার, তারপর নৌকা করে আরও চার কিলোমিটার গিয়ে ট্রেনিং সেন্টার। নির্জন চারপাশ,ভয়ার্ত শেয়াল কুকুরের কামড়াকামড়ি, ডুবায় ব্যাঙ-সাপেদের অবাধ আধিপত্য। ফসলের ক্ষেত, কাদামাটির রাস্তা, সকাল সন্ধ্যা গলায় লাল-সবুজ চেকের ময়লা গামছা ঝুলিয়ে মোড়ের পাশে বসে থাকা কয়েক জোড়া রিক্সা চালকের ক্লান্ত দৃষ্টি। ট্রেনিং এর পুরুটা সময় জুড়ে একই চিত্র চোখে পড়েছে তুলিরেখার। ঢাকা শহরে যাদের জন্মলগ্ন বেড়ে উঠা তাদের কাছে এই জায়গাটাকে প্রত্যন্ত অঞ্চল বললে খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। হঠাৎ করে মাস কয়েকের জন্য শহুরে কেউ এখানে এলে বেশ উপভোগ করবে প্রকৃতিটা। প্রতি বছর এই ট্রেনিং সেন্টারে শিক্ষানুবিশ নতুন অফিসাররা চার মাসের একটা ট্রেনিং নিতে আসে তুলিরেখারঢাকার অফিস থেকে।

হেড অফিসের ক্লার্ক যেদিন ট্রেনিং এর শিডিউলটা টাঙ্গিয়ে দিয়েছিল নোটিস বোর্ডে সেদিনই তুলিরেখা শিহরিত হয়েছিল আনন্দে। অনেক দিনের সুপ্ত মনটা জেগে উঠেছিল আবার নতুন করে। যাক এবার নিজের মত করে কিছুদিন বাইরে থাকা যাবে। দুই বছরের সংসার জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। বিয়েটা হয়েছিলো মা বাবার পছন্দে। সেই সাথে তুলিরেখারও মত ছিল শতভাগ। তার পতিদেবতাটি মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে মোটা বেতনের চাকুরে। অভিজাত পাড়া বনানীতে বাড়ি, নিজস্ব গাড়ি তার উপর বাপের একমাত্র ছেলে। পরিচিতজন হয়ে বিয়ের প্রস্তাবটা এসেছিল ছেলের বাড়ি থেকেই। তারপরও তুলিরেখার বাবা-মা এই সম্পর্কটা নিয়ে একবছর ভেবেছেন। নানা ভাবে যাচাই বাছাই করেছেন। একমাত্র মেয়ে, একটু বাজিয়ে দেখে শুনে বিয়ে না দিলে কি হয়!

বিয়েঅন্তেপ্রেম বলতে যা বুঝায় তুলিরেখা আর শাফিনের ক্ষেত্রে ওটাই ঘটে। বিয়ের কিছুদিন পেরুনোর পর শাফিনের প্রতি তুলিরেখার ভালোবাসা জন্মাতে শুরু করে আস্তে আস্তে। নানান ছলে সেটা প্রকাশও করেছে তুলিরেখা। অথচ আজ দু’বছরে একবারও শাফিন তার ভালোবাসা প্রকাশ করেনি, না কথায় না কাজে। তুলিরেখা একটা জিনিস খুব ভালো করে লক্ষ করেছে, সেই বাসররাত থেকেই শাফিন কেমন যেন আত্মমগ্ন হয়ে থাকে। ভেবেছে শুরুতে অনেকেরই এমনটা হয় কিন্তু দিন অতিবাহিত হবার সাথে সাথে তুলিরেখা বুঝে গেছে এটা তার জন্মগত স্বভাব। শাফিন নিজেকে নিয়ে মেতে থাকে সারাক্ষণ। নিজের চারদিকে একটা শক্ত প্রাচীর তৈরি করে রেখেছে যা এপর্যন্ত তুলিরেখার পক্ষে ভাঙা সম্ভব হয়নি। নিজের মনের চারদিকে যেমন একটা নিজস্ব খোলস আছে তার, ঠিক তেমনি বাসায়ও একটা একান্ত রোম আছে। সেখানে কারো যাওয়া বারণ। অফিসের বাইরের সময়টাতে কিংবা ছুটির দিনে শাফিন ঐ রুমেই কাটায় বেশীরভাগ সময়। শুধু খাঁবার আর ঘুমানোর সময় তুলিরেখা তার দেখা পায়। বাকি সময়ের কিছুক্ষণ বাইরে থালেও টিভি নিয়ে পড়ে থাকে।

নিতান্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে দাপটের সাথে দীর্ঘদিন সরকারী চাকুরীর পর নিজের পেনশনের টাকা দিয়ে বনানি বাড়িটা করেছে শাফিনের বাবা। তিনতলা বাড়ির দোতলায় গোছানো ফ্লাটে ওরা থাকে। বিয়ের দু’বছর পরও নাতি নাতনির মুখ দেখতে না পেয়ে স্বভাবতই শাশুড়ি কিছুটা নাখোশ তুলিরেখার উপর। সরাসরি কথা বার্তায় সেটা না বললেও তার শাশুড়িমা সকল শাশুড়িকূলের স্বভাবসুলভ চাতুরতায় অসন্তোষেরকারন খানিকটা বুঝিয়ে দেয় সুযোগ পেলেই। এটা যে শুধুমাত্র তুলিরেখার একার সমস্যা নয় সেটা শাশুড়িকে বুঝাতে পারে না কোন রকমেই। পতিদেবতার উদাসীনতা, সংসারের দায়ভার, শাশুড়ির খোঁটা সব কিছু মিলিয়ে নিজেকে উত্তরনের একটা মোক্ষম হাতিয়ার মনে করে এই চার মাসের ট্রেনিংকে। পারিবারিক এসব বিষয় নিয়ে অনেকটা দিশেহারা, অপ্রকৃতিস্থ গোছের হয়ে গেছে তুলিরেখা। সেখান থেকে পরিত্রাণ না পেলে আত্মহত্যা টাইপের একটা কিছু করে বসতে পারে, মাঝে মাঝে এরকমটাই ভাবে তুলিরেখা।

সন্তান সন্তুতি দেয়া না দেয়া বিধাতা পুরুষের ঐকান্তিক ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে কিন্তু যাদের বছরের পর বছর পেরিয়েও সন্তান হয় না তারা ওসিলার জন্য ডাক্তার কবিরাজের শরণাপন্ন হয়, সেটাই স্বাভাবিক। অনেকবার তুলিরেখা ডাক্তারের কাছে গিয়েছে শাফিনকে নিয়ে। তাদের কোনরকম সমস্যা পায় নি ডাক্তার। পাবে কিভাবে, আসল ঘটনা তো তুলিরেখা জানে! সে না পারে ডাক্তারকে বলতে, না পারে কাউকে। আর তার শাশুড়ি তো বিশ্বাসই করবেন না। উল্টা গাল ফুলিয়ে বলবেন,

-তুমি কি গো বৌমা, আমার ছেলের উপর এত্তবড় অপবাদ! পাঁচ কান হলে মানুষজন কি বলবে, শুনি? বলেছ বলেছ, দ্বিতীয়বারের জন্য আর ওকথাটি যেন না শুনি। যত সমস্যা সব তোমার আর এসেছ আমার ছেলের নামে উটকো কথা বলতে? এইবার আমি নিজে তোমাকে নিয়ে যাব ডাক্তারের কাছে।

তুলিরেখা জানে শাশুড়ির সাথে ডাক্তারখানায় গেলে জল কোনদিকে গড়াবে। তাই এ বিষয়ে শাশুড়িকে সে কিছুই বলে না। একবার ভাবে শাফিনকে ছেড়ে একেবারে চলে যায়। পরক্ষনেই কোথায় যেন টান পড়ে। চিনচিনে ব্যথা হয়। কি যেন হারানোর ব্যথা। আসলে শাফিনের প্রতি তার অদ্ভুত মায়া হয় ভাবলেই। মানুষ হিসেবে সে তো আর খারাপ নয়? তার সব রকম বাহ্যিক চাওয়া পাওয়া মিটাচ্ছে। এখানে ওখানে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে, নানান রেস্টুরেন্ট এ নিয়ে গিয়ে খাচ্ছে। পার্বণগুলোতে এটা ওটা কিনে দিচ্ছে। কিন্তু যত আপত্তি ঐ এক জায়গাতেই। অথচ ওটাই যে একজন নারীর চরম পাওয়া। নারীর বেঁচে থাকার অবলম্বন। নারী জন্মের সার্থকতা।

ইদানিং তার পতিদেবতাটির প্রতি কেমন যেন একটা অনীহা তৈরি হচ্ছে নিজের ভেতর। দিনকে দিন অসহ্য ঠেকছে তাকে। শুরুতে যে ভালোবাসা ছিল তা এখন শুধুই করুণা আর মায়া। সেই মায়াকরুনাতে মিশামিশি হয়েই সম্পর্কতা আজো টিকে আছে। জীবনের এই উথাল পাথাল সময়ে হঠাৎ একদিন মুহিনের সাথে আলাপ। মোবাইল ঘাটতে গিয়ে ফোন নাম্বার। পুরনো অফিসের কলিগ। পাশাপাশি কিউবিকলে বসতো ওরা। আগের অফিস ছাড়ার পরও মাঝে মাঝে কথা হয়েছে বারকয়েক। হঠাৎ তুলিরেখা নিজের মনের জটিল অবস্থাকে হালকা করার একটা দাওয়াই খুঁজে পেয়ে যায় মুহিনের ভার্চুয়াল আগমনে। ধরাবাঁধা জীবনের বাইরেও যে একটা আশ্চর্য শৃঙ্খলবিহীন জীবন আছে, সেই জীবনের তীব্র আমেজ আছে সেটা প্রথম বুঝতে পারে মুহিনের সাহচর্যে এসে। সাত রঙের সবকটা এসে তার জীবনটাকে স্বপ্নিল করে সাজিয়ে দেয় আলতো ছোঁয়ায়। অষ্টক রং ধরা দেয়।

মুহিনের সাথে তুলিরেখার আলাপ হয়েছিল ট্রেনিং শুরুর ঠিক মাস তিনেক আগে। ক্রমে ক্রমে এই সম্পর্কের গভীরতাটা পুরুপুরি গেঁড়ে বসে ট্রেনিং-এর চার মাসে। ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে পুরুটা সময় নিজের একান্ত। তার ট্রেনিংটা ছিল ক্লাস এবং ওয়ার্কশপের মিশ্রন। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকেই তুলিরেখা ফেবুতে মেসেজ পাঠায়, মুহিনের তড়িৎ রিপ্লাই। রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা, কত কথা! ধীরে ধীরে এই কথাবার্তা বনে যায় প্রেমরূপালাপে। বিশ্বাস আর ভালোলাগায় ভর করে তুলিরেখা বলে যায় জীবনের কথা, অতীত বর্তমানের কথা, ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা একে একে। প্রথমদিকে হঠাৎ একদিন তুলিরেখা মোহিনকে বলেছিল,

-ডু ইউ লাভ মি?

-হোয়াট অ্যাবাউট ইয়োর থিঙ্কিং? মুহিনের উত্তর।

-জাস্ট নাথিং। মনে হল তাই জিজ্ঞেস করলাম।

সেদিন এ পর্যন্তই শেষ ছিল ব্যাপারটা। এরপর আর কেউ এগোয়নি সেদিকে। বলতে গেলে মুহিনই রনে ভঙ্গ দিয়েছিল সজ্ঞানে। তারপরও তাদের যোগাযোগ থেমে থাকে নি। সময় বয়ে গেছে নিজের মেজাজে, সেই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বইছে তাদের সম্পর্কের উতলা বাতাস।


-দুই-

গেল সপ্তাহে ট্রেনিং শেষ হল পুরোপুরি। আবারো নিজের সংসার, স্বামী, শাশুড়ি নিয়ে সেই পুরনো ক্যাচাল। এই নিয়ে তুলিরেখা বড্ড অখুশি। তবে যতটা সময় অফিসে থাকবে সব কিছু ভুলে নিজের মত থাকতে পারবে এই যা একটু সান্ত্বনা। অনেকদিন পর স্বামীকে কাছে পেয়ে বাসায় ব্যস্ততা বাড়ে একটু। দীর্ঘ বিরতির পর নতুন করে আবার সংসারে মন দেয় বা দিতে চায় আগের সব কিছু ভুলে। অফিসের কাজেও আসে দায়িত্ববোধ আর ব্যস্ততা। মাঝে মাঝে মুহিন জানতে চাইলে এ কথাগুলোই বলে তুলিরেখা। মুহিনের সাথেও আর আগের মত কথা হয় না। চাপা ক্ষোভ নিয়ে মুহিন এড়িয়ে চলে তুলিরেখাকে। এতদিন যে শ্রেফ নিজের প্রয়োজননিজের অবসর সময় কাটাতে তুলিরেখা মুহিনের সাথে সম্পর্করেখেছেএতদিনে সেটা পরিস্কার হয় তার কাছে।মুহিন আজ নিজেকে ধিক্কার দেয় সবচেয়ে বেশি। নিজের মনকেই ঠাট্টা করে নির্মম ভাবে।

তুলিরেখার সাথে যোগাযোগটা একেবারে হয় না বললেই চলে আজকাল। বেশ কয়েকবারই মোহিন চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করার। নিজের ব্যস্ততা, একথা সেকথা বলে যখন তুলিরেখা অজুহাতের পর অজুহাত ফাঁদে, তখনই মোহিন বুঝে গেছে যা বুঝার। ফের নিজের আত্মসম্মান আর খোয়াতে চায় না সে।

তারও প্রায় মাস তিনেক পর মোহিন হঠাৎ একদিন তুলিরেখাকে দেখতে পায় অন্য একটি ছেলের সাথে। নিউমার্কেট হয়ে নীলক্ষেতের দিকে হেঁটে যাচ্ছে ওরা দুজন। হাতে হাত, হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। ছেলেটিকে মুহিনের চেনা চেনা মনে হয়। একটু কাছে আসতেই স্পষ্ট ধারনাকরতে পারে, এ তো তুলিরেখার সেই বন্ধু যার কথা অনেক আগেতাকে বলেছিল। বন্ধুটির কথা এতবার বলেছিল যে এখনো বর্ণনা চোখে লেগে আছে। বর্ণনার সাথে ছেলেটমিলে যাচ্ছে হুবুহু। শ্লেষের হাসি ফুটে উঠে মোহিনের ঠোঁট জোড়ায়। করুণা হয় ছেলেটির জন্য, সেই সাথে তুলিরেখার প্রতিও। বেচারি তুলিরেখা!

এরই মাঝে দু’একবার তুলিরেখাও যে চেষ্টা করেনি মুহিনের সাথে যোগাযোগ করার তা কিন্তু নয়। তবে মুহিন পাত্তা দেয়নি। আর নিজ চোখে ছেলেটির সাথে তুলিরেখাকে দেখার পর থেকে কেমন যেন বিশ্বাসটাই উঠে গেছে।


-তিন-


তারও মাস ছয়েক পর একটা নাম্বার থেকে পর পর আট দশটা কল আসে মুহিনের মোবাইলে। ফিরতি কলে ওপাশ থেকে এক পরিচিত অথচ কেমন যেন বিষণ্ণ এক নারী কণ্ঠ কথা বলে উঠে।

-হ্যালো মুহিন, আমি তুলিরেখা বলছি।

মাঝে মাঝে তার এমন হয় যে কোন বন্ধু কিংবা আপনজন যাকে সে একবার মন থেকে মুছে ফেলেছে তার সাথে দীর্ঘদিন পর হঠাৎ কথা হলে নিজের কথা আটকে যায়। মুখে আটকে থাকা কথাগুলোগলার মধ্যে দলা পাকাতে থাকে। তুরেখাকেও ততদিনে ভুলে গেছে সে। তুলিরেখা নামটা মুছে দিয়েছে স্মৃতি থেকে। আজ ইচ্ছে করলে কলটা কেটে দিতে পারতো, কিন্তু মুহিন তা করে নি। সে শুনতে চায় কি বলে তুলিরেখা।

-হ্যাঁ। মুহিন বলছি।

-কেমন আছো?

-যথারীতিভালো।

-আমার মনটা ক’দিন ধরে ভালো নেই। তোমার সাথে কি আজ একটু দেখা করা যাবে?

-সরি। আমি আজ ব্যস্ত আছি।

-তাহলে কাল?

-কালও ব্যস্ত থাকবো। অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাব।

-ঠিক আছে। রাখলাম। বাই।

-বাই।

এতদিন পর হঠাৎ কেনই বা তুলিরেখা তাকে ফোন করে দেখা করতে চাইলো হিসাব মেলাতে পারছে না। অবশ্য মুহিন আজ হিসাব মেলাতেও চায় না। অনেক হিসাব মিলিয়েছে এতদিন, হৃদয়খাতা শুন্য আজ। সে ভুলে যেতে চায় সব। ইদানীং ভুলে যাওয়াটা বেশ রপ্ত করেছে। সকালের কথা বিকেলে, রাতের কথা সকালে আর মনে পড়ে না। এইসব হিজিবিজি ভাবনা ছেড়ে একসময় অফিসের কাজে ডুবে যায় মুহিন। সব কাজ ঘুচিয়ে রেখে কাল আবার সকাল সকাল অফিসে আসতে হবে। এগারোটা তিরিশের ঢাকা-কুমিল্লা প্রাইম সার্ভিস বাসের টিকেট কাটা।


-চার-

কাক ডাকাভোরে ঘুম ভাঙ্গে মুহিনের।আটটা নাগাদ বেড়িয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে। তাড়াহুড়োর মাঝে আজকের পত্রিকাটা দেখা হয় নি বাসায়। অফিসে পৌঁছেই পিয়নকে চা দিতে বলে টেবিলে রাখা আজকের একটা দৈনিক টেনে নেয় মুহিন। প্রথম পাতার শেষ দিকের একটা কলামে এসে স্থির হয়ে যায় চোখ।শিরোনাম “পারিবারিক অশান্তির জের ধরে তুলিরেখা নামের এক বধুর আত্মাহুতি।” লেখার ভেতরে ঢুকে বিস্তারিত পড়ার সাহস হয় না তার। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হচ্ছে।

অদ্ভুত এক বিষণ্ণতায় মনটা ছেয়ে যায় মুহিনের। মুহিন বুঝেযায় তুলিরেখাকে এতদিন উপেক্ষা করার বেদনা, গতকাল তুলিরেখার সাথে দেখা না করার দুঃখ, কিংবা তুলিরেখার এই চির প্রস্থান সংবাদ তাকে বয়ে বেড়াতে হবে জীবনের বাকিটা সময়।

পরক্ষনেই ভয়ে কুচকেআসে মুহিন। চিন্তারা পাক খায় অবিরত, ভাবনায় ভিড় করেগতকাল তাকে করাফোন কলটাই যদি তুলিরেখার শেষ কল হয়!

