মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ছোটগল্প - সাইফুল্লাহ সাইফ

ঘরের ছেলে ঘরে ফেরা
সাইফুল্লাহ সাইফ


ওর নামের মূল শব্দটি মাছুদ কিংবা মাছুম জাতীয় কিছু একটা ছিল । তারপর বিবর্তনের বহু পথ পাড়ি দিয়ে নামের বিকৃতিতে যা সাধারণত হয়- ওর নামটি প্রথমে রূপ নিলো মাছু, তারও দিন কয়েক পর মাছু শব্দের সাথে মানুষের মুখে মুখে কোথা থেকে যেন হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিতভাবে উড়ে এসে যুক্ত হল আ-কারান্ত ‘অন্তঃস্ত’ । অর্থাৎ নামটি দাঁড়িয়ে গেলো- মাছুয়া এবং সর্বশেষ বিধ্বস্ত রূপ মাউচ্ছা ।

মাউচ্ছা শব্দটি গল্পের ক্ষেত্রে একটু বেশি বেমানান দেখায় বলে গল্পকারকে মাছু নামটিই ব্যবহার করতে হল । তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মাউচ্ছা ব্যবহার করা যেতে পারে ।

অনেক স্বপ্ন নিয়ে দূরদেশের একটি অজপাড়াগাঁ থেকে বিদেশ-বিভূঁইয়ে এসে উপস্থিত হল মাছু ওরফে মাউচ্ছা । ওদের গ্রামের চেয়ারম্যান আব্দুর সাত্তারের মতো তারও একটি মোটরসাইকেল থাকা চাই- সকাল বিকেল মোটরসাইকেলে তার সোনাবউটিকে পেছনে বসিয়ে হাওয়া খেতে কিংবা বিলাস সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া । বউটি তার সুঢৌল স্তনযুগল মাছুর পিঠের সাথে এঁটে দিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে মোটরসাইকেলে বসে থাকবে । বাতাসে সিনেমার নায়িকাদের মতো ওর খোলা চুলগুলো এসে মাছুর নাকে মুখে লাগবে । মালতীর (বউয়ের নাম) সারা গাঁ থেকে সে মাদকতাময় পাগল করা একটি শীতল গন্ধ শুষে নেবে । মালতীর শরীরের গন্ধটি মাছুকে গাঁজার ধোঁয়ার মতো নেশা ধরিয়ে দেয় । কিন্তু সবসময় এই গন্ধ পায় না মাছু- সারাদিন অমানুবিক খাটুনিতে ঘামের গন্ধ ও ধুলো-ময়লা মিলে মালতীর শরীরের স্বাভাবিক গন্ধটিকে আটশে দুর্গন্ধময় করে তোলে । যেদিন মালতী একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে সেদিনই কেবল মাছু মালতীর শরীরের পাগল করা গন্ধটি পায় ।

মালতীকে দামী দামী পোশাকআশাক কিনে দেবে, দামী সুগন্ধি কিনে দেবে ।

একটি পাকা বাড়ি থাকবে ওদের, বাড়ির সামনে থাকবে একটি বড় পুকুর । পুকুরে থাকবে শানবাঁধানো ঘাট । ওরা দুজন ফকফকা মাখনের মতো জোছনা রাতে পুকুরঘাটে এসে আদর-আহ্লাদ করবে, সুখ-দুঃখের কথা বলবে । আর আমিনপুর বাজারে মাছুর থাকতে হবে একটি ঢেউটিনের আড়ত । আজকাল ঢেউটিনের খুব কদর । লোকজন এতো টাকা যে পায় কই! গ্রামের শনের ঘরগুলো সব টিনের ঘর হয়ে যাচ্ছে । ঢেউটিনের ব্যবসায় একবার নামতে পারলে টাকায় টাকায় জিন্দেগী পার!

