সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ৩য় বর্ষ ৮ম সংখ্যা



সম্পাদকীয়



এই সময়টা পিকনিককে মনে করিয়ে দেয়। যেন কমলালেবু ,পিকনিক,বইমেলা আর কবিতাদের নিয়েএই শীতে খুব কাছের কোন বন্ধুর কাছে চলে গেছি। সে যেন বহুদিন ধরেই আমন্ত্রন জানিয়ে রেখেছিল এরকম শীতের মুহূর্ত গা ঘেঁসে একসাথে কাটানোর জন্যে ... আমার এক প্রিয় কবির কবিতা মনে পড়ে, একটা দুটো নয় পুরো একটা বই। সেই কোনকালে তিনি তার কবিতাগুলো দিয়ে শীতকালের কাছাকাছি আমায় নিয়ে চলে এসেছেন।


যাকগে, যেখানে শুরু করা যেত স্রেফ নামাস্তে দিয়ে সেখানে শীতকাল আর কবিতার সম্পর্কেই নাহয় শুরুটা হোলো। শুরু হলে এবার তাকে একটা গতিপথ দিতে হয় আমাদের, এদিকে যখন আমরা এ সংখ্যা পড়ছি হয়ত পৃথিবী তার গতিপথের অন্তিম প্রান্তে সূর্যের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলছে ... আমাদের কিন্তু খেয়াল থাকেনা পৃথিবী বা আমরা ছাড়া কে কখন কোন গতিপথে চলছি। বাংলা লিটল ম্যাগাজিন কিন্তু একটু একটু করে গতিপথ বদলাচ্ছে ব্লগ বা ওয়েব দুনিয়ার দিকে, অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আমার শীতকালীন ব্লগ মেলাও পেতে পারি।


শীতকাল যখন এসেই পড়েছে প্রয়োজনীয় উষ্ণতা অন্তত সংগ্রহ করে নিতে হবেই আগামী তিনমাসের জন্যে – সামনেই শীতের পসরা সাজিয়ে কলকাতা আমাদের কাছে উপুড় করে দেবে আরও অনেক আনন্দের উপকরণ। আমরা কোনটা বেছে নোব সেটা এই মুহূর্তেই ভেবে রাখুন , কারণ এবারের পাগলামি ভরা ক্ষেপচুরিয়ানস হাতে পেলে আপনার সঙ্কল্প আর অটুট থাকবেনা এটুকু দাবি করাই যায়। কমলালেবু, পিকনিক নিয়ে শীত কাটাতে চাইলেও আপনার মস্তিষ্কে আমরা ঠুসে ঠাসে কবিতা ভরেই দোবো... এ পাগলামি যে থামার নয় কোনোকালেই।


টুটাফাটা আঁচড়গুলোর মোকাবিলায় শীতকালীন কোল্ডক্রিম হিসেবে রাখলাম এই সংখ্যাটি। অসংখ্য কবিতা, গদ্য, বেশ কিছু গল্প, প্রবন্ধ,রম্যরচনায় সাজিয়ে... ঠোঁটে মুখে আর মনেও খানিকটা মেখে তবেই শীত উপভোগ করতে বেরোবেন।


ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষে
রাজর্ষি মজুমদার

উত্তর সম্পাদকীয় - অরিন্দম চন্দ্র

প্যাহলে “আপ”...প্যাহলে আপ
অরিন্দম চন্দ্র



চার রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের শেষে বেঁড়ে ব্যাটা “আম আদমি পার্টি” কেন ঘোড়া কেনাবেচা না করে,জনতার কাছে আশ্বাসিত দায় পালন না করে, রাজধর্ম না পালন করে আবার পূনর্নিবাচন চাইছে তাই নিয়ে জাতীয় মিডিয়া আজ কূট-তর্কে মেতেছে।ঠিকই তো,এদের উচিত ছিল বিজেপি বা কংগ্রেসের সাহায্য নিয়ে জল পরীক্ষায় নামা,যাতে প্যাহলে আপ প্যাহলে আপ বলতে বলতে গাড়ি না ফস্কে যায়।রাজ্যের প্রচারমাধ্যমগুলির কথা ছাড়েন,এরা সাবালক হতে হতে আমরা বুড়িয়ে যাব।

একথা সত্যিই যে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে “আপ” এক নতুন তৃতীয় বিকল্পের কথা দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরেছে,ঝাড়ু আজ স্টুপিড কমন ম্যানকে মূল্যবৃদ্ধিতে ফেঁসে দূর্ণীতির ঘন কুয়াশায় আবৃত রাজনীতির বাতাবরণ থেকে একটু হলেও মুক্তির আস্বাদ দিতে পেরেছে,যা কি না সরকারী বাম-দল গুলিও এই সময়ে ভোট-বাক্সে প্রতিফলিত করতে ব্যর্থ হয়ছে।

কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র।এই যে কেজরিওয়ালরা আম-আদমির স্বার্থে সরকার গড়ার লাইন থেকে সরে যাচ্ছে সেটা কি নিছক আরেক সততার প্রতীকের নির্মাণ,না কি সমাজ পরিবর্তনের যে কথা তাঁরা পথসভা থেকে সোশ্যাল-নেটওয়ার্ক সাইট বা এসএমএস এর মাধ্যমে গোটা দিল্লীর ভোটদাতাদের কাছে পৌঁছে দিলেন তার মধ্যেই কিছু অজানা প্রশ্নের উত্তর আজও অধরা রয়ে গেল ??

মূল্যবৃদ্ধি বা দূর্নীতির ইস্যু আজকাল লোক খুব খাচ্ছে।রাজপুরুষগনও মেতে উঠেছেন বাইট দিতে।আর খুব ঠাণ্ডা মাথায় তাই মিডিয়াও “রাগা” বনাম “নমো”র লড়াইকে হাইলাইট করছে হরবখৎ।কিন্তু কিসের যেন দুই পিঠই সমান,ভারতের মানুষ ইতিহাসটা খুব কম আয়াসে ভুলে যান।যেন এনডিএ আমলে ভারতে মূল্যবৃদ্ধি কম ছিল,দূর্নীতির লেশমাত্র ছিল না এ পোড়া দেশে।পেঁয়াজ আশী টাকা সব্বাই করেছে,সব্বাই ভুগেছে,কফিন থেকে কমনওয়েলথ—গল্পটা একইরকম।

তাই এডভান্টেজ নরেন্দ্র মোদী---মিডিয়ার চিৎকারের পরও কিছু প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই থেকে যায়।মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তিশগড় মোদীর আমোদে আম-জনতা কতটা মেতেছে সেটার হিসাব পরে হবে,কিন্তু রাজস্থানেও মোদী হাওয়ার চেয়েও বোধকরি সরকারের ব্যর্থতা আর চুরিটা বেশী কাজে এসেছে সরকার গঠনের কাজে।মিজোরামের মত চুনোপুঁটিকে কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না,আমরাও ছেড়ে দিলাম।আর যে লোকের উন্নয়নের মডেলে গুজরাটের প্রায় অর্ধেক কন্যাশিশু আজও অপুষ্ট তার কথা ঝড় তুললেও গোটা দেশের মানুষ সেই ব্যক্তি বা তার দলকে এখনো কতটা বিশ্বাস করেন তার সারবত্বা জানতে আর কটা মাস অপেক্ষা করাই শ্রেয়।

বাকি রইল তৃতীয় বিকল্প।কেউ ভাবছেন ফেডেরাল ফ্রন্ট,কেউ অ-কংগ্রেস অ-বিজেপি আর কেউ বা এই হালের “আপ”।ফেডেরাল ফ্রন্টের নেতা-নেতৃদের পাল্টি মারা আগেও দেখেছি,তাই খুব বেশী আশা করলে চাষা যে মরবেই সেটা বোঝার জন্য ক্ষুরধার কূটবুদ্ধির দরকার নেই।আর অ-কংগ্রেস অ-বিজেপি জোটের ভিত্তি যতক্ষণ না নির্দিষ্ট কর্মসূচীর উপর বা বৃহত্তর ঐক্যের ভিত্তিতে হচ্ছে মানুষ তাকে কতটা বিশ্বাস করবে তাও এখনই বলা যাবে না।

বাকী রইল “আপ”।এটা ঠিক যে এই ঝাড়ুর ব্যাপক জনসমর্থনের পিছনে শুধুমাত্র নাগরিক সমাজের ভূমিকাই নেই, এই দেশের সাধারন মানুষের একটা “সিম্বলিক” সমর্থন আদায়ে তারা সমর্থ হয়েছে।কিন্তু ইলেক্ট্রিক বিলের বা জলকরের বোঝা বা দিল্লী জুড়ে মেয়েদের উপর অত্যাচারই কি সব? বা দূর্নীতি আর মূল্যবৃদ্ধি?? “আপ” কি গত দুই দশক জুড়ে নয়া-উদারনীতির বিরুদ্ধে??না কি এই এই নীতিকেই আরও সইয়ে সইয়ে খাওয়ানোর নয়া এক্সপেরিমেন্ট? যা বিজেপি বা ইউপিএ করতে পারছে না?? প্যাহলে “আপ” না কি প্যাহলে আপ????

বড়গল্প - কৌস্তভ ভট্টাচার্য

ফিসফিসোনি ইন্টারন্যাশানাল
কৌস্তভ ভট্টাচার্য



নয়-ছয়-অ্যানাবেল


নয়-ছয় মিলে যে পনেরো হয়, সেটা আমরা মাঝেসাঝেই ভুলে যাই – আর ভুলে যাওয়াটা অনেকসময় কম পেইনফুল। নইলে গোটা অগাস্ট মাস জুড়ে পনেরোই অগাস্টের দেশজ উৎসবে মাততে মাততে – আমরা বরাবর একটা আন্তর্জাতিক হয়ে যাবার চান্স মিস করে ফেলি – না ফ্রেন্ডশিপ ডের কথা হচ্ছেনা – সেটা তেসরা অগাস্ট, আমরা যথাবিধি – কুছ কুছ হোতা হ্যায়ের রিস্টব্যান্ডে, ফেসবুকে অন্যের ওয়াল থেকে ফোটো শেয়ার করে, আর প্রায় প্রেমিককে ‘উই আর জাস্ট ফ্রেন্ডস – ইউ সি’ বলে নির্বাহ করি।

যেটা ভুলে যাই – শুধু আমরা না, গোটা কয়েক তীব্র পলিটিক্যাল র‍্যালি ছাড়া এদেশের পৃথিবীর প্রায় সবাই আজকাল যেটা ভুলে যায় – ফ্রেন্ডশিপ ডের থেকে তিন তিন দিন দূরত্বে দুটো পাপ, আমাদের ঠাকুর্দারা যখন বাঙলাদেশ ছাড়বেন কি ছাড়বেন না ভাবছেন – তখন টুপটাপ জাপানের বুকে ঝরে পড়েছিল। কর্ণেল পল টিবেটস – যে বি-২৯ টা চালাতেন নিজের মায়ের নামে তার নাম রেখেছিলেন – এনোলা গে। ঠিকই ছিলো – মায়ের গর্ভ সবসময় ধারণ করার বস্তু নয়, মাঝে সাঝে লজ্জা ঢাকতে গর্ভপাতও সভ্যতার রুলবুকের ফুটনোটে আইনসিদ্ধ। এক্ষেত্রে গর্ভপাতটা একটু দেরিতে হওয়াতেই সম্ভবতঃ লজ্জাটা পুরোপুরি ঢাকা যায়নি – তিনের দ্বিতীয় গুণিতকে ‘লিটল বয়’ আর তৃতীয় গুণিতকে ‘ফ্যাট ম্যান’ এর পাপের মেলানকোলি, তাই আমরা তিনের প্রথম গুণিতকে বাৎসরিক বন্ধুত্ব দিবসের তলায় চাপা দিয়ে বেশ কয়েকবার উঁকি মেরে দেখি – পাছে কেউ জেনে ফেলে।

সম্ভবতঃ মিত্রশক্তির হাতে লাগা রক্ত মুছতেই হিউ হাতে ভালোবাসার পোক্ত পালিশ লাগাতে চেয়েছিলো। ভালোবাসা আল্টিমেটলি বেশ আজিব মাল। কেউ তাকে জীবনের সমস্ত কমপ্লিকেশনস ভেবেই মোলো, কেউ আবার সমস্ত কমপ্লিকেশনসের সলিউশন। থ্যাঙ্কফুলি হিউ দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী – অ্যাটলিস্ট এই কেসটায়।

হিউ প্যাক্সটন জন্মসূত্রে ব্রিটিশ, কেন্টের বাসিন্দা। প্রকৃতি প্রাপ্তি হয়েছিলো সুদূর প্রাচ্যে – টোকিওর রাস্তায়। মিডোরি জাপানকন্যা – ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের হয়ে একটি ভারী শান্তশিষ্ট জানোয়ার সংরক্ষণ করাই ওর পেশা – বাঘ। হিউ, মিডোরির টইটইয়ে সদাসঙ্গী – পেশায় লেখক – আর্টিকেল লেখে বেড়াবার রসদ জোগাড় করতে – গল্পগুলো ইচ্ছের পেট ভরাতে। আফ্রিকায় টাইগার নেই – সেটা যেকোনো ঋজুদা পাঠক থাপ্পড় মেরে পৃথিবীর তাবড় শিকারীকে শিখিয়ে দিতে পারে – তাও ওরা সাউথ আফ্রিকা গেছিলো – কি জানি কি খুঁজতে – বোধহয় সিংহ আর বাঘের হিসুর সিমিলারিটি ও ডিফারেন্স জাতীয় কিছু। গিয়ে কাজের কাজ যেটা হয়েছে – হিউ প্রথম গল্পের বইটা নামিয়ে ফেলেছে।

আপাততঃ ওরা ব্যাঙ্ককেই সেটলড – একটি সাত বছরের ছটফটে হুরীপরী শুদ্ধু – মায়ের রূপ পেয়েছে – আর বাবার দেওয়া নাম – অ্যানাবেল।


হাজার দশেক

কৃষ্ণ আর আমি একবার একসাথে চাঁদের ছবি তুলতে গেছিলাম। ওর নিকন ডি৩২০০ সঙ্গে ১৮-৫৫ লেন্স – আর আমার ক্যানন এস-এক্স ৩০ডি – গাধার পুরুষাঙ্গের মতো বড়ো হওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সুপার জুম কেপেবিলিটি সহ।

তো যেটা দাঁড়ালো – ওর চাঁদটাকে বেশ আকাশের গায়ে একটা দইয়ের ফোঁটার মতো দাঁড়ালো। আমারটায় বেশ ক্রেটার ফ্রেটার সহ একটা নাসা মার্কা উচ্চনাসা এফেক্ট এসে গেলো। পৃথিবীর সব ডিএসেলারের মুখে আমার বিজয়লাথ।

নাগারহোল ন্যাশানাল পার্ক এদেশে প্রায় অপরিচিত আর বিদেশে বহুপরিচিত একটি জঙ্গল। কেরালা আর কর্ণাটকের বর্ডারে কাবিনীর কাছে গা ঘাপটি দিয়ে পড়ে থাকা একটাই থাকা খাওয়ার হার্বাল মাসাজ পাবার এলাহি ব্যবস্থা। আর পৃথিবীর বেশিরভাগ ধলা চামড়ার কাছেই যেহেতু ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়াকে দান করার জন্য অঢেল ডলার থাকে তাই প্রতিদিনের খরচ – বেশি না মাথা পিছু হাজার দশেক - থাকা-খাওয়া-জঙ্গলে ঘুরঘুর-এক জানলা হনুমান সাক্ষী রেখে নতুন বউয়ের বুকের তিল আবিষ্কার ইনক্লুসিভ।

তো আম্মো গেসলাম – বাপ মা কে ট্যাঁকে গুঁজে – প্রিয়তমাসু ক্যানন এস-এক্স ৩০ডি গলায়।

সেখানে জঙ্গলে বেশ একটা হুডখোলা জিপে ঘোরায়। বালাই ষাট বাঙালি পাঠক মেলোড্রামাটিক হবার আগে পুরোটা শুনুন – জঙ্গলে গাউর, বাঘ সব থাকলেও – জিপে দু’দুটো বন্দুকবাজও থাকে।

তো হিউ, মিডোরি আর অ্যানাবেল জায়গা পেয়েছিলো আমার জিপের পেছনের সিটে। আমি সপরিবার ও সক্যামেরা সামনে। হিউদের ছিলো টেন্ট নাম্বার ৫, কিন্তু জিপে অ্যালোকেশান ছিলো রুম নাম্বার ৫ এর। কোথা থেকে কি হইলো বোঝা গেলনা – দেখা গেলো টেন্ট নাম্বার ৫ আর রুম নাম্বার ৬ কে ‘হাত ধর প্রতিজ্ঞা কর’ গাইয়ে বিদেয় দিলো ট্যুরিস্ট লজ।


পেয়েছি পেয়েছি, থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু

টাইগার কল বস্তুটি যারা শোনেননি তাদের কি করে বোঝাই জিনিসটা কিরকম। দাঁড়কাকের গলাটা ছ’মাসের বাচ্চার মতো হয়ে গেলে ব্যাপারটা যে’রম দাঁড়াবে অনেকটা সেরকম।

বুদ্ধদের গুহ হবার কোনো ইচ্ছে বা সক্ষমতা কোনোটাই আমার নেই – তবু এটুকু পাব্লিকের জ্ঞাতার্থে – আমরা আসার রাস্তায় একটা বাঘের তাড়া খাওয়া গাউর দেখেছি (যাকে বাইসন লিখলে আমার জঙ্গুলে দাদা বিক্রমাদিত্য গুহ রায় আমাকে দুই কুমীরে পা দিয়ে দাঁড়াতে বলতে পারেন) যে গায়ের রঙটা বাদে টোটালি সলমন খান – কিন্তু সম্ভবতঃ ভয়ে, অথবা পরাজয়ের গ্লানিতে একটা বেচারা গাছে শিঙ ঘষে ঘষে গাছটার ছালবাকলের সাড়ে দেড়টা বাজাচ্ছিলো। ভিডিও তোলা আছে – দেখতে চাইলে বলবেন।

তো মূল জঙ্গলে ঢুকলাম – জঙ্গলটার ভালো ব্যাপারটা হচ্ছে – জঙ্গলটা পর্ণমোচী গাছের জঙ্গল – আর সময়টা শেষ ডিসেম্বর – তো প্রায় একটা শান্তিনিকেতনের ঝোপঝাড়ের মতো চেহারায় জঙ্গলটা মান রক্ষার হতাশ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ট্যুরিস্টের পৌষমাস – কারণ পাইকারি রেটে অ্যানিমাল ওয়াচ হচ্ছে, হাতি ময়ূর, হাজার খানেক পাখি, শূয়োর, ওয়াইল্ড ডগ বা ঢোল কি নেই তাতে।

প্রত্যেকটা জঙ্গলেই একটা জায়গা থাকে যেখানে সব জন্তু জানোয়ার – দিনে একবার করে মাটি থেকে চেটে চেটে নুন খেতে আসে। সেই জায়গাটায় গেলে ওয়াইল্ড লাইফ দর্শনের সম্ভাবনা বেশি হয়। তো আমাদের জিপটা ঘুরতে ঘুরতে সেই পার্টিকুলার জায়গাটায় আসার পর – আমাদের পাকা চুল গাইড হঠাৎ করে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিলো। সেই আওয়াজটা শোনা যাচ্ছিলো – হরিণের, বাঁদরদের – যেটার কথা বিক্রমদার মুখে, ঋজুদার বইয়ে, ন্যাশানাল জিওগ্রাফিকে শুনেইছি শুধু – এক্সপিরিয়েন্স করা হয়নি – ততপূর্বে।

গাড়িটা যেখানে দাঁড়িয়েছিলো – সেই জায়গাটায় রাস্তাটা একটা এল শেপের টার্ণ নিয়েছে। গাইড ড্রাইভারকে বললো গাড়িটা চালাতে, টার্নটা নিয়ে গাড়িটা দু-তিনহাত এগিয়েছে কি এগোয়নি – ভদ্রলোক রাস্তা পেরোলেন – আমার বাবা আর মা একে অন্যের হাত চেপে লাফালাফি করতে লাগলো সাউন্ড না করে – হিউ আর মিডোরি খালি গাইডকে থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু করে গেলো।

আমি কি করলাম? আমি ঘটনাটা ঘটার পর রিয়ালাইজ করলাম যে আমি ভিডিও তুলতে এতো ব্যাস্ত ছিলাম যে একটা খাঁটি বেঙ্গল টাইগার সচক্ষে দেখা মিস করেছি। শুধু ভিডিওটা ঠিকঠাক আসার জন্য পেয়েছি পেয়েছি করে গেছি।

আর মিডোরি – নিজের ক্যানন ৬০ডি – তার সাথে একটা টেলি লেন্স এটসেট্রা হাতে নিয়ে বসে খালি বাঘটা দেখেই গেছে – ছবি আর তোলেনি।


পে প্যাল


তখন আমি হায়দ্রাবাদে। নাগারহোল থেকে ফেরৎ এসে গেছি প্রায় মাস দুয়েক। কোলকাতার জন্য মনটায় একটা টানটান না পাওয়া জমে থাকে হরবখৎ।

মিডোরি, হিউ আর অ্যানাবেলের সাথে আলাপটা সেই বাঘ দিবসের রাত্তিরেই হয়েছিলো। মিডোরি আমার কাছ থেকে বাঘের ভিডিওটা নিয়েছিলো। সেখানেই জানলাম ওর ইউনাইটেড নেশনসের সাথে কাজকম্মের কথা। হিউ টিপিক্যাল ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে বললো – ‘ইউ মাইট এন্ড আপ গেটিং সাম মানি ফর দিস’।

তো ভালো – বাঙালি মধ্যবিত্ত ছেলে – মেয়ে আর পয়সা চিনতে ভুল করেনা। মাঝের দু’মাস যে ছবিগুলো মেইল করিনি ওদের – সেটা নেহাৎ ল্যাদ।

প্রসেসিং ট্রসেসিং করে মিডোরির মেইল আইডিতে পাঠালাম ওগুলোকে।

কিছুদিন পর রিপ্লাই এলো – মিডোরির নয়, হিউয়ের কাছ থেকে – ওরা এখন বাঘ ছেড়ে শাশুড়ি সামলাচ্ছে। ছবিগুলো ভালো লেগেছে। ডিটেলে কথা আছে। পরে বলবে।

বললো – কিছুদিন পরেই।

হিউয়ের একটা আর্টিকেল বেরিয়েছে সেই গাউরকূলের সলমন খানকে নিয়ে – আমি হিউকে বলেছিলাম – ওটা লিখলে যেন আমায় পাঠায় – আমি বাঙলা করে ছাপাবার ব্যাবস্থা করবো – সে আর হোলোনি। কারণ আমাদের ম্যাগাজিনটা তখনো নেহাত ওয়েবম্যাগ – সাহেবসুবোকে ডলার দিতে গেলে – হেঁ হেঁ ওই আর কি।

যাই হোক – বেশ কিছু পাখির ছবি তুলেছিলাম নাগারহোলে – হিউয়ের একটা বড়ো আর্টিকেল যাচ্ছে, নাগারহোলকে নিয়ে। নিপ্পন এয়ারওয়েজ নামের জাপানী এয়ারলাইন্সের ইনহাউস ম্যাগাজিন উইংস্প্যানে। সেটার জন্য আমার কিছু ছবি চেয়েছে । ছবি পিছু ৫০ ইউ-এস-ডি দেবে, চারটে ছবি অর্থাৎ ২০০ ইউ-এস-ডি।

ইউ-এস-ডি শব্দটা নেশা ধরাবার পক্ষে চুল্লু-চরসের থেকে কম যায়না – তবে কিনা সাহেব মানুষ। আর আমার থেকে আমার বাবা-মার সাহেবে বেশি ভয় – যদি ছবিগুলো নিয়ে পয়সা না দেয়। বিক্রমদাকে জিজ্ঞেস করলাম একবার। বিক্রমদা ছবিগুলো দেখে প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিলো হিউ এন্ড কোং ছবির কিস্যু বোঝেনা – নইলে এইসব ছবি চাইতো না।

যাই হোক – আমিও বামুনের ছেলে – ঠাকুর্দা বর্ডার পেরিয়েছেন – অল্পতে নাহি দমে এই শর্মা। দিলাম পাঠিয়ে – হিউ বললো আমার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেবে। তার জন্য একটা পে-প্যালে অ্যাকাউন্টও খুলে ফেললাম।

সেখান থেকে আমার কাছে টাকা এলো বটে – প্রথম দু’মাসে ১.৩২ টাকা – অ্যাকাউন্ট ভেরিফিকেশানের জন্য পে-প্যাল থেকে বিনামূল্যে ইলেট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারায়িত।


ভেসে আসে কোলকাতা


হিন্দি ছবির নাচা-গানা-ঢাক-ঢোল আমার বরাবরের প্রিয় জিনিস। মানে ইয়ে রুচি নিয়ে যদি প্রশ্ন তোলেন তবে স্বীকার করতে হয় আমার করণ জোহরের বোলে চুড়িয়া বোলে কঙ্গণা গানটার পিকচারাইজেশান বড়ো ভাল্লাগে।

সুরের জন্য নয়, কথার জন্য নয়, উৎসবের জন্য।

হিন্দি সিনেমায় ওই যে একটা প্রচন্ড রঙচঙে সেটে – ততোধিক রংবেরঙের কস্টিউম পড়ে প্রায় শ’খানেক লোক একসাথে তাথৈ করে ওটা আমার বড়ো ভাল্লাগে।

আমার – রঙ ভাল্লাগে।

রঙ – যেটা আমার শহর কোলকাতাকে ভারতবর্ষের আর পাঁচটা শহরের তুলনায় আলাদা করে দেয়। সেই রং - যেটা কখনো রাজনৈতিক লাল-সবুজ, কখনো একাকিনী হলদেটে, কখনো ঋতুপর্ণ ঘোষকে অকালে হারিয়ে বিষণ্ণ সাদা-কালো।

এই রঙগুলো নিয়েই কোলকাতা ঘুম থেকে ওঠে, কলোনী এরিয়াগুলোতে এখনো কলের লাইনে দাঁড়ায়, চলন্ত পাব্লিক বাসের পিছনে ছোটে, ২টাকা খুচরোর জন্য অটোওয়ালার বাবা-মা এক করে দেয়, ব্র্যান্ডেড টি-শার্ট পরে ঝুপসে খেতে যায়, দাম্পত্য কলহে মুখ গোমড়া করতে করতে ‘মধ্যরাত্রের আচমকা মিলন’ আবিষ্কার করে।

মুম্বই ছাড়া আর বাকি সমস্ত ভারতবর্ষীয় শহরের কাছে কোলকাতা ঠিক এখানেই জিতে যায়। বাকি শহরগুলোর মোনোক্রোমকে হারিয়ে দিয়ে একটা ইজেল হয়ে দাঁড়ায় – যেখানে ইচ্ছে মতো রং মেলানো যায়। আর মুম্বইয়ের বর্ষাকাল দেখে কালিদাসের কথা মনে পড়েনা। তাই – কথা হবেনা।

কোলকাতা ফিরে এলাম তাই – গত জুনে। সবাই বললো ভুল ডিসিশান – সবাই বললো ব্যাঙ্গালোর জাতীয় কোথাও যেতে – সবাই বললো এ শহরে সব জান্তব, সব মৃত, সব ভুল।

মন বললো – ঠিক, ঠিক, ঠিক।

এর মাঝে আর হিউদের সাথে কথা হয়নি।


অক্টোবর


কোলকাতায় আসার থেকে বিশেষ ছবি তোলা হয়নি। আসলে এইসব আঁতলামি করতে একটু একাকীত্ব লাগে। মনটা যদি বেজায় ভালোবাসা সম্পৃক্ত থাকে – মানুষে, বাবা-মায়, বন্ধুবান্ধবে – তখন আর ক্যামেরার কথা মনে থাকেনা।

কিন্তু অক্টোবর এসে গেলো কত্তা – ওয়ান মোর নাচনকোঁদন মাস – দুগগাপুজো অন দ্য কার্ড। এইসময় ক্যামেরা হাতে না বেরোনো মানে ক্যামেরাকে ব-কার শ-কার তুলে খিস্তি দেবার সমতুল্য।

আমার বাড়ির কাছে একটা ঠাকুর বানাবার জায়গা আছে – সাইজ করে তুলতে পারলে সেটা যে কুমোরটুলি নয় বোঝে কার বাপের সাধ্যি।

তাই গেনু – সেই পুওর ম্যানস কুমোরটুলিতেই – খচখচাৎ করলুম বেশ কিছু ছবি। দু’টো ফোটোগ্রাফার বন্ধুকে দেখালাম – একজন বললো বড্ডো কমন অ্যাঙ্গলস, আরেকজন বললো থট প্রসেসটা স্টিলের নয়, ভিডিওর।

তো যাই হোক,শ্রদ্ধেয় তপন রায়চৌধুরী বলেছেন - সাহেবদের মাথায় অতো বুদ্ধি হয়না – নইলে কেউ সোনামুখ করে ওরিয়েন্টাল কুইজিনের স্বাদ পেতে কাঁচা লঙ্কা চিবোয়না।

তাই হিউকেও ছবিগুলো পাঠিয়ে দিলাম। সাথে একটা মেইলও জুড়ে দিলাম। মনটা যে একটু ইউ-এস-ডি ইউ-এস-ডি করছিলোনা তা বললে পরমপিতা আমাকে পাপ দেবেন।

হিউ,

এখন আমি প্র্যাকটিকালি ঘরের ছেলে ঘরে ফেরৎ এসে গেছি। কোলকাতা থেকে লিখছি, দূর্গাপুজো সম্বন্ধে শুনেছো বোধহয় – আমাদের এদিকে সবচেয়ে বড়ো উৎসব। বড়োই আনন্দে আছি।

আমার সেই বাঘবন্দীর ক্যামেরায় কয়েকটা ছবি তুলে পাঠালাম। গুগল ড্রাইভ একটা বেশ নতুন ও ভালো ফিচার। ওটাতেই তুললাম। দেখে জানিও কেমন।

~কৌস্তভ


আনন্দ এবং

কৌস্তভ,

প্রথমে কয়েকটা কম আনন্দের খবর বলি। আমার নিজেকে বেশ গিলটি লাগছে তোমার নাগারহোলের ছবিগুলোর ভবিতব্য জানাতে। আসলে কোনো ভবিতব্য নেই – যেটা রয়েছে সেটাকে ফুলস্টপ বলাই ভালো।

আমি এডিটরকে ছবিগুলো পাঠিয়েছিলাম (যে আবার কিনা বিদেশে ছুটি কাটায় বেশিরভাগ সময়), কোনো এক সাব-এডিটর ছবিগুলো হারিয়ে ফেলেছে। হপ্তা-মাস-বছর কাটতে চললো। এবার নিজেরই লজ্জা লজ্জা লাগছে।

আমার প্রত্যেক দিন মনে হয় আগামীকাল তোমাকে একটা মেইল করে খোলাখুলি জানিয়ে দিই, কিন্তু আগামীকালটা এখনো এসে পৌঁছয়নি।

এক্সিকিউটিভ সামারি – তোমার পে-প্যালের অ্যাকাউন্টে আর কেউ নিশ্চয় কিছু জমা করেছে। কিন্তু আমি কিম্বা উইংস্প্যান কিছু করিনি।

এবারের ছবিগুলো দেখতে পারলাম না। দুর্গাপুজোর সম্বন্ধে শুনেছি তো বটেই – বেশ ড্রামাটিক লেগেছিলো। আমার কম্পিউটারের টেম্পারমেন্ট ইদানীং ভালো যাচ্ছেনা। তাই গুগল ড্রাইভের লিঙ্কটা খুললো না। দেখবো নিশ্চয়। এবার ডিরেক্ট মেইল করে দিও – এই সোশাল মিডিয়াগুলো আজকাল আর ইউজ করিনা।

অন্য কথা বলি?

তুমি আনন্দে আছো জেনে ভাল্লাগছে।

আনন্দ এমন একটা জিনিস যেটার গুরুত্ব আমরা প্রায়শই বুঝিনা – আন্ডারএস্টিমেট করে ফেলি।

কোলকাতায় ফিরেছো জেনে ভালো লাগছে। আশা করি কোলকাতায় বিল্ডিংগুলোর সিকিউরিটি ব্যবস্থা ভালোই।

বন্ধুদের বিবিসি ওয়ার্ল্ডে ধ্বংসস্তূপ থেকে রেসকিউ হতে দেখেছো কখনো? নাইরোবিতে ওয়েস্টগেটের খবর দেখছিলাম ব্যাঙ্ককে বসে বসে – চা খেতে খেতে।

অ্যানাবেল হঠাৎ করে বলে উঠলো – ‘বাবা দেখো দেখো, লুসি আর ফ্লোরা’।

নাইরোবিতে দু’মাস হলো গেছে ওরা। এর আগে একবারই মাত্র একটা প্রায় জীবনসঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছিলো ওরা দু’জন – একটা বাইসাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে।

আসলে আমরা স্বাভাবিক ভাবে এতো ভরে থাকি, যে টুকরো আনন্দগুলো প্রায়শই ওভারলুক হয়ে যায়। রাস্তায় চলার মধ্যে, একটা খাজা বই পড়ার মধ্যে, নিজের পরিবার গড়ে তোলার মধ্যে যে একটা তীব্র আনন্দ আছে – সেটা ভুলতে বসি।

কিন্তু জীবনটা তো আসলে সন্ধানের গল্প – মানুষ খুঁজে বেড়াবার, ইমোশন খুঁজে বেড়াবার, আশা খুঁজে বেড়াবার, বন্ধুত্ব খুঁজে বেড়াবার।

আনন্দ খুঁজে বেড়াবার।

তাই তোমার আনন্দের জন্য শুভেচ্ছা রইলো। আনন্দেই থেকো।

~ ব্যাঙ্কক থেকে হিউ, মিডোরি আর অ্যানাবেল

বড়গল্প - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

কৈসে যাওব
অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
১.

আমি যখন জন্মাই, তখন নাকি মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। কোলকাতায় পুলিশের জীপ, ট্যাক্সি অর্ধেক ডুবে গেসলো সেদিন।
সেদিন, আষাঢ়স্য বিংশ দিবসে।


বাতাবাড়ি, রাজর্ষিদার সাথে। রাজর্ষিদা বরানাগরিক। মন যদিও সায় দিচ্ছিল না যেতে। মন বলছিল আসবে, ফোন। শকুন্তলার। তাও যাওয়া হল। কদমতলা গার্লসের সামনে থেকে বাস ধরে বাতাবাড়ি ফার্ম মোড়। ঘণ্টা দেড়েক। সকালের বাকি ঘুমটুকু বাসে পুষিয়ে নিয়ে যখন মাথা চুলকোতে চুলকোতে নাবলাম বাস থেকে, তখন দেখি, সামনে লেখা জায়গাটার নাম, মাথাচুলকা। এক প্যাকেট সিগারেট কিনে যে সাইকেল ভ্যানটায় উঠলাম, তাতে সিমেন্ট, রড এসবও আছে। প্যাসেঞ্জার, মোরা দুজনায়। বারেবারে ফোনটা দেখে যাচ্ছি। শকুন্তলার ফোন এলো না। প্রায় আধ ঘন্টা দুলতে দুলতে গিয়ে পৌঁছলাম, লতিফ ভায়ের বাড়ি। রাজর্ষিদার মুখে এই নামটা শোনা ইস্তক মাথায় ঘুরছে একটাই শব্দ, বীফ। ভ্যান থেকে নেমে, রাস্তার ঢালু দিয়ে লতিফ ভায়ের বাড়ির দিকে যেতে যেতে, এই শব্দটাই মাথায় ঘুরছিল আবার। আর, স্যালাইভাতেও। যাই হোক, ব্যাগপত্তর রেখে আমরা যাচ্ছি সেই বহুশ্রুত জায়গাটা দেখতে। যেখানে অদূর ভবিষ্যতে একটা লিটল ম্যাগাজ়িন লাইব্রেরি হবে। একটা ফ্রি স্কুলও। মোট দেড় বিঘে জমি। মিউটেশনের কাজ চলছে। জায়গাটার তিনদিকে খুঁটি পুঁতে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। এখানে হাতি আসে খুব। একটা খুঁটি ভেঙে দিয়ে গেছে ক’দিন আগে। একপাশ দিয়ে লাগানো হবে দেড়শো সুপুরি গাছ। তার ফাঁকে ফাঁকে ঝাউ। গেটের সামনে দুটো রাণিচাপ। বর্ষায় জল উঠে আসে ষোড়শী তণ্বীর মতো ঐ নদীটা থেকে। তাই বোল্ডার ফেলা হচ্ছে তার পাড় ঘেঁষে। পাশেই লাটাগুড়ি ফরেস্ট। অনেক চা বাগান। চা বাগান দেখেই, আমার আবার মনে পড়লো, শকুন্তলার কথা। ক’দিন আগেই আমি আর শকুন্তলা সুকনা ফরেস্টে গেছিলাম। সেখানে ওর খুব ইচ্ছে করছিল জঙ্গলের ভেতরে হারাতে। ডুয়ার্সের জঙ্গলের মতো এত মায়াবী জঙ্গল আর কোথাও কি আছে! চুপ করে কান পেতে আমরা শুনতে থাকি জঙ্গলের শব্দ। সে যেন তার নিজের খেয়ালে আছে। নিঃশ্বাসে একটা বুনো চাপ চাপ গন্ধ। নাক থেকে ফুসফুস, গোটা স্নায়ুতে সেই গন্ধটা ছড়িয়ে যেতে থাকে। আসার সময় আমাদের অটোটা থেমেছিল সুকনা স্টেশনের কাছে। ছোট্ট স্টেশন। ছবিতে এরকম দেখা যায়। জঙ্গল এই জায়গাটার মনটাই যেন অন্যরকম করে গড়ে দিয়েছে। শকুন্তলা স্টেশনের ছবি তুলছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এই স্টেশনের স্টেশন মাস্টার আর হাওড়া স্টেশনের স্টেশন মাস্টার দুজনেই এক পদে চাকরি করেন, তবু দুজনের জীবন কতটা আলাদা। আমরা দুটো চা বাগানের মাঝখানে বসে ছিলাম। রাস্তা থেকে অনেকটা ভেতরে। ও শুয়ে ছিল আমার

কোলে মাথা রেখে। কি কথা বলছিলাম আমরা তখন? মনে পড়ছে না। ছবিটা ভাসছে। আমি খুব ছবি তুলছিলাম, ওর ক্যামেরায়। বিকেল হতেই ও বলছিল,

— তাড়াতাড়ি উঠতে হবে, এখানে সন্ধ্যের পরে হাতি বেরোয়।

একটা জলের ফোঁটা হঠাৎ যেন পড়লো আমার হাতে।

— বৃষ্টি? কিরে? চ’ উঠি।

অনেকটা ভেতরের দিকে এসে গেছি আমরা। বেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে সময় লাগবে। তাই পা চালিয়ে। ফোঁটা আর পড়ছে না, তবুও, তাড়াতাড়িই বেশ ঝরাবে মনে হচ্ছে। ধ্রুপদী সঙ্গীত পরিবেশনের আগে ওস্তাদেরা যেমন যন্ত্রগুলির স্কেল ঠিক করে নেন টুং টাং করে বাজিয়ে, বৃষ্টি এখন সেরকম। এখানে ঢোকার সময় একটা ব্রিজ পেরোতে হয়েছে। ব্রিজটা তৈরি হচ্ছে। নিচের নদীটায় জল ছিল না। আর ব্রিজটায় মাঝেমাঝে কাঠের পাটাতন, কোথাও বেশ ফাঁকা। ফাঁকগুলো বাঁচিয়ে পাটাতনে পা রেখে রেখে ও দিব্যি চলে গেল ওপারে। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম মাঝপথে। শুধু ফাঁকগুলোই দেখতে পাচ্ছি। মাথা ঘুরছে। ও হাসছে ওপারে দাঁড়িয়ে। এখন কি করা? পেছনে মিস্ত্রিগুলো নেপালি ভাষায় সাহস দিচ্ছে আমাকে।

— যানুস যানুস, কেই হুন্দেই ন

কিন্তু সাহস এমন একটা জিনিস একবার গেলে আবার চট করে আনা মুশকিল। একটা মিস্ত্রি নিজেই এগিয়ে এলো। আমার হাতটা ধরে পার করে দিল ব্রিজটা। ফেরার সময় মনে পড়লো, এই রে! আবার পেরোতে হবে ঐ ব্রিজটা? এখন তো মিস্ত্রিগুলোকেও পাবো না। বলতেই মাথায় খেললো, আরে! বাঁ-পাশ দিয়েই তো আরেকটা রাস্তা আছে। আমরা ঐ পথটাই ধরলাম। খিদেও পাচ্ছে এবারে। ছবি তুলতে তুলতে ফিরছি আমরা। শকুন্তলা খুব কায়দা করে ছবি তুলতে জানে। লোকজন টেরই পাবে না, ও ছবি তুলে নেবে। আবার কাছে গিয়ে, দাঁড় করিয়েও ছবি তোলে। বিস্কুট আর আলুর চিপ্স কিনে, সুকনা স্টেশনের কাছ থেকে যখন অটো ধরলাম, বৃষ্টি তখন আলাপ ছেড়ে মুখড়া ধরেছে। অটোর পর্দাটা হিমশিম খেয়ে নামালাম আমি আর উলটো দিকে বসা ছেলেটা, দুজনে মিলে। আমি তো ছাতা নিয়ে বেরোই নি। শকুন্তলার সাথে ছাতা আছে। ও আমাকে বলছিলো,

— কেন ছাতা নিয়ে আসিসনি? সবসময় ছাতা নিয়ে বেরোন উচিত।

আমি বেশ জোর দিয়ে বললাম—

— দ্যাখ, আর কেউ ছাতা নিয়ে আসেনি। কেউ তো জানতোই না যে বৃষ্টি আসবে।

আমার কথা শুনে, অটোতে বসা সবাই জানালো তারা ছাতা নিয়েই বেরিয়েছে। দু’একজন ব্যাগ থেকে বের করেও দ্যাখালো। সিটি সেন্টারের সামনে যখন নামলাম দুজনে, বৃষ্টি তখন ঝালায় পৌঁছে গেছে। ও ছাতাটা খুললো, নেমে। আমরা দৌড়ে ঢাউস ঐ বাড়িটার ভেতরে হারিয়ে গেলাম। হ্যাংআউটে বসা গেল না বৃষ্টির জন্য। টেবিলে আমরা মুখোমুখি বসে, আর অঝোরে তখন বাইরে ঝরছে বৃষ্টি। সুনীল গাঙ্গুলি বলতো, আগেকারদিনে গল্প-উপন্যাসে প্রায়ই এরকম একটা লাইন থাকতো, ‘তখন নিয়তি দেবী অলক্ষ্যে দাঁড়াইয়া হাসিলেন’। সেদিন হ্যাংআউটেও বোধহয় তিনি ছিলেন। এবং হাসছিলেন। নইলে কে জানতো, সেদিন রাতেই আমাদের দুজনের তুমুল ঝগড়া হবে! আর শকুন্তলা ভোর চারটের সময় হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে চাইবে!



কিন্তু, তাই বলে বাতাবাড়িতে বৃষ্টি? রাজর্ষিদার গুঁতো খেয়ে তিরতিরে ঐ হাঁটুজল নদীটায় নেমে স্নান করতেই হল। উঠে আসতেই নামল বৃষ্টি। আর বাজ। ওফ্! সে এক দৃশ্য। চারদিকে মাঠ, আর চা বাগান, তার একপাশ দিয়ে নদীটা। নদীর ঠিক পাশেই একটা টং ঘরে আমরা। কুচকুচে আকাশ। এখানেও ছাতা আনিনি। কেউই আনেনি। আমার মনে হচ্ছিল, সব জায়গার বৃষ্টি কি আলাদা? আমার জন্মের সময়ের বৃষ্টি, শিলিগুড়ির বৃষ্টি, বাতাবাড়ির বৃষ্টি, সুকনার বৃষ্টি, সব জায়গার বৃষ্টির মেজাজটাই তো আলাদা। রাজর্ষিদা বলছিলো, শকুন্তলাকে আনলে পারতাম। ওর ভাল্লাগতো। বৃষ্টি একটু থামতে, নেমে এলাম টং ঘর থেকে। লতিফ ভাই, রাজর্ষিদা আর আমি। হাঁটছি। রাতে থাকবো কি থাকব না, এই নিয়ে দোনামনা চলছে আমাদের দুজনের। নাঃ, দুপুরে বীফ জুটলো না। কিন্তু তার বদলে যা জুটলো তাও দারুণ। খেয়ে উঠে আমরা ঠিক করলাম, থাকবোনা। যাব কোথায়? ও যাবে, আলিপুরদুয়ার। শৌভিকদার বাড়ি। আর আমি? আমি কোথায় যাব? জলপাইগুড়িই ফিরে যাই। মন তখনও বলছে আসবে আসবে, ফোন আসবে। শকুন্তলা আজকে শিলিগুড়িতে। জলপাই থেকে শিলিগুড়ি যাওয়াটা সহজ হবে। অবশ্য, যদি শকুন্তলা ডাকে। আর না ডাকলে? তাহলে কালই ফিরে যাব কুচবিহার। কিন্তু, রাজর্ষিদা চাইছে আমাকে আলিপুরে নিয়ে যেতে। বিকেল সাড়ে তিনটে প্রায় তখন। ভাবলাম এখনও যখন ফোন এলো না, তাহলে চলো আলিপুর। তারপরে দেখা যাবে। বৃষ্টি থেমে গেছে। আমরা আবার ভ্যানে চেপে বাতাবাড়ি ফার্ম মোড়। মালবাজারের বাস। মনটা কিন্তু খচখচ করেই যাচ্ছে। মালবাজারে পৌঁছে, রিকশা নিয়ে রেল স্টেশন। স্টেশনের কাছে এসেছি যখন, ট্রেন ঢুকছে। রাজর্ষিদা বললো—

— অর্জুন, যা দৌড়ে টিকিটটা কাট। আমি রিকশা ভাড়াটা দিয়ে আ—

ব্যাগ রইলো ওর কাছেই। আমি নেমে দৌড়। টিকিট কেটে প্ল্যাটফর্মে আমি, রাজর্ষিদা দু’দুখানা ব্যাগ নিয়ে আধা দৌড় আর দু’পাশে আধা হেলতে হেলতে ঢুকছে। আর ট্রেনও ছেড়ে দিল তখন। দৌড়ে ধরলাম তাকে। আঃ…. পেরেছি। ঝাঁঝা এক্সপ্রেস।



আগের রাতে প্রায় সাড়ে তিনটে অবদি কথা হয়েছে শকুন্তলার সাথে। তারপরে সাত সকালে উঠে বাতাবাড়ি। ঘুম হয়নি তেমন। বাসের ঐ দেড় ঘন্টায় আর কতটুকু হয়! ট্রেনে উঠে জায়গাও পেয়ে গেলাম কপালজোরে, দুজনেই। আমি মালবাজার থেকেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেলস্টেশনে, ঘুম। তাও জার্নির সময় যা

হয়, টানা হয়না। যা হয়, ছেঁড়া ছেঁড়া। রাজর্ষিদা একবার বললো,

— শকুন্তলাকে ফোন করে বলে দে ট্রেনে উঠে গেছিস।

— থাক।

ওকে আর বললাম না, সকালের পর থেকে ওর ফোন স্যুইচড অফ। মালবাজার থেকে ট্রেনে আড়াই-তিন ঘণ্টা লাগে আলিপুর যেতে। সন্ধ্যে যখন হব হব, ট্রেনও গন্তব্যের কাছাকাছি এসে গেছে, অন্য প্যাসেঞ্জারদের মুখ থেকে জানা গেল, আলিপুরে ভয়ানক বৃষ্টি হচ্ছে। ছ’টা নাগাদ নিউ আলিপুরদুয়ারে আমরা নেমে দেখলাম, বৃষ্টি তখন চলে গেছে। সে যে এসেছিল, তার চিহ্ন সর্বত্র। বছর চারেক হল আমি আর ছাতা ব্যবহার করিনা। চার-পাঁচ বছর আগে, এক জুলাই মাসে, ঘোর বর্ষায় আমি বেয়াক্কেলের মতো পরপর ছ’সাত খানা ছাতা হারিয়েছি। শৌভিকদাকে ওর আই-টেন সমেত দেখা গেল একটু এদিক ওদিক করতেই। ওর বাড়িতে ব্যাগ রেখে আমরা চারজনে আবার বেরিয়ে গেলাম। আমি, রাজর্ষিদা, শৌভিকদা আর আই-টেন। রাজর্ষিদাও খুব ভালো গাড়ি চালায়। এখন শৌভিকদাই চালাচ্ছে। পেছনে আমরা দুজন। মদ আর শসা কিনে, কবি সুদীপ মাইতির বাড়ি। শঙ্খবাবু যতই বলুন ‘মদ খেয়ে তো মাতাল হতো সবাই’, মদের যে কিছু গুণ আছে সে তো মদ্যপায়ী মাত্রেই জানে। বাকিরা শুধু বিয়োগই দ্যাখে। গুণ অঙ্কটা এখনো অনেকেই ভালো করে কষতে পারে না। রাজর্ষিদার সামনে আমি মদ খেলে, ও কাকা আর জ্যাঠার মাঝামাঝি একটা গার্জেন হয়ে যায়। আমি দু’পেগ খেলে, ও বলে, আমি চার পেগ খেয়েছি। আমাদের কবিতা, পান চলতে চলতেই আবার নামলো বৃষ্টি। রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা আড্ডা ভাঙলাম। প্ল্যান হল পরদিন চিলাপাতা যাওয়া হবে। আমি তখনও জানি না, আমি যাচ্ছি না। শকুন্তলার আর ফোন না আসায় আমি ভেবেছি এখান থেকেই কুচবিহার ফিরে যাব। অনেকদিন পর মদ খেয়ে সত্যি মাতাল মাতাল লাগছে। রাতে প্রায় বারোটা নাগাদ ফোন এলো শকুন্তলার। আশ্চর্য হয়ে গেলাম এটা জেনে, ওর মনেই নেই কাল রাতে আমরা প্রায় সাড়ে তিনটে অবদি কথা বলেছি। এমন কি আজ সকালেও যে আমি বাসে ওঠার একটু পরে, ন’টা নাগাদ ও ফোন করেছিল, আমি ওকে বলেছিলাম বাতাবাড়ি যাচ্ছি, সেসবও কিচ্ছু মনে নেই। ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু ওকে বুঝতে দিলাম না সেটা। শকুন্তলা বললো,

— কাল আসতে পারবি?

আমিও হ্যাঁ বলে দিলাম। রাত তখন আড়াইটে। আলিপুর থেকে শিলিগুড়ি যেতে সাড়ে চার ঘণ্টা তো লাগবেই। সকাল সকাল বেরোতে হলে এখনই শুয়ে পড়া দরকার। কাল শকুন্তলাকে আবার দেখার উত্তেজনা নিয়ে শুয়ে

পড়লাম। শুধু চিন্তা একটাই, আগেরবার গিয়ে উঠেছিলাম শিবমন্দিরের একটা হোটেলে, সোনার তরী। ভালো হোটেল। কিন্তু সেটা ও যেখানে থাকে একদম সেই এলাকায়। ওর বাড়িওলা, পাড়ার লোকেদের কাছ থেকে একটা অন্য দৃষ্টিলাভ হয় এর ফলে। তাহলে? শিলিগুড়ি একেবারেই আমার চেনা শহর নয়। তাহলে ভরসা সুব্রত। আমার বন্ধুই বলা চলে। আমার চেয়ে বেশ বড় একটু বয়েসে। কিন্তু বন্ধুই। এনজেপিতে থাকে। ওর এক বন্ধুর হোটেল আছে মেডিকেলের কাছে। ঠিক হোটেল বলা ভুল, রেস্টুরেন্ট কাম বার। সকাল সকাল উঠে রাজর্ষিদাকে বললাম,

— বেরোচ্ছি, শিলিগুড়ি।

ট্রেনের খোঁজ করে জানা গেল সাতটা-সাড়ে সাতটা নাগাদ একটা গাড়ি আছে। শৌভিকদার বাড়ির কাউকে না জানিয়েই বেরিয়ে গেলাম। ওরা তখনো ওঠেনি ঘুম থেকে। রাজর্ষিদা আমাকে কিছুটা এগিয়ে দিল। আমি অটো ধরে আবার নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে। কালই সন্ধ্যায় নেমেছিলাম এখানে। স্টেশনে পৌঁছে কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সাড়ে বারোটার আগে ট্রেন নেই। আমি আবার অটো ধরে চৌমাথায়। বাস পেয়ে গেলাম। জায়গাও। রাজর্ষিদাকে এসএমএস করে দিলাম।



শকুন্তলা জলপাইগুড়ি শহরের মেয়ে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে এখন, ভুগোল নিয়ে। পেটে একগাদা খিদে নিয়ে যখন তেনজিং নোরগে বাস স্ট্যাণ্ডে নামলাম, তখন দুপুর প্রায় বারোটা। নেমেই সুব্রতকে ফোন করলাম। ও আধ ঘণ্টার মধ্যে মেডিকেলের হোটেল মালিকের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা করে দিল। আমি বেশ নিশ্চিন্ত হলাম। টেনশনটা গেল। তখন নিয়তি দেবী বোধহয় অলক্ষ্যে দাঁড়াইয়া আবার হাসিলেন। ওখানে গিয়ে ঘর বুক করে শিবমন্দিরে এসে দেখা পেলাম শকুন্তলার। তখন দেড়টা। পেট আর কিছুই মানছে না। জানা গেল দুপুরে আমাদের দুজনের নেমন্তন্ন, নার্গিসদির বাড়ি। যেতে যেতে শকুন্তলা বললো—

— যেখানে যাচ্ছিস সেটা কিন্তু আর্মি ম্যানের বাড়ি। যদি আমাকে কষ্ট দিয়েছিস, তাহলে থানা না পুলিশ না, একেবারে কোর্ট মার্শাল।

নার্গিসদির বর, শামসেরদা, বি.এস.এফ-এ চাকরি করে।

* * *

বিকেল বিকেল নার্গিসদির বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা এদিকে ওদিকে আর সিটি সেন্টারে ঘুরেই কাটালাম। সন্ধ্যেবেলা হোটেলে ফিরে মাথায় বাজ পড়ল। এত দৌড়ঝাঁপে শরীর এমনিতেই ক্লান্ত। জানা গেল, মহিলা নিয়ে থাকা যাবে না। মানে? আমার তো আগে থেকেই বলা ছিল। আমি ভাবলাম, মালিকের সাথে নিশ্চই এদের এখনো কথা হয়নি। আমি কি তখন জানতাম, নিয়তি দেবী আগেই অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে খানিকটা হেসে নিয়েছেন! সুব্রতকে ফোন, মালিককে ফোন। ব্যবস্থা কিছুই হল না। অগত্যা মধুসূদন। সোনার তরী। খোঁজ করা হল আগেরবারের ঘরটা খালি আছে কিনা। ওটা আমাদের দুজনেরই পছন্দ। খালি নেই। অন্য ঘর পাওয়া গেল। আমরা অনেকক্ষণ নিভৃতে কাটালাম, একসাথে। শকুন্তলা ওর নতুন একটা লেখা শোনালো। গত

সপ্তাহে যখন এসেছিলাম, এই হোটেলেই পাশের ঘরে উঠেছিলাম আমরা। শনি-রবি দু’দিন ছিলাম। ভোর অবদি জেগে থাকতাম পাশাপাশি। প্রথম দিন ওকে হোটেলে রেখে রাতের খাবার কিনতে বেরিয়েছি। মটর পনীর, রুটি। আমাকে এসএমএস করে জানালো, চার প্যাকেট প্যানটীন শ্যাম্পু আর ময়েশ্চারাইজ়ারের ছোট প্যাকেট একটা। কিনে নিলাম। আমার নিজেকে বেশ সাংসারিক সাংসারিক মনে হচ্ছিল। ফিরে এসে দুজনে গল্প করছি বিছানায় বসে। একটু রাত করেই খাব আমরা। দুধের মতো ধবধবে সাদা চাদর পাতা বিছানায়। চুমু খেতে গেলাম, বলে কিনা না, হবে না। আমার মুখে নাকি গন্ধ। আগে ব্রাশ করে আয়। ব্রাশ এনেছি, কিন্তু পেস্ট তো আনিনি। রাত দশটায় বেরিয়ে পেস্ট কিনে এনে ব্রাশ করলাম। শকুন্তলা টিভিটা চালিয়ে দিল। যাতে পাশের ঘরে শব্দ না যায়। হোটেলের ঘরে টিভি কি এই জন্যেই থাকে? একই জিনিস যখন যেভাবে কাজে আসে। আদর থামিয়ে ও কবিতা পড়ছে, কবিতা থামিয়ে আদর। এবারে শকুন্তলা রাতে থাকবে না। আর কি যোগাযোগ! এই ঘরে টিভি নেই। ঠিক হল পরদিন আমি প্রদীপের মেসে শিফট করে যাব। প্রদীপ এখানেই থাকে, মেসে। তরুণ কবি। সাড়ে ন’টা নাগাদ বেরিয়ে আমরা ডিনার সেরে নিলাম। ওকে ওর ঘরে পৌঁছে আমি ফিরে এলাম সোনার তরীতে। প্রায় একবছর আগে, গত বছর জুলাই মাসে প্রথম আসি এখানে। সেবার রাত প্রায় এগারোটা অবদি আড্ডা দিয়েছি ওর ঘরে। তার পরেরদিন ভোরবেলা, পাঁচটা নাগাদ, শকুন্তলা হোটেলে হাজির। বৃষ্টি পড়ছে বাইরে, টিপ টিপ করে। আমি তো চমকেই গেছি। এতো ভোরে! দেখি গেরুয়া রঙের একটা সালোয়ার পরে এসছে। খোঁপা বাঁধা উঁচু করে। বোষ্টমীর মতো লাগছিলো ওকে দেখতে। অত ভোরে হোটেলের লোকগুলোও ঘুমে কাদা। আমি যত ডাকি-

— ও দাদা, ও দাদা, ঊঠুন, গেটটা খুলে দিন।

কে শোনে কার কথা। একবার শুনে ঊঁ—আঁ ক’রে আবার পাশ ফিরে শোয়। শেষে আমাকেই দেখিয়ে দিল বালিশের নিচে চাবি আছে। আমি চাবি নিয়ে গেট খুলে দিলাম। কিন্তু, এবারে যেটা নেই, তা’ হল বৃষ্টি। এবারে সকালে আমরা অনেকক্ষণ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। গতবছর রাতের অন্ধকারে ঘুরেছিলাম। এবারে সকালের আলোর কৈশোরে। আমরা ফুল কুড়াই, ছবি তুলি। আঙুল ছুঁয়ে থাকি। কেউ কাউকে না ছুঁয়ে পাশাপাশি হাঁটলেও শরীরে-মনে একটা লেনদেন হয়। সকালের হাল্কা রোদ মাখা গাছগুলো আস্তে মাথা ঝোঁকায়, অল্প হাসে আমাদের দেখে। কাল ও জলাপাইগুড়ি ফিরে যাবে। আমি কুচবিহারে। পরশু ও যাবে কোলকাতায়, ডাক্তার দেখাতে। ফিরে পিএইচডি আর বি.এড-এর পড়াশোনায়, আমি চাকরির জন্য জি.কে। কিন্তু, ফেরার পথে গল্পটা একটু জলপাইগুড়ি ছুঁয়ে গেল। এয়ারভিউ মোড় থেকে কুচবিহারের কোনো বাস না পাওয়ায় ময়নাগুড়ির একটা বাস ধরে নিলাম। আমরা গোসালায় নেমে যাব। ও রিকশা নিয়ে বাড়ি, আমি বাস ধরে কুচবিহার। বাসে আমরা দুজনেই একটা ভালো জায়গা পেলাম। ও জানলাটা নিল। আমি ওর পাশেরটা। আমাদের দুজনের ঠোঁটই কাতর ও প্রত্যাশী হয়ে ছিল, বোঝা যাচ্ছিল ওর ঠোঁটের তিরতির করে কেঁপে ওঠা

দেখে। গোসালায় নেমে আবার মত পাল্টালাম আমরা। আমি শংকরদার বাড়ি যাব। ও সন্ধ্যে বেলা আসবে দেখা করতে। পরদিন সকালেও আসবে, ট্রেন ধরার আগে।
* * *

সন্ধ্যায় শকুন্তলা এলো। সকালেই বেরোবার সময় ও রায়তা করে নিয়ে এসছিলো। আমার ব্যাগে রাখা ছিল সেটা। বের করে নুন দিয়ে ঝাঁকিয়ে ভাল করে বানালাম। বেশিক্ষণ বসলো না। রিমঝিম শংকরদার মেয়ে। সেভেনে পড়ে। ওকে স্কুল থেকে টেবিল ক্যালেণ্ডার আর পেন স্ট্যাণ্ড বানাতে দিয়েছে। তাই নিয়ে বেশ একটা হুলুস্থুল পড়ে আছে বাড়িতে। আমি বারান্দায় বসে সিগারেট খাই, পেপার পড়ি। কিছু মনে এলে খাতায় টুকে রাখি। লেখা হলে বৌদিকে খুব পোলাইটলি বলি—

— ব্যস্ত আছো? একটা লেখা শুনবে?

