শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ৩য় বর্ষ ২য় সংখ্যা

সম্পাদকীয়

"আমি তাইত পাগল হইলাম না মনের মতো পাগল পাইলাম না,
সবাই বলে ‘আমি পাগল’ আসল পাগল কয়জনা।
যদি একটা পাগল পাইতাম আমি তার সাথে পাগল হইতাম,
আমি ভালো মানুষের ভালবাসা তাই জীবনে চাইলাম না।

আছে অনেক সেয়ান পাগল মতলবের মদ খায়
এই জগতে আসল পাগল চেনা বড় দায়
তাই বলি সভায় বিনয় করি – আমায় দাওনা একটা পাগল ধরি
আমি পাগল হইতাম, পথে রইতাম ঘরে নাহয় রইলাম না ।"

ক্ষেপচুরিয়াস - এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছি আমি , আপনি, আপনারা । দুনিয়া আসলে এক পাগলখানা আর আমরা তার অংশ ; তবে এতেও কিছু পার্থক্য আছে - কেউ পাগল প্রেমে , কেউ কবিতায় , কেউ ধোঁকা দিতে আবার কেউ বা সেয়ানা পাগল ! মোদ্দা কথা সম্প্রদায় আসলে দুটো - 'নির্বোধ আর বুদ্ধিমান', শঙ্খ ঘোষ একথা কবেই তার কবিতায় বলে দিয়েছেন ।

এই আষাঢ় মাসে নিয়মমাফিক এই ব্লগ্‌জিন , তবে মাসটা যেহেতু বরষার তাই ভেজা ভেজা কিছু লেখা এই সংখ্যায় আছে ! অনেক পরিশ্রম করেই চেষ্টা করেছি এই সংখ্যাটি যাতে গুনমান বজায় রাখতে পারে , চেষ্টা করেছি ব্যক্তিগত সম্পর্ককে দূরে রেখে লেখা নির্বাচনের । অনেক লেখাই এসেছে , তার মধ্যে থেকে বেছে নিয়েছি এবারের লেখকতালিকা । ভুল , ত্রুটি হলে তার দায় একান্তভাবেই আমার , আর কারো নয় । এবারের সংখ্যায় থাকছে গুচ্ছ কবিতা ,এছাড়া আছে কিছু অনবদ্য গল্প , ব্যাক্তিগত গদ্য, নবীন- প্রবীণ মিলিয়ে কিছু কবিতা ও অন্যান্য নিয়মিত বিভাগ ; আশা করি সবার ভালো লাগবে । ভেজা ভেজা দিনে , ইলিশমাছ সহযোগে পড়ে ফেলুন এই সংখ্যা, যদিও ইলিশের যা দাম !

পরিশেষে বলি : কবিতার জন্য , সাহিত্যের জন্য এই কাঙালপনা ~ ছড়িয়ে পড়ুক দিক্বিদিকে । সামনেই মা আসছেন তার ছানাপোনা নিয়ে , সব্বাই মেতে উঠুন প্রাণের উৎসবে । কিন্তু মনে রাখুন সেই মানুষটিকে যে একফোঁটা ভালোবাসার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে পথে-প্রান্তরে, মনে রাখুন সেই শিশুটিকে - যার গায়ে হয়তো এবারও জামা উঠবে না , মনে রাখুন সেই বন্ধুকে যে একদিন আপনার খুশি চেয়ে নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিয়েছিল । ভালো থাকুন , ভালো রাখুন ।।



মিলন চট্টোপাধ্যায় ও পৃথা রায়চৌধুরী

উত্তর সম্পাদকীয় - অরিন্দম চন্দ্র

সংস্কার
অরিন্দম চন্দ্র



“সংস্কার” শব্দটির একটি আলাদা দ্যোতনা রয়েছে আমাদের মনে।শব্দটির অভিঘাত আমাদের নিয়ে যায় কয়েক শতক আগে যখন রামমোহন রায় বা বিদ্যাসাগর বা হেয়ার সাহেব বা ডিরোজিও সাহেবের নেতৃত্বে আমাদের দেশের শিক্ষা বা সমাজ নীতির আমূল পরিবর্তন হয়েছিল।আজ ২১ শতকে এসে আমরা নতুন করে যে “সংস্কার” শব্দটি দেখি তার অভিঘাতে শুধু শিক্ষা নয়,এ দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে আরো একটি পরিবর্তন এসেছে।কিন্তু প্রশ্ন কার জন্য এই “সংস্কার” ??

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন দেশের অর্থমন্ত্রী হয়ে দেশের “হাল” ধরতে প্রায় বিশ বছর আগে ব্যাপক অর্থনৈতিক “সংস্কার” কর্মসূচী ঘোষণা করেন তার পর থেকে একের পর রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প বিক্রী হতে থাকে,দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ জলের দরে দেশী-বিদেশী রাজপ্রভুদের করায়ত্ব হয়,দেশের পরিষেবা ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয় অবাধে।ঠিক সেই সময়ে ধুয়ো তোলা হয় বিদেশী পুঁজির অনুপ্রবেশে দেশের অর্থনীতি চাংগা হবে,বেকারী কমবে,মানুষের আয় বাড়বে।এবং সাথে আসে TINA FACTOR ---THERE IS NO ALTERNATIVE...আন্তর্জাতিক মূদ্রা কোষ,বিশ্বব্যাঙ্ক আর বিশ্ববানিজ্য সংস্থার চাপে দেশের মানুষকে গেলানো হয় “সংস্কারের” নয়া দাওয়াই।অবাক হবার কিছুই থাকে না যখন প্রধান বিরোধী দল ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার সাথে সাথে একই জুতোয় পা গলায়---রাজা আসে যায়,লাল জামা গায়,নীল জামা গায়,রং পাল্টায়,দিন পাল্টায় না...

আজ দেশের সামনে আরেক নতুন সঙ্কট উপস্থিত।রাজপুরুষদের ধোঁকার টাটিটি এবার পুরো উন্মুক্ত।২০০৮ সালের পর থেকে দুনিয়া জোড়া আর্থিক সঙ্কটে এই দেশ কিছুটা হলেও INSULATED ছিল তার মূল কারণ এ দেশে এখনো কিছু রক্ষাকবচ সাংবিধানিক পথে দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।যেমন ব্যাঙ্ক বা বীমা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রয়ত্ব উদ্যোগের প্রাধান্য বা বিদেশী পুঁজির অনুপ্রবেশ স্বত্তেও এ’দুটি ক্ষেত্রে এখনও তেমন কিছু বিপদ ঘটাতে পারে নি,কারণ ঐ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ।২০০৮ এ আমেরিকা সহ প্রায় সব ধনী দেশগুলি তাদের দেশে যে আর্থিক সুবিধার প্যাকেজ দান করে তার জন্য এদেশের বাজারও সুফল পায়।আজ যেই মাত্র ডলার চাঙ্গা হয়েছে দেশের বাজার থেকে ডলার উধাও।প্রজাপতি পুঁজি ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে মধুর সন্ধানে যাবে এটাই এই পুঁজির নিয়ম।ফলতঃ,ডলার এর দাম এক টাকা বাড়লে দেশের ৮৮০০ কোটি গলে যায়,তেলের দাম বাড়ে,রাজকোষ খালি হয়ে যায় আর কি!!!রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ও অর্থমন্ত্রীর মাঝে প্রায় মুখ দেখাদেখি বন্ধ,আমদানী করা হল নব্যযুবক এক গভর্নরকে,তিনি এসেই কিছু নিদান দিলেন,শেয়ার বাজার উঠলো,ডলারের দাম কমল,রাজপুরুষগণ ধন্য ধন্য শুরু করলেন এবারকার মত বচ গ্যায়া শালা।

কিন্তু সমস্যার গোড়ায় গলদটাই রইল অধরা।বিশ বছরের সংস্কার এই দেশকে আজ এমন এক যায়গায় খাড়া করে দিয়েছে যেখানে সামান্য সমস্যা হলেই দেশের মাল-জানের হেফাজতের দায়িত্বের লোকেরা আবারো “সংস্কার” করতে উদ্যত হন।অস্যার্থে,আবার কিছু রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পের জলের দরে বিক্রী,আরো কিছু মানুষের পেটে লাথি,আরো কিছু নেতার পকেট ভারী।ভাবনার কথা,এই টালমাটাল সময়ের মধ্যেই সরকার পাশ করে নিয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আইন,পেনশন আইন যার মধ্যে অন্যতম।আজ দেশের যে কয়জন হাতে গোনা সাধারণ মানুষ এই সামাজিক সুরক্ষা কবচের আওতায় পড়েন আগামীতে তাদের রক্ত জল করা টাকা খাটবে শেয়ার বাজারে।সাথে রয়েছে আগামী অধিবেশনেই বীমা ক্ষেত্রে আরো বিদেশী পুঁজির রাস্তা খোলার অঙ্গীকার,সোজা বাংলায় একুল ওকূল দুই কুলই যাবে।

লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে দেশের মিডিয়ার কল্যানে “রাগা” বনাম “নমো”-র তাল ঠোকাঠুকি বাড়ছে।একজন বংশমর্যাদায় রাজপুরুষ,আরেক জন দক্ষিণপন্থার এই মুহুর্তে সব চেয়ে বড় মুখ।কিন্তু কোথাও এঁরা একবারের জন্য কবুল করছেন না ক্ষমতায় এলে এই “সংস্কার” কর্মসূচীকে বন্ধ করব।কারণ প্রধানমন্ত্রীর বাড়ী যেতে গেলে ওয়াশিংটন হয়ে যাওয়াটাই আজ দস্তুর।আশা জাগে,এইবার অন্ততঃ নেতা নয় নীতির ভিত্তিতে নতুন সরকার আসুক, “সংস্কার” শব্দটি তার প্রাপ্য যথার্থ দ্যোতনা পাক।

বিস্মৃত ইতিহাস - মিলন চট্টোপাধ্যায়

কালের আড়ালে শ্যামাচরণ
মিলন চট্টোপাধ্যায়



বাঙ্গালী সতত গর্ব করে তার ইতিহাস নিয়ে , চায়ের পেয়েলায় তুফান তুলতেও আমাদের জুড়ি মেলা ভার । আবার ভুলে যাওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা কতটা পারঙ্গম তাও আমাদের জানা এবং এক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞানপাপী বলাটাও অত্যুক্তি নয় ।

আজ থেকে দু'শো বছর আগে বিহারের পূর্ণিয়াতে এমন একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন যাঁকে বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ বললেও কম বলা হয় । কিন্তু আমরা তাঁর কিছুই প্রায় জানিনা । যে জাতি বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমের নামে মাথা নিচু করে তাদের এমন বিস্মৃতি শুধু হতাশাজনকই নয় লজ্জাকর'ও বটে ।

সন - ১৮১৪ ( ১২২০ বঙ্গাব্দ , ৮ই চৈত্র , রবিবার ) , বিহারের রানি ইন্দুমতি'র দেওয়ান , চৈতন্য দীক্ষাগুরু কেশব ভারতী'র উত্তরপুরুষ হরনারায়ণ সরকারের ঘরে বেজে উঠল মঙ্গলশঙ্খ , বাবা হলেন তিনি । পুত্রের নাম রাখা হল শ্যামাচরণ । আদরে - আহ্লাদে বেড়ে উঠতে লাগলেন তিনি । কিন্তু সৌভাগ্য কারো বেশীদিন থাকে না , মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই পিতৃহারা হলেন তিনি । মায়ের হাত ধরে ফিরে এলেন পিতৃগৃহ নদীয়া জেলার মামজোয়ান গ্রামে । সেখানে একটিমাত্র পাঠশালা , তেমন পড়াশোনার সুবিধা নেই ; তবুও নিরুপায় হয়েই শিক্ষালাভ হতে থাকলো পাঠশালায় । চোদ্দ বছর বয়সে এক জ্ঞাতির শ্রাদ্ধ উপলক্ষে কৃষ্ণনগর গেলেন শ্যামাচরণ, সেখানেই তাঁর বুদ্ধিমত্তা'র পরিচয় পেয়ে তাঁকে নিজের বাড়িতে থেকে পড়তে বললেন কাকা হরচন্দ্র সরকার । হাতে চাঁদ পেলেন শ্যামাচরণ , সেখানে তাঁকে পড়াতে শুরু করলেন রামতনু লাহিড়ী'র জ্ঞাতি শ্রীনাথ লাহিড়ী । অল্পদিনের মধ্যেই ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করলেন শ্যামাচরণ । ইতিমধ্যে রামতনু লাহিড়ী'র সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তাঁর । কুড়ি বছর বয়সে কোলকাতায় এসে পিতৃবন্ধু রীড সাহেবের অধীনে ১০ টাকা বেতনে মুন্সী পদে নিযুক্ত হলেন । কিছুদিন পরে একটি মামলায় রীড সাহেবের হয়ে মিথ্যা সাক্ষী দেবেন না বলে চাকরী ছেড়েও দিলেন । এইসময় রামতনু লাহিড়ী'র চেষ্টায় জোসেফ কোম্পানির অফিস ইনচার্জ জোসেফ সাহেবকে হিন্দি পড়ানোর জন্য মাসিক কুড়ি টাকায় নিযুক্ত হলেন , তখন তাঁর বয়স বাইশ বছর , এই সময়েই তিনি রামতনু লাহিড়ী'র কাছে ইংরাজি পড়তে শুরু করলেন । ইতিমধ্যে একদিন অশুদ্ধ উর্দু বলে উপহাসিত হওয়ায় তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন উর্দু শিখবেন এবং ১৮৩৭ সালের আগেই হিন্দি, ইংরাজি ও উর্দুতে পারঙ্গম হয়ে উঠলেন । এইসময়েই তিনি ল্যাটিন, গ্রীক, ইটালিয়ান ভাষা শিখতেও শুরু করলেন ।

১৮৩৭ সালে , কোলকাতা মাদ্রাসায় বাংলা পণ্ডিত হিসাবে মাসিক পঁচিশ টাকায় নিয়োজিত হলেন শ্যামাচরণ , পরে তা বেড়ে মাসিক চল্লিশ টাকা হয় । এরপর ১৮৪২ সালে কোলকাতা সংস্কৃত কলেজে মাসিক সত্তর টাকায় দ্বিতীয় ইংরাজি শিক্ষক রূপে যোগদান করেন । ছ'বছর পর তিনি সদর দেওয়ানি আদালতে পেশকার রূপে নিয়োজিত হন , এইসময় তাঁর খ্যাতি অনুবাদক হিসেবে ছড়িয়ে পরে এবং তখন তিনি মাসিক চারশ টাকায় এই আদালতে প্রধান অনুবাদক হিসেবে যুক্ত হন ( ১৮৫০ ) । ১৮৫৭ সালে সুপ্রীম কোর্ট তাকে 'Chief interpreter' হিসেবে মাসিক ছয়শ টাকায় নিয়োগ করে । বাঙ্গালীদের মধ্যেই শ্যামাচরণ'ই প্রথম এই পদ অলঙ্কৃত করেন । ১৮৭২ সালে তিনি ' Tagore law lecturer ' মনোনীত হন । এই ঘটনাটি ১৮ ই জুলাই ১৮৭২ এর অমৃতবাজার পত্রিকায় ছাপা হয় । এই পদের সম্মানদক্ষিণা ছিল দশহাজার টাকা । এই সময় মুসলমান আইন নিয়ে তিনি যে বক্তৃতা দেন তা ১৮৭৩-৭৪ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় । এরপর ১৮৭৪ সালে শ্যামাচরণ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন যা ৬ ই মার্চ, ১৮৭৪ এ ভারত সংস্কারক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এ প্রথম সভাপতি ছিলেন তিনি ( ২৬ শে জুলাই ১৮৭৬ ) ।

১৮৫৮ সালে তিনি এক বৈপ্লবিক কাজ করেন , নিজের গ্রাম মামজোয়ানে প্রতিষ্ঠা করেন ইংরাজি- বাংলা অবৈতনিক বিদ্যালয়, এছাড়াও প্রচুর জনহিতকর কাজও তিনি এসময় করেন । মা যাতে গ্রামের বাড়ি থেকে ট্রেন দেখতে পান সেজন্য তিনি মামজোয়ান থেকে বাদকুল্লা পর্যন্ত একদম সোজা একটি রাস্তা নির্মাণ করান যা ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ - মাতৃভক্তির এ এক অসামান্য নিদর্শন । এই রাস্তাটি বর্তমানে ' শ্যামাচরণ সরকার রোড 'নামে খ্যাত । ১৮৮২ সালের ১৪ ই জুলাই শ্যামাচরণ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।

শ্যামাচরণ শর্ম সরকারের লেখা কিছু বই ~

(১) Introduction to the Bengali Language adapted to students who know English - In two parts BY a Native.
(২) বাঙ্গলা ব্যাকরণ
(৩) ব্যবস্থা দর্পণ
(৪) THE MUHAMMADAN LAW : being a digest of the law applicable especially to the sunnis of India, Calcutta 1873, P.P 567 , TAGORE LAW LECTURES, 1873
(৫) THE MUHAMMADAN LAW : being a digest of the sunni code in part and lmaniyah code, Calcutt 1875 , TAGORE LAW LECTURES, 1874
( এই দুটি বই প্রথম মুসলিম আইন গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত । এইজন্য এখনও একে 'SHYAMACHARAN LAW ' বলে অভিহিত করা হয় । )
(৬ ) সিরাজিয়া
(৭) VYAVASTHA CHANDRIKA, a digest of Hindu Law as current in all the provinces of India, Except Bengal proper vol. 1. 1878, vol. 11.1880
(৮) পাঠ্য সার ।
(৯) নীতি দর্শন ।

শ্যামাচরণই একমাত্র ,যার বই মস্কো লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে । প্রথম আইন গ্রন্থ প্রণেতা, এখনও মুসলিম আইন নিয়ে কথা বলতে ‘আমরা শ্যামাচরণ ল‘এর শরণাপন্ন হই ।প্রথম সিনট্যাক্স সম্বলিত বাংলা ব্যাকরণ প্রণেতা , পরপর পাঁচবার সুপ্রীমকোর্টের 'Chief interpreter' , প্রথম বাঙালি হিসেবে ' Tagore law lecturer ' ( প্রসন্নকুমার ঠাকুরের নামে এই পদ ) ।

শ্যামাচরণের ভাগ্যে বহু অপবাদ জুটেছিল , তারমধ্যে অন্যতম হল তিনি নীল বিদ্রোহের সময় চুপ ছিলেন । আজ জানা যাচ্ছে - দীনবন্ধু মিত্র'র 'নীলদর্পণ' নাটকের অনুবাদ করেছিলেন শ্যামাচরণ ' BY a Native ' নামে যা তৎকালীন আরেক বিখ্যাত পুরুষ ' বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ' , মধুসূদন দত্ত'র লেখা বলে প্রচার করেছিলেন ! যদিও স্বয়ং দীনবন্ধু মিত্র , তাঁর 'সুরধনী' কাব্যে লিখেছিলেন -

" চলিতে চলিতে পরে চড়ি যে লহরী
দেখিলাম সুখে মামজোয়ানি নগরী
মামজোয়ানিরে তোর সার্থক জীবন,
দিয়াছ সমাজে শ্যামচরণ রতন ... "
আশা করা যায় , স্বয়ং নীলবিদ্রোহের অন্যতম রূপকার বিনাকারনে এই প্রশস্তি করেন নি । যদি শ্যামাচরণ নীলবিদ্রোহকে সমর্থন নাই করতেন তবে এই লেখা লিখিত হত কি ?

আরেক সম্মানীয় মানুষ ' বিদ্যাসাগর ' , শ্যামাচরণের ব্যাকরণ না পড়েই ' ফুঃ ফুঃ ' করে তাচ্ছিল্য করে সরিয়ে রেখেছিলেন ! ভাবতে অবাক লাগে যাকে আমরা জানি 'দয়ারসাগর' রূপে তিনিও এমন করেছিলেন ! যদিও পরবর্তীতে বিদ্যাসাগর স্বীকার করেছিলেন তাঁর ভুল হয়েছিল ।

আজ এই সময়ে আমাদের উচিৎ এমন এক মানুষের জন্য কিছু অন্তত করা , যাতে এতদিন যে অনাদরের ধুলো পড়েছে তাঁর গায়ে তা কিছুটা হলেও মোছা যায় ।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি -

১। শ্যামাচরণ সরকারের জীবনচরিত / বেচারাম চট্টোপাধ্যায়
২। 'গোরাগাঙনি'
৩। স্মারক পত্র
( মহাত্মা শ্যামাচরণ শর্ম সরকার দ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপন সমিতি , শান্তিপুর শাখা কমিটি )

বিশেষ কৃতজ্ঞতা -

গোরাগাঙনি টীম,
দীনবন্ধু সরকার ,
গৌতম অধিকারী,
গৌতম চট্টোপাধ্যায়
এবং
নিজের কানজোড়া'কে ।

কবিতা - মোশতাক আল মেহেদী

গুচ্ছ কবিতা
মোশতাক আল মেহেদী



(১)

সারারাত কাটকুট শব্দে পোকায় খাচ্ছে কবিতা,
আমি বিছানায় শতখন্ড হলে
টিকটিকি ডেকে ওঠে -ঠিকঠিক...



(২)

বাতাসের কাতুকুতু খেয়ে পাতাদের হাসি,
বলি এতো ভালো নয়, পড়ে যাবি।
পিঁপড়ের ভেলা হতে ইচ্ছে করে?
এসবই ছল, প্রলোভনের টইটুম্বুর ।
সবাই যেভাবে যায়
চিহ্নটুকু মুছে যায়...



(৩)

এবার বসন্তে মানুষের হাতে হাতে বাঁশ,
মগজে চৈত্রের চাষ, অপরূপ আগুনের
রান্নাঘর পোড়ে হিংস্র আগুনে
জীবনযাপনে বন্দুকের সিসা ঢুকে যায়
ক্ষমতার মনোরোগে কাঁপছে বাতাস...



(৪)

ভালবাসবো বলে যে ঘৃণা থাকবে না
অমন সহজ বাক্য মানিনা -
কারা আমার চোখ থেকে সুখস্বপ্ন ছিঁড়ে
ফেলে দেয় দুঃখের সীমানায়,
মানবিকবোধের গতরে ট্রিগার টেপে স্বদেশে রাজাকার
মিতার শরীরে বেড়ে ওঠা ভিনদেশি ভ্রুণের আগাছা
জলে জঙ্গলে পড়ে থাকা মৃতের চিত্‍কার
গোলাম আযমের তলপেটে লুকানো ছুরির ইতিহাস...



(৫)

শিমুলতলার তলে পাখি উড়ে আসে
শালিখ চড়ুই জানে ভাতবৃষ্টি হবে,
পাখির ঠোঁটের সাথে কথা বলে কবি...



(৬)

জীবন কি এমনই তেতো?
রক্ত-চিনি শুষে নেবে পদ্মবুরুজ!
গোল আলু গড়াগড়ি করলার ঝোলে...
চিকেনের ঠ্যাং নড়ে আহাম্মক পেটে।



(৭)

কতকিছু ভেসে গেল -
তবু অক্ষরে সুধা আছে ...



(৮)

অগ্নিকুন্ডে জলের ছিটা
ধোঁয়া এবার বৃষ্টিকে নাচাবে
যতো পারো করে যাও সন্ধ্যাপুজা
মন্ত্র উচ্চারণে বুঁজে আসা চোখ
ঈশ্বর কপালে চুমু রেখে মিশেছে ধোঁয়ায়...

ব্যক্তিগত গদ্য - মধুছন্দা পাল

বিয়ে, আমাদের বাড়ীর
মধুছন্দা পাল

প্রায় প্রত্যেক বছর আমাদের বাড়ীতে একটা তো বটেই কখনও কখনও দুটো বিয়েও লাগতো । বাড়ীর দাদা দিদিদের ছাড়াও জ্যাঠতুত দিদির মেয়েদের বিয়েও আমাদের বাড়ী থেকে হতে দেখেছি ।

রান্না ঘরের ঠিক পাশেই একটা ঘর ছিল আমরা সেটাকে বড় ঘর বলতাম ।রান্নাঘর আর বড় ঘরের মাঝখানে একটা দরজা নিরামিষ উনুন ঘেঁষে । পিসিমা নিরামিষ উনুনে দুধ জ্বাল দিয়ে বড় ঘরের চৌকাঠের ওপারে রাখা বাটিতে বাটিতে ঢেলে রাখতো । কি ছিলনা ঐ ঘরে ! গৃহস্থের সাংসারিক প্রয়োজনের সব জিনিষ পত্র রাখার ব্যবস্থা ছিল ওখানে । আমাদের জমি থেকে আসা চাল ভর্তি বস্তা,একটার ওপর একটা উঁচু করে সাজিয়ে রাখা মাচার ওপর। উঁচুতে ঝোলান কাঠের শক্ত পোক্ত চার কোনে চারটে লোহার শেকল দিয়ে ঝোলান মাচায় বাড়ীর সমস্ত লেপ কম্বল । শীতের শেষে তুলে রাখা । , বড় একটা চৌকির ওপর বড় থেকে ছোট করে সাজানো খান দশেক শিল নোড়া , নানা মাপের লোহার হামানদিস্তা । আরও নানা রকম বাসন পত্র , পাথরের বাসনের সেট , আর চৌকির নীচে গরমকালে বস্তার ওপর সাজানো শ’দরে কেনা আম , উঁচু স্ট্যান্ডের ওপর সারি সারি খাবার জলের কলসি । ঐ ঘরের একটা খোপ মতো জায়গায় থাকতো ছোটকাকীমার বেলা দশটার স্পেশাল চায়ের সরঞ্জাম আর থাকতো পিসিমার খই ভাজার পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া বালি ভর্তি কড়া আর একটা নারকোল কাঠির ছোট ঝাঁটা । ,আর ।যা থাকতো সেটাকে বলা হত যজ্ঞির বাসন ।

সে সময় মনে হয় এখনকার মতো বাসন ভাড়া পাওয়া যেতনা । তাই বাড়ীতেই এই সমস্ত বাসনের ব্যবস্থা থাকতো । তবে আমাদের বাড়ী থেকে বাঙ্গালী প্রতীবেশীদেরও অনুষ্ঠানের জন্যে বাসন নিয়ে যেতে দেখেছি ।

কি কি বাসন ছিল একটু মনে করি । যতদুর মনে পড়ে বিশাল বিশাল কালো রঙের কড়া , হাঁড়ী , হাতা ঝাঁজরি , ডেকচি, নৌকো , বিরাট বড় বড় বারকোশ । আরও হয়তো কিছু ছিল । পেতলের বড় বড় গামলা । বঁটি বেশ অনেক গুলো । পরিবেশনের করার জন্যে ছোট বালতি , হাতা চামচ জল দেওয়ার জন্যে পেতলের জলের জগ।

বিয়ের আগে সে সমস্ত নামানো হতো । বেশ কিছুদিন ধরে চলত মাজাঘষার পর্ব । বাসনের ঘড়াম ঘড়াম আওয়াজেই মনে হতো শুরু হয়ে গেল বিয়ে বাড়ী।

কার বিয়ে কি বৃত্তান্ত অত কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় কে? বাড়ীতে কতো লোকজন আসতো । কতো ছোট বাচ্চা । সেই আনন্দেই মশগুল । একটাকে ট্যাঁকে নিয়ে সারা বাড়ী চষে বেড়াতে পারলে আর কি চাই ! একবার মনে আছে , কার বিয়ে মনে নেই বড় বউদির এক বান্ধবী এসেছে বিয়ে উপলক্ষে । মনে হয় গায়ে হলুদের সময় । দিনের বেলা ।, কোলে একটা ছোট্ট বেশ মোটাসোটা মেয়ে । আমি ওকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি হঠাত বাচ্চাটা কিলবিল করে উঠলো আর আমার কোল থেকে সোজা মাটিতে থপাস করে পড়ে গেল । সত্যি করেই আওয়াজ হোল , থপাস । একটু দুরেই মেয়ের মা এবং আরও অনেকে । বাচ্চাটা একটু কান্না কাটি করলো ,ওর মা এসে কোলে নিলো । আমায় অবশ্য কেউই তেমন কিছু বললোনা ।

বিয়ের সময় আমাদের পুরনবাড়ী নতুন করে সাজত । দরকার বুঝে রঙ করানো হতো । বিয়ের দিন থামে থামে রঙিন কাপড় জড়িয়ে দেওয়া হত নানা রঙের । আলো লাগানো হতো । আমাদের সেই বাড়ীকে যেন চিনতেই পারা যেতনা ।

কতো যে লোকজন আসতো বাইরের শহর থেকে । একেকটা ঘরে মেঝেতে টানা বিছানা হতো ।পছন্দমতো সঙ্গী বেছে তার পাশে শুয়ে বকবক করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়তাম । কলকাতা থেকে যেতো জ্যাঠামনির ছোট মেয়ে জামুদি । তার দুই মেয়ে প্রায় আমারই বয়সী । এইরকম আরও ছিল কেউকেউ

।আমরা কতো যে দৌরাত্ম করতাম । হাজার বার একতলা তিনতলা করতাম । পড়তাম , কেটে যেত , ছড়ে যেত । থুতনি কাটা তো স্বাভাবিক ঘটনা ছিল । খুব বকুনি খেয়েছি বলে মনে পড়েনা ।

আমাদের বড়দি মানে সবচেয়ে বড় জ্যেঠতুত দিদি যেত কলকাতার কাছাকাছি কোন ছোট শহর থেকে । কয়েকটি ছেলে মেয়ে থাকতো সঙ্গে । একবার কারো বিয়ের দুদিন পর যে যেখানে পেরেছে দুপুরে ঘুমিয়ে ক্লান্তি কাটাচ্ছে বা গল্প গাছা করছে । আর আমরা নেচে বেড়াচ্ছি সারা বাড়ী । বড়দির এক মেয়ে একটা পছন্দসই জায়গায় কষে ঘুম লাগিয়েছে । সেই সুযোগে কেউ একজন তার সারা মুখে আলতা দিয়ে এঁকেছে দাড়ি গোঁফ । সে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এলে সবাই ওকে দেখে হাসাহাসি করলেও বেচারা কিছুই বোঝেনি , একটু অবাক হলেও সকলের সঙ্গে হাসছে , কিছু বুঝতে না পেরে ।

শেষে অনেকপরে কেউ ওকে টেনে আয়নার সামনে গিয়ে হাসির কারণ দেখিয়ে দিল , বেচারি আমাদের জ্যাঠাইমার কোলে মুখ গুঁজে “ও দিদা , তুমি কেন কিছু বললেনা ।” বলে খানিকটা কেঁদে নিল । এই রকম ঘটনা আরও ঘটতো ।

সবসময়ই বিয়ে হয়েছে অন্য শহরের ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে । অন্য শহর থেকে বর এসে উঠত ধরমশালায় । ভাগলপুরে ভালো হোটেল তখনও হয়নি মনে হয় । ধর্মশালা বললে যেমন শোনায় ঠিক তেমন ছিলনা সেগুলো । সেসময় পূন্যকামী মাড়োয়াড়িরা অনেকেই পূর্বপুরুষের স্মৃতিতে একটা করে ধর্মশালা স্থাপন করতেন । অনেক জায়গা নিয়ে । বড় বড় ঘর , বাগান , ইত্যাদি নিয়ে দুতলা বাড়ী । আমাদের পাড়াতেও ছিল তেমন গোটা দুয়েক । খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা নিজেদের করতে হতো । তো বরযাত্রীদের সেখানে ওঠানো হতো । বাকি আদর আপ্যায়ন বাড়ী থেকে করা হতো । লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে মহিলারা সে সময় বরযাত্রির সঙ্গে আসতেননা মনে হয় । তাঁদের কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছেনা ।

বিয়ের বেশ কদিন আগে বসতো মিষ্টির ভিয়েন । রান্নাঘরের সামনের উঠোনে । এমনিতেই আমাদের গৃহদেবতা গোপালের মিষ্টি তৈরি হতো বাড়ীতে । সন্দেশ , রসগোল্লা , পান্তুয়া । আমাদের বাড়ীর তৈরি মিষ্টির নাম ডাক ছিল । কাজেই বিয়ের মিষ্টিও হতো খুবই উপাদেয় । বোঁদে হতো মনে আছে । বিয়ের সময় আমরা দইয়ে বোঁদে দিয়ে খেতাম । , মাটীর খুরিতে জমাট টক দই তার ওপর রসে টুপটুপে বোঁদে , আহা ! কি স্বাদ তার । মিষ্টির ভিয়েনের পর হতো যজ্ঞির রান্না । যখন মাছ ভাজা হত দাদারা মাছ ভাজা চুরি করে ওপর নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে খেত । কদিন ধরে একতলার বারান্দায় লম্বা দুটো সারিতে আমরা খেতে বসতাম । বিয়ে কিম্বা বৌভাতের সময় তিনতলার ছাদে খাওয়া হতো । তখনও টেবিল চেয়ারে বসে খাওয়ার চলন হয়নি বিয়েবাড়ীতে । মাটিতে বসে শালপাতায় খাওয়ার ব্যবস্থা হতো। কলকাতার মতো কলাপাতায় নয় । শালপাতা আর মাটীর খুরি ,গ্লাস । কি যে খাওয়া হত সব মনে নেই । খুব সুন্দর পাঁঠার মাংস হতো মনে আছে । পরদিন সকালে আমরা বাসি লুচি দিয়ে পাঁঠার মাংস খেতাম জলখাবারে আর বোঁদে । আর একটা বিশেষ পদের কথা অনেকেই মনে করতে পারবেন , সেটা হোল “ছ্যাঁচড়া” । মাছের কাঁটা তেল ইত্যাদি আর শাক পাতা দিয়ে তৈরী। নাম শুনে যতই নাক সিঁটকান হোকনা কেন ঐ রকম স্বাদু চচ্চড়ি আর খেয়েছি বলে মনে হয়না । তবে এই পদটা হতো “ঘর যোগে” অর্থাৎ বাড়ীর লোকজনের খাওয়া দাওয়ার সময় ।

বাড়ীর ছেলেরা পরিবেশন করতো । কোমরে তোয়ালে অথবা গামছা জড়ানো পরিবেশকদের নিশ্চয়ই মনে আছে , অনেকেরই ! লুচির ঝোড়া হাতে “ লুচি, লুচি” বলতে বটে যাওয়া । মাছ কিংবা মাংসের বালতি হাতে আর একটুকরো মাছ অথবা মাংস বা মিষ্টি নেওয়ার জন্যে পেড়াপিড়ি । সেসব কোথায় আজ চলে গেছে । আমরা ছোটরা নুন লেবু আর জল দেওয়ার অনুমতি পেয়ে ধন্য হয়ে যেতাম । আর একটা কাজ করতাম মনে আছে । গোছা গোছা শালপাতা ধুয়ে ঠাকুরঘরের বারান্দায় রাখা থাকতো । আমাদের কখনও কখনও পরিস্কার কাপড় দিয়ে সেই শালপাতা মুছে রাখতে বলা হত ।

ছেলেদের বিয়ে হলে বউ আসতো সাধারনতঃ সকালের ট্রেনে ।সন্ধ্যেবেলা একটা মহিলা মহলের ঘরোয়া আড্ডা বসতো । সেখান নতুন বৌকে ঘিরে বসতো বাড়ীর আর প্রতিবেশী মহিলারা ।

প্রধানত নতুন বউয়ের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করার জন্যেই। নতুনবৌকে দিয়ে গান গাওয়ানো হতো । এ ছাড়া আর যার যা গুন আছে সে তাই প্রকাশ করতো । সে এক কাণ্ড ।আমি আর আমার উনিশদিনের ছোট জ্যাঠতুত বোন একদম সামনে গিয়ে বসতাম । আগে থেকেই জানতাম গান শুনে হাসি পাবে । জানিনা কেন এমন মনে হতো । সত্যি করেই হাসি পেত । হাসি চাপার জন্যে নানারকম দুঃখের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করতাম ( পরশুরামের বিরিঞ্চিবাবা মনে পড়ছে তো ?) কিছুতেই কিছু হতোনা ।শেষ পর্যন্ত উঠে পড়তাম । আর এই রকম অসভ্যতা করার জন্যে বড় দিদিদের কাছে বকুনিও খেতাম ।

এটা আমার শোনা ঘটনা - আমাদের লালুদা আমাদের বাড়ীর বড় ছেলে । তার জন্যে মেয়ে দেখতে যাওয়া হয়েছে বিহার আর বাংলার সীমানার কোন শহরে । প্রথম ছেলের বিয়ে বলে কথা ! জ্যাঠা, কাকারা প্রায় সবাই গেছে ।সঙ্গে আমার দাদা । বেশ ছোট তখন । বড় বড় চেহারার পেছনে চাপা পড়ে গেছে প্রায় । মিষ্টিমুখ করার সময় দাদাকে আর কারো চোখেই পড়েনি । আমাদের হবু বৌদির ছাড়া । সে কাউকে দিয়ে ছোট্ট দেওরটিকে বাড়ীর ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাবার খাইয়েছে একটা হাঁড়ীর ঢাকায় করে ! মনে হয় রেকাবি কম পড়েছিল । পরে দাদা বড় হয়ে বউদিকে এই নিয়ে ঠাট্টা করতো আর বৌদি বলতো “তুই আবার কথা বলছিস ? খাওয়া তো হতই না , আমি না দেখলে । মুখচোরা কোথাকার ।”

এমনি করেই আনন্দ করে শেষ হতো বিয়ের দিন গুলো । অষ্টমঙ্গলার পর একএক করে ফিরে যেতো যারা যারা এসেছিল । বাসনপত্র উঠে যেত তাদের যায়গায় । আবার সেই আগের রুটিন । কিছুদিন খুব মন খারাপ লাগতো । আবার সব আগের জায়গায় ফিরে যেত। আমরাও ।

গুচ্ছ কবিতা - বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

গুচ্ছ কবিতা
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়





পাপের কোরাস চুইয়ে
হলুদ ত্বকে ফুটে আছে
মৃদু হাইফেন-
সে-লা-ই-বি-হি –ন

উপত্যকা



অনূদিত ঘুমকাতরতা
তুলে আনছি
আকরিক সুখ

ওরা ফেলে গেছে
লোকাল কুয়াশা ,বাতিল বারুদ, ম্যাপলিথো স্বপ্ন
ক্লোজড ছায়াপথ
কুড়িয়ে নিচ্ছি উদভ্রান্ত
গল্পরেখা



স্থির হাতলে
আটকে রাখা প্রত্যন্ত অক্ষর
গড়িয়ে আসছে
জমাট ছবি, আলোরং
জ্যোৎস্না সিরিঞ্জ
বিনিময় যোগ্য শীত পেরিয়ে
দেখি তোমার স্বাদু অন্তর্বাস
আর কয়েকটি
অ ক্ষ র



তার ব্যারিটোনে
রাগি সতর্কতা
নিকোটিন উৎসব
জানালায় বিদ্যুৎ রঙ

প্রাক্তন গন্ধের মধ্যে
লালিত চৌকাঠ ।



শিল্পায়ন

রীরের আনাচে কানাচে
( প্রাগম্যাটিক মনোলগ )
ভাইব্রেশন, নাট বল্টু , হামিং সাউন্ড
ধাতব শীৎকার ...

-

বিঃ দ্রঃ- পি এল এফ হাই ।

কবিতা - মৃণাল বসুচৌধুরী

নিষিদ্ধ দহন
মৃণাল বসুচৌধুরী



স্মৃতি এক পুরনো অসুখ
        শুশ্রূষাবিহীন কোন
                  নিষিদ্ধ দহন
হয়ত বা চিত্রকলা
        শুদ্ধতম ভোরের বকুল

স্মৃতি এক মৃগনাভি
        হলুদকুসুম
        ছায়ামাখা মন্দিরের সিঁড়ি
অথবা আহ্লাদি কোন পদ্মপাতা
        কাঙালিনী পথের নূপুর
অমলপ্রবাহে এক
        বিবাগী চড়ুই
        বৃষ্টিভরা মেঘ কিংবা
                    শব্দের পাঁচিল
শূন্যঘরে অলৌকিক
        সোনালি আশ্রয়

স্মৃতি এক শব্দহীন সুখ
        জ্যোৎস্নায়
        ছিন্নমূল শিকড়ের গান
কখনো বা আর্তনাদ
        অশরীরী বিষাদ -পুরাণ 


কবিতা - মৃণালকান্তি দাশ

হত্যা
মৃণালকান্তি দাশ



অস্পষ্ট হয়ে এলে ফুলের শীৎকার
গাছের সংস্রব থেকে সরে যায়
মনুর ছেলেরা

পথের দুদিকে নামে অন্ধকার
রহস্যের মত
মাটির উত্তাপ থেকে খুঁটে নেয়
শোকের ফসল

তারপর ক্রমাগত ভোর হতে থাকে

কবিতা - বারীন ঘোষাল

একাবাস
বারীন ঘোষাল



একা বাস করে
তার কংক্রিট ছায়ার কং
                                                       কিচ কিচ ক্রিটের আলো
বারে বারে সারাই মিস্তিরি আসে
সে টুকরোয় গণপিটুনির ভাবে পলেস্তারা সাজিয়ে বিট্টুখেলার কথা

পায়ের ছাপ মোছার খেলা তাই
                               -- -- -- জন্য যতটা মুভির স্মৃতি দরকার
যতটা বিছানা
যেন প্রতিবেশী নেই
                              ঝাঁ গিজগিজে উরুস্তান

ফুটো ছপ্পর তো মজনু লে
মিঠা পিনহোলেরা
                                               মিঠি বারিশ
                       ঝিলিকমালা আর বজ্রের ঠোঁটে
একাবাস ফোটে



কবিতা - যশোধরা রায়চৌধুরী

বৃষ্টি
যশোধরা রায়চৌধুরী



মেঘখানি হয়ে ওঠে গাঢ়
তারপরে, বৃষ্টি, আরো বাড়ো
বৃষ্টি বেড়ে বাড়তে বাড়তে ফুলে
ফেঁপে ওঠে, কালিন্দীর কূলে
দুলতে থাকে মেঘের নৌকোও
নৌকোয় রাজকন্যা, শোও
বৃষ্টি , তুমি রাজকন্যা আজ
মাথায় জলের ঝাপটা সাজ



কবিতা - সপ্তাশ্ব ভৌমিক

পদাতিক
সপ্তাশ্ব ভৌমিক



ঝাপ বন্ধ করে রাখি ফণা থাকে চোখের আড়ালে
ভেতরে অবাধ্য ঋণ ক্রমাগত সুদ হয়ে বাড়ে
প্রতিবিম্ব শুধু জানে আকার বিকার আয়তন
গভীরে অনেক ক্ষয় উপরে চিকন আবরণ

অবিরাম তীর ছোটে মেঘের আড়ালে কারা হাসে
পদাতিক একা লড়ে অস্ত্র শুধু ঢাল তলোয়ার
নিশ্চিত পতন জানি তবু যুদ্ধ শুদ্ধ করে পথ
ক্রমাগত রক্ত ঝরে নিভে আসে অলীক শপথ

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে আরো ধীরে মৃত্যু নেমে আসে
বাতিস্তম্ভ বহুদূরে হিম পড়ে সৈনিকের গায়
অস্ত্র পড়ে আছে পথে শেষ হল মান অভিমান
শেয়াল কুকুর ডাকে আজ রাতে নেই পরিত্রাণ

শুয়ে থাক নুয়ে থাক ভিন্ন কোনো পথ নেই আর
পুড়ে যাচ্ছে পুড়ে যাক ভেতরের সব হাহাকার

কবিতা - সুবীর বোস

কুয়াশা শব্দ - ৪
সুবীর বোস



আমরা নির্দিষ্ট চেয়ারে যখন পরিবেশবিদ
লুকোনো কুয়াশাগুলো অঙ্গীকারে জমা হয় ঘোলাটে মাদুরে
    তখন দর্জিরা মাপ নিলে মাছেদের বিন্যস্ত সন্ধ্যার
আহা, কী নিপুণ - মোলায়েম মিশে যায় ফাৎনা ও আগ্রাসী লোভ
                                                     জলে ঢিল আর মগজ পরম্পরায়
এসময় নবসারসের প্রায় আরোপী আদলে
প্রকৃত গর্বিত মুখ বসে থাকে আমাদের উত্তরপুরুষ

তারপর আমরা নির্দিষ্ট হই বাতিল আধুলি থেকে নতুন খেলায়! 


কবিতা - নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়

জেগে আছি
নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়


গোপন গোপনে ডাকবে। এই ভালো। এর মধ্যে কথা বাড়াবার
এমন অসুখ কোথা পেলে? ভ্যালা অশুভম দিনটি কাবার
করে বাঁচে নিত্যসুখ, সুধা প্রভু, গোলাপী সে আলাপের ঘাট
একটু ফসকে গেলে এপিটাফে লিখিও সে প্রবল আকাট
লোহার বাসরঘরে প্রণয় বুঝিতে পারে পিরিতির ফাঁক
রাতজোড়া চন্দ্রবিন্দু ছাপ মুছে আই ডোন্ট কেয়ার মিহি টিস্যু
লোনলি গ্রহটি হাতে চলিয়াছে নিবারণ ভ্রমণপিপাসু
তাহাদের তরে বাপু কিছুক্ষণ উপস্থ ও জিহ্বাকে তালাক
কে যে কি ভাবিয়া করে, কে যে শোনে অন্যবীণা, ঢাকের প্রলাপ
প্রবাদের পৌষমাস বসিল রে সর্বনাশী এলোকেশী পাশে
না হয় কিছুটা থাক যমের অরুচি সেই অমৃতগরাসে
অতিচেনা হয়ে পড়লে স্পয়েলস্পোর্ট, সময় ছাড়ালে কালসাপ

গোপনে গোপন ডাকবে। যে আছে চোখের কাছে, বাস্তুভিটে, আলো
সুয়ো হোক দুয়ো হোক, এ প্রবীণ অন্ধকার হাতটি বাড়ালো ।

কবিতা - বিদিশা সরকার

শনাক্তকরণ
বিদিশা সরকার


কেন এত নীরবতা
ত্রয়োদশী চাঁদের আলোয়
ক-অক্ষর পড়া যায় ?
রজনীগন্ধার আলো বাগান ভরিয়ে ....

জোনাকিরা নিভে গেছে ,
গত সাতদিন শুধু
পড়শির উৎসবে মারবা সানাই

তবু শূন্যতায় ভরা
শূন্যে ব্যাবিলন
তুমিও কি ফিরে গেছ
রোজ যেরকম ---
অপেক্ষাতো বেওয়ারিশ লাশ
শনাক্তকরণে যারা
কুলটা বলেছে ।



কবিতা - অলক বিশ্বাস

প্রকৃত গল্প
অলক বিশ্বাস



প্রকৃত গল্প বলা ভীষণ কঠিন
ভূমিকম্প হতে পারে এই ভেবে
তুমুল বর্ষণে তুমিও বজ্রপাত !
রোদহীন দিন কঠিন ভীষণ
ভূপৃষ্ঠে উছল সেই তো অশ্রুপাত।

নিখুঁত দেখছি একটু একটু করে
সরাই আভরণ, দু‘চোখে বিকেলগুলি
গল্পে নির্জন দ্বীপ
অনুভব দীর্ঘতর হলে রাত্রি গভীর নিবিড়
প্রাকৃত শিল্পকলায় প্রকৃত বিশ্ব গড়ে তুলি।

প্রকৃত গল্প আসলে নদী
প্রকৃত সারস থাকো যদি

প্রকৃত পাথর হয়ে যাও। 


কবিতা - অশোক দেব

প্রাপ্তি
অশোক দেব



পায়ের পাতা পড়ে আছে -
এক পাটি এদিকে, অন্যটা একটু দূরে ।
কে যেন এসেছিল, ফেলে গেছে ।
তাদের গায়ে গায়ে লেগে আছে শুকনো প্রণাম, কার যেন ।
একটু পথশ্রম আছে, এখনও দগদগে ঘায়ের মত ।
আলো নিয়ে যাই, নুয়ে দেখি, কার ? কার হতে পারে ?

এমন সময় অকালজ্যোৎস্না বেজে ওঠে আকাশে ।
চন্দ্ররহিত সেই জ্যোৎস্না শুধু এইখানে আসে, আসে এই বিদেহীদের পাড়ায় ।

আপনি, এখানে ?
-  পেছনে তাকিয়ে দেখি, আমার করুণাকাল, তার টি শার্টে জন্মপূর্ব সাল লেখা আছে ।
আপাদমস্তক দেখি তাকে ।

পা আছে, পায়ের পাতা নেই, প্রণাম লেগে আছে ।

কবিতা - জুবিন ঘোষ

শববাহক
জুবিন ঘোষ


প্রিয় শববাহক, তোমার পায়ের ডিমে ব্যথা হয়নি তো !
কাঁধের হাড়ে ? অনেক করেছ আজ
এইবার ফিরে যাও, বউটি অপেক্ষা করে আছে
গেটে লাগিয়ে রেখেছে সে মাধবীলতার গাছ
#
মন্থর পায়ে নদী ডিঙ্গিয়ে চলেন ওরা
কোমরে গামছা, ছিন্ন তালু, কাঁধ ভেঙে গেছে ভারে
এ-নদী পেরোতেই হবে সূর্যাস্থে, হাতে মাত্র একটা রাত্রি
#
কুয়াশায় মৃতদের মধ্যে দলছুট হয়ে
শেষ ফেরীটা ফিরে গেছে একটু আগে
আগুনের রহস্য ভুলে বাউণ্ডুলে ছাই
পৃথিবী বলে, -- উড়ে যাও ভাই, উড়ে যাও ভাই
#
সন্তরণ প্রণালী ভুলে ভাসিয়ে দিয়েছ শব
কেউ জানত না তার জন্মরহস্য, তখনও আদমশুমারি হয়নি পৃথিবীর
তাকে আদর করে মুখে ঢালো দু'ফোঁটা জল
#
মাঙ্গলিক প্রার্থনায় সদ্যজাত শ্মশানযাত্রী
ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি
হে মাংস হে অস্থি

কবিতা - ইন্দ্রনীল তেওয়ারী

গীত
ইন্দ্রনীল তেওয়ারী


কতদিন কথা বলিনি।
কতদিন শুনিনি গান।

আজ এতো রোদ,এতো ঝলমলে সকাল.........
এতো গোলমেলে রাস্তা।
পৌছনো দায় হয়ে গেছে।

কতদিন ওড়েনি বাতাসে ঝরঝর বৃষ্টি।
কতদিন ঢেকে যায়নি আকাশ মেঘে।

আজ এতো যে মানুষ, এতো কথা।
অসংখ্য ছায়াছবি।
মুখটুকু চিনে নেওয়া ভার।

আরও কতো ঘুম পেরিয়ে যাবে।
আরও কতো বিছানা, ঠিকানা.........
অগুনতি চুম।

মনে হয়,
দুয়ার পেরোন যাবে না আর, দুয়ার না পেরোলে।

কবিতা - বাণীব্রত কুণ্ডু

আকাশ ডিঙোনো খেলা
বাণীব্রত কুণ্ডু


কি জানি কি বলি,
যত সন্ধ্যের অলিগলি জীবনেতে এসে মেশে!
জীবন বিরাম চায়, তবু প্রাণ ছাড়ে না তো তাকে!
যতদিন বাঁচা যায় হৃদয়কে তুলে রেখে,
আকাশ ডিঙোনো খেলা খেলে গেছে জোনাকি আর তারাদের সাথে!

কিছু নদী ভুল বোঝে, জোনাকিতে তারা খোঁজে!
ভেঙে যায় চুড়ি ও নুপূর!

দূরে তারা দূরে থাকে, নদী তবু বয়ে যাবে
তারা থেকে তারাদের খোঁজে!
জোনাকিরা আলো দেবে, জোনাকিরা নিভে যাবে;
ভালোবাসা নদী পাবে অন্য তারার ভোরে!



কবিতা - ঊষসী ভট্টাচার্য

উদ্বাস্তু
ঊষসী ভট্টাচার্য


নিমগ্ন পারমিতা,
রেললাইন থেকে উঠে এসেছ রাজপথে,
নামতে নামতে আর কত গর্তে ঢুকবে বলো?
চৌকাঠ তো কবেই পেরলে।
সিঁদুর গলিতে আর হাঁটনি কখনো।
টুপুর যেদিন এল,
সেদিন আকাশ চিরে হঠাৎ প্লাবন,
ক্ষয়ে আসা জীবনে সোনা চমকে উঠলো যেন।
রাগে জেদে সম্পর্কের টুটি ছিঁড়বে ভেবেও,
একটা সুতোই কিছুদিন আরও বাঁধল তোমায়।
তবে,সুতোই তো , দড়ি হবার সাধ্য কোথায়?
টুপুর কে ফেলে হঠাৎ পালালে,
আমি তথৈবচ ।
যাকে ছুঁড়েছো আগেই ,
তাকে আর ফেলবে কোথায়?
মাস খানেক যেতে না যেতেই,
পলাতক, টুপুর ও।
পালানো রক্তে,
আটকাবে কে ? বিধাতা?
সীমাবদ্ধতা তাঁর ও।

আমি সেই হেঁটে চলা দিগন্তে,
আর একটা নোনা ঢেউ ,
কিংবা কিছু নুড়ি পাথর
সরাতে সরাতে, রাত ফুরনোর অপেক্ষা।

এক বেলোয়ারি মাদলে ভেসে এল নতুন ঢেউ-
কঙ্কনা,

‘কঙ্কণ তাঁর নিক্কন নয়,
চোখ ছলছলে নদী,
ঠোঁটের কোনায় আলতো সে মেঘ
আমায় ডোবালো যদি’

ঢেউ আসে যাবে বলেই,
স্থির কিছুই তো নয়।
তবু, ফের এই দিগন্তে।
টুপুর আসেনি, তুমিও না।
কঙ্কনা ভেসেছে,
যেমন কথা ছিল,
আমিও ফের তথৈবচ,
মুখে লেগে আছে দিনান্ত আভা,
এই দিগন্তে রোদ্দুর ঝলমলো।

কবির কলমে উঠে আসে বুক -
‘মুখ দেখে বোঝা যায়না
পাঁজরে কত ফুটো’ ।।

কবিতা - কচি রেজা

বিজিতা
কচি রেজা


পুতুলগুলোর খুব কাছেই থাকি,
শীতকালে ওদের গাল আর পালিশ করা নখও বস্তূত কাঁপে,
আমি কাঁটাঝোপ অনেক কষ্টে পেরিয়ে এসে শুনি, এখনও
চিনে মেয়েদের 'পা বেঁধে রাখা হয়,

দুঃসংবাদের কাছে যে-কোনো সুসংবাদই বিপজ্জনক, টের পেয়ে
শেষপর্যন্ত পড়ে ফেলি হস্তরেখার বই,
বলি নি তো, আমি সুবাসিত, জিহ্বভার নিচে দুগ্ধ ও মধু, তবু
ধর্মীয়তাৎপর্য মেনে কেউ যেতে দিল না পর্বাতারোহীদের সঙ্গে।

কবিতা - বেবী সাউ

সমান সমান
বেবী সাউ


সকাল থেকে ছোলা ভেজা চিবোচ্ছি আর গাধার সাথে তুলনা করছি । কাজ নেই কর্ম নেই ইচ্ছে নেই । মাঝখানে থেকে তোর সাথে ঝগড়া । জীবনটাই হেল হয়ে গেল হে ! ভ্যাপসা দুপুর ঘামে ভিজে শরীরে নারীর গন্ধ আর আলোছায়া কম্বিশন মিশিয়ে হতাশা ও প্রতিশ্রুতি ছড়িয়ে , রুমার নাম্বার ডায়াল করি । দু বার ,পাঁচবার ছাড়িয়ে যখন একুশবারে পৌঁছালো রিংটোন , মহারানী ফোন তুললেন । ক্লান্ত গলায় শুনলাম , 'কিরে , কি বলছিস ? '

গা-পিত্তি উদোর ঘাড়ে চাপিয়ে , ঝাঁকুনি ব্রেক মেরে , নর্মাল স্বরে বললাম , 'এমনি , কোথায় ?'

'মধুমিতা দির সাথে , চলে আয় ' ।

কাল তোর ফুটবল ম্যাচ ছিল । হিসেব কষে দেখেছি , প্রেমালাপের চেয়ে বিরহটাই বেশি জীবন্ত তোর কাছে । তোর হাত থেকে দু চারটে কবিতা , মুক্তগদ্য কিম্বা ছোটগল্পের পোস্টমর্ডান রূপের জন্যই এই সম্পর্কে ঝগড়াটাই একান্ত প্রয়োজনীয় । সেরকমই , ফুটবলের ম্যাচের সাথে পার্কের হাওয়া খাওয়ার কোন তুলনা না থাকলেও , রুমার সাথে কাল বিকেলে দেবদারু পাতা তুলেছি , গোপনে গোলাপ ছিড়েছি সর্বোপরি সুইচড অফ করেছি ফোনের । আর শুনেছি , রুমার নাকি মধুমিতাদিকে ডালিং বলতে ভালো লাগে ।

মধুমিতাদি ঘর পৌঁছে দেখি , পূজা ড্রেসেস থেকে কেনা মধু- টপ রুমার গায় । মধুমিতাদির গায় ঢোলাঢোলা নাইটি ।রুমার চোখে মুখে তৃপ্তির ঝলকানি আর এক গোপন ইশারার লুপ্ত ফসিল । নিউটনের র্থাড ল কিম্বা ল অফ সেগ্রেজশান জানা স্টুন্ডেট সূত্র মেলাতে না পারলেও , ইচ্ছে হয় , তোকে ছেড়ে মধুমিতাদিকেই বিয়ে করি ।

কবিতা - বিলাল হোসেন

ঝুলে যাওয়ার গল্প ...
বিলাল হোসেন



বৈদগ্ধের চামড়া ঝোলার গল্প সবখানে হাত পা ছড়ালে
আত্মসাৎ করে নেয় সত্যমিথ্যার সবটুকু— প্রপঞ্চ সময়
পা পিছলে পড়ে যাবার আগে আগে
শুষে নেয় বিদ্যারস মৃত্যুখাদের দেয়াল
অর্থ-টানে শুকিয়ে চ্চর চ্চর তার জংধরা সকাল,
শুষ্ক বিলম্বিত দুপুর,
নির্ঘুম রাতের পাশ ফেরা বাতাসের
কষ্টকষ্ট ধড়ফড়ানি

বুদ্ধির গোঁড়ায় বেড়াকাটে পোষা ইঁদুর

মণনের তুলা ভরা
কোলবালিশের ফুটো বেয়ে গড়ায় সুষমা
বলিরেখা নর্দমায়

কীটের দেহে ঝলকায় কিংবদন্তীর আলো

আর দ্যাখো—
এই আলোতে নিভে গেল জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা –
জ্ঞান-সূর্য যার নাম

—এইভাবে চামড়া ঝোলার গল্পের ঝুলি ভরতেই থাকে
সময়ের , বৈদগ্ধের

কবিতা - শুভেন্দু দেবনাথ

দিন যাপন
শুভেন্দু দেবনাথ


যাপনের দিন ফুরোলে শাটার নামিয়ে অসুখ নামে
বুদবুদ শ্বাসে অভ্যস্ত মাউথ অর্গান জুড়ে কোলাজ দৃশ্যাবলি,
জড়ানো বালিশের স্বপ্নে উত্তাপ ছড়িয়ে
ভুলিয়ে দেয় ঘোরগ্রস্ত উত্তেজনার কথা
নিহত রোদের ছায়ায় তোমার সদ্যোজাত ঘুমে
বিস্মৃতির ছুরিতে লেগে থাকে কিছু আদরের দাগ
কেউ কেউ পুড়ে যাচ্ছে বলে কেউ কেউ আলো পাচ্ছে
চুমুর শব্দে আজকাল আগুন জ্বলে না বলে
ভেতরে ভেতরে টের পাই অন্তহীন চিতার দহন
দু’টাকার সিল্ককাটে ঠোঁটের প্রতিবিম্বে
অন্ধকারের গায়ে লেগে থাকে কিছু প্রলাপের জলছাপ
ঝুলে পড়া স্তন থেকে ঈষৎ বিরহ নেমে এলে
নিজের দিকেই টিপে দিতে পারো নিঃসঙ্গতার পিস্তল।।
মাঝরাতে আমাদের স্মৃতি ফিরে গেলে অন্ধকারে
টলোমলো করে উঠবে আমাদের জীবন।।



কবিতা - পিনাকী সেন

শরসন্ধান
পিনাকী সেন


এবার কি দেখছ অর্জুন
চোখ শুধুই চোখ
চোখেরও গভীরে আরও কত কি
পড়ে শোনাই তবে
খবরদার
ও চোখের অতলে যেও না আর
ফেরার পথ পাবে না যে
তার চেয়ে বরং দৃষ্টি বিস্তার কর আরও
অগভীর হও
পাখির চোখ ঠিক রেখে লক্ষ্য স্থির কর
তোমাকে নোতুন এক কৌশল শেখাই

কি দেখছ অর্জুন
অনন্য চাঁদপানা মুখ
টিকালো নাক পুরুষ্টু লোভনীয় ঠোঁট
তবে কি চুম্বন করি
অত সহজেই আটকা পরবে
অগভীর হও আরও

অনবদ্য নিরাবরণ নিখুঁত নিটোল মানসী
তবে কি আলিঙ্গন করি
চূড়ান্ত লক্ষ্য এখনই বিস্মৃত হবে

প্রথম ভোরের রোদে শৃঙ্গার
মেঘলা চুল আকাশী আঁচলে মিশেল
হাজারো হলুদে সবুজে কাঁচুলি থেকে মেখলা
এবার তবে উন্মুক্ত করি
ও বস্ত্রের প্রান্ত খুঁজেই পাবে না তুমি
আরও আরও অগভীর হও

সদ্যস্নাতা যুবতি তার সদাব্যস্ত চিদাকাশ
ঘন রঙিন দুর্গম মন উচ্ছল খালবিল নিয়ে একাকার
রঙ শুধুই রঙের খেলা
ক্রমশ সাদা কালো আর আকার
নানান আকৃতি মিলেমিশে রেখা
পারস্পরিক কাটাকুটিতে বিন্দু
শুধুই বিন্দু বৃত্তবৎ শূন্য চারিদিকে
এবার
এবার শরসন্ধান কর পার্থ
সেই খানে



কবিতা - তন্ময় ভট্টাচার্য

ইনফ্যাচুয়েশান
তন্ময় ভট্টাচার্য



ছাদ থেকে ধাপে ধাপে নীচে নেমে এলো যে বিড়াল
গায়ে আবিরের ছোপ, একচোখ ধূসর সবুজ
কপালের মাঝখানে ও গলায় আঁচড়ের দাগ
হলদেটে লোম পুড়ে নির্বিষ হয়েছে তখনই
যখন ছাদের থেকে ধাপে ধাপে নীচে নেমে এলো

আধিভৌতিক বা কাব্যিক কোনো রূপ নেই
নিছক সন্ধেবেলা, এই সাড়ে সাতটা নাগাদ
মা তখন গোগ্রাসে সিরিয়াল গিলে চলেছেন
বাবার সামনে ডাঁই বাজারের ফর্দাবলী
আমি শেলী ঘেঁটেঘুটে ড্যানি ব্রাউনকেই খুঁজছি
এমন সময় ধাপে ধাপে নেমে এলো সে বিড়াল

নতুন বৌঠানের পায়ে ফোটা কাঁচের রাণু
ডেসডিমোনার নিষ্পাপ চোখ,ঘুমন্ত দেহ
চন্দ্রমুখীর নাচ, ঘোমটা জড়ানো বিনোদিনী
ফজিলতুন্নেসার মুখ ভেবে বিরহ-গাঁথা
সব হারানোর পরে উদাসীন সর্বজয়ার
অভিযোগহীন রাত,তসলিমা নাসরিন,নীরা...
আমার শক্ত কোলে মাথা রেখে সবাই শুলো

বিড়ালটা জানলার ফাঁক দিয়ে চেয়ে থেকে থেকে
আরো নীচে নেমে গেলো...হয়তো বা কাঁটার খোঁজেই

কবিতা - নীলাঞ্জন সাহা

কুপ্রস্তাব
নীলাঞ্জন সাহা


ঘরে আলো জ্বলছে জ্বলুক , জানলা বন্ধ থাক
ব্লুটুথ দূরত্ব থেকে আরও
আরও এগিয়ে যাব আমি
টাচস্ক্রিন বৃন্ত তোমার খরগোশের কানের মতো
সজাগ হোক
আর তুমি বাঁশির মুখে ফুঁ
আমার অঙ্গুলি হেলনে
সুর হ'য়ে যাও !

কবিতা - দেবদারু

আল্ট্রাভায়োলেট সিরিজ
দেবদারু



লালবাড়ি

দেখলাম ,পলাশী কিংবা তারও আগে থেকে মিলেনিয়াম পার্ক খুব বেশি দূর না
বীজের অঙ্কুরন লালবাড়ির টেবিলে দফন হলে শোক-মাত্রা হারা নতুন দিনের ভরসা গুলো
ট্রামলাইনে স্মৃতি হয়ে যায়। আমি দেখেছি আর নির্জলা ময়দান কে সাক্ষী রেখে
নীরবে চিৎকার করে বলেছি - আই অবজেক্ট
ইউর ওনার , আই অবজেক্ট ,
আই অবজেক্ট, কিন্তু.....।.

বইটা বলেছিল দুটো গোলার্ধ আলাদা, আমি তখন কিশলয়
তারপর সাবধান বিশ্রাম , এ প্লাস বি এর হোল স্কয়ারে খেলতে খেলতেই
দর্পণে দেখি ই ইকুয়েল্টু এম সি স্কয়ার আর ঠিক তখনই
বিডন স্ট্রিটের ভ্রাম্যপথ আমাকে নিচে রেখে বুঝিয়ে দিয়ে গেল
ভাল্লুকের কোনও দেশ হয় না, কোনও জাত হয় না, সে
এক স্বতন্ত্র শ্রেণী
সে শাসক, আমি চিৎকার করলাম -আই অবজেক্ট
ইউর ওনার , আই অবজেক্ট ,
আই অবজেক্ট, কিন্তু.....।.

তরঙ্গময় দৃষ্টি ঝাপসা করে বি বা দি’র উচ্চারণ শুভ সকালের অভিবাদন না পেয়ে
নতজানু পুনর্বার, আমি ধর্মতলার ইলেক্ট্রনিক্স রেস্তরায় দেখি
ভারি বুটের শব্দ ,রক্তিম রুলের কঙ্কাল আর ভীতিগ্রস্ত লক্ষ চোখ ছত্রভঙ্গ হয়ে
ছড়িয়ে পড়ছে হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর,অশ্রুসিক্ত তারায় ফুটে উঠছে
দিন দুপুরে- ‘ক্ষমতার অপব্যবহার না করলে মানায় না ক্ষমতাবান’ ।
আমি চিৎকার করছি -আই অবজেক্ট
ইউর ওনার, আই অবজেক্ট ,
আই অবজেক্ট, কিন্তু.....।.

কিন্তু কেউ শোনেনি, ওই স্বয়ং কৃষ্ণও না ,যে এখনও মাইক্রোফোন পেলেই
চরম নাটকীয়তায় বলে ওঠে - পরিবর্তনই নিয়ম ।



কবিতা - ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী

ওষুধ
ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী



অবিন্যস্ত টেবিল
চুলের ভারে সরে যাওয়া খাট,
শব্দহীন বব মারলি।
বোধহয় ,'' Don't worry be happy "
বলা হয়েছে এক গুর্নিয়মান পাখা কে, যে
পৃথিবীকে সঙ্গে পায়নি আজ।
তবু একাই স্থবিরতা কাটাচ্ছে
কাঁচের গায়ে লেগে থাকা জীবনকে সাক্ষী রেখে ।




কবিতা - সায়ক চক্রবর্তী

নীল হয়ে যাই
সায়ক চক্রবর্তী



মন ভরা আছে মন দিয়ে, শূন্যতা আকাশেই আছে
তবুও কেমন যেন লাগে, কারণ খুঁজতে গিয়ে
বিলাসিতা করো – দেখি আর নীল হয়ে যাই।

তুড়ি মারা দূরত্ব তবু অবকাশে পথ টান যেন!
কখনও দূরত্ব ভুলে ওপারে তাকাও,
দেখো, ধসে যায় প্রাণ ; কাঁচা সময়ের বুকে,
জেগেও ঘুমিয়ে আছো পোকেমন কোলে –
দেখি আজ নীল হয়ে যাই।

ঝড় আসে একদিন, দুইদিন... তারপর কোনদিন
তোমার কলিং বেল টিপে দিলে ডেকে নিও তাকে।
জানি তুমি প্রিয়তম, আরও প্রিয় হতে গেলে
দূরে গিয়ে বুকে তুলে নাও আবর্জনার স্তুপ,
একটু একটু করে কারণ বোঝো – জানি সরে যাবে,
শুধু এইটুকু আশা ; কাউকে তো ভালবাসবে!
তুমিও ভাববে জানি আড়মোড়া ভেঙ্গে – বুঝবে
কেমন করে গোলাপের পোকা দেখে নীল হয়ে যাই।

কবিতা - শর্মিষ্ঠা ঘোষ

সিদ্ধান্ত : এক
শর্মিষ্ঠা ঘোষ


কিছুকাল স্বেচ্ছাবন্দীত্বে কাটাবো , হে আমি
শামুক জন্ম অভিলাষী আদ্যন্ত প্যারট
তাতে কারও কচুপোড়া জেনেশুনে
ঢুকেরব উদ্বায়ী বেনোজলে আধাআধি

অবাক স্বমেহন নির্বাহী আত্মরতি ভারবাহী , যে আমি
নাবুঝ খচ্চর স্বর্গাদপি গরিয়সী
আয়নাসকল তোমাদের ক্ষুরে
আমেন , প্রণাম , মারহাব্বা প্রণয়

রজ তম নানাবিধ গুণনিধি অসংস্কৃত , এই আমি
কল্পবৃক্ষ কামধেনু হতে চেয়ে ঢ্যারা
গত্যন্তরে ফুরিয়ে যাওয়া তুমি তুমি বাতিকে
জনান্তিকে আপাতত কফিন বানাবো


কবিতা - তুষ্টি ভট্টাচার্য

দধীচির হাড়
তুষ্টি ভট্টাচার্য



দধীচি দেখে নি হাড়ের নাচ
খুলিতে করেনি সে বিষপান
দধীচি মরেছে হাড়ের গুঁতোয়
জানে নি কখনও হাড়ের নাম

টিবিয়া ফিবুলা ফিমার - ব্যাস
আগেভাগে ছোটে , দেখেনি ও
দধীচির ছিল চোখের রোগ

হাড়ে হাড়ে ঘষে আগুন লাগে
জেনেছে কে –
কোন মহাজন



ভেজা জামাকাপড়


ছাদের দড়িতে মেলা ভেজা জামাকাপড়ের সাথে
লুকোচুরি খেলছে রোদ আর মেঘবৃষ্টি

রোদ একা একাই ঘুরছে ফিরছে
মেঘবৃষ্টির জুটি এসময়ে প্রায়ই হারিয়ে দিচ্ছে ওকে

ভেজা জামাকাপড় ক্লিপে আঁটা পড়ে আছে
শুখনো হওয়ার অপেক্ষায়

মেঘ সাথী আছে , তবু বৃষ্টির কি অসুখ ? এত কাঁদছে !

রোদ লুকিয়ে পড়ছে ক্রমশ এক গলা জলে
ভেজা জামাকাপড় আরও চুপচুপে 
 
 

কবিতা - পার্থ প্রতিম রায়

প্রবণতা আমাদের চিন্তা ঢেলে দেয়
পার্থ প্রতিম রায়



ঘরোয়া আশ্রয়ে একাগুলো ভায়োলিন হচ্ছে
প্রজাপতি জাপটানো পাশ ফেরা নিয়নের আলোতে
অনুভূতির 'টিপসই'... মেঘেদের মন খারাপ স্বরূপ
তুমি বৃষ্টি হয়ে চুইয়ে পড়ছো ইচ্ছে রঙের পাশটুকুতে...
উপলব্ধি গড়িয়ে পড়ে স্তব্ধতায়
অন্ধকারের দিকে আরো একটু ছায়ার স্বচ্ছতা হারাচ্ছে দেয়াল
আলোর স্পেশটুকু জ্যোৎস্নার ঠাট্টা
গল্পে ওপচানো শুয়ে থাকি
বেঞ্চের ধুলো মাখা অহংকারে
স্পন্দন সংক্রান্তে রোদের আব্বুলিশ...


মনযান

দোলা খাওয়া হাওয়ার খিলানে
নিভে গেছে জোনাকির রং,
লুকানোর ছলে জড়িয়ে নিচ্ছি
সামঝোতার দুহাত...
সিঁড়ি টপকে থমকে যাওয়া
ঘোরগুলো সামিল একাকি!
যতটুকু তলানি হচ্ছে আমার বিম্ব
ততটুকু জোকার হচ্ছি আমি।
#
জীবনের প্রকৃত সংলাপে
খুঁটে খায় নষ্টাল নমনীয়তা
ঠেস দেওয়া আলোর আঁচলে
চাঁদের অবিকলটুকু সব....
শৈশব আমার স্বপ্ন কাউন্টারে
এরপর জানলায় বোবা গল্পগুলো
এসে দাঁড়ালে হরিয়াল হয়ে যায়
চোখের ঘনগুলো...


কবিতা - সূরজ দাশ

কামনা কাঠের ঘুণ
সূরজ দাশ


নদীতে গোসল সেরে
মেহগনি কাঠের পালঙ্ক বলেছিল
ছায়াব্রিজে এসো

হাওয়ার ওড়না মেলে
ঠোঁটে ঠোঁট কামরাঙা
জমানো শীতের ঝাঁপি খুলে
এসো বজ্রভর্তি কামনা অসুখ
সাঁকোর কিনারে মেলে ধরো ইন্দ্রজাল

এ যাবৎ যত স্বপ্ন ইশারায় ফুটেছিল
প্রেম এসেছিল ডুবোজাহাজের ঢেউ চেটে চেটে
সন্ন্যাসীর কমণ্ডলু নিংড়ানো ধুলো–ঝড়–মাটি
মস্তকে ধারণ করেছিল নিশা কতবার

আলুভাতে পোড়া-বেগুন
চোখের শিশিরে কে কার
বৈঠা হাতে পার হয় রাত্রি
পাঁজরে কার রশি বাঁধা
মেঘালয়ে নিশিযাপন
রাস্তা পেরিয়ে কেউ এলো না কেন
কি বিষণ্ণ, কি বিষাদ কামনা কাঠের ঘুণ
কূট কূট সারারাত্রি তলদেশে নাচায় আগুন


বেদনা রঙের মেয়েটি

গোপন ক্যামেরা থেকে একটার পর একটা ছবি বেরোচ্ছে
স্বল্পবাস অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি
যৌনবিছানার উচ্ছ্বাস আর
আন্তরিক আস্থার হাসি
ভিনরাজ্যের ছবি, ভালো থাকার মজবুতি বুনিয়াদ
আরও কত নাগরিক... ব্রতকথা...

আকাশের নিচে বেদনা রঙের মেয়েটি যার গত অঘ্রাণে বিয়ের কথা ছিল
সে এখন ঝাঁট দিচ্ছে তারাতলায়, সকাল-দুপুর

ধানকাটা ফাঁকা মাঠ আবার হাঁটছে
এগোচ্ছে জলঘর, মাঝিয়ান হাট
স্বপ্নদেখা গোল গোল চোখ
ভরপুর শ্বাসকষ্টে ডুবে যেতে যেতে
বিকেলের মনখারাপ আঁকছে খবরের পাতায়

অনুবাদ কবিতা – কৌশিক ভাদুড়ী

অনুবাদ কবিতা
কৌশিক ভাদুড়ী


(ওড়িয়া ভাষার কবি শ্রী রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডার দ্রোহ বাক্য গ্রন্থ থেকে)
বোমা ফুটুক বা কুঁড়ি ফুটুক

ফেরার বেলা এসে গেছে।
ক্ষীণতম সম্ভাবনার কাছে
ইতিহাসের মার্তণ্ডও ঝাপসা দেখাচ্ছে।

দূর দেবদারু শিখরে কখন দ্রুত অপসৃত হয়েছে
বৈকালিক কিরণের হেমছটা-
অন্তিম অভিমানের দ্যুতি।

নীল আঁধার মাঝে নিঃশব্দে
অস্পষ্ট ভাবে স্বচ্ছ
নগ্ন কায়াভাসটি ফিরে এসেছে
একেলা একাকী।

যে যেখানে যেমন আছ শুনে রাখ সকলে :
দেনা আছে অনেক, পাওনা নেই কিছুই,
কোন দাবী কোন অভিযোগ নেই আমার
কা’র প্রতি।
কীই বা আছে সাক্ষ্য দিয়ে প্রমাণিত করার,
নিক্কণ শ্রুত হতে না হতে
পিছন পানে কেন চা’ব?
বালি জল মাটি পবন মন বিবেকের সর্বাঙ্গে
রুমঝুম নূপুরের মতন
নিজে নিজে আমি বাজছি।

কত শীঘ্র শেষ হয়ে গেল রাত।

স্পষ্টতর হচ্ছে বাত পিত্ত শ্লেষ্মার শরীর,
ধীরে ধীরে রক্তে বেড়ে উঠছে
আরোহীহীন বিপুল অশ্ববাহিনীর
সম্মিলিত হ্রেষা আর খুরধ্বনি
পুচ্ছছটা গতি।

প্রতিনিয়ত দাও, দিক দাও অসংখ্য
দাও ইচ্ছা-আরোহণ, এবার আমাকে দাও-
অপ্রমিত সংযমন শক্তি।

কোটি কোটি বিগত শতাব্দীর
সকল ঘটনা থেকে গরীয়ান-
যা কিছু ঘটতে যাচ্ছে
পর মুহূর্তে,
সেই অনিশ্চিত বিস্ময় লাগি আমি উৎকন্ঠিত,
যা কিছু ‘আসন্ন’, সেখানে আমি ‘বর্তমান’।
বোমা ফুটুক বা কুঁড়ি ফুটুক
তার সাথে ফুটতে প্রস্তুত আমি
নিঃসর্ত ভাবে।



নায়ক

আমি মঞ্চে যাই না , মঞ্চের নেপথ্যে থাকি না ,
দ্রষ্টা হতে চাই না, ভোক্তা হতে চাই না;
অথচ যোখানে দাঁড়াই,
যত নিভৃত হোক না কেন,
যবনিকা উন্মোচিত হয়ে যায় সমুখে,
স্পটলাইট্ কেন্দ্রিত হয় মুখের উপরে,
একুশ তোপশব্দ ও দুন্দুভি শোনা যায় শূন্যতে,
ব্যতিক্রান্ত হয়ে যায় নির্ধারিত প্রোটোকল,
লোহিত গালিচা আপনি বিছিয়ে যায়
পায়ে পায়ে হাঁটলে।
আমাকেই কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে অহরহ কিংবদন্তি,
ঘিরে আসে গুজবের ঘন কুয়াশা,
নায়কত্ব থেকে মুক্তি নেই আমার।
বাতুল হয়ে ঐতিহাসিক আমাকে নিতে চায় পুরাণে,
কে জানে কিভাবে আমি ফিরে আসি।
কুশলী মিত্র আমাকে নিতে চায় মনোহর বধ্যভূমিতে,
কে জানে কিভাবে আমি ফিরতে পারি!
পদ্মিনী আমাকে নিতে চায় মৃণালের আদিম উত্সে
চিত্রিণী নিতে চায় ভূকম্পিত চন্দ্রশালাপুরে
শংখিনী তা'র তৃষ্ণা-সমুদ্রে
হস্তিনী তা'র সুবিপুল মারক আশ্লেশে।
অক্রূর আমাকে নিতে চায় মথুরায়,
অর্জুন করুক্ষেত্রে,
দ্বারকা থেকে শাম্ব আমাকে কোলে নিতে চায়
এরকা বনে।
আমি কোথাও যেতে চাই না।
বংশী বাজাই না বা বজ্র পুষি না আমি,
নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান হলে
আরম্ভ হয়ে যায় খেলা।
কী শ্রীরাধা কী রুক্মিণী
ঠিকঠাক চিনতে পারি না সর্বদা,
আমি কোনোখানে ধরা দিই না...
নায়কত্ব থেকে মুক্তি নেই আমার।
আমি প্রকারান্তরে লঘুচাপের মতন দাঁড়িয়ে থাকি
যেখানে পাগল মৌসুমীর মতন
চারপাশ থেকে দৌড়ে এসে জড়ো হয় ঘটনা।
আমি অমর না হতে পারি,
আমার আয়ু কিন্তু ইতিহাস অপেক্ষা দীর্ঘতর।


বীজবিক্ষেপ

প্রতিটি আজ আগামীকাল
প্রতিটি তিথি অক্ষয়তৃতীয়া
মুঠোর পর মুঠো বুনে যা খেতে খেতিতে।

যে বীজের ডানা আছে
তাকে উড়িয়ে দে পবনে
যে সাঁতার জানে তাকে ভাসিয়ে দে জলে ...
আর যে ফুঁড়তে জানে
গুঁজে দে পর্বত প্রমাণ পাথরের ভেতর।
কাঠবিড়ালির পায়ে পাঠিয়ে দে প্রতিবেশী বাগানে
শস্যাহারী পাখির বিষ্ঠায় পাঠিয়ে দে
সাতশ পঞ্চাশ ক্রোশ সুদূর বিন্দুর
মহিম্ন গর্ভাধানকে!

যত্র তাকাস তত্র
অসহ্য আতুরতায় ফেটে পড়ে ফল, বীজাধার;
দ্যাখ-
ফেটে পড়ে চারা, গুল্ম, লতা, কুঞ্জ, দারু
ফেটে পড়ে কানন কেদার।

আড়ি কুনকে মুঠো
সব আজ ভরপুর...
বুনে যা।

বুনে যা
চরু গলাধ:কারী যুবতীর ভিজে লন-ঘাসে ...
বন্দীশালার অন্ধকারে ...
বাড়ির পেছনের বাগানে ... নকশী বাগানে ...
পাঁচ কান পঞ্চায়ত প্রকৃতিতে সুড়সুড়ি
প্রত্যেক বিষ্ণুনাভিতে।
মুঠো কে মুঠো বুণে যা শূন্যতে, মাটিতে।
কে জানে লুকিয়ে রয়েছে কল্পাংকুর
কোন্‌ গর্ভাধানের লাল অভ্যন্তরে!
কে জানে এবার অষ্টমে না পরার্ধতমে!

কী হবে গোলা, মাড়াই উঠোন
দুই পা তোর সর্বদা খেতে।
সকল ভবিষ্যত কাল তোর দিয়ে দে
এক মুঠো চালের মতন
কোনো এক চকুলিআ পাণ্ডার থালায়।
বীজ তৈরির দায় নেই তোর-
অধিকার কেবল বোনায় !

বোন বৃষ্টি বোন রক্ত বোন অশ্রু বোন কালিমা
বোন পরাগ বোন উপল বোন অঙ্গার
বোন কাঁচ বোন পারদ বোন মাংস বোন শূন্য...
মুঠো খালি হয়ে গেলেও সেঁটে থাক
বপন ভঙ্গিমায়।

প্রতি বর্গইঞ্চি মাটি আজ দোফসলা
প্রতি বর্গইঞ্চি নারী আজ গম্যা, গর্ভযোগ্যা ...
ধরিত্রী আজ কুক্ষিগতা ...
উড়ে যা ভেসে যা ঢুকে যা উঠে আয় বিক্ষিপ্ত হয়ে যা
ওরে বন্য ব্যাকুল বীজস্তূপ!
বোনা হয়ে যা বোনা হতে থাক সর্বদা
চরাচরে।

দ্রষ্টব্য - চকুলিআ উরিষ্যার এক শ্রেণির মানুষ এনারা মাধুকরী করেন। এনাদের এক হাতে বাঁশের আগায় বসান তালপাতার তৈরি ছাতা থাকে, অন্য হাতে ভিক্ষার থালা।

অনুবাদ কবিতা – ইন্দ্রাণী সরকার

অনুবাদ কবিতা
ইন্দ্রাণী সরকার



Invocation
P. B. Shelley

Rarely, rarely, comest thou,
Spirit of Delight!
Wherefore hast thou left me now
Many a day and night?
Many a weary night and day
'Tis since thou art fled away.How shall ever one like me
Win thee back again?
With the joyous and the free
Thou wilt scoff at pain.
Spirit false! thou hast forgot
All but those who need thee not.As a lizard with the shade
Of a trembling leaf,
Thou with sorrow art dismayed;
Even the sighs of grief
Reproach thee, that thou art not near,
And reproach thou wilt not hear.Let me set my mournful ditty
To a merry measure;
Thou wilt never come for pity,
Thou wilt come for pleasure; -Pity then will cut away
Those cruel wings, and thou wilt stay.I love all that thou lovest,
Spirit of Delight!
The fresh Earth in new leaves dressed,
And the starry night;
Autumn evening, and the morn
When the golden mists are born.I love snow and all the forms
Of the radiant frost;
I love waves, and winds, and storms,
Everything almost
Which is Nature's, and may be
Untainted by man's misery.I love tranquil solitude,
And such society
As is quiet, wise, and good: -Between thee and me
What diff'rence? but thou dost possess
The things I seek, not love them less.I love Love -though he has wings,
And like light can flee,
But above all other things,
Spirit, I love thee -Thou art love and life! O come!
Make once more my heart thy home!


আহ্বান
পি. বী. শেলী
(অনুবাদ - ইন্দ্রাণী সরকার)


ওগো আমার সুন্দর তুমি বড় কম আসো !
কত দিন কত রাত তুমি আমায়
একা ফেলে চলে যাও |
তুমি চলে যাবার পর আমার
দিন আর রাতগুলো শুধু কষ্টেই কাটে |
কেমন করে আমি তোমায়
আবার ফিরে পাবো ?
তুমি কেমন করে সব কষ্ট
ঝেড়ে ফেলে দাও |
মিথ্যে তুমি ! যারা তোমায় চায় না
তুমি শুধু তাদেরই মনে রাখো |
যেমন করে একটি সরীসৃপ কাঁপা কাঁপা
পাতার ছায়ার রূপ ধরে,
তুমি তেমনি সব কিছুতে মিলেমিশে
সব দুঃখ ঝেড়ে ফেলে দাও |
একটু দুঃখের নিঃশ্বাসও তোমায়
স্পর্শ করে না বা তুমি শোনোও না |
আমার হতাশার গানটা আবার আনন্দে বেঁধে নি,
যাতে তুমি আবার ফিরে আসো |
তুমি যা যা ভালোবাসো আমিও ত্' তাই ভালোবাসি |
সুন্দর সবুজ পৃথিবী, তারাখচিত আকাশ,
শরতের বিকেল আর সোনালী কুয়াশায় ভরা সকাল |
আমি তুষার ভালোবাসি আর তার হিরন্ময় দ্যুতি |
আমি ঢেউ, বাতাস, ঝড় সমস্ত প্রাকৃতিক

সৌন্দর্য্য খুব ভালোবাসি |
আমি শান্ত একাকীত্ব ভালোবাসি,
আর তার সাথে জড়িত নীরবতা, জ্ঞান; সব !
তোমার আমার মাঝে তবে কি তফাৎ ?
আমি যা খুঁজি তা তোমাতেই পাই |
আমি ভালোবাসাকে ভালোবাসি --
যদিও তার ডানা আছে আর আলোর বেগে উড়ে যায়,
কিন্তু সবার চেয়ে ওগো সুন্দর আমি তোমায় ভালোবাসি ----
তুমি আমার ভালোবাসা ও আমার জীবন !
ফিরে এস আরও একবার তুমি আমার হৃদয়ে স্থান নাও ||

প্রবন্ধ - অমলেন্দু চন্দ

বিবর্তনের ইতিকথা - বাংলা রেনেসাঁস
অমলেন্দু চন্দ


যে কোন অগ্রগতির ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মধ্যে এটা দেখতে পাওয়া যায় যে প্রধান চরিত্রেরা সাধারণত বিচ্ছিন্ন ব্যাক্তিত্ত্ব। আভ্যন্তরীণ বা বাইরের কোন কনভালসন থেকে তারা এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন প্রশ্ন নিয়ে আসেন – যেমন ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক লেখাগুলো ফরাসিদের ইতালি অভিযানের কনভালসন প্রসূত, ১৭৮৯ এর বিপ্লব ও পরবর্তীকালে নেপলিয়ানের যুদ্ধোন্মাদ এর প্রসুতাগারে হেগেলিয় ইতিহাসের দর্শনের জন্ম। ১৮৭১ এর ফ্রাঙ্কো-প্রুসিয়ান যুদ্ধ আর তার পর বিসমার্ক এর হহেনজেলার্ন এম্পায়ার এর স্বপ্ন ও স্থাপনা যে ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে পরবর্তী জার্মান সাম্রাজ্যবাদ এর জন্ম নীটশের এম্পায়ারিক্যাল হিস্টোরিসিস্ম এর জন্মও সেই সময়ের কনভালসনের নিরিখে, এক দর্শন যা আজকের দিনের ইতিহাসবাদের অগ্রদূত, যার গভীর ও গম্ভীর অভিপ্রায় পরবর্তী জার্মান দর্শন আর ধর্মতত্ত্বের মধ্যে ছায়া ফেলেছে। নতুন চিন্তা চেতনার মাটি তখন তৈরি হয় যখন মনন ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসকে অতিক্রমণের পর্যায়ে চলে যায়। ক্রমবিকাশের ইতিহাস তাই চলিত ইতিহাসের থেকে আলাদা হয়ে যায়। সেই ইতিহাস তখন একটা নিঃসংশয় বর্তমান। এই অনুভব একটা সমাহিত জ্ঞান যার ধারক এক সিংহাসনচ্যুত সম্রাটের মতই সেই কনভালসনে পুড়ে যাওয়া প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে ছাই দিয়ে নতুন অবয়েব নির্মাণ করে। সেখানে থাকে আনন্দ, থাকে যন্ত্রণা, থাকে বিস্ময় আর থাকে সম্পৃক্ত এক নতুন নির্মাণ যা এক নতুন চেতনার অভিধানের পাতা খুলে ধরে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপিয়ান কালচারের জন্য এক বিষম সংকট তৈরি করেছিল। এই যুদ্ধ তাদের চিন্তা চেতনার ভিত্তিভূমি এবং দৃষ্টিভঙ্গি কে বদলাতে বাধ্য করে এবং সেই পরিধির বিস্তারের সঙ্গে বোধহয় একমাত্র সাযুজ্য উপমা পারমানবিক পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চিন্তার পরিধির বিস্তার। এই বিস্তার সেই চিন্তা চেতনাকে ঋদ্ধ করার মাটি যুগিয়েছে।

প্রতিটি কালচারের মধ্যে এমন কিছু মানুষ থাকেন যারা তাদের আকর্ষণ বা তাদের অস্তিত্বের উপস্থিতির বিকিরনক্ষমতার সুবাদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দের তাদের সংসর্গে নিয়ে আসেন যেখানে তাদের ভূমিকা এক পথ নির্দেশকের। এম্পায়ারিক্যাল হিস্টোরিসিস্ম এটা মনে করে যে কোন ক্রাইসিসের ধ্বংসাত্মক চেহারা বা যে কোন কনভালসনের পেছনে প্রকৃতির দিক থেকে একটা ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার কার্য কারন কাজ করে। তাহলে কি এটা ধরে নিতে হবে যে কনভালসন টা না থাকলে নতুনের সৃষ্টি হবে না! সম্ভবত। তাহলে এটাও করোল্যারি হিসেবে ধরা যেতে পারে কি যে চিন্তা চেতনার নবীকরণের এই পদ্ধতিটাও একটা ন্যাচারাল সিলেক্সানের অঙ্গ? অন্তত বদলের ধারার খোঁজ তো সেই দিকেই ইঙ্গিত করে।
একটা পর্যায়ে চিন্তা চেতনার স্তরে বৌদ্ধিক কনভালসনের ঐতিহাসিক নাম রেনেসাঁস। ইউরোপিয়ান রেনেসাঁস মধ্যযুগীয় ফিউড্যাল পৃষ্ঠপোষকতা নির্ভর চিন্তা চেতনার থেকে লোকায়ত হতে আরম্ভ করে দিল নাকি ফেরত যেতে শুরু করল, বেগবান হল কারন বহু ভাষিক সেই সব কবি সাহিত্যিক শিল্পী চিন্তাবিদেরা ভিন্ন ভিন্ন ভাষার বহু দিনের কালচারের ঝুলির থেকে বার করে আনতে লাগলেন সব অমূল্য রত্ন। অবশ্যই এই রেনেসাঁসের পেছনে রয়েছে সেই সময়ের ইতিহাস যখন কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর এবং ডার্ক এজ এর সমাপতনে ইতালির দিকে পালিয়ে এলেন অনেক গ্রীক এবং নন গ্রীক ইন্টেলেকচুয়াল, বাইজেন্তিয়ান সভ্যতার কেন্দ্রে যারা এতকাল বসবাস করেছেন। ততদিনে রোমের পাপ্যালসি সচেষ্ট হয়েছে ইউরোপের মাটিতে একটা আধ্যাত্মিক এবং বস্তুতান্ত্রিক জীবন সংগঠনের, অবশ্যই চার্চের হেজিমনিস্টিক উদ্দেশ্য নিয়ে। এদিকে পুরনো সামন্ত্রতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে একটা স্থিতিশীল ইউনিফাইং কাঠামো গড়ে উঠছে, জাতীয় মনারকির গুরুত্ব বৃদ্ধি হচ্ছে, জাতীয় ভাষার উন্নয়ন চলছে। ফ্রান্স জার্মানি স্পেন পর্তুগাল ইংল্যান্ড হয়ে উঠল সেই ব্যাবহারিক বিকাশের রাজনৈতিক লীলাক্ষেত্র। রেনেসাঁস স্কলার ক্লারিক দের হাত থেকে ছিনিয়ে নিল বৌদ্ধিক চেতনার বিস্তারের স্পিরিট, নাম হল তার হিউম্যানিস্ম।