ছোটগল্প-মামুন ম.আজিজ

ইরি আমার ছিল না
মামুন ম. আজিজ


এক


তার নামটা ইরি। শুনলেই সায়েন্স ফিকশনের কোন চরিত্র কিংবা ধানের শীষ হৃদয় পটে ভেসে ওঠে। এমন নাম কী কারণে কে জানে? অবশ্য আমি তা জেনেছিলাম অবশেষে।
আমার দোষ ছিল না, প্রকৃতি এক খেলা খেলছিল আমরা সরলতার সাথে। সেই ক্লাশ এইটে কোচিংয়ের সময় প্রথম জানলাম আমাদের ক্লাশের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটার নাম ইরি। ছাত্র ছিলাম ভালোই তবুও অনেক সহপাঠীর কণ্ঠে আমার নামের আগে বিশেষ উপাধি ছিল ‘কেলাস’। সেই আমি-কেলাস রনি মেয়েদের সাথে কথা বলতামই না প্রায়, আমার সংকোচ হত। সহপাঠী বন্ধুরা এক একজন প্রেমের পাঠও নিয়ে নিয়েছে ঐ বয়সে, তবে আমার মনে ইরির প্রতি একটা আকর্ষন কেবল অনুভত হচ্ছিল, সেটাকে রোজ জাগ্রত হবার আগেই কবর দিয়ে দিতাম।
রোজ আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ইরি স্কুলে যায় আসে। আমি তিনতলার জানালায় পর্দার আড়াল হতে উঁকি মারি, চলে যাবার পর স্কুলের পথে পা দিই। নাইনে আমাদের ডে শিফট আর ওদের হলো মর্ণিং।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠলাম, তবুও আমি সেই কেলাসই রয়ে গেছি। সামনের পথে মাঝে মাঝে চোখ চলে যায় অজান্তেই। তারপর মনে পড়ে ইরিতো এখন কলেজে উঠেছে। ইরির সাথে বোধহয় আর কোনদিন দেখা হবে না। বাসাটা ওদের খুব একটা দূরে নয়, কিন্তু সে পথে পা দেবো, ওমা! আমি কি সেই ছেলে। তারচেয়ে ইরি, সাইফাই উপন্যাসের মহাশূণ্যে ঘুরে বেড়ানো কোন চরিত্র হয়েই আমার মনে নির্বাসনে থাক...অথচ...
ঠিকই একদিন চমকে গেলাম। সমানের বিল্ডিংটার দোতলায় ডান পাশের বারান্দায় এক বিকেলে পড়ন্ত সূর্যের রক্তিম অথচ নীরব হাহাকারে জ্বলে উঠল এক নারী মূর্তি, চিনলাম-আমার ইরি। মনের কবরে ভাঙনের আলোড়ন টের পেলাম। রাতে পড়া শিঁকেয় উঠলো। পড়তে পারলাম না আরও কয়েক রাত। আবার দেখলাম আরেক বিকালে, তারপর আরও একদিন। ইরি যেন আমার জানালার দিকেই তাকিয়ে থাকে। একদিন চোখে চোখ পড়ে গেলো। আমি পর্দা টেনে লুকালাম। কেটে গেলো কয়েকটা দিন।
হঠাৎ ক্লাশ শেষে এক বিকেলে বাড়ি ফিরছি, গরমে ঘেমে শেষ। তিন তলায় উঠে হাপাচ্ছি, হঠাৎ কানে এলো নারী কণ্ঠের ফিসফিসানি। একটু ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজতেই মিললো, ঐ তো তিন তলা থেকে চারতলার যাবার মাঝ সিঁড়িতে জানালা ধারে দু’জন উঁকি দিচ্ছে আর হাসছে। ওরা মাথা ঘোরাতেই, চোখে চোখ পড়তেই চিনলাম, সেই আমার ইরি। সাথের মেয়েটাকেও চিনলাম-নন্দিতা, সামনের বাসাটা ওদেরই।
আমার সামনে দিয়ে দু’জন দৌড়ে নেমে যাচেছ, আমি বোকার মত তাকিয়ে আছি। হঠাৎ কী মনে করে ইরি তাকাল, ‘তুমি রনি না, আছ কেমন, ভাল তো? পড়ে কথা হবে’ ...বলেই নেমে গেলো। আমিও ছুটে ঠিক তাদের দাঁড়িয়ে থাকা জানালার কাছে চলে গেলোম। নিচে তাকিয়ে দেখছিলাম ওদের চলে যাওয়া। হঠাৎ দরজার দিকে পায়ের আওয়াজ পেলাম। আমার বড় ভাই মণি।
‘কীরে হাপাচ্ছিস কেনো? ওখানে কি?’
কী বলব বুঝে উঠতে পারলাম না, নিশ্চয় ওদেরকে সিঁড়িতে দেখেছে... পকেটে একটা চকলেট পেয়ে গেলাম, ওটা দেখিয়ে বললাম ‘ভাইয়া, এইতো এই খোসাটা ফেলতে..’
তোকে না বলেছি ঐ সব খাবি না একদম, সব ভেজাল...
মুখে বললাম, ‘আর খাবনা ভাইয়া;’...আর মনে মনে-‘শালা ডাক্তারি পড় দেইখ্যা একটু পোদ্দারি করলা। আমিও সুযোগ নিবানে, তরী আপার লগে গেইদিন হাত ধইরি কী করছিলা দেখছি ভালোই।’


দুই.


যাক, সে রাতে মোটামুটি অংক কষে ফেললাম, ফলাফল- ইরিও আমার প্রতি দূর্বল। না হলে নন্দিতার সাথে এত সখ্যতা পাতানো আর আমাদের সিঁড়িতেই চলে আসা। ...কয়েকদিন খেয়াল রাখলাম। ইরি এক দুদিন পর পরই ও বাসায় আসে। জানালার পর্দা এখন অনেকটাই খুলে রাখি। ইরি সেটা ধরতে পেরেছে। সে মুচকি হাসে।
গতকাল বিকেলে নিচে দেখা হয়ে গেলো। দোকানে ওরা কিছু কিনছিলো। আমাকে ডাকলো, আমি দুরু দুরু বুকটা ফুলিয়ে এগিয়ে গেলাম। কথা হলো। ভালো মন্দ জিজ্ঞাসা আর কী।
নন্দিতাকে বললাম, ‘ইরি আর তুমি একই কলেজে বুঝি?’
ইরি পার্সে টাকা রাখতে রাখতে বলল, ‘হ্যাঁ রনি, আমরা একসাথে। তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।’
আমি উচ্ছ্বসিত। বললাম, ‘শুনব আগে কিছু খাও। বল কি খাবে-আইসক্রিম?’
ইরি না বলতে যাচ্ছিল, কত ভদ্র মেয়ে! নন্দিতা তার আগেই বলে উঠল, ‘হুম, চকবার...’
টাকা পরিশোধ করছিলাম। ইতিমধ্যে হঠাৎ ‘বাই’ বলে আইসক্রিম নিয়ে নন্দিতার বাসার দিকে চলে গেলো দু’জন । পেছনে তখন দেখি ভাইয়া ফিরছে। না দেখার ভান করে বাসার দিকে এগোলাম।
দু’দিন পরের ঘটনা...
ইরি নন্দিতাদের বাসায় আছে সেটা এক নজর দেখেছি। তারপর আর দেখলাম না। মন জানালার পাশে আর টিকছিলনা, বাইরে বেরিয়ে মোড়ের দোকানে গিয়ে চা খাওয়ার নামে বসলাম। এখান থেকে নন্দিতাদের বারান্দা খুব স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু দেখা নেই। হঠাৎ তারা বারান্দায় হাজির। মুখ গোমড়া। আমি তবুও সেদিকে তাকিয়ে কেবলা কান্তের মত একটা হাসি দিয়ে ফেললাম। তারপর ভীষন অবাক হলাম। ইরি হাতটা বাড়িয়ে মনে হলো আমাকে ওখানে থাকতে বলল।
একটু পরেই নিচে নেমে এল। কাছে আসতেই বললাম, ‘খাবে...আইসক্রিম।’
নন্দিতা হাসল। ইরি বলল, ‘না খাওয়ানে উচিৎ তো আমারই।’
আমি সে কথার অর্থ তেমন বুঝলাম না। তবে তারপর ইরি যা বলল তাতে আমি হাতে চাঁদ পেলাম না চাঁদ থেকে পড়ে গেলাম ঠিক বুঝলাম না, হঠাৎ এক বিস্ফোরণ ছিল আমার জন্য।
বলল,‘ তোমাদের বাসায় যাবে। ফিজিক্সের একটা নোট লাগবে।’
আমি মনে মনে ভাবলাম, বাসায় যাবার উছিলা; কেবল মুখ ফুটে কেউ একজন বলে ফেললেই এখন হয়ে যাবে প্রেম। কিন্তু ভাইযার তো এতক্ষণে চলে আসার কথা। দূর নোটের উছিলা আসে না।
দু’জনেই বাসায় ঢুকল আমার সাথে। মার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম স্কুলের সহপাঠী বলে। একটু পড়েই ভাইয়া ঘরে ঢুকল খুব গম্ভীর চেহারায়। মনে হচ্ছে কার সাথে রাগ-টাগ করে এসেছে যেন। নিশ্চয় ঐ আপুটার সাথে। আমরা তিনজন ড্রইং রুমে বসে ছিলাম। মা চা করে দিয়েছিল সেটা হাতে নিয়ে মোটামুটি নীরবই ছিলাম। হঠাৎ ভাইয়া একুট পিছিয়ে ঘরে উঁকি দিলো। একটু যেন থতমত খেলেন...আওি অতি উৎসাথে বললাম, ‘ভাইয়া ওরা আমর সাথে স্কুলে পড়ত, নোট নিতে এসেছে।’
ভাইয়ার মনে হলো শোনার আগ্রহ নেই। কেবল একটা ভাব নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘ও আচ্ছা তোর ক্লাশ মেট। ভালো।’
ইরি খুব হাসছিল মুখ টিপে। ভাইয়া দেখতে খুবই সুন্দর, হ্যান্ডসাম। আবার ভাইয়ার দিকে না ইরির মন যায়। তাড়াতাড়ি কণ্ঠ নামিয়ে বলে ফেললাম, ‘ভাইয়াটা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি বদের হাড্ডি। একটা আপু আছে তরী নাম। ওর সাথে পড়ে। মাঝে মাঝে বাসায় আসে, আমি একদিন দেখে ফেলেছি দুজনে হাত ধরাধরি করছিল। আরেকদিন দিন শুনেছি ফোনে কার সাথে প্রেমালাপ করছে। সে যে তরী আপু না তা বুছেছিলাম।’
ইরি আর নন্দিতা এক বাক্যে যেন বলে উঠল, ‘তাই। খুব বাজে তোমার ভাই। ঠিক তোমার উল্টো। তুমি এত লক্ষ্মী হলে কেমনে?’
কেবলা হাসি দিলাম। মনে মনে ভাবলাম যাক ভাইয়ার প্রতি দূর্বল হবে না অন্তত।
ওরা দেরী করল না, যাবার সময় বলে গেলো কাল বিকালে যেন আমি ইরিদের পাড়ার ওপাশে ফাস্টফুডে যাই। জরুরী সেই কথাটা বলবে।



তিন

সময়ের আগেই পৌঁছে গেলাম। ওরা একটু পরে এল। খাবার ওর্ডার দেয়ার পর ইরি মুখ খুলল, ‘তুমি খুব লক্ষ্মী ছেলে রনি। স্কুলে সবাই তোমাকে কেলাস বলতো আসলে তুমি কেলাস না। এই নাও আমার আপুর বিয়ের কার্ড। তোমাকে আমার তরফ থেকে বিশেষ দাওয়াত।’
কার্ডটা হাতে নিয়ে খুললাম। ডাক নাম ‘তরী’ লেখা দেখে বললাম, ‘ইরির বোন তরী..., আপু কি করেন?
‘তোমার ভাইয়ার সাথে ইন্টার্নী করছে। শীঘ্রই ডাক্তার হয়ে যাবে।’
মানে?
‘মানে বুঝলে না আমাদের দেবর মিয়া’ নন্দিতার এই বাক্য শুনে আরও কিছই বুঝলাম না।
বললাম, ‘দেবর মানে? কাল কেনো বললে না ঐ তরী আপুই তোমার আপন বোন...?
ইরি মুখ খুলল, একটু লজ্জা যদিও মুখে, সেটা লুকিয়ে বলেই ফেলল, আরে বুদ্ধু তুমি যে আমার কী উপকার করেছো জান না। আরেকটা ছোট উপকার, করে দাও ভাই প্লিজ... এই ছোট প্যাকেটটা তোমার ভাইয়াকে দেবে।’
‘আমি তো কিছুই বুঝছিনা।’
‘আমরাও বুঝতে পারিনি সেদিন যখন তোমাকে দেখলাম তিনতলার সিঁড়ি ঘরে, আমরা তো অপেক্ষা করছিলাম তোমার ভাইয়ার জন্য। নন্দিতা বলল আরে ওই তো আমাদের ক্লাশের সেই কেলাস রনিটা না। সরি , তুমি আসলে কেলাস নও... মণির ভাই রনি, মিলে যাচ্ছিল, তারপর তোমাকে ডাকলাম...’
‘রনি, তোমার ভাইয়ার সাথে আমার এফেয়ার অনেক দিন ধরেই। আপুর সাথে বাসায় যেত। থাক অত যেনে তোমার লাভ নেই, তুমি খুব লক্ষ্মী দেবর আমার। কাল তোমার ভইয়ার সাথে ঝগড়া হচ্ছিল। আমিও নাছর বান্দা, বললাম তোর মার সাথে দেখা করেই ছাড়ব। আর তুমি তুরুপের তাস, পৌঁছে গেলাম তোমাদের বাসায়...’
খাবার চলে এল। ওরা মন খুলে হাসছে। আমিও বোকা বোকা একটা হাসি দিলাম এবং একই সাথে মনের ভেতর আবার ইরিকে দিলাম কবর । কী বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সাহস করে বলেই ফেললাম, ‘তোমাকে তবে ভাবী বলেই ডাকি।’
হো হো করে হেসে উঠে ইরিবলল, ‘তোমাকে তবে ছোট্ট দেবর ...’
‘ওকে, একটা প্রশ্ন ছিল-তোমার নামটা ইরি কেনো বলবে?
‘ মণিকে কখনও এর উত্তর দেইনি, যদি ওকে না বল...!’
‘বলব না, প্রমিস ভাবী...’
‘ আমার নানা ফিলিপাইনস এ ধান গবেষণা ইনিষ্টিটিউট মানে ইরি তে চাকুরী করেছিলেন এক সময়, নানার শখ আর তরীর বোন .. হয়ে গেলাম ইরি...।’


ছোটগল্প - লতিফ জোয়ার্দার

ধুসর কিছু স্মৃতির অন্তরালে বাদামি দুটি মন
লতিফ জোয়ার্দার

ব্যস্ত নগরীর ফুটপাত ধরে পথ চলতে চলতে, মনে হলো কে যেন পিছন থেকে ডাকছে আমায়। থমকে দাঁড়ালাম, মাথাটা ঘুড়িয়ে তাকানোর পূর্বে কেন জানি মনে হলো! আমি হয়তো ভুল শুনেছি। এখানে আমাকে কে চেনে! চেনাজানা তেমন কারো কথা ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। আবার ছুটতে শুরু করি, ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে থাকি আমি। মনে হলো সেই মানুষটাও আমার পিছু নিয়েছে। কয়েক কদম যেতে আবার সেই সুমিষ্ট কন্ঠের আহবান শুনতে থাকি। আবার থমকে দাঁড়াই... এবার আর না তাকিয়ে পারি না। আমার সামনে তখন মধ্য বয়সী এক নারী। নাদুসনুদুস চেহারা। মেকাপের ভিড়ে প্রকৃত অবয়ব হারাতে বসেছে। কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। কে এই নারী। কিছু সময় একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখ টিপ টিপ করতে থাকে। অথচ কিছুতেই পলক ফেলতে ইচ্ছে করে না। আগন্তুক নারী আমাকে বলতে থাকে।
Ñ তুমি মনে হয় আমাকে চিনতে পারোনি। আর চিনবার কথাও না। কতদিন আগের কথা। বছর কুড়িতো হবেই।
কথা বলতে বলতে থেমে যায় ভদ্র মহিলা। কিছু সময় আবার তাকিয়ে থাকে। কিছু মানুষ আমাদের ধাক্কা দিয়ে নিজের পথ তৈরি করে ছুটে চলেছে, যার যার গন্তব্যে। দুরন্ত ছুটে চলা এ নগরী, কখনো থেমে থাকে না। অবিরত ছুটতেই থাকে। এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে কারো সাথে আলাপ করা বেশ কঠিন। কিন্তু আমার তখন বেশ তাড়া! সামনে থেকে রিকসা নিয়ে কমলাপুর যেতে হবে। তিনটা দশে রাজশাহী গামী সিল্কসিটি ট্রেন। ধরতে না পারলে আজ নিশ্চয় বাড়িতে পৌঁছাতে পারবো না আর।
Ñ দেখুন আমি আপনাকে চিনতে পারিনি, আর সেই সময়ও আমার নেই, আর ঘন্টা দেড়েক পর আমার বাড়িতে যাওয়ার ট্রেন, ধরতে না পারলে! আমাকে এই নগরীতে থেকে যেতে হবে। আর থাকবো! তেমন পরিচিত কেউ নেই আমার এখানে। তবে ইচ্ছে করলে হোটেলে থেকে যেতে পারি কিন্তু হোটেলে থাকতে হলে যে পরিমান অর্থ প্রয়োজন তার অর্ধেকও নেই আমার পকেটে।
আবার সে কথা বলতে শুরু করে। এমন ভাবে কথা বলতে থাকে যেন, সে আমার কত দিনের চেনা।
Ñ সত্যি! তুমি আমাকে চিনতে পারোনি! আমি রোজী... এক সাথে এক কলেজে দু’বছর পড়েছি গো। বলো এখনো তুমি আমাকে চিনতে পারোনি।
আমি তখনো হাবার মতো চেয়ে থাকি। স্মৃতির ডাটা কেবল্স গুলো দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। রোজী! কোন রোজী। রোজী আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে।
Ñ ও বুঝেছি! তুমি আমাকে এখনো চিনতে পারোনি। চলো! সামনে যে কোন একটা রেষ্টুরেন্টে গিয়ে কিছু সময় বসি, সেখানেই বাদ বাকি কথা সেরে ফেলা যাবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ।
Ñ আপনাকে তো বলেছি, আমার তাড়া আছে, ট্রেন ধরতে হবে।
আমার এসব কথায় তার কোন ছোঁয়া লাগেনা। রোজী তবুও নাছোর। এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন কিছু সময় তাকে দিতেই হবে। কিছু বলার জন্য ওর ঠোঁট দুটি কাঁপতে থাকে। মুখের অভিব্যক্তি গুলো দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে।
Ñ তবে চলো। তোমার সাথে আমিও না হয় ষ্টেশন পর্যন্ত যাই। আর রিকসায় যেতে যেতে কথা বলি।
Ñ আপনি আমার সাথে! কী বলছেন। মাথা ঠিক আছে তো।
Ñ কেন! তোমার কোন সমস্যা আছে?

আমরা রিকসার জন্য সামনে এগুতে থাকি। সবেমাত্র প্রেসক্লাবের সামনে আমরা। এখান থেকে রিকসা নিলে দিগুন টাকা গুনতে হবে, সে কারণে আমার ইচ্ছে ছিলো দৈনিক বাংলার মোড় থেকে রিকসা নিবো। কয়েক কদম যেতেই রোজী একটা রিকসা ডেকে বসে।
Ñ এই রিকসা কমলাপুর যাবা।
Ñ যামু! তয় আশি টাকা লাগবো।
Ñ টাকা কোন সমস্যা না। যাবা কিনা বলো।
কথা বলতে বলতে রোজীর সাথে রিকসার চড়ে বসি। বেশ ঘুরে যেতে হবে কমলাপুর। রোজী আমার শরীরের সাথে লেপটে বসে আছে, আমার মুখের দিকে মুখ নিয়ে কথা বলছে।
Ñ শফিক! তোমার মুখের পোড়া দাগটা দেখি অবিকল ঠিক তেমনি আছে। কেমন আছো তুমি!
আমি কথা বলবো কী! অবাক বিস্ময়ে তার দিকে চেয়ে থাকি। কী যে হয়েছে আমার! পুরনো কিছুই ঠিক ঠাক মতো মনে করতে পারি না। এক সিগনালে আমাদের রিকসা তখন আটকে আছে। লাল বাতি হলুদ বাতি অতঃপর সবুজ বাতি জ্বললেই আমরা যেতে পারবো। কতক্ষণ যে, এ অবস্থায় থাকতে হবে কে জানে!
আমি সবকিছু মনে করার চেষ্টা করি। এক রোজীর কথা, তখন আবছা মনে আসছে আমার, কিন্তু সে তো এমন মোটা ছিলো না। একেবারে লিকলিকে। মনে হতো বাতাসে উড়ে যাবে। পাখির মতো কেমন যেন উড়ে উড়ে বেড়াতো সারাদিন। সেই রোজী কী! মেলানোর চেষ্টা করি। কিছুতেই মেলে না। সেই চুল সেই হাসি, কোন কিছুতেই কোন মিল খুঁজে পাই না। রোজীর দীঘল লম্বা চুল আর সাথে লাগাতার হাসি। আর সেই রোজী না হলে... এমন করে আর কে এখানে চিনবে আমায়! লম্বা মুখটা মাংশের ভারে গোল হয়ে গেছে। আর চুল ছেটে ববকার্ট করেছে রোজী। আমার দিকে তাকিয়ে, কেমন যেন হো হো করে হাসতে থাকে রোজী।
Ñ কী ব্যাপার! এখনো তুমি আমাকে...। হাই কপাল আমার... যার সাথে একবার কথা বলতে পারলে ধন্য হতো শফিক সহ কতজন... সে আমাকে এখন চেনে না। সত্যি করে বলোতো... তুমি আমাকে চিনতে পারোনি! নাকি, চিনে না চেনার ভান করছো। তবে এটা ঠিক, আমি তখন এমন ছিলাম না। এমন মোটা বেঢপ চেহারা ছিলো না আমার।
রোজী! সেই রোজী, আমাদের কাদের স্যারের মেয়ে রোজী। যাকে একটা গোলাপ দেবার জন্য কতদিন প্রতিক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকেছি রাস্তায়। সেই রোজী! যার একটু ভালোবাসা পাবার জন্য হন্নে হয়ে তার বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরেছি। কী কপাল আমার! সেই রোজী এখন আমার সামনে! অথচ...
আমার চোখ জলে ভিজে ওঠে। বিষণœ হয় চারিপাশ। একটা অদ্ভুত স্মৃতি এসে দোলা দিয়ে যায়। আমি তাকে চিনতে পারাতে, চঞ্চল হয়ে ওঠে সে। পুরো মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় । এই প্রথম রোজীর মুখের দিকে ভালো করে চাইলাম আমি। কালো শাড়িতে মেচিং ব্লাউজ,তার দুধ আলতা রঙের শরীরের সাথে এমন ভাবে ফুটে আছে যে, অন্য রকম এক শিহরণ দিচ্ছে আমায়। ভেতর থেকে সাদা ব্রা উকি দিয়ে যাচ্ছে। তার নরম কমল শরীর এসে আমাকে মোহগ্রস্থ করে দিচ্ছে। তবে আর যাই হোক! সেই আগের রোজী আর নেই। সেই দুরন্ত চঞ্চল অদ্ভুত মায়াবী মেয়েটি। কলেজে সবার দৃষ্টি আটকে যেতো যার চোখে।

Ñকী ব্যাপার থমকে গেলে মনে হয়।
Ñ থমকে যাবার কথা কী নয়। এতদিন পড়ে আবার তোমার দেখা পাব কোনদিন ভাবতে পেড়েছি। যার জন্য কত অস্থির বিকেল, আমাকে ব্যথার দোলায় দোলাতো। যার জন্য থমকে যেতো সময়। এখন আমার সব মনে পড়ছে। বাস্তবিক সংসার নামক অদ্ভুত বস্তুটার সাথে আমি কিছুতেই পেরে উঠছি না আর। অভাবের সাথে সংগ্রাম করে কতদিন টিকে থাকা যায় বলো। দুই ছেলে আর এক মেয়ে আমার। একজন মেডিকেলে, আর দুজন কলেজে। আমার ছোটখাট ব্যবসা দিয়ে আর কুলাতে পারছি না। তাই জায়গা জমি বিক্রি করে, বিদেশ যাবার জন্য তিন লক্ষ টাকা দিয়েছি এক দালাল কে।
বিদেশতো! পাঠাতেই পারলোই না। এখন টাকাগুলো নিয়ে পায়তারা শুরু করেছে।

ইতিমধ্যে রোজী অন্য রকম হতে থাকে। বুকের ভেতর জমাট বাঁধা ব্যথার পাহাড় নিয়ে পিছন ফরে চায়।
চোখ ছলছল করে ওঠে। মনে মনে ভাবতে থাকে, এই সেই শফিক! যে কিনা তার একটু ভালোবাসা পাবার জন্য কত রকম চেষ্টা করে যেতো। সেই চিঠির কথা আজো মনে আছে তার। ছোট্র দুই লাইনের সে কী আবেক। একটা বই পড়তে নিয়েছিলাম ওর থেকে। সেখানেই ছিলো...



রোজী
তোমায় নিয়ে বুকের ভেতর হয় যে তোলপাড়
জানি তুমি! একদিন হবে যে আমার।

কী যে মাদকতা এখনো মনে হলে উলোট পালোট হয় সব। কিন্তু তখন আমি অলরেডি আরেক জনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। ওদিকে শফিককে কষ্ট দেবার মতো অবস্থা আমার ছিলো না। তাকে দেখলেই মুচকি একটা হাসি দিয়ে ব্যস্ততার ভান করে পালিয়ে যেতাম। কখনো কখনো একটু আদটু সময় দিতাম তাকে। এতেই মনে হতো সে যেন স্বর্গ পেয়েছে। কলেজের ক্লাস আমার ভালো লাগতো না। মামুনের সাথে মোটরবাইকে লং ড্রাইভে বেড়িয়ে পড়তাম। সেই বয়সেই মামুন বিয়ের জন্য অস্থির হতো। কতদিন বুঝিয়ে রেখেছি। মামুন আমার দু-ইয়ার সিনিয়র। কলেজে রাজনীতি করতো। বাম রাজনীতি তার রক্তের সাথে মিশে যেতে থাকলো। রাতদিন মিছিল মিটিং। রাত করে বাড়ি ফেরা। দিনে দিনে আমাকে সময় দেওয়া কমিয়ে দিলো মামুন। তখন এরশাদ হটাও আন্দোলন তুঙ্গে। সবদল এক হয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ হটাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। রাস্তায় রাস্তায় মানুষ আর মানুষ। সবাই যেন সমস্ত ভয় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। সিপাহীদের তপ্ত কন্ঠ তাদের দমাতে পারে না। তাদের গুলির ভয়ে কেউ রাজপথ ছাড়ে না। একজন বুক পেতে দিলে! আরো দশজন মিছিলে এসে যোগ দেয়। সর্বপুরি সব মানুষের একটাই দাবী। স্বৈরাচারী এরশাদ তুই কবে যাবি!

দেখতে দেখতে এইচ.এস.সি ফাইনাল পরীক্ষা সামনে চলে এলো। রাতদিন পড়াশুনায় ব্যস্ত তখন আমি। শফিকের সাথেও তেমন একটা দেখা সাক্ষাত হতো না আমার। পরীক্ষার দুদিন আগে একবার দেখা হলো শফিকের সাথে। আমি তখন প্রবেশপত্র নেবার জন্য কলেজে গিয়েছি মাত্র। সামনে এসে দাঁড়ালো শফিক। ও হয়তো সেজন্যই এসেছে। চোখের ভাষা বিনিময় হলো। সাথে দু’চারটি কথা। মনে হলো ভালো নেই শফিক। বেশ উসকো খুসকো চেহারা। মনে হচ্ছে শরীরে কতদিন জলের পরশ পড়েনি।
Ñ শফিক, কী হয়েছে তোমার? এমন দেখাচ্ছে কেন?
Ñ না! তেমন কিছু না। ভেবো না। ভালো আছি আমি।
আমার নিকট সবকিছু এড়িয়ে গেল শফিক। বড্ড কষ্ট পেলাম। মামুন দূরে সরে যাচ্ছে দিনেদিনে,্ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। আমাকে ছাড়তে পারবে কিন্তু রাজনীতি থেকে দূরে যেতে পারবে না কোনদিন। ওদিকে শফিক নিজেকে মনে হলো গুটিয়ে নিচ্ছে।
কোন মতো পরীক্ষাটা পার করে ঢাকাতে চলে এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য, কোচিং-এ ক্লাস করা শুরু করলাম। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম লেখাপড়া নিয়ে। ভুলে যেতে চাইলাম পিছন সব স্মৃতি। কোথায় পড়ে থাকলো মামুন আর কোথায় শফিক।

মাঝে মাঝে এখনো বেশ মনে পড়ে শফিক আর মামুনের কথা। যখন মনটা বড় বেশি বিষণœ হয়। কোন কাজে মন বসে না। মন হারিয়ে যায় তেপান্তরের ওপারে, তখনই বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠে। এখানে আমি সব পেয়েছি, বড় লোক স্বামী, দামী গাড়ি বাড়ি সব। কিন্তু সেই কলেজ জীবনের সেই বাদামি স্মৃতি এখনো আমায় কাঁদায়। এখনো ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সেই ছোট্ট শহর ঈশ্বরদীতে। রেললাইন ধরে ছুটে চলা মাইলের পর মাইল। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। এখনো কী সে শহর তেমনি আছে। শফিক মনে হয় ফিরে গিছে পুরনো সেইদিনে। স্মৃতির রাস্তা ধরে পিছন ফিরে চাইছে শফিক।

আবার দু’জনই বেশ কিছু সময় চুপচাপ। কারো মুখে কোন কথা নেই। সিগনাল ছেড়ে আবার রিকসা চলতে শুরু করেছে। এক সময় আবার আমরা ফিরে যাব, যে যার যার গন্তব্যে। আবার একাকিত্ব আবার স্মৃতির রশি ধরে টানাটানি। কথা বলতে শুরু করি আমি।
Ñ একটা কথা বলবো রোজী?
Ñ বলো?
Ñ তুমি কী সেদিন আমাকে! সত্যিই...
এটুকু বলে আর কিছু বলতে পারি না। থমকে যাই। রোজীর চোখ থেকে তখন জল গড়িয়ে পড়ে। আরার নিশ্চুপ আমরা। আবার নিস্তব্ধ আমরা। রিকসা চলতে চলতে এক সময় থেমে যায়। ভাড়া মিটিয়ে আমরা ষ্টেশনের ভেতরে যেতে থাকি। ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে নির্দিষ্ট লাইনে। কিছু সময় পর আবার যাত্রা শুরু করবে। রোজী একটা ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে যেতে চাইলে। আমি ওর হাত ধরে ফেলি। কিছুতেই কান্না শামাল দিতে পারে না রোজী। আমার হাতের মধ্য থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে এগুতে থাকে। আমি চেয়ে থাকি রোজীর যাত্রা পথে...

ছোটগল্প - আফসার নিজাম

সাহস এবং জলপাইড্রাগন
আফসার নিজাম



(স্বৈরশাসনের বিপক্ষে অবস্থানকারী ছাত্রদের জন্য)

আমরা অনুভব করতে পারছি একটি সাহস ক্যাটওয়াক করে ধীরে ধীরে উঠে আসছে আমাদের মাঝে। সূর্যালোকের রোদে যেমন করে গাছের ছায়া মাটিতে লম্বা হতে থাকে ঠিক তেমনি আমাদের ভেতরে সাহস বড় হয়ে প্রবেশ করতে থাকে হৃদয়ের ভেতর। সাহটা পায়ের কাছ থেকে উঠে এসে বুকের মধ্যখানে আসন নেয়। তারপর আরো শক্তি অর্জন করে আমাদের ঘাড়ের শাহীরগের মাঝে সঞ্চালিত হয় আর ‘চির উন্নত মম শির’ বলে বুক টান করে দাঁড়ায়। সাহস দাঁড়িয়ে গেলে সকল ভয় উবে গিয়ে ধু ধু প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। চোখের প্রিজমে তখন খেলা করে মুক্তির নেশা।

আমাদের মাঝে যে একটা সাহস জন্মেছে সে কথাটা আর গোপন থাকে না। এ কান থেকে ও কান হয়ে মানে মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে পরে খেলার মাঠ থেকে ছাত্রাবাসে। ছাত্রাবাস হয়ে রাজপথে। রাজপথ থেকে শহর-নগর-গ্রাম-গঞ্জে। গ্রাম তো আর গ্রাম নেই এখন এক একটা গ্রাম মানে এক একটা ছোট শহর। ছোট শহরে আর কোনো কথাই গোপন থাকে না। গোপন কথাগুলোও গোপনীয়তা খুলে বেড়িয়ে পরে সদর দরজা দিয়ে। তাই সাহসের কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে, বুকে বুকে। কারণ তারা সাহস দেখবে। সাহস দেখার জন্যই অপেক্ষা করে আছে। আহা সাহস! প্রিয় সাহস।

হতাশায় ডুবে যাওয়া মানুষগুলো টের পায় সাহস জেগেছে। ঝড়ের মাঝে মেঘনা নদীতে বরিশালের লঞ্চগুলো যখন টালমাটাল অবস্থা ঠিক সেই সময় সারেং লঞ্চটা চরে ঠেকিয়ে দিলে মানুষ যেমন স্বস্তি অনুভব করে আজ তারা ঠিক সেই স্বস্তি অনুভব করে। আর ভয় পেলে মানুষ যেমন শব্দ করে চিৎকার করে। যতো ভয় ততো বেশি চিৎকার। ভয়কে জয় করার চিৎকার দিয়ে মানুষ বলতে থাকে, ‘সাহস জেগেছে; আমাদের সাহস।’ তখন সাহসের কথা গুঞ্জরিত হতে থাকে অলিতে-গলিতে। গুঞ্জরিত হতে থাকে কিশোর থেকে বৃদ্ধদের কানে কানে।

যুবকেরা সাহসের টের পেয়ে আর ঘরে বসে থাকতে পারে না। তারা বেরিয়ে পড়ে। ঘরের ভেতরে তারা অস্বস্তি অনুভব করে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় বলে মনে হয়। বাইরে বেরিয়ে এক বুক নিশ্বাস নিয়ে জ্বলে ওঠে। জ্বলে ওঠে আর জ্বালাতে থাকে হৃদয়ের আগুনে মুক্তির রাজপথ। আগুনের জোগান দিতে জমি থেকে ছুটে আছে কৃষক, কারখানা থেকে ছুটে আসে শ্রমিক, পাঠশালা থেকে ছুটে আসে শিক্ষার্থীসহ শিক্ষক। আর ছুটে আসে প্রজাতন্ত্রের সকল চাকুরে। কারণ তারাও অপেক্ষা করতে ছিলো এমন একটা সাহসের। কবে সে সাহস জেগে ওঠবে। কবে মুক্তির নিশান উড়বে। কবে বুক খুলে নিশ্বাস নিবে। কবে মুখ খুলে কথা বলবে, একান্ত কথা; আপন কথা; মনের কথা; তর্কের কথা; প্রতিবাদের কথা; বলা কথা; না বলা কথা। অতপর খেলার মাঠ থেকে সাহস ফিরে এলো খেলাই হয়ে ওঠলো সাহসের কেন্দ্রবিন্দু। খেলায় খেলায় জমে ওঠলো খেলা। পুঞ্জিভুত ক্ষোভ আঁছড়ে পড়লো খেলার মাঠে, খেলার মাঠ হয়ে ওঠলো রাজনীতির মুক্তমঞ্চ; খেলার মাঠ হয়ে ওঠলো মুক্তিরক্যাম্প। খেলার মাঠ হয়ে ওঠলো স্বাধীনতার উড়াল পাখি। খেলার মাঠ হয়ে ওঠলো স্বাধীনতার ভেতরের স্বাধীনতা।

খেলার মাঠ নিয়ে খেলুড়ের কপালে ভাঁজ হয়। ভাঁজে ভাঁজে জমে ওঠে বিষাক্ত ঘাম। ঘাম মুছতে মুছেতে ভাবে ‘খেলার মাঠে নেমে আসলো পদনের বৃষ্টি? নেমে আসলো খোদার লা’নত?’ ভাবতে ভাবতেই খেলুড়েরা হারাতে থাকে তাদের মায়াজাল। মায়াজাল ছিঁড়ে যাচ্ছে। মায়াজাল ছিঁড়ছে দেখে খেলুড়েরা জ্ঞানশূন্য হয়। তাদের জ্ঞানে পচন ধরে। পচে পচে জমিনের ওপর পড়ে। জমিন গ্রহণ করে না; জমিন ওগলে দেয়; জমি বমি করে। পানি বৃদ্ধি পায়; পানি বন্যা হয়। সূর্য রেগে ওঠে; সূর্য় তাদের মাথায় ঢেলে দেয় রাজ্যের তাপ। সে তাপে তাদের মাথার তালু গরম হয়। গরম মাথা জ্ঞান শূন্য হয়। জ্ঞান শূন্য মাথায় প্রস্তুতি নেয় আরো একটি শয়তানি খেলার। খেলার মাঠ থেকেই তাই শুরু হয় তাদের ইবলেশি অপারেশন।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধা নামে। সন্ধা নামে না যেনো প্রজাতন্ত্রে নেমে আসে অন্ধকার শুয়র। অন্ধকারে খেলা করে ভুতের বাচ্চা। ভুত ভুতের দোস্ত; ভুতেরা ভুতেরা মামাতো ভাই; ভুতেরা ভুতেরা শালাতো ভাই; ভুতেরা ভুতেরা তালতো ভাই। ভুতেরা ভুতেরা মিলিত হয়। এরপরই সারি সারি জলপাইড্রাগনে ভরে যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রান্তর। জলপাইড্রাগনের গর্জনে কেঁপে ওঠে বইয়ের আলমিরা। কেঁপে ওঠে রাবেয়া হল, কার্জন হল, কলা ভবন, টিএসসি। কেঁপে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ, কেঁপে ওঠে নজরুলে কবর। আর কেঁপে ওঠে কোমলমতি ছাত্রদের অন্তরআত্মা।

অন্ধকার গিলে খায় আলোর ফোয়ারা। নিজেকে ছাড়া আর কারোই মালুম হয় না। তখন জলপাইড্রাগনের সার্চলাইট জ্বলে ওঠে। জ্বলে ওঠে জলপাইড্রাগনের আগুন চোখ। যেনো এখনই জ্বালিয়ে দেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল জ্ঞান। জ্বালিয়ে দেবে আটষট্টি হাজার বর্গমাইল সবুজ। স্তব্ধ করে দেবে ষোল কোটি মুখের আওয়াজ। আওয়াজকে ড্রাগনজান্তারা খুব বেশি ভয় পায় । আওয়াজ শুনলেই কেঁপে ওঠে তার অন্তরআত্মা। তখন অন্ধতীরন্দাজের মতো অন্ধকারে তীর চালায় যেনো টিকটিকির মতো টিক টিক করে কেউ সত্য উচ্চারণ করতে না পারে। জান্তা জানে সত্যই মিথ্যাকে দূরভুত করে।

কিন্তু না। ড্রাগনজান্তার বিরুদ্ধে জেগে ওঠে সাহস। সাহসে সাহসে জেগে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। সাহসেরা গেয়ে ওঠে বিজয়ের গান; সাহসেরা গেয়ে ওঠে মুক্তির গান। সাহস মানুষের মনে সাহস জোগায়। মানুষেরা আড়মোরা দিয়ে ওঠে। মানুষেরা সাহসে ভর করে ওঠে দাঁড়ায়। মানুষেরা দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে। মানুষেরা বিক্ষোভে ফেটে পরে। বিক্ষোভে, রাজপথে উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি হয়; তরঙ্গ সৃষ্টি হয় শহর-নগর-বন্দরে; গ্রাম-গঞ্জে; অলিতে-গলিতে। তখন মিছিলের লাইন দীর্ঘ হয়। বন্ধ হয় স্বৈর শাসনের প্রজাতন্ত্র। গাড়ি চলে না; দোকান খোলে না। ব্যাবসা বন্ধ; ইশকুল বন্ধ; অফিস বন্ধ; আদালত বন্ধ। রাজপথ দিয়ে তখন টহল দেয় জলপাইড্রাগন। তার ক্রুড় শব্দে কেঁপে ওঠে রাজপথ। তখন মিছিলের শব্দও আরো জোড়ালো হয়। শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে ওঠে স্বৈরকুরসি।

ড্রাগনজান্তার ক্ষোভ হয়; গোস্বা হয়; রাগ হয়। তার অহং-এ ঘা লাগে। ঘা লেগে আরো বেড়ে যায় অহং। অহংকারে বুকের ছাতি ফেটে বেড়িয়ে আসে তার কলিজা; কালো কলিজা। কালো কলিজায় শুভ্রতার কোনো চিহ্ন নেই। নেই কোনো গোলাপের আঁচর কিংবা প্রিয়তমার কোনো চুমুর চিহ্ন। সে যেনো এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। টগবগ করে জ্বলে থাকে দোজগের কালোআগুন। যে আগুনলাভা ধ্বংস করে দেয় মানুষের সাজানো সভ্যতা। সেই কুৎসিত কলিজা থেকে বেরিয়ে আসে জানোয়ারের হুংকার। তার হুংকারে পেঁচা জানোয়ারও হুংকার দেয় প্রজাতন্ত্রের প্রজার ওপর। হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহসের ওপর। ট্যা ট্যা ট্যা শব্দে ভারি হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রান্তর। কাঁদানো গ্যাসে ছেয়ে যায় টিএসসি চত্বর; কাদানো গ্যাসের অন্ধকারে ভরে যায় কলাভবন; নিলক্ষেত, ফুলার রোড, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ। বিদ্যুৎ নিভে যায়। অন্ধকার গ্রাস করে জ্ঞানের আলো। এ যেনো ড্রাগনের কৃষ্ণগহবর থেকে নিয়ে আসে অন্ধকার। অন্ধকার দিয়ে ছেয়ে ফেলতে চায় জ্ঞানের জগৎ। পেঁচা শাসকের অন্ধকার পছন্দ। সে অন্ধকার ভালোবাসে। অন্ধকার ভালোবেসে অন্ধাকার ছড়িয়ে দেয় প্রজাতন্ত্রের ভেতর-বাহির। সেই কৃষ্ণঅন্ধকারে একটুকরো আলো নিয়ে এগিয়ে আসে সাহস। সাহসের সাহস দেখে কুপি নিয়ে এগিয়ে আসে আষট্টি হাজার বর্গমাইলের প্রজাসকল। এগিয়ে আসে প্রজাতন্ত্রের বৃদ্ধ মা। মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রতিটি ছাত্র হাতে করে নিয়ে আসে আলোর মশাল। এক এক করে জ্বলে ওঠে মশাল। মশালে মশালে আলোকিত হয় জ্ঞানের জমিন। আলোর মিছিল দেখে ভয় পায় অন্ধকার। আলো তার শত্র“। তখন অন্ধকার অন্ধকারকে শিষ দেয়। ড্রাগনশিৎকারে নোংরা হয় পরিবেশ। নোংরা দেখে শুয়র যেমন আনন্দ পায় তেমনি নোংরা শিৎকারে আনন্দ পায় ড্রাগনজান্তা। তাদের মুখ শিৎকার করে। চোখ শিৎকার করে। পা শিৎকার করে। আর হাতের মেশিনগান শিৎকার করে ওঠে। মেশিনগানের শিৎকার আলোর অগ্রপথিকের দিকে ছুটে আসে। ঠিক তখনই বাতাসের সকল শিকল ছিঁড়ে নপুংসক শাসকের একটি বুলেট ডুকে যায় সাহসের বুকে। বুলেটের প্রবেশ পথ দিয়ে বেরিয়ে আসে তপ্তলহু; মুক্তির লহু; স্বাধীকারে লহু; গণতন্ত্রের লহু। লাল হয়ে ওঠে শুভ্রজামা। জামা পরম আদরে গ্রহণ করে শুষে নেয় মুক্তির লাললহু। সাহসের বুকে বুলেট দিয়ে কিছুটা শান্ত হলেও আবার শুরু করে ড্রাগন আওয়াজ। সেই আওয়াজ আকাশ তোলপার করে তোলে। আকাশের মালিককে যেনো জানিয়ে দিতে চায় বুলেটই শক্তির মূল উৎস।

আমরা ছুটে যাই নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। কাধে তুলে নেই সাহস। সাহসেÑ সাহস ভর করে আমরা কলাভবনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই ওপরে। স্বৈর বুটগুলো আমাদের অনুসরণ করে কুকুরের মতো। আর সাহসের লাল রক্ত দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসে। আমরাও সন্তর্পনে সাহসকে শুয়ে দেই কলাভবনের দোতালার একেবারে শেষ রুমের বারান্দার ওপর। যেনো মায়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকে সাহস। তারপর বই খাতা ছিঁড়ে গায়ের ওপর বিছিয়ে দেই ফুলের পাপড়ির মতো যেনো কোনো ভাবেই বুঝতে না পারে জলপাইড্রাগনের ক্রুদ্ধচোখ।

সাহসকে পরম যতেœ রেখে আমরা লুকিয়ে পড়ি নিরাপদ আশ্রয়ে। কারণ প্রতি মুহূর্তে জলপাইড্রাগন চোখ খুঁজে ফিরছে সাহস। যেনো কোনো প্রকারেই মানুষের সাহস বৃদ্ধি না পায়। তাই তারা আমাদের অনুসরণ করে খুঁজে নেয়। বুটের শব্দে কলাভবনের বারান্দা কেঁপে ওঠে। হাজার হাজার অন্ধকারেও সেই বুটের আওয়াজ সন্ত্রস্ত করে তোলে বারান্দা। তারপর হঠাৎ করেই ড্রাগনটর্চগুলো জ্বলে ওঠে একসাথে। যেনো দোজখি আলো গ্রাস করে নেয় তামাম বারান্দা। বুটের শব্দে শব্দে এগিয়ে আসে ড্রাগনপা। আর হুমড়ি খেয়ে পড়ে সাহসের ওপর।

বাতাসে বইয়ের ছেঁড়াপাতা সরে গেলে সাহসের মুখের ওপর আলোর বন্যা এসে পড়েতেই বিদ্যুৎ আলোর মতোই উজ্জ্বল আলো ছড়াতে থাকে সাহসের চেহরা। তখন ভয় পেয়ে যায় জলপাইড্রগান। পিছিয়ে আসে আর একসাথে ট্যা ট্যা ট্যা আওয়াজ তুলে ঝাঁঝরা করে দেয় সাহসের অবশিষ্ট দেহ। তখন দেহের অবশিষ্ট রক্তের নহর শরীর থেকে বের হয়ে শিক্ষাঙ্গণকে মুক্তির স্বাদ দিতে দিতে এগিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে। জলপাইড্রাগন তাদের অগ্নিহাসি দেয়। অগ্নিহাসি মানুষে বুকে লাগে। মানুষ কেঁদে ওঠে। কেঁদে ওঠে মা, কেঁদে ওঠে বোন, কেঁদে ওঠে ভাই, কেঁদে ওঠে আত্মীয়-অনাত্মীয় প্রজাতন্ত্রের সকল বনিআদম।

অগ্নিহাসি শেষে জলপাইড্রাগনের সাঁড়াশি হাত সাহসের একটি পা ধরে নির্দয়ভাবে সিঁড়ি দিয়ে টানতে টানতে নিচে নামিয়ে থাকলে আমরা আমাদের ভেতরে আবার সাহস অনুভব করতে থাকলাম।

ছোটগল্প - পারভীন আক্তার

পারভীন আক্তার
ফেরা


তলপেটে প্রচন্ড পেইনের হিস্ট্রি দেবার পর বেডে তোলা হলো মেয়েটিকে। পালপেশন করে দেখার শুরুর দিকেই ডাক্তার আর একটি বিষয় লক্ষ্য করলেন। মেয়েটার লাল সালোয়ারের অনেকটা অংশ ভেজা।

"অন্য কোন সমস্যা আছে তোমার? "—ডাক্তার জানতে চাইলেন।
"না আপা। শুধু প্যাটে ব্যথা। "
"পিরিয়ড হয়েছে নাকি? "
"না। "
"লাস্ট কবে হয়েছিল? "
"তিন -চার মাস আগে। "
"বিয়ে তো হয়েছে। পেটে বাচ্চা -কাচ্চা এসেছে কিনা, কিছু বুঝতে পারো? "
সাথে আসা মেয়েটার ভাবী জবাব দিল এবার,
"না আপা। স্বামী দ্যাশের বাইরে থাকে। "
"ও...,আচ্ছা। কতদিন হল? "
"এই তো...।সাত -আট মাস হইবো। "
পেটে ব্যথার সম্ভাব্য কারণগুলোর সবগুলো বিষয়ে হিস্ট্রি নেবার পরও মেয়েটা মুখ খুলছিলোনা বলে এবার কিছুটা বিরক্ত হলেন ডাক্তার। সন্দেহটা আগেই হয়েছিল। শুধুমাত্র এর বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ বলে এতটা সরাসরি বলাও যাচ্ছেনা।
"শোন মেয়ে, যদি অন্য কোন ব্যাপার থাকে, তোমাকে তো বলতে হবে। না বললে চিকিৎসা হবে কি করে? "
"আমি একটু বাথরুমে যামু। "

বেড থেকে নামানো হল তাকে। কিন্তু সে নড়ছেনা। ডাক্তার লক্ষ্য করলেন, তার দু 'পা বেয়ে রক্তের ধারা মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে যাচ্ছে।
"এবার বল মেয়ে, এসব কি? কোন ওষুধ -পত্র খেয়েছো আজ -কালকের মধ্যে? "
মেয়েটা এবার হ্যাঁ -না কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ডাক্তারের মুখের দিকে। তার ভাবী বলল,
"হ আপা।খাইছে। "
"কি ঔষধ? "
এবার দু'জনেই চুপচাপ।
"কোন পরীক্ষা -নিরীক্ষা করা হয়েছিল? "
"হ্যাঁ আপা। "-ভাবীর জবাব।
"কিসের পরীক্ষা? "
"প্রস্রাবের। "
"বাড়িতেই? "
"হ্যাঁ। "
"কয়দাগ উঠেছিল ? "
"দুই দাগ। "
এবার ডাক্তার বিরক্ত হয়ে মেয়েটাকে বললেন, "আগে বলোনি কেন মেয়ে?শুধু শুধু এতগুলো কথা খরচ করালে। "
মেয়েটা কিছু না বলে মেঝেতেই বসে পড়ল চুপচাপ। আর তারপর নিজ হাতেই টিকটিকির বাচ্চার মত একটা কিছু বের করে কাঁদতে লাগল।
ডাক্তার ভাবলেন, ছেলে মানুষ। মায়া হচ্ছে হয়তো বাচ্চাটার জন্য। কিন্তু ডাক্তারের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে সে কাঁদতে কাঁদতেই তার ভাবীকে বলে উঠল,
"আমার জামাই শুনলে মাইরা ফালাইবো ভাবী। "
ভাবী তাকে আশ্বস্ত করল, "চুপ কর। কেউ জানবো না। "
ডাক্তারের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে এবার মেয়েটাকে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন,
"কান্দিসনা। আগে মনে আছিলো না? এহন ডরাস ক্যান? "
আর মেয়েটা ডাক্তারের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
"আমার জামাইরে দিয়াই হইছে। "
"সে কি দেশে এসেছিল তিন -চার মসের মধ্যে?"
ডাক্তারের এই প্রশ্নটার জবাব তার ভাবী দিল,
"না আপা। আসেনাই। "
মেয়েটা এবার বলে উঠল,
"আমার আগেও এমন দুই -তিন মাস বন্ধ থাকত। কতজনের তো এমন কইরা বাচ্চা প্যাটে আসে। আমারও তেমনি হইছে। জামাই দ্যাশে থাকতেই। "
"যাদের এমন করে হয়, তাদের স্বামী সাথেই থাকে মেয়ে,বিদেশে নয়। আর তুমি যা বলছ, তা সত্যি হলে তোমার বাচ্চা আরও বড় হত। "
মেয়েটার নির্বোধের মত আত্মপক্ষ সমর্থের চেষ্টা দেখে তার প্রতি করুণা হল ডাক্তারের। আর তার বাবার প্রতি প্রচন্ড রাগ। যে বাবা মেয়েটিকে জরুরী বিভাগে ঢুকিয়ে দিয়েই বাইরে চলে গেছেন। হয়তো তিনিও জানেন সব। লজ্জায় ভিতরে আসছেন না। এদের মত বাবারা দশ পেরোলেই মেয়ের বিয়ে দিয়েই ঝাড়া হাত -পা।

ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখলেন। স্পনটানিয়াসলি প্লাসেন্টা আউট হয়ে গেছে। মেয়েটার সৌভাগ্য। তারপর কিছু ইনভেস্টিগেশন ও ঔষধ লিখে অ্যাডমিশন দিয়ে ইনডোরে পাঠিয়ে দেয়া হল মেয়েটিকে।ডাক্তার ভাবীকে সতর্ক করে দিলেন, যেন ভালোভাবে ধরে নিয়ে যায়। কেননা, প্রচুর লস হয়েছে। ভীষণ ফ্যাকাশে আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে মেয়েটিকে।প্রেশার ফল করে গেছে। বেডে নিয়ে দ্রুত চ্যানেল ওপেন করতে হবে।

ভাবী মেয়েটিকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে দোতলায়, ইনডোরে। ধীর পদক্ষেপে এগোচ্ছে মেয়েটি। তার বাবা আর এলেনইনা ভিতরে। ডাক্তার মেয়েটার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন অপলক। একটা অচেনা কষ্ট বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

বাল্যবিবাহের কুফলের এক জ্বলন্ত প্রমাণ চোখের সামনে দেখে সমাজের নির্বোধ মানুষগুলোর প্রতি যার পর নাই বিরক্ত হলেন তিনি। পুতুল খেলার বয়স পেরোতে না পেরোতেই এরা পুতুল পুতুল মেয়েগুলিকে তার সম্পূর্ণ অজানা -অচেনা সংসার নামক এক অন্ধকার রাজ্যে ছুড়ে দিতে পারলেই ভাবে, দায়িত্ব শেষ।

ডাক্তারের ভাবনায় ছেদ পড়ল এক মৃদু আর্ত চিৎকারে। মেয়েটি হাত -পা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়েছে বারান্দার ফ্লোরে। আর তার ভাবী তাকে দু 'হাতে আগলাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ডাক্তার উঠে গিয়ে মেয়েটাকে পুনরায় জরুরী বিভাগে নিয়ে আসতে বললেন।মেয়েটির বাবা এবার আর না এসে পারলেন না। মেয়েটাকে বেডে তুলে দেয়া হল। ডাক্তার দেখলেন, তার সারা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। ডাক্তার পালস দেখলেন। ভীষণ লো ভলিউম। ব্লাড প্রেশার আগের চেয়েও ফল করেছে। শকে চলে যাচ্ছে রোগী। দ্রুত হাতে চ্যানেল ওপেন করা হল। জরুরীভাবে কিছু ইঞ্জেকশন দেয়া হল চ্যানেলে।

জ্ঞান ফিরতে আরও কিছুক্ষণ সময় লাগলো।ডাক্তার মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেন। ঘামে ভেজা একটা শান্ত স্নিগ্ধ নিষ্পাপ মুখ। তিনি মেয়েটাকে তার নাম ধরে বার কয়েক ডাকলেন।
মেয়েটার পাতলা ঠোঁট দু 'টো তিরতির করে কাঁপছে। ডাক্তার জানতে চাইলেন,
"কেমন বোধ করছ এখন? "
সে জবাব দিতে পারলোনা। ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে রইলো ডাক্তারের মুখের দিকে। তারপর পুনরায় তার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এল। মাথার ভিতর এলোমেলো সব চিন্তার ভিড়। একরাশ ঘেন্নায় মনের ভেতরটা তেতো হয়ে উঠলো। বুকের ভেতর একটা দীর্ঘশ্বাসের কবর দিল সে।

আর কিছুই ভাবতে চাইলোনা মেয়েটি।ডান বাহুতে একটা চাপ অনুভব করল সে। বুঝতে পারল, ডাক্তার তার প্রেশার দেখছেন। এরপর ডান হাতেরই কব্জির কাছে আঙ্গুল চেপে ডাক্তার নাড়ী দেখলেন হয়তো। তারপর ডাক্তারকে তার বাবার সাথে কথা বলতে শুনলো মেয়েটি।তিনি বাবাকে বললেন, "এখন একটু ভালো আছে। "
বাবাকে দোষারোপ করলেন বার বছরেই মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য।এই বয়সে ওর মত মেয়ের কিভাবে হেসে -খেলে, নেচে -গেয়ে বেড়ানোর কথা —এসব বলছিলেন বাবাকে।
আর...আর...ঐ যমপুরীতে যেন আর আগামী বছর তিনেক না পাঠানো হয় মেয়েকে, যেহেতু তার স্বামী বিদেশেই থাকবে ততদিন। আর ততদিনে মেয়েটি তার জীবনের ভাল -মন্দ বিষয়গুলো বুঝতেও শিখবে।

মেয়েটি বুঝতে পারল, ভাবীর কাছে হয়তো সেই বিভিষিকাময় রাতের কথা শুনেছেন ডাক্তার,যে লজ্জার কথা আর কাউকে বলতে পারেনি সে। ডাক্তারের কথাগুলি শুনতে শুনতে অবচেতন মন মেয়েটাকে নিয়ে গেল বছরখানেক আগে।

মায়ের হাতের ধুয়ে রোদে শুকিয়ে ভাজ করে তুলে রাখা কাপড়ের মত মেয়েটারও বহু যত্নে ভাজ করে তুলে রাখা স্মৃতিগুলোর পাট ভাঙছে একে একে।

গাঁয়ের মাঠে ঘাটে দাপিয়ে বেড়ানো এক চঞ্চলা কিশোরী —
ছি -বুড়ি আর গোল্লাছুটের দুরন্ত জনপ্রিয় হার না মানা দৌড়বিদ, দলে পেয়ে খেলার সাথীদের ধন্য ধন্য হাসিমুখ —
রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে-পুড়ে খালের ঘোলা পানিতে ডুব-সাতার শেষে রক্ত জবা ফোলা চোখ স্বাভাবিক না হওয়া অবধি, অথবা ভেজা কাপড়-জামা রোদে বসে গায়েই না শুকানো অবধি ঘরে না ফেরা —
গায়ে ধুলা-মাটির গন্ধ মেখে পা টিপে টিপে বাড়ি ফিরেই বাড়ির এক চিলতে উঠোনে বসে থাকা মায়ের মধুর মধুর গালি —
রাতে কুঁড়ে ঘরে মাটিতে পাটির বিছানায় ছেঁড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ঘুমানো। মায়ের গায়ের মিষ্টি "মা মা" গন্ধ আর কাঁথায় ন্যাপথলিনের; নেশা নেশা গন্ধে মনে প্রশান্তি, দু'চোখে ঘুম।
আহ্!

ছোটগল্প - পিন্টু রহমান

ভ্রমরের ছোঁয়ায় অর্চনার ফুল
পিন্টু রহমান


সারি-সারি তালগাছ আর উঁচু-নিচু টিলা পিছনে ফেলে ট্রেনটি অবশেষে বাঙলাদেশ সীমানায় প্রবেশ করে; মিলা আর স্থির থাকতে পারেনা, খুশিতে ওর তনুমন নেচে ওঠে। বুকভরে শ্বাস নেয়, আহঃ বাঙলাদেশ, প্রিয় বাঙলাদেশ!
চারদিকে মুগ্ধতার আবেশ, প্রাণের স্পন্দন। নয়নের সীমানায় বিস্তির্ণ ফসলের মাঠ। পূবের হাওয়ায় পাকা ধানের শীষগুলো নুয়ে পড়েছে। আসন্ন শীতে প্রকৃতির সর্বত্রই বিরহের বসন। মাথার উপর দিয়ে ঝাঁকবেধে উড়ে যায় বুনোটিয়া।
মিলা তন্ময় হয়ে পাখিগুলোর পানে চেয়ে থাকে। আচ্ছা, পাখিগুলোর গন্তব্য কোথায়; ওরাও কি তার মতো শিঁকড়চ্যুত বৃক্ষ!
মিলা আনমনে মাথা ঝাঁকায়। দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে গেলে মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে নেয়। মৈত্রী এক্সপ্রেসের কামরাজুড়ে কেবল বিষন্ন বাতাস; বুকের গহীণে তীব্র ব্যথা। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবেগ দ্রুত ওঠানামা করে। মিলা তখন মিথিলাকে কোলের মধ্যে টেনে নেয়।
- তোমার কি হয়েছে আম্মু, মামার জন্য কষ্ট হচ্ছে?
মিলা নির্বিকার। মন খারাপ নতুন কিছু নয়, প্রায়ই তার এমন হয়। অবশ্য আজকের অনুষঙ্গ অন্যরকম।
নির্জন মূহুর্তে অনেকগুলো চোখ তার স্মৃতির পর্দায় উঁকিঝুকি মারে। শর্বনাসা যুদ্ধের চিত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অনুভূত হয় লাশের গন্ধমাখা উৎকট বাতাসও। সারা আকাশজুড়ে যেন শকুনের আনাগোনা! ভুবনডাঙার ঘরে-বাইরে লাল রক্তের স্রোত; কলতলায় পড়ে আছে বাবা মা’র ক্ষত-বিক্ষত লাশ।
মিলা অশংখ্যবার শিহরিত হয়। ভাবতে কষ্ট হয়, তাদের একটি সঙসার ছিল; সুখের সঙসার। ভালোবাসার আকুলতা এখনো তার ব্যাকুলতায় আঘাত করে। জীবনের ঐসব দিনগুলোতে বার বার ফিরে যাই ফিরে আসে। স্মৃতির আঙিনায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শাহেদের মুখ।
শাহেদকে নিয়েই তো ধল প্রহরের আগে দিঘীর জলে শাপলা তুলতে যেত! রাতের পর রাত এক আকাশের নিচে বসে গল্প করতো, জীবনের ছবি আঁকতো।
ভাবলে মনে হয় সেদিনের কথা: অথচ মাথার উপর দিয়ে কত মেঘ উড়ে গেছে!