পরদিন সকালে দশটা নাগাদ আবার এলো শকুন্তলা। বিকেলে ট্রেন ওর। রিমঝিমের হাতের কাজটা করে দিল। যেন ও আগে থেকে জানতো কি করতে হবে। আগে থেকেই যেন ওর প্ল্যান করা ছিল কিভাবে করবে ওটা। ফটাফট করে দিল জিনিসটা। আমি চেয়ারে বসে বসে দেখলাম। তারপরে ছাদে গেলাম আমরা। দুপুর মেঘলা তখন। ও নিভৃতে চাইছিল আমাকে। এ বাড়িতে ছাদের ওপরে ছাদ আছে একটা। অনেক বাড়িতেই থাকে। সেখানে উঠে আবিষ্কার করা গেল একটা ঘরও আছে। হুড়কো খুলে, ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।

* * *

শকুন্তলার ঠোঁট এখন নতুন জিভের মতো অল্প লাল হয়ে আছে। ও বললো, আমার ঠোঁটও তাই। ছাদের ঘরটা থেকে আমরা বেরিয়ে, নেমে এলাম নিচের বড় ছাদে। রেলিঙে হাতের ঠেস দিয়ে ঝুঁকে আছি দুজনে। এখান থেকে শংকরদার ফ্ল্যাটে ঢোকার গলিটা দেখা যায়, স্পষ্ট। গলির মাথায় রাস্তাটাও দেখা যায় কিছুটা। শকুন্তলা বললো,

— নিচে চল। বৌদি স্নান করে বেরিয়ে ছাদে কাপড় মেলতে আসবে হয়তো।

আমরা তাও আরো কিছুক্ষণ তুলোর মতো লেগে লেগে ভেসে ভেসে বেড়ালাম ছাদের এখান থেকে ওখানে। ওর গলায় ঘাড়ে মুখ গুঁজে ওর গন্ধ মেখে নিচ্ছি। শিবমন্দিরে থাকার সময়, এক রাতে ক্যাডবেরি কেনা হয়েছিল। ডেয়ারি মিল্কের ছোট প্যাকেট পাওয়া গেল না। তাই, অপছন্দের কিটক্যাট। আমি হোটেলের ঘরে ফিরে আসার পর শকুন্তলা বারবার জিজ্ঞেস করছে,

— ক্যাডবেরি এনেছিস?

— না।

— কেন?

— এমনিই… ক্যাডবেরি দিয়ে কি হবে?

— বলনা.. এনেছিস তাইনা?

— না বললাম তো

— ও, আচ্ছা। ঠি-কা-ছে।

আমি শ্যাম্পু, ময়েশ্চারাইজ়ার এগুলো টেবিলের ওপর রাখছি। ও বাথরুমে গেল। এই ফাঁকে আমি ক্যাডবেরিটা আমার ব্যাগে লুকিয়ে রাখলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে, আমার ব্যাগ ঘাঁটতে লাগল। কি করে যেন ঠিক সন্দেহ করেছে। কিন্তু পেলো না। সালোয়ার পালটে শকুন্তলা এখন হাউজ় কোট পরেছে। লাল আর কালো মেশানো। আমাকে বাঁ-হাত দিয়ে ঠেলে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর বাঘিনীর মতো আস্তে আস্তে আমার ওপরে উঠে আসছে। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। কামাতুরা সব নারীর চোখ কি এক? যেমন সানি লিওন তেমনিই শকুন্তলা? টিভি চলছে। বোধহয় অ্যানিমেল প্ল্যানেট। টেবিলের ওপর রাখা রাতের খাবার। আমি হাত বাড়িয়ে ব্যাগ থেকে ক্যাডবেরিটা বের করে ওর হাতে দিলাম। ওর চোখে একটা দুষ্টুমি ঝিলিক দিল। আর ঐ ঝিলিকটাকে চোখে রেখেই খুলে ফেললো কিটক্যাটের প্যাকেটটা। এক টুকরো ঢুকিয়ে নিল নিজের মুখে। আমার মুখের ওপর ঝুঁকে এলো শকুন্তলার মুখ। জিভ দিয়ে কিটক্যাটের ভেজা টুকরোটা চালান করে দিল আমার মুখে। ঠোঁটের ভেতরে ঠোঁট, জিভের ভেতরে জিভ, আর তার ভেতর দিয়ে কিটক্যাটের একটা টুকরো এ-মুখ থেকে ও-মুখে চলে যাচ্ছে। তারপর মুখ সরিয়ে আয়নায় দেখি, দুজনের ঠোঁটই অল্প লাল অল্প বাদামি। দুজনের চোখেই আদরের ভাষা বরফের মতো ঝরে ঝরে পড়ছে। আমরা হোটেলের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। রাত গভীর হচ্ছে আস্তে আস্তে। রাস্তার বাতিগুলো কি এক অজানা মনখারাপ নিয়ে চুপচাপ ঝুঁকে আছে। দুটো নেড়ি কুকুর এখানে সেখানে রাস্তার ময়লা শুঁকছে। দূরে কোথায় একটা দুটো কুকুর ভৌউউউউউ করে উঠল। নেড়ি দুটো চমকে তাকালো এদিক ওদিক, কান খাড়া ক’রে। আমাদের হোটেলটাও চুপ করে আছে। শকুন্তলা হঠাৎ বলে উঠল—
There lies the heat of summer
On your cheek’s lovely art:
There lies the cold of winter
Within your little heart.
That will change, beloved,
The end not as the start!
Winter on your cheek then,
Summer in your heart.
— হঠাৎ হাইনে!

— কাল আমার ডায়রিতে যেটা লিখে দিয়েছিলি এটা তার উত্তর।

— কাল? কাল কি লিখেছিলাম?

— মনে কর

— কাল… কাল… কাল… কি লিখেছিলাম রে?

— মনে কর মনে কর… তুই-ই তো লিখেছিলি। তোরই তো মনে থাকা উচিত

— আঃ, মনে পড়ছে না তো, বল না—

— তাড়াহুড়ো নেই তো কোনো। পরে মনে ক—

— মনে পড়েছে

— ভালো

— ওটা ভাস্কর চক্রবর্তীর লাইন। ‘সঙ্গে থেকো সঙ্গে থেকো। সবসময় সঙ্গে সঙ্গে থেকো।’


২.

এত মন কেমন নিয়ে এই শহরের জল ছুঁইনি কখনো, আগে। এত জল এত মেঘ এত শহরও এই শহরে দেখিনি আগে। একটা বাসার নাম রাখা হয়েছিল, অক্ষরবৃত্ত। না, বরং বলা ভালো, রাখা হবে এমনটাই ঠিক হয়েছিল। এখন সেখানে ছন্দ কম, পড়িয়াছে। কিন্তু আমি জানি, মাত্রা অক্ষর পর্বে নয়, ছন্দ সব থেকে বেশি বাস করে যতির বাসায়। তবে, যতিতে থাকে স্মৃতি। তার পূর্বের সবটুকুর চলা ডুবে থাকে, মিশে থাকে যতির চুল থেকে নখ। একটা বাসার নাম রাখা হয়েছিল, অক্ষরবৃত্ত। এখন যতিতে এসে, সে বাসা, জ্বলজ্বল ও ছলছল করছে। বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতেও কি থাকে না বন্যার জল, মিশে?



কাল শকুন্তলা বলছিলো, আমরা যদি বাকি জীবনটা হোটেলে হোটেলে কাটিয়ে দিই? আসলে কিন্তু আমি যতটা জীবন ও জীবিকা বিমুখ, শকুন্তলা ততটাই জীবনমুখী। আমিও ওরকম জীবনমুখী হয়ে থাকবার চেষ্টা করে দেখেছি কয়েকবার। দু’তিন মাসের বেশি টানতে পারিনি। হাঁপিয়ে যাই। মাঝে মাঝে মনে হয় সারাদিন সিগারেট খেয়ে যাওয়া আর আমজাদ আলি খান সাহেবের সরোদ শুনবার জন্যেই বোধহয় বেঁচে আছি। ছাদ থেকে নেমে এলাম আমরা। যতটা ধীরে নামা যায়। নামছি। বৌদি স্নান করে বেরিয়েছে সদ্য। ভেজা চুল খুলে পুজোয় বসেছে। শকুন্তলা বৌদিকে আর রিমঝিমকে বলে বেরিয়ে গেল। আমি ওকে খানিকটা এগিয়ে দিলাম। ফিরে এসে দেখি চশমাটা ফেলে গেছে। বিকেলের বাস ধরে আমিও ফিরে এলাম কুচবিহার। সঙ্গে ক’রে নিয়ে এলাম ওর চশমাটা। আর পরদিন থেকে কি এক ভয় কোত্থেকে এসে চেপে ধরলো আমাকে। চিনিনা জানিনা কি এক ভয়। এরকম দম বন্ধ করা, শ্বাসরোধী একা লাগছে কেন বুঝতে পারছি না… হয়ত ভয় পাচ্ছি… হয়ত বুঝতে চাইছি না… যদি সেই কারণটা এই একার থেকে বেশি জোরালো হয়…? সারাদিন ধরে একটার পর একটা সিনেমা দেখে যাচ্ছি… যতক্ষণ দেখছি, ততক্ষণ, নিরাপদ লাগছে সব কিছু। সিনেমা ফুরোলেই, সারা ঘর, টেবিল, খাট, বইয়ের তাক, এমন কি ফ্যানের হাওয়া, সব চেপে আসছে… একের পর এক সিগারেট খেতে খেতে আর একটার পর একটা সিনেমা দেখতে দেখতে আমি কি কারোর আসার জন্য অপেক্ষা করছি? সবকটা সিনেমা দেখা শেষ হয়ে গেলে তখন আমি কি করব, সেটাও আরেকটা ভয়। কি মনে হল, fbটা খুলে চলে গেলাম এক মৃত মানুষের অ্যাকাউন্টে… কেন গেলাম? একটা মানুষ একদিন নিজের হাতে সাজিয়েছিল এই প্রোফাইল, কভার। সেই পুরনো পোস্ট, পুরনো শেয়ার, পুরনো ট্যাগগুলো। পুরনো স্টেটাস। ছবি। সব আছে। লোকটা নেই। নিজের মনে এটাই ভাবছি, এটাই বলছি, কেন গেলাম? আমিও তো এক আত্মধ্বংসী, আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষ... এবং vulnerable... তাহলে? এত লিখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু, কিছুতেই কিচ্ছু লিখতে পারছি না। জীবনের ঝামেলাগুলোর মতোন চুলগুলো মুখের সামনে, চোখের সামনে চলে আসছে বারবার। নাকি চুলগুলোর মতোন ঝামেলাগুলো চলে আসছে! সারাদিন ধরে মাথাটা ব্যথা করে করে কাঁপিয়ে দিল একেবারে। সন্ধ্যে একটু রাতের দিকে গড়াতে শুরু করলে, ব্যথাটাও কমেছে যাহোক। কি মনে ক’রে ভাতখন্ডের হিন্দুস্থানী সংগীত পদ্ধতির বইটা বের করলাম। পঞ্চম খন্ড। খুব ভালো লাগলো এই কথাটা— দেসরাগশ্চ দ্বিতীয়প্রহরে নিশি। কি সুন্দর কথাটা! দ্বিতীয়প্রহরে নিশি। যতবার উচ্চারণ করছি, কথাটা, ভেতরে ইকো হয়ে হয়ে ঘুরছে। দ্বিতীয়প্রহরে নিশি। দ্বিতীয়প্রহরে নিশি। সারাদিন খুব ঘুমিয়েছি। রাতে কি জাগবো তাহলে? যদি জেগেই থাকি, কে জাগবে আসলে? আমি? নাকি আমার মতোন দেখতে কেউ জাগবে? এই ঘরে, এই খাটে, এই কম্পিউটারের সামনে, বুকসেলফের পাশে, কে থাকে? আমি? বাথরুমে যাবার সময়, টবে রাখা গাছগুলোর দিকে চোখ যায়। না, ঠিক যাবার সময় নয়, তখন একটা তাড়াহুড়ো থাকে যাবার প্রতি। চোখ যায়, ফেরার সময়। খুব মায়া হয় ওই সবুজগুলোর জন্য। নেহাতই অল্প ওরা। কিন্তু, তাতেই কতটা ভরিয়ে রাখতে জানে। ভরে থাকতে জানে। রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে, আমি যখন বাথরুমে যাই, আমার কেন দেস অথবা সৌরঠ, কোন রাগের কথাই মনে আসে না!? বেশ একটু বড় হয়ে, ইমন রাগ শিখছি তখন। কল্যাণ ঠাট। বেহালার তারে সে রাগ তুলতে গিয়ে যেই না কড়ি মা লাগিয়েছি, ছেলেবেলার সেই ডাক, ফিরে এলো কানে। সন্ধ্যেবেলা, খেলার মাঠ থেকে ফিরে, আধো আলো আধো অন্ধকারে, কলতলায় হাত-মুখ ধুচ্ছি, আর চিৎকার করে বলছি, মাআআআআআআআআ….. খেতে দাও খিদে পেয়েছেএএএএ…. সেই তীব্র মা… আমার স্কেলটা মিলে গেল ন্যাচরাল সি-তে। আর কি আশ্চর্য, এটাও সন্ধ্যের রাগ। সেই কতদিন আগে, সন্ধ্যেবেলা, না জেনেই, কড়ি মা লাগিয়েছি। বিশুদ্ধ কড়ি মা-য় ডেকেছি মাকে। তারও কত পরে লিখেছি, ইমন ধুয়ে গেছে মায়ের কল্যাণে। সেই সন্ধ্যে। সূর্যাস্ত। ঘটাং ঘট ঘটাং ঘট করে আমি টিউকল পাম্প করছি, আর হড়হড় করে জল নেমে আসছে, ধুয়ে ফেলছি হাঁটুতে, পায়ের পাতায়, আঙুলে, হাতে, ধুলো কাদা। আর সন্ধ্যে নামছে, আস্তে আস্তে কালো হয়ে আসছে মাঠ। দূরের বাড়িগুলো আরো আবছা হয়ে যাচ্ছে। শাঁখে ফুঁ দিচ্ছে মা। চৌকাঠে দিচ্ছে জল ছিটিয়ে। শকুন্তলা হঠাৎ করে কেন জানিনা যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ভাস্কর চক্রবর্তী নামের ঐ লোকটার মতো আমিও প্রতিদিন আরো বুঝতে পারছি, একমাত্র লেখাই পারে, লেখাই পারে আমাকে বাঁচাতে। রক্তের মধ্যে শব্দের চোরকাঁটা ঢুকে গেছে কখন, অজান্তে। রাস্তায় বেরোলে অবধারিত ভাবেই কিছু চেনা মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায়। তবে জানা মানুষ নয়। একজন মানুষের একটা জীবনে জানা মানুষ ক’জন থাকে? আমার ক’জন জানা মানুষ? কিছু কিছু মানুষের সামনে শুধু হাসতে হয়। ঠোঁটদুটো দুপাশে যতটা পারা যায় ছড়িয়ে রাখতে হয় তাদের সাথে কথা বলার সময়। তারা যখন কথা বলেন, তাদের কথাগুলো যেন শুনছি, এরকম একটা ভান করার জন্যে সবসময় তখনো ঐরকম হাসিটা ধরে রাখতে হয়। তারা মুখ নিচু করে দেখেন আমার দু’পায়ের বড় বড় নখ। আমি এদেরকে কখনো আমার ঘরে আসতে বলতে পারি না। এদের সামনে প্রচুর মিথ্যেও বলে ফেলি আমি অবলীলাক্রমে। দেখাই, আমি কত ভাল আছি এখন, কত কাজ করছি, কত দায়িত্ব সামলাই আমি। কত পড়াশুনো করছি। কবিতা উপন্যাস পড়ার মতো ফালতু পড়াশুনো নয়। এ হল কাজের পড়াশুনো। যে পড়া পড়লে চাকরি হবে। জি.কে., জি.আই., কারেন্ট এফেয়ার্স, রিজ়নিং টেস্ট। কত ঠিক এবং ঠাক আছি আমি আজকাল, ইদানীং, দেখাই। নীল রঙের একটা সাইকেল ভ্যান বাচ্চাদের নিয়ে ফিরছে স্কুল থেকে। সরু সরু গলার তীক্ষ্ণ কোরাসের আওয়াজ চিঁ চিঁ করতে করতে চলে গেল। আজ মঙ্গলবার। কিছু একটা পুজো-টুজো হবে হয়তো বা। পাশের কোনো বাড়িতে শাঁখে ফুঁ পড়ল তিনবার। তৃতীয়বারের ফুঁতে বেশি জোর পেলো না ফুঁ দাত্রী। আচ্ছা, যদি ইন্টারভিউতে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার কী করতে ভালো লাগে, আমি কি বলতে পারবো, আমার ‘দেসরাগশ্চ দ্বিতীয়প্রহরে নিশি’ কথাটা বারবার উচ্চারণ করতে ভালো লাগে?

ছোটগল্প - মৌ দাশগুপ্ত

সম্পর্ক
মৌ দাশগুপ্ত



জায়গাটা ভারী নির্জন। উত্তর শহরতলীর রেলস্টেশনের লাগোয়া এই এলাকায় রেলগাড়ীর ঝমাঝম শব্দটাই যা মাঝেমধ্যে নীরবতাকে ভেঙে বৈচিত্র্য আনে। ছোট একটা কচুরীপানা ভরা জলা, পাশে পুরসভার বানানো জঞ্জাল ফেলার বড় সিমেন্টের ডাষ্টবিন,যেখানে খনিক দূরবর্তী বাজার,হাউসিং,নার্সিংহোম,আর টয় ফ্যাক্টরীর আবর্জনা গাদা হয়ে থাকে বছরভোর।অনতিদূরে বন্ধ হয়ে যাওয়া জুটমিলের ভাঙাচোরা ধাঁচাটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে ধুঁকছে। আগাছার জঙ্গলে ঢাকা। লোকজনের যাতায়াত বিশেষ নেই। কুকুর ভবঘুরেদের আড্ডা। অসামাজিক কাজকর্মেরও অভাব নেই বলেই জনশ্রুতি। সাধারন লোকজন তাই যাতায়াতের সময় জায়গাটা এড়িয়েই চলে। একটু ঘুরপথ হলেও রেললাইনের পাশের ইঁটের রাস্তাটাই লোক টানে বেশী।

আজ হঠাৎই নিস্তরঙ্গ নৈশব্দে বাঁধা পড়েছে এক সদ্যোজাতার কান্নায়। একটা ছোট্ট পুরানো কাপড়ের পুঁটলীটার মধ্যে থেকে হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করছে বাচ্চাটা।নোংরার ওপর যত্ন করে কাপড়ে মুড়ে কেউ একান্তে রেখে গেছে। ছেড়ে গেছে। ডাস্টবিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাদামী নেড়ি কুকুরের দৃষ্টি সেদিকেই। চোয়াল থেকে নোংরা লালা গড়িয়ে পড়ছে জিভ বেয়ে। কাছেই ডাষ্টবিনের সিমেন্টের দেওয়ালে বসা, কি পাশের ছাতিম গাছের ডালে বসা, ইতস্তত ওড়া কাকগুলো লোভী দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। ওদের জন্য এটা এক খণ্ড মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। সাহসী একটা কাক উড়ে এসে বসে বাচ্চাটার কাছে। ঘেউ ঘেউ করে এগিয়ে আসে কুকুরটা। যেন খাবারের ভাগ কাউকেই দিতে রাজি নয়। বাচ্চাটার চোখে মুখে এসে বসছে পোকা মাছি,লাল পিঁপড়ে। তারস্বরে চিৎকার করছে শিশুটি।। হয়তো ঠাণ্ডাও লাগছে তার। মাতৃগর্ভের ওম থেকে বেড়িয়ে সে পায়নি নরম কাঁথা আর মায়ের কোমল স্নেহের উষ্ণতা। তার অভিমান তীক্ষ্ণ চিৎকার হয়ে চীরে দিচ্ছে ভোরের শান্ত নীরবতা। দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে প্রতিবাদ করছে গলে পচে যাওয়া এই সমাজ ব্যবস্থার। যেখানে একজন মা তার সন্তানকে লোকলজ্জায় কি অন্য কোন চাপে ফেলে যেতে বাধ্য হয়।

একটা কিশোর কন্ঠ শোনা যায়। - ‘বাঘু, এই বাঘু। কোথায় গেলি?’ সাথে আরেকটি মিহি গলা তাল মেলায়। বাচ্চাটার পাশে বসে থাকা কুকুরটা উঠে দাঁড়ায়। জিভ দিয়ে মুখ চাটতে চাটতে লেজ নাড়ায়। হাই তোলে কিন্তু দৃষ্টি সরায় না। একটু পরে ভৌ ভৌ করে ডেকে ওঠে।ডাষ্টবিনের অন্য সাইড দিয়ে এগিয়ে আসে দুই মূর্তি। বড় ছেলেটির মেরে কেটে বছর বারো, অন্য ছেলেটির আরো কম। স্টেশনে ভিক্ষে চাওয়া দুই পথশিশু। কোমরে দড়ি বাঁধা ছেঁড়া ময়লা হাফপ্যান্ট।একজনের হাতে একটা বাসী পাউরুটি, আজকের রোজগার। অন্যজনের হাতে কয়েকটা শাপলা,আধপচা দাগধরা কয়েকটা বেগুন। আজকের দুপুরের খ্যাঁটের উপাদান। কুকুরটা আবার ডাকতে ডাতে দৌড়ে গিয়ে বড় ছেলেটির মলিন হাফপ্যান্টের প্রান্ত দাঁতে কামড়ে ধরে অকুস্থলের দিকে টানতে থাকে। হাবভাবে বোঝা যায় এরাই বাঘু অর্থাৎ কুকুরটির মালিক।

শরীর এখনো অশক্ত। কলেজ বন্ধ, মা বাবার সাথে কসবার বাড়ীতেও নেই পৃথা। দক্ষিণেশ্বরের কাছেই ওর ছোটপিসির বাড়ীতে আছে আজ মাস ছয়েক। আসল কারন কেউ জানে না। পাশ ফিরে শোয় পৃথা। দুচোখে জলের ধারা থামেনা তার। সাতটা দিন কেটে গেছে, এখনও বাচ্চাটার কথা ভেবে প্রতি রাতে কাঁদে সে। কিছুতেই ভুলতে পারেনা নিজের ভুলের কথা। ভালবেসে নিজর সর্বস্ব দিয়েও ঠকে যাবার কথা। চরম মানসিক আঘাত পাবার কথা। বাড়ীতে শারীরিক অসুবিধা জানাজানি হবার পর ওর চরম আপত্তি স্বত্তেও গাইনোকলোজিস্টকে দেখিয়ে অ্যাবরেসনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল পৃথার একান্ত শারীরিক যার অনিবার্য ফল স্বরূপ পৃথার সন্তানের জন্ম, এরপর লোক লজ্জার ভয়ে হাসপাতাল থেকেই সেই সন্তানকে সরিয়ে দেয়া। ওকে অবশ্য বলা হয়েছিল যে ওর মৃত সন্তান হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের নার্স পরে কেন জানিনা ওকে আসল ঘটনা বলে দেয়। বলে দেয় যে, কোন এক নির্জন এলাকায় সেই সদ্যজাতা বাচ্চাটিকে রেখে আসা হয়েছে, যদি কারও দয়া হয়, যদি কোন নিঃসন্তান দম্পতি তুলে নিয়ে যান বাচ্চাটাকে। যদিও এর পরের খবর কেউই জানেনা। তবুও ওর মনে একটাই আশা, সে যেখানেই থাকুক ,ভালো থাকুক, বেঁচে থাকুক, সুস্থ থাকুক।

ফাগুনমাস। রেললাইনের ওপর খোলা নীলাকাশটা পড়ন্ত বিকালে মলিন লাগছে। নীল পটভুমিকায় থোকায় থোকায় ফুটে আছে লাল কৃষ্ণচূড়া। আকাশে কয়েকটা কাক চক্রাকারে উড়ছে।রেললাইনের অনতিদূরে ভাঙা পরিত্যক্ত জুটমিলের পাশের রাস্তাটা যেখানে ডোবার পাশে পুরসভার বড় ভ্যাটটার পাশে হঠাৎ যেন থমকে গেছে সেখানে রাস্তার ধারে ঢালু জায়গাটা ঘেঁষে ইতস্তত জলজ আগাছা আর বুনো ঝোপঝাড়ের ভীড়। একটা ঝোপের পাশে রক্তমাখা একটা বস্তা। চটের বস্তা। সেখান থেকে একটা হাত বার হয়ে আছে। কয়েক মুহুর্ত তাকালে বোঝা যেতে পারে হাতটি হয়তো কখনো ছটফটে একটি শিশুর ছিলো। ওই যে মনে হচ্ছে তার ছোট ছোট দুই পা যেন বস্তায় ঢেকে আছে। মুখের একটা পাশও বস্তা থেকে বার হওয়া হয়ত রক্তের গন্ধ পেয়ে কুকুরগুলোই বস্তা কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে তারপর কোন নামানুষের এই পাশবিক কুকীর্তি দেখে পশু হয়েও লজ্জা পেয়ে সরে গিয়ে খানিকদূরে থাবা গেড়ে বসে পাহাড়া দিচ্ছে। ছোট্ট একটা মাথা, একমাথা চুল আলুথালু। একটা লাল ফিতে প্রায় খুলে গিয়েও কিছুতেই যেন মায়া ছেড়ে সরে যেতে চাইছেনা । আকাশের দিকে খোলা দুই চোখ। নি:সীম শূণ্যতা মাখা। চোখগুলোয় কোন ভয় নেই, কান্না নেই। কোন প্রশ্নও নেই। শুধু অবিশ্বাস আর কেমন যেন এক থমকে যাওয়া নিস্পাপ সারল্য, থমকে গেছে কাকেরাও। তাদের কর্কশ কণ্ঠের কোন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। ঠুকরে দেবার ইচ্ছে জাগছে না তাদের। তারা নেমে আসছে না। শুধু চক্রাকারে উড়ছে। অন্ধকার নামবে, গুনগুন করে কাঁদছে কয়েকজন জমায়েত স্টেশনবাসী ,কেউ মেয়েটার কাকা, কাকী, মামা মামী,মেসো মাসী, দাদা দিদি,রক্তের নয় কিন্তু গাঢ় সম্পর্ক ওদের। ওরা বসে আছে পুলিশের জন্য আর মেয়েটার দুই দাদার জন্য। দু’জনই ট্রেনে হকারী করে। খবর গেছে তাদের কাছে। বছর দশেক আগে এই আবর্জনার গাদায় ফেলে যাওয়া এক সদ্যোজাতাকে নিয়ে দুই কিশোর বালক যে সম্পর্কের বাঁধন গড়ে তুলেছিল তা ভেঙে চুরমার হওয়ার মুহূর্তটা যে কতটা বেদনার তা বুঝছে বলেই একে একে সব স্টেশনবাসী জড় হচ্ছে ওদের সামাল দিতে। ওদের ভরসাতেই ছোট্ট একরত্তি বোনটাকে রেখে রোজগারে যেত দু’ভাই। কখন যে মেয়েটা নজর এড়িয়ে একলা হয়ে গেল, কখন যে দূরে সরে গেল সুরক্ষিত এলাকা ছেড়ে কখন যে এক নরপশুর আদিম প্রবৃত্তি জেগে উঠলো এই একরত্তি মেয়ের মধ্যে নারীত্ব আবিস্কার করে কে জানে।

পৃথা নামের সেই নিতান্ত অবুঝ কিশোরীপ্রায় তরুণীটা আজ দশটি বসন্ত পেরিয়ে আজ একটি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টার। ভালোভাবে বলতে গেলে ক্রাইম রিপোর্টার।। সংসার-সন্তান-সম্মান সব-ই আছে তার।তারপরও কোন কোন দিন বিকেল বেলার অবসন্ন সময়ে তার মনে পড়ে মন দিয়ে মন নেবার ছলনার কথা। এক সুঠাম যুবকের মিথ্যে প্রতিশ্রুতির কথা। সে তো হারিয়ে গেছে পৃথার জীবনের পাতা থেকে। ছিল এক রক্তের দাগ। সময়ের ভাঁজে সেও আর মনে পড়ে কই! তবুও কেন এ প্রতীক্ষা, এই মন খারাপ, এই সব পেয়েও না পাবার দুঃখ? এর উত্তর সে জানেনা।

পুলিশ এসে ধর্ষিতা বালিকার নিথর শব তুলে নিয়ে গেছে অনেক আগে, বড় ভাইটি শক্তমুখে চুপ করে থাকলেও ছোট ভাইটি শাপশাপান্ত করে গালি দিয়ে কেঁদে ভাসিয়েছে। কেঁদেছে ঐ মেয়ের বয়সী সন্তানদের মা বাবারা, অজানিত আশঙ্কায়,অসহায় ক্রোধে,কেঁদেছে মেয়েটার সমবয়সী খেলুড়েরা, যাদের সাথে সকালেও কথা বলেছে খুশী নামের মেয়েটা।খবরের ছোট্ট হেডলাইন বানাতে এসে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়েছে পৃথা। কেন জানি না ওর দু'চোখ ভিজে ওঠে,ওর বাচ্চাটা বেঁচে থাকলে এই রকম বড়ই হতো এখন। দশ বছর।ওর বাচ্চাটা থাকলে আজকে হয়তো অন্যরকম জীবন হত পৃথার। কিন্তু তার যদি এইরকম ভবিতব্য হোত? ভাবতেই বুকটা ব্যাথায় মুচড়ে ওঠে ওর। কষ্ট লুকাতে অন্য কিছু ভাবতে চেষ্টা করে সে। না কোন অমঙ্গল যেন না হয় তার। সে যেখানেই থাকুক ,ভালো থাকুক, বেঁচে থাকুক, সুস্থ থাকুক।

ছোটগল্প - ঋষি সৌরক

সাকিন হাওয়ার অলিগলি
ঋষি সৌরক



এই গলিটার মত গলি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই হলফ করে বলা যায়। আর সেই গলিটা দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে রতন। এক-একটা পা ফেলার সাথে রোমাঞ্চের গুঞ্জন উঠে আসে । সাবধানে পা ফেলে চলে রতন । শ্যাওলায় পা পিছলে যেতে পারে। একটু বিপজ্জনক অথচ কয়েক ফুটের এই গলিটা পার হলেই ...

কোলকাতার হাওয়ায় অদ্ভুত সব গন্ধ । কিছুটা সংস্কৃতি কিছুটা হালচাল – চলমান মেট্রো – শ্যামবাজার – শহর ছুটে যাচ্ছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত – তার কোঁচড়ে বনেদিয়ানার শেকড় এবং কসমোপলিটন দণ্ডবত। কোলকাতায় রাই আছে । রাই এর গায়ের গন্ধ আছে । রতন খুব জোরে জোরে শ্বাস নেয় । কোলকাতার হাওয়া কি আমেদাবাদ এ ভেসে আসে? আসতেই পারে । হাওয়াদের কোনো পাসপোর্ট লাগে না – রোমিং ও লাগে না । কোলকাতার সেইসব হাওয়ার কোনো একটায় রাই এর বুক থেকে উঠে আসা অদৃশ্য চিহ্ন থেকে যায় । পরম যত্নে শ্বাস নেয় রতন। কাকারিয়া লেক এর কাছে আরাধনা সিনেমা হল । আবিষ্কার করে যারপরনাই পুলকিত হয় রতন। সিনেমা দেখতে এতদিন আলফা-ওয়ান সিনেপলিস এ ছুটেছিলো রতন । ছুটেছে শিবা কমপ্লেক্স আশ্রমরোড । কিম্বা সিটিএম রেভলিউশন । ইমোশনাল ফিল্মম্যানিয়া বলে একটা রোগ আছে । মানুষ যখন খুব একাকীত্বে ভোগে – নিকষ নিঃসীম একাকীত্ব তখন অস্বাভাবিক রকমের সিনেমা দেখে – নিজের রুচির ভেতরে এবং বাইরে । যেসব সিনেমা সে একা দেখতে পারে না সেইসব সিনেমাও সে অনায়াসে দেখে ফেলে একা একাই তবে সিনেমাহলের অন্যান্য দর্শকদের মাঝে । সে মনে করে ওই একটা সময়ের জন্য সে আর একা নেই । যারা দর্শক তাদের সাথে একসাথে সে নিজের একাকীত্ব শেয়ার করে নেয় কোনো কমিউনিকেশন ছাড়াই । প্রচুর টাকা এভাবে নষ্ট হয়ে গেছে রতনের। তেলুগু-ভোজপুরি-ইংলিশ-যতবিচ্ছিরি হিন্দি এমনকি গুজরাতী সিনেমাও সে দেখে ফেলেছে গাদাগুচ্ছেক। একদিনে পাঁচ-পাঁচটা সিনেমা পাগলের মত দেখে গেছে সে ।প্রতি টা সিনেমার টিকিট ২০০ টাকা করে।কিছুটা সময় এভাবে কাটে । কিন্তু একাকীত্ব যেন আরো ছেঁকে ধরে ।প্রতিবার সিনেমা শেষ হবার পর সিনেমাহল থেকে যখন সবাই বেরিয়ে যায় রতনের খালি মনে হয় আর একটু থাকা যেত না ! আরাধনা সিনেমা হল এ ৪০ টাকার টিকিট –ব্যালকনি । রতন এখন ওখানেই সিনেমা দেখতে যায় । লোকে ভীষণ প্রাণবন্ত ভাবে সিনেমা দেখে । সিটি মারে – নাচ করে। ওদের উদ্বেগ-কৌতুহল- আনন্দ-হতাশা –চিতকার –আবেগ সমস্ত কিছুর মধ্যে রতন নিজেকে খুঁজে পায় । নিশব্দে কথোপকথন হয় ওদের সাথে । ভোজপুরি সিনেমায় সুইটি ছাবড়া যখন কোমর দুলিয়ে আইটেম নাচে তখন সিনেমা হলের রিক্সাওলা থেকে বাবুসাব সক্কলে গলা জড়াজড়ি করে সে কি ফুর্তি-কি মস্করা রতন শুষে নেয় ! শুষে শু্ষে নেয় ।বাঁকুড়ার কথা মনে পড়ে ? বাঁকুড়ার সেই কুসুম হল। যেখানে একবার জোর করে এক বান্ধবী নিয়ে গেছিলো লে-ছক্কা দেখতে ? ২০টাকার টিকিট । না আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা না আছে ডলবি সাউণ্ডসিস্টেম না আছে মুভেবল আরামকেদারা আর না আছে ২০০ টাকার জাম্বো-পপকর্ন ! মানুষের গায়ের গন্ধ যে কতখানি ডেলিকেট হয় – একজন বান্ধবী কতখানি পরম আত্মীয়া হলে সামান্য যত্নই স্বর্গ হয়ে ওঠে মনে পড়ে যায় রতনের । আজ ওর আরাধনা সিনেমা হল এ গেলেও মনে হয় বাঁকুড়াতে পৌঁছে গেছি । “সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে অচেনা ক্রাউডকে এড়িয়ে আবছায়া রাত্তিরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরা যাবে ফেরা যাবে মনে কর ফেরা হল না বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেলো না কে যেনো ম্যাজিক করে ভ্যানিস করে দিয়েছে বাড়িটাকে বাড়িটাকে রোজই তো ঘটে কত হ্যানাত্যানা কেন এমনটা ঘটে না ঠিক যেমন অবাস্তবে আমার এ ভালোবাসা বেঁচে থাকে বেঁচে থাকে” –একাকীত্বটা কানে বেজে ওঠে ! আর ঠিক তক্ষুণী মনে পড়ে যায় রায়বরেলী উত্তরপ্রদেশের কথা ! প্রথম একার মত একা হওয়ার শুরু । বাবা-মা-পরিবার-পরিজন-সাধের বাংলা –বারো মাসে তেরো পাব্বন সব ছেড়ে সত্যি সত্যি একা । এভাবেই একটা গুজরাতের মধ্যে আস্ত কোলকাতা আস্ত উত্তরপ্রদেশ আরো কতকী অজানা আয়তনে ঢুকে আছে । বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য কে অনুভব করে রতন । বুকের মধ্যে গান বাজতে থাকে একা একা । একা একাই গুনগুনিয়ে ওঠে রতন । একাই শোনে একাই খায় একাই বাঁচে । একা একাই ভালোবাসে । একা একা গলি পেরোয় একটা । আমদেবাদ থেকে কোলকাতার শর্টকাট । যেটার খবর আর কেউ জানে না । শুধু রতন জানে। ওই গলিটার ওপারে আছে কোলকাতা । কোলকাতার কোনো এক গলি দিয়ে উত্তরপ্রদেশ । উত্তরপ্রদেশের কোনো এক শর্টকার্ট দিয়ে বাঁকুড়া। বাঁকুড়া থেকে ফ্যাণ্টাসিমোড়া অলিগলি পেরিয়ে আমেদাবাদ । এভাবেই মিশে থাকে বেঁচে থাকা । একা একা বেঁচে থাকার পরও আমি থেকে আমরা হয়ে ওঠে ; কোলকাতার রতন –বাঁকুড়ার রতন-উত্তরপ্রদেশের রতন আর আমেদাবাদ এর রতনেরা ! হাওয়াদের কোনো সইসাবুত লাগে না – হাওয়াদের হারিয়ে যেতে ছুতো লাগে না । রতন হারিয়ে যায় ...

ছোটগল্প - ঈশান ব্যানার্জী







প্রবন্ধ - অমিতাভ প্রহরাজ

লেখা লিখতে কারোর 'ল' লাগে, কারোর পেন লাগে-
অমিতাভ প্রহরাজ



প্লিজ ভাববেন না কোন তুলনা বা "দ্যাখ-কেমন-লাগে" টাইপের অঙ্গভঙ্গি করার চেষ্টা করছি এটা পোস্ট করে, নিছক ওই মিলের জায়গাটা কেমন কাকতাল জাতীয় পতনের মজা সেটা মনে পড়লো বলে বললাম... তুলনার কোন জায়গাই আসেনা, কারন আপনার লেখাটি, আপনার নিজস্ব লেখা, একটি স্বতন্ত্র সৎ সৃষ্টি, আর আমারটা জানিনা, তবে টুকে লেখা নয় এইটি জানি... এটি পোস্ট করে কোন উপদেশ, জ্ঞান বা বাণী বিতরণকরছিনা বা মডেল কবিতাও দেখাচ্ছি না... কেমন চিন্তাস্রোত, আমাদের অজান্তে তার বেস্ট ফ্রেন্ড 'সময়'কে নিয়ে অন্য চিন্তাস্রোতের সাথে লাইন মারে সেটাই দেখাচ্ছি... সেইজন্য, নিজের ভাবনা-চিন্তাকে একটু চোখে চোখে রাখবেন, ও খুব উড়ু উড়ু আর নিজেকে বেশ লায়েক ও সবজান্তা ভাবে, আপনার অজান্তেই... ও তো টীন-এজার থাকতে পছন্দ করে সবসময়, ব্রোঞ্জ এজার বা স্টোন এজার বা বাপ ঠাকুর্দা, প্যালিওলিথিক এজার, নিওলিথিক এজার দের দু চক্ষে দেখতে পারেনা... ওর মানসিকতাটা হচ্ছে যে "তুমি কবে কি একটা পাগলাচোদার মতো ভেবে দুটো পাথর ঠুকে ওই গা গরম করার আর রাত্রে দেখার জিনিস বানিয়েছিলে বা পুরো সার্কিটকাটার মতো পাথরে ঠুকে, হাতে কড়া ফেলে ওই মোষগুলোর মতো দেখতে কয়েকটা দাগ কেটেছিলে গুহার মধ্যে, সারাক্ষণ খালি তার কথা বলে যাবে, ওরকম হতে বলবে ওটা আমাদের ইন থিং নয়, জেনারেশান গ্যাপ... আমি বড় হয়ে জ্যাকসোন পোলক হবো... নাম শুনেছো কখনো? তোমার মতো মোষ আঁকেনি সারাজীবন ধরে, ওই আলতা ফালতা, মীরার ভজন আমাদের চলেনা..." এবং এই মানসিকতাটা ওর গ্রো করে আপনাকে না জানিয়েই, লুকিয়ে লুকিয়ে... হস্টেলে গেলে ছেলের যেমন পাখনা গজায়, তেমনি... তাই ভাবনাচিন্তা নামক কিশোর/কিশোরীটিকে স্নেহ ও আদরের সাথে সাথে শাসনও করতে হয়... বকতে হয়, অপদার্থ, নালায়েক, বাচাল, সবজান্তা বলে... এই শাসন করলে ওর মধ্যে বিনয়, অন্যকে শ্রদ্ধা করা, ঝগড়া না করা, মানুষকে ভালোবাসা এইসব ভালো গুনগুলো আসে... নইলে বখে যায়, উদ্ধত, দুর্বীনিত হয়ে ওঠে, আপনি হয়তো ওর দিকে নজর দেওয়ার সময় পাচ্ছেন না তার সুযোগ নিয়ে... আপনি ওকে হয়তো ভালো ভাল বইতে পাঠান ক্লাস করতে, ভালো সিনেমার কাছে কোচিং এ ভর্ত্তি করে দেন, ভাল গানকেও প্রাইভেট টিউটর রাখেন যাতে ও বড় হয়ে ভাল রেজাল্ট করে... ও ফাঁকতালে করে কি ওইসব কোচিং কেটে অহংকার সমিতি বা দর্প সংঘ ক্লাবে রকবাজি করছে, প্লাস বললাম তো ভাবনাচিন্তা বেসিক্যালি একটা বাচ্চা ছেলে তো, তাই একটু হীরো হওয়ার, ইমেজ তৈরী করার, হাতে বালা পরার, ট্যাটু করার প্রবল ইচ্ছে থাকে... স্বাভাবিক, রনবীর কাপুরের চুলের স্টাইল নকল করে, ওয়ার্ডরোবে জেনিফার এ্যানিস্টনের পোস্টার লাগিয়ে রাখে... কিন্তু এদিকে আপনি ওকে কোথাও নিয়ে যান সঙ্গে করে, তখন বলবে "এ্যান্থনি হপকিন্স আমার সবচেয়ে প্রিয় অভিনেতা, হুপি গোল্ডবার্গ আমার প্রিয় অভিনেত্রী, ব্রিটনিকে সহ্য করতে পারিনা", কারন খুব চালু তো, হবে নাই বা বা কেন? যার বাপের নাম ঘিলু মায়ের নাম অনুভূতি দেবী, যার ঠাকুর্দা রায়বাহাদুর অভিজ্ঞতা রায়, সে তো মহা চালু হবেই, বংশের ধারা... তাই সবার সামনে ইমেজের জন্য ওইসব, এদিকে ফিফিটি শেডস অফ গ্রে প্রথম দিনেই কেনা হয়ে গেছে আপনারই পকেট মেরে... আপনি হয়তো ভাবছেন যে না, ওকে আপনার মনের মতো তৈরী করবেন, কিন্তু বজ্জাত ছেলেটি, মানে ভাবনাচিন্তা, মহা ত্যাঁদড়... ওর একটা স্টেডি গার্লফ্রেন্ড আছে চেতনা নামে... তার কথাও আপনার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে... আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন, এদিকে বাবু চেতনার সাথে ফ্লার্ট করেই যাচ্ছেন সারারাত ধরে... আপনি সকালে দেখলেন ওর চোখ লাল, জিজ্ঞেস করলেন যে "কি হয়েছে রে? রাত্রে ঘুমস নি?" ও বলবে "না না, খুব দুঃখের স্বপ্ন দেখেছি একটা, দেখে কাঁদছিলাম"... ওই জন্য এক আধটু শাসন দরকার, বা কোন ডাক্তারজেঠু বা মাস্টারকাকু টাইপের কাউকে দরকার যাকে ও যমের মতো ভয় পায়... কারন অনেক সময় হয় কি, আপনার খুব স্নেহের পাত্র তো, আপনি জন্ম দেননি বটে কিন্তু বলতে গেলে কোলেপিঠে করে আপনিই মানুষ করেছেন... শরীর টরীর খারাপ হলে ওকে আপনি নিজে এ্যাসটেরিক্স কিনে দিয়েছেন, আনন্দমেলা দিয়েছেন... ও তো বড্ড মায়া কাড়ে আপনার... জানেন যে অর বাপ ঘিলু আর মা অনুভূতিদেবী ওকে জন্ম দিয়ে ফেলে রেখে নতুন এ্যাফেয়ার করতে চলে গেছে, বাবা মায়ের সান্নিধ্য পায়নি কোনদিন, তাই মায়া কাজ করে... অনেক সময় প্রাণে ধরে বকতে পারেন না... সেইজন্যই একজন কাউকে দরকার এ্যাটলিস্ট যার কথা না মানলেও অন্তত যেন শোনে... এতে ওরই ভালো হবে... আর ওই যে ইমেজ তৈরী বললাম, ওটা খুব খারাপ অভ্যেস, ওটাকে ছোটবেলাতেই বুঝিয়ে দেবেন যে ঠিক নয়... ভাবনাচিন্তাকেও ভাবতে শেখাবেন, ওর যেন এটা না মনে হয় যে "আমার নাম ভাবনা চিন্তা, আমার আর ভাবনাচিন্তার দোরোকার নেই"... আমার উপদেশ নয়, এটা আমি নিজে ভুগেছি বলেই বলছি... ফার্স্টহ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্স থেকে বলছি... আমি বা আমরাও ভাবতাম ইংরেজিসাহিত্য সম্পর্কে জানা একটা খুব জরুরী ব্যাপার ক্রিয়েটিভ হতে গেলে... অলিখিত সিলেবাস ছিল যেন, যে তুমি অন্য লেভেলের ক্রিয়েটিভ মানুষ, সত্যিকারের ইন্টেলেকচুয়াল হতে চাও, তাহলে সেট ফরম্যাট যেন আছে