মধ্যযুগীয় রিলিজিয়াস ধ্যান ধারনা মোক্ষলাভের পদ্ধতিগত ধার্মিক বিশ্লেষণ পেন্যান্সের গ্লোরিফিকেসানের স্থলাভিষিক্ত হল সৃষ্টির জন্য সংগ্রাম এবং প্রকৃতির ওপরে বিজয়েচ্ছায় মানুষী প্রয়াস। মানুষের সম্ভ্রমবোধ তার নিজের প্রতি, সে আবার ফিরে পেতে চাইল প্রাচ্য প্রতীচ্যের সেই লিগ্যাসি – সেই পুরাতন স্পিরিট আর উইসডম। সাথে যোগ হল মানুষী চেষ্টার জয়গান, তাই কলম্বাসেরা ছুটল দিকে দিকে – ভাঙো ভৌগলিক ব্যারিয়ার।

এই একই জিনিস লক্ষ্য করা যায় উনিশ শতকিয়া বাংলা ভাষার চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে – বাংলার রেনেসাঁস। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, বিভিন্ন তত্ত্ববিদ্যা – এ তো ছিল সেই সময়ের একটা নিঃসংশয় বর্তমান। সামাজিক মূল্যবোধের তত্ত্বে এলো সেই সময়ের নিরিখে যুগান্তকারী বৈপ্লবিক চিন্তা – বিধবা বিবাহ, নারী শিক্ষা। উত্তপ্ত অভ্রান্ত সেই সময়ের অবিসম্বাদি বর্তমান, আজকের ইতিহাস। সে সময়ের এক একজন মননশীল শক্তিশালী শিক্ষিত চিন্তাবিদ এক সঙ্গে সংস্কৃত, জার্মান ফ্রেঞ্চ আর ইংরেজিতে সুদক্ষ ছিলীন যাদের চিন্তাধারায় একসাথে সেই সব ভাষার কালচারের অতলান্তিক বয়ে যেত নিশিদিন, জ্বলে থাকত একটা নীল সরু শিখার মত অভ্রান্ত লাইটহাউস। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা, অনুভুতির তীব্রতা আর আনন্দের উদ্ভাসের সম্মিলিত গ্রন্থনা শিল্পিত হয়েছিল সব কিছুতে। সেই সময়ের এক উজ্জ্বলতম বুদ্ধিবাদি চরিত্রের নাম হেনরি ডিরোজিও। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ারথ এর প্রকৃতিপ্রেম আর মানবতাবোধ, তাঁর প্রখ্যাত সব উত্তরসুরী শেলি কীটস - ইংরেজি সাহিত্যের একটা অন্যতম অধ্যায় রোম্যান্টিসিজম এর ভাবনাপুষ্ট ডিরোজিও এই সময়ের যুব সম্প্রদায়ের নবজাগরনের পেছনে এক অন্যতম প্রতিভা। প্যারিচাদ মিত্র তাঁর অন্যতম শিষ্য। কলকাতার পার্ক স্ট্রীট সিমেট্রি র সমাধিফলকে ১৯৭৮ সালে লেখা হয়েছে – টিচার পোয়েট মেন্টর অফ ইয়ং বেঙ্গল। ইতিহাস এবং সাহিত্যের অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি একজন কবিও ছিলেন। ইয়ং বেঙ্গলদের একটা শ্লোগান ছিল – হি হু উইল নট রিজন ইজ এ বাইগট, হি হু ক্যান নট রিজন ইজ এ ফুল, অ্যান্ড হি হু ডাজ নট রিজন ইজ এ স্লেভ।

বাংলার রেনেসাসের ছিল সেই সময়কার সমাজমনে চেতনার বিবর্তনের বদলের ও ভেঙে গড়ার প্রয়োজনবোধ যার মুলে ছিল সোশ্যাল এভিল এর বিরুদ্ধে লড়াই । ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এর উত্তরনের গল্প করতে গেলে প্রথমেই একটা নাম এসে পরে - রাজা রাম মোহন। বেনারসের সংস্কৃত ঘরানার শিক্ষা দীক্ষা পাটনায় থাকাকালীন তিনি গভীরভাবে পড়াশুনা করেন পারসিয়ান আর অ্যারবিক জাতিগত ঐতিহ্য নিয়ে। মোনোথেইস্ম বা একেশ্বরবাদ নিয়ে এই সময় তিনি কিছু লেখা লেখিও করেন। এর সাথে যুক্ত হয় ইংরেজি ভাষা শিক্ষার আর তদনান্তিন পশ্চিমা মডার্ন কালচারের প্রভাব। কলকাতায় থাকতে আরম্ভ করার পর -

সেটা বোধহয় ১৮১৪ - তিনি আরম্ভ করেন বেদান্ত আর উপনিষদের অনুবাদ, পাশাপাশি চলছিল তাঁর আত্মীয় সভা’র কাজ কম্ম, আর এসবের মুল উদ্দেশ্য ছিল জনসমক্ষে এটা তুলে ধরা যে সব ধর্মই মুলে মোনোথেইস্ট, তার লড়াইটা ছিল গোঁড়া পুরোহিত তন্ত্র সর্বশ্য হিন্দু বাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখানেই থামেন নি তিনি, ১৮২০ থেকে তাঁর বিস্ফোরক এবং বিতর্কমূলক লেখা বেরোতে শুরু করে যেখানে তিনি খ্রীষ্টের নীতিকথা বা মর‍্যাল মেসেজ কে পাদ্রীতন্ত্রের অলৌকিকের ওপরে নির্ভরশীলতা ও তাদের প্রণীত খৃষ্টান তত্ত্বের থেকে আলাদা করে বিশ্লেষণ করে দেখান যে সেগুল কেন হয়েছে। সে সব বোধহয় ১৮২৩ বা ২৪ যখন মিসন্যারি রা হিন্দু পুরোহিত ও গোঁড়া সমাজ তাঁর ওপরে খড়্গ হস্ত হয়ে ওঠে। ১৮২৮ এ ব্রাহ্ম সমাজের স্থাপনা করেন। ডেভিদ হেয়ার এর সঙ্গে তাঁর অসম্ভব ভাল বোঝাপড়া ও সখ্যতা এবং ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ স্থাপনার পেছনেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য

সতীপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই তাকে এক অদ্ভুত আসনে বসিয়ে রেখেছে আমাদের মনে। সতীদাহের দানবীয় প্রথার ব্যপারে একটা নথিভুক্ত তথ্য হল ১৮১৪ থেকে ১৮২৯ এর মধ্যে নাকি প্রায় ১০,০০০ বিধবা কে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৮২৯ এর দিসেম্বারে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক আইন করে এই প্রথা বন্ধ করে দেন। প্রথম বাংলা খবরের কাগজের সৃষ্টিও তাঁর হাতেই, ১৮১৮ সালে - সাপ্তাহিক সমাচার দর্পণ। তাঁর নাটকীয় ব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠ নমুনা – কু সংস্কার ভাঙতে চেয়ে – তাঁর কালাপানি যাত্রা, মানে জাহাজে চেপে বিদেশ যাত্রা। এরকম একটা লোক ১৮৩০ সালের ফ্রেঞ্চ রেভলিউসানের পরে ঘরে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারেন নি, সরাসরি সংস্পর্শে আসার তাগিদে ১৮৩০ এই ইংল্যান্ড পাড়ি দেন। ১৮৩৩ সালে সেই দেশেই মারা যান, ব্রিস্টলের আরনোস ভেল সিমেট্রি তে তাঁর সমাধি রয়েছে।

ডিরোজিও’র ইয়ং বেঙ্গল – কৃষ্ণমোহন ব্যানারজি, রসিক কৃষ্ণ মল্লিক, রাম গোপাল ঘোষ – যাকে বাংলার ডেমস্থিনিস বলা হত তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতার জন্য। প্যারি চাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার – বিশেষ করে প্যারি চাঁদের গদ্য। রাম তনু লাহিড়ী যিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর নাটকীয় ব্রাহ্মনত্বের অভিজ্ঞান উপবীত অনুষ্ঠান করে পরিত্যাগ করার জন্য।
একদিকে রাম মোহনের শিক্ষিত পরিশীলিত কিন্তু তীব্র প্রতিবাদী সংস্কার মুলক আচরন অন্যদিকে ডিরোজিয়ানদের কান্ড কারখানার প্রতি অনীহার এর টানা পোড়েনের মাঝে সেই সময়ের পরিবর্তন কামী মডারেট দৃষ্টিভঙ্গি নেতৃত্ব খুঁজে নেয় দেবেন্দ্রনাথ আর বিদ্যাসাগরের মধ্যে। এই সময়ের আর একজন অত্যন্ত প্রতিভাশালী কিন্তু ক্ষনজন্মা ব্যক্তিত্ব হলেন ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত – সংবাদ প্রভাকর এর খ্যাতনামা এডিটর, লেখক, চিন্তাবিদ। মাত্র সাতচল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন (১৮১২ – ১৮৫৯) কিন্তু তাঁর মধ্যেই চিরকালের জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নিজের পরিষ্কার জায়েগা করে নিয়েছেন – তাঁর উল্লেখ ছাড়া এ ভাষার ইতিহাস অসম্পূর্ণ। এ ছাড়া অক্ষয় কুমার দত্ত ও তাঁর তত্ত্ব বোধিনী পত্রিকার প্রসঙ্গ ছুঁয়ে না গেলে রেনেসাসের ছবি সম্পূর্ণ হয় না। প্যারি চাঁদের টেক চাঁদ নামের আড়ালে আলালের ঘরের দুলাল, আর প্রায় এক সময়েই কালিপ্রসন্ন সিংহের হুতোম – যতদিন বাংলা আছে, এরা থাকবেন।

ঈশ্বর বিদ্যাসাগর আর একজন - লড়াইয়ের অন্য নাম। বাল্যকালে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই, হিন্দু সংস্কৃত কলেজে পড়াশুনা, পরে ফোরট উইলিয়াম কলেজে সংস্কৃতের পন্ডিত থেকে ধাপে ধাপে প্রিন্সিপ্যাল হওয়া। এই লোকটা না থাকলে হয়ত বাংলা ভাষা শিক্ষার আদল কয়েক শো বছর পিছিয়ে থাকত।

এই সব যখন চলছে তখন সময় এসে গেছে ১৮৫৭ সালে। সিপাহি বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশানের নেতৃত্ব ডিরোজিয়ানদের হাত থেকে চলে যায়। এরি মধ্যে নীলচাষ আর মালিকদের কান্ড কারখানা, দীনবন্ধু মিত্র, নীল দর্পণ, সেটা ১৮৫৯-৬০।

এই সময়েই মাইকেল শুরু করলেন তাঁর কাজ কম্ম, অন্যদিকে বঙ্কিম – বলা যেতে পারে প্রানবন্ত শিক্ষিত বাংলার এই সব রত্নেরা নতুন চেতনার জমিতে দাঁড়িয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ তা তুলে ধরতে শুরু করলেন, রেনেসাসের বর্ধিষ্ণু বোধের সমাপতনে।

১৮৫৯-৬০ মাইকেলের ব্ল্যাঙ্ক ভারস, ১৮৬০ বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী, যাত্রা শুরু। ১৮৭২ এ বঙ্কিম লেখেন আনন্দমঠ। বঙ্কিম এর সমস্ত লেখাতেই জাতীয়তা বাদের এবং বোধের ছবি উঠে আসে কোন না কোন ভাবে। আনন্দমঠ এক অর্থে সেই বোধের কালমিনেসান।

এই সময়ের নব্য হিন্দুত্বের জনজাগরনের শিল্পিত প্রতিরুপ হলেন একদিকে কেশব চন্দ্র সেন অন্যদিকে রামকৃষ্ণ। কেশব চন্দ্র সেন দেবেন্দ্রনাথের প্রিয় হয়ে ওঠেন তাঁর পর একসময় ব্রাহ্ম সমাজের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। খোদ দেবেন্দ্রনাথ তাঁর নাম দেন ব্রহ্মানন্দ। অদ্ভুত ইতিহাস, একটা সময়ের এই ফায়ার ব্র্যান্ড ব্রাহ্ম যার নব্যচেতনার আগুনের টানে বহু জুবক ব্রাহ্ম সমাজে র সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন, কুচ বিহারের রাজার সঙ্গে বৈবাহিকী সুত্রের প্রয়োজনে , তাঁর মেয়ের সঙ্গে রাজার এক পুত্রের বিবাহ হয়, সেই পুরাতন সমস্ত পদ্ধতি মেনে নেন, যার ফলে সেই সময়ের ইয়ং টার্ক রা ক্ষেপে যান। তাদের মধ্যে আনন্দ মোহন বোস, সুরেন্দ্রনাথ, শিবনাথ শাস্ত্রী অন্যতম। এই সুরেন্দ্রনাথ আর সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজি আলাদা লোক। এদের সক্রিয়তায় ব্রাহ্ম সমাজ ভেঙে তৈরি হয় সাধারন ব্রাহ্ম সমাজ। এরা ধর্মীয় মতবাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার এবং স্বাধীনতার বোধে সম্পৃক্ত হতে থাকেন। ফলত এরা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। শুরু হয় ন্যাশনাল সেন্তিমেন্তের প্রচার প্রসার ও ইন্সটিটিউসন্যালাইজেসান। জন্ম হয় প্রথম ইন্ডিয়ান অ্যাসসিয়েসানের ।

১৭৬৫ সালে শাহ আলম গীর এর কাছ থেকে বাংলা বিহার আর উড়িষ্যার অংশের দেওয়ানী নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্প্যানি পত্তন হয়েছিল। ১৮৫৭ র সিপাই বিদ্রহ্র ডিস্টিঙ্কট অধ্যের মধ্যে জে রেনেসাসের আবর্তনচক্র ছিল তাঁর কাল্মিনেসান আসে স্বাধীনতার লড়াইয়ের অঙ্কুরোদ্গমে। ন্যাস্নালিস্ম এই সময়েই আস্তে আস্তে শেকড় ছড়াতে আরম্ভ করে।

ছোটগল্প - রূপঙ্কর সরকার


ভাঙ্গি দরওয়াজা
রূপঙ্কর সরকার



রাত এখন তিনটে। আজ রাস্তায় একটাও কুকুর নেই। খানিক আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই তারা কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে সেঁধিয়েছে। একটা সাইকেল আসছে। সওয়ার একজন প্রৌঢ়। তিনি কালও এসেছেন, পরশুও এসছেন, দশবছর আগেও এসেছেন, যখন যুবক ছিলেন, তখনও আসতেন। এপাড়ায় যত কুকুর আছে, তাদের মধ্যে প্রবীনতম সদস্যও এঁকে চেনে, তাই কেউ কোনওদিন ঘেউ করেনা। শুধু এপাড়া নয়, এঁর যাত্রাপথের পুরোটাই ইনি সারমেয়মহলে পরিচিত। কেউ এঁকে আটকায়না, রাস্তার নাইট গার্ডরাও না। আজ তারা নেই সুতরাং সে প্রশ্নও নেই। এই অসময়ে কোনও নাইট ডিউটিও শেষ হয়না। তবু তিনি কোত্থেকে আসেন, আমরা জানিনা, জানার দরকারও নেই। তিনি সাইকেল চেপে আসছেন, এটাই কথা। রাস্তাটা ভালরকম ভিজেও না, আবার প্রায় শুকিয়ে এসেছে, তাও না। এমন ভিজে পথে সাইকেল চালালে চাকার নীচে একটা চিরচির করে আওয়াজ হয়। সাইকেলটার বয়স যথেষ্ঠ হয়েছে বলে আরও নানা রকম যান্ত্রিক আওয়াজ হয়। এই দু রকম আওয়াজই হচ্ছে।

জীবনে কোনও দিন যা করেন নি, প্রৌঢ় আজ তাই করলেন, একবার সাইকেল থামালেন। ভাল করে ঠাওর করলেন, তিনি কী দেখছেন, প্রেতাত্মা ? ডানদিকের তিন নম্বর বাড়িটার তিনতলার বারান্দায় সাদা কাপড় পরে ওটা কে দাঁড়িয়ে এই অপার্থিব সময়ে ? সাদা কাপড়ও এঁকে দেখছেন। তিনি প্রেতাত্মা নন, জলজ্যান্ত মানুষ। এমন সময়ে কাউকে রাস্তায় সাইকেল চালাতে দেখে তিনিও সমপরিমান অবাক হয়েছেন। মানুষটির নাম রামায়ন চৌধুরী, এক আধা সরকারী সংস্থার ডেপুটি জেনারাল ম্যানেজার। নাম শুনে বিহারী মনে হলেও তিনি আদ্যপান্ত বাঙালি। বিহারি হলে ‘চওধ্‌রী’ হয়, ইনি চৌধুরী। এই চৌধুরী পদবীটা নিয়েই অবশ্য প্রশ্ন।

সে প্রশ্ন অবশ্য পরে। আপাততঃ এঁর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার কারণ, ইনি একটা সাংঘাতিক খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটা ভয়ানক হলেও ঘুম ভাঙার পর আর কিছুতেই মনে করতে পারছেননা তার বিষয়বস্তু। সুখস্বপ্নের স্মৃতি অনেক সময়েই তারিয়ে তারিয়ে চাখা যায় ঘুম ভাঙার অনেক পরেও, কিন্তু দুঃস্বপ্ন প্রায়ই হারিয়ে ফেলে মানুষ। হারাতে চায় বলেই কি ? রামায়নবাবু স্বপ্ন দেখার পর বুকের মধ্যে একটা চাপ অনুভব করছেন। সেটা স্বপ্নের, না গতরাত্রের অতিভোজনের ফল, তাই নিয়ে খানিক দ্বিধা থাকলেও, উঠে বাথরুমে গিয়ে ঘাড়ে মাথায় জল দিয়েছেন। দিয়ে, খোলা বারান্দায় ঠান্ডা বাতাস খেতে এসেছেন। আমরা জানি ইনি কী স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু আমরাও তা নিয়ে এখন আলোচনায় যাবনা। আগে দেখি, এঁর ব্যক্তিগত জীবনটা কী রকম।