ভিড় ঠেলে মিলার ভাড়াকরা কামরায় হঠাৎই একজন আগন্তকের অনুপ্রবেশ। মিলা না করতে পারেনা; কেননা লোকটির একটা পা নেই- পঙ্গু। তবু মনের মধ্যে উঁচাটন। যা দিনকাল পড়েছে মানুষকে বিশ্বাস করা কঠিন। লোকটিকে তার অসহ্য লাগে। অজানা আশংকায় মনের মধ্যে আনচান করে। যদি চোর-ডাকাত হয়!
মিলা আঁড়চোখে লোকটিকে নিরীক্ষণ করে। বেশভূষায় চোরের সাখে খুববেশি অমিল নেই। তাকানোর ভঙ্গিমাও দৃষ্টিকটু। দাঁড়ি-গোঁফের আড়ালে চোখদুটো যেন বার বার জ্বলে ওঠে!
আগন্তকই প্রথম কথা বলে, আমাকে দেখে খুব রাগ হচ্ছে তাইনা? আসলে আমি একা না, পঙ্গু মানুষ দেখলে সবারই এমন হয়; আমার নিজেরও।
মিলা মনে মনে খানিকটা হোঁচট খায়। লোকটি কি তার মনের কথা পড়তে পারছে; নাকি নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করছে!
পঙ্গু লোকটি নিজেই মিলাকে আস্বস্থ করে, ভয় নেই ম্যাডাম, কিছুদুর গিয়েই নেমে পড়বো।
লাইটারের আগুনে আগুন্তক সিগারেট ধরায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত খাওয়া হয়না; মিলা বাঁধা দেয়, দেখুন, এটা আমার ভাড়াকরা কামরা; যা খুশি তা করতে পারেননা। দয়া করে অন্য কোথাও বসুন। তাছাড়া সিগারেটের গন্ধ আমার সহ্য হয়না।
কয়েক মূহুর্ত চিন্তা করে লোকটি জানালার বাইরে সিগারেট ছুঁড়ে মারে। তার নিজের ভিতরেও অনুশোচনা। মিলার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে, ছরি ম্যাডাম, বাচ্চাটার সামনে আমার সিগারেট ধরানো ঠিক হযনি।
মিথিলার মুখে একটু একটু করে কথা ফুঁটতে শুরু করে; আম্মুর ইশারা অমান্য করে আগন্তকের গলা জড়িয়ে জানালায় উঁকিঝুঁকি মারে। প্রকৃতির নানাবিধ অনুষঙ্গ তাঁর শিশুমনেও দোলা দেয়। কখনো বা উচ্ছ্বাস তরঙ্গে দু’হাত বাড়ায়। মিষ্টি মধুর কলতানে মৈত্রী এক্সপ্রেস এর ছোট্ট কামরাটি পুনরায় যেন প্রাণ ফিরে পায়, চাচ্চু, তোমার আরেকটি পা কোথায়?
- কোথায় আবার; চরি-টুরি করতে গিয়ে বোধহয় কাটা পড়েছে!
মিলা ঠিক এমন এমন একটি সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিল। এরপর নিশ্চয় লোকটির ভিতরকার জ্বলেওঠা তেজ নিভে যাবে!
অখচ এখানেও লোকটি অন্যরকম; মিলার কথা গায়ে না মেখে মিটমিট করে হাসে- উৎভ্রান্তের হাসি।
এই হাসিটাও মিলার অসহ্য, হাসছেন কেন, হাসতে লজ্জা করেনা?

আম্মুর আচরণে মিথিলার শিশুমন আহত হয়। অসহায় মানুষটার অপমানে সে নিজেও খানিকটা বিচলিত। আম্মুর হয়ে মিথিলা ক্ষমা প্রর্থণা করে, প্লীজ চাচ্চু, তুমি কষ্ট পেওনা। আম্মুর মনটা বোধহয় খারাপ; তাই এমন করছে।
মিথিলার সরল অভিব্যক্তি মিলাকে আহত করে। বুঝতে পারে, ঔদ্ধত্বের সীমা মাড়ানো ঠিক হয়নি। তাছাড়া লোকটি তো তার কোনো ক্ষতি করেনি!
মিলার তপ্ত হৃদয়ে অনুতপ্তের লু হাওয়া বয়ে যায়। সেই কতদিন আগে দেশ ছেড়েছে; বলতে গেলে আজ সে বিদেশ-বিভুঁইয়ে। আগ্রহভরে মিলা জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবেন আপনি?
মিলার প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই; কানে বাঁজে কেবল একটানা শোঁ-শোঁ শব্দ। ট্রেনের জানালা ভেদ করে দৃষ্টির সীমারেখা আকাশের ঠিকানায়; যেখানে দ্বাদশীর চাঁদ ক্রীড়ারত।
মিলার অনুশোচনা ক্রমশ রিদ্ধ হয়। পুনরায় জিজ্ঞেস করে, রাগ করেছেন?
- না না ম্যাডাম, রাগ করবো কেন, আপনি তো মিথ্যে বলেননি; তাছাড়া দয়াকরে বসতে দিয়েছেন। অন্য কেউ হলে পুলিশ ডাকতো, না হয় হাতে দুটো পয়সা ধরিয়ে বিদায় করতো।
আতœতুষ্ঠির মাঝেও একবুক যন্ত্রণা;অন্যদিকে মিথিলার করুণ চাহনী, চাচ্চু, আপনার বুঝি কেউ নেই!
ব্যথায় মিলার দুচোখ জলে ছলচল করে। ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে তার ভাবনাগুলোও হামাগুড়ি দেয়। এই রাতের আঁধারে সে কোথায় উঠবে! ঢাকার পথঘাট খুববেশি চেনা নয়; তাছাড়া যুদ্ধের পর রাতারাতি সব বদলে গেছে। নিরবতার ক্ষণগুলো পার হলে আগন্তক মিলার পানে একদৃষ্টে তাকায়, চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, একটা কথা বলবে?
- কি কথা?
- ভুবনডাঙার কথা তোমার মনে আছে, মিলা?
মিলার এবার অবাক হওয়ার পালা। যে তার নিজের নাম, এমনকি গ্রামের নাম পর্যন্ত জানে, তাকেই কিনা অপমান করেছে!
মিলার সারামুখে লজ্জার আভা, কিন্তু আপনি কে!
খানিকটা সময় নিয়ে আগন্তক জানতে চায়, শাহেদের কথা তোমার মনে পড়ে?
এক অলৌকিক শক্তি মিলার নিজস্ব অনুভূতি কেড়ে নেয়। এক নিমিষেই তার পৃথিবীটা যেন বদলে যায়! মনে পড়ে ২৫ মার্চের কথা; বান্ধবীর বাসার নাম করে মিলা সেদিন সারা শহর ঘুরেছিল, অনাগত স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল। কিন্তু ঐ স্বপ্ন আঁতুড়ঘরেই প্রাণ হারায়।
অথচ সেই শাহেদ তার সামনে বসা; নিজের চোখদুটোকেও তার অবিশ্বাস, কিন্তু শাহেদ...........
শাহেদ পাথর চোখে তাকিয়ে রয়। বুকের মধ্যেএকখণ্ড ব্যথা ক্রমশ কুণ্ডলী পাকায়। দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বলে, আমি মরিনি মিলা।
- তাহলে এমন হলো কেন; কেন সব স্বপ্ন ভেঙে গুড়িয়ে গেল!
মিলার ধরা গলায় অভিমানের রেশ। শাহেদের মনে হয় একটু একটু করে সে যেন ঘোর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। তার চারপাশে কালরাত্রির আবহ;ষ্পষ্ট দেখতে পায়- রাতে কি ঘটতে যাচ্ছে দিনের আলোয় তার বিন্দুমাত্র আভাস ছিলনা। সন্ধ্যার পর পরই পাক বাহিনীর সাজোয়া যানগুলো রাস্তার মোড়ে-মোড়ে অবস্থান নিতে শুরু করে। সবার মধ্যেই বিবমিষা; কি হয়, কি হয়! তখন পর্যন্ত আন্দাজ করতে পারেনি এই রাতটিই বাঙালী জাতীর কালরাত্রির মর্যাদা পাবে; বুঝতে পারেনি ভোটের রাজনীতিতে পরাজিত সৈনিক বুলেটের ভাষায় উত্তর দেবে।
ক্ষ্যাপা কুকুরের মত ওরা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। নাঃ, কোন বাছ-বিচার ছিলনা; নারী, শিশু, বৃদ্ধ কাউকেই শালারা ক্ষমা করেনি। এক একটি সতেজ প্রাণ মূহুর্তেই লুটিয়ে পড়ছিল। শহরময় শুধু লাশ আর লাশ; ঐ রাত্রেই ঢাকা শহরে প্রায় ৫০ হাজার নিরীহ বাঙালী খুন হয়।
মিলা ভয়ার্ত চোখে শাহেদকে জিজ্ঞেস করে, তারপর, তারপর কি করলে!
- আমি গাঁ ঢাকা দিলাম, বেশ কিছুদিন পালিয়ে বেড়ালাম, এরপর এক বৃষ্টিভেজা রাতে ভুবনডাঙায় হাজির হলাম; কিন্তু তোমাকে পেলাম না। কি নিষ্ঠুর তুমি, ফিরে আসার সময়টুকু পর্যন্ত দিলে না!
কিছুক্ষণ থেমে শাহেদ পুনরায় বলতে শুরু করে, তোমাকে হারিয়ে সেদিন কষ্ট পেয়েছিলাম সত্যি তবে ভেঙে পড়িনি। একসময় মনে হলো এই দেশ আমার প্রেম, আমার ভালবাসা। পদে-পদে মৃত্যুর সম্ভাবনা জেনেও যুদ্ধে নাম লেখালাম। একদিকে পাকবাহিনী অন্যদিকে তাদের দোসর রাজাকার; উঃ, সেকি টেনশন! মাঝে-মধ্যে দিশেহারা হয়ে উঠতাম। বৃষ্টিতে ভিজে, খেয়ে না খেয়ে ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলাম; শত্র“মুক্ত হলো জনগন; অর্জন করলাম লাল-সবুজের পতাকা। সেকি আনন্দ মিলা, একটা পা দিয়েছি তবু দুঃখ ছিলনা; কিন্তু আজ আমি ক্লান্ত। দূর্বিসহ জীবনের বোঝা বইতে-বইতে হাঁফিয়ে উঠেছি।
একজন মুক্তিযোদ্ধার সামনে মিলার মাথা নুঁয়ে পড়তে চায়, পায়ের ধূলো মাখতে সাধ জাগে।
- তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে মিলা, স্বামী-সন্তান নিয়ে তো বেশ আছো!
কথা বলতে গিয়ে মিলার ঠোঁটদুটো তির-তির করে কেঁপে ওঠে। শাহেদের মুখের পানে তাকালে বুকের মধ্যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর কোন প্রান্তে যেন হাহাকার ওঠে। চিনতে কষ্ট হয়।
- বাবা-মা কোথায়?
- নেই মিলা; এক এক করে জীবনের সূতো কেটে- আজ আমি সূতাকাটা ঘুড়ি। অহর্ণিশ ঘুরপাক খাচ্ছি।
- কেন, স্ত্রী-পুত্র!
শাহেদ আরেক দফা হাসে।
- হাসছো যে!
শাহেদের কণ্ঠে তাচ্ছিল্লের ব্যঞ্জণা, আমার মতো পঙ্গুর আবার বিয়ে! তাছাড়া সবার ঘর-সংসার থাকতে নেই।
- কিন্তু বাইরের টানই বা কতদিন! এভাবে কি জীবন যাবে?
- হয়তো যাবে হয়তো যাবেনা; তবে অনুশোচনা নেই। মহাজীবনের পথে নিজেকে সঁপে দিয়েছি। ভেবেছিলাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বেঁচে থাকবো, কিন্তু সে আশাও সুদুর পরাহত। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নতুন একটা খেলা শুরু হয়েছে।
শাহেদের আমিত্বের কাছে মিলার নিজেকে অসহায় মনে হয়। দুরন্ত কৈশর, চণ্ডিদের তুলশিতলা, শৈলেন বাবুর পোড়োবাড়ি, অভিসারের নির্ঘুম রাত, মলাটের ভাঁজে-ভাঁজে নীলখাম অসংখ্য সব স্মৃতি আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে; জেগেওঠে বুকের অন্তপুরে লুকিয়ে থাকা গোপন ব্যথাও।
কৈশরের মিলা কখনোই এমন সুস্থির ছিল না; কথার পিঠে কথা লাগিয়ে অস্থির করে তুলতো। অথচ এই মূহুর্তে তার মুখ দিয়ে কথা সরেনা। কিছুতেই বলতে পারবে না, একজন শাহেদের জন্য সে পাগলা গারদের চৌকাঠ ছুঁয়েছিল; অন্ধকার আকাশই তার সঙ্গী হয়েছিল।
জীবনের হিসেব গোলমেলে; এক অঙ্কের সাথে অন্য অঙ্কের কোন মিল নেই। যে শাহেদকে ছাড়া এক মূহুর্ত ভাবতে পারতো না, তাকে ছাড়াই কেটে গেছে জীবনের অনেকগুলো বছর!
পরিবর্তনের উল্টোমুখী স্রোতে শাহেদ নিজেও আজ অনেক দুর পর্যন্ত চলে এসেছে; মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনো ভাবনা আর তাকে আলোড়িত করেনা।
শাহেদ ভাবতো, কোনদিন মিলার সাথে দেখা হলে কৈফিয়েত চাইবে। কিন্তু আজ আর কোনো কৈফিয়েত নেই; সব কৈফিয়েত তার নিজের কাছে। তা না হলে তার জীবনটা কেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে, কেনই বা একটি মানস প্রতিমা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে!
সঙসারের কথা যে শাহেদ ভাবেনি তা না, কিন্তু প্রতিমার অঞ্জলী দিতে দিতেই তো সে ক্লান্ত!
জীবন বড় বিচিত্র। কাছে থেকেও মিলা আজ অনেক দুরে; চোখেমুখে কষ্টের আল্পনা। শাহেদের বুকের গহীণে অভিমান গুমরে মরে। মিলাকে বলতে সাধ জাগে, ভেবনা মিলা; দুঃখের আগুনে পুড়ে-পুড়ে এ জীবন একদিন নিঃশ্বেষ হয়ে যাবে; কোন মা আমার লাশটা ছুঁয়ে দেখবেনা, কোন মেয়ে বলবেনা-বাবা, ও বাবা, আমাকে তুমি কার কাছে রেখে যাচ্ছো! মাটির অভাবে এই দেহখানা হয়তো শেয়াল কুকুরে খাবে।
মিলার মধ্যেও ঠিক বিপরীতমুখী ভাবনা; হাজারো মানুষের ভীড়ে শাহেদ আবারো হারিয়ে যাবে। একমুঠো ভাত কিংবা আশ্রয়ের জন্য নিরন্তর ছুঁটাছুঁটি করবে; মৃত্যুর হীমশীতল কোলে লুটিয়ে পড়বে; অথচ মিলা তা জানতেও পারবেনা।
একটু-একটু করে ভাবনার পরিধি সংকুচিত হতে শুরু করে। টানা হুঁইসেল বাঁজিয়ে শোঁ-শোঁ শব্দ তুলে ছুঁটে চলে রাতের শেষ ট্রেন। পিছনে পড়ে থাকে সিগনাল বাতি, রেল লাইনের স্লিপার, বৈদুতিক খুঁটি, নাম না জানা অসংখ্য সব লোকালয় আর একখণ্ড পাথর।


ছোটগল্প - আব্দুল্লাহ আল দুররানী সনি

আব্দুল্লাহ আল দুররানী সনি
একটুকরো গল্প



স্যার ,

ঘড়িতে সময় রাত ২ টা তিন মিনিট। সোডিয়ামের হলুদ আলো আর রাতের নীরবতা ভেঙ্গে মাঝে মঝে ছুটে চলা কিছু ট্রাক। এটিএম বুথের বৃদ্ধ প্রহরী টুলে বসে ঘুমানোর আয়োজন করছে। রাস্তার মোড়ে সাইকেলে বিক্রি করছে গরম রুটি আর হালুয়া। রিক্সার সিটে পা তুলে দিয়ে ঘুমন্ত কিছু চালক। একজন গনিকার ক্লান্ত পথে ফেরা আর তাকে উদ্দেশ্য করে বাড়ির দড়োয়ানটার রগরানো খিস্তি। একটি ভ্যানে ভ্রাম্যমান চা সিগারেটের দোকান। দুইটি কিশোরি মেয়ে অনবরত হেসে চা বিস্কুট দিচ্ছে কাস্টমারদের। চা খাবার নামে অনেক গুলো লাল চোখ তাদের শরীর অবগাহন করছে। মাঝে মঝে এটা ওটা নেবার ছলে গায়ে স্পর্শ করে পান খাওয়া লাল দাঁত গুলো বের করছে। রাত বাড়ছে তার সাথে সাথে বাড়ছে নীরবতা। রাতের বোধয় আলাদা একটা গন্ধ থাকে।

যাত্রী ছাউনিতে আমি ছাড়া আছে আর তিনটা প্রানী। একরাশ কাপড় পেঁচিয়ে একজন যাযাবর আর দুটা কুকুর। পকেটে ৩য় বর্ষের মার্কসিট। সিগারেট আছে আর দুই তিনেক, তার তুলনায় রাতটা অনেক বড়। বিশ্বাস করেন স্যার আমি কাপুরুষ নই। আমি জীবন থেকে পালাতে চাচ্ছিনা বরং জীবন মুক্ত করতে চাচ্ছি। বাবাটা রিটায়ার্ড করেছে অনেক আগে অপেক্ষায় তার ছেলে সংসারের হাল ধরবে। মার আমার উপর অগাত বিশ্বাস আমি একটা কিছু করব। আমার ভয় করে স্যার, আমার ভয় করে । এতো গুলো চোখের আশা আমি পূরন কতে পারব না , পারব না স্যার। সময় সম্পর্কে একবার বলে ছিলেন নি:শ্বাস গ্রহন আর ত্যাগের মাঝামাঝি সময়কে বতর্মান বলে” আমার সময় আর বুঝা হলনা। মাকড়সা যেমন তার জালে কোন শিকার ধরা পড়লে ধীরে ধীরে তাকে জড়িয়ে ফেলে এবং এক সময় তাকে মেরে ফেলে আমরাও তেমন ডিপার্মেন্ট এর সেশন জটের জালে জড়াচ্ছি। সেশন জটের ঘুন পোকা আমার সময় খেয়ে তার বংশ বৃদ্ধি করছে। আর আমি দাড়িয়ে আছি জারুল গাছটার মত, সবাই আসে যায় , আমার আর যাওয়া হয়ে উঠেনা। ধীরে ধীরে আমার পা মাটির সাথে সখ্যতা করে আমাকেও করেছে গাছ, একটা জারুল গাছ। প্রেমিকাটার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এখন কি করব স্যার? একদিন আপনিই শিখিয়ে ছিলেন সম্পর্কের মানে । তার দায়িত্ব নিতে কি আমি প্রস্তুত ? যাওয়ার আগে বলে ছিল ভাল থেকো, আমি ভাল নেই স্যার। স্যার আমি কি সত্যি কাপুরুষ? হয়ত মনে মনে বলবেন এত তাড়াতাড়ি হার মানলেন , আর কিছুদিন টিকতে পারলেনা। সম্ভব না স্যার , সম্ভব না। আপনি একদিন বলেছিলেন “ জীবন লম্বা হবার দরকার নেই, বড় হওয়ার দরকার ।” বড় হওয়া যেখানে অনিশ্চিত সেখানে আর জীবন র্দীঘায়িত করতে ইচ্ছা করছে না। কোন কিছুই এখন আর অনুকূলে নেই, আজ অর্থ যোগানের শেষ টিউশনিটাও চলে গেছে। মেসের ভাড়া দেবার আজ শেষ তারিখ, গত দুই মাসের ভাড়া বাকি । দুঃশ্চিন্তার ছাড় পোকা আমায় সারা রাত জাগিয়ে রাখে, আমি ঘুমাতে পারি না স্যার। আমার ইচ্ছা গুলো মধ্যবিত্তের অভিমান হয়ে দাড়িয়েছে। স্বপ্ন আর স্বপ্ন ভঙ্গের রনাঙ্গনে আমি পরাজিত। কোন এক দিন বলে ছিলেন “ তরুন বয়সে অধিকার আছে নতুন কিছু নেবার আর পরিণত বয়সে দায়িত্ব আছে দেবার।” আমি বোধয় পারলাম না।

মার হাতের পালং শাকের কথা থুব মনে পরছে। কত দুপুর পার করেছি না খেয়ে, মাকে বানিয়ে বনিয়ে বলেছি খেয়েছি। মা কি ধরতে পারত আমার মিথ্যা কথা ? মা তো সব বুঝে। আপনি একদিন বলে ছিলেন আমরা ওদের মত এতা উন্নত না কারন ওরা ওদের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটাকে অবলিলায় ত্যাগ করতে পারে , আমরা যা পারি না। যেদিন পারব সেই দিন আমরাও উন্নত একটা জাতীতে দাড়াব। তাই আমি

জাফর সাহেব হতবিহব্বল। চিঠিটা এথানেই শেষ , বাকি অংশ জাফর সাহেবের কাছে নেই, বাজার থেকে শুটকি কেনার সময় এ কাগজটা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে ছিল। বাজার আলাদা করার সময় সুন্দর হাতের লেখা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ।তার পর এক মনে পড়তে শুরু করেন। জাফর সাহেব হঠাৎ ছটফট করতে থাকে। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল শুধু একটা বিষয় “ ছেলেটার শেষ পর্যন্ত কি হয়ে ছিল?” ভাবতে ভাবতে তার ঘুমন্ত ছেলে আয়াতের দিকে তাকালো। ছেলেটা ঘুমের মধ্যেও হাসে। তিনি পারবেনতো এই হাসি বাঁচিয়ে রাখতে? একটা দীর্ঘ শ্বাসের শব্দ।

প্রবন্ধ - আরশাদ উল্লাহ

হাইকু লেখার উপর কিছু তথ্য
আরশাদ উল্লাহ



হাইকু কবিতা নিয়ে অনেক লেখক অনেক রকম আলোচনা করেছেন। তাদের অনেকেরই মন্তব্য ছিল যে
হাইকু হল ১৭ টি syllable এর কবিতা যা তিনটি লাইনে লিখা হয়। তাদের ধারনা প্রথম লাইনে ৫ টি,
দ্বৈতীয় লাইনে ৭ টি ও তৃতীয় লাইনে ৫ টি সিলেবল থাকে। এ কথা জেনে অনেকেই হাইকু লিখতে গিয়ে সিলেবল খুঁজাখুঁজি শুরু করেন। কিন্তু Willium J. Higginson তাঁর লেখা বই The HAIKU HANDBOOK টিতে অনেক গবেষণা করে লিখেছেন যে জাপানী হাইকু পাশ্চাত্য দেশে লিখা হাইকু থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ, জাপানী হাইকু তাদের ট্রেডিশন্যাল ধারায় ৫-৭-৫ পদ্ধতিতে লিখে এবং তাদের লিখা হাইকুতে সিলেবল নেই। জাপানী হাইকুতে 'অনজি' থাকে সিলেবল নয়।
উদাহরণ হিসাবে তিনি যেমন দেখিয়েছেন তা নিম্নরূপঃ

English syllable: a on two wrought
Japanese onji: a (আ); n (ণ); ka (কা); shi (শি); tsu (ৎচু), ইত্যাদি।

উপরের ইংলিশ সিলেবল এ, অ্‌ টু, রট উচ্চারণ করতে প্রলম্বিত স্বর-ধ্বনি বুঝা যায়। আবার জাপানী হাইকুতে যে সব বর্ণকে 'অন্‌জি' বলা হয়েছে সেগুলির উচ্চারণ আ, কা, সি, ৎচু, ইত্যাদি। এগুলি কিন্তু জাপানী ৪৮ টি 'হিরাগানা' বর্ণের পাঁচটি বর্ণ। সুতরাং বর্ণ গণনায় ৫-৭-৫ টি বর্ণ মিলে মোট ১৭ টি বর্ণ বা অক্ষর হয়। বাংলা ব্যাঞ্জন বর্ণে অনেক অনজি আছে, যেমন, খ, ঘ, চ, থ, ঝ, ঠ, ইত্যাদি। তাই বাংলাতে হুবহু জাপানী পদ্ধতিতে মোট সতের অক্ষরে হাইকু লিখা সম্ভব।

আমার কথা হল বাংলাতে হাইকু লিখতে হলে জাপানী হাইকুর নিয়মাবলি মেনে লিখাই উত্তম। আমরা যদি ইংলিশ হাইকুর ধারা মতো লিখি তাহলে বড় বিভ্রান্তিতে পড়তে হবে।

ইংলিশ এবং জাপানী হাইকুর এক অনুবাদ অনুষ্ঠান করেছিল নিউ ইয়র্কের Japan Society, Inc. সে অনুষ্ঠানে ইংলিশ হাইকু কবি ও লেখক Willium J. Higginson উপস্থিত ছিলেন। তিনি তাঁর বইটিতে অনুষ্ঠানটির উপর লিখেছেন যে সেখানে ২৮ টি হাইকু কবিতা আবৃত্তি করা হয়েছিল। ইংরেজীতে যিনি অনুবাদ করেছেন তিনিও একজন হাইকু কবি ছিলেন। তিনি অনুবাদ হাইকু পাঠ করার সময়ে খুব কম সিলেবল ব্যবহার করেন। তিনি লিখেছেন, বিস্ময়ের কথা হল ইংরেজীতে অনুবাদ করা হাইকুটি জাপানী হাইকুর তুলনায় পড়তে ৬০% দীর্ঘ সময় নেয়। সময়ের ব্যাপারটি হয়তো আবৃতি যিনি করেছেন তার উপর নির্ভর করেছে। সে যাই হোক, আবৃতি অনুষ্ঠান শেষে হিজ্ঞিন্‌সন জাপানী হাইকু লেখক ও ইংলিশ হাইকু লেখকের সাথে কথা বলে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করাতে উভয়ে উত্তর দিয়েছেন যে তারা নিয়মাবলী অনুসারেই হাইকু পাঠ করেছেন। অথচ আবৃতির সময়ের কথাটি বিবেচনা করলে বেশ ব্যতিক্রম বুঝা গিয়েছে।

বাংলা হাইকুতে কিন্তু ইংলিশ হাইকুর মতো অধিক সময় নিবেনা। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি যে বাংলা ও জাপানী হাইকু আবৃতি করলে একই সময়ে শেষ হয়।
নিম্নে দু'টি জাপানী হাইকু কবিতার ইংলিশ ও বাংলা অনুবাদ করেছি। যেহেতু আমি জাপানী ভাষা জানি সেহেতু জাপানী ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে। ইংলিশে অনুবাদ করেছেন হিজ্ঞিন্‌সন।
এ হাইকুটি লিখেছেন কবি বাশোঃ

furuike ya                    old pond........           জ্বলা পুকুর
kawazu tobikamu        a frog leaps in            বেঙ্গের লাফালাফি,
mizuno oto                  water's sound            জলের শব্দ.........

এ হাইকুটি লিখেছেন কবি ইস্‌সাঃ
utsukushiki                 a really lovely             অতি সুন্দর
tako agarikeri             kite has risen above    ঘুড়ি উপরে উড়ে,
kojiki goya                 a begger's hut             ভিখারি ঘর.........

হাইকু দুটিতে ',' কমা দিয়েছি এ জন্য যে প্রথম বারটি বর্ণ বা অক্ষর বোধগম্য। একটি ঘুড়ি উপড়ে উড়ছে; তারপর 'ভিখারি ঘর' কথাটি লেখা। তাতে বুঝা যাচ্ছে যে উপরের ১২ টি অক্ষরে যে বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে নিচের পাঁচটি অক্ষরে লেখা কথার সামঞ্জস্য নেই মনে হচ্ছে। এটাও এক রহস্য, কারণ হাইকুতে অনেক কিছু উহ্য থাকে যা বুঝে নিতে হয়। পূর্ণাংগ বাক্য না হলেও হাইকু হয়। 'ভিখারি ঘর'

কবির চোখে পড়েছে প্রথমে তারপর লক্ষ করেছেন অতি সুন্দর রঙ্গিন ঘুড়ি তার উপরে উড়ছে। এখন চিন্তা করলে সবার নিকট কবিতাটির ভাব পরীষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু সে ভাব কিন্তু বড় গভীর অর্থ বহন করছে। তা হলো একজন ভিখারির নড়বড়ে ঘরের উপর রঙ্গিন ঘুড়ি দেখে কবি অবাক। তাই সে ভাব হাইকুতে প্রকাশ করেছেন। এখন বাকি রইল 'সময়' কি করে দেখালেন। আমার আগের লেখাতেও উল্লেখ করেছি যে সময় প্রকাশ করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ একটি সীজন উল্লেখের মাধ্যমে। তা না হলে সঠিক হাইকু হবেনা। এ হাইকুতে ঘুড়ি উড়াবার সময়টি বুঝে নিলেই হবে। শীত প্রধান দেশে বসন্ত কালে অর্থাৎ মার্চ মাসে শিশু দিবসে ঘুড়ি উড়ায়। আমার কথা এখানে শেষ হয়নি। তা হলো শেষের লাইনটি যদি ভিখারি(র) ঘর হতো তা হলে আরো পূর্ণাংগ বাক্য হতো। কিন্তু 'র' বাদ দিয়েছি। এই বাদ দেওয়ার প্রথাও জাপানী হাইকুতে রয়েছে। তাকে বলে 'কিরেইজি' অর্থাৎ কাটা বা বাদ দেওয়া শব্দ। 'র' বাদ দিয়ে পাঁচটি অক্ষরে মিলানো হয়েছে, তাতে কিন্তু হাইকুটি অসম্পূর্ণ হয়নি। ট্রেডিশন্যাল জাপানী হাইকুতে দু'টি 'rhythmical unit' বা সমান তাল বা মাত্রা থাকে। উপরে 'কমা' লক্ষ করলে তা বোধগম্য হবে। উপরে বারটি অক্ষরে বা অন্‌জিতে ও নিচে পাঁচটি অক্ষর বা অনজিতে লিখা হয়েছে। আবার উপরে পাঁচটি লিখে নিচে বারটি অক্ষরেও হাইকু লিখার প্রথা আছে।

যারা হাইকুতে আগ্রহি তাদের মনে রাখতে হবে যে ট্রেডিশন্যাল হাইকুর সৃষ্টি হয়েছে অসম্পূর্ণ দীর্ঘ কবিতার স্তবক থেকে। তাই হাইকুতে সমান তাল বা মাত্রাও অসম্পূর্ণ থাকে। হাইকুতে সাধারণ ব্যাকারণ নীতি বর্জন করা হয়। তাতে অসম্পূর্ণ বাক্য থাকে এবং জটিল ক্রিয়াও বর্জন করা হয়।

হাইকুর উপর আরো কিছু কথা স্মরণ রাখা উচিত। তা হল বাংলাতে হাইকু লিখতে ৫-৭-৫ অক্ষরেই লিখতে হবে ও যুক্তাক্ষর একটি গণনা করা হবে। ইংরেজী, জার্মন ও ইটালিয়ান ভাষাতে হাইকু লিখতে হলে 'সিলেবল' এ লিখা হয়। বাংলাতে যথাপোযুক্ত অক্ষর যুক্ত করে মাত্রা বা তালের সাথে মিল রেখে লিখতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে যে হাইকু লিখা কিন্তু সহজ নয়। একটি পারফেক্ট হাইকু লিখতে হলে অনেক ভাবতে হয়। আর সেটি যথার্থ হাইকু হল কিনা তা পড়েই বুঝা যাবে। আমি আবার বলছি বাংলা হাইকু বাংলা ভাষাতে জাপানী হাইকুর অনুকরনে লিখা সম্ভব। নিম্নে নজদিক লিখা আমার
দু'টি হাইকু উদাহরণ হিসাবে দিলাম।

নিষ্প্রাণ ঘোড়া,
শকুনের ছায়ায়
উড়ন্ত মাছি......

গ্রীষ্মের মশা
রক্ত খেকো পতঙ্গ,
নির্ভীক যুদ্ধা......

কবিতা ভাবনা - অঞ্জন আচার্য

অঞ্জন আচার্য
কবিতা লিখি কেন


কেনো লিখি? বিশেষ করে কবিতা? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি প্রায়শই আমাকে হতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রশ্নে নিশ্চুপ থাকি। উত্তর যে নেই তা কিন্তু নয়। আছে। উত্তরটি বরং রবীন্দ্রনাথের ওপর চাপিয়ে দিয়ে খোঁজার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথের তাঁর পঞ্চভূত গ্রন্থের পরিচয় প্রবন্ধের এক জায়গায় বলেছিলেন- “জীবন এক দিকে পথ আঁকিয়া চলিতেছে, তুমি যদি ঠিক তার পাশে কলম হস্তে তাহার অনুরূপ আর একটা রেখা কাটিয়া যাও, তবে ক্রমে এমন অবস্থা আসিবার সম্ভাবনা, যখন বোঝা শক্ত হইয়া দাঁড়ায়- তোমার কলম তোমার জীবনের সমপাতে লাইন কাটিয়া যায়, না তোমার জীবন তোমার কলমের লাইন ধরিয়া চলে। দুটি রেখার মধ্যে কে আসল কে নকল ক্রমে স্থির করা কঠিন হয়। জীবনের গতি স্বভাবতই রহস্যময়, তাহার মধ্যে অনেক আত্মখণ্ডন, অনেক স্বতোবিরোধ, অনেক পূর্বাপরের অসামঞ্জস্য থাকে। কিন্তু লেখনী স্বভাবতই একটা সুনির্দিষ্ট পথ অবলম্বন করিতে চাহে। সে সমস্ত বিরোধের মীমাংসা করিয়া, সমস্ত অসামঞ্জস্য সমান করিয়া, কেবল একটা মোটামুটি রেখা টানিতে পারে। সে একটা ঘটনা দেখিলে তাহার যুক্তিসংগত সিদ্ধান্তে উপস্থিত না হইয়া থাকিতে পারে না। কাজেই তাহার রেখাটা সহজেই তাহার নিজের গড়া সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে, এবং জীবনকেও তাহার সহিত মিলাইয়া আপনার অনুবর্তী করিতে চাহে।” অর্থাৎ নিজের জীবনের রেখার পাশে কলমের রেখা দেওয়ার জন্যই হয়ত লিখি। সত্যিকার অর্থে আমার কিছু বলার আছে যা সবার সাথে ভাগাভাগি করার। ভাবনাগুলো তাই লিপিবদ্ধ করি। বলা যায় ভাবনার বুদ্বুদগুলো মস্তিষ্ক থেকে প্রসব করি মাত্র।

তবে কবিতাই যে কেন লিখি তা আমার কাছে অনেকটা রহস্যময়। হয়ত সহজ কথা সহজভাবে বলতে পারি না বলেই কবিতার রহস্যময়তার আশ্রয় নেই। আসলে আমার ভাবনাগুলোই ছন্দবদ্ধ হয়ে ধরা দেয় মাথার ভেতর। মোটা দাগে বলতে গেলে, আমি কবিতা লিখি না, কে যেন আমাকে দিয়ে লেখায় কবিতা। ভাবনা-বুদ্বুদগুলো খুব সংক্ষিপ্ত; অথচ বিস্তৃত অর্থবহ। যেমন আমার একটি কবিতার লাইন এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। কবিতাটি মাত্র দু লাইনের- “আগুন পোড়ায় না হাত/ হাত পোড়ে আগুনে।” এ দিয়ে কী বোঝা গেল? আসলে আমরাই আগুনের কাছে যাই। পুড়ে অঙ্গার হই। কাব্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন- “...কাব্যের আনুষঙ্গিক ফল যাহাই হউক কাব্যের উদ্দেশ্য উপকার করিতে বসা নহে। যাহা সত্য যাহা সুন্দর তাহাতে উপকার হইবারই কথা, কিন্তু সেই উপকারিতার পরিমাণের উপর তাহার সত্যতা ও সৌন্দর্যের পরিমাণ নির্ভর করে না। সৌন্দর্য আমাদের উপকার করে বলিয়া সুন্দর নহে, সুন্দর বলিয়াই উপকার করে।” আমিও তাই মনে করি।

পৃথিবীর কোনো কিছুই সাধনা ছাড়া হয় বলে আমার মনে হয় না। কবিতা তার বাইরের কিছু নয়। প্রতিনিয়ত সাধনার ফলেই নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে গড়ছি আজো। প্রতিভা-ফতিভা বলে কিছু থাকলে, তা থাকতে পারে। আমি তার ওপর নির্ভর করে বসে নেই। আজ থেকে দশ-বারো বছর আগে লেখা আর আজকের লেখার মধ্যে এই যে আমি বিস্তর ফারাক দেখতে পাই- তা তো সাধনারই ফল। যদি সেসময়ের লেখাকে এখনও কালজয়ী ভেবে বসে থাকতাম, তাহলে কুয়োর ব্যঙ হয়ে বেঁচে থাকতে হতো। নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ জলের উপর জলছাপ-এর অনেক লেখাই এখন আমার কাছে লেখা মনে হয় না। প্রথম সন্তানের প্রতি একটু আলাদা দরদ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই বলে তার কোনো ত্রুটি থাকতে পারবে না- তা ভাবা অন্যায়। আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ আবছায়া আলো-অন্ধকারময় নীল সেই সাক্ষ্যই বহন করে। নিজেকে নিজের থেকে ক্রমাগত অতিক্রম করা মানেই তো জীবনের সার্থকতা। আর লেখালিখি তো জীবনেরই এক অংশ। যারা কলম-শ্রমী তাদের কাছে লেখা এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ জীবনের।

তবে কবিতার পাঠকই কবিদের বাঁচিয়ে রাখে যুগের পর যুগ। তাদের স্মৃতিকোষেই বেঁচে থাকে কবিতার পঙ্‌ক্তি। তারা তো ইতিহাসের নীরব বাহক। আজ যাদের কবিতা আমরা পড়ি কিংবা শুনি, তার অনেকাংশ প্রশংসার দাবিদার ওই পাঠকেরা। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিতার পাঠকরা একটু ভিন্নতর। তারা কবিতার মতোই সংবেদনশীল। সবাই কবিতা পড়েন না। তারাই কবিতা পড়েন যারা সত্যিকার অর্থেই কবিতা ভালোবাসেন। জীবননান্দ যেমন বলেছিলেন- “কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।” কবিতা তো তেমনই। পৃথিবীতে যদি একজনও আমার কবিতার পাঠক থেকে থাকে- আমি তার জন্যই কবিতা লিখে যেতে চাই আমৃত্যু। মৃত্যুর আগে অন্তত এ ভেবে শান্তি পাবো, যে অন্তত একজনের কাছে আমি কবিতার মধ্য দিয়ে পৌঁছাতে পেরেছি।

ধানমণ্ডি, ঢাকা ১২০৯

কবিতা ভাবনা - পলিয়ার ওয়াহিদ

পলিয়ার ওয়াহিদ
কবিতার রূপ ও স্বরূপ


কবিতা একটি অমিমাংশিত শব্দশিল্প। মূলত কবিতার কোনো নিদিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তবে এটাও বলা যাবে না যে, আসলে কবিতার কোনো সংজ্ঞা হয় না। কবিতা খানিকটা আলো-আধারির খেলা বলা যেতে পারে। যারা চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে গিয়েছেন তারা নিশ্চয়ই জানবেন সেখানকার পরিবেশ খানিকটা আধো আধো আলো ছায়ার একটা ব্যাপার থাকে। অবশ্য এ রকম পরিবেশ সবাইকে মুগ্ধ করে। কবিতাও সে রকম সবাইকে মুগ্ধ করে এটা আমরা সবাই স্বীকার করি। ঝাঁঝালো অতি সচেতন শব্দ- কবিতা নয়, তাকে স্লোগান বলাই শ্রেয়। কবিতা শব্দটির নাম শুনলে আমাদের মধ্যে কেমন যেন একটা আবেশ ছড়িয়ে আবেগের ঘরে প্রবেশ করায়। সবাই যেন কোথায় মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যায়। এই যে হারানো, হারিয়ে যাওয়া ক্ষণিকের জন্যে এটাই কবিতার আত্মা। কবিতা এক নান্দনিক শব্দ সমাহার বিশিষ্ট কথামালা। কবিতার ক্ষেত্রে কবিকে প্রথম এসে ভর করে চিন্তা। তারপর কবি ভাবের সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকেন। সচেতন একটি উপলব্দি এসে সুরসুরি দিয়ে কবিকে করে যান অবচেতন। তারপর শব্দের ভেলায় চড়ে বাক্যের রাজ্যে এগিয়ে যান কবি। তৈরি হয় কবিতার শরীর। চিন্তা-চেতনা, স্বপ্ন-কল্পনা, ভাব-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি, উপলব্দি-অভিজ্ঞতা যখন শব্দের সংমিশ্রনে মিলেমিশে বাক্যে রূপ নেয় তখন তা কবিতায় অবয়ব ধারণ করে। কবির মনে এক ধরনের মৃদু দোলা অনভূব হয়। ভালো কবিতা প্রথমে কবিকে দুলিয়ে যায়। কবি কখনো কখনো হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলেন। মানুষের মন থেকে আগত যে কোনো ভাব, মস্তিষ্কে ব্যবহৃত ভাবনা, দক্ষতার সাথে পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার ছন্দোবদ্ধ শিল্পিত প্রকাশই কবিতা বা পদ্য। যদিও কবিতা সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা। কিন্তু আজ অবধি কবিতার সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা আমরা পাই নি। এই যে কোনো সংজ্ঞা পাওয়া যায় নাই এর মানে দাঁড়ায় কবিতা গণিতের মতো কোনো সূত্রতো নয়ই বিজ্ঞানের কোনো বিশেষ ছকেও সীমাবদ্ধ নয়। কবিতা এক অসীম আকাশের ঠিকানা। কবিতা কখনো আবেগ কেন্দ্রিক, কখনো অনুভূতিপ্রবণ মনের বহিঃপ্রকাশ, কখনো সমকালের মুখপাত্র, কখনো শাব্দিক ঝংকার, কখনো বেদনাবিধুর হৃদয়ের কান্না, কখনো শোকাহত হৃদয়ের আর্তনাদ, কখনো সংগ্রামী স্বশস্ত্র সৈনিক, কখনো আবার অধিকার বঞ্চিত শ্রমজীবি মানুষের মুখপাত্র।

প্রশ্ন হতে পারে কবিতা তাহলে কি? সাধারণত আমরা যারা কবিতার সাথে দিনরাত উঠা বসা করি তারা এভাবে বলতে চেষ্টা চালায় তাহলো এমন ‘কবিতা একটা সুন্দরী নারীর মতো।’ তাকে তুমি মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজাও। তার কপালে কালো টিপ নাকি লাল টিপ আঁকলে ভালো লাগবে তা কবিকে নির্বাচন করতে হয়। ললাটে পরাতে পারো সোনার টিকলি। নাকে নথ, গলায় গজমতি হার নাকি হীরার হার কোনটা মানাবে সবই তো কবিকে সিদ্ধন্ত নিতে হবে। সংগীতে বাঁধতে পায়ে নুপুর এবং আলতা পড়াতে পারো নিজের মতো করে। কামনীয় করতে কোমরে পারাতে পারো বিছা। এজন্য কবিকে তো অনেকে নবী কিংবা প্রভূ বলে থাকেন। কারণ তার সৃষ্টির মধ্যে কেউ নাক গলাতে পারে না। যেমন পারে না সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে। এভাবে তাকে সাজাতে হয় আবার লক্ষ্য রাখতে হবে সাজাতে সাজাতে যেন স্বরস্বতীকে কালী না বানিয়ে ফেলি তাহলে ঘটবে বিপত্তি। যে নারীর শরীরে বাড়তি মেদ নেই সেই নারীই কিন্তু হয়ে উঠে মোহনীয় কামনীয় সর্বপরি সৌন্দর্যের আধার। তাই সব দিকে খেয়াল করে কবিতার শরীরকে আঁকতে হবে। যেন বাড়তি মেদে সৌন্দর্যের হানি না ঘটে। আবার অনেকে বলেন, ‘কবিতার জন্য কবিতার সৃষ্টি; আর কারো জন্য নয়।’ এটা কোনো কথা নয়। কবিতার জন্যে আবার কবিতা কিসের? শিল্পের জন্যে শিল্প এ কথাকে তো অনেক আগেই অগ্রজ বাঙলী কবিরা খারিজ করে দিয়েছেন। পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি সবকিছু মানুষের জন্যে। সব শিল্পই জীবনের জন্যে আর মানুষ জীবনের মধ্যে নিহিত। এটা এক ধরনের চতুর বিলাপ। অনেকে অভিযোগ করে বলেন, কবিদের কোনো দ্বায়বোধ নেই তারা সংসার বিরাগী হয়। এসব খোঁড়া যুক্তি। সংসার বিরাগী হয় তো কবি বিশ্বসংসারের সংসারী হওয়ার জন্যে। সমাজের সবচেয়ে কমিটেড ব্যক্তিটি হচ্ছে কবি। কবির চেয়ে আর কেউ কমিটেড হতে পারে না। কবির একটা কমিটমেন্ট থাকতে হবে। দ্বায়বোধ না থাকলে আর যায় হোক অন্তত কবি হওয়া সম্ভব নয়।

কবিতার সংজ্ঞা নিরূপণ নয় কবিতা আসলে কি এবং কেন তা জানার নেশা আমার রক্তের সাথে মিশে গেছে বলেই আমি নিবেদিত হয়েছিলাম বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থের উপর। তাতে অবশ্য অশেষ উপকারই হয়েছে আমার নিজের আর আমার সাহিত্যকর্মী বন্ধুদের। কারণ প্রতেকটা ধর্মই সুন্দর সুন্দর তথ্য দিয়েছে কবিতার। যা আমরা ভাবতে পারি না। এখানে অনেকের গা রি রি করে উঠতে পারে। কবিতার সাথে আবার ধর্মের সম্পর্ক কিসের? আছে আছে সমাজের এমন হোনো বিষয় নেই যে তা নিয়ে কবিতা আলোচনা করে না। কবিতা নিজেই একটা সার্বিক শিল্প এর মধ্যে বিশেষের কোনো স্থান নেই। মানবমুক্তির একমাত্র আসমানী কিতাব আল-কুরাআনে বলা হয়েছেÑ ‘সুসংবদ্ধ সত্যসুন্দর শব্দ সমষ্টিই গজল বা কবিতা।’ আবার গীতা’য় বলা হচ্ছেÑ ‘সুনন্দন তত্ত্বের সমাহার বিশিষ্ট শব্দমালাকে শ্লোক বা কবিতা বলা হয়।’ অন্যদিকে বাইবেল গ্রন্থে বলছেÑ ‘পরস্পর মেলবন্ধন বা সংযুক্ত সৎ ও স্বচ্ছ কথাধ্বনিকে বলা হয় সংগীত বা কবিতা।’ এভাবে আমি আরো তথ্যের জন্যে অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থের স্বরপাণœ হয়েছি। যতটা পারা যায় কবিতা সম্পর্কে আমি জানতে চায় উজার করে। তাই আমার এই সামান্য চেষ্টা। তবে এই চেষ্ট শেষ নয়। অতিসামান্য ভেবে কবিতার এই নানাবিধ সংজ্ঞা আমি দিতে পারি কিন্তু সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। আমি শুধু চেষ্টা করেছি কবিতার বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্ব সম্পর্কে পাঠকের সাথে স্ববিস্তর আলাপ করতে। আর এই জন্যে কবি বন্ধু রাসেল আর আজিম হিয়ার অনুরোধে এই কঠিন কাজে মগ্ন হবার মতো দুঃসাহস দেখাতে চেষ্টা করেছি।

একেক জনের দৃষ্টিতে কবিতার সংজ্ঞা এক-এক রকম স্বাদ পেয়েছে। এখন হাজির করবো বিভিন্ন কবিদের কাছ থেকে পাওয়া কবিতা সম্পর্কিত সংজ্ঞা। পৃথিবীর অনেক কবি আজ পর্যন্ত কবিতার বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। আর তাদের সংজ্ঞায় ও দর্শনে ফুটে উঠেছে কবিতার নান্দনিকতা। ম্যাথ্যু আর্নল্ড-এর কবিতাবিষয়ক বিখ্যাত সেই সংজ্ঞাটির কথা আমরা জানিÑ যে সংজ্ঞায় তিনি কবিতাকে ‘ক্রিটিসিজম অব লাইফ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কেউ কেউ স্বীকার করেন, ‘পয়েট্রি ইজ ইমিটিশন অব লাইফ, মিরর অব লাইফ’। এটাই যে কবিতার সংজ্ঞা প্রকৃত তা কিন্তু নয়। হুমায়ুন আজাদের মতেÑ ‘যা পুরোপুরি বুঝে উঠবো না, বুকে ওষ্ঠে হৃৎপিণ্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাবো না; যা আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও, রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তার নাম কবিতা।' অসাধারণ জটিল কাব্যিক সংজ্ঞা এটি। সিকানদার আবু জাফরের মতেÑ ‘আমার চোখের সামনে যা দেখি তাকে অনুভব করেই যা সৃষ্টি হয় তাই কবিতা।’ বুদ্ধদেব বসুর মতেÑ ‘কবিতা বোঝার বিষয় নয়, এটাকে অনুভব করতে হয়। কারণ কবি সম্ভবত বুঝেসুঝে কবিতা লেখেন না; কেবল মাত্র বিষয়কে সামনে রেখে তাকে অনুভব করেই কবিতার জন্ম হয়। কবিতা সম্বন্ধে 'বোঝা' কথাটাই অপ্রসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনা, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে, ‘বোঝানো যাবে না’। আল মাহমুদ বলছেন ‘পাখীর নীড়ের সাথে নারীর চোখের সাদৃশ্য আনতে যে সাহসের দরকার সেটাই কবিত্ব।’ এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে কবিতা লিখতে যথেষ্ট সাহসের প্রয়োজন। অর্থাৎ, কবি সাহসী।’ সৈয়দ শামসুল হকের মতেÑ ‘কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ।’ শেলীর ভাষায়Ñ ‘কবিতা হলো পরিতৃপ্ত এবং শ্রেষ্ঠ মনের পরিতৃপ্তি এবং শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের বিবরণ।’ রবার্ট ফ্রস্ট বলেন ‘কবিতা হল পারফরমেনস ইন ওয়ার্ডস।’ কবি কোলরিজ এর মতামতÑ ‘গদ্য মানে শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো। আর পদ্য মানে সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো।’ এডগার এলান পোর মতে ‘সৌন্দর্যের ছন্দোময় সৃষ্টি।’ কীট্স বলেনÑ ‘কবিতা মুগ্ধ করবে তার সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায়, একটি মাত্র ঝংকারে নয়। পাঠকের মনে হবে এ যেন তারই সর্বোত্তম চিন্তা যা ক্রমশ ভেসে উঠছে তার স্মৃতিতে।’ কবি এলিয়ট বলতেÑ ‘কবিতা রচনা হলো রক্তকে কালিতে রূপান্তর করার যন্ত্রণা।’ কার্লাইল বলেনÑ ‘কবিতা হলো মিউজিক্যাল থট।’ জগৎ বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল কবিতার সংজ্ঞায় বলেন ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়ো।’ কবি সেন্ট অগাস্টিন বলেনÑ ‘যদি জিজ্ঞাসা করা না হয়, আমি জানি। যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি জানি না।’ বিখ্যাত ফরাসি কবি বোদলেয়ার বলেনÑ ‘প্রত্যেক কবি অনিবার্যভাবেই সমালোচক। একজন সমালোচক কবি হয়ে উঠলে আশ্চর্য হওয়া যতটা স্বাভাবিক তার চেয়ে বেশি আশ্চর্য হতে হবে যদি একজন কবির মধ্যে সমালোচক জেগে না থাকে।’ ইংরেজ কবি জনসন বলেনÑ ‘কবিতা হল মেট্রিক্যাল কম্পোজিশন। আনন্দ এবং সত্যকে মেলাবার শিল্প যেখানে ৎবধংড়হ কে সাহায্য করার জন্যে ডাক পড়ে রসধমরহধঃরড়হ এর।’ কবি মিল বলেনÑ ‘চিন্তা এবং বাক্য, যার মধ্যে আবেগ পেয়ে যায় নিজের শরীর।’ মেকল বলেন ‘ কবিতা বললে আমরা বুঝি সেই শিল্প যা শব্দকে ব্যবহার করে এমন ভাবে যা কল্পনার রাজ্যে জাগিয়ে দেয় এক স্বপ্ন।' ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেনÑ ‘কবিতা সমস্ত জ্ঞানের শ্বাস-প্রশ্বাস আর সুক্ষ আতœা।’ এসব সংজ্ঞা থেকে প্রতিমান হয় যে কবিতা এক ‘আবেগের ঘোর’। যাকে উপলব্দি করতে হয়, বুঝা যায় কিন্তু বোঝানো যায় না। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল¬াহ কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে নিজেই সংশয়ে পড়েছেন। ‘সত্যি অর্থপূর্ণ কবিতার সংজ্ঞা দেওয়া খুবই কঠিন।’

কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে আমার সবচেয়ে ভালোলাগে যে কয়েকটি লাইন তাহলো কবি শঙ্খ ঘোষের ‘বোধ’ কবিতাটি পাঠকের বোধের জন্য দ্বায়বোধ মনে করেই উপস্থাপন করছিÑ
‘‘যে লেখে সে কিছুই বোঝে না
যে বোঝে সে কিছুই লেখে না
দুজনের দেখা হয় মাঝে মাঝে ছাদের কিনারে
ঝাঁপ দেবে কি না ভাবে অর্থহীনতার পরপারে!’’
আমার মনে হয় না যে আর কোনো কবিকে হাতে করে শেখাতে হবে না যে কবিতা এ রকম ও রকম। এরপরও যদি কাউকে বলে দিতে হয় কবিতা এ রকম তা হলে তাকে দিয়ে কবিতা হবে না অন্য কিছু ভাবতে বলায় মঙ্গল।



পলিয়ার ওয়াহিদ
সাব এডিটর, দৈনিক যায়যায়দিন

কবিতা ভাবনা - কুহক মাহমুদ

কবি ও কবিতা
কুহক মাহমুদ


যান্ত্রিকতার ছায়া আজ এতটাই বড় যে কোনটা নিজের ছায়া আর কোনটা আধুনিকতার তাতে ভ্রম হয়। মাঝখান থেকে ঐতিহ্যের রূপ-রস আহরণ করে সুস্থ-সংস্কৃতির বিকাশ কিভাবে সম্ভব তা প্রশ্নের সম্মুখিত করে বৈকি, যেখানে নিজেকে দেবার মতো সময় বের করা আর গোধূলির প্রস্থানে পূর্ণিমা নামানোর মতই দূরহ। তবু আশার কথা এই যে, জীবন চর্চার আরাধনা আর ফসল ফলানো সংস্কৃতির বুনিয়াদ গড়ে উঠছে আয়ি রাণী পিপিলিকার শশব্যস্ততায়। ঐতিহ্যের নানান উপকরণ সংস্কৃতির রন্দ্রে রন্দ্রে সঞ্চারমান কিন্তু সব উপকরণ বিরাজমান নয়। তাই মনে করি কবির কাজ অতীতের দিকে ফিরে তাকানো। সে সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। ইতিহাস থেকে সব উপকরণ সংগ্রহ করে সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করাটাও যে কাজ, আজকের সব উত্তর আধুনিক কবিরা তা ভুলতে বসেছেন। এহেন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখবো কি করে বুঝতে পারি না। এটা আমাদের মানতেই হবে যে চিন্তাধারার পরিবর্তন এলে আমাদের চারপাশের পার্থিব বস্তুর রূপ-রস-গন্ধ ভিন্ন মাত্রা পায়। যা হয়তো পূর্বে বাস্তব ছিলো বা ধ্রুব সত্য ছিলো তার মাঝে কতটুকু মিথ্যা আছে তা প্রস্ফুটিত হয় চর্চার মাধ্যমেই। পশ্চিম থেকে ধার করা উত্তর আধুনিকতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে তীব্র আলোর ঝলসানিতে দেখা যায় আমাদেরই দগ্ধমুখ আর আয়নার সামনে দাঁড়ালে এই মুখশ্রীই আমাদের বিমোহিত করছে। পশ্চিম আমাদের যতটা না শিখিয়েছে সাহিত্যকলা তার চাইতে বেশী শিখিয়েছে প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়কে বারুদগন্ধ সহ্য করবার ক্ষমতা। এটা অস্বীকার করবার জো নেই যে, হাজার বছরের ইংরেজী সাহিত্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ তাই হয়তো অনেক কবিকেই ইংরেজী সাহিত্যের প্রভাবদোষে আক্রান্ত বলে দোষারপ করা থেমে যাবে না। এখানে হয়তো বলা যেতে পারে আমাদের চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় কবিতার মাঝে গীতিময়তা শ্রুতিময়তার স্বাদে-গন্ধে প্রাণ উছলানো গতিময়তার ঝরণা কল্লোল থেমে গিয়েছিলো? তারপর কি আর আর কখনোই ফিরে পায়নি তার বাঙালিরূপ? এ প্রশ্ন অমীমাংসিত বা বাংলা কবিতার আত্মপরিচয়ের যে রূপ প্রকাশ করা হয়েছে তাতে মোটেও তুষ্টি নেই। অনেক বিদগ্ধ দার্শনিক চিন্তাবিদ এখনও এনলাইটমেন্টের ব্যাখ্যা করে চলেছেন এবং তাতে নিয়েজিত আছেন। মিশেল ফুকোর রূপ উদ্ঘাটনের জন্যে অষ্টাদশ শতকে প্রকাশিত ইম্যানুয়েল ক্যান্টের একটা লেখনির উপর ভর করে চমৎকার মন্তব্য করেছেন; আধুনিকতা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের সীমানা সংকীর্ণ, বিশ্লেষণ অস্পষ্ট আর তাই আধুনিকতা না বুঝে এনলাইটমেন্টের প্রয়োগ করাটাও ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হবে। আমাদের বর্তমান সময়ের এই উত্তর আধুনিক কাব্যচর্চাটা হওয়া উচিৎ রেঁনেসা বা রিফর্মেশনের মতোই ইতিহাস খ্যাত। একজন কবি মাত্রই শিল্পী; আর শিল্পের জন্ম অনুভব থেকে। এই অনুভব থেকেই ভাবাবেগের জন্ম যা প্রকাশিত হলে শিল্পরসিকদের আনন্দ প্রদান করে। এ বিষয়টি প্রয়োজন না মিটিয়েই আনন্দ দেয় তাই তা সুন্দর; হতে পারে তা জাগ্রত স্বপ্ন তবে এটাই ইচ্ছা পূরণের উপায়। হতে পারে তা কল্পনার বিষয়, তবে তা প্রকাশ ক্ষমতাকে নিখুঁতভাবেই গড়ে তোলে। শিল্পের আছে স্থিতি আর জীবনের আছে গতিময়তা। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের যোগ বিয়োগ, অভিজ্ঞতার সাথে চিন্তার সমন্বয়, হৃদয়ের সঙ্গে বুদ্ধির প্রয়োগ, বিশ্লেষণের সাথে আত্মার বিমলানন্দ, বিচারের সাথে সহানুভূতির অবস্থান, রূপের মাঝে বিষাদ, জলের মাঝে রঙ এমনি সব ইন্দ্রিয়ানুভূতি পরিবেশনার নানান আকারে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়ে যখন একটা সংগতি বা সামঞ্জস্যপূর্ণ সৌন্দর্যকে খুঁজে নিয়ে আনন্দ দেওয়া সম্ভব হয় তাতেই শিল্পের দক্ষতা বা তাঁর ফসল জন্মদানকারীগণ এক একটা প্রতিভা। বেনেদেত্তোর ক্রোচের ভাষায় বলা চলে- ‘প্রতিভা- শব্দটি শুধুই শিল্পস্রষ্টার।’ তাই শিল্পীকে তার নিজস্ব চর্চাকৃত বিষয় সম্পর্কে সম্মক ধারনা পোষন করতে হবে, বিশেষভাবে জানতে হবে, গভীরভাবে অনুভব করতে হবে নয়তো তা হবে কারিগরের সৃস্টি বাজারে বিক্রয়যোগ্য পণ্য। কোনক্রমেই শিল্প হবে না। শিল্পী একাধারে দ্রষ্টা ও স্রষ্টা উন্নততর সৃজনীক্ষমতা ও মূল্যবোধের প্রতীক। কবি কথার বর্ণচ্ছটায় ষ্পর্শ ঘামে রঞ্জিত হওয়া তারুণ্যের সকাল-দুপুর-রাত স্বপ্ন আর ইচ্ছের সাম্পানমাঝি দরিয়ার বুকে তরতর করে বইয়ে দিবে বাক্যের স্রোতে। স্বপ্নকে সত্যি করবার উদ্দাম প্রচেষ্টায় অনুপ্রাণিত করা কবিতার সান্নিধ্য দ্যুতি ছড়াবে সমাজে সংসারে। মনন আর মেধার মিশ্রনে জীবনের আভা ছড়াবে স্বতঃস্ফূর্ততার কবিতা। আবেগ তাড়িত সম্পন্ন মানুষের প্রতিকৃতিতে থাকবে বিশুদ্ধ মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবার নান্দনিকতায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য যার মাঝে থাকবে দায়বদ্ধতা মিটিয়ে দেবার নৈকট্য। জীবন ও সামাজিক নিগূঢ় বন্ধনের অন্বেষায় মগ্ন কবি অস্তিত্বের পথ ধরে ইতিহাসের প্রজ্ঞা লগ্নিকারী হবেন, বিষন্ন বস্তুবিশ্বের একাত্মতায় যোগি না হয়ে জ্বালিয়ে দিবেন তন্দ্রালীন জোনাকির মশাল আর তার প্রতীক আশ্রিত শব্দমালায় সূর্য হবে নতজানু পদ্মের দোসর। আর খোঁজার আগ্রহ যাদের আছে, যারা বোঝেন ভাব-বাচ্যের আবেদন শব্দের নৈপুণ্যে সমৃদ্ধ হয়, নিজকে অন্যকে পুনরায় ভাবনার সুযোগ করে দেয় যে এইতো আমাদের নিত্য দিনের সংস্কৃতি তেমনি প্রাত্যহিক সমস্ত গ্লানি সরিয়ে দেবার কৌশল শিখে নেবার প্রত্যয় যেখানে আত্মবিশ্বাস বাড়ায় সেখান থেকে কবিতার জন্ম। আর সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি- তাই কাব্য ভাষা সকলের জন্যেও নয়। কবিতার সামনে দাঁড়ালে তার কাব্য ভাষার রূপময়তায় যা সুন্দর বা বাহ্ বলে উঠবার মতো চোখের অঞ্জন হয় তারাই আপন খেয়ালে শুদ্ধ কাব্য ভাষায় আমাদের সামনে দাড়িয়ে বলতে পারেন, আমি কবি বা কবিতা লিখতে পারি। সব মিলিয়ে আপন খেয়ালে নতুন কাব্য ভাষায় কবি অবলীলায় বন্দি করতে পারেন পাঠককে। পাঠক তাঁকে ঘিরে গড়তে পারেন যে কোনো বৃত্ত, যেখানে থাকে মুক্তির মতো আস্বাদ। এছাড়াও কবির মাঝে কবিতার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় সারল্য, সহজ জীবন বোধের দিন, উপমা ব্যাঞ্জনার সুখ প্রহ্লাদ। অনেক সময় দেহজ কামজ যন্ত্রনার বাইরেও যে অতিন্দ্রিয় কোন অনুভব থাকে, সেখানে কবি মাত্রই শব্দের আবেশে দিতে পারেন শুশ্রুষা, কবিকে তাই মুন্সিয়ানার ঘটকও বলা যেতে পারে, আমি আমরা যেথা হতে নিতেই পারি আত্মার বিমলানন্দ। কবি- নীলকণ্ঠী কৃষ্ণ অবতার। নৈঃশব্দ্যের মাঝ থেকে আহরণ করা শব্দের আকর খোঁজা চাষী। মাছরাঙার মতো জল অক্ষরের ভূগোল স্পর্শ করা দরাজ স্বর, হাওড় সংগীতে সময়কে স্তব্ধ করে দেবার অপার্থিব যাদুকর বা অর্ফিয়ুসের অমোঘ নিয়তি বা নার্সিসাসের আত্মমগ্নতার আত্মহুতি যেখানে দস্তায়েভস্কি প্রশ্ন ঝুলে থাকে টেলিগ্রাফের তারে- কবিরা মহিমান্বিত বেদনার সন্তান পূর্বাপর, আজন্ম ও অদ্যাবধি। তাই এই শৈল্পিক নৈতিকতার বিশুদ্ধতা রক্ষা করা অবশ্যকরণীয় কবির কর্ম, তাইতো কবিতা হৃদয়কে সৎ করে দেয়। আর কবিতা লেখার সময় কবি হয়ে ওঠেন বিশুদ্ধ, সৎ এক ধ্যানী সন্ত।