ক) "কম্যুনিজম, বিপ্লব, প্রতিবাদ ফরম্যাট, ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্ট্র্যাটেজি"- এই ফরম্যাটে ফার্স্ট ধাপ,

১) বাবা মা যদি ভগবানে বিশ্বাস করেন তো প্রথমেই নাস্তিক ডিক্লেয়ার করো নিজেকে, নাস্তিকের থেকেও ইম্পর্ট্যান্ট, বোল্ড আর আন্ডারলাইনে যেকোন জীবিত মানুষ (বয়সে বড়, বুড়ো হলে আরো ভালো) বলো "আমি ভগবানে বিশ্বাস করিনা। আমি ধর্ম মানিনা"

২) নেক্সট স্টেজ, প্রায় সব বাঙালীর বই আলমারীতে ন্যাপথলিনের সঙ্গে দু কপি ডাস ক্যাপিতা (বাঙালীরা যেটাকে দাস ক্যাপিট্যাল বা দাসদা ব্যাবসায় কত ইনভেস্ট করেছেন জাতীয় উচ্চারণ করে), সাদা মলাট দেওয়া, নীল প্যারালেল দাগ নীচে দুটো, ঠিক তার পাশে কুচকুচে নীল রঙের তিনটি বই থাকে, যাতে লেনিন শব্দটা পরিষ্কার চোখে পড়ে, বাকিটা খেয়াল করেনা (অনেকে লেনিন সমগ্র বা লেনিন অমনিবাস ও বলে), আর কিছু বাড়িতে তার পাশে এঙ্গেলেস লেখা একটি দামড়া বাংলা বইও থাকে, যেটা ছোটবেলা থেকেই দেখছেন

৩) প্রথম দু তিন বছর আপনি জানবেন যে মার্ক্স এঙ্গেলেস নামক একটি ভদ্রলোক একেবারে শোলে জাতীয় ব্যাপার পৃথিবীতে, কিন্তু ঘটনাটা কি ঘটিয়েছেন তারা খুব ক্লিয়ারলি জানবেন না, বাবা কাকাদের জিজ্ঞেস করলে পাকামির জন্য বকে। তবে এই জিনিসটা বুঝে যাবেন যে ওই লোকটা 'পার্টি' করতো এবং সিপিএম 'পার্টি' করতো, এবং জ্যোতি বসুর থেকেও বড় নেতা ছিল এবং সম্ভবতঃ ওই লোকটাই প্রথম ইনক্লাব জিন্দাবাদ বলেছিল। এবং এর পরেও অনেক অনেকগুলো এবং আছে, যে এবং গুলো জানতে চাইলে বাবা "এঁচোড়ে পাকা" বলে ঠাটিয়ে এক থাবড়া মারে

৪) কয়েকটা জিনিস আপনি ঠিক করে নেবেন, যে আপনিও বড় হয়ে পার্টি করবেন এবং অনেক লোকের সামনে বক্তৃতা দেবেন যেমন টিভিতে দেখায়, বাবার মতো বসার ঘরে বক্তৃতা দেবেন না। ইন-দ্য-মিন-টাইম এস এফ আই বলে একটা পার্টি থেকে একটি ধেড়ে ছেলে, লোক বা কাকুই বলা যায়, এসে বলবে আমি ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশানের অমুক ব্লা ব্লা এবং আপনার কাছ থেকে দু টাকা নেবে চাঁদা বলে (১৯৯৪ সাল) আর একটা স্লিপ দেবে এবং আপনার মনে হবে আপনি স্বপ্ন দেখছেন, যখন দেখবেন ওই স্লিপটাতে সি পি এম পার্টির মতোই কাস্তে হাতুড়ি তারা প্লাস একটা ঘুঁষি ছাপা আছে। এবং কি অবিশ্বাস্য!!! ও বলবে আপনাকে সুলভ শৌচালয় চলো মিছিলে যদি আপনি আসেন তো বাধিত হবে। আপনি বুঝবেন যে আপনিও 'পার্টি' করছেন এবং বড়ো হয়ে গেছেন।

৫) এর পরের স্টেজটাই খুব ক্রুশিয়াল। এই স্টেজে একসাথে বহু ঘটনা ঘটবে। প্রথমতঃ এবার সত্যি সত্যি মধ্যে আপনার বাংলা সিলেবাসে প্রথম আধুনিক কবিতা আছে। সেইই আধুনিক কবিতা যা দেশে ছাপা হয় এবং বাবা পড়তে দেয়না বড়দের বই বলে আর মা বাবাকে বলে "আজকাল কবিতার কোন মাথামুন্ডু নেই, যা ইচ্ছে তাই লিখে দিলেই হলো, আধুনিক কবিতা তো!!" এবং একটু চাপা গলায় বলবে "এগুলো পড়া যায়না, সেক্স ঢুকিয়ে দিলেই আর বাজে কথা লিখে দিলেই আধুনিক কবিতা হয়ে যায়"। আপনি এই স্টেজে এসে আপনার মনে হবে একটা খুব খেলাধুলোর দোকান আপনার বাড়িতেই আছে কিন্তু সেটা আপনাকে বলা হয়না। সেক্স শব্দটা আপনার শোনা আগে এবং কেন সেক্স বলার সময় বাবা, মা বা ভালোজেঠুও ফিসফিস করে বলে বা খুব চাপা গলায় বলে। এবং এগুলোর সাথে সাথে আরো কয়েকটা ফিসফিস শব্দও কানে এসছে আপনার, যেমন "নিরোধ", "কণ্ডোম", "কপার-টি", "পিল" ইত্যাদি। আর এগুলোও মাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে রামথাবড়া খেয়েছেন। এমন কি এরকমও একটা ব্যাপার হবে, আপনার মা হাস্পাতালে ভর্ত্তি হবেন একটা কিছুর জন্য, এবং কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে সবাই বলছে "ও একটা অসুখ হয়েছে" কিন্তু আপনি জেনে ফেলেছেন চুপিচুপি শুনে যে মায়ের নাকি "ইউটেরাস" বলে একটা জিনিস অপারেশান হবে এবং এটাও বুঝে ফেলেছেন যে সেক্স, কন্ডোম ইত্যাদির মতো ইউটেরাসও সবার সামনে বললে ক্যালানি খাবেন। এই পয়েন্টে এসে ছেলে আর মেয়ে একটা ফারাক হবে, আপনি যদি মেয়ে হন আপনি আরেকটি গোপন বিষয়ের নাম শুনবেন "গাইনী প্রবলেম"।

৬) যাক লেখার বিষয়ে আসি, এই সব মিলিয়ে যখন ভজকট, তখন আপনি সুকান্ত ভট্টাচার্যের "আঠারো বছর বয়স কি দুঃসহ" বা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর "অমলকান্তি" পড়বেন এবং আবিষ্কার করবেন যে এইরকম দেখতে শুনতে কবিতা লেখা বেশ সহজ। আর সেইরকম কয়েকটি কবিতা লিখে, "শুদ্ধরাগ সন্ধ্যে হতে চাইতো" বা "আমি আজীবন বিপ্লব করে যাবো" ধরনের, একটা কমপ্লিটলি নতুন ফীলিংস হচ্ছে। বেশ আনন্দ আনন্দ, কিন্তু নতুন ব্যাট কেনার আনন্দের মতো নয়, সামার ভেকেশান পড়ার আনন্দের মতো নয়, ক্লাসে সেকেন্ড হওয়ার আনন্দের মতো নয়, এমন কি প্রাইজ পাওয়ার আনন্দের মতো নয়। বাবা মা আদর করলে যে আনন্দ, তার মতো তো নয়ই, ইন ফ্যাক্ট ওতে আপনি এখন আনন্দ পাওয়াটা খুব একটা পছন্দ করেন না। মানে বাবা-মা আদর টাইপ টা। এমন কি আরেকটা নতুন আনন্দ যেটা আপনার মাসতুতো দাদা মুকুলদা শিখিয়েছে, দফা তিনশো দুই ম্যাগাজিন বা পেন্টহাউস লেটার্স পড়ে করতে হয়, সেটার মতোও নয়। এখানে এসে আপনি একটা মহাসমুদ্রে পড়ে যাবেন। একবার ভাববেন যে ওই সেক্স নামক রহস্যময় ব্যাপারটার মতো কি আনন্দটা? হয়তো তাই, কিন্তু এটার একটা বড় এ্যাডভান্টেজ দেখতে পাবেন যে ওইধরণের একটা হেবি আনন্দ যার জন্য আপনি যদি ছেলে হন তাহলে মেয়েদের বন্ধু করতে হয় বা মেয়ে হলে ছেলেদের বন্ধু করতে হয় (যেটা কদিন আগেও এমন কোন মুশকিল ছিল না, এখন আচমকা খুবই কঠিন কাজ হয়ে গেছে) এই বাধ্যতামূলক কন্ডিশনটা ছাড়াই একটা হাই ফাই আনন্দ হচ্ছে আধুনিক কবিতা লিখে। তারপর, একদম ধাপের পর ধাপ আসবে।
সেই লেখা অন্য কাউকে শোনালে আনন্দটা বেড়ে যাচ্ছে, বিশেষতঃ বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে শোনালে।
সেই লেখা দিয়ে আপনার পার্টি করার স্বপ্ন, যা এ্যাতোদিনে কয়েকটা নতুন নতুন জিনিস জেনে ফেলেছেন এস এফ আই এর সেন্টুদার কাছ থেকে। "রাজনীতি", "সাম্যবাদ", "সমাজবদল", "বিপ্লব"। শব্দগুলো শুনেই আপনার হেবি ভাল্লেগেছে, কথায় বার্তায় ইউজ করতে পারলে তো পুরো অমিতাভ বচ্চনের মতো মনে হয়। যেমন বন্ধুকে যদি সাথি বা কমরেড বলা যায় ব্যাপক লাগে। আর সবচেয়ে দারুন ব্যাপার এটা এরকমই ফাটাফাটি জিনিস যা দিয়ে বোসজেঠুকে কমরেড বিমানবাবু বলে ডাকা যায়, এবং সেটা খারাপ বলে না লোকে। বা "মানুষ" শব্দটা বললে তার আগে যদি "বঞ্চিত, শোষিত, অবহেলিত" যোগ করা যায় ত দারুন স্মার্ট লাগে নিজেকে। এটা অপূর্ব ব্যাপার আরো কয়েকটা দারুন কারনে। যেমন বাবা যদি এম-টিভি দেখতে বারণ করে তাতে "আমি তোমার কথা শুনবো না" বললে বেধড়ক ক্যালানি খেতে হয় শুধু নয়, কেউই সাপোর্ট করেনা, ঠাকুমাও না। বলে অবাধ্য হবেনা। কিন্তু এই নতুন জিনিসটা দিয়ে বাবাকে "মানছি না, মানবো না" বললে অভদ্রতা হয়না। তারপর স্বপ্নে টাইটানিকের কেট উইন্সলেট প্রায়শঃই উদোম হয়ে আসে এবং তার ফলে বেশ কিছু নতুন নতুন ব্যাপার হয়, যেগুলো কাউকে বলতে নেই। এবং "তুমি স্বপ্নই দেখে যাও সারাজীবন, বাস্তবে কোনদিন ফার্স্ট হতে হবে না" বলে বকাবকি করে সবাই। তাদেরকে যদি "আমি সমাজবদলের স্বপ্ন দেখি" বললে তার জন্য বকাবকি করাটা খুব মুশকিল হয়ে যায় বড়োদের, এটা লক্ষ্য করা গেছে। ক্লাসে স্যারের সাথে মুখে মুখে তর্ক করলে নীলডাউন করিয়ে দেয়, কিন্তু একই জিনিস যদি "আমি প্রতিবাদ করেছি" বলি, তবে বেশ বেকায়দায় পড়ে যান বাঘা বাঘা স্যারেরা পর্যন্ত। এই আবিষ্কার একটা রিভিলিশান হয়ে আসে আপনার কাছে।

৭) এবং পরের স্টেজে অবধারিতভাবে আপনি প্রেমে পড়বেন। কপাল না গোপাল তার ওপর ডিপেন্ড করবে ওটি ওয়ান ওয়ে না বোথ ওয়ে। কিন্তু সেটি যেরকমই হোক একটা জিনিস আপনি নজর করতে বাধ্য হবেন যে যেগুলো লিখে অন্যকে শুনিয়ে দিব্যি আনন্দ হয়, সেগুলির আরেকটা উপকারিতাও আছে ("সমাজে গরুর ভূমিকা" যেরকম)। বেশ কিছু ব্যাপার স্যাপার যেগুলো জানালে বাম্পার লাগে, যেমন "আমি তোমাকে পাগলের মতো ভালবাসি" বা "আমার তো দুঃখে বানানো জীবন" বা "আমি একদিন কোথায় হারিয়ে যাবো ঠিক নেই", এগুলো সোজাসাপটা জানানো খুব একটা সহজ কাজ নয়। সিনেমা টিনেমায় খেয়াল করবেন এইসব পার্ট হীরো-হিরোইন ভাই বোনেরা গান দিয়ে সামলে দেয়। গান-টান আপনার জানা, কিন্তু তাও দুপুরবেলা পাশাপাশি সাইকেলে বেশ খানিকক্ষন কিচির মিচির করতে করতে আচমকা দুজনেই একসাথে চুপ, হাল্কা মাথা নীচু, বুঝতে পারছেন যে এটি পারফেক্ট টাইমিংস বার্তা দেওয়ার, সেসময়ে গলা ছেড়ে গান গেয়ে ওঠা যে কি বিটকেল পরিস্থিতি তৈরী করে তা একমাত্র যারা ফেস করেছে তারাই জানে। এই দুপুর, এই পাশাপাশি, এই ফেরত আলতো সাইকেল, এ যে কি দারুন সময় বলে ওঠার "আমার জীবনে খুব দুঃখ", বলে বোঝানো যাবেনা!! মুখ দিয়ে ওই বাক্য সরবেই না আর তখনই আপনি খেয়াল করবেন আধুনিক কবিতার আরেকটা ইউটিলিটি ফ্যাক্টর, এটা দিয়ে না-বলা, শক্ত-বলা কথাগুলোতো বেশ বলিয়ে দেওয়া যায়, এক নম্বর। দুই নম্বর, এটা তো বেশ পেন ড্রাইভের মতো যাতে ওই গা-শিরশির মোমেন্টসগুলো যা শুরু হওয়া মাত্রই "এই শেষ হয়ে গেল রে", "এই শেষ হয়ে গেল রে" ধুকপুক চালু হতো, সেগুলোকে স্টোর করে রাখা যায় পরের জন্য। এই ইউটিলিটি ফ্যাক্টরে এসে বেশীরভাগ জার্নি শেষ হয়ে যায়। কবিতাকে টা-টা, থ্যাংক ইউ, গুড বাই, ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড বলে বিদায় দিয়ে অন্যান্য নানান প্রাসঙ্গিক দুষ্টুমির ''আঙ্গিক'' নিয়ে মাথা ঘামানোর খেলা চলে আসে। কিন্তু একদল গাড়োল একটি নিরেট আকাট মার্কা কনক্লুসানে পৌঁছয়। সেটি হলো, এত বড় একটা সমস্যার সমাধান যখন কবিতা দিয়ে হয়ে গেল, তার মানে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান কবিতা দিয়েই করা যাবে। আর এই ভাবার সাথেই সাথেই পড়ে যায় জীবনের সর্বডীপ গাড্ডায়। আর যেহেতু পতনশীল বস্তুর কোন ওজন ম্যাহসুস হয়না, সেহেতু কেউ নিজেকে ভেবে ফেলে পাখি, কেউ ভেবে ফেলে মেঘ, কেউ ভাবে আলো, কেউ ভাবে আকাশ। মোদ্দা কথা এতদিন একটা "নিজে" নিয়ে কাটানো উজবুক আরেকটা সেকেন্ড অলটারনেটিভ "নিজে" খুঁজে পায়, যে ওকে খুব মেনে চলে ঠিক যেমন ও বাবাকে মেনে চলে বা হেডস্যারকে। এইসব গাণ্ডুদের মধ্যে আমি একজন। আর আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনিও একজন।

ব্যক্তিগত গদ্য - অলোকপর্ণা।

সাফ্‌ল
অলোকপর্ণা



নীচে পড়ার একটা আরাম আছে, সমস্ত দায়ভার আলগা হয়ে কাঁধ থেকে ঝরে যায়। যেমন আমার হল, ব্যাগ থেকে সবজিগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে গেল যে যার নিজের মত,- মাইগ্রেশান। তিথি চেয়েছিল, ইউনিভার্সিটি থেকে, পরিবার থেকে, আমার থেকেও। বাদবাকীগুলো অনেক ঝড়ঝাপ্টা পার করে তিথিতে পৌঁছালেও আমি দেরী করিনি তাকে ছাড়পত্র দিতে। তিথি যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, “তুমি যা বলো, তা করেই ছাড়ো।” স্তুতি না দোষারোপ,- আজ অবধি বুঝিনি আমি। তাই এরপরে আমি এমন কিছু বলিনি আর কখনও, যা আমার দ্বারা করা সম্ভব হবে না। তাই আমি বলেছি, অফিসে যাব, অফিসে বোনাস, বৎসরান্তে সি এল নিয়ে দীঘা, গোপালপুর সবই হবে। আমি করিও, বাবাকে হসপিটাল, মা কে ফিজিও, ভাইকে প্রাইভেট ফার্ম- সমস্তই করি। তাও আশ মিটলো কই। রোজ সূর্য ওঠার আগে আমি মনে মনে ভালো হয়ে চলার কথা বলে, ব্রাশ করে, আরো যা যা প্রত্যাশিত সমস্ত ‘করেই ছাড়ি’।