রামায়ন চৌধুরির উচ্চতা বেশ ভালই, পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চি। কিন্তু তাঁর চেহারায় চৌকো আদলের জন্য উচ্চতা খানিক কম মনে হয়। তাঁর ঘাড়ের পেছন দিকটা বেশ চওড়া, বলতে গেলে, ‘ঘাড়ে গর্দানে’।, জ্যোতিষিরা এমন চেহারাকে মঙ্গলের জাতক বা মার্শিয়ান বলে থাকেন। খুব ছোট ছোট করে সামরিক কায়দায় ছাঁটা চুলে তাঁকে মানায় ভালই। তিনি সেরকমই চুল ছাঁটেন। তাঁর পেশীবহুল দেহ, রোমশ বুক, ছোট চোখ, উঁচু হনু এবং পুরু ঠোট। তিনি সাধারণের তুলনায় বেশি কামাতুর কিন্তু এক নারীতেই সন্তুষ্ট। সে নারী তাঁর স্ত্রী পূরবী। অন্য মহিলারা যতই আকর্ষণীয়া হোন, রামায়নবাবু তাঁদের দিকে ভুলেও তাকান না। সাধারণ মার্শিয়ানদের সঙ্গে তাঁর একটাই তফাত, তিনি কথায় কথায় রেগে যান না বা আক্রমণাত্মক ব্যবহার করেন না। জ্যোতিষে এমন বিভ্রান্তি হয়েই থাকে, না হলে জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বলা হ’ত।

আমরা এবার তাঁর বেডরুমে ঢুকব। এ কাজটি সমীচিন নয়, কিন্তু আমরা অনোন্যপায়, কারন, এখানে কাহিনী একটা মোড় নেবে। বেডরুমে ঢোকার আগে অবশ্য আমরা একটু ফ্ল্যাশব্যাকে ঘুরে আসতে পারি। রামায়নবাবু ইকনমিক্সে মাস্টার্স করেছেন। কলেজে পড়ার সময়েই পূরবীদেবীর সঙ্গে পরিচয়। তাঁর অবশ্য সাবজেক্ট আলাদা ছিল, বাংলা। পূরবীও এম এ টা সেরে নিয়েছে বাংলায়। সে এম ফিল করতে যাচ্ছিল, রামায়ন একটা চাকরি পেল। পেয়েই বলল, বিয়ে করি চল। তার আর তর সইছিলনা। পূরবী রামায়নকে নিয়ে বাড়ি এল, বাবা মার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। বাবা খুশিই হলেন। যতই পণপ্রথা উঠে গেছে বলে সরকারি প্রচার হোক, ফোকটে দাবিহীন পাত্র পাওয়া চাঁদকপালে হ’লে হয়।

রামায়ন প্রণাম করতে যেতেই পূরবীর বাবা বললেন, থাক থাক। তাঁর নামটা ইমমেটিরিয়াল, তাই রেফারেন্সে রাখছিনা। থাক থাক বলতেই রামায়ণ নীচু হওয়া থেকে বিরত হয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। তার মাংসল ওজনে সোফাটা মৃদু আর্তনাদও করল। পূরবীর বাবা মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেন। নিজের মনেই গজগজ করলেন, থাক থাক তো বলতেই হয়, ওটা ভদ্রতা। তাই বলে – মুখে বললেন, তা তোমাদের বাড়িতে তো যেতে হবে আমাদের। মানে, আফটার অল কন্যেপক্ষ – রামায়ন বলল, বাড়িতে নিশ্চয় যাবেন, যে কোনও ছুটির দিন অবশ্য। তবে গেলে আমাকেই পাবেন। বাবা গত হয়েছেন বছর তিনেক, মা আরও আগে। - আর কোনও সিনিয়র আত্মীয় স্বজন – নাঃ কারো সঙ্গে যোগাযোগ নেই। পূরবীর বাবা কিছুক্ষণ মাথার ওপরে ঘুরন্ত ফ্যানটাকে মৃদু টিকটিক আওয়াজ করার অমুমতি দিয়ে নীরবে কী সব ভেবে বললেন, এই যে পূরবী রাম রাম বলে, তোমার পুরো নাম কি বাবা ? রামকুমার, রামজীবন, এমন কিছু থাকবে তো। তোমাদের মত বয়সে রাম দিয়ে নামও এখন দুর্লভ, সব আধুনিক নাম টাম –রামায়ন বলল, আমার নাম রামায়ন, রামায়ন চৌধুরী।

মৃদু বিষম খেলেন ভদ্রলোক। রামায়ন ? খুব আস্তে, একমাত্র নিজে শোনার মত করে বললেন, স্ট্রেঞ্জ ! তোমার পিতাঠকুরের নাম কি ছিল? রামায়ন বলল, নটবর। দ্বিতীয়বার বিষম খেলেন ভদ্রলোক। আবার ফ্যানের টিকটিক, আবার মনে মনে হিসেব, - আচ্ছা তোমরা যে চৌধুরী, এটা তো খেতাব। তোমরা আসলে কী? মানে, আসল পদবীটা কী? রামায়ন একটু হেসে বলল, কি জানি, ওসব নিয়ে কোনওদিন মাথাই ঘামাইনি। - ও, আচ্ছা বাবা, তোমাদের গোত্রটা কী ? রামায়ন কিছুক্ষণ থেমে বলল, বিশ্বামিত্র। বিরাট একটা শ্বাস ফেলে উদ্ভাসিত মুখ নিয়ে পূরবীর বাবা বললেন, বাঁচালে বাবা। বলে নিজের বুকে হাত বোলাতে লাগলেন। রামায়ন বলল, কেন, বাঁচালাম কেন? তিনি বললেন, আরে বিশ্বামিত্র মানে তোমরা মিত্তির, আমাদের পাল্টি ঘর – আমরা তো বোস, গৌতম গোত্র। কি নিশ্চিন্তই যে হলাম, কোনওদিন মেয়ের বাপ হলে বুঝবে।

আমরা যে বেডরুমে ঢুকব বলছিলাম, এই তার উপযুক্ত সময়। আমরা আর ঘন্টাখানেক পরে ঢুকতে পারতাম, নিশ্চিন্তে নিদ্রিত দুই নরনারীকে পেতাম। রামায়নবাবুর আবার মৃদু নাকও ডাকে। কিন্তু না, আমাদের এই সময়েই ঢুকতে হবে, না হলে উদ্দেশ্য সাধিত হবেনা। মাত্র কিছুক্ষণ আগে এঁদের রতিযুদ্ধ শেষ হয়েছে। রতিক্রিয়া বা রতিক্রীড়া শব্দদুটো ব্যবহার না করার কারণ হল, এঁদের বাড়িতে যুদ্ধই হয় এবং সেটা একতরফা। রামায়নবাবুর লিবিডো একটু প্রবল তা আগেই বলেছি। একটু নয়, বেশ। আর মার্শিয়ানদের আক্রমণাত্মক স্বভাবের যে ব্যতিক্রমের কথা আগে বললাম, সেটা ইনি পুষিয়ে নেন বিছানায়। পূরবীদেবী বিছানার ওপর পা ছড়িয়ে সোজা হয়ে বসে আছেন। একটা সাদা চাদরে তাঁর কাঁধ থেকে হাঁটু অবধি ঢাকা। ওই যে রকম হলিউডি ছবিতে দেখায়, সেই রকমই। রামায়ন কিন্তু বোম ভোলে স্টাইলে হাত পা ছড়িয়ে চিত হয়ে আছেন। লজ্জা কার কাছে, যে ঢাকাঢুকি দেবেন? আমাদের উপস্থিতি তো আর ওঁরা টের পাচ্ছেন না।

পূরবী বললেন, একটা কথা তোমায় জিজ্ঞেস করব ? রামায়ন এতটাই তৃপ্ত যে, যে কোনও কাউকে লাখটাকা দান করতে পারেন এক্ষুণি। বললেন, তুমি আবার পারমিশন নিয়ে কথা বল কবে? পূরবী বললেন, আজ ইন্সিওরেন্সের এজেন্ট এসেছিলেন। একটা প্রিমিয়াম ডিউ আছে কিনা দেখতে তোমার লকারটা খুলতে হয়েছিল। রামায়ন বললেন, থামলে কেন, বলো ? পূরবী বললেন, একটা কাগজ পেলাম। আমি দেখতে চাইনি, হাতে উঠে এল। সেটা একটা শিডিউল্ড কাস্ট সার্টিফিকেট। তাতে লেখা কাস্ট- মেথর, সাব কাস্ট- হাড়ি, - এগুলো কী ? আমাদের সঙ্গের সাউন্ড টেকনিশিয়ানকে বলা হল – ‘ঝাঁই’ করে একটা মিউজিক দাও, ক্লাইম্যাক্স টাইপ। রামায়ন খুব ক্যাজুয়ালি বললেন, ঠিকই লেখা আছে। আমার আসল নাম রামায়ন হাড়ি। আমরা জাতিতে মেথর। চৌধুরীটা এফিডেভিট কেস, তখন পঞ্চাশ টাকা লাগত। আমরা টেকনিশিয়ানকে বললাম, নাঃ কেটে দাও হে, আওয়াজটা খাচ্ছেনা।

পূরবী ভুরু কুঁচকে বললেন, কী বলছ কি তুমি? বিশ্বামিত্র গোত্র কার ? রামায়ন হাসতে হাসতে বললেন, ওটা তো শিবুর গোত্র। ওই যে, শিবুকে তুমি চেন তো, আমার বিয়ের সময়ে বরযাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে খচ্চরটা। এখন মন্ট্রিয়লে থাকে। ওর ছেলেটা ব্রিলিয়ান্ট, কী একটা আবিষ্কার ক’রে - পূরবী বললেন, ছিঃ তুমি আমাদের ঠকিয়েছ? রামায়ন এইবার একটু ঢাকাঢুকি দিলেন, তাও সামান্য। পাশ ফিরে খুব ঠান্ডা গলায় বললেন, ঠকিয়েছি ? সেটা কীরকম ? – ঠাকাওনি ? এফিডেভিট করা পদবী, বন্ধুর গোত্র, বাবা ঠিকই বলেছিলেন, রামায়ন, নটবর, এগুলো তো এযুগে ভদ্রলোকের নাম হয় না। টেকনিশিয়ান বলল, কিরে, এখানে দেব ? আমরা বললাম, নাঃ ঠিক জমছেনা। আর একটু দেখি। রামায়ন ঢাকাটা আর একটু টেনে দিয়ে বললেন, আরি! ভদ্রলোক কাকে বলে। আমি মাস্টার্স করেছি ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে। একটা পাবলিক সেক্টরের ডিজিএম। অডিওভিসুয়াল প্রেসেন্টেশনের সময়ে টানা নির্ভুল ইংরিজিতে ঘন্টাখানেক বকবক করি। আমার বাবাও গ্র্যাজুয়েশন করেছে। ঠাকুদ্দা অবশ্য – তা সে যাই হোক, তার নাম তো বলিনি। নটবর আর রামায়ন ভদ্রলোক নয় কী ক্যালকুলেশনে?



রামায়ন এবার আরও খানিকটা চাদর টেনে কাত হয়ে বসেছেন। পূরবীর মুখটা চিবুক ধরে ঘোরাতে গেলেন, ঘুরলনা। পূরবী কাঁদছেন সম্ভবতঃ। টেকনিশিয়ান ফিসফিস করে বলল, পেথস দিই? এস্‌রাজ টেস্‌রাজ ? আমরা ইশারায় থামালাম। রামায়ন বলছেন, আচ্ছা, তুমি তো জাত ফাত কিছু মাননা, নাস্তিক এবং লেফটিস্ট। তোমার সমস্যাটা কোথায়? পূরবী মুখ না ঘুরিয়েই বললেন, আমার কোনও সমস্যা নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতাম, চেঁচিয়ে বলতাম, আমি জাত মানিনা, ওকেই বিয়ে করব। রেজিস্ট্রি করতাম, অনুষ্ঠান করতাম না, কিন্তু বাবার সরল বিশ্বাসকে – নাঃ, আই ক্যান নট অ্যাকসেপ্ট ইট। রামায়ন বললেন হুম্‌।

ডিজিএম সাহেবের মন মেজাজ ভাল নেই। ক’দিন ধরে পূরবী ছেলের কাছে শুচ্ছেন। রামায়ন বিছানায় টসিং অ্যান্ড টার্নিং, বিরহে কাতর, কিন্তু পূরবী খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন ব্যাপারটা। আমরাও আর লোকেশনে নেই। ওঁরা নিজেরাই ফয়সালা করুন। রামায়নের অফিসে একটা নিজস্ব কেবিন আছে, থাকতেই হবে। তার মধ্যে একটা অ্যাটাচ্‌ড ওয়াটার ক্লোসেটও আছে। অফিসের মেন গেটের কাছে জেনারাল টয়লেট, কর্মীদের। সেখানে রামায়নের, থুড়ি, চৌধুরী সাহেবের যাওয়ার কথা নয়। আজ কী হয়েছে, ভীষণ ইয়ে পেয়েছে। ব্লাডারে বেশ চাপ, নিজের কেবিন অবধি দৌড়ে যাওয়াটাও বিচ্ছিরি দেখায়। চৌধুরী সাহেব জেনারাল লু তে ঢুকে পড়লেন। এখনও অফিস আওয়ার শুরু হয়নি, সব কর্মীরাও আসেনি। টয়লেট সাফ হচ্ছে। সুইপার বিশ্বনাথ হাত দিয়ে পরম যত্নে ইউরনাল বেসিনগুলো ঘষছে। চৌধুরীসাহেবকে দেখলেই অন্য কর্মীরা হাত তুলে সেলাম করে, বিশ্বনাথের সে সময় নেই। সে কাজে মগ্ন, গুনগুন করে গানও করছে।

সব কর্মীরা এসে কাজে বসলে চৌধুরী সাহেব বেল বাজিয়ে অফিস সুপারকে ডাকলেন। কী ব্যাপার গাঙ্গুলিবাবু, আজ একটু লু টা ইন্‌সস্পেক্ট করলাম। ওখানে বিশ্বনাথ হাত দিয়ে ইউরিনাল সাফ করে কেন? ওকে গ্লাভ্‌স দেয়া হয়না? গাঙ্গুলি বাবু বললেন, কী করব স্যার, বহুবার বলেছি। স্টোরে গ্লাভ্‌স আছেও বেশ ক’জোড়া। তা ছাড়া আজকাল মেকানাইজড ব্রাশও পাওয়া যায়, তাও কেনা আছে। ও কিছুতেই নেয়না। বলে হাতেই আমার সুবিধে। নীচু গলায় বললেন, আসলে শালারা জাতে মেথর তো, সাত পুরুষের অভ্যেস স্যার – চৌধুরী সাহেব চমকে ভাবলেন, আমার সার্ভিস ফাইলটা তো হেড অফিসে থাকার কথা, এখানে কপি ফপি নেই তো? টিফিনের সময় ক্যান্টিন থেকে খাবার দিয়ে যায়। আজ ছিল হাতরুটি, ডিমের ডালনা আর চাটনি। চৌধুরিসাহেবের হঠাৎ মনে পড়ল, বিশ্বনাথ সকালে সুইপিং করে দুপুরে ক্যান্টিনে রুটি বানায়। তাঁর বমি পেয়ে গেল। বেসিনে গিয়ে ওয়াক তুললেন। খাবারটা সরিয়ে রেখে চাপরাশিকে ডেকে বললেন, ক্যান্টিনের কোয়ালিটি গোল্লায় গেছে। কাল থেকে খাবার দিতে বারণ কোর। আমি বাড়ি থেকে টিফিন আনব।

বাড়ির থমথমে পরিবেশটা এখনো চলছে। পূরবীদেবী ছেলের সঙ্গেই শুচ্ছেন কিন্তু রামায়নের পক্ষে একা শোয়া সম্ভব নয়। একদিন পূরবীর হাত ধরে বললেন, তুমি এখনও রেগে আছ? আচ্ছা আমার কথা শোন। স্বামী হিসেবে তোমার সঠিক ভরণপোষণ করতে পারছি? হ্যাঁ কি না। আমি কি বিছানায় স্যাটিসফাই করতে পারি? হ্যাঁ কি না। ঐ সার্টিফিকেটের দৌলতে আজ আমি ডিজিএম। তোমায় পার্টিতে, অনুষ্ঠানে, সবাই মেমসাহেব, ম্যাডাম এই সব বলে, তোমার সামান্য হলেও বুক ফোলে, হ্যাঁ কি না। পাতি সুপারভাইজারের বৌকে যেমন লোকে বৌদি বলে, তার চাইতে তুমি অনেক বেশি সম্মান পাও, হ্যাঁ কি না। তোমার ছেলে ঋতম, মানে আই মীন, আমাদের ছেলে, গ্রীক দেবতার মত সুন্দর। হ্যাঁ কি না। তোমার বন্ধুই তো রাজাবাজারে জেনেটিক্স নিয়ে রিসার্চ করছে। সে-ই তো বলল, জেনেটিকালি উচ্চবর্ণের সঙ্গে দলিতদের কোনও ডিফারেন্স নেই। তোমার সামনেই তো বলল। কী, চুপ করে আছ কেন ? আমি আর পারছিনা। শুতে এস প্লীজ। পূরবীদেবী এলেন, কিন্তু খেলা জমলনা। আজ রামায়নই চাদর ঢেকে বসে আছেন। বললেন চল, কোথাও ঘুরে আসি। মন ভাল করা দরকার। আমি লীভ অ্যাপ্লিকেশন করছি কিন্তু।

ট্র্যাভেল এজেন্সির গাড়িটা পাহাড় বেয়ে এঁকেবেঁকে উঠছে। গাইডটার হিন্দী কেমন অদ্ভুত। ফরেনারদের জন্য ইংরিজি যা বলছে, তা আরও অদ্ভুত। সাদাগুলো অধিকাংশই পূর্ব ইওরোপের, তারা ইংরিজির বিন্দুবিসর্গ বুঝছেনা। গাইড বলল, অব হম চলতে হ্যাঁয় এক পেয়ারভরি অওর দর্দভরি কাহানি সুননে, কাহানি বাজ বাহাদুর অওর রাণী রূপমতী কি। ইয়েস, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, ( লেডিজের জ টা বর্গীয়, জেন্টেলম্যানে প্লিউরাল নেই, আমরা ডিটেলে যাচ্ছিনা) উই আর নাউ গোইং টু লিসিন টু এ লব ইশটোরি অফ কুইন রূপ- রামায়ন দেখলেন, পূরবী বাসের জানলা দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন। বাসটা কোথাও একটা থামল। টুরিস্ট বাস থামা মানেই নামা, কিছু একটা, দ্রষ্টব্য হোক আর না হোক তা দেখা আর বকবক শোনা। গাইড বলল, দেখিয়ে, অ্যাইসা বারহ্‌ দরওয়াজে হ্যাঁয়, দেয়ার আর টুএল(ভ উহ্য) গেটস হিয়ার। জ্যায়সে, ভাঙ্গি দরওয়াজা, আলমগীর দরওয়াজা, দিল্লী দরওয়াজা – দিস ইজ কল্‌ড ভাঙ্গি দরোয়াজা – পূরবী নামেন নি। রামায়ন নতুন কেনা ডিএসএলআরটা নিয়ে ছেলেকে বললেন, আয় ঋত –