সাত্তার চেয়ারম্যানের মতো গ্রামের সবাই তাকে সমীহ করে চলবে । তার কথার একটি বড় রকম শক্তি থাকবে । ইত্যাদি..ইত্যাদি ।

নিজের জীবনটাকে পাল্টাতে মাছু তার জিগ্রি দোস্ত খোকনকে অনেক বলে কয়ে নানা শর্ত সাপেক্ষে এসে উপস্থিত হল আবুধাবিতে ।

ওর বাবার কিছু জমি-জমা বিক্রি করে, ওর বউকে চাপ দিয়ে শ্বশুরের কাছ থেকে কিছু টাকা আদায় করে খোকনের অর্ধেক পাওনা মিটিয়ে বাকি অর্ধেক বিদেশ গিয়ে কাজ করে শোধ দেবে- এই শর্তে মাছু তার স্বপ্নের পথে এক পা রাখে ।

ওর সোনাবউটা সহজে বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনতে রাজি হয়নি বলে তাকে কায়দা করতে হয়েছে- কয়েক দফা পিটিয়ে মাছু তাকে সোজা করেছে । বউকে পিটাতে ওর সত্যি খুব খারাপ লেগেছিলো । বহুদিন ধরে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিয়েছিল, বিকল্প উপায় ভেবেছিল । নানা জল্পনা-কল্পনা করে এর স্বাভাবিক কোন সুরহা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত এই নির্দয় কাজটিই করতে হল তাকে । বউ দীর্ঘদিন তার সাথে অভিমান করে কথা বলেনি । মাছু বউয়ের মন গলাতে কতো চেষ্টা-চরিত্র করেছিলো তখন! অবশ্য ওর মনে তেমন কোন দীর্ঘস্থায়ী অপরাধবোধও ছিল না, কারণ ও নিশ্চিত ছিল যে- ওদের একদিন খুব সুখের একটি সংসার হবে- কোনো না পাওয়ার হাহাকার থাকবে না, কোনো অতৃপ্তি থাকবে না । বউকে মারার যাতনাটা তখন পুষে যাবে । বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে ওর হাতে টাকা আসার পর ও ওর বউটার কাছে বারবার ক্ষমা চেয়েছিলো । যৌতুক নিতে মাছু নরাজ, এতো অমানুবিক সে নয়- সে ঠিকই শ্বশুরের টাকা শোধ করে দেবে বলে মনে মনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধও হয়েছিলো ।

ওর বাবাও সহজে টাকা দিতে চাননি । কারণ ওর অপরাধের জরিমানা এবং ধারদেনা শোধ করতে গিয়ে তাকে ইতোমধ্যে বেশ কিছু জমি-জিরাত খোয়াতে হয়েছে । তাই নিজের বাবার উপরও বিশেষ অ্যাকশন নিয়ে মোটামুটি অর্ধেক টাকা মাছুকে যোগার করতে হল । অবশ্য ও মনে মনে ভেবেছিলো, বিদেশ গিয়ে বাবাকে এর দ্বিগুণ জমি কিনে দেবে ।

ভিসা চলে এলো, মাছু টুপ করে প্লেন চেপে বসল- চলে এলো আবুধাবি, তার স্বপ্ন পূরণের শহর ।

এবার মাছুর বিদেশ গমনের আগের কিছু ঘটনার অবতারণা করা যেতে পারে ।

মাছু শৈশবে তার দুরন্তপনার জন্য কিছু উপাধি লাভ করেছিলো । প্রচণ্ড দুষ্ট ছিল বলে ওর জীবনের প্রথম উপাধিটা ছিল উল্লুক, উল্লুকের মতো একমুহূর্তের জন্য স্থির নয় । স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি খেত বলে নাম ছিল খাদক এবং বেশি খাবার ফলে পেটটা যথেষ্ট বড় ছিল বলে পেটুক ।

কৈশোরে শুরু হল পাড়াপড়শিদের দিনরাত এক করে দেয়ার মহড়া । ওর সাথে জুটেছিল আর কিছু সাঙ্গপাঙ্গ- খোকন, হামিদ, কালাম, আবুল এই চার জন । আজ আজিমুল্লার গাছের পেয়ারা, কাল হাকিম মিয়াঁর গাছের নারিকেল, পরশু কুদ্দুস ব্যাপারীর গাছের আম, পরদিন নুরুল্লার গাছের কাঁঠাল, সুরেশের গাছের বড়ুই ইত্যাদি । হাস-মুরগি চুরি করে বিশেষ আয়োজন করে খোয়াতি খাওয়া, আবার শীতের দিনে খেজুরের রস চুরি করে সিন্নি রাঁধা ।