বাজারের পথে পুকুর পার, এখানে এখনো সে সব পুরনো ছায়া পড়ে আছে। সেসব ছায়া এখনো সিগারেট জ্বেলে চোখ বুজে বলে দিচ্ছে সি পি এমের আরও বছর পঞ্চাশ... দীর্ঘশ্বাসগুলো কলেজের দিন ছুঁয়ে ঘুরে ঘুরে টুপ করে জলের মধ্যে পড়ে, ছায়াগুলো ভয়ে কেঁপে যায়। বাজারের ব্যাগ আরও দৃঢ় হয়ে হাত চেপে ধরে, ঠিক যেন তিথি, রাস্তা পার হতে হবে যে। প্রচুর সিগনাল! প্রচুর যানজট। আরও যেসব সেপিয়াগুলো গাছতলায়, মিত্রদের রকে, বঙ্কু টি হাউসে ক্লিপড হয়ে আছে সেগুলোর দিকে তাকাইনা আর। হন হন করে হেঁটে যাই। নাহলে যে চোখে পড়ে যাবে, আজ অবধি যা করার কথা ছিল তার কিছুই আমি করে উঠিনি।

এবছর বাড়িতে ইলিশ এলো না। মা-র প্রিয়। ভাইয়ের মিউজিক সিস্টেম ভাইয়ের পিছু পিছু অফিস ফেরতা ঢুকে গেল ভাইয়ের একান্ত ঘরে। মা,- চিরকালের মত সেদিনও মিউট হয়ে থেকো। আমি আর মা পাশাপাশি ফ্যামিলি ফটোতে যেন সবচেয়ে বেশি সাদাকালো। আর বাবা... বাবা জল চেয়ে চেয়ে চাকরী জীবন থেকে ফিরে শয্যা নিলো যেদিন আমি নিশ্চিত হলাম এবার মরে গেলেই বাবা চাতক হয়ে জন্মাবে। চাতক চাতক, চাতক জীবন, চাতক চোখদুটোও,- এখনো আশা করে, এবারের মোড়টা পেরোলেই তিথিকে দোতলার ছাদে দেখা যাবে। বাজারের ব্যাগটা পর্যন্ত হাওয়ায় দুলে দুলে হেসে উঠলো।

সামনে বালিশে তুলো ভরার দোকান, তার পাশ কাটিয়ে মাংস কাঁটা গলি তিথির সিঁথির মত পশুর রক্তে লালচে। প্রতিবার মরন্ত মুরগী দেখেও নিরামিষাশী হওয়া হোল না। পাতে পড়লেই সব মাংস আমি হয়ে যায়,- আমি আর যাকে খাচ্ছি- সেই মুরগি পর্যন্ত সবই আর কিচ্ছু নই মাংস ছাড়া। তিথিরা আমাদের মাপমত কেটে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। তিথিরাই খাচ্ছে কব্জী ডুবিয়ে আমাদের, হাড় থেকে মজ্জা চুষে আলাদা করে নিচ্ছে,- আহ্‌ এতেও কি তৃপ্তি! “এক কেজি সলিড দেখে, মাথা দেবেন না।” কচকচ আওয়াজটা ঢাকবার জন্য আমি চারদিকে তাকাই। এদিক ওদিক ছিটিয়ে আছে পালক, রক্ত, টেলার, মোবাইল রিচার্য আর নিষেধ সিডি।

বটি থেকে মাথা সরিয়ে নিয়ে আমি স্কুল জীবনে তাকালাম। জ্বলজ্বলে চোখে স্কুল তাকিয়ে আমারই দিকে, মিটমিটে চোখে কলেজ আর অর্ধনিমির্লিত চোখে তিথির ইউনিভার্সিটি। বাবার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স রিচার্যড হোলনা বলে যেখানে পা পড়লো না আর। এক প্লাস্টিক মাংসলো স্বপ্ন নিয়ে আমি চাকরীর বাজারে লাফিয়ে পড়লাম। এইতো লাস্ট ল্যাপ!! ফিনিসিং লাইন ওই যে,... ওই তো... আর একটু! ফিনিসিং লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে বাবার ক্যান্সার আমার গলায় বিজয়মাল্য পড়িয়ে দিল।



আনাজ, শাক আর সময়, মা রোববার রোববার আনতে বলে। আনাজে ঢাকবে স্বচ্ছল পারিবারিক সাপার, শাকে আমাদের এক এক জনের সমস্ত না পারারা ঘুমিয়ে পড়বে শীতের পাতে। তাহলে বাবার হাতে থাকলো আর ছয় মাস। কড় গুনে গুনে বাবা অংক কষেছে আর রাফ করছে, সিঁড়ি ভাঙার অথবা বাঁদর আর তৈলাক্ত বাঁশের। যখন বড় হলাম, দেখলাম, ওসব অঙ্ক মেলাতে গিয়ে বাবা পিছলে পিছলে পড়েছে বার বার, সিঁড়ি থেকে, উঁচু থেকে। ছোটবেলার ইচ্ছে মতো আজ আমি অর্ধেক বাবার মতই হয়েছি, তাই তার গর্বের শেষ নেই আমায় নিয়ে। শেষ ছমাস আমার কাঁধে ভর দিয়ে তাই বাবা রিক্সা থেকে নামবে, সিঁড়ি দিয়ে উঠবে, আর পিছলাবে না।

বাজারের ব্যাগ কাঁধের দায়ের থেকে কোনো দিনই ভারী হয়ে উঠবে না, আমি জানি। আপাতত তাই পঞ্চাশ বছরের নিশ্চিন্তি। অর্ধেক বাবা হয়ে আমিও এমনই একদিন সিঁড়ি ভাঙা অংক কষবো, বাদরের সাথে পাল্লা দিয়ে তৈলাক্ত বাঁশ থেকে পিছলে পিছলে পড়ব, আর বাকি অর্ধেক মা হয়ে সন্তানের স্পষ্ট হয়ে ওঠা নির্বাক দেখব। তিথি তখন কোথায়? তিথির হাত পা বুক পেট নাভি টেলারের ম্যানিকুইনের মত আলাদা আলাদা হয়ে মাটিতে পড়ে থাকবে, কিছু নেবে ওর বর, কিছুটা সন্তান, কিছুটা জীবন। আর আমার চোখে তখন তিথির নানা অংশ সাফল করে নিয়ে নেবে ভীড় বাসের মহিলা সহযাত্রী, হোটেলের রিসেপ্টশানিসস্ট, দুম করে ধাক্কা দিয়ে সরি ছুঁড়ে দিয়ে যাওয়া পথযাত্রীনী। আমি দেখবও না, কি ভাবে তিথির মাথা বসে যাচ্ছে মাঝরাতে বউয়ের মাথায়, তিথির হাত ভাগ করে নিচ্ছে কাজের লোক আর আমার মেয়ে। অফিসের স্টেনো হয়তো পাবে তিথির পিঠ, বাসযাত্রীনী তিথিকোমর থেকে আমার লুব্ধ হাত ছিটকে সরিয়ে দিয়ে হয়তো চেঁচিয়ে উঠবেন –পার্ভার্ট! বলে। কন্ডাক্টার ততক্ষনে আমাকে ছিটকে ফেলে দেবে রাস্তায়।


আমি ফিরে এসে বাজারের ব্যাগ তুলে নিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে পিছলাতে পিছলাতে নামা শুরু করি। আমি বলি ‘সাফল্ড হয়ে চলো, সাফল করে দাও’। যা বলি তা করে ছাড়ার জন্য আমার পিছনে বাজার, তিথি, কলেজ, স্কুল, বাড়ি, মা, বাবা, ভাই, অফিস সমানে সাফল্ড হয়ে যেতে শুরু করে,- সারাজীবন সাফল হয়ে যায়।

ব্যক্তিগত গদ্য - শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়

হে আশ্চর্য হে আকাশ ...
শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়



খোলা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে মুখে ঠান্ডা হাওয়ার ছোঁয়া পেলে দেশের কথা খুব মনে পড়ে। বাড়িঘর, পাড়ার পুকুরটার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে পুকুরপাড়ের রাধাচূড়া গাছটার কথা। গাছের সামনের রাস্তাটায় ক্রিকেট খেলতে খেলতে বল পড়ে যেত পুকুরের জলে। এদিক ওদিক থেকে ঢিল ছুঁড়ে তাকে টেনে আনা হত কাছে। সেই সব খোলামকুচিদের মনে পড়ে। একটু চ্যাপ্টা টুকরো পেলে তাকে নষ্ট করতাম না। ব্যাঙাচি করতাম। শরীরটাকে বাঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে পুকুরের এপার থেকে ওপার জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে লাফ খাওয়াতাম ইঁটের টুকরোটাকে। একদিন খেলা সেরে সবাই চলে গেলে রাধাচূড়ার গায়ে ইঁট দিয়ে ঘষে ঘষে আপন খেয়ালেই লিখেছিলাম দুটো কথা লিখেছিলাম। লিখেছিলাম – “আমি”। আর লিখেছিলাম – “খেলা”। তখন আকাশজুড়ে নেমে আসছে গোধূলি। সন্ধ্যার ফিরিওলারা একজন দুজন করে শুরু করেছে চলাচল। দূরে গলির বাঁকে দুলে উঠছে ঘটিগরমের লন্ঠন। সেইদিন কোনো শব্দ করেনি রাধাচূড়া গাছ। তার গা ছুঁয়ে একা একা দাঁড়িয়ে দেখলাম কে যেন তার স্বর্ণাঞ্চলের শেষপ্রান্তটিকে টেনে সরে যাচ্ছে আমাদের আকাশ থেকে অন্য আকাশে। সেই অতীত আকাশকে মনে পড়ে খুব। সেসব আকাশ কী স্পষ্ট বদলে যেত ঋতুবদলে, উৎসবে। হাওয়ায় পুজো পুজো গন্ধ এলেই দেখতাম বিকেলের আকাশ একটু একটু করে ভরে উঠছে রঙিন ঘুড়িতে। পাখিদের সমস্যা হচ্ছে। শূন্যে বেড়ে যাচ্ছে ভিড়। সাইকেল থামিয়ে, গাড়ির ধাক্কা খেতে খেতে, বুড়ি ঠাকুমাকে ফেলে দিতে দিতে ছুটে যেত হল্লাবাজ বালকের দল। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলে গেলে বাড়ি ফিরে আসতাম। তখনও জানলা দিয়ে আকাশে দেখি দিনাবসান মেঘে মেঘে ভেসে যাচ্ছে অবোধ কোলাহল। ছাদে ঘুড়ি পড়লে আমি খুব আনন্দ করে কুড়িয়ে নিতাম। একটা পাটকাঠি কিংবা কাঠের টুকরোয় অনেকক্ষণ ধরে জড়িয়ে নিতাম কাটা সুতো। তারপর একসম বাবাই বা গুলুকে ডেকে দিয়ে দিতাম ঘুড়িটা। সেই সব ঘুড়ি ওড়াতে না-পারার দিনগুলো ফিরে ফিরে আসে। দুঃখ ছিল ঠিকই, কিন্তু কোনো হাহাকার ছিল না মোটেও। আমি ঘুড়ি ওড়াতে পারতাম না, কিন্তু রোজ বিকেলে দেখতাম মাথার ওপর দোল খাচ্ছে বন্ধুদের ঘুড়ি। ওদের জাদুকর মনে হতো। আর যাদের চিনি না একেবারেই, ওই ঘুড়ির সূত্রে তাদের সঙ্গেও অল্প পরিচয় হয়ে যেত। ভাইকে যখন বলতাম, দ্যাখ্‌ দ্যাখ্‌ শতরঞ্চিটা চুপিচুপি বাড়ছে ... লাল চৌখুপিটাকে শিওর এ্যাটাক্‌ করবে ... তখন ঘুড়ির ওই অতর্কিত স্বভাবের কথা বলে আসলে তো চিহ্নিত করতাম লাটাই হাতে তার চালকটিকেই। তারই নাম হয়ে যেত শতরঞ্চি বা লাল চৌখুপি। নিজের অজান্তেই কারো একটা পক্ষ নিয়ে নিতাম। আমার খুব ভালো লাগত ময়ূরপঙ্খী ঘুড়ি। মনে হত আকাশের কেউ যেন তাকে আঘাত না করে। সে নিজের মতো উড়ুক। উড়তে উড়তে আকাশের বুকে বিভোর হয়ে থাকুক একচিলতে ধূপছায়া রঙ। কোনো ময়ূরপঙ্খীকে দেখে কেউ “দেড়ি দেড়ি” বললেই, আমি চাইতাম ময়ূরপঙ্খী নেমে যাক। সরে যাক আরও দূরে। তবু একেকদিন দেখতাম শেষ বিকেলের মায়ালোকে ভাসতে ভাসতে চলেছে একটা ময়ূরপঙ্খী। আমি ওর জন্য লোভ করিনি। ওকে ভাসতে দিয়েছি। আপনমনে ভাসতে ভাসতে চলে যাওয়া সেই ময়ূরপঙ্খীকে মনে পড়ে। আজ বুঝি সে গিয়ে পৌঁছেছে আমার অকালমৃত বন্ধুদের দেশে। চন্দনামাসি নাকি ছেলেবেলায় পাড়ার ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে জুটে ঘুড়ি ওড়াত! ও-ই আমাকে নানান ঘুড়ি চিনিয়ে দিয়েছিল। আমি ওড়াতে পারি না জেনেও, ওদের ছাদে ঘুড়ি এসে পড়লে, আমার জন্য রেখে দিত। ঘুড়ি ধরতে গিয়ে বেপাড়ার একটা ছেলেকে ভালো লেগে গিয়েছিল ওর। সেই ভালোলাগা বহুদিন ছিল। কিন্তু বলতে পারেনি। সৎমা জানতে পারলে মেরে গায়ের চামড়া তুলে নিত। চন্দনামাসি বলেছিল, আজও আকাশে ঘুড়ি দেখলে সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে। এওতদিনে তার নিশ্চয়ই ঘরসংসার, ছেলেপুলে হয়ে গেছে... আকাশের দিকে চেয়ে থাকা চিরআইবুড়ো চন্দনামাসির দুঃখী অথচ প্রসন্ন সেই মুখখানা মনে পড়ে। আসলে ঘুড়ি-ওড়ার দিনগুলোয়, শরতকালের মেঘময় দিনগুলোয় আকাশে আকাশে ছড়িয়ে থাকে বন্ধুত্ব। আমার মতো মানুষদের জন্য নিঃশব্দ সখ্যতা। আর থাকে এক মায়ামাখানো স্বাধীনতা। মনে পড়ে কোজাগরীর আলোয় ভরে ওঠা আকাশ। কী অপরূপ সেই রাত্রিকাল, কী স্পর্শকাতর তার বিস্তার! সেইসব রাত্রির কাছে দাঁড়িয়ে নিজেকে কাঙাল মনে হত। কিছুতেই যেন প্রকাশ করতে পারছি না তাকে। বাড়িতে বাড়িতে পুজো হচ্ছে। আর ব্যক্তিগত সব প্রদীপের আলো একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। জ্যোৎস্না আমার এক পিসির নাম। লোকের বাড়ি বাড়ি ডিউটি করে। হপ্তায় হপ্তায় টাকা এনে তুলে দেয় ভাইয়ের হাতে। আর রাত্তিরে মাতাল হয়ে ফিরলে ভাই পিসিকে ধরে মারে। জ্যোৎস্নাপিসি চুপ করে থাকে। লুকিয়ে টাকা জমায়। ছোট্ট ভাইঝিটার জন্য রূপোর দুখানা নুপূর গড়িয়ে দেয়। আকাশভরা চন্দ্রালোক দেখে জ্যোৎস্নাপিসির কথা মনে পরে। মনে হয় তার হাত থেকে রূপোর নুপূর চুরি করে গলিয়ে কে ঢেলে দিয়েছে আকাশে। অনাদি অনন্ত ওই প্রবাহের মধ্যে আজ বিরাজ করছে পিসি। কোনো অনাদর কোনো আঘাত আর স্পর্শ করতে পারছে না তাকে। লক্ষ্মীপুজো পেরোলেই হাওয়ায় বাজিমশলার গন্ধভাসে। দিকে দিকে জন্ম নেয় হাজার হাজার শাদা মোমবাতি। বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে বসে চিলেকোঠার বাজি তৈরির ঘরটার কথা মনে পড়ে। একটাই ছোটো বাটখারা ছিল আমাদের। তাই অনেকগুলো ভারী পাঁচটাকার কয়েনকে ওজন করে বাটখারার মতো ব্যবহার করতাম। আর সুবিধাও হত। অর্ধেক ওজনের কিছু লাগলে, পাল্লা থেকে গুনে গুনে কমিয়ে দিতাম অর্ধেক কয়েন। কালীপুজোর দিন রাত্তিরেই একবার দেখা গেল মশলা লেগে লেগে ওই কয়েনের ওপরগুলো ক্ষয়ে গেছে। আর চলবে না সেগুলো। ভয়ে বাবাকে বলিনি সে কথা। বাবার হাতে একটা ঘরে বানানো রঙমশাল ধরিয়ে দিয়েছিলাম। বাবা শিশুর মতো ঘোরাচ্ছিল। আর দূরান্ত অবধি চলে যাওয়া সেই আলোয় খুব খুশি হয়ে উঠছিলাম আমরা ভাইবোনেরা। তার পর মাকে বললাম গিয়ে বাবার সঙ্গে হাত লাগাতে। ‘এই বুড়ো বয়সে ... তোদের যত সব ...’ বলতে বলতে মা কথা শুনেছিল। সেইদিন রঙমশালটা শেষ হচ্ছিল না কিছুতেই। আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের আকাশবন্ধুত্ব বুঝি ওর ভেতর ঢুকে পড়েছিল এক অনিঃশেষ প্রাণ হয়ে। আজ খুশি খুশি সেই মুখগুলো বড়ো মনে পড়ে। মণি বলছিল, দাদা ছবি তোলো ... ছবি তুলে রাখো ... শীতের মুখে তখন ঠান্ডা পড়ছে অল্প অল্প। ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে আছে চারধার। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে বাজির আওয়াজ। উৎসবের পরিব্যাপ্ত সেই চরাচরে আমাদের আনন্দিত বাড়িটার ছবি নিশ্চয়ই এঁকে রেখেছিল কেউ। সে কি কাল? সে কি অদৃশ্য বন্ধুজন কোনো? এখনও আমাদের দেশে অন্ধকার পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে আছে রাধাচূড়া। তার গা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছি “আমি”। আমার অসমাপ্ত সব “খেলা”ধূলা। কোনো অলৌকিক উল্কাপাতে আমার অস্তিত্ব থেকে ভেঙে আলগা হয়ে গেছে আমার মন। বারবার সে ফিরে যাচ্ছে শ্যামসবুজ সেই ছোট্ট মফস্বলে, শরতশিশিরে ভিজে থাকা লক্ষ্মীর পদচিহ্নময় অলিতে গলিতে ...

আজও কোনো হিমশীতল অন্ধকার নেমে এলে ওপরে চেয়ে দেখি দীপাবলির আশ্চর্য আকাশ হয়ে আমার মাথার ওপর জ্বলে যায় বাবা আর মায়ের শাশ্বত যৌবন ...