পাথরের তোরণ পথের দু ধারে। ছাদ একটা ছিল, তা ভেঙে পড়ে গেছে অনেকদিন আগেই। দুধারে তোরণের ওপর বড় বড় অক্ষরে চূণ দিয়ে দু ভাগে লেখা, ‘রাম রাম কহো’।, রামায়ন বললেন, ঋত দেখেছিস, এইসব লেখা জোখা অ্যালাউ করে কী করে, মনুমেন্টটার অ্যাপিয়ারেন্সটাই নষ্ট। ঐখানে গিয়ে দাঁড়া তো, ঐ রাম লেখাটা কভার করে দাঁড়াবি। এই বলে তার দিকে ক্যামেরা তাক করলেন। ওঁর একটা অভ্যাস, কোথাও গেলে দৃশ্যটা ক্যামেরাবন্দী করার যোগ্য হোক আর না হোক, উনি কাউকে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলবেনই। গাইড বলল, দেখিয়ে ইয়ে হ্যায় ভাঙ্গি দরওয়াজা। ইয়াহাঁপর এক ভাঙ্গি কো বলি চঢ়াকে গেট বনায়ে থে। অওর আপলোগ রাজস্থান যাওগে তো কঈ অ্যায়সে গেট মিলেঙ্গে। ঋতম জিজ্ঞেস করল, আঙ্কল, ইয়ে ভাঙ্গি কেয়া হোতা হ্যায়? গাইড বলল, বেটা উওহ্‌ সুইপার লোগ হোতে হ্যাঁয় না, উনকো ভাঙ্গি কেহতে হ্যাঁয়। কোই গেট ইয়া ব্রিজ বনানে সে পেহলে ইনকা বলি চঢ়ানা শুভ্‌ মানা যাতা থা। রামায়ন দেখল উন্মাদিনীর মত এক নারীমূর্তি ছুটে আসছে। তার ওড়না বাসের দরজায় আটকে গেছে, তার পরোয়া না করে সে ছুটছে। ওড়না ছিঁড়ে দরজায় ঝুলে রইল, হাতও কেটে গেছে খানিকটা, সরু রক্তের ধারা নামছে ফর্সা হাত বেয়ে। একটানে ঋতমকে সরিয়ে নিয়ে হাঁফাচ্ছে পূরবী। পাগলের মত চিৎকার করে বলছে, এই ছবি ডিলিট করো, করো এক্ষুণি, করলে তুমি? – পূর্ব ইয়োরোপের কয়েকজন মহিলা এই সব দেখে বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে কানে কানে কী সব বলছেন। ওরা গাড়িতে উঠে পড়ল তাড়াতাড়ি।

আমরা আবার ফিরে এসেছি। আমরা এখন রাত তিনটের সময়ে, সেই ভিজে রাস্তায়, সাইকেল চাপা প্রৌঢ়র কাছে। তিনি অবাক হয়ে দেখছেন বারান্দায় দাঁড়ানো সাদা মূর্তিকে। আসলে সাদা দক্ষিণ ভারতীয় ভেশ্তি আর সাদা পুরোহাতা গেঞ্জি পরা বলে অমন লাগছে রামায়নকে। উনি স্যান্ডো গেঞ্জি ভুলেও পরেননা। প্রৌঢ়ের চোখকে জুম করা যাবেনা, কিন্তু আমরা জুম করে কাছে চলে এলাম। রামায়নের চোখেমুখে আতঙ্ক। কিসের আতঙ্ক উনি জানেন না, স্বপ্নের কথা কিছুই মনে নেই। কিন্তু আমরা জানি। উনি স্বপ্নে দেখেছেন, ক’টা বাঁধনির কাজ করা পাগড়ি পরা বিশাল গোঁফ ওয়ালা লোক ঋতমকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে বধ্যভূমির দিকে। ঋতম বলছে, বাবা, এরা আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ?

স্বপ্নটা মনে না থাকলেও তা অবচেতন থেকে উঠে এসেছিল, আবার সেখানেই ফেরৎ গেছে। পরদিন ঋতমের আইআইটির ফর্ম ফিল আপ। সে একাই করতে পারে, তবু বাবাকে না দেখিয়ে কিছুই লেখেনা। রামায়ন কাস্টের জায়গায় জেনারালে টিক মেরে দিলেন। ঋতম বলল, ফর্মটা নষ্ট করলে তো? আবার একটা ডাউনলোড করতে হবে। রামায়ন খুব ধীরে বললেন, সেটাতেও এখানেই টিক দেব। বাবা তুমি জয়েন্টে চব্বিশ পেয়েছ, তুমি তো উসেন বোল্ট। ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জডদের সঙ্গে দৌড়বে কেন? ঋতম বলল, তুমি জান, আমার হোল কেরিয়ারের কী বারোটা বাজবে? রামায়ন তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, এখন খারাপ লাগছে তো? যখন আমার মত বয়স হবে, তখন বুঝবি – বলে, অতবড় পালোয়ানি, মাংসল, কুস্তিগীরের মত লোকটা গেঞ্জির হাতায় চোখ মুছতে লাগল। টেকনিশিয়ান বলল, এবারে পেথস দিই? আমরা বললাম, নাঃ, এতক্ষণ দেয়া হয়নি যখন, আর লাগবেনা।

ছোটগল্প - অভীক দত্ত

ব্ল্যাকআউট
অভীক দত্ত


বসে ছিলাম চৌরঙ্গীর মোড়ে। এখানে সাধারনত প্রচুর লোক থাকে। কিন্তু আজকে কেউ ছিল না। মাসিক কাগজের দোকানের উল্টোদিকে আমি আর পিঙ্কি রিক্সায় বসে ছিলাম। রিক্সাচালকও কেউ ছিল না।

পিঙ্কি অনেকক্ষণ থেকে বলে চলেছে ওর আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না ওকে কিভাবে আইসক্রিম খাওয়াব। আইসক্রিম কিনতে হলে রিক্সা থেকে নামতে হবে। তার থেকেও বড় কথা একটা দোকানও মনে হচ্ছে না খোলা আছে। সবকটা বন্ধ।

পিঙ্কির নাম একসময় সোহিনী ছিল। তারপর সোনা। তারপর আমার মা হঠাৎ করে ওকে দেখে বলল ওকে নাকি মার ছোটবেলার বন্ধু পিঙ্কির মত দেখতে। মা-ও পিঙ্কি বলা শুরু করল। আমিও। তারপর দেখলাম সোহিনীও খুব একটা আপত্তি করল না। তাই শেষমেশ এই নামটাই স্থায়ী হল। আমার জীবনের একমাত্র প্রেমিকা।

পিঙ্কিরও নাকি আমিই প্রথম প্রেমিক। কিন্তু আমার বন্ধুরা এই কথা বিশ্বাস করে না। ওরা বলে সুন্দরী মেয়েরা হল স্পঞ্জের মত। সবাই হাতে করে দেখতে চায়। যদি প্রেমিক নাও থাকে তবু কোথাও না কোথাও ভিড় বাসে ট্রামে জায়গামত হাত পড়ে গেছে। এইসব কথা শুনলে আমার মনখারাপ হয়। মাঝে মাঝে জটিল জটিল প্রশ্ন আসে। কোন কোনটা পিঙ্কিকে জিজ্ঞেসও করে ফেলি। শুনে পিঙ্কি মুখ ভার করে ফেলে। কখনও কখনও কথা বলে না। দু তিনদিন আমার ফোন ধরে না। তারপর অনেকগুলো এস এম এস করতে হয়। “সরি”, “আমি আর কোনদিন এরকম কথা তোমায় জিজ্ঞেস করব না”, এই ধরনের কথা।

পিঙ্কিকে একজন অঙ্ক করায়। ওর দাদার বন্ধু,খুব হ্যান্ডসাম। আমার বন্ধুরা বলে পড়ানোর ফাঁকে ওই ছেলেটা নাকি পিঙ্কির হাত ধরে। আমার খুব রাগ হয়। তারপর পিঙ্কিকে বলেই ফেলি ওই ছেলেটার কাছে পড়ার কি আছে? আর কেউ নেই যে পড়াতে পারে?

শুনে পিঙ্কি রাগ করে। গম্ভীর হয়ে যায়। আর আমাকে আবার সবকিছু মেনে নিতে হয়।

কিন্তু ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যায়। বিশ্বাস হয় না ওই ছেলেটা আর পিঙ্কির মধ্যে ভিতর ভিতর কিছু হয় না।

আজ কেউ নেই এখানে। রিক্সাটার মধ্যে সন্ধ্যে থেকে আমি আর পিঙ্কি বসে আছি। আর থেকে থেকে ও আমার কাছে আইসক্রিম খেতে চাইছে। চারদিকটা অন্ধকার। রাস্তার লাইটগুলি কোনটা জ্বলছে কোনটা জ্বলছে না।

হাওয়া দিচ্ছে না। কিন্তু গরমও লাগছে না, তবে ভয় লাগছে। কেউ যদি আমাকে চিনে ফেলে? চিনে ফেলে যদি তাড়া করে? তাহলে পিঙ্কি কি ভাববে? বেইজ্জতির একশেষ হয়ে যাব তো! আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে আমি একটা ভয়ঙ্কর কোন অপরাধ করেছি। লোকে দেখলে যখনই কেউ আমাকে চিনতে পারবে তখনই আমার কলারটা ধরে আমাকে যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করবে আর পিঙ্কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।

যদিও এই জায়গাটা এখন জনমানবশূন্য তবু একটু আগে বিশুকে দেখলাম যেন। কড়া চোখে আমাকে দেখতে দেখতে চলে গেল। বিশু কি আমার থেকে টাকা পায়? কি জানি।

আমার থেকে কে কে টাকা পায় এখন ঠিক মনে করতে পারছি না। নাকি আমি কাউকে প্রতারণা করেছি? খুব বাজে কিছু কাজ। হতে পারে। না হওয়াটা আশ্চর্য না। এই রিক্সাটায় এসে বসার পর আমার সেরকমই কিছু একটা মনে হচ্ছে।

পিঙ্কি আইসক্রিম খেতে চাইলেও তাই খাওয়াতে পারছি না কোনভাবেই। মনে হচ্ছে রিক্সা থেকে নামলেই ভয়ঙ্কর কিছু একটা হয়ে যাবে। চারদিক থেকে সবাই ছুটে আসবে, আমার দিকে আঙুল তুলবে। আর পিঙ্কিকে আমি হারিয়ে ফেলব।

পিঙ্কিদের বাড়িতে অনেক ছেলের যাতায়াত। ওদের একান্নবর্তী পরিবার। ওর কাকার ছেলে আছে, ওর দাদা আছে, তাদের বন্ধুরা হরবখত যাতায়াত করে চলেছে ওদের বাড়িতে। তাদের কাউকে যদি পিঙ্কির পছন্দ হয়ে যায় তাহলে আমি কোথায় যাব?

তার উপর এখন মনে হচ্ছে এই তো সামনেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। আমি কিছুই পড়াশুনা করিনি। সবটাই সামনের ছেলেটার থেকে টুকব। লুস শিটে লিখে ছেলেটা বেঞ্চিতে রাখবে আমি সুরুৎ করে সেটা নিয়ে আমার লুস শিটের সাথে মিশিয়ে ফেলে সেটা থেকে টুকতে যাব আর গার্ড আমায় ধরে ফেলবে। আমার বাড়িতে খবর যাবে। বাবা মারবে। মা মারবে। আর পিঙ্কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।

তারপর আমি একা একা ঘুরব। কোথাও কেউ থাকবে না।

ঘুরতে ঘুরতে একটা স্টেশনে এসে পড়ব। যেটার ওভারব্রিজে ওঠার পর দেখতে পাব সামনের পাটাতন কয়েকটা নেই। এদিকে ট্রেন এসে পড়েছে। আমাকে পার হতেই হবে। ওপারে যেতেই হবে। ওপারে যাবার জন্য লাফ দেব আর তারপরে সব কিছু আবার আগের মত গুলিয়ে যাবে।

পিঙ্কির বাবা আমাকে পছন্দ করে। ওদের বাড়িতে গেলে অনেকরকম কথা বলে। পিঙ্কির মা যত্ন আত্তি করে। কিছু না কিছু খেতে দেয়। আর আমি দেখি পিঙ্কিদের নীচের ঘরে আসা কাকার ছেলের বন্ধুদের। কোন কোনটা উচ্চিংড়ে টাইপ। দেখলে মাথা গরম হয়ে যায়। মনে হয় গিয়ে দিই দু-ঘা। এদের নিশ্চয়ই কারও কারও পিঙ্কির উপর গোপনে ভালবাসা আছে। চেষ্টা করে হাসির কিছু বলে পিঙ্কির মনকে জিতে নেবার। পিঙ্কি যখন এদের সাথে গিয়ে হেসে হেসে কথা বলে তখন আমি কিছু খেতে পারি না। মনে হয় গিয়ে পিঙ্কিকে ঠাসিয়ে চড় কসাই। বলি লজ্জা করে না নিজের বয় ফ্রেন্ডের সামনে ছেনালিগিরি করছ?

কিন্তু কিছুই করতে পারি না। চুপচাপ দেখে যাই। খেয়ে দেয়ে ফোন অফ করে বাড়ি চলে আসি। সারারাত ঘুমাতে পারি না। এপাশ ওপাশ করি। তারপর মাঝরাতে উঠে ফোন অন করে দেখি পিঙ্কি অনেকগুলি এস এম এস করেছে। আমিও কড়া ভাষায় কতগুলি এস এম এস করি। তারপর পিঙ্কি ফোন অফ করে দেয়। আমি জেগে বসে থাকি।

এই রিক্সাটায় বসে আছি কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে রাস্তায় লোক না থাকলেও এবাড়ি ও বাড়ির জানলা থেকে সবাই পিঙ্কিকেই দেখছে। তাদের কারও না কারও সাথে পিঙ্কির গোপনে যোগাযোগ আছে। আমার ফোন রেখেই পিঙ্কি তাদের ফোন করে। পিঙ্কির ফোন ব্যস্ত পেলে আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বারবার ফোন করতে থাকি। আর যতবার ব্যস্ত পাই আমার মাথার ভেতরে আগুন জ্বলতে থাকে। মনে হয় সব ধ্বংস করে দিই। তারপর যখন বলে ওর পিসি ফোন করেছিল আমার বিশ্বাস হয় না। মনে হয় নির্ঘাত মিথ্যা কথা বলছে।

আমি যদি এবার আইসক্রিম আনতে যাই, এই চত্বরের সব দোকানই তো বন্ধ, আর এই রিক্সাওয়ালাও নেই তারমানে আমাকে এখানে পিঙ্কিকে রেখে যেতে হবে। আর রেখে গেলেই পিঙ্কির সাথে কারও না কারও দেখা হয়ে যাবে।

হঠাৎ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হল। মোটা মোটা সূচের মত জলগুলি আমার আর পিঙ্কির গায়ে এসে লাগতে লাগল। পিঙ্কির সাদা সালোয়ার ভিজিয়ে দিতে লাগল, আমি ভিজতে লাগলাম আর শুধু মাথায় আসতে লাগল পিঙ্কিকে যেভাবেই হোক আমার কাছে রাখতে হবে, ওকে কিছুতেই হাত ছাড়া করা যাবে না।

আমি রিক্সার মধ্যে পিঙ্কিকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছি একটা ছেলে এসে দাঁড়াল রিক্সার পাশে। “ওই” বলে চেঁচিয়ে আমাকে ডাকল। আমার বুকটা কেঁপে উঠল। আমি মুখ ফিরিয়ে ছেলেটাকে দেখলাম। লম্বা, চুলগুলি ছোট ছোট করে কাটা... আমার দিকে তাকিয়ে বলল “নাম, নাম রিক্সা থেকে...”



পিঙ্কিও কখন যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে আমার পাশ থেকে। আমার পা দুটো কেউ জোর করে আটকে রেখে দিয়েছে। আর আমি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছি। চারদিক জনমানবশূন্য...

ছোটগল্প - অনুপম মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়ে গপ্পো
অনুপম মুখোপাধ্যায়



দোলন যেন বেল বাজার অপেক্ষাতেই ছিল । সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিল । এবং প্রশ্ন, ‘ভিজেছো তো ?’

জুবিন উত্তর দিল, ‘না না । ট্যাক্সি নিয়ে নিয়েছিলাম । এই গলির মুখ থেকে একটু ভিজতে হল । তেমন কিছু না । বৃষ্টি এখন কমে এসেছে ...’

‘কোথায় কমেছে ! কী শব্দ হচ্ছে বাবা !’

জুবিন হেসে বলল, ‘বাড়ির ভেতরে শব্দ বেশিই মনে হয় । একটু বৃষ্টিতে ভেজা স্কিনের পক্ষে ভালো । তুমি খেয়েছ ?’

‘ন্যাকামি হচ্ছে । যাও চেঞ্জ করে নাও ।’

‘আগে খেয়ে নিই । খিদে পেয়েছে । পরে চেঞ্জ করছি । বা ...’ চোখ টিপল , ‘করছি না ।’

‘শয়তান । আজ ওসব হবে না । আমার ... র‌্যাশ হয়েছে ।’

‘সেকি ! ওষুধ দিল যে ডাক্তার ! আবার সেই ...’

‘হুঁ । হাতমুখ ধুয়ে এসো । খাবার দিচ্ছি ।’

হাতমুখ ধুয়ে জুবিন টেবিলে এসে বসল । দুটো বেডরুম একটা কিচেনের ছিমছাম সুখের আদল । এখান থেকে কিচেনটা দেখা যায় । দোলন খাবার গরম করছে । আজ অনেক রাত হয়ে গেল । এত রাত অবধি মেয়েটা না খেয়ে বসে আছে তার জন্য ... জুবিনের খুব খারাপ লাগছিল । বৃষ্টিটা তাকে আজ বাঁচিয়ে দিল । কিন্তু এভাবে আর কতদিন ...

দোলন খাবার নিয়ে টেবিলে এসে বসল । জুবিন একটা রুটি ছিঁড়ে ডালে ডোবাল । মুখে ভরে বলল, ‘দিন তাহলে আজ কেমন গেল তোমার ?’

দোলন হেসে ফেলল , ‘রুটি ছিঁড়ে রোজ তুমি ঠিক এইভাবে এই কথাটাই বলো ।’

‘তাই ?’

‘হ্যাঁ । দেড় বছর দেখছি । একমাত্র সানডে ছাড়া ।’

জুবিন কিছু বলতে যাচ্ছিল , কলিং বেল বাজলো । জুবিন ঘড়ির দিকে তাকাল । রাত এগারোটা পাঁচ । অবাক হয়ে বলল, ‘আজ জুবিন এত দেরি করল ফিরতে ! এত রাত তো ও করে না !’

দোলন বলল, ‘ না না । ও ঢের আগে ফিরেছে । খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে । ওটা মনে হয় ... দোলন ।’ একটা রুটি ছিঁড়ে ডালে ডোবালো । মুখে ভরে বলল , ‘অফিসেই আটকে গিয়েছিল বৃষ্টিতে ... ফোন করেছিল আজ না-ও ফিরতে পারে ।’