ওদের জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হয়ে এসবের ভুক্তভোগীরা বারবার বিচার বসাত । সত্তার চেয়ারম্যান আমিন চৌকিদারকে দিয়ে একেকজনকে পিটিয়ে বস্তা বানিয়ে ফেলতো- জরিমানা তো সাথে ছিলোই । আমিন চৌকিদার গ্রামে বেশ নামকরা চৌকিদার । বলশালী লোক, ডাকাতি চেহারা । চোর পেটাতে তার বিশেষ খ্যাতি । টানা একশো বেত্রাঘাত করেও যেন হোস-ফোঁস নেই ওর মধ্যে । বেদম মার খেয়ে খেয়ে চারজোয়ান বারবার প্রতিজ্ঞা করতো জীবনে আর দ্বিতীয়বার এই কাজ করবে না বলে । কিন্তু ওদের এই প্রতিজ্ঞা থাকতো যতদিন পিঠে আমিন চৌকিদারের বেতের বারির ব্যথা থাকতো ঠিক ততদিন ।

এবার মাছুর যৌবন এলো । আরো কিছু নতুন উপাধি যুক্ত হলো- ষণ্ডা, গুণ্ডা । শুরু হল এই চারসঙ্গীর নতুন ধান্দা । এবাড়ি ওবাড়ি উঁকিঝুঁকি, মেয়েদের দেখলেই অশালীন মন্তব্য, সীৎকার, এমন কি আড়ালে আবডালে শিকারের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা আর সুযোগ মতো শিকারের দেখা পেলেই খেঁকশিয়ালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া । এর জন্যও বহুবার বিচার বসলো, আগের চেয়ে কঠিন শাস্তি হল ।

একসময় ওদের পরিচয় হয় গাঁজার জাহাজের সাথে । গ্রামে কাউল্লা চোরাকে বলা হয় গাঁজার জাহাজ । ওর মাধ্যমেই এ অঞ্চলে গাঁজার আদানপ্রদান হয় বলে ওকে সবাই গাঁজার জাহাজ বলে ডাকে । অনেক উপরতলার লোকজনের সাথে ওর উঠাবসা । ওর কাজ ছিল শহর থেকে গাঁজা নিয়ে এসে গ্রামে গ্রামে সাপ্লাই দেয়া । নতুন নতুন কাস্টমার তৈরি করা । একটি ছোট পান-বিড়ির দোকান ছিল ওর । সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে এই দোকান । গাঁজার জাহাজ বিড়ি-সিগারেট বিক্রির সময় সতর্ক চোখে তাকাতো নতুন নতুন বিড়ি-সিগারেট টানা কাস্টমারদের দিকে । ওদের হাবভাব, চোখমুখে জড়তা দেখে বুঝে নিত- কাকে কাকে গাঁজার সাগরে ভাসানো যাবে, কাকে কোন সূত্র এপ্লাই করতে হবে, বশে আনতে কতদিন সময় লাগবে । আর গভীর রাতে ওর বশে আনা সঙ্গীদের নিয়ে নেমে যেতো চুরিধর্ম পালন করার কাজে । গাঁজার জাহাজের সানিধ্য পেয়ে মাছুর জীবনে এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল । মাছু গাঁজা খেয়ে আর তাস খেলে খেলে দিনগুজরান করতে থাকে । গাঁজা এবং তাসের টাকা যোগাতে কাউল্লা চোরার সাথে মিলিত হয়ে চুরি আর ডাকাতি ।

মাছুর বাবা অনেক ভেবে চিন্তে এবার একটি সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে দিলেন তাঁর কুলাঙ্গার ছেলেটিকে । ওর বউটাও ছিল গ্রামের অন্য মেয়েদের চেয়ে আলাদা । বউয়ের মধ্যে কি এমন জাদুটানা শক্তি পেলো বোঝা দায় যে- বউকে পেয়ে মাছুর নারী আসক্তি একদম চলে যায় । যাবেইনা বা কেন? ওর বউয়ের মতো রূপে গুনে আর দ্বিতীয় কেউ কি চোখে পড়েছিল ওর? এমন বউয়ের চোখের দিকে তাকালে যেন বুকে কাঁপন ধরে যায় । চোখে ঘোর লেগে যায়, মনে আগুন ।

বউকে প্রচণ্ড রকম ভালবাসতে শিখে গেলো মাছু । বউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শিখে গেলো । বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন ততদিনে মাছুকে বেধে ফেলে স্বপ্নের জালে । বড়লোক হওয়ার উপায় খুঁজতে থাকে সে । চুরি-ডাকাতি করে যে মাছু জীবনে বড়লোক হতে পারবে না এ সত্যটিও তখন তার কাছে স্পষ্টভাবে উন্মোচিত হয় ।

ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু খোকনকে ততদিনে তার বড়ভাই আবুধাবিতে নিয়ে যায় । খোকন আবুধাবিতে যাওয়ার একবছর পর দেশে ফিরে এলে মাছুর চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় খোকনের বড়োলোকি হাবভাব । পাঁচগ্রাম ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে করলো খোকন । সেকি বিয়ে!- যেনতেন কোন বিয়ে নয় । তখন মাছুর মনে পড়ে তার নিজের বিয়ের কথা । খুব দুঃখবোধ হয় মালতীর জন্য । জীবনে কিছু দিতে পারেনি মেয়েটিকে সে ।

সেই থেকে মাছুর মনে মনে ঘোর লেগে যায় আবুধাবি..আবুধাবি ।

মাছু আবুধাবি যাবার কিছু দিন আগে থেকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে গেলো । প্রত্যেক ঘরে ঘরে গিয়ে সবার পা ধরে ক্ষমা চাইল । মা-বাবা এবং শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে ক্ষমা চাইল । ঠিক বিদেশ যাবার তিনদিন আগে ওর বউটা ফুটফুটে চাঁদের মতো একটি পুত্র জন্ম দিয়ে বসলো । এই ছেলে ছেড়ে দূরে কোথাও থাকা যায়? ছেলেকে পেয়ে ওর স্বপ্নটা ডানা গজিয়ে আকাশে-বাতাসে উড়তে লাগলো । সারাদিন ছেলেকে বুকে জরিয়ে বসে থাকতো মাছু- আসলে বসে থাকতো না, সে তখন উড়তো ।

মাছুর আবুধাবি জীবন শুরু হল । টানা খাটুনি- সেই তুলনায় পাওনা যৎসামান্য । বাড়িতে টাকা পাঠানো, নিজের খাওয়া-পরার খরচ, খোকনের বাকি টাকা পরিশোধ করার চিন্তায় মাছু চোখে সর্ষেফুল দেখতে লাগলো । অবশ্য বড়লোক হওয়ার চিন্তা তখনও মাথা থেকে গেলো না ওর ।

মাছু ওভারটাইম কাজ নিলো । বড়লোক হতে গেলে ওভারটাইম কাজ ছাড়া উপাই ছিল না মাছুর । চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দুই-তিন ঘণ্টার জন্য কাজ থেকে মুক্তি পেত । তখন কবুতরের খোপের মতো আলোবাতাসবিহীন একটি ছোট্ট ঘরে এসে দু’দণ্ড ঠাই নিত । এতো পরিশ্রমের পর ঘরে ফিরেও ঘুম হতো না মাছুর । ওর ফুটফুটে চাঁদের মতো ছেলেটার কথা মনে পড়ত । ভাবতো- রায়হান(ছেলের নাম) এতদিনে বসতে শিখে গেছে, এতদিনে হামাগুড়ি দিতে শিখে গেছে, হয়তো এতদিনে ছেলেটা মুখে ফেনা তুলতে তুলতে বলতে শুরু করেছে, ‘বা..আ...আ..., বু...উ....উ.. ।’

মাছুর মনে পড়ে তার সোনাবউ মালতীর কথা । ওর নাকে এসে লাগে মালতীর শরীরের গন্ধ । মাছু পাগল হয়ে যায়! ইচ্ছে করে সব ছেঁড়ে-ছুড়ে একছুটে গিয়ে পড়ে মালতীর বুকের উপর । তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বউ গো আমি বড়আলা হইতাম চাই না, হুদা তোমার পাশে থাকতাম চাই । আমগো পোলাডারে কোলে নিয়া একটু আদর করতাম চাই ।’

আবুধাবিতে এসে ওর মতো অনেকেই বউয়ের কথা মনে পড়লে ছুটে যায়- এখানকার পতিতালয়গুলোতে । একবার নেশা ধরে গেলে জলের মতো মেয়েদের পেছনে টাকা ঢালতে থাকে এরা । মাছুরও যে সেখানে যেতে ইচ্ছে হয়নি তা নয় । ও গিয়েছিলোও বেশ কয়েকবার । কিন্তু বউয়ের কথা, ওর ছেলেটার কথা মনে পড়লে সব মিয়য়ে যায় । কোথায় উধাও হয়ে যায় যৌন উত্তেজনা! তাছাড়া টাকার মায়াও মাছুকে আপত্তি তোলে ।

বাড়ি থেকে খবর আসে ওর ছেলেটা অসুস্থ- নিউমোনিয়া হয়েছে । ছেলের চিকিৎসার জন্য যেন মাছু বাড়তি কিছু টাকা পাঠায় । মাছু দিশেহারা হয়ে যায় । ছেলের জন্য টাকা পাঠায় । নিজে খেয়ে না খেয়ে থাকে । সে মাসে খোকনকে কিছু দিতে পারেনি মাছু । খোকনও ক্ষেপে যায় ।

একদিন খোকন এসে মাছুকে হিসেব দিলো মাছুর কাছে সে আর কতো টাকা পাওনা ।

খোকনের টাকার অঙ্কটা শুনে মাছু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘খোকইননা তুই তো আমাততেন আর পাবি চল্লিশ হাজার ট্যাকা! হালার পুত তুই এতো চাস ক্যান?’

খোকন উত্তর দেয়, ‘খানকির পোলা ট্যাকায় ট্যাকা পদাই করে- তুই জানোস না?’

‘তাই বইল্ল্যা চল্লিশ হাজার ট্যাকা ছয়-সাত মাসে আরো চল্লিশ হাজার ট্যাকা পদাই করবো? তুই যা কইবি আমি তা-ই মাইন্যা লোমু?’

‘তোর তো মানোন ছাড়া উপায় নাই রে মাউচ্ছা । আমার ইস্টামে সব কতা লেহা আছে যে! তুই ইস্টামের কতা ভুইইল্যা গেলি? দস্তখত করছস না ইস্টামে?’ খোকন কথাটি বলেই দাঁত বের করে খিক খিক করে হেসে উঠে । ওর পান খাওয়া ময়লাযুক্ত দাঁতের কালচে মাড়ি পর্যন্ত দেখা যায় । ওর এই হাসি দেখে দাঁতেদাঁত চেপে ধরে মাছু । চোখ দুটি আগুনলাল হয়ে উঠে ।

এককথায় দুই কথায় ওদের তুমুল ঝগড়া বেঁধে যায় । হাতাহাতি....মারামারি ।

পাশের ঘরে থাকে খোকনের বড় ভাই জোটন । ওদের চিল্লাচিল্লির শব্দে তার কাঁচা ঘুমটা তামাতামা হয়ে যায় । ব্যাপারটা কী! ব্যাপার দেখতে এসে ওর চোখ জ্বলে উঠে ।

‘মাউচ্ছা! আরে তুই হালার পুতের এতো সাওস আমার ভাইর গলা চাইপপা ধোওল্লি?’

জোটন দৌড়ে এসে বসিয়ে দিলো আধমন ওজনের এক ঘুসি মাছুর বুকের উপর ঠিক হৃৎপিণ্ড বরাবর । মাছু এক ঘুষিতে কাইত!

দুই ভাই মিলে মাছুকে চেপে ধরে মেঝেতে । প্রথমে একজন উঠে বসে মাছুর বুকের উপর । আরেকজন উঠে গিয়ে ওর ময়লা চিটচিটে বালিশটি নিয়ে মাছুর মুখে চেপে ধরে । মাছু কোঁকাতে থাকে ।

মাছুর আত্মাটা ওর শরীর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে শেষ মুহূর্তে নিজেকে নিজে বলে গেলো, ‘হায়রে মাউচ্ছা! কী করলি তুই? তোর না একখান দুধের পোলা, একখান অবলা সোনাবউ?’