প্রতিবেদন - আবদুর রহমান রানা

বাংলাদেশের খাদ্য সংকট নিরসনে কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা
ম. আবদুর রহমান রানা


১৪৭৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট একটি দেশ, বাংলাদেশ। দেশটিতে ১২ কোটি ৯২ লক্ষ লোকের বাস যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে ৮৭৫.৫ জন (বিবিএস, ২০০১)। এ ক্ষুদ্র আয়তনের দেশটির অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ জুড়ে রয়েছে জলাশয়, পাহাড় ও বনভূমি এবং যা একটি দেশের পারিবেশিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যকীয় হিসাবে কাজ করে, যদিও তা বাংলাদেশের পেক্ষাপটে অতি নগণ্য একটি অংশ মাত্র। বিবিএস ২০০১ হতে প্রাপ্ত তথ্যানূযায়ী দেশটির ৮.০৮ মিলিয়ন হেক্টর (মাথাপিছু ৬২৫ বর্গমিটার) নেট কৃষি জমি। ২০০১ এর আদম শুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪১% ধরে প্রতি বছর ১ কোটিরও বেশী জনসমাগম হচ্ছে বলা যায়। এবং এ হিসাবে দেশটির বর্তমান মোট জনসংখ্যা কমপক্ষে ২০ কোটিরও বেশী। এ হিসাবে দেশটিতে বর্তমানে মাথাপিছূ কৃষি জমির পরিমাণ ৪০০ বর্গমিটারেরও কম। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, নিপোর্ট এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৭০ সালে এদেশের জনসংখ্যা ২২ কোটিতে দাঁড়াবে (দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৬, ২০০৯) যা নিতান- প্রলাপ ব্যতীত আর কিছুই নয়। তদুপরি বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন ও সমূদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল এবং জোয়ার-ভাটা প্রবণ নদীসমূহের ঁঢ়ংঃৎবধস পর্যন- পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে পানি ও মাটিতে লবণাক্তার প্রকোপ ধীরে ধীরে বেড়ে যাওয়ায় এসব এলাকায় কৃষি উৎপাদন মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। যার প্রমাণ স্বরুপ বলা যায়, ২০০৯ এর বোরো মৌসুমে চট্টগ্রামের আনোয়ারা, পটিয়া, বাঁশখালী উপজেলার কয়েক হাজার হেক্টর জমির বোরো উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যাহত হয়। এছাড়াও ফি বছর বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগে উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার হেক্টর জমির কৃষি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। এছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে কক্সবাজার, চকরিয়া, মহেশখালী, সাতক্ষীরা, খূলনা ও বাগেরহাটে উপকূলীয় বনাঞ্চল ও কৃষিজমি ধ্বংস করে লবণাক্ত পানিতে (যদিও কোথাও কোথাও মিঠা পানির চিংড়ি চাষ এবং সমন্বিত চিংড়ি ও ধান চাষ হচ্ছে) চিংড়ি চাষের মহড়া চলছে। এতে একদিকে যেমন মারাত্মক ভাবে বিপর্যস- হচ্ছে দেশের উপকূলীয় পরিবেশ অন্যদিকে চাপ বাড়ছে দেশের শস্য নির্ভর কৃষি উৎপাদনের উপর, সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সংঘর্ষ। এতে হয়ত দেশের মুষ্টিমেয় কতিপয় ব্যক্তির হাতে কাঁচা বৈদেশিক মূদ্রার সমাগম হচ্ছে কিন' আর্থিক দৈন্যতা ও খাদ্য সংকটে পতিত হচ্ছে দেশের লাখ লাখ উপকূলীয় সাধারণ প্রানি-ক চাষী। এখানে প্রশ্ন জাগতে পারে প্রচুর অর্থ থাকলে খাদ্য ক্রয় করে খাদ্য সংকট নিরসন করা সম্ভব নয় কি? স্পষ্ট উত্তর হতে পারে ”না”। যার প্রমাণ হিসাবে বিগত তত্বাবধায়ক সরকারের সময় কালকে উল্লেখ করা যেতে পারে। ছোট্ট আরো একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হতে পারে। বিগত বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময়ে এক নিকট আত্মীয়কে নিয়ে দুপুর ১.৩০ ঘটিকার সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে শুরু করে কোন একটি খাবারের দোখান, ক্যান্টিন কিংবা ঝুপড়িতে দুপুরের ভাত পাওয়া যায়নি। যদিও ভাতের প্লেট ৫০০.০০ (পাঁচশত) টাকা হরেও কিনে খাওযার মত অর্থের সংস'ান সে মুহূর্তে ছিল। সুতরাং খাদ্য সরবরাহ পর্যাপ্ত না হলে কোন ক্রমেই তা দূর্মূল্য দিয়েও পাওয়া সম্ভব নয়। যার আরো একটি হতে পারে বাংলারে ১৩৫০ সালের দূর্ভিক্ষ। দেশের বিস-ীর্ণ দ্বীপ জনপদ যেমন হাতিয়া, সন্দীপ, কুতুবদিয়া এবং বেশীর ভাগ নদীসমূহের তীরবর্তী অঞ্চল ভাঙ্গনের কবলে পড়ে প্রতি বছর হারাচ্ছে ৮৮ হাজার একর (৩৫২০০ হেক্টর) কৃষি ও বসতি জমি (বিবিএস, ২০০১)। এতে একদিকে দেশ হারাচ্ছে বিশাল কৃষি ভূমি অন্যদিকে উদ্বাস' হচ্ছে দেশের লাখ লাখ মানুষ। এ সকল উদ্বাস-ু মানুষজন ভিড় জমাচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো নগরীসমূহে এবং সৃষ্টি করছে আর্থ-সামাজিক ও পারিবেশিক নানাবিধ সমস্যা। বাংলাদেশ নদীমাতৃক একটি দেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রক্ষ্মপুত্রের মতো বড় নদী ছাড়াও নারায়ণগিরি, করমাই, সত্তা, জুরী, পিয়ানগাং প্রভৃতি ছোট নদীসহ দেশটির উপর দিয়ে ৭৫০ টিরও অধিক নদ-নদী জালের মত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। যদিও বর্তমানে নদী খেকোদের কবলে পড়ে এবং প্রাকৃতিক কারণে প্রবাহ হারিয়ে অনেকগুলো নদী মৃত এবং মৃতপ্রায় যার অন্যতম বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ইছামতি, ছোট যমুনা, করতোয়া, সাগরদাড়ি, গুমতি ইত্যাদি। এ নদীসমূহের পায়ই প্রত্যেকটি কোন না কোন ভাবে হিমালয় হতে উৎপন্ন হয়ে ভারতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে সুবিশাল অববাহিকা তৈরী করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এ সকল নদীসমূহ বর্ষাকালে বিশাল জলরাশি বয়ে এনে বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন মাত্রার বন্যা ঘটিয়ে থাকে। তাই প্রতি বছর কমপক্ষে বাংলাদেমের ২৫ ভাগ জায়গা বন্যা দ্বারা প্লাবিত হয়ে থাকে। এবং কখনো কখনো তা দেশের ৬০-৭০ ভাগেরও বেশী এলাকা প্লাবিত করে থাকে যেমন ১৯৮৮, ১৯৯৮ এর দীর্ঘ মেয়াদী বন্যা। যদিও পূর্বে দেশে দীর্ঘ সময় পর পর একটি ধ্বংসাত্মক বন্যার আবির্ভাব হতো ইদানিং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রায় প্রতি বছরই দেশটি দীর্ঘ মেয়াদী ধ্বংসাত্মক বন্যা দ্বারা প্লাবিত হচ্ছে। এতে করে প্রতি বছরই দেশটির বিশাল আয়তনের শস্য ভূমি বন্যায় আক্রান- হচ্ছে এবং দেশের খাদ্য সংকটকে আরো ঘনীভূত হরছে। অন্যদিকে দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাসমূহ যেমন রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী ইত্যাদি মারাত্মক কৃষি খরার সম্মুখীন যদিও ইদানিং কালে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ভূ-গর্ভস' পানি সেচের মাধ্যমে একধরনের তথাকথিত সবুজ বিপ্লব চলছে। কিন' যথেচ্ছ হারে ভূ-গর্ভস' পানি উত্তোলনের ফলে অদূর ভবিষ্যতে পরিবেশ বিপর্যয় মারাত্মক আকার ধারণ করবে। এখানে নীলফামারী জেলার ডুমুরিয়া ও ডিমলা উপজেলার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ দুটি জেলায় কৃষি খরার প্রভাবে কৃষি উৎপাদন বর্তমানে প্রায় শূন্যের কোটায়। উপরোল্লিখিত কারণসমূহ প্রাকৃাতক যদিও কোন না কোন ভাবে মানব কর্মকাণ্ড এগুলোকে ত্বরান্বিত করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে এবং বাংলাদেশের কৃষি তথা কৃষি ব্যবস'া ধ্বংস এবং খাদ্য সংকট তৈরীতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এ সকল প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও নানাবিধ মানব সৃষ্ট কারণ রয়েছে যেগুলো কৃষি জমি ধ্বংস এবং খাদ্য সংকট সৃষ্টিতে বিশাল ভূমিকা রাখছে। এর অন্যতম অপরিকল্পিত উপায়ে অবকাঠামো উন্নয়ন। বাংলাদেমের গ্রামীণ জনপদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায় বিভিন্ন কারণে অকারণে একটি মাত্র পরিবারের বাসস'ানের জন্য বিশাল বিশাল আবাদী জমি ধ্বংস করে বাড়ি-ঘর তৈরী করা হয়েছে যেখানে অনায়াসে ৮-১০ টি পরিবারের বাসস'ান গড়া সম্ভব। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে আবাদী জমির উপর দিয়ে দীর্ঘ রাস-া তৈরী করে বিলের মাঝে একটি ছোট্ট বাড়ি তৈরী করা হয়েছে যা বিশেষ ভাবে নোয়াখালী অঞ্চলে পরিলক্ষিত হয় সবচেয়ে বেশী। এছাড়াও কোন চৌরাস-ার মোড়ে কিংবা কালভার্ট এবং বিশেষ কোন স'াপনা যেমন মাজার, মসজিদ, মন্দির, কেয়াং ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাজার ব্যবস'া। যদিও এ সকল হাট-বাজারের অদূরবর্তী স'ানে রয়েছে বিশাল বিশাল হাট-বাজার। যেমন নোয়াখালী জেলার নদী ভাঙ্গন প্রবণ দ্বীপ জনপদ হাতিয়া উপজেলার ১৫০৮.২৩ বর্গ কিলেমিটার (রানা, ২০০৭) এলাকার মধ্যে রয়েছে ২৭১ বড় ও মাঝারি আকারের হাট-বাজার (যদিও বর্তমানে এর বিশাল এলাকা নদী গর্ভে বিলীন)। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট হাট-বাজার ও দোখানপাট বিভিন্ন স'ানে স'ানে। এখানে গড়ে ১০৬৬ জনেরও কম জনসংখ্যার জন্য (মোট জনসংখ্যা ২৯৫৫০১ জন) রয়েছে একটি বড় ও মাঝারি আকারের হাট-বাজার। এ সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশী যার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তাই ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায় অনেক হাট-বাজারে দিনের বেলায় তো জনসমাগম হয়ই না, সাপ্তাহিক হাটের দিনেও জনসমাগম খুবই কম চোখে পড়ে যার অন্যতম চেয়ারম্যান বাজার, সুখচর বাজার, দাশের হাট, খবির মিয়ার হাট, খাশের হাট ইত্যাদি। গ্রামাঞ্চলে ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, কয়েক শতাংশ এবং কোথাও কোথাও বিঘা পরিমাণ জমির উপর এগুলোর অবস'ান এবং প্রায় ক্ষেত্রে কৃষি জমির উপর গড়ে তোলা হয়েছে এ সকল প্রতিষ্ঠানসমূহ। সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধর্মীয় উপাসনালয় গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের পথে পথে। ২০০৪ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় হাতিয়ার নলচিরা ইউনিয়নে (বর্তমানে নদী ভাঙ্গার কারণে ইউনিয়নটির অর্ধেকও অবশিষ্ট নেই) ৭৯ টি মসজিদ ও ৭ টি মন্দির রয়েছে। এ সকল উপাসনালয়গুলো একদিকে যেমন গড়ে উঠেছে কৃষিজমির উপর অন্যদিকে বৃক্ষ আচ্ছাদিত হওয়ায় এর চৌহদ্দির সীমানায় বেশ পরিমাণ জমি বার মাসই থেকে যায় অনাবাদি। এছাড়াও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাবে অপ্রয়োজনীয় রাস-া, খাল ইত্যাদি। কোথাও কোথাও একই রাস-া পূর্বের রাস-াটিরই পাশ্ববর্তী কোন আবাদি জমির উপর দিয়ে তৈরী করা হচ্ছে ক্ষমতা ও বিত্তের প্রভাব প্রমাণের খাতিরে। তেমনই একটি রাস-া চকরিয়া পৌরসভা হতে মহেশখালী (বদরখালী) যাওয়ার রাস-াটি। ইলিশিয়া নামক স'ানে ক্ষমতার দাপট প্রমাণের জন্য এবং অন্যের আবাদি জমি ধ্বংস করার জন্য প্রায় বিঘা খানেক জমি নষ্ট করে পূর্বের অবস'ান হতে সরিয়ে বাঁকা করে তৈরী করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে আরেক উপদ্রব হিসাবে দেশে আবির্ভূত হয়েছে ইউক্যালিপ্টাস বন-বাগান। এ বৃক্ষটি একদিকে যথেষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে অন্যদিকে ধ্বংস করছে কৃষি জমি। গ্রামাঞ্চলে নিরক্ষর/স্বল্প শিক্ষিত মানুষগুলো সরকারের ভ্রান- নীতিতে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় গ্রামীণ কৃষি সম্পদ ও কৃষি জমিকে ধ্বংস করে এ বন-বাগান করে যাচ্ছে দেদারসে। এ প্রসঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা বগুড়া প্রণিধানযোগ্য। বগুড়ার কাহালু, সদর, সোনাতলা, শাহজাহানপুর উপজেলা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সকল উপজেলায় বিশাল বিশাল ইউক্যালিপ্টাস বন-বাগান পরিলক্ষিত। এ বৃক্ষটির পত্রে একরকম পত্ররন্ধ্র না থাকায় গাছটিতে প্রস্বেদনের হার প্রায় অনুপসি'ত বললে অত্যুক্তি হবেনা। তাই এ বৃক্ষ দ্বারা আচ্ছাদিত এলাকার চারিদিকে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের উপসি'তি খুবই কম থাকে। যার ফলে বায়ু অত্যধিক উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে এ গাছ মাটির ভূ-গর্ভস' স'ান থেকে পানি শোষণ করে বলে মাটি শুষ্ক হয়ে পড়ে এবং এর চারিদিকে অন্যান্য ছোট লতা-গুল্ম ইত্যাদি এর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মরে যেতে বাধ্য হয়। তাই যেখানে এ ধরনের বন-বাগান রয়েছে সেখানে অন্য গাছের অনুপসি'তি বেশ চোখে পড়ার মতো। বগুড়া সদর উপজেলার পল্লীমঙ্গল ইউনিয়নের শাকেরকোল গ্রামের অধিবাসীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে জানা যায় এখানে আগে যেখানে ১৫-২০ ফুট গভীর হতে টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যেতো বর্তমানে সেখানে পানি স-র নীচে নেমে যাওয়ার কারণে ৭০-৮০ ফুট গভীর হতেও পানি পাওয়া যায় না। আমার বিশ্বাস এ সমস্যা অদূর ভবিষ্যতে আরো প্রকট আকার ধারণ করবে এবং এতে করে এসব অঞ্চলের কৃষি ব্যবস'া আরো গভীর সংকটে পতিত হবে। এছাড়াও জমির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খন্ডে বিভক্তি কৃষি জমি হ্রাসের আরো একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে জমি বিভক্তির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে সমান তালে। যাতে করে জমি বিভক্তির সীমানা নির্ধারণে গড়ে তোলা জমির আইল বিশাল আয়তনের কৃষি জমিকে গ্রাস করে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। তদুপরি আরো একটি বিষয় পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, যে সকল জমি কৃষি উৎপাদনের দিক থেকে গুণগত মান সম্পন্ন সে সকল জমিগুলোর উপরেই অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলে সবচেয়ে বেশী। এতে করে দেশ হারাচ্ছে দু-ফসলি ও তিন-ফসলি ভালো মান সম্পন্ন কৃষি জমি যা বাংলাদেশের স্বল্প ভূমি সম্পদের জন্য বিশাল একটি হুমকি।