রম্যরচনা - প্রকল্প ভট্টাচার্য

জাতে ওঠার বজ্জাতি
প্রকল্প ভট্টাচার্য




পড়াশোনায় ডিগ্রী, ভাল চাকরি, অফিস অথবা শ্বশুরবাড়ীর পয়সায় দু’চারবার বিদেশভ্রমণ, এইসব তো আজকাল ঘরে ঘরে। এতে আর আজকাল জাতে ওঠা যায় না। বড় মুখ করে কারোকে বলতে যান ‘এই আমার পিএইচ ডি টা শেষ হলো’ কিংবা ‘মাইক্রোসফট এ চাকরি পেয়েছি’, জবাবে নির্ঘাত শুনতে হবে, ‘ও তাই নাকি? হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার বড় শালার মেজ ভাগ্নেও তো...’ বক্তার মুখ বাঁকিয়ে মন্তব্যের থেকেই জেনে যাবেন যে আপনার সাফল্যের দাম খুব বেশী হলে একটা একচোখ ওয়ালা কড়ি। জাতে ওঠার জন্য তিনটে জিনিস প্রয়োজন। এক নম্বর হলো, বড়সড় কোনও অসুখ বা অপারেশন। আপনার নিজের হলেই সবথেকে ভাল, নাহলে খুব কাছের কারো। ‘আর বলবেন না, অ্যাপোলো ডেন্টালে গেছিলাম তো রুট ক্যানাল করাতে। সব হল, ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরোতেই মাথাটা গেল ঘুরে। ও তো আবার ভীষণ নার্ভাস, জানেনই তো, তার ওপর গত বছরই বাই পাস হয়েছে...’ দেখবে সক্কলে হাঁ করে শুনছে। আরও কেউ কেউ ফিরিস্তি অবশ্যই দেবেন যে তাঁর বত্রিশটা দাঁতেই রুট ক্যানাল হয়েছে, বা বার চারেক বাইপাস। তবে খবর্দার তাঁদের জিগ্যেস করে বসবেন না যে তাঁরা আদৌ দাঁত মাজেন কি না, অথবা ঠিক কতগুলো হার্টের অধিকারী তিনি। জেনে রাখবেন, অসুস্থতাই আজকাল সুস্থতার পরিচয়। দ্বিতীয় হলো যোগাযোগ বা কন্ট্যাক্টস। সি এম-এর পিএ বা পি এম-এর সিএ হলেই ভালো, তা নাও যদি হয় বড় মেজ সেজ ন’ ফুল হাফ কোনো একটা মন্ত্রীর সাথে পরিচিতি দরকার। তাও যদি না হয় তাহলে যে কোনও একটা সেলিব্রিটির সাথে যোগাযোগ থাকতে হবে। আত্মীয় হতে পারলে তো কথাই নেই। যখন বাজার করতে যাবেন, আপনাকে দেখিয়ে লোকেরা বলাবলি করবে, ‘ওই দ্যাখ, ওনার ই সেজ ভায়রাভাই সেদিন দাদাগিরিতে এসেছিল!’ ব্যাস, সেই বছর আপনার পাড়ার কালীপুজোর আর উদ্বোধন আটকায় কে! তিন নম্বরটা অবশ্য একটু গোলমেলে। একটা স্ক্যান্ডাল চাই। বেশ রগরগে হবে, অথচ ছিঁচকেমি থাকবে না। মানে চিট ফাণ্ডের টাকা ঝাড়া চলবে না, কিন্তু একটা ডিভোর্স বা ইলোপ কেস, নিদেন পক্ষে লিভ টুগেদার যেন থাকে। ব্যাস, দেখবেন আপনার দাম বাজারে আলুর মতো চড়ছে! আর কি চাই! মশলা তো জেনেই গেলেন, বানিয়ে ফেলুন মুখরোচক ঝালমুড়ি! জাতে তো উঠে গেলেন দাদা, এবার এই ভাইটাকে যদি একটু দ্যাখেন...!

গুচ্ছ কবিতা - রাজর্ষি মজুমদার

শ্রেয়সীকে ভেবে নিয়ে শীত
রাজর্ষি মজুমদার



১.

কবিতার কথা ভাবলে আমায় ভাবতে হয় – আজকাল ভাবা ভীষণ পরিশ্রমের কাজ। আমায় চুপ করে বসে থাকতে হয়েছে ভাবনায়- কবিতা লেখার আগের সময় প্রিয় থেকে প্রিয়তম নদীর মতন। জলের অভাবে শুকিয়ে গিয়েও বেঁচে উঠতে চাইছে কাগজের কাছে এসে।



২.

উষ্ণতা শীতকালে আমার প্রয়োজন – সিগারেটে কিংবা কাঁথার আড়ালে উষ্ণতা আমার পছন্দ নয় তবুও তোমার বুকের কথা ভেবে নিজেকে উষ্ণ রাখতে শিখি মুহূর্ত থেকে মুহূর্তান্তরে।



৩.

সে ছেলেটা কয়েকবার ছোট্ট মাছি দেখেও ভয় পেয়েছে- সেখানে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে বড়। বেশ কিছু ধুলমাখা বই আর হাত, পা থাকার অহংকার নিয়ে অনেকক্ষণ ভয় ভুলে থাকতে চাই। ভয় ভুলে থাকার দরুন জতুগৃহ ছেড়ে শীতের সবজিতে চলে গেছে মাছি ও আমার মন। সময় হলে, মিঠে রোদ পিঠে ফিরে আসবে।



৪.

একা বসে থেকে এ শহরে অবশেষে শীতকাল এসেছে প্রিয় হয়ে সেখানে আমার সোয়েটারে ডোরাকাটা কুয়াশা লেগে লেগে আমায় আমার মতো থাকতে দিচ্ছেনা – জামা খোলার আগে মনে এসে বসেছে পাথর ছোঁয়ার আনন্দের মতো শীত – সমস্ত প্রিয় চায়ের দোকান, ঠোঁট এবং বইয়ের দোকান খুঁজে খুঁজে বের করার কঠিন কাজে হাতকে সাহায্য করতে।



৫.

বাস থেকে নেমে গেলে হাতে টিকিট ধরে রেখে ভেবে উঠতে পারিনা টিকিটের কাজ কি?
ঠিক সেই মুহূর্তেই, আমার ভাবনা পরিষ্কার হবার আগেই বাস বেরিয়ে যায় দু তিনখানা।
আগে আমি বাসের টিকিট জমাতাম, এখন বাকিদের মতই দু আঙুলে চিপে রাস্তায় ফেলে দিই।



৬.

“ রও মে হ্যায় রাখশে উমর কাঁহা দেখিয়ে থামে
নে হাথ বাগ পাড় হ্যায়, নহ পা হ্যায় রেকাব পর।”
গালিব পড়ে মাঝে মাঝে বাঁচতে শিখি- তখন বরানগরে দিল্লীকে খুঁজছি।
দুপুরের ঘুমে জীবন , চায়ের মধ্যে ফরাসডাঙ্গা মদ।



৭.

কয়েকজন্ম বেঁচে থাকতে হলে তোমার থেকে ভাল কেউ নেই যার সাথে বাঁচা যায়।

চলন্ত বাস থেকে নেমেই বাজার সারতে হয় আমাকে সারা সপ্তাহের মতন; কুমড়ো আর লাউ কিনে রেখে দিতে হবে অন্তত। আমি জানি তোমার ডাল ভাত পছন্দ, দুপুরে মিষ্টি পান। বিকেলে আদা দিয়ে দুকাপ মতন চা।



৮.

আমার কাছে অনেক নতুন মানুষ তোমার খোঁজ নিয়ে গেছে- তোমার ঠিকানা, চুলের আপাত বাদামী রঙ সম্বন্ধে তাদের অনেক কৌতূহল। পরে অনুযোগ করোনা তোমায় আগে জানাইনি বলে।



৯.

শীতে বরানগরে বরফ পড়েনা, শুনলাম নাকি দেরাদুনে ট্রান্সফার নিচ্ছ।

তোমায় বহুদিন বরফের মাঝে দেখা হয়না, শীতে শীতল হয়ে তোমায় মনে পড়ে আমার... বাঁধাকপির পাতায় বা নতুন গুড়ের গন্ধে। তুমি এখনও পিঠে বানাও? বানাতে পার?



১০.

তোমায় ভেবে আমার সময়গুলো বদলে যাচ্ছে দ্রুত, কয়েকবছর ধরে ঠিক এই সময় – যখন শীতকাল এসে উঁকি দিয়ে গেছে বিছানায়। আমরা বয়সের তুলনায় বুড়ো হয়েছি খানিক, চাঞ্চল্যের দুটো দাড়ি পেকে গেছে।



১১.

আমার শীতকাল এসেছে তোমার বয়সে, দুপুরের কোল্ড ক্রীমের নরমে। তোমার ন্যাপথলিন মাখা যেসব সোয়েটারীও আদর বইমেলা লিটল ম্যাগে মিশিয়ে নন্দন মিলনমেলায় ফেলে এসেছ নিয়মিত – শীতার্ত সেসব মুহূর্তের খোঁজ কি নিয়েছ কখনো?


তোমার বাড়ির স্টপে এবার ট্রাম দাঁড়ালেই নেমে পড়ে কি এক কাপ চায়ের দাবি কি করতে পারি আমি? অন্তত সেই সকালগুলোয়; যখন তোমার মা ইস্কুলে বেরিয়েছে, পুরো পাড়া পেপারে মগ্ন আর সিগারেট ধরিয়ে তোমায় দেখছি আমি।

কবিতা - জয়দীপ মৈত্র

দুটি কবিতা
জয়দীপ মৈত্র



হিমঘর


আমাদের সবার বাইরে একটা করে মানুষ
আর ভেতরে হিমঘর
একদিন ঝড়ে যে ফল কুড়িয়েছি
তার বীজ এখন সর্বত্র ছড়িয়ে
দোলনা থেকে দেশলাই অব্দি শুধুই অস্থিরতা

মাঝেমাঝে জুতো থেকে বালি ঝেড়ে ফেলি



শিরোনামহীন


একেকটা চিঠি আসে
কৃষ্ণগহ্বর হয়ে
শুষে নেয় প্রত্যুত্তর
নক্ষত্রের মতো টুকিটাকি পুড়ে যাই
জিভের আড়ালে
সিঁড়ি ভরে যাচ্ছে মৃত পাখিময় পদক্ষেপে
যে ছায়ার ইতিহাস গাছহীন
সে কোনোমতেই
আমার বিকেল হতে পারে না 
 
 

কবিতা - তনভীর হোসেন

দুটি কবিতা
তনভীর হোসেন



শিকার

রাতে আমি
দেয়ালি টিকটিকি দেখি,
স্থির ও স্থিরের মাঝে থাকে
গতিরোধক রাত,
এই ত্রিমাত্রিক দৃশ্যে শিকার শিখি,
আমার আশেপাশে
সবার শিকারি স্বভাব,
কি লাভ নখ দাঁত ফেলে রেখে,
চলো শিকার খেলি।


বয়স

স্তব্ধ চাইনা
তবে যে মাছের পেটি খুঁড়ে
সাঁতার পাইনা
পাই গর্ত...কাঁটা
সে কাঁটা তুমিও
তোমারও বয়স পাবে
দোল খাবে উন্নত
পাতলা ঝোলের গভীরে একদিন
ডুবে যাবে সবুজ আপেল। 
 
 

কবিতা - পবিত্র আচার্য

দুটি কবিতা
পবিত্র আচার্য


(১)
বুকের তেষ্টা পায়, মাছেদের বর্ষা মিলনের মত
জলবুক এ যৌবন ঢেউ আছড়ে পড়ে উথাল
মায়া প্রপঞ্চ, দুষ্টু ক্যাবরে ঢাকা থাকে গোপনাঙ্গ
আমার জন্যে কেউ বিছিয়ে দেবে ওমের চাদর
গুমজ্বর নেভাতে আগুনের দরকার ছিল বুঝি
শূন্যের দিকে চেয়ে থাকি, হাতে লেখা ফুটনোট
স্মৃতির বিভক্তি ছড়িয়ে পড়ে মিলন রাত্রির মত
ঋতুবাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে ছিলাম অনেক টা পথ
নিষিদ্ধ আপেলের খোঁজে।।

(২)
নিষিদ্ধ শরীরের ঠুক
ইথারের দেওয়ালের হাসি উচ্ছলে পড়ে নিরাশ্বাস
নগ্ন ছায়ারা পয়দা হয়
ছেঁড়ে যাওয়া যৌনতার বমি গুলো চাটতে থাকি
যতক্ষণ না অন্ধকার থেকে আকরিক গন্ধ পাই
ওই যোনি পথে আঁধারিগন্ধের চ্যাট চ্যাটে সিক্ততায়
নারী-পুরুষের বিসর্গ সন্ধির কোলাজ মাখা আছে
রাত মুছে গেলে দুই পা জলের মধ্যে চুবিয়ে রাখী
শরীরের চতুষ্কোণের চাদরে লেগে আছে লালাদাগ।।

কবিতা - কিঙ্কিণী বন্দ্যোপাধ্যায়

শহরতলি থেকে
কিঙ্কিণী বন্দ্যোপাধ্যায়



খুচরো পয়সার ভিড়-
অচল সিকি, আধুলি, কুড়িয়ে বাড়িয়ে
চার-পাঁচটা একটাকা দুটাকাও
খুঁজলে পাওয়া যাবে কি?
-এরপর তোমার ধুলোজামা আমায় ভিজে গিয়ে
মেঘে মেঘে অস্পষ্ট-

দুর্বোধ্য-এসবই দুর্বোধ্য-আমি-
বুঝতে পারিনা-বুঝিনা কিছু
শুধু খিদে পেটে মাঝে মাঝে কিছু অসংলগ্ন
প্রলাপ বকে যাই।
মেঘলা বিকেল-বন্ধ ঘর-
অসহ্য ভ্যাপসা গন্ধ-ভাল লাগে
এই গন্ধ ভাল লাগে
এই ভ্যাপসা ভাল লাগে
এই অসহ্য ভাল লাগে।

এলে না কেন? অপেক্ষা করতে করতে
করতে করতে অপেক্ষা করতে করতে
মুছে ফেলেছি পুরো ইনবক্স!
একি করলাম আমি ঠাকুর!
সবই তোমার জন্য-তোমার জন্য!
তুমি আসনি বলেই তো মুছে ফেলেছি ওসব।

তবে আবার কবে দেখা হবে? আবার?
কুবো পাখি ডাকা বনে?
আমি কখনও দেখিনি সে পাখি-
জানোই তো, আমি শহরতলির মেয়ে-
ভাসতে ভাসতে এসে পড়িনি তোমাদের শহরে।
অনেকক্ষণ হেঁটে হেঁটে খিদে পেটে পৌঁছতে পেরেছি
-মাঝে তো দুবার ছিঁড়েও গেল চটির স্ত্র্যাপ।
প্রথমবার ওই বুড়ো মুচির কাছে গেলাম-
চারটে আধুলি খরচা করে।
পরেরবার তাই নিজের হাতেই সেফটিপিন,
না না, পায়ে ফুটে যাবে না, ওসব অভ্যেস আছে আমার
-বললাম না, ভাসতে ভাসতে আসিনি এ শহরে।
শহরতলির মেয়ে আমি। সারাদিন রিক্সার প্যাঁক-পুক,
স্টেশনের রাস্তায় ব্যস্ত ভিড়-
অটোর লাইনে মারপিট-এসবই জানি আমি।
তোমাদের মেগাসিটির ট্রাফিক পুলিশ,
জেব্রা ক্রশিং, মেট্রো-টেট্রো সবই
তাই ভালোলাগে আমার।
ভালোলাগে পোড়া ডিজেলের গন্ধ, সাজানো ফুটপাতে
সাজানো মানুষের ঢল।
ল্যাম্পপোস্টের গোড়ায় ভিখারি, তার পাশেই
বসে উকুন বাছছে একা পাগলী।
আর তারপর-
আর একটা মোড় ঘুরলেই তোমার বাড়ি-
তাই তো? জানি আমি। সেইজন্যেই তো শহরে আসা।
আসছি। দাঁড়াও একটু। আর একটা মোড় তো? জানি-
একটু দাঁড়াও।

কবিতা - অনিমিখ পাত্র

নভেম্বরের লেখা
অনিমিখ পাত্র



তখন কিভাবে আগুণ ধরে গেল জমানো কাগজকুটোয়
আশ্বিনের কুকুর অবহেলায় ক্লান্ত হয়ে এলো
কিভাবে নভেম্বরে ভারি হয়ে এলো পুকুর
শ্যাওলায় আটকে গেল জলের প্রণয় কিভাবে
অনুবাদে অনুবাদে শিকড় কোথায় পর্ণমোচীর
তেমন একটা ভাষাই বা কোথায়

যেন এতোক্ষণের শ্বাসবায়ু ঘরবাড়ির গায়ে বুলিয়ে দিতেই
হঠাৎমাত্র রোদে এসে হতভম্ব হয়ে গেল
গতজীবনের অপরাজিতা
তখন গোটা একটা আকাশ থেকে যায় উপন্যাসের ভেতর
অল্প নীচে মানুষেরা আয়না বানায়
মানুষেরা তখন কিভাবে সেই আয়না ভেঙে দেয়

কবিতা - অনীক রুদ্র

জ্যোতিষ বাণী
অনীক রুদ্র



বলছি না ভুল হবে
চলে যাচ্ছে এককের যুগ
ওই লোককে নদী খাবে
মাংসের গন্ধ পেয়ে নদীটিও হয়েছে উৎসুক

আমাদের চেনা নয়
ভাবগতিক রহস্যজনক
বিপন্ন চলন মুদ্রা, সঞ্চয়ে
রঙিন একটি ছবি

ভিজে যাচ্ছে, কী করে বাঁচবি?

বলছি না ভুল হবে
ওকে সঙ্গে নিলে যেন
হাতি ঘোড়া, সাপ ব্যাঙ সবকিছু পাল্টাবে

যা হবার, হতে পারতো – হবে
সামগ্রিক না হলেও, মোটামুটি
দাম্পত্যজীবন সুখী হবে 
 
 

কবিতা - মিতুল দত্ত

তীর্থভ্রষ্ট
মিতুল দত্ত



মৃত্যুই সতীর্থ শুধু সুতীর্থে সবাই কাঁদে তুমি কি কাঁদবে না?
তুমি কি বলবে না ওই জ্যোতির্লিঙ্গ স্থাপনের পিচ্ছিল প্রদেশে
এত আলো, মাত্রাতীত কোন অচিরাচরিত পথে ভ্রষ্ট হয়ে যায়?

নাবিকজন্মের কালে কেন এত সঙ্ঘদোষ,
কেন তুমি শুক্রবিষ লিখেছ অক্ষরে?
জলের লাবণ্য ভেঙে আমাদের অস্থির শিকারা
মুহুর্মুহু উঠে কেন নেমেছে পাতালপরিখায়?

তোমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে দিতে মনে হয়
আমাকেও নিয়তি যে কবে নেবে, কীভাবে বা নেবে?

শিশিবোতলের শব্দে ভেঙে গেছে অবিকল্প কথা
শুধু ওই গবাদি-মাঠের দিকে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর চলাচল নেই
অলৌকিক দাবাখেলা পড়ে আছে ঈশ্বরের সাথে
সমুদ্রে শোয়ানো ছক, অরক্ষিত পানপাত্র,
রাজাকে বাঁচাবে বলে রোহিণীনক্ষত্র বাজি ধরে
কারা ওই ফিরে যায় নির্বিকল্প সমাধির দেশে
তবু রাজা তো বাঁচে না

আমাকেও নিয়তি যে কবে নেবে, কীভাবে বা নেবে –
তোমাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিতে দিতে মনে হয়


কবিতা - অনির্বাণ দাস

নজর
অনির্বাণ দাস



স্মৃতি মানেই সেই গুদামঘর
যেখানে লোকে সিমেন্টের বস্তা স্টক করে রাখে
#
দিনকাল তো ভাল নয়
বর্ষা বাদল লেগেই আছে
#
এখন কথা হোল
টিনের চালে ফুটো আছে কিনা
#
মিস্ত্রীর আর কি
এটা সেটা বুঝিয়ে
হাতে লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে
সেই যে ফুটে গ্যালো ...

কবিতা - যুধাজিৎ বসু


কবিতা - দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায়


কবিতা - রঙ্গীত মিত্র

ফেসবুক লেখা-৯৯৯
রঙ্গীত মিত্র



নেশাঋক্তনারী, জীবনের ছক উলটে ক্রমশও ভাসিয়ে নিয়ে যায় ;
ভাসিয়ে নিয়ে যায় সিগারেটের ধোঁয়ার মতো তার চুল
আর আমার মত যে গাঁজা বানানটাই করতে শেখেনি
যে জানে না পাঁইট আর নিপের পার্থক্য কি?
সেখানে ফাঁকা বোতল থেকে অ্যালকোহলের গন্ধে স্ট্রবেরী লেগে আছে।
লেগে আছে সেই সুখ যেখানে পৃথিবীও তার ভার রাখতে পারেনা
অন্যের আকর্ষণ অবলম্বন করে ঘোরে।
যদিও তোমাকে শুনেছি সাহসের ভিতর যদিও এ বিছানা উপত্যকার মতো নির্জন অথচ নয় ;
তবুও হঁকোর কল্কের মতো তারা উঠেছে আকাশে

আমরা দুজনে প্রবল নেশার ভিতর, নক্ষত্রের মতো দেখছি, একে অপরকে।


কবিতা - আষিক

চিঠির দূরত্বে
আষিক



এতদিন কেটে গেল দুর্ঘটনা লুকিয়ে লুকিয়ে
এখন আর গোপন কোর না
তাকে গিয়ে বলো
এখন কেমন আছ
এতদিন কেমন থেকেছ
কত কিছু ঘটে গেছে তোমাদের অজানা সময়ে

এতদিন কেটে গেল দুর্ঘটনা লুকিয়ে লুকিয়ে

পরবর্তী অঘটন চিঠির দূরত্বে পড়ে আছে