বুধবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ২য় বর্ষ ১৩ম সংখ্যা

সম্পাদকীয়


বিশেষ গদ্য সংখ্যা

বিশ্বের এই বৃহত্তম গণতন্ত্রের দশা মোট ছেষট্টি বছরে যা হয়েছে, তা আশা করি স্বাধীনতার সময় কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি। আজ, এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে একটি অসহযোগ আন্দোলন অথবা একটি ভারত ছাড়ো আন্দোলন হয়তো তখনকার থেকে ছেষট্টি গুণ কঠিন হয়ে পড়েছে। একই সাথে এদেশের অর্থনীতি ঔপনিবেশিকতার গ্রাসে ছেষট্টি গুণ বেশী বন্দী। নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম ছেষট্টি গুণ বেড়ে গিয়েছে। বিশ্বমুদ্রা ইউ. এস. ডলার ভারতীয় টাকার ছেষট্টি গুণ হয়ে যাবে অচিরেই। মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে গল্পমালা তো আঙুলেই রইল জপবন্দী হয়ে ! এ এমন এক অদ্ভূত দেশ, যেখানে দড়মার বেড়া আর খড় থেকে শুরু করে প্লাস্টিক পেন্ট পর্যন্ত সবই বাড়িঘর বানানোর কাজে লাগে। যত লোক ছাতের তলায় শোয়, তার প্রায় সমান বা আরো বেশী লোক আকাশের তলায় ! লিখতে লিখতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল, একবার কালিপূজোর মেলায় বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের কাছে চোখে পড়ল, একটি ইঁটের উনুনে চাপানো কড়াই। বাবা আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন, ‘দেখো বাবু, কি অভাগা দেশ ! একদিকে ফাস্ট ফুড কর্ণার, লোকে মহার্ঘ্য সব খাবার কিনে খাচ্ছে। আর তারই পাশে মহিলা আলুসেদ্ধ বিক্রি করে অন্নসংস্থান করতে বসেছেন।’ আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি, সেদিন মহিলা কি সেদ্ধ করছিলেন। আলু সেদ্ধ কি কেউ রাস্তায় পয়সা দিয়ে কেনে নাকি ? জানি, এই প্রশ্ন আদৌ নীরিহ নয় ! অর্থনীতি কান টেনে বলবে, ওই মহিলার মূলধন দিয়ে চাউমিন কর্নার বানানো যায়না, আলুসেদ্ধ-ই যায় ! কিন্তু, ছেষট্টি বছর পরেও এই যে তথাকথিত বৈষম্য চাক্ষুষ করছে এক কিশোর, তার শৈশবটিই তো এসব দৃশ্য দ্বারা সিজন্‌ড হয়ে গেল ! বড় হয়ে এই সহ্যক্ষমতা আমি পাচার করে দিচ্ছি আমার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে, এভাবেই চেন রিয়্যাকশনে সর্বংসহা হচ্ছে দেশ !

ক্ষেপচুরিয়াস গ্রুপ সারা বিশ্বের কবিতাপ্রিয় বাঙালীর খেলাঘর। তবু, ছেষট্টি আগে স্বাধীন হওয়া এই ভূখণ্ডে বসে যখন ক্ষেপচুরিয়ান্‌ ভারতের স্বাধীনতাদিবস সংখ্যার সম্পাদকীয় লিখছি, তখন শিহরন বইছেই মনে মনে। এহ বাহ্য, দুহাজার তেরো সনের ক্ষেপু ব্লগ অন্যান্য কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সাধের ক্ষেপচুরিয়াস আজ মুদ্রিতরূপে সেজে উঠেছে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটি ক্ষেপুর কাছে এ এক বিরাট খবর ! অনেক পরিশ্রম, অনেক মানঅভিমানে চয়িত এই গ্রুপের সর্বাঙ্গ যদিও, অনেকাংশে ধন্যবাদ রাখে, সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে – প্রতিটি ক্ষেপু কাছেই। এই স্বাধীনতা দিবসেই ক্ষেপচুরিয়াস প্রিন্টম্যাগ প্রকাশ হচ্ছে, আশা করা যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি সবার কাছে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে।

স্বাধীনতাদিবসে বিশেষ গদ্য সংখ্যা রাখা হল। বাছাই করে নয়, পুরোপুরি আমন্ত্রণের ভিত্তিতে ছোট গল্প, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এই সংখ্যার জন্য। প্রতিটি লেখার নির্যাস, বলাই বাহুল্য, পনেরোই আগস্ট ! একই সাথে, এই সংখ্যা থেকে শুরু হল একটি নতুন বিভাগ, “হৃত বিস্মৃত হৃদবিধৃত”। বরনীয় বাংলা কবিদের কবিতায় স্মরণ করব আমরা, প্রতি সংখ্যায়, এই বিভাগে।

অলমতি বিস্তারেন, লেখারা নিজেদের কথা নিজেরাই বলবে। একটি প্রায়-অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে শেষ করি।

মফঃস্বল তো মফঃস্বলই থেকে যায় ! আজ নৈহাটী শহরে “এস্থেটিক” নামে একটি নতুন নাট্যদল আত্মপ্রকাশ করল। প্রথম উপস্থাপনা তাদের নিজস্ব একটি একাঙ্ক – ‘সাজানো নয়’। ‘সাজানো ঘটনা’ শব্দবন্ধটি ইদানিং বাংলার খবরবুভূক্ষু জনতা খুব খেয়েছে। খুব মোটা দাগের একটি পথনাটক, থার্ড থিয়েটারের দর্শক-অভিনেতা সংযোগের আদর্শ কারিকুরিসহ প্রসেনিয়ামে মঞ্চস্থ হল এবং অবধারিত হাততালি পেল প্রচুর। সমস্যা সেখানে নয় ! কথা হচ্ছে, এত ব্যাপকভাবে গণসংস্কৃতির স্রোত ধাবিত হতে বাধ্য হয় ধর্ষনের বিরোধীতা করতে, নারীনির্যাতন রুখতে। অশীতিপর কবিসাহিত্যিককে রাস্তায় নামতে হয় নারীর অসম্মানের প্রতিবাদ করতে ! এবং সেজন্যে তার নিন্দা করেও রীতিমত দৈনীকের সম্পাদকীয়, উত্তর-সম্পাদকীয় লেখা হয় ! এসব কথা যখন স্থির হয়ে ভাবতে বসি, প্রতিবাদ নয়, ঘৃণা নয়, একদলা লজ্জ্বা উঠে এসে বাকরুদ্ধ করে ! তখন মনে হয় – এ সমাজের আর কি অবশিষ্ট আছে, যে এখানে বসে এখনো সাহিত্যচর্চা ফলপ্রসূ হবে ?

ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষে অত্রি ভট্টাচার্য্য

উত্তর সম্পাদকীয় - অরিন্দম চন্দ্র

পরাধীনতাটা আজ আর দেশী নয়,আন্তর্জাতিক
অরিন্দম চন্দ্র



সেই কবে কবি লিখেছিলেন, “স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে...”। সত্যিই তো ১৯৪৭ থেকে প্রতি বছর এই দিনে আমরা এমন কত গান গাই,কবিতা আওড়াই, শপথ নিই। কিন্তু যাঁদের ঘাম-রক্তে পাওয়া এই স্বাধীনতা তাঁদের উত্তরাধিকার কিভাবে পাচ্ছি আমরা, কতটুকু স্বাধীন সত্যি সত্যি এ দেশের মানুষ?

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী যে দেশের ৭৭% মানুষ আজও দৈনিক ২০ টাকার বেশী খরচ করতে পারে না সেই দেশের একজন সাধারণ নাগরিকের কাছে “স্বাধীনতা” শব্দটির ব্যঞ্জনা ঠিক কতটা হতে পারে সেটার প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণ আমি-আপনি দিতে পারি না; কারণ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আমরা প্রায় সব্বাই এদের ভোট দিই, তাতে আম-আদমি বা ম্যাঙ্গো-পিপলের ঐ ২০ টাকা-ওয়ালারাও আছে, আছি আপনি-আমিও। তাই দেশের এক রাজপুরুষের মুখে শোনা “দারিদ্র্য একটি মানসিক অবস্থা” জাতীয় নির্মমতাও আমরা সহজেই হজম করতে পারি বা এখনও এই দেশে দৈনিক ৫ টাকায় ভরপেট খেতে পাওয়ারবর্বরোচিত রসিকতাকে অম্লানবদনে সহ্য করে যাই। আর ভরপুর উদ্যমে দীঘা-শংকরপুর-মন্দারমণির হোটেলগুলি স্বাক্ষ্য দেয় আমাদের স্বাধীনতার। স্বাক্ষ্য দেয় শপিং-মলগুলির বাৎসরিক আজাদি মোচ্ছব।

কি ভাবছেন, বিপ্লবের বুলি ? বা প্রগতিশীল তকমায় অন্ধের হস্তীদর্শন ? গণতন্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম পীঠস্থানের খুব কাছে মানেসর, মারুতির কারখানা। যে কোম্পানীর বার্ষিক আয় বৃদ্ধির হার ৪০% সেইখানে শ্রমিক-কর্মচারীরা ১৫% মাইনা বৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলন করে আজ তাঁদের প্রায় ১৫০ জন জেলে পচছেন। দেশের ১২ কোটি মানুষ গত ২০-২১ শে ফেব্রুয়ারী ধর্মঘটে নেমেছিলেন, স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রীও যার দাবীগুলির মান্যতা দিতে একরকম বাধ্য হয়েছেন, সে দেশের কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই ধর্মঘটের সরাসরি বিরোধিতা করেন নি, ব্যতিক্রম আমাদের পশ্চিমবাংলা। এ’গুলি কোন বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। আমি আপনি কোন ভাবে এই স্বাধীন দেশের রাজন্যবর্গের অপছন্দের কাজ করলে, সেটা যতই গণতান্ত্রিক পথে হোক না কেন, “চোপ” শব্দটা আসছে, কোথাও সরাসরি, কোথাও বা আইনী পথেই।

আর এই স্বাধীনতা হরণের সচল প্রয়াসটা শুধুমাত্র এই দেশের সীমারেখার মধ্যেই আবদ্ধ, এটা ভাবা সম্পূর্ণ ভুল। এই সমকালে সবচেয়ে বেশী সাংবাদিক জেলে পচছে তুরস্কতে। অথচ বর্তমান শাসক রেসেপ এর্দোয়ানই ২০০২ সালে গনতন্ত্রের অন্যতম জাজ্ঞিক হিসাবে উঠে এসেছিলেন। কাছাকাছি মিশরের চিত্রমালা আরও করুণ। অতি সম্প্রতি দু’জনের নাম উঠে এসেছে, এডওয়ার্ড স্নোডেন ও জুলিয়ান আসাঞ্জ। দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার নাগরিকদের অধিকার হরণের প্রয়াসের বিরুদ্ধে মুখ খুলে আজ একজন লণ্ডনের ইকুয়েডরস্থ দূতাবাসে স্থান পেয়েছেন, আরেক জন রাশিয়ার এয়ারপোর্টএ। এই পোড়া দেশের সরকারও আরো কঠিন-কঠোর আইন আনতে চলেছেন। সে আপনি পথে নামুন বা সাইবার-স্পেসকে ব্যবহার করে জনমতকে সংগঠিত করুন। আমার আপনার মোবাইলের I.M.E.I NUMBER, SIM CARD বা কম্পিউটরের I.P ADDRESS আজ রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে উন্মুক্ত। এ এক ভয়ঙ্কর ব্যবস্থা ! অরওয়েলের “বিগ ব্রাদার” আজ প্রতি মুহুর্তে নজরদারীতে ব্যস্ত, আর আমি-আপনি স্বাধীনতার নরম পানীয়তে উল্লাসের চুমুক মারছি টিভি খুলে।

পরাধীনতাটা তাই আজ আর দেশী নয়,আন্তর্জাতিক।গোটা পৃথিবীতে আজ ষড়যন্ত্রটার জ্যামিতিটা স্পষ্ট হচ্ছে। তবুও আশা জাগে, প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীনতা হয়তো একদিন কবির কন্ঠ থেকে আমার আপনার প্রত্যেকের চেতনার অস্ত্রকে শান দেবে,সকলের জাতীয়,না আন্তর্জাতিক হয়ে উঠবে সেই মহামন্ত্র,

“চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উত্‍‌সমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়...............”

ঘনাদার কলম - মেছো বাঙালি

ঘনাদার কলম
মেছো বাঙালি



সৈয়দ মুজতবা আলি বলেছিলেন- বেহেস্তে ইলিশের বর্ণণা নেই । সুতরাং ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না, তাই তিনি বেহেস্তে যাবেন না ।

বাঙালী স্বর্গে গেলেও মাছ খাবে। বাঙালীর মাছ খাওয়ার বাড়াবাড়ি দেখে আশ্চর্য হবার কিছু নাই। মাছ না খাওয়াটা বাঙালির বড্ড চাপ ।

চীন, জাপান, বার্মা, পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ও দ্বীপপুঞ্জ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের প্রধান খাদ্যাতালিকায় আছে ভাত-মাছ।

বাঙালীদেরও তাই। বাঙলার অজস্র খাল-বিল, নদী-নালায় এত মাছের ছড়াছড়ি দেখেও মাছ না খাওয়ার লোভ বাঙালী কোনোকালেই ছাড়তে পারেনি, বরং দিন দিন বেড়েছে। এই মৎস্যপ্রীতিই সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে অন্যান্য ভারতীয়দের কাছে থেকে আলাদা করে রেখেছে।

ভারতের আর্যসভ্যতা ও সংস্কৃতি, বাঙালীদের এই মৎস্যপ্রীতি কোনোদিনই ভালো চোখে দ্যাখে নি।

আজও বাঙালীদের এই মাছ খাওয়া দেখে অনেকে নাক সিঁটকোয়। কিন্তু তাতে কি! ভাত-মাছই বাঙালীদের প্রাণ । সুদূর প্রবাসে থাকলেও মাছ না পেলে বাঙালি শোকাহত হয়ে বসে থাকে ।

প্রায় আড়াই হাজার বছরের আগে থেকেই ভারতের আর্য-ব্রাহ্মণ্যধর্মে (বৌদ্ধ, জৈন সহ) খাওয়ার জন্য প্রাণীহত্যার প্রতি একটা নৈতিক আপত্তি প্রকাশ করে।

সেই থেকে তারা নিরামিষ ভোজের প্রতিই পক্ষপাতী হয়ে উঠেছিল। (পৃথিবীর অন্যান্য জাতিদের চেয়ে ভারতীয়দের পাতলা-চিকনা শারীরিক গঠনের এটা একটা প্রধান কারণ কিনা সেটাও একটা তর্কের বিষয় হতে পারে।)

প্রাণীহত্যার প্রতি আপত্তি বাঙলাতেও উঠেছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেটা কোনোদিনই তেমন পাত্তা পায় নি। কোনো শক্তিই চিরাচরিত ও বহু দিনের অভ্যস্ত প্রথা এত সহজে ভাঙতে পারে না।

বাঙলার অন্যতম প্রথম ও প্রধান স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট। তিনিও অনেক যুক্তিতর্ক দিয়ে বাঙালীদের অভ্যাসকেই সমর্থন করেছিলেন। তিনিই অনেক শাস্ত্র ঘেঁটে প্রমাণ দেখিয়েছিলেন যে মাছ-মাংস খাওয়ায় কোনো দোষ হয় না। কিছু তিথি ও বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে না খেলেই হলো। অনেকে বলেন বাঙালীর চিরাচরিত অভ্যাসকে সমর্থন না জানিয়ে তাঁর কোনো উপায় ছিল না। প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ তেল বা চর্বির তালিকায় জীমূতবাহন ইলিশ মাছের কথা বলেছেন। বাঙালীর আরেক স্মৃতিকার শ্রীনাথাচার্যও এই মত সমর্থন করেন। বৃহর্দ্ধমপুরাণেও আছে যে সাদা ও আঁশযুক্ত মাছ ব্রাহ্মণেরাও খেতে পারেন। কিন্তু যে মাছ গর্তে বা কাঁদায় বাস করে, মুখ ও মাথা সাপের মত (যেমন, বাণ মাছ), দেখতে কদাকৃতি, আঁশহীন, পচা, শুকনো মাছ ব্রাহ্মণদের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল। এছাড়াও শামুক, কাঁকড়া, মোরগ, সারস, বক, হাঁস, পাখী, উট, গরু, শূকর – এসব নিষিদ্ধ ছিল।

তবে নিম্নতর সমাজে এসব কেউ মানত না। (সমাজে স্তর বিন্যাসে এটাও একটা কারণ কি?)

বাঙালীদের মৎস্যপ্রীতির পরিচয় ময়নামতি ও পাহাড়পুরের পোড়ামাটির ফলকগুলোতে পাওয়া যায়। সেখানে মাছ কোটা বা ঝুড়িতে ভরে হাটে নিয়ে যাওয়ার চিত্র আছে। হরিণ শিকার করে নিয়ে যাওয়ার চিত্রও আছে। এর বর্ণনা পাওয়া যায় চর্যাগীতেও।

বৌদ্ধাচার্য লুইপা নাকি মাছের অন্ত্র খেতে ভালবাসতেন, তাই তার নাম হয়েছিল মৎসেন্ত্রাদ। তবে মাছ যে বাঙালি জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বোঝা যায় মধ্যযুগের বাংলায় জেলেদের বার বাড়ন্ত দেখলেই, কৈবর্তরা তো আসলে জেলে সম্প্রদায়ই যারা নাকি এক কালে রাজার বিরুদ্ধে সমবেত হয়ে বিদ্রোহ করেছিল। বাঙালি চিরকালই মাছেভাতে আছে

মাছ খাওয়ার এমন ঐতিহ্য পৃথিবীতে আর কোন জাতির আছে বলে জানা নেই। ঈশ্বরগুপ্ত বলেছেন, ‘ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল’।

বরিশালের বৈষ্ণবরা যাতে মাছ খেতে পারেন, তার জন্য বিধান এলো -

ইল্লিশ, খল্লিস, ভেটকী, মদগুর এব চ।
রোহিত রাজেন্দ্র, পঞ্চমৎস্যা নিরামিষাঃ।।

অস্যার্থঃ- ইলিশ, খলসে, ভেটকী, মাগুর এবং রুই- এই পাঁচরকম মাছ নিরামিষ। খেলে দোষ নেই!

সাথে, আরও জুড়ে দিলেন:- কাঁচকলা দিয়ে রান্না করলে, সব রকম মাছই খাওয়া যায়!

তন্ত্রশাস্ত্র আরও সরেস! তাঁরা কী বলেছেন বিধান দিতে গিয়ে!!!!!!

মৎস্য তিন প্রকার। উত্তম, মধ্যম ও অধম।

উত্তম মৎস্য= প্রায় কন্টক বিহীন।

মধ্যম মৎস্য= কিছু পরিমাণ কন্টক।

অধম মৎস্য= প্রচুর কন্টক হইলেও উত্তম রূপে ভর্জিত হইলে অতীব উপাদেয়। মানেটা হলো, কাঁটা মাছ কড়কড়ে করে ভেজে খেতে পারো!

কী মৎস্যপ্রেম! কাউকে ছাড়া নেই! বাঙালি বলে কথা !! হুঁ হুঁ বাওয়া !

খাল-বিল নদী-নালার দেশ বঙ্গদেশে আগাগোড়াই খাওয়া হতো মাছ। সে জন্যেই বাঙালিদের সঙ্গে ভাত এবং মাছ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চন্দ্রকেতু গড়ে মাছের ছবিসহ একটি ফলক পাওয়া গেছে। নীহাররঞ্জন রায়ের ধারণা, এই ফলকটি চতুর্থ শতকের। তাছাড়া অষ্টম শতাব্দী থেকে পাহাড়পুর এবং ময়নামতিতে যে সব পোড়ামাটির ফলক তৈরি হয়, তার অনেকগুলোতেই মাছের ছবি আছে। এ থেকে মাছের প্রতি এ অঞ্চলের লোকদের ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু ভারতবর্ষের অন্য অনেক অঞ্চলের লোকেরা বাংলাদেশের এই মৎস্য প্রীতিকে ভালো চোখে দেখেন নি। তারা এখনো মাছ খান না। সুকুমার সেনের মতে, প্রাচীন বাঙালির সমাজে মাছ-মাংস জনপ্রিয় ছিলো ব্রাহ্মণ নয়, অব্রাহ্মণদের মধ্যে। আর, ধর্মভীরু বৌদ্ধদের মধ্যে মাছ খাওয়া আগাগোড়াই বারণ ছিলো। কিন্তু কই, রুই, ইলিশের মতো মুখরোচক খাবার অথবা একটা দেশের জনপ্রিয় রীতিকে কেবল ধর্মের নামে রাখা সহজ ছিলো না। বারো শতকে সবর্বানন্দ যখন তাঁর টীকাসবর্বস্বতে মাছের নিন্দা করেছেন তখনও ইলিশের কথা তিনি ভুলে যাননি বলা হয়, উদ্ভট শ্লোক রচিত হয়েছিলো বারো শতকে অথবা তার কিছু কাল পরে। এতে মাছের বিশেষ করে রুই মাছের কীর্তন করা হয়েছে। আর মাছ খাওয়ার রীতিমতো প্রশংসা করা হয়েছে । এর একটি পদে বলা হয়েছে যে, যে-নারী রোজ কলা পাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল আর নালিতা শাক পরিবেশন করেন, তাঁর স্বামী পুণ্যবান অর্থাৎ ভাগ্যবান। মাছ বাঙালিদের কাছে এতো প্রিয় হবার জন্যেই বাঙালি গৃহিণীরা বিশেষ যত্ন নিয়ে নানাভাবে মাছ রান্না করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন।

বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরোনো রান্নার বই “পাক রাজেশ্বর” প্রকাশিত হয়েছিলো ঊনিশ শতকে। তারপর ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের পাকপ্রণালী। এই দুই বইতে মাছ রান্নার বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে। কিন্তু জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রজ্ঞাসুন্দরী তাঁর রান্নার বই মাছের ৫৮ রকমের রান্নার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ থেকে মাছের প্রতি বাঙালিদের আকর্ষণ কতো প্রবল তার আভাস পাওয়া যায়।

মাছের প্রতি এই ভালোবাসার কারণে প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিদের মাছ-খেকো বলে অনেকে দুর্নাম করেছেন। সর্বানন্দও তাদের একজন। টীকাসর্বস্বে তিনি লিখেছেন যে, শুটকি মাছ হলো নিম্নবর্ণের লোকদের খুবই প্রিয় খাদ্য। তিনি এ জন্যে বাঙালিদের শুটকি খেকো বলেছেন।

বঙ্গদেশে যে মোগল কর্মকর্তারা বাস করতেন, তারাও বাঙালিদের মাছ-ভাতকে ঘৃণা করতেন। ঈসা খান এবং তাঁর পুত্র মুসাকেও তারা জেলে বলে আখ্যায়িত করেছেন। যখন ইংরেজ আমল শুরু হয়ে যায় তখনও মোগল আমলের সাবেক কর্মকর্তারা এই মানসিকতা ভুলে যেতে পারেন নি। গোলাম হোসেন সালিম ১৭৮০ এর দশকে তার রিয়াজ-উস-সালাতীনে এই মনোভাবই প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘এ দেশের উঁচু-নিচু সবাই মাছ, ভাত সর্ষের তেল, দই, ফল আর মিঠাই খেতে পছন্দ করে। প্রচুর লাল মরিচ এবং লবণ তাদের পছন্দ। তারা আদৌ গম এবং যবের রুটি খায় না। ঘিয়ের রান্না খাসি এবং মোরগের মাংস তাদের মোটেই সহ্য হয় না।

মধ্যযুগের সাহিত্যে মাছের যে বিবরণ পাওয়া যায় তা বিস্তারিত। বিশেষ করে ভারত চন্দের তালিকা রীতিমতো দীর্ঘ, আধুনিককালে বিদেশ থেকে আনা কিছু মাছের কথা বাদ দিলে, অন্য যে সব মাছের সঙ্গে বাঙালিদের পরিচয় আছে সে সব মাছের বেশির ভাগের নামই সেকালের সাহিত্যে পাওয়া যায়।

পদ্মপুরাণ, মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল ভারতচন্দ্র এবং ঈশ্বর গুপ্ত মিলিয়ে যেসব মাছের কথা জানা যায় সেগুলো হলো : আড়/আউড়, ইচা,( চিংড়ি) ইলিশ, উলকা এলেঙ্গা কাতল, কালবসু, কুড়িশা, কৈ, খয়রা, খরশোলা, খলিশা, গড়ুই, গাগর, গাঙ্গাদাঁরা কাঁকলেকা, চাঁদা (নানা রকমের), চান্দাগুঁড়া চিংড়ি, চিতল, চেঙ্গ, চেলা, টেংরা, ডানিকোনা, তাপসে, তেচক্ষা, পাঁকাল, পাঙ্গাস, পাবদা, পার্শে, পুঁটি (নানা রকমের), ফলুই। ফলি, বাঁশপাতা, বোয়াল, বাচা, বাটা, বাণ (নানা রকমের), বানি, বেলে, ভেকুট, ভেদা, ভোল-চেঙ্গা, ভোলা, ময়া, মহাশোল, মাগুর, মৃগাল, মৌরলা, রিঠা, রুই, লাটা, গড়ই শঙ্কর শাল গজাল, শিঙ্গী আর শোল। এসব মাছের বাইরে বিশ শতকের গোড়ায় সতীশচন্দ্র শাস্ত্রী যেসব মাছের তালিকা করেছিলেন, সেগুলো হলো : অঞ্জনা, আলবুলা, আরশি, কটকটিয়া, করাতি, কাকাল, কাকাশিয়া, কারসি কুরচি, ঘাগৌট, ঘারুয়া, চন্দ্রমারা, চাকুন্দা, চাপলি, টেপা, তর, দেওকাটা, দেবারী, নফেলা, পটকা, পান, ফেসা, ভাঙ্গন এবং শিলন্দ।

সেকালের সাহিত্য থেকে কেবল বিচিত্র ধরনের মাছের নামই জানা যায় না, সেই সঙ্গে আরা জানা যায়, খাদ্যের স্বাদ বৃদ্ধির জন্যে কতো বিচিত্রভাবে মাছ রান্না করা হতো। যেমন, রান্না মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল থেকে মাছ রান্নার রকমারি সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলেও মাছের বিভিন্ন রকম রান্নার বিবরণ দেওয়া আছে। যেমন, রুই মাছ দিয়ে পলতার আগা; মাগুর মাছ দিয়ে গিমা শাক, ঝাঁঝালো সর্ষের তেল দিয়ে রান্না খরসুন মাছ; ভেতরে লাল লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে বাইরে সুতো জড়িয়ে চিংড়ি মাছের মাথা, চিতল মাছের কোল ভাজা আর কৈ মাছ দিয়ে মরিচের ঝোল।

জানি না, এই সব রান্না আজকাল কয়জনে পারে !!!!!

তবে আমাদের কাটা পোনা, আজও সমান ভাবে জনপ্রিয় এই পশ্চিমবাংলায় ।

জয়তু মৎসপুরাণ ।

-

উৎস – ইনটারনেট এবং বিভিন্ন বই ।

ধারাবাহিক - রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়


অবভাস
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়



১১

He was born at the hour of bulls…


গাদা করা টেবিলে একটু সরিয়ে পেনসিল, নোটবুক, কফিকাপ। পাশে টাইমস আর টেলেগ্রাফ।
কফিকাপটা কায়দার। কোন এক বান্ধবীর দেওয়া।
একদিকে লেখাঃ
April 20 - May 20
taurus
the bull
অন্যদিকে কিছু বিশেষণ, ছড়ানো ছেটানোঃ
stubborn
                    patient
    loving
                                           sympathetic
                   subtle
appreciative
                             practical
                                                       efficient
     generous
                                  teachers
                 understanding

এর মধ্যে stubborn, loving, sympathetic, practical আরgenerous শব্দগুলো অপেক্ষাকৃত বড় ফন্টে ছিল।
কী মনে হল তার,  কাগজদুটোর রাশিফলের পাতাগুলো খুলে বসল। তারপর দাগাল। ২৮শে জুলাই।
দ্বিতীয়টায় কুসুম ভান্ডারী লিখেছেন-
Look for new ways to handle situations. The sheer force of your personality will ease you out of a tricky situation.
আর প্রথমটায় বেজান দারুওয়ালা-  
You face a fresh new challenge – from within yourself, wishing to excel in what you do. An excellent time for moving out of your usual orbit.

শেষ লাইনটা বেশ মনে ধরল তার। তাই বার বার দাগাল।
 সেদিন বুলবুলিটা একটু বাড়াবাড়ি ধরনের হয়ে গিয়েছিল।
মনে আছে রস-কষ-শিঙ্গাড়া?
ডানহাতের বুড়ো আর তর্জনীর মাথাটা খালি পেন্সিল-কাটার দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। একটু চাপ বেশি দিতে হয়েছিল। তা বেশ। তবে শাটা ভেঙে দিয়েছিল, যাতে আর কোন দিন ডান হাত ওয়ান শটার নিয়ে আর না চমকায়।  
He was born at the bulls' hour.            

ধারাবাহিক - সুবীর সরকার

এপিটাফ
সুবীর সরকার



৩৪।


দিনদুনিয়ায় দেশকালের ওপর কখন যেন আন্ধার নেমে আসে। লম্ফ জ্বলে ওঠে কচুঝোপে জোনাকআলোর জোনাই। ধল্লা নদীর চরে কাশিয়াবাড়িত শেয়ালেরা ডেকে ওঠে। পাকশালে আন্ধনঘরত রেহেনা খালার তৎপরতা শুরু হয়। দাওয়ায় বসে তামাক টানে ইদ্রিশ মোল্লা। তামাকের রসে পুরুষ্টু হতে থাকে শরীরমন। অর্ধচেতনায় তখন জোতজমি কাকিন্যার বড়বিল নীলসাগর রসুনভাজার গন্ধ।নিকাহের খোয়াব ভাসতে থাকে। একসময় খোয়াব ভাঙেও রেহেনা খালার গুনগুন বিয়ের গীতের টানা সুরের লহরীতে। জোতজমির মতো জোতজমি পড়ে থাকে আর চারপাশে কেবল আহাজারি। রুহের জন্য মাগফেরাত।



৩৫।

হাড়িত নাই ভাত
মাথাত দিনু হাত

বনাঞ্চল চরাঞ্চল-এর ভিতর হাওড় বিল কুড়া দহের ভিতর উদ্দেশ্যহীন অনিবার্যতায় নৌকো ও মাঝির সম্পর্কের মতোন দোতরা ও গীদালের সখ্যতার মতোন জীবন সংকোচনপ্রসারনের ধন্ধধোঁয়ায় ফাঁকা ফসলহীন শীতমাঠে নেমে এসেও নির্জনতা খুঁজতে গিয়ে চিরকালীন বিষাদ নিয়ে জেগে উঠতে থাকে শোক ও শ্লোকবাহিত। ধান কাটার মরসুমে কালবৈশাখীর তাণ্ডবলীলার অপরূপ দৃশ্যসুখ স্মৃতিতে বহন করতে থাকা রূপকান্ত অধিকারী তখন ঘুমের ভিতর পাশ ফেরে আর বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকে বাওকুমটা বাতাসের যত গান। গল্পের পাকে পাকে জড়িয়ে যাবার মতন।

গুচ্ছ কবিতা - বারীন ঘোষাল

গুচ্ছ কবিতা
বারীন ঘোষাল


সিনেমা


কত শান্ত বসে আছে এক বুদ্ধু
ডাকবন্দী খেলার মধ্যে
         ওং
                       ফোং
                                    মন মুন মন মুন
#
মনটি মুনে
আলোকিত চাঁদে
                     চন্দ্রস্কোপে
ফিলিমের ইম খুলে রীল ফিল হীন হয়ে যাচ্ছে সিনেমায়
আর গাছের তলাটা ঘুরে ফিরে খুঁজছে তাহাকে
#
নতুন আর তুন প্রজাপতিদের চেনা যাচ্ছে না আলাদা
শীতল রোদের ঢঙে শবনম যেন জমবো
জমবো করছে না
হরাপতন পড়ছে না এই অলিখিত চিঠির ছলে
                                              যুদ্ধলিপির সিনারিওটি
#
অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকার হয়ে বসে আছে
স্মশানের মধ্যেও শান্ত
#
জীবনীর সিনগুলো মাঝে সাঝে কেউ দেখছে না


মোমেন্ট

স্লো মুভির জন্য এই ঘড়িয়ালটাই ফিট
ট্রাসটা স্লিপ করেছে এত সোজা বোঝার সময় নেই
নিদ সিঞ্চন ছোঁয় না কিছু আর
                 স্তনান্তে হাতের ফিলিং ফুরোল তাই
#
একা থাকো চবুতরায়
                চবুতরা যাকে বলে জানি না
রূপকথার ভেজা ঠোঁটে ছেলেবেলাকার জিভ
খাস গান
                আম গান
#
প্রাচীন ভিখারি এসে দাঁড়াতো দরজায়
সিনটা সিনটায়
রূপকন্যে আর নেই
শুধু ধূন তেরেনুম আর কানঘুমে বহেরা
                           পিছল জোড়া চোখ
শুধু ছোটা
                 সেই পড়ন্ত অবস্থার কী হল
মুধু মম নয়ে
                স্নেহের মোমেন্ট আঁকা কোলের অঙ্কখানি পড়ুক


পিউ কাঁহা

তারাদের মধ্যে কোন সাপলুডো নেই কেন যে
                             ভগবানদের পাস্টাইম
                             নিদেন বাসুকী নয়তো উলুপীর খেল
সেদিন আকাশে তিতলি ওড়াবার খেলা
                             ওরা নাআআআআ ওড়না
#
মানুষে টানুষে খেলার মধ্যে
                             বিষের মন্থনটি ছবি হয়ে গেল
          ছবি নেমে এল বিছানায়
দুজনে মিলে বেড়াল লোফালুফি চলছে
কী জ্ঞান কী নির্জ্ঞান বস্তর বিস্তোরিয়া
বয়েই গ্যাছে রাত অলি বিমানিয়া উফ্‌
#
তোমার পিউ কাঁহাটি আমাকে আর একবার দেখাও না
রূপরূপ করছে মাই পালানো শীত
ওই মেঘের পুং
                   শব্দে পরিচয় আর বনবর্ণে
      সড়কিয়া হমদম
উর্দু ভাষায় কাআআআশ
পিউ কাঁহা পর্ণ পর্ণো কেন বাড়িঘর নড়বড়ে

কবিতা - উজান

কম্পাস
উজান


কবিতায় স্মার্ট হয়ে উঠছেন পায়রাবতী
আর সঙ্গমে স্মার্ট হয়ে উঠছেন সমতল পেট

সেভাবে দেখলে আমার কোন উন্নতি হচ্ছেনা
দশটি ময়ূরী দিকের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘাড় লম্বা হয়ে ওঠা ছাড়া

আমি অপেক্ষা করছি
কবিতা,শরীর আর শুন্যতার সঙ্গমে স্মার্টলি ঢুকে পড়ব বলে

তারপরেই আমাদের দিগদর্শী জন্ম হবে বেশ...



কবিতা - ব্রততী চক্রবর্তী

বিষয়ঃ ভালবাসাবাসি
ব্রততী চক্রবর্তী



মাত্র কুড়ি মিনিটের উদাসীনতা বুঝিয়ে দেয় সামনে
নিশ্চিত বিপদ ; ত্বকের উপরে একশো চার
আর বুকের ভিতরে
মাইনাস দুশ তিয়াত্তর !

বেপরোয়া মন নিজের ক্ষমতা বোঝে কই !

অমাবস্যার স্মার্ট ক্যামফ্লেজ এখন হৃদয়ের জ্যোৎস্নায় আর
দুজনের ভাষা তখন একই বর্ণমালায় তবু অবোধ্য ;
সব ফুলের রঙ আজ
মন ভোলানো নীল

শুনেছি নীল রঙে মিশে থাকে তীব্র কালকূট -
একবার দু ঠোঁটে ছুঁয়ে যেতে চাই হাতে সময় বড্ড কম !

ছুটছে গাড়ি, আসছে স্টেশন
দুহাতে জড়াও অলীক ভুবন !

কবিতা - দেবাশিস কোনার

তিনটি কবিতা
দেবাশিস কোনার


আমার জন্য নয়


সব কিছুই আমার জন্য নয়
ঘেরা থাক কাঁচের দেওয়ালে সুশজ্জিত,
সভ্যতার নিদ্ড়শন এবং বাদশাহি তাম্রপত্র ৷
কেবল তুমি দেখবে দু'চোখ ভ'রে সবকিছু -
দশ্ড়কের মতো,বিচারকের দৃষ্টিতে ।
আর বেশ মজা করে ইচ্ছে হলে মাঝে মাঝে
টিফিন আর প্যাকেজ ড্রিকিং ওয়াটার চাইতে পার ।

ঠান্ডা সভাগৃহে শীতের রোদের মতো ঝরে আনন্দফুল,
দীঘ্ড় লাউঞ্জ ভেদ করে অ্যানাউন্সমেন্ট,মেটাল ডিটেক্টার
সিকিউরিটির নজর এড়িয়ে ধূমপান নো স্মোকিং জোন
আর রুফটপ রেস্টুরেন্টে বিন্দাস ভোজ ।
এ তো স্পষ্টই দেখা যায় ,তাই না ?

তোমাক শুধু তার ভিতর থেকে খুঁজে দেখি আর
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি মেট্রো চ্যানেলে ব্যস্ততার মাঝে
ফুচকার দোকানে । হয়তো তখন ফুচকাও
তোমার কাছে মোগলাই - যা কিনতে আমাকে প্রয়োজন .......



বৃষ্টি নামা


আইঢাই করা শরীরের অভ্যন্তরে জল ঝড়ে অবিরাম
অচিন্তনীয় কষ্টে ভেসে যায় বিদ্যুৎ মেঘের ওম্
কতটা সে যন্ত্রণা তা স্থির করতে চেয়েছি
অথচ নিজেকে কখনও বুঝিনি সঠিক
সিদ্ধান্ত নিতে না পারাটাই যদি
মাপকাঠি হয় তবে তা
প্রযোয্য হোক
স্বস্থানে

আপাতত
শান্তির জন্য
আসুন সকলে প্রার্থনা করি
ঘুণ যে ভাবে বাঁশকে ভালোবেসে প্রতিদিন
মেঠো পথে পয়ার জল ছোটার শব্দ যেমন করে
চাষীর বুকে আশার আলো জাগায় ঘূর্ণমান মেঘের সাথে
ভরকেন্দ্রে নারী শরীরের আহ্লাদ আর কাব্যময়তা কূলকিনারাহীন
বিচার করতে থাকি বৃষ্টিনামার তত্ত্ব-তালাশ এবং জাড্যমনতা আছে কী না


বাঁচার নির্ঘন্ট

দাঁড়িয়ে আছি বাসস্টপে একা শুনশান কেউ কোথাও নেই
নিশ্চুপে নিরুপদ্রুপে যেন খাঁচায় বন্দী পাখি
দূর থেকে তাক করে আছে কেউ । লক্ষভেদ করলেই
আমার মাথা থেকে ধর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে ।
আমার জীবন এক সুতোর ওপর নির্ভর করে আছে
একটু এদিক সেদিক হলেই তাল কেটে যাবে
জবাবদিহী করবার কোনও আধিকার নেই আমার
মৃত্যু পরোয়ানা লেখা চিঠিতে শুধু সময় সংক্ষেপ
আমি তবুও দমতে পারি না , মনে হয় ঘুড়ে দাঁড়াই
জানি জীবনে একবার মরতে হবে । তবে কেন মরার আগে মরব ?

বৃষ্টি এসে আমাকে ভেজায় প্রবল ভাবে
এখন আমি বাঁচা মরার সন্ধিক্ষণে অপেক্ষারত
আমার এতদিনের জীবনের সব হিসেব-নিকেশ
চুকিয়ে দিতে হবে । কোনও গড়মিল খুঁজে পেলেই
জারি হবে আদেশনামা । সভ্য সমাজের আমি এখন কলঙ্ক
আমার চারপাশে এখন শকুনের দল ছিঁড়ে খাবে বলে অপেক্ষা করে আছে ।

জীবন বাজি রেখে আমি এখন ডুব সাঁতার দিতে প্রস্তুত
চোরা অভিমানে আমার দেহ থেকে খসে পড়ছে বিদ্যুত
লড়াই করতে করতে আমি এখন ক্লান্ত
আমাকে গ্রাস করে নষ্ট চাঁদ
পরিযায়ী ক্ষোভে জর্জরিত আমি
মাদক সেবনের উপকারিতার বিজ্ঞাপন দিলেই মুক্তি ।

হৃত বিস্মৃত হৃৎবিধৃত

হৃত বিস্মৃত হৃৎবিধৃত

[এই বিভাগটি বর্তমান সংখ্যা থেকে সূচনা হল। বাংলা ভাষাকে ওরা গান বলে, কিন্তু বাংলা ভাষা তো কবিতা ! আমরা যারা বাংলা কবিতাকে নিয়ে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে রয়েছি, তাদের পালকগুলি এক-এক বিন্দু শব্দের শিশির নিয়ে ভোরবেলা স্বপ্নে যায়। এত দীর্ঘ ইতিহাসের এক এক টুকরো এই আশ্লেষেশিশিরে মাখামাখি করে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেব স্থির হল, ক্ষেপুব্লগের আগামী সংখ্যাগুলিতে। সুখ্যাত-অখ্যাত-পঠিত-বিস্মৃত বাংলা ভাষার কবিদের স্মরণের আলোয় আমন্ত্রণের দায়িত্বে রইলেন অত্রি ভট্টাচার্য্য।]

স্বাধীনতা দিবস বিশেষ সংখ্যায় স্মরণ করছি কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। লাল চেতনায় ফুটিফাটা এই কবির নাম মানুষের লড়াইএর শেষদিন পর্যন্ত সংগ্রামের অক্ষরে লেখা থেকে যাবে। দগদগে কলমকুশল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছন্দচর্চা থেকে অ-ছন্দের অস্ত্রসজ্জা – সবেতেই ছিলেন সমান পারদর্শী। ‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’ (১৯৬৪) থেকে বইএ বইএ ‘অফুরন্ত জীবনের মিছিল’ (১৯৮৫)-তে চলে এলেন তিনি, অথচ তার জীবনের থেকে বৃহৎ জীবনোৎসব রঙ ছড়িয়ে গেল নিভল না, এখনোও অক্লান্তরূপ অম্লান। তার পাঁচটি কবিতায় আমরা মনে করি এই রক্তকবির পাঞ্জায় কাটাকুটির দাগগুলিকে।


কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে

কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে ব’লে
আজও তার নিঃশ্বাসের বাতাস নির্মল ;
যদিও উজীর, কাজী, শহর-কোটাল
ছড়ায় বিষাক্ত ধুলো, ঘোলা করে জল

তথাপি মানুষ আজো শিশুকে দেখলে
নম্র হয়, জননীর কোলে মাথা রাখে,
উপোসেও রমনীকে বুকে টানে ; কারও
সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে।

জন্মভূমি আজ

একবার মাটির দিকে তাকাও
একবার মানুষের দিকে।

এখনো রাত শেষ হয় নি ;
অন্ধকার এখনো তোমার বুকের ওপর
কঠিন পাথরের মতো, তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারছো না।
মাথার ওপর একটা ভয়ংকর কালো আকাশ
এখনো বাঘের মতো থাবা উঁচিয়ে বসে আছে।
তুমি যেভাবে পারো এই পাথরটাকে সরিয়ে দাও
আর আকাশের ভয়ংকরকে শান্ত গলায় এই কথাটা জানিয়ে দাও
তুমি ভয় পাও নি।

মাটি তো আগুনের মতো হবেই
তুমি যদি ফসল ফলাতে না জানো
যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও
তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।
যে মানুষ গান গাইতে জানে না
যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।
তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে,
তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়।

১৯৭০



নিরাপদ মাননীয় মানব সমাজ
‘I smell dark police in the trees’

দীর্ঘ দেবদারু বীথি আজ কোন আকাশ দেখে না
এখন আকাশ জুড়ে নষ্ট চাঁদ, শুরু হবে পিশাচের নাচ ;
এখন বাতাস দগ্ধ দুধকলা দিয়ে পোষা সাপের নিঃশ্বাসে...
ভাল আছ—নিরাপদ—আমাদের মাননীয় মানব সমাজ ।।

আগস্ট ১৯৬৫

স্থিরচিত্র
শ্রীগোপাল মৈত্র, সুহৃদ্বরেষু

সবই তো এক রকম
আমাদের চোর পুলিশ স্কুল কলেজ হাসপাতাল,
এই দেশে মানুষের পা রাখার জায়গা কোথায় ?
এখানে শিশুরা আসে জন্মনিয়ন্ত্রণের হুকুম মেনে ;
এখানে বেকার যুবকরা মাইলের পর মাইল
এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের লম্বা কিউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে
এক প্রাগৈতিহাসিক ক্ষুধার স্পর্ধাকে
তাদের বুকের হাড় আর পিঠের চামড়া খুলে দেয়
যা তাদের বেঁচে থাকার মাশুল !

কিছুই বদলায় না। আমাদের স্বপ্নগুলি
বিকলাঙ্গ ভিক্ষুকের মতো
সমস্ত দিন, সমস্ত রাত যাকেই সামনে পায়
তারই পা-জড়িয়ে ভিক্ষা চায় ;
যে দৃশ্য আমরা জন্ম থেকে দেখে আসছি।

তবু আমরা অপেক্ষা করি ; এক মন্ত্রী যায়,
অন্য মন্ত্রী আসে
আমরা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি ।

২৮ জুন ১৯৭৭

অথচ ভারতবর্ষ তাদের

কোথায় তাদের ঘর ? ত্রিপুরায়, আসামে, বাংলায়
সাঁওতাল পরগণায়, দাক্ষিণাত্যে, মেঘালয়ে

ঘর কোথায় ? পাহাড়ে, জঙ্গলে, চা-বাগানে, কয়লা-খনিতে,
তারা হাঁটে, কুঁজো হয়ে কাজ করে, আধপেটা খায়, বিনা চিকিৎসায় মরে ।
কিংবা কপালের জোরে বেঁচে থাকে
কোথায় তাদের মান ? দেশ থাকতে দেশ নেই,
                                  পথের ঠিকানা নেই
অথচ ভারতবর্ষ তাদের রক্ত ও হাড়—তারাই গড়েছে
                                                       এই মহাদেশ
শত শতাব্দির শ্রমে, পরিচ্ছন্ন সততায়, মানবিক
                                                   শুভেচ্ছায়-বোধে !



২৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৪

ছোটগল্প - অলোকপর্ণা

কাঁটাতার
অলোকপর্ণা





চন্দনা হেঁটে এসেছে অনেকখানি,- কাঁটাতারে পৌঁছে তা টের পেয়ে নিশ্চুপ সে ফেরার পথ ধরে। যেন এছাড়া অন্য আর কিছু হওয়ার ছিল না। ওপাশের গ্রাম তার নজর এড়িয়ে যায়, মগ্ন চন্দনা আজ সকাল থেকে মনে মনে ‘হৃদয় আমার প্রকাশ হল’ গেয়ে চলেছে। তাই তার মনে পড়েনা, কাঁটাতারের ওপাশের কথা জিজ্ঞেস করায় কেমন করে চড় মেরেছিল পুষ্পল, মনে পড়েনা পুজোয় ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলায় কেমন ঘাড়ধাক্কা জুটেছিল। এসব পুরোনো কথা চন্দনা ভুলে গিয়েছে। পুষ্পলের পাখি হয়ে গিয়েছে সে, পুষ্পল যা বলিয়েছে তাই বলেছে, যা পরিয়েছে তা পরেছে। চন্দনার হাসি পেয়েছে তার নামের এমন সার্থকতায়, এতই হাসি পেয়েছে যে হাসতে হাসতে সে কেঁদে ফেলেছে, মিনিট চারেক পর বেরিয়ে এসেছে বাথরুম থেকে।

কাজের লোক শুক্লা তিন মাস আগে জানাল পুষ্পলের পরকীয়ার কথা। সে কথা বিস্তারিত শুনে চন্দনা বাথরুমে ঢুকে আবারও হাসতে শুরু করেছে। সেদিন কান্না আসেনি আর। খুব হেসে নিয়ে যখন সে বাইরে এসেছে, দেখেছে বিকেল, পুষ্পলের আসার সময় হয়েছে। সেই থেকে চন্দনা গান গাইছে মনে মনে, যেমন আজ ‘হৃদয় আমার...’ গেট ঠেলে সে কম্পাউন্ডে ঢোকে, লেটার বক্স খুলে দেখে নেয় কেউ এল কি না। এসেছে, অফিসিয়াল এক চিঠি। এনভেলপে নিজের নাম দেখে চন্দনার গান থামে। ঘরে ঢুকে টেবিলে বসতে বসতে চিঠির বয়ান বার তিনেক পড়া হয়ে যায়। পুষ্পল ডিভোর্স চেয়েছে অবশেষে। শুক্লা নেই। দরজা জানালা সব বন্ধ। চন্দনা গেয়ে ওঠে, ‘এই- যে আলোর আকুলতা...’ গলা কত বদলে গিয়েছে!

গান থেমে যায় কলিং বেলের ডাকে। দরজা খুলতে না খুলতে শুক্লা একমুখ হাসি নিয়ে বলে যায় “ঘরভাঙানি ডাইনিটা পরিবার নিয়ে চলে যাচ্ছে শহরে, এবার তোমার কপাল ফিরবে গো!” বিত্তের বাঁধা মাঝে না থাকলে শুক্লা যে আনন্দে তাকে জড়িয়েই ধরত চন্দনা তা বোঝে। কাঁটাতারের ওপারে কি আছে তা ও বলতে পারবে জেনেও গা ঘিনিয়ে শুক্লার গায়ের আঁশটে গন্ধ থেকে বেরিয়ে আসে চন্দনা। পুষ্পলের প্রেমিকা চলে যাচ্ছে,- তাহলে ডিভোর্সের চিঠির মানে কি? সে বারান্দায় এসে গাছেদের পাশে বসে। ভাবে গাছের থেকে স্বাধীন কেউ আছে! টবের গাছেরা ফরিশ্তার বেশে দাঁড়িয়ে, যেন সময় হলেই উড়ে যাবে,- ওড়া! চন্দনা ভাবে পাখির চেয়ে স্বাধীন...- নাহ্‌ আর কেউ নেই। পুষ্পলের থেকে ছাড়া পেলে সে সত্যিই পাখি হয়ে যাবে।

পাখি হয়ে যাবে... এটা আনন্দ না বিষণ্ণতা সে টের পায় না।




সন্ধ্যের মুখে টিউব জ্বালিয়ে টেবিল ক্লথটা নামিয়ে চন্দনা সূঁচ- সুতো তৈরী করে। কাশ্মীরী স্টিচের এই কাজটা দুবছর পরে রয়েছে। একগাদা রঙিন সুতোর রিল ছড়িয়ে দিতে বিছানাটা এমন হেসে উঠল যে সেখানকার প্রতি রাতের নির্মমতাকে চন্দনা এক্কেবারে ভুলে গিয়ে ফুলের পাপড়িটা লাল হবে না হলুদ- এই দ্বিধার মাঝে দাঁড়িয়ে মনে মনে গেয়ে উঠল, ‘সব নিয়ে শেষ ধরা দিলে...’। পুষ্পল ঘরে আসে।

“একটা চিঠি আসবে তোমার কাছে, ডিভোর্স পেপার, ওটা আমায় দিয়ে দেবে। আমি উইথড্র করছি।” সময় নষ্ট না করে সে বেরিয়ে যায়।

সূঁচ হাতে থেমে থাকে চন্দনা। লাল না হলুদ- হলুদ না লাল... স্বাধীন ভাবে হলুদ সুতো বেছে নিয়ে চন্দনা তার শীর্ণ কবজিতে নিপুণ স্টিচ ফেলে চলে যতক্ষণ না পিঠ থেকে তার ডানা বের হয়।

যতক্ষণ না বিছানায় শুয়ে পরতে পরতে সে দেখে তার সারা গা ভরে যাচ্ছে পালকে,

যতক্ষণ না চোখ বোজার পর ‘অনন্ত আকাশে...’ গাইতে গিয়ে কিচিরমিচির ছাড়া অন্য কিছু সে শুনতে পায়না।

ভোরের দিকে শুক্লা সরকারী কোয়ার্টারে আসার পথে দেখে কাঁটাতারের ওপাশে কুষ্ঠরোগীদের গ্রামে কি কারণে যেন উৎসব লেগেছে, নাচাগানা, হৈ হট্টগোল, আনন্দের আভাস পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকেই। তার ইচ্ছে হয় ওপারে চলে যায়...

আঁশটে গন্ধ নিয়ে শুক্লা কাঁটাতার থেকে সরে আসে, যেন এছাড়া অন্য কিছুই আর করার ছিল না।

ছোটগল্প - গৌতম যুথিপুত্র

ক্লাসরুম ২০৮০
গৌতম যুথিপুত্র



“আরে এ মা , সুখিকাকা নাইরে , সুখিকাকা পলাইছে....আরে এ মা...সুখিকাকা পলাইছে বটে।

দু-পাশে বিস্তীর্ণ চাষের জমি । তার বুক চিরে চলে যাওয়া হাইওয়েটা শুয়ে আছে নিথর অজগরের মতো । দিন নেই রাত নেই দানবের মত বড় বড় ট্রাকগুলো দৌড়ে চলেছে সেই পথ বরাবর । রঘুনন্দনের নজর এল একদিন হঠাৎই ট্রাকগুলো সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল রাস্তা্য়...একটার পর একটা , তারও পরে একটা । রঘুনন্দনের নিজের জমি নেই । অন্যের জমিতে খেতমজুরের কাজ করেই চলে তার সংসার । বাবুরা ভোটের সময় এসে আশ্বাস দেয় , এবার ভোটে জিতলেই তোরা বছরে একশো দিনের কাজ পাবি নিশ্চিত , সুতরাং...।নিরক্ষর রঘু্ ভোটের রাজনীতি খুব বোঝে , শুধু বোঝে না কত দিনে একশো দিন হয় ; ভোট বাবুরা বোঝায় একশো দিনেই তোদের বছর। আর জানে কাজ কাজ না জুটলে ফুলমনি আর ্বুধিয়াকে নিয়ে ভুখা থাকতে হয় ।

একদিন , দুইদিন ,তিনদিন....ট্রাকগুলোর নড়বার কোন লক্ষণই নেই । ড্রাইভার , খালাসি কয়েক’শ লোক হাইওয়েতেই পড়ে আছে । শুকনো খাবারেও তাদের টান পড়েছে। রঘুনন্দন অবস্থা বুঝে রাস্তার ধারে বাঁশ পুঁতে পলিথিনের চাদরে মুড়ে অস্থায়ী খাবারের দোকান খুলে ফেলল । সারাদিন তার দোকান চলে । ভোর হতেই বুধিয়া আর ফুলমুনিকে নিয়ে সে চলে আসে সেখানে । ভালই খদ্দের জোটে তার দোকানে । রঘু ভাবে কত লোক , কত বিচিত্র তাদের ভাষা । অবাক হয় রঘু ।

---কী হইয়েছে গো, হেথা কী মেলা লাগেছে ? ফুলমনি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ।

রঘু বলে , কী জানি , শুনতে পাই নেতারা রাস্তা জুড়ে মিটিং করছে আমাদের কাজের জন্য.....কাজ কবে পাবো সেটা মিটিং শেষ হলে বুলবে । এখন কাজে লাগ ; আটা মেখে ফেল জলদি জলদি ।

এরই মধ্যে ট্রাকওয়ালা সুখবিন্দরের সঙ্গে বুধিয়ার ভাব জমে গেছে । এবার সুখবিন্দর মাল নিয়ে মুলুকের দিকেই যাচ্ছিল । এখানে আটকে না গেলে এতদিনে ঘর পৌঁছে যেত সে । ঘরের কথা মনে হতে মনটা তার ভারী হয়ে যায়। তবু বুধিয়াকে নিয়ে খেলায় মেতে সে ঘরের কথা ভুলে থাকবার চেষ্টা করে । এদিকে রঘুর কারবার ভালই চলতে থাকে। রাতে বাড়ি ফিরে রঘুনন্দন ফুলমনিকে বলে , কাল আরও আটা , আলু নিয়ে যাব । আরও কামাই করে লিতে হোবে। প্রায় মাঝরাত । হাইওয়েতে ঘরঘর আওয়াজ । সার দিয়ে ট্রাক চলতে শুরু করেছে । পুলিশের লোকেরা রাস্তা ফাঁকা করে গাড়ি চালু করে দিয়েছে । মিটিং অবরোধ সব আপাতত বন্ধ । আবার কবে শুরু হয়ে যাবে ঠিক নেই । সবার তাড়া লেগেছে । ট্রাক ছুটিয়ে দিয়েছে যার যার গন্তব্যস্থলের দিকে ।

পরদিন ভোরবেলা । বুধিয়াকে কাঁধে করে রঘুনন্দন আসে হাইওয়েতে । সঙ্গে ফুলমনি । ফাঁকা রাস্তায় হু হু করে ট্রাক , গাড়ি সব ছুটে চলেছে । সুখবিন্দরকে দেখতে পায় না রঘু । বুধিয়া তার সুখি কাকাকে না পেয়ে কাঁদে । রঘু বলে , কান্দিস নাই বুধিয়া ; তোর সুখিকাকা তার ঘর গেছে । তারপর ফুলমনির দিকে ফিরে বলে , মিটিং শেষ হইছে রে ফুলমনি , এবার আমাদের কামকাজ মিলবে ; সারা বছরের কাম , একশো দিনের কাম । আর ভুখা মরতে হবে নাই .....।”


গল্পটা শেষ করে একটু থামলেন ইতিহাসের শিক্ষক বাদল রায় । ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের মুখের উপর আলতো দৃষ্টি বুলিয়ে বললেন , সম্ভবতঃ গল্পটা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে কোন এক অখ্যাত গল্পকারের লেখা । এই গল্পটা থেকে আমরা আজ থেকে প্রায় আশি-নব্বই বছর আগেকার অর্থাৎ ২০০০-২০১০ সালের ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা ভয়ানক খন্ডচিত্র পাই । ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারতবর্ষ বিদেশী শাসনের অবসান ঘটিয়ে তার প্রথম স্বাধীনতা পেয়েছিল কিন্তু পরবর্ত্তী প্রায় একশো বছর সে শোষিত হয়েছিল রাজনৈ্তিক শঠতা , অর্থনৈ্তিক ভন্ডামি এবং সামাজিক ব্যাভিচারের দেশীয় দালালতন্ত্রের কাছে । দূর্বল সংবিধান , অক্ষম গণতন্ত্র , নিস্ক্রিয় বিচারব্যবস্থা দেশের সাধারন মানুষকে নিরাপত্তা দিতে ব্যার্থ হ’ল । ক্রমে এক ব্যার্থ রাষ্ট্রে পরিনত হ’ল ভারত । কিন্তু হিস্ট্রি রিপিটশ ইটসেলফ ! আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে এই দুমড়ে যাওয়া ভারতবর্ষের সর্বস্তরের মানুষ একদিন রুখে দাঁড়াল রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে, শুরু হ’ল প্রতিরোধ তারপর প্রতিআক্রমন যাকে ঐতিহাসিকরা ভারতবর্ষের“ স্বাধীনতার দ্বিতীয় যুদ্ধ “ বলে অভিহিত করেছেন । অবশেষে ২০৪৭ সালে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় শোষন গুঁড়িয়ে দিয়ে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হ’ল এক পরিচ্ছন্ন রাজনৈ্তিক , সামাজিক , অর্থনৈ্তিক বাতাবরন । ঘটনাক্রমে সে দিনটাও ছিল ১৫ই আগষ্ট, আমাদের স্বাধীনতা দিবস । আজ ২০৮২ সালে দাঁড়িয়ে তোমরা যে ভারতবর্ষকে বিশ্বের সুপার পাওয়ার হিসাবে দেখছো সেখানে রাজনীতি আছে কিন্তু রাজনৈ্তিক ব্যাভিচার নেই , দৃঢ় অর্থনীতি আছে কারন অর্থনৈ্তিক শোষণ নেই , পর্যাপ্ত খাদ্য আছে কারন কালোবাজারী নেই , ব্রথেল আছে কিন্তু ধর্ষক নেই ! সে অর্থে ভারতবর্ষ আজ সত্যিই স্বাধীন ; এখানে আজ কেউ বলার নেই , ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় । স্বাধীনতার এই দ্বিতীয় যুদ্ধই যেন আমাদের স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধ হয় , আর সে দ্বায়িত্ব নিতে হবে তোমাদেরই ।

স্কুল ছুটির ঘন্টা বেজে উঠল ঢং..ঢং...ঢং...

প্রতিবেদন - সীমা বন্দ্যোপাধ্যায় রায়

সাগরপারের প্রতিবেদন

আনন্দমেলা না স্বাধীনতা দিনের ভাবনা !

সীমা বন্দ্যোপাধ্যায় রায়




মাম ১৮থ অগস্ট আমার ফ্রেন্ড -এর বার্থ-ডে। তুমি জাস্ট আমাকে ড্রপ করে দিতে পারো তবে তোমাকেও যেতে বলেছে। সব ফ্রেন্ডস-এর মাম-দের ইনভাইট করেছে। -কবে? -১৮থ. অগস্ট..এ

-একদম না। সেদিন ইন্ডিয়ান আনন্দমেলা আছে। তুমি তোমার ফ্রেন্ড-কে বলে দেবে সেদিন তুমি এ্যটেন্ড করতে পারবে না। ওখে এ...?

-বাট হোয়াই মাম ? হোয়াট ইজ আনন্দমেলা?

-আর এক...টিও কথা না। আমি কোন- ও কথা শুনতে চাই না। সেদিন বিরাট ফেয়ার আছে। তুমি আরো বেশী এনজয় করতে পারবে সেখানে।

-বাট মাম, সব ফ্রেন্ড-রা আসবে আমি ছাড়া।

নদীর দুই স্রোতের মধ্যে যেটা মুখ্য স্রোত সেটা কখনও বয় চরের উত্তর পূর্ব প্রান্তে কখনও বা চরের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে। এ নিয়ে যে লেখালিখি বা তর্ক করা হয় তা মূলতঃ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে মুখ্য স্রোতের মধ্য রেখার ভাগে পড়ে বলে মনে হয়।

যাই হোক, ৮ বছরের ক্রিশ আর কি করে...পরের দিন স্কুলে গিয়ে বার্থডে বন্ধুকে জানিয়ে দেয় ১৮থ আসতে পারবে না কারণ তার মাম-এর আগে থেকে স্কেডিউল করা আছে। তারা কোনও ইমপর্ট্যান্ড ফেয়ার এটেন্ড করতে যাচ্ছে আর সেটা খুব দরকারি, তাদের যেতেই হবে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল আরেক খুদে বাঙ্গালী ফ্রেন্ড অর্ক। সে বলে উঠল... -আমি জানি। সেদিন মাম আর ড্যাড দের ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স ডে। কিন্তু আমার মামি ড্যাডি যাবে না সেখানে, কারণ বড্ড বোরিং নাকি সেই ফেয়ার। লটস অফ সাউন্ড। গ্লুমি এনভাইরণমেন্ট। -সো হোয়াট... দেয়ার ইন্ডেপেন্ডেন্স ডে। আমরা সেখানে গিয়ে কি করব! মাম তো আমাকে তা বলে নি, বলেছে আনন্দমেলা আছে।

খুদেরা আস্তে আস্তে সব ভু্লে এবার খেলতে লেগে গেল।

১৮থ আগস্ট শনিবার কাজেই ক্রিশ-রা একটু দেরি করে সকালে উঠল। তারপর মা বাবার সাথে ক্রিশও রেডি হয়ে নিল। ক্রিশ-এর মা বাবা আসলে মারাঠি কিন্তু কলকাতার কলেজে পড়ার জন্য বাংলা বলতে পারে। ওরা নাগপুরের বাসিন্দা। এখন আছে টেক্সাসের ডালাস সিটি তে।

ঠিক বিকেল ৪টেয় ওরা স্টার্ট করল আনন্দমেলার উদ্দেশ্যে। মা পড়েছে কমলা শাড়ি আর সবুজ ব্লাউজ আর বাবা সাদা শর্টস আর কমলা টি-শার্ট। ক্রিশ-এর পুরো সাদা জামা আর প্যান্ট। ধুম ধারাক্কা গান শুনতে শুনতে ওরা পৌঁছে গেল বিশাল খোলামেলা মাঠ আনন্দমেলায়।

বিকেল ৫-৩০টা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত চলবে এই মেলা। সে এক এলাহি কান্ড কারখানা। সত্যি চোখ ধাঁধানো মেলা। ক্রিশ তো একেবারে আহ্লাদে টইটুম্বুর। (ক্যারাউজ্যাল) নাগরদোলা থেকে শুরু করে হরেক রকমের খেলা। কত রকমের খাবার দাবার আছে সব সুন্দর সুন্দর বুথ -এ সাজানো, ড্যান্স-ড্রামার জন্য স্টেজ।

মাম ড্যাড-এর সাথে হাত ধরে ঘুরতে লাগল। নানা রকম ফায়ার ওয়ার্ক্স এর কারসাজি সারা আকাশ জুড়ে। খুব ভাল লাগছিল ক্রিশ-এর, মনে মনে ভাবল ওর আর সব ফ্রেন্ডস-রা আসলে বেশ ভাল হোত। হঠাত মাম ড্যাডকে দাঁড়াতে দেখে ক্রিশ ও দাঁড়িয়ে পড়ল... প্যারেড করা ব্যান্ডপার্টির সাথে দেখল একটা কালো গাড়ির(সিটি মেয়র) দুদিকের জানলায় একদিকে আমেরিকার ফ্ল্যাগ আর আরেকদিকে আরেকটা ফ্ল্যাগ-এ অরেঞ্জ আর সবুজ বর্ডারের মাঝখানে সাদা বর্ডার। তার ঠিক সেন্টারে একটা হুইল আছে।

মাম কে জিগেস করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ও ছিল ওর ড্যাডির কাঁধে, তাই ড্যাডিকেই সাহস করে জিগেস করল...অন্য ফ্ল্যাগটা কি, ড্যাডি? আমার হুইল-টা খুব ভাল লেগেছে, জানো তো, ড্যাডি। -ওটা ইন্ডিয়ান ফ্ল্যাগ।

আরো অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু মাম -এর ভয়ে চুপ করে গেল। বাইরে বেশি কথা বলা মাম একদম পছন্দ করে না। ফ্ল্যাগ-টাকে যে খুব ভালবেসে ফেলেছে ক্রিশ।

প্যারেড চলে যাবার পর আবার সবাই হৈ হুল্লোড় করতে লাগল। ওরা রাত সাড়ে ১২টায় বাড়ি ফিরে এল। ক্রিশের একদম বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। কি জমজমাট মেলা।

রবিবার ব্রেকফাস্ট খেয়ে মামি আর ড্যাডির সাথে ইন্ডিয়ান চ্যানেল-এ জি টিভি দেখতে দেখতে খুব এক্সাইটেড হয়ে উঠল ক্রিশ। জিগেস -ই করে ফেলল... -মামি! আমি জানি ১৮থ ছিল ইন্ডিয়ার ইন্ডেপেন্ডেন্স ডে। অর্ক বলেছে আমাকে।

তোমরা কেন বললে ইন্ডিয়ান আনন্দমেলা। আর জি টিভি কেন বলছে ১৫থ ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স ডে? অ্যাম কনফিউজড মাম!

ড্যাডি আর মামি একসাথে বলে উঠল। -তোমাআ...কে জানতে হবে না, এতো। তুমি এই আমেরিকায় জন্মেছো আর ৪র্থ জুলাই এই আমেরিকার ইন্ডেপেন্ডেন্স ডে, এটাই মনে রেখো সব সময়। এমনকি আমরাও এই দেশের সিটিজেন এখন। আন্ডারস্টান্ড!

- ও তাই অর্ক-এর মামি ড্যাডিরা যায় নি আনন্দমেলায়। তারা আমেরিকান্স। তাহলে আমরা কেন গেলাম ফ্রেন্ড-এর বার্থডে-তে না গিয়ে।

-উফস! বড্ড বাজে প্রশ্ন করো আজকাল। কারণ জানি না। আমরা আনন্দমেলায় গেছিলাম, তুমি বেশি এনজয় করেছো, তাই না? যাও তোমার রুমে চলে যাও। ডিস্টার্ব কোরো না।

অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই জনপ্রিয় ছড়াটা অনেকটা এইরকম হয়ে গেল না?
তেলের শিশি ভাঙ্গল বলে খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো
তার বেলা ?

এই আনন্দমেলা আর স্বাধীনতা দিবসের কুইজ-টা লেগেই থাকে এখন। মা বাবার সময় থাকে না, না, নিজেরাই এড়িয়ে যায় খুদে-দের কাছ থেকে এই 'ইন্ডিয়ান ইনডেপেন্ডেন্স' দিনটাকে বোঝানোর হাত থেকে।




তবে দুই যুগ আগে আমি যখন প্রথম এসেছিলাম লুইজিয়ানায়, তখন ১৫ই আগস্ট যে কখন আসত আর কখন চলে যেত জানতেও পারতাম না। তখন আমি আমার সমস্ত ডানা মেলে খুঁজছিলাম আমার ওড়ার আকাশ; আজ আমি ডানা গুটিয়ে বসেছি আমার সাজানো আস্তানায়।

অ-বাঙ্গালীরা অবশ্য একটা ফ্ল্যাগ লাগাত ওদের তৈরী করা বেদিক সোসাইটি-তে। বাঙালি? না না। বাঙ্গালীরা ওখানে যাবে কেন? যে কয়জন হাতে গুণে বাঙ্গালীর বাস, তারা তো অন্য কাজ-এ ব্যস্ত, সময় নষ্ট করার পক্ষপাতি তারা হবে কেন?

কি মুশকিল! আরে, আমিও তো বাঙ্গালী ...কাজেই আমিও যেতাম না। একবার গেছিলাম। কারণ টা অবশ্য-ই নিজেদের পারশোনাল প্রফিট-এর ব্যাপারে। আমার বাপের সরি দাদাদের বাড়ির যে সাইড বিজনেস ইন্ডিয়ান স্টোর! -তার প্রচার করা। খাবারটা গেছিল আমাদের দোকান থেকে। কাজেই আমরা নামক বাঙ্গালীরা সশরীরে হাজির।

জীবনের একটা বড় অংশই তো জীবিকা। জীবিকার অনুরোধে আজেবাজে কাজ না করে উপায় কী? তাই না?

জন গন মন অধি......”- হচ্ছে! হোক না...এদিকে তো খাবার লাইন হয়ে গেছে সেখানে। প্রথমে না দাঁড়ালে তো ঠান্ডা খাবার খেতে হবে, বা শেষমেশ তলানি জুটবে, কাজেই লাইন -এ দাঁড়িয়েই সবাই “জন গণ থেকে বন্দেমাতারম...” গাইতে গাইতে খাবার নিচ্ছে।

ওদিকে দারুণ দেশভক্ত কয়েকজন গায়ে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী আর খালি পায়ে ফ্ল্যাগ উড়িয়ে সব কটা দেশাত্মবোধক গান গেয়ে চলেছে, খুদেরা পিসজা খেয়ে লুকোচুরি খেলে চলেছে তাদের চারপাশে।

আহা! এই অভিবাসী দেশে তাও তো আমরা স্বাধীনতা দিবস পালন করে উদ্ধার করে দিচ্ছি। এরকমটি তো দেখি নি দেশে থাকতে। দেশের স্কুলে থাকতে যাও বা গলার শিড় ফুলিয়ে একটু সবার সাথে গলা মেলাতাম, জব্বলপুরে গিয়ে সেটাও শিকেয় উঠিয়ে দিযেছিলাম...কলেজ বন্ধ থাকত। বাড়িতে ভাত মাছ খেয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা। ব্যাস! ওই পর্যন্ত। কাজেই এই অভিবাসীদেশে আর এটা নতুন কি?

তাও নিউ ইয়র্ক-এ বেশ সাজানো গোজানো গাড়িতে করে দেশ থেকে হিন্দী সিনেমা আর্টিস্টদের নিয়ে প্যারেড হয় আর মানুষ হুমড়ি খেয়ে পরে। স্বাধীনতা দিবস না বলিউড বিগ ম্যান দিবস, বোঝা মুশকিল। আমি খুব একটা টি ভি এডিক্টেড নই, সেই আমিও সাত তাড়াতাড়ি বসে পরি টি ভি-এর সামনে...না না ফ্ল্যাগ ওঠানো দেখব বলে না। ~ আহা! সেই সব ভারত থেকে আসা জ্যান্ত দেবতাদের যাদের টি ভি-র পর্দায় দেখেই চোখ ছানাবড়া করি।

টিভি টা খুলে তাও তো দেখে সবাই। আর আমি? ধ্যুস! বাঙ্গালী তো। ঘরে বসে খালি বড় বড় বাত মারি। আর সবার খুঁত খুঁজে বেড়াই। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণের কথায়ঃ” এই দুনিয়ায় আমি-ই সচ্চা আর সব ঝুটা মাল।”

কই আমরা বাঙ্গালিরা তো কিছু করে দেখাই না? এক বাঙ্গালীদের উৎসবগুলো ছাড়া? আর সেখানেই বা কজন অ-বাঙ্গালী থাকে? অ-বাঙ্গালীদের সাথে মিশবে তবে তো। তারা তো অ-বাঙ্গালী । কই আর তো কেউ বলে না যে, অ-গুজরাতি বা অ-মাদ্রাজী...যাই হোক। আমার না সবতাতেই বাড়াবাড়ি ব্যাপার, এই জন্যেই আমার আজ পর্যন্ত কিছুই হল না। কাজেই আমরা বাঙ্গালীরা তখন হয় আসন্ন পূজার রিহার্সাল বা কারুর বাড়ির পার্টিতে বসে আঁতেল গল্প করছি। মানুষের জীবনে একটা সময় আসে যখন বিত্তের চেয়ে সময়ের মূল্য বেশী।

আমরা খালি দল গড়ি আর দল ভাঙ্গি। ওই যে আছে না, হারাধনের দশটি ছেলে এদিক ওদিক করে একটিতে ঠেকল, ঠিক সেই অবস্থা এই 'আমরা' নামক বাঙ্গালী দলদের। তাই আমি বাবা কোন দলেই আমার নাম লেখাই নি, হাজার ডাকাডাকিতেও এক্কেবারে পিঠে কুলো আর কানে তূলো দিয়ে থাকি। সুস্থ শরীর-কে অসুস্থ করার কি কোন মানে আছে?

দেশের স্বাধীণতাকে স্মরণ করতে গেলে 'স্বরাজ', 'স্বরাজ' বলে চেঁচালে চলবে না-কি? দেশের আজকালকার উঠতি ছেলেমেয়েরা কি বলতে পারবে- কারা ছিলেন শহীদ খুদিরাম, বিনয়-বাদল-দীনেশ, ননীবালাদেবী? এখানকার ছেলেমেয়েদের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম।

এখানে খুদে-দের গল্পচ্ছলে পরিষ্কার করে বোঝালেই তো হয় ভারতের স্বাধী্নতা দিবসের গল্প। তবেই তো ওরা জানবে, ওরা ভালবাসবে মামি ড্যাডির দেশ ভারতবর্ষ-কে।

এখন যারা নতুন প্রজন্মেরা এসেছে তারা কিন্তু অনেক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে, হাতের কাছে ইচ্ছে থাকলেই করতে পারছে, তাহলে তারা পিছিয়ে কেন? এক একটা বড় শহর তো আর আমেরিকানদের একপেশে নয়, সেখানে তো ভারতীয়, চাইনীজ, ভিয়েটনামীজ, জাপানীজদের মার মার কাট কাট, ঠিক যেমন দেশের মুখার্জ্জী পাড়া, বোস পাড়া সেইরকম। আমার তো এক এক সময় মনে হয়, আমরা ভারতের -ই কোন যায়গায় থাকি, অবশ্য-ই আমার এই মাথা মোটা বুদ্ধিতে।

কাজেই বর্তমান ইমিগ্রান্ট-রা যদি চেষ্টা করে, খুদেদের কিন্তু দেশপ্রেমী গড়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। সবাই বলবে খালি মুখে মারিতং জগতং...

আরে বাব্বা! তাই তো স্পিকটি নট হয়ে আছি। কে বাবা কেঁচো খুড়তে সাপ বার করবে?

তবে এটাও ঠিক, জীবন যদি বিচিত্র না হয় তা হলে সাহিত্যও বিচিত্র হতে পারে না। আর আমি তো সত্যি সাহিত্যের কী-ই বা বুঝি? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই তো লিখেছেন, “এরে ভিখারী সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে।”

আমার ও বিশ্বাস ছিল আমিও লিখতে পারব একখানি কি দুখানি রম্যক্লাসিক, যদি অখন্ড মনোযোগ দি আর বিশ্বের জ্ঞানের ভান্ডারে একটু আধটু উঁকিঝুঁকি মারি। অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতন আমারও একটা Tryst with destiny আছে, আমার নিজস্ব স্বাধীনতা থাকবে আমার লেখায়।

দেখুন প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ, সব কথা সকলের নয়। আমি যা বলছি, হয়তো সেটা আমারই কথা। সেটাকে এই অভিবাসী দেশে থাকা সবার কথা বলে বুঝতে গেলেই কিন্তু ভুল বুঝবে্ন। আমাকে গাল দিয়ে বসবেন। একের কথার উপর আরেক মানে চাপিয়েই পৃথিবীতে কিন্তু মারামারি খুনোখুনি হয়।

এবার আমার নিজের কথাটা স্পষ্ট করেই না-হয় আপনাদের বলি। রূপক দিয়েই বলতে ভাল লাগে, নইলে এ-সব কথার রূপ চলে যায়– কথাগুলো লজ্জাবতী লতার মতন করে লজ্জিত হয়ে ওঠে। দেশের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ নাড়ির ভালোবাসারই, কিন্তু সে যেন “ঘড়ায়-তোলা জল– প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব।”

প্রবন্ধ - পার্থপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়

‘বন্দেমাতরম্‌’ সংগীতঃ স্বদেশ ভাবনার মহামন্ত্র
পার্থপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়


‘প্রবাসী’ পত্রিকার কার্তিক ১৩৬৭ সংখ্যায়, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন – গান্ধীজী জাতির জনক, কিন্তু ‘বন্দেমাতরম্‌’ মন্ত্রের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র জাতির মন্ত্রদাতা গুরুদেব।

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার ১২৮৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের প্রথম খণ্ড দশম পরিচ্ছেদে ‘বন্দেমাতরম্‌’ সংগীতটি প্রথম সন্নিবেশিত হয়। যদিও তার অনেক আগে, ১৮৭৫-৭৬ সাল নাগাদ বঙ্কিমচন্দ্র গানটি লিখেছিলেন। শোনা যায় ‘বঙ্গদর্শন’-এর কার্যাধ্যক্ষ কাঁটালপাড়া নিবাসী পণ্ডিত রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একবার, একপাতা ম্যাটার কম পড়ায় সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্রকে কিছু কিছু লিখে দিতে বলেন। বঙ্কিম তাকে আশ্বস্ত করে বলেন – ‘আচ্ছা, আজই পাবে।’ এইসময় পণ্ডিতমশায়ের নজর পড়ে টেবিলে রাখা একটি কাগজের উপর। কাগজটিতে ‘বন্দেমাতরম্‌’ গানটি লেখা ছিল। বোধহয় তিনি সেটা পড়েওছিলেন। পণ্ডিত মহাশয় বলেন – ‘বিলম্বে কাজ বন্ধ থাকিবে, এই যে গীতাটি লেখা আছে – উহা মন্দ নয় ত – ঐটা দিন না কেন।’ একথায় নাকি বঙ্কিমচন্দ্র প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে কাগজটি তৎক্ষণাৎ দেরাজের ভেতর রেখে বলেছিলেন – ‘উহা ভালো কি মন্দ, এখন তুমি বুঝিতে পারিবে না। কিছুকাল পরে উহা বুঝিবে। আমি তখন জীবিত না থাকিবারই সম্ভব। তুমি থাকিতে পার।’ (দ্র. “বঙ্কিমচন্দ্রের বাল্যকথা” পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ) ঠিক একই প্রসঙ্গের উল্লেখ পাই শচীশচন্দ্রের লেখা থেকেও। শচীশচন্দ্র লিখছেন – ‘বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর দুই চারি বৎসর পূর্ব্বে, একদা আমার ভগিনী ( বঙ্কিমচন্দ্রের জ্যেষ্ঠা কন্যা ) তাহার পিতার নিকট ‘বন্দেমাতরম্‌’ গানের কথা তুলিয়াছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র বলিয়াছিলেন, “একদিন দেখিবে – বিশ-ত্রিশ বৎসর পরে একদিন দেখিবে, এই গান লইয়া বাঙ্গালা উন্মত্ত হইয়াছে – বাঙ্গালী মাতিয়াছে।” ( দ্র. বঙ্কিমজীবনী )

বলা বাহুল্য, ‘বিশ-ত্রিশ বৎসর’ যেতে হয়নি; স্বদেশী আন্দোলনের সময়ই ‘বন্দেমাতরম্‌’ গান বিপ্লবীদের মহামন্ত্রে পরিণত হয়। আসমুদ্র হিমাচল ‘বন্দেমাতরম্‌’ ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে। স্বয়ং, রবীন্দ্রনাথ কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে ( ১৮৯৬ ) নিজের দেওয়া সুরে ‘বন্দেমাতরম্‌’ চেয়েছিলেন, দিকে দিকে গড়ে ওঠে ‘বন্দেমাতরম্‌ সম্প্রদায়’। বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা পুরুষ অরবিন্দ ঘোষ প্রকাশ করেন ‘বন্দেমাতরম্‌ পত্রিকা।’ এমনকি তিনি ‘বন্দেমাতরম্‌’ সংগীতের ইংরাজী অনুবাদও করেন। আবার অরবিন্দ মোটেই প্রথম তার
‘বন্দেমাতরম্‌ পত্রিকা’য় বঙ্কিমচন্দ্রকে ঋষি বলে সম্বোধ করেন। রবীন্দ্রনাথ তার “স্বদেশী আন্দোলনে নিগৃহীতদের প্রতি আবেদন”–এ জানিয়েছিলেন—‘অদ্য কঠিন ব্রতনিষ্ঠ বঙ্গভূমির প্রতিনিধিস্বরূপ যেই কয়জন এই দুঃসহ অগ্নিপরীক্ষার জন্য বিধাতা কর্তৃক বিশেষরূপে নির্বাচিত হইয়াছেন তাহাদের জীবন সার্থক। রাজরোষরক্ত অগ্নিশিখা তাহাদের জীবনের ইতিহাসে লেশমাত্র কালিমাপাত না করিয়া বার বার সুবর্ণ অক্ষরে লিখিয়া দিয়াছেঃ বন্দে মাতরম্‌।’

এই ‘বন্দেমাতরম্‌’ ধ্বনি কন্ঠে নিয়ে সেদিন ক্ষুদিরাম – কানাইলাল – সূর্যসেনের দল হাসতে হাসতে ফাঁসিকাঠে প্রাণ দিয়েছে। ১৯২৭ সালে গান্ধীজী একবার ‘বন্দেমাতরম্‌’ প্রসঙ্গে বলেছিলেন –

“When we sing the ode to motherland, “Bande Mataram”, we sing it to the whole of India.” আর ঋষি অরবিন্দের কথায় – “The Mantra has been given and in a single day a whole people had been converted to the religion of patriotism.”

মুক্তগদ্য - পল্লব ভট্টাচার্য্য

ব র্ণ মা লা
পল্লব ভট্টাচার্য্য

যদি বৃষ্টি হয় , তাহলে ছাতা ধরবে কে ? মাথার মধ্যে যে কোনও প্রশ্ন ঘুরপাক খেলেই , মূর্ধণ্য ণ ঘন ঘন সিগারেট খায় আর ধোঁয়া ছাড়ে। বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিলে বুদ্ধিজীবি হওয়া যায় কিনা না জেনেই, প্রশ্ন আর সিগারেট, সিগারেট আর প্রশ্নের মধ্যে ধোঁয়াক্কার এক অবস্থায় মূর্ধ্যণ দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু ছাতার রঙ কী হবে?

ন যেহেতু নাজারত নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, সে বারেবারেই তাগিদ দিতে থাকে। হাজার হোক, ঠিক সময়ে ছাতাটা হাজির করার দায় তার।

‘আরে বাবা, আমি বলি কী, স্বাধীনতা শব্দটার দিকে তাকিয়ে দেখেছো কখনও?’ বলতে বলতে চক্রবর্তীর চোখে-মুখে একটা মিচকি ভাব ফুটে উঠে। ঞ-রা সাধারণত একটু বোকা ধরণের লোক, সবকিছুতেই হুল্লোড় খোঁজে। কিন্তু চক্রবর্তীর এমন কথায় তারা কোনও রগড় খুঁজে পায় না। ফলে যা হয় আর কি, তারা আগের মতোই ঘাড় গুজে বসে থাকে। যতক্ষণ না পতাকা উত্তোলন আর বক্তৃতা শেষ হয়, ততক্ষণ চকলেট বিলির কোনও সম্ভাবনা নেই। সুতরাং বক্তৃতার মাথামুন্ডু কিছু না বুঝতে পেরে অনুস্বররা মাঝে মাঝেই নাক খুটবে বা হাত চুলকাবে ।

তাহলে প্রশ্ন একটা নয়, দু`টো। কে ছাতা ধরবে, এবং সেই ছাতার রঙ কী হবে ? প্রশ্ন দুটোর মধ্যে দন্ত-ন মূর্ধণ্য ণ করতে করতে, আমাদের পতাকা পতপত করে উড়তে থাকে।

বঙ্কিমচন্দ্রের বয়স পার হওয়ার পরও সুপবন না দেখে উহাতে কি লেখা উচিত বোঝা যায় নি। তাই মা যা হইয়াছেন তাহাতেই দিন গুজরান করা ছাড়া, যা হইবেন ভাবিতে কষ্ট হয়।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া এই কষ্ট দূর হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে কিনা - খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিশন গড়ার প্রস্তাব ইতিমধ্যেই বিবেচনাধীন। কোনও না কোনও প্রাক্তনকেই এর প্রধান করতে হবে জেনে, ঠ ইতিমধ্যেই ঠোক্কর দেওয়া শুরু করেছে।

আপাতত , দরজা না খোলা অবধি , ভাবা যাক , সুপবন দেখিলে কোন নাম লিখে দিতে হবে।

‘নাম ? নামে কী আসে যায় ?’ বলতে বলতে আমাদের ঌ (লী) অন্তত সাড়ে তিনবার ডিগবাজি খায়।

কে দেখেছে , কে দেখেছে, বলে চেল্লানোর কোনও দরকার নেই। দাদা-ই সব দেখে । দাদা দেখেছে ।

সুতরাং দাদার হাতে সত্যি সত্যি কলম আছে কিনা, আর থাকলে তা ছুড়ে মারার আদৌ কোনও অভিপ্রায় রয়েছে কিনা - এটুকুই জানা দরকার। কাগজওয়ালারা এই জানা ও না জানার মধ্য দিয়ে একধরণের ডালকুত্তা বানিয়ে বাজারে ছেড়ে দেয়। অতঃপর ঘেউ ঘেউ মার্কা দু’-এক দিনের পর ক্রমশ থিতিয়ে আসা জীবনে, য থেকে জ আর জ থেকে য চক্কর কাটতে কাটতে এক সময় মুখ ঝুলিয়ে বসে থাকে এক ভুল ইতিহাস। স্প্রে পেইন্টার রামলাল সমস্ত ভুলগুলোতে ওয়েল্ডিং, ডেন্টিং আর স্প্রে করে যাচ্ছে। আসলে মেরামতি ছাড়া টিকে থাকা যায়না জেনে সকলেই রামলালের দ্বারস্থ হয়। আজ হবে কাল হবে করে খদ্দেরদের ঝুলিয়ে রাখা ছাড়া তারই বা কী করার আছে ?

খদ্দের ঝুলিয়ে রাখতে পারাটাই ব্যাবসার মূল চাবিকাঠি । পেটে অং বং কং কালির অক্ষর কিছু না থাকলেও, এই চাবিকাঠিটি জানা থাকলে আটকায় কার সাধ্যব! আপনি থাকছেন স্যার। অতএব আছেন। দুই দিকে দুই রুই কাতলা ভেসে উঠেছেন।

জলের তলায় কী ?

এই প্রশ্নে গ্রাম গঞ্জে এখনও উত্তর আসে ,-একটু আস্তে চল না ঠাকুরঝি । গ সেই আস্তে চলা গরুর গাড়ির সওয়ার । চলছে তো চলছেই । চলতে চলতে গাধা হচ্ছে , গাড়ল হচ্ছে । জেট গতির কাছে গাইয়া হয়ে হাত কচলাচ্ছে । আর ভার্চুয়ালের দুনিয়ায় তখন গ থেকে গ্লোবাল হয়ে, ঘোড়েল হয়ে উঠছে দুনিয়া ।

মূর্ধণ্য ণ জানে, ঞ-দের দুনিয়া থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে সে। ঞ থেকে মূর্ধণ্য ণ অবধি দূরত্বে একটিই অগ্রগতি এক্সপ্রেস। চুনোপুঁটিরা এই এক্সপ্রেসে উঠিতে পারে নাই। তারা মালগাড়ির অপেক্ষায় …..

চক্রবর্তী ঘুড়ির সুতায় মাঞ্জা দিতে দিতে বললেন, ‘বয়ের কাঁধে না চড়লে তোমাদের স-এর স্বাধীনতাই আসে না বাবাসকল। খুব যে কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায় করছো ! বলি, দীর্ঘ-ঈ ছাতা না ধরলে ভিজে একসা হয়ে যাবে না ?

ঞ-রা কিছুই না বুঝে , এমন সময় বেমক্কা হাততালি দিয়ে উঠলে, গ-জ মার্কা থাম চারটি কেঁপে উঠল। আজ মেঘলা। বজ্র ও বিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা জানিয়া মূর্ধণ্য ছাতার খোঁজ করতে লাগল। নাজারতের ন-বাবু ছাতার সর্বজনগ্রাহ্য রঙ নিয়া ব্যস্ত। কিছুতেই মনস্থির করতে পারে না । তখনই হিন্দি সিনেমার পর্দা জুড়ে ঘোড়ার চিঁহিঁ ডাক, “ম্যায় আজাদ হু……” !!!

চক্রবর্তী আর কথা বলে না। চুপচাপ বাদাম ভাঙে আর সিনেমা দেখে।

অনুবাদ কবিতা - কৌশিক ভাদুড়ী

ওড়িয়া ভাষার কবি শ্রী রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডা রচিত “দ্রোহ বাক্য” কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘শিশুপালের উক্তি’ কবিতাটির অনুবাদ করলেন কবি কৌশিক ভাদুড়ী ।

শিশুপালের উক্তি


ভীম সুন্দর শিকারি পক্ষীটির ঘোর শনশন ঠাটে
আলোকজিত্ গতিতে
তেড়ে আসার দৃশ্য ভারি উন্মাদক ।

ছিন্ন শির খসে পড়ার কালে
কেই বা কবে দৃষ্টি রাখে
রত্নমুকুট পড়ল কত দূরে
সমবেত উদ্যোগীদের ভিতর কার বেশি হাতের কাছে!

নির্দিষ্ট নির্ঘন্ট ভিতরে রক্ত-পরত না পড়লে
জং ধরে যায় ধাতুতে,
অস্থিতে লবণ-চর পড়ে,
চর্মরোগের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়
ছাতির শ্রীবত্স চিহ্ন তোমার!

অর্চনা তোমার সম্ভব নয়,
যুগে যুগে আমার
ঘোর ঘর্ঘর ভর্ত্সনা না হলে!

মুণ্ডু কাটা যাওয়ার পরই
পুনরায় আমার শরীর চতুর্ধা মূর্তি ধরে,
মৃত্যুকে আলিঙ্গন-পাশে নিলে বোঝা যায় সে রুক্মিণী!

একদিন হয়তো অনন্ত মৃত্যুর অনুভবে
রুক্মিণীময় হয়ে যাবে আমার
প্রতীপ অমরত্বের প্রত্যেক মুহূর্ত-
কবে আসবে পরিণতির সে মহালগ্ন কে জানে!
..........................
টীকা- “চতুর্ধা মূর্তি”- পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রা দৃশ্যত ত্রিমূর্তি হলেও, সুদর্শন চক্রের উপস্থিতি হেতু অনেক মতে এই রূপে অভিহিত করা হয়। সম্ভবত শিশুপাল নিধনের সঙ্গে এই ভাবেই কথাটি সম্পর্ক রাখে।
- অনুবাদক কৌশিক ভাদুড়ী।

অনুবাদ প্রবন্ধ - অত্রি ভট্টাচার্য্য

এক মুসলিম যুবককে খোলা চিঠি
তারেক আলী, অনুবাদঃ অত্রি ভট্টাচার্য্য
তারিক আলী রচিত “Clashes of Fundamentalisms” (Verso, ২০০৩) গ্রন্থ থেকে  “Letter to an young Muslim”
প্রবন্ধের অনুবাদ করলেন অত্রি ভট্টাচার্য্য

প্রিয়বরেষু,

মনে আছে, ২০০১-এর নভেম্বরে সেই বিরাট যুদ্ধবিরোধী সমাবেশের পরে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করেছিলে (যদ্দূর মনে পড়ছে, গ্লাসগো-য় ) এবং জানতে চেয়েছিলে আমি ধর্মবিশ্বাসী কিনা? যখন আমি বলেছিলাম, “না”, তখন তোমার বিস্মিত মুখ আমি ভুলিনি, বা ভুলিনি তোমার বন্ধুর মন্তব্য (‘আমাদের অভিভাবকেরা আপনার ব্যাপারে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন’), বা তীরের মত এসে বেঁধা তোমাদের গরম প্রশ্নগুলো ! এগুলি আমাকে খুব ভাবিয়েছে, এবং তোমার ও তোমার মত ইউরোপ-উত্তর আমেরিকার আরোও যারা এইধরনের প্রশ্ন করেছে তাদের কাছে এই আমার উত্তর।

যখন আমরা কথা বলি, আমি তোমাকে বলেছিলাম, ধর্মের বিরুদ্ধে আমার সমালোচনা এবং যারা একে রাজনৈতীকভাবে ব্যবহার করে, তা প্রকাশ্যে কূটনীতি প্রদর্শনের জন্যে না । অত্যাচারী ও শোষকেরা চিরকাল ধর্মকে স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্যে ব্যবহার করেছে। অবশ্য এইটুকুই সব নয়। পৃথিবীর সর্বত্রই প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসী বহু মানুষ আছেন, যারা গরীবের পক্ষ নিয়ে লড়াই করে থাকেন, কিন্তু তারা সংগঠিত ধর্ম নিয়ে নিজেরাই দ্বন্দ্বে জড়িত।

কর্মী বা গ্রাম্য পুরোহিত যারা দমননীতির বিরোধীতা করেছিল, ক্যাথলিক চার্চ তাদের দোষী সাব্যস্ত করে। যেসব মুসলিম সামাজিক চরমপন্থার পক্ষে কথা বলেছিল, ইরানী আয়াতোল্লা-রা তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়। যদি আমি সত্যিই বিশ্বাস করতাম, এই চরমপন্থী ইসলাম মানবতার উত্তরণের পথ, তবে তা প্রকাশ্যে স্বীকার করতেও দ্বিধা বোধ করতাম না, তার ফলাফল যাই হোক না কেন। আমি জানি তোমার অনেক বন্ধু “ওসামা” নামটি উচ্চারন করতে ভালোবাসেন এবং নয়-এগারো নিয়ে তারা খুব খুশী। এরা একাই নয়, এটা সারা পৃথিবীতেই হয়েছে এবং এর সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। আমি শুনেছি আর্জেন্টিনায় শিক্ষক ওসামার সমালোচনা করায় ছাত্ররা ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমি জানি এক রাশিয়ান যুবক একটি এক শব্দের মেল করেছিল তার বন্ধুদের, যাদের বাবা-মা –রা নিউইয়র্ক-এর বাইরে স্থায়ী – ‘অভিনন্দন’ – আর তারা জবাব দিয়েছিলঃ ‘ধন্যবাদ। এটা দারুণ হয়েছে।’ মনে আছে, আমরা কথা বলেছি, যে ফুটবল মাঠে গ্রীক জনতা দু মিনিট নীরবতা পালনের সরকারী নির্দেশ মানেনি, বদলে আমেরিকাবিরোধী গুঞ্জনে মুখর হয়েছিল।

কিন্তু এর কোনোটাই আলোচ্য ঘটনা সমর্থন করে না। দুঃখের বদলে এই যে আনন্দ, এর পেছনে কোন শক্তি নয়, বরং এক সাংঘাতিক দুর্বলতা রয়ে গিয়েছে। ইন্দোচীনের মানুষ আমেরিকার হাতে যা সহ্য করেছে, কোন ইসলাম দেশ তা করেনি। সেখানে ১৫ বছর টানা বোম্বিং হয়েছে আর অজস্র মানুষ নিহত হয়েছে। তারা কি আমেরিকায় পাল্টা বোম ফেলার কথা একবারও ভেবেছে? কিউবাবাসীরা, চিলিয় বা ব্রাজিলিয়-রাও ভাবেনি। শেষ দুটি দেশ নিজেদের সীমানায় আমেরিকার পৃষ্ঠপোষিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়েছে এবং শেষপর্যন্ত জিতেছে।

আজকাল, মানুষ নিজেকে বড় অসহায় ভাবে। তাই, আমেরিকার উপর আঘাত আসায় তারা উৎসব করছে। এসব করে কি হবে, এর ফল কি হবে, তাতে কার লাভ - সেসব তারা বুঝতেও চায় না। তাদের প্রতিক্রিয়াও, এই ঘটনাটির মতোই, পুরোপুরি প্রতীকি। আমার মতে ওসামা আর তার দলবলের রাজনৈতীক পথ শেষ হয়ে গেছে। নয়-এগারো এক বিরাট আতসবাজির শো বই কিছু নয়। আমেরিকা, পাল্টা এক যুদ্ধ দিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার সন্দেহ আছে, এ থেকে আদৌ অন্ধকার ভবিষ্যতটুকু বদলাবে কিনা। এই ঘটনা আমেরিকার অভিধানে এক টিকা বা টিপ্পনী হিসেবে থেকে যাবে। রাজনৈতীক, অর্থনৈতীক বা সামরিক অর্থে এটা স্রেফ একটা আলপিনের খোঁচা ছিল।

ইসলামীয়দের কি দেবার আছে? এমন এক অতীতের পথনির্দেশ, সপ্তম শতকের মানুষের সৌভাগ্যবশতঃ যার কোনোদিন কোন অস্তিত্ব ছিল না। যা তারা সারা পৃথিবীর ঘাড়ে চাপাতে চাইছে, ‘শাহী আফগানিস্তান’ যদি তার নমুনা হয় তবে তো বেশীরভাগ মুসলিম তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেবে ! ওসামা বা মোল্লা ওমর ইসলামের ভবিষ্যত – এ কথা ভাবাও যায়না ! সেটা হলে, আমাদের উভয়ের সংস্কৃতির পক্ষেই খুব মারাত্মক জিনিস ঘটবে ! তুমি কি তার মধ্যে বাস করবার কথা ভাবতে পারো? তুমি সহ্য করতে পারতে, যদি তোমার মা, বোন বা প্রেমিকা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে বাধ্য হত, আর শুধু মৃত মানুষের মত মুখ ঢেকে বাইরে বেরোবার অনুমতি পেত?

তোমাকে সোজাসুজি বলি, আমি হালের আফগান যুদ্ধের বিরোধীতা করেছি। বৃহৎ একচেটিয়া শক্তি নিজেদের ইচ্ছামত সরকারের পরিবর্তন ঘটাক, এ আমি কোনমতেই চাই না। কিন্তু তালিবানরা যখন দাড়ি কামিয়ে বাড়ি পালিয়ে গেছে, আমি তাদের জন্যে একফোঁটা চোখের জল-ও ফেলিনি। এর মানে এও নয় যে, যারা ধরা পড়েছে তাদের সঙ্গে পশুর মত ব্যবহার করতে হবে, বা জেনিভা কনভেনশন-অনুযায়ী প্রাপ্ত তাদের সাধারন অধিকার লঙ্ঘন করতে হবে, তবে আমার আপত্তি অন্য জায়গায়; এই মূহুর্তে বিশ্বে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মৌলবাদের কোন জুড়ি নেই। তারা ইচ্ছামত যে কোন আইন অথবা চুক্তি ভাঙতে পারে। আফগানিস্তানে অন্যায়ভাবে যুদ্ধ চালানোর পরে তারা এই যে খোলাখুলি যুদ্ধবন্দীদের অত্যাচার করছে, তার একটাই কারণ – তারা পৃথিবীকে তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায়, আর তাদের এই নোংরামি দিয়ে কিউবার মাটিকে অপবিত্র করতে চায়। সবাইকে দেখিয়ে দিতে চায় সিংহের ল্যাজ মোচড়ালে তার শাস্তি কী মারাত্মক হতে পারে !

আমার মনে আছে, ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে সিআইএ আর তাদের দেশীয় আঞ্চলিক দালালরা কিভাবে যুদ্ধবন্দীদের উপরে অত্যাচার আর ধর্ষন চালিয়েছিল ! ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকা জেনিভা চুক্তির প্রায় সমস্ত ধারাই অগ্রাহ্য হয়। তারা বন্দীদের পশুর মত মারত, মহিলাদের ধর্ষন করত, বন্দীদের হেলিকপ্টার থেকে মাটিতে ফেলে দিত বা সমুদ্রের জলে ডুবিয়ে মারত আর এ সবই হত, বলাই বাহুল্য, স্বাধীনতার নামে।

যেহেতু পশ্চিমের অনেকে এখনো “মানবিক অনুপ্রবেশ” জাতীয় গাঁজাখুরিতে বিশ্বাস করে, তারা এসব দেখেশুনে হাঁ হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু গত শতাব্দীতে সাম্রাজ্যবাদ-কৃত অপরাধের তালিকার তুলনায় এ তো কিছুই নয় ! নয়-এগারোর পরে আমি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আমাদের আরোও অনেকের সঙ্গে দেখা করেছি। একটা প্রশ্ন বারবার শুনতে হয়েছেঃ ‘আমরা মুসলিমরা কি এতই বুদ্ধিমান যে এমনি একটা কাণ্ড ঘটাব?’ আমি সবসময় বলি, ‘হ্যাঁ’, তারপরেই জানতে চাই, তাদের মতে কে এর জন্যে দায়ী? এবং একই উত্তর আসে ‘ইজরায়েল’। কেন? ‘আমাদের দোষী বানিয়ে আমেরিকাকে আমাদের দেশ আক্রমন করানোর জন্য’ আমি আস্তে আস্তে তাদের উৎসাহিত ভুল ধারণাগুলির মূলোদ্ধার করি, কিন্তু এসব কথা বলতে গিয়ে কষ্ট-ও পাই খুব। কেন এত এত মুসলিম এই জগদ্দল ধারণায় ডুবে গেল? নিজেদের প্রতি এত সহানুভূতি কোথা থেকে এল এদের মধ্যে? এদের আকাশ সবসময় অন্ধকার হয়ে থাকে কেন? কেন নিজেদের ছেড়ে শুধু অন্য কাউকে দোষারোপ করতে হবে?

মাঝে মাঝে যখন আমি ঘুরে বেড়াই, আমার মনে হয় এমন কোন ইসলাম রাষ্ট্র নেই যাদের মধ্যে একফোঁটা গর্ববোধ অবশিষ্ট আছে। যারা দক্ষিণ এশিয়া থেকে এসেছে তারা সৌদি আরব বা গাল্‌ফ দেশগুলির থেকে ব্রিটেনে অনেক বেশী সমাদর পায়। এখন কিছু একটা না হলেই নয় ! আরব বিশ্ব পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে আছে। বছরের পর বছর, ইরাকী, সিরীয়, সৌদি, মিশরীয়, জর্ডনীয়, প্যালেস্তিনীয়দের সঙ্গে প্রতিটি আলোচনায় বারবার একই প্রশ্ন উঠেছে, একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। আমাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কেন আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। সবকিছু যেন থমকে রয়েছেঃ আমাদের অর্থনীতি, আমাদের রাজনীতি, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা, এবং সর্বোপরী আমাদের ধর্ম।

প্যালেস্তাইন রোজ মার খাচ্ছে। পশ্চিম তা দেখেও দেখছে না। আমাদের সরকারগুলি সব মৃত। আমাদের রাজনীতিবিদরা কোরাপ্ট। আমাদের জনগণ অবহেলিত। কেউ যদি ইসলামীদের দিকে হাত বাড়িয়েই দেয়, তবে এতে আশ্চর্য্যের কি আছে? আর কে আছে আমাদের পাশে আজকাল? আমেরিকা? সে তো গণতন্ত্রই চায় না, এমনকি কাতারের মত ছোট্ট দেশেও চায়নি এবং তার একটাই সোজাসাপ্টা কারণ। যদি আমরা আমাদের সরকার নির্বাচিত করি, তবে তারা হয়তো আমেরিকার ঘাঁটিগুলি গুটিয়ে নেবার দাবী জানাবে। তাই না? ওরা এর মধ্যেই আল জাজিরা টেলিভিশনকে আর সহ্য করতে পারছে না, কারণ আল জাজিরা ওদের কোন কোন ব্যাপারে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে। এই একই চ্যানেল যখন আরব উচ্চবিত্তদের কোরাপশন নিয়ে আঘাত করেছিল, তখন কোন সমস্যা ছিল না। নিউ ইয়র্ক টাইমসে টমাস ফ্রিডম্যান তো গোটা একটা কলাম জুড়ে আল জাজিরার প্রশস্তি গেয়েছিলেন। তিনি এর মধ্যে আরবে আসন্ন গণতন্ত্রের আভাস খুঁজে পেয়েছিলেন। তবে আর নয় ! কারণ গণতন্ত্র মানে ব্যাতিক্রমী চিন্তাভাবনার জায়গা, আর আল জাজিরা আফগান যুদ্ধের যে ছবি দেখিয়েছে, মার্কিন চ্যানেলগুলিও তা দেখায়নি, সেজন্যে বুশ আর ব্লেয়ার যুগপৎ কাতারের উপরে চাপ সৃষ্টি করলেন অপ্রীতিকর সম্প্রচার বন্ধ করার জন্য।

পাশ্চাত্যের কাছে গণতন্ত্র হচ্ছে, যা তারা বিশ্বাস করে তাতেই চিরকাল পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখা। এই কি প্রকৃত গণতন্ত্র? আমরা যদি আমাদের সরকারকে নির্বাচিত করতে পারি, দুই-একটি দেশে মুসলিম সরকার-ও নির্বাচিত হতে পারে। পাশ্চাত্য কেন আমাদের মুক্তি দেয় না? ফরাসী সরকার কি আলজিরিয়ান মুক্তিযোদ্ধাদের ছেড়ে দিয়েছিল? না। তারা চেয়েছিল, ১৯৯০ আর ৯১-এর নির্বাচনকে শুন্য ও ফাঁপা ঘোষনা করা হোক। ফরাসী বুদ্ধিজীবীরা Front Islamique du Salut (FIS)-কে ‘ইসলামী ফ্যাসিস্ত’ রূপে বর্ণনা করেছিল, তাদের নির্বাচনে জয়লাভের তথ্যকে সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করে। তাদের সরকার গড়তে দিলে, তাদের মধ্যে বর্তমান দলাদলি সামনে চলে আসত। সেনাবাহিনী সতর্ক করতেই পারত, জনগনের সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপ কোন অবস্থাতেই মেনে নেওয়া হবে না। শেষে যখন FIS-এর আসল মাথারা কাটা পড়ল তখনই আরোও লুম্পেন এলিমেন্ট প্রকাশ্যে এল এবং অরাজকতা ছড়াতে লাগল। আমরা কি তাদেরকে গৃহযুদ্ধের জন্যে দায়ী করব, নাকি আলজিয়ার্স ও প্যারিসের যেসব মাথা এদেরকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছিল, তাদের? আলজিরিয়ায় যে ধ্বংসজজ্ঞ চলেছে তা ভয়াবহ ! তার জন্যে কি শুধু ইসলামরাই দোষী? কি হয়েছিল ২২.৯.১৯৯৭ তারিখে আলজিরিয়ার দশ মাইল দক্ষিণে বেনতালা (Bentalha) শহরে? কারা সেদিন রাতে সেই শহরের ৫০০ পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করেছিল? কারা? ফরাসীদের মধ্যে সবজান্তা, বার্নার্ড-অঁরি লেভি ( Bernard-Henri Lévy ) নিঃসন্দেহ যে, এই জঘন্য কর্মকাণ্ডের পেছনে মুসলিমদেরই হাত ছিল। তাহলে কেন সেনারা স্থানীয় জনতাকে আত্মরক্ষার্থে সশস্ত্র থাকতে দিল না? স্থানীয় মিলিশিয়াকে কেন সেদিন রাত্রেই এলাকা ছাড়তে বলা হল? সব কিছু চোখের সামনে ঘটা সত্ত্বেও সুরক্ষাবাহিনী কেন এল না? মঁসিয়ে লেভি কেন মনে করেন, Maghreb জনগণের হিতকল্পে অধিগ্রহন করা উচিত, অথচ কেউ এই মৌলবাদী চিন্তার প্রতিবাদ পর্যন্ত করে না?

আরব-রা বলে, আমরা জানি কি করতে হবে, অথচ পশ্চিম এসে নাক গলালেই তাদের হাবভাব পাল্টে যায় – এমন দীর্ঘদিন ধরেই ঘটছে। তাই, যদি তারা সাহায্য করতে চায়, তারা দূরে থাকুক। এটা আমার আরব বন্ধুদের বক্তব্য, এবং আমি তাদের সঙ্গে সম্পুর্ন সহমত। ইরানের দিকে তাকান। আফগানিস্তান দখলের সময় পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গী বদলে গিয়ে নরম হয়েছিল। ইরান যুদ্ধের সময়-ও তাদের প্রয়োজন ছিল, অথচ সে সময় তারা দূর থেকেই দেখে গিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী মৌলবাদীরা বলছে ‘axis of evil’-এর কথা, যার মধ্যে ইরান-ও পড়ে। সেখানে অনুপ্রবেশের ফল প্রাণঘাতী হতে পারে। নতুন প্রজন্ম কেরানীতন্ত্রের দমননীতি দেখেছে। এরা কিচ্ছু মানেনি। শাহ্‌-এর কিংবদন্তী এই প্রাগিতিহাসের অঙ্গ। এই যুবক-যুবতীরা আর কিছু না হোক, অন্ততঃ একটি ব্যাপারে নিঃসন্দেহ। এরা আর আয়াতোল্লাদের শাসন চায় না। যদিও সাম্প্রতিককালে ইরান, সৌদি আরব বা ‘শাহী আফগানিস্তান’-এর মত দুঃসহ নয়, তবু আয়াতোল্লারা লোকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।

তোমাকে একটা গল্প বলি শোনো। বচ্ছর কয় আগে লস আঞ্জেলেসে আমার সঙ্গে এক নবীন ইরানী চিত্রপরিচালকের দেখা হয়েছিল। তার নাম মোসলেম মানসৌরি। সে তার নির্মীয়মান তথ্যচিত্রের জন্যে তোলা দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার সাক্ষাৎকার সঙ্গে নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিল। সে তেহরানের জনাতিনেক বেশ্যার বিশ্বাস অর্জন করে এবং দুই বৎসর ধরে তাদের ছবি তোলে। আমাকে সেসব ফুটেজের কিছু কিছু দেখিয়েছিল। তারা ওর সাথে বেশ খোলাখুলিই কথা বলেছিল। তারা বলেছিল ধর্মীয় উৎসবগুলিতেই তাদের সবচেয়ে ভালো ব্যবসা হয় ! আমার কাছে পাঠানো নমুনাগুলি থেকে আমি তথ্যচিত্রটির একটি আভাস পেয়েছি। একজন মহিলা তাকে বলছেনঃ ইদানিং প্রত্যেকে তাদের শরীর বেচতে বাধ্য হচ্ছে ! আমাদের মত মেয়েদের মাত্র ১০,০০০ তুমানের বদলে পুরুষের সঙ্গে শুতে হয়। যুবকদের ১০ মিনিটের জন্যে হলেও একসাথে বিছানায় যেতে হয়.........এসব এদের মৌলিক চাহিদা.........এতে ওরা শান্ত থাকে।

‘সরকার যখন এটা নিষিদ্ধ করে, বেশ্যাবৃত্তিও বেড়ে যায়। বেশ্যাবৃত্তি ত দূরের কথা, সরকার বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে প্রকাশ্যে কথাবার্তা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। ......পার্কে, সিনেমায়, রাস্তায় তুমি তোমার পাশে বসা মানুষটির সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। রাস্তায় যদি কোন মেয়ে কোন ছেলের সাথে কথা বলে, ‘ইসলামের রক্ষক’-রা তাদেরকে ঘন্টার পর ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করবে। আজকাল আমাদের দেশে, কেউ তৃপ্ত নয় ! কারুর কোন নিরাপত্তা নেই। আমি একটা কোম্পানিতে কাজের খোঁজে গিয়েছিলাম। দাড়িওলা ম্যানেজার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকে চাকরী দেব আর মাইনের থেকে ১০,০০০ তুমান বেশী দেব।’ আমি বললাম, ‘আপনি অন্ততঃ আমার কম্পিউটার জ্ঞানটুকু পরখ করে দেখুন আমি এই কাজের উপযুক্ত কিনা।’ তিনি জবাব দিলেন, ‘আমি তোমাকে চাকরী দেব তোমার সৌন্দর্য্যের জন্যে।’ আমি বুঝলাম, আমাকে যদি ওখানে কাজ করতে হয়, তাহলে রোজ ওই ভদ্রলোকের সাথে অন্ততঃ একবার করে শুতে হবে।

যেখানেই যাও, সর্বত্র একই চিত্র। আমি এক বিশেষ পরিবার-আদালতে গিয়েছিলাম, বিবাহবিচ্ছেদের জন্য – এবং বিচারক, একজন পাদরী, তার কাছে ভিক্ষা চেয়েছি আমার সন্তানের দায়িত্ব আমাকে দেবার জন্যে। আমি তাকে বলি, ‘প্লিজ......দয়া করে আমাকে আমার সন্তানের দায়িত্ব নিতে দিন। আমি আপনার ‘কানিজ’ হতে রাজী [ ‘কানিজ’ (Kaniz) অর্থে ঝি/ চাকর……এটা একটা ফারসী ব্যাজস্তুতি, যার মানে হল, ‘আমি এর জন্যে যা সম্ভব তা করতে পারি।’] সেই ভদ্রলোক কি বললেন ভাবতে পারো? তিনি বললেনঃ “আমার কোন ঝি লাগবে না। আমি একটা মেয়ে চাই।” একটা আদালতের বিচারক, একজন পাদরী যখন একথা বলছে, তখন তুমি বাকিদের কাছ থেকে কী আশা করবে? আমি আমার বিচ্ছেদের কাগজ সই করাতে অফিসারের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বিবাহবিচ্ছেদ করতে নিষেধ করলেন, তার বদলে বেআইনীভাবে আরেকটা বিয়ে করতে বললেন। কারণ স্বামী ছাড়া নাকি আমার পক্ষে কোন কাজ পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। উনি ঠিকই বলেছিলেন, কিন্তু আমার কাছে ওনার পারিশ্রমিক দেবার মত টাকা ছিল না......এসব অভিজ্ঞতা বয়স অনেক বাড়িয়ে দেয়......মানুষের উপরে চাপ এত বাড়ে, যে তাতে ক্ষতি হয়। যদি এর থেকে মুক্তির কোন উপায় থাকত......’

কোন আমেরিকান নেটওয়ার্ক তার ফিল্ম না কেনায় মোসলেম হতাশায় প্রায় উন্মত্ত হয়ে পড়েছিল ! এরা খতমী-র রাজত্বে নাড়া দিতে চায় নি। মোসলেম নিজেই এক বিপ্লবের সন্তান। বিপ্লবী না হলে সে আদৌ এই ছবি বানাতে চাইত না। সে খুব দরিদ্র পরিবারে জন্মেছে। সে ইরাক যুদ্ধে অংশ নিতে অস্বীকার করেছিল। তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এই অভিজ্ঞতা তাকে আমূল বদলিয়ে দেয়। ‘জেলখানা খুব কষ্টকর হলেও মূল্যবান অভিজ্ঞতা ছিল আমার কাছে। এখানে থাকার ফলেই আমি টের পেয়েছিলাম আমি আমার চেতনাগত পরিণতির দিকে পৌঁছেছি। আমি প্রতিবাদ করছিলাম, অন্তর্নিহিত শক্তির অস্তিত্ব বুঝতে পারছিলাম। আমার মনে হয়েছে, আমি আমার জীবনকে নৈতীকভাবে দূষিত পাদরীদের শাসন থেকে মুক্ত করেছি, এবং তার জন্যে আমাকে এই মূল্য চোকাতে হচ্ছে। আমি গর্ববোধ করতাম। একবছর পরে ওরা আমাকে বলল, আমাকে একটিমাত্র শর্তে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমাকে লিখিতভাবে জানাতে হবে যে আমি প্রতি জুম্মাবারের নামাজ এবং অন্যান্য ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহন করব। আমি সই করিনি। ওরা আমাকে আরো একবছর জেলে বন্দী করে রাখল।’

এর পরে সে একটা চলচ্চিত্র পত্রিকায় সাংবাদিকের কাজ নেয়। ‘আমি ভেবেছিলাম সংবাদমাধ্যমের চাকরীটা আমার নিজের কাজ, মানে রাজনীতির মসনদের ভিতর ঘটে চলা জঘন্য অপরাধগুলি নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ - এর একটা মুখোশ হবে। আমি জানতাম, আমি যে ধরনের ছবি তৈরী করতে চাই, সেন্সরবোর্ডের নীতিনিয়ম আমাকে তা করতে দেবে না। যা নিয়েই লিখি না কেন, ইসলামিক সেন্সরবোর্ড আমাকে তা প্রকাশ করতে বাধা দেবেই। জানতাম এর ফলে শুধু সময় নষ্ট আর শক্তিক্ষয় হবে। তাই আমি গোপনে আটটি তথ্যচিত্র বানাবো স্থির করি। আমি চোরাপথে এই ফুটেজগুলো ইরাণের বাইরে পাচার করি। টাকাপয়সার সমস্যা থাকায় মাত্র দুটি ফিল্মের সম্পাদনার কাজ সম্পুর্ন হয়। প্রথমটা “Close Up, Long Shot” আর অন্যটা “Shamloo, The Poet Of Liberty”

প্রথম ছবিটার বিষয় ছিল আব্বাস কিয়েরোস্তামির ড্রামা-তথ্যচিত্র “Close Up”-এর প্রধান চরিত্র হোসেন সাবজিয়ানের জীবন। কিয়েরোস্তামির ছবিটি বেরনোর কয়েক বছর আমি সাবজিয়ানের সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি সিনেমা ভালোবাসেন। তার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা তার প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে শেষে বিদায় নিয়েছে। আজকাল তিনি তেহরানের সীমান্তবর্তী এক গ্রামের থাকেন, এবং এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, সিনেমার প্রতি তার প্রেম শুধু দুর্ভাগ্যই বয়ে এনেছে। আমার ছবিতে তিনি বলছেন, “আমরা যে সমাজে বাস করি, সেখানে আমার মত মানুষ ধ্বংসই হয়ে যায়। আমরা নিজেদের কখনোই তুলে ধরতে পারিনা। দুধরনের লাশ হয়ঃ শায়িত আর চলন্ত। আমরা হলাম চলন্ত লাশ !”’

এইরকম এবং এর চেয়েও খারাপ গল্প আমরা প্রতিটি মুসলিম-অধ্যুষিত দেশে খুঁজে পাব। ডায়াস্পোরা মুসলিম, যাদের অভিভাবকেরা পশ্চিমে চলে গিয়েছেন, আর ইসলামের খাসমহলে বসবাস করা মুসলিম – এদের মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য আছে। দ্বিতীয় দলভুক্তরা অনেক বেশী প্রতিবাদী, কারণ ধর্ম তাদের পরিচয়ের খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়। স্বাভাবিকভাবেই তারা মুসলিম। ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় চিত্রটি একটু ভিন্ন। একধরনের সার্বজনিন বহুসংস্কৃতি সবকিছুর মূল্যে এখানে এক বিরাট তফাৎ গড়ে দিয়েছে। এর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে চরমপন্থী রাজনীতির পতনের একটি সুস্পষ্ট যোগ চিহ্নিত করা যায়।

‘সংস্কৃতি’ আর ‘ধর্ম’ হল আর্থসামাজিক অসাম্যের অপেক্ষাকৃত নরম, মুখরোচক প্রতিশব্দ – যেমন, স্তরবিন্যাসের পরিবর্তে বৈচিত্র্য হল ইদানিং উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপীয় সমাজের অন্যতম চর্চার বিষয়। আমি কথা বলেছি মেঘরাব (ফ্রান্স), আনাতোলিয়া (জার্মানী), পাকিস্তান ও বাংলাদেশ (ব্রিটেন), দক্ষিন এশিয়া থেকে স্ক্যাণ্ডেনেভিয়ায় আগত এবং প্রায় সর্বত্র থেকে আসা (আমেরিকা) মুসলিমদের সঙ্গে। আমি প্রায়ই নিজেকে জিজ্ঞেস করি, এত লোক তোমার মত মনে মনোভাব পোষন করে কেন? এরা কাশ্মীর আর পাঞ্জাবের বলশালী ও সতেজ গ্রামবাসীদের থেকে অনেক বেশী রক্ষনশীল ও অনমনীয় হয়ে পড়েছে, যাদের আমি খুব কাছ থেকে চিনতাম।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অদ্বৈতবাদী স্কুলের উপরে অগাধ বিশ্বাসী। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি তার প্রতিটি বক্তৃতা শেষ করেন ‘ঈশ্বর আমেরিকাকে রক্ষা করুন’ বলে। ওসামা প্রতিটি টিভি সাক্ষাৎকারের শুরু ও শেষে আল্লার নামে শপথ নেয়। এদের প্রত্যেকের যেমন এসব বলার অধিকার আছে, আমারও তেমনি অধিকার আছে চৈতন্যপ্রাপ্ত মূল্যবোধগুলির কাছে বিশ্বস্ত থাকার। চেতনা ধর্মগুলিকে আক্রমন করেছে –খ্রীষ্টধর্মকে, মূলতঃ – দুটি কারণেঃ প্রথমতঃ, এটা একটা আদর্শগত ভুল ধারণা, আর দুই, এটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়নতন্ত্র, নিগ্রহ এবং অসহিষ্ণুতার অশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন। আজ কেন আমরা এই দুই ঐতিহ্যের কোন একটিকে ছেড়ে কথা বলব?

তুমি আমাকে ভুল বঝো, তা আমি চাই না। আমার ধর্মের বিরোধীতা শুধুমাত্র ইসলামেই সীমাবদ্ধ নয়। বা সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মের ভূমিকাকে আমি আদৌ অস্বীকার করছি না। খ্রীষ্টধর্মেরই দুই ভিন্ন মত – প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারবাদ বনাম ক্যাথলিক সংস্কারবিরোধীতা – এদের আদর্শের সংঘাতের ফলেই ইউরোপ এক বৃহৎ বিস্ফোরনে ফেটে পড়েছিল। ধর্মতত্ত্ব থেকে উদ্ভুত ক্ষুরধার বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক, যার ফলে ক্রমশঃ গৃহযুদ্ধ এবং কালক্রমে গোটা এক বিপ্লবের জন্ম নেয়, এখানে তার একটি উদাহরন দেওয়া গেল।

হিস্পানী অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে ষোড়শ শতাব্দীর ডাচ বিপ্লব জন্ম নিয়েছিল স্বীকারোক্তিমূলক সংস্কারসাধনের নামে তাদের পবিত্র কিছু চিত্রকে অপবিত্র করার ফলে। ইংল্যাণ্ডে সপ্তদশ শতকের পিউরিটান বিপ্লবের কারণ ছিল স্কটল্যাণ্ডে এক নতুন প্রার্থনাগ্রন্থের প্রচলন, ১৬৮৮-তে ক্যাথলিকবাদকে সইতে অগ্রাহ্য করা যার পরবর্তী বিদ্রোহটির জন্ম দেয়। চেতনার উদ্ভব সেখানেই থেমে থাকে না এবং এক শতাব্দী পরে এর দ্বারাই ফ্রান্সে বিপ্লবের আগুন জ্বলে ওঠে। ইংল্যাণ্ডের চার্চ এবং ভাটিকান এই নতুন শত্রুর বিরুদ্ধে একজোট হল, কিন্তু জনগণতান্ত্রিক সার্বভৌমত্ব ও সাধারনতন্ত্রের ধারণা এত সহজে মুছে যাবার ছিল না।

আমি তোমার প্রশ্ন প্রায় স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। এতে আমাদের কী যায় আসে? অনেক কিছু, বন্ধু আমার। পশ্চিম ইউরোপ ধর্মতাত্ত্বিক ভাবাবেগে ভেসে গিয়েছিল, কিন্তু ইদানিং তা আবার আবছা হয়ে আসছে। দিগন্ত জুড়ে আধুনিকতা। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, অটোমান সাম্রাজ্যের সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। সুন্নি-শিয়ার প্রভেদ বড় দ্রুত স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল এবং পরস্পর বিরোধী শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ইসলামের যাবতীয় মতানৈক্য ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবার কথা ছিল। সুলতানেরা, তাদের ধর্মগুরুদের সহায়তায় এক বিরাট সাম্রাজ্য চালিয়েছেন, যা শেষ হবার মুখে এসে দাড়িয়েছিল।

এইটে যদি আঠারো শতকের চিত্র হয়ে থাকে, আজকের দিনে তার কতটুকু সত্যি হওয়া সম্ভব? বাস্তব অভিজ্ঞতাই বোধহয় মুসলিমদের সামনে একমাত্র রাস্তা, যার দ্বারা তারা এর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারে, যেমন ইরান করেছে। নব্যউদারতাবাদের বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যে অন্য কোন পরিবর্তের অনুপস্থিতি ধর্মের এই উত্থান কিছুটা ব্যাখা করে। একটু খেয়াল করলেই বুঝবেন, যতদিন ইসলামীয় সরকারগুলি দেশের দরজা সারা বিশ্বের অনুপ্রবেশের জন্যে খুলে রাখবে, সামাজিক-রাজনৈতীক ক্ষেত্রে তারা যা খুশি করার অধিকার পাবে।

আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ আগেও ইসলামকে ব্যবহার করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। এখানেই আসল লড়াই। একটা ইসলামীয় সংস্কারসাধন আমাদের বড় প্রয়োজন যা মৌলবাদের সুগভীর রক্ষণশীলতা এবং পশ্চাদপদতাকে মুছে দেবে, এহ বাহ্য, ইসলামের সামনে একঝাঁক নতুন আদর্শ রাখবে যা আধুনিক পাশ্চাত্যবাদী ধ্যানধারণার থেকে বেশী উন্নত।

এর ফলে ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীভবনের প্রয়োজনীয়তা তৈরী হবে; মোল্লাতন্ত্র বীলিন হবে; সামগ্রিক ইসলামের সমবায় সম্পত্তি হিসেবে ধর্মগ্রন্থের ব্যাখা যা মুসলিম বুদ্ধিজীবীরাই কুক্ষিগত করে রেখেছিল, তা থেকে মুক্ত হবে। যুক্তিবাদী, স্বাধীন চিন্তার অধিকার এবং কল্পনার অধিকার পাওয়া যাবে। এ পথে না এগোলে আমরা সুপ্রাচীন যুদ্ধবিগ্রহেই চিরতরে ডুবে যাব এবং কোন সমৃদ্ধ ও মানবিক ভবিষ্যৎ নয়, বরং ভাবতে থাকব কিভাবে বর্তমান থেকে অতীতে ফিরে যাওয়া যায়। এ ভবিষ্যতের কথা ভাবাও যায় না। আমি আমার কলমকেও আমার সঙ্গে দৌড় করিয়েছি এবং অনেক্ষন ধরে যা তা বকবক করে গেলাম। আমি নিজে বদলাব কিনা সন্দেহ আছে, কিন্তু তুমি বদলাবে – এমনটা আশা করি।

প্রবন্ধ - অর্ক গুপ্ত

পুনঃপ্রকাশঃ

গৌতম চট্টোপাধ্যায়-সম্পাদিত “পুনরুত্থান” পত্রিকা থেকে পুনঃপ্রকাশিত স্বাধীনতা-বিষয়ক একটি প্রবন্ধ।


স্বাধীনতার সময় থেকে

স্বাধীনতার সময় থেকেঃ
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ক্ষেপুর পাতায় রইল গত শতাব্দীর কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবি।


চিত্র ১:- নতুন দিল্লীতে রাষ্ট্রপতির বাসভবন এবং সংসদ ভবনের একটি দুর্লভ সংগ্রহ।


চিত্র ২:- সেলুলার জেল, আন্দামান, ১৯১৭



চিত্র ৩:- শের শাহ সুরী নির্মিত গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড, সেকালের দৃষ্টিতে।


চিত্র ৪:- হুগলী ঘাট, কলকাতা, ১৯১৫


চিত্র ৫:- The Times of India দৈনিকের প্রথম পাতার একাংশ, শুক্রবার ১৫ই আগস্ট ১৯৪৭


চিত্র ৬:- ভারতের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবস পালন। ২৬ জানুয়ারী ১৯৫০


চিত্র ৭:- ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহিদ বাংলার ক্ষুদিরাম বোস


চিত্র ৮:- সেকালের বিদ্যুৎ-উৎপাদন কেন্দ্র ১৯১৭


চিত্র ৯:- ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে লেখা লর্ড মেকলের ভারত-বিষয়ক চিঠি। ফেব্রুয়ারী ১৮৩৫।


চিত্র ১০:- পার্টিতে মহিলাদের জমায়েত। মুম্বই। ১৯১৯ সাল।