ভাঙ্গি দরওয়াজা রূপঙ্কর সরকার
রাত এখন তিনটে। আজ রাস্তায় একটাও কুকুর নেই। খানিক আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই তারা কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে সেঁধিয়েছে। একটা সাইকেল আসছে। সওয়ার একজন প্রৌঢ়। তিনি কালও এসেছেন, পরশুও এসছেন, দশবছর আগেও এসেছেন, যখন যুবক ছিলেন, তখনও আসতেন। এপাড়ায় যত কুকুর আছে, তাদের মধ্যে প্রবীনতম সদস্যও এঁকে চেনে, তাই কেউ কোনওদিন ঘেউ করেনা। শুধু এপাড়া নয়, এঁর যাত্রাপথের পুরোটাই ইনি সারমেয়মহলে পরিচিত। কেউ এঁকে আটকায়না, রাস্তার নাইট গার্ডরাও না। আজ তারা নেই সুতরাং সে প্রশ্নও নেই। এই অসময়ে কোনও নাইট ডিউটিও শেষ হয়না। তবু তিনি কোত্থেকে আসেন, আমরা জানিনা, জানার দরকারও নেই। তিনি সাইকেল চেপে আসছেন, এটাই কথা। রাস্তাটা ভালরকম ভিজেও না, আবার প্রায় শুকিয়ে এসেছে, তাও না। এমন ভিজে পথে সাইকেল চালালে চাকার নীচে একটা চিরচির করে আওয়াজ হয়। সাইকেলটার বয়স যথেষ্ঠ হয়েছে বলে আরও নানা রকম যান্ত্রিক আওয়াজ হয়। এই দু রকম আওয়াজই হচ্ছে।
জীবনে কোনও দিন যা করেন নি, প্রৌঢ় আজ তাই করলেন, একবার সাইকেল থামালেন। ভাল করে ঠাওর করলেন, তিনি কী দেখছেন, প্রেতাত্মা ? ডানদিকের তিন নম্বর বাড়িটার তিনতলার বারান্দায় সাদা কাপড় পরে ওটা কে দাঁড়িয়ে এই অপার্থিব সময়ে ? সাদা কাপড়ও এঁকে দেখছেন। তিনি প্রেতাত্মা নন, জলজ্যান্ত মানুষ। এমন সময়ে কাউকে রাস্তায় সাইকেল চালাতে দেখে তিনিও সমপরিমান অবাক হয়েছেন। মানুষটির নাম রামায়ন চৌধুরী, এক আধা সরকারী সংস্থার ডেপুটি জেনারাল ম্যানেজার। নাম শুনে বিহারী মনে হলেও তিনি আদ্যপান্ত বাঙালি। বিহারি হলে ‘চওধ্রী’ হয়, ইনি চৌধুরী। এই চৌধুরী পদবীটা নিয়েই অবশ্য প্রশ্ন।
সে প্রশ্ন অবশ্য পরে। আপাততঃ এঁর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার কারণ, ইনি একটা সাংঘাতিক খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটা ভয়ানক হলেও ঘুম ভাঙার পর আর কিছুতেই মনে করতে পারছেননা তার বিষয়বস্তু। সুখস্বপ্নের স্মৃতি অনেক সময়েই তারিয়ে তারিয়ে চাখা যায় ঘুম ভাঙার অনেক পরেও, কিন্তু দুঃস্বপ্ন প্রায়ই হারিয়ে ফেলে মানুষ। হারাতে চায় বলেই কি ? রামায়নবাবু স্বপ্ন দেখার পর বুকের মধ্যে একটা চাপ অনুভব করছেন। সেটা স্বপ্নের, না গতরাত্রের অতিভোজনের ফল, তাই নিয়ে খানিক দ্বিধা থাকলেও, উঠে বাথরুমে গিয়ে ঘাড়ে মাথায় জল দিয়েছেন। দিয়ে, খোলা বারান্দায় ঠান্ডা বাতাস খেতে এসেছেন। আমরা জানি ইনি কী স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু আমরাও তা নিয়ে এখন আলোচনায় যাবনা। আগে দেখি, এঁর ব্যক্তিগত জীবনটা কী রকম।
রামায়ন চৌধুরির উচ্চতা বেশ ভালই, পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চি। কিন্তু তাঁর চেহারায় চৌকো আদলের জন্য উচ্চতা খানিক কম মনে হয়। তাঁর ঘাড়ের পেছন দিকটা বেশ চওড়া, বলতে গেলে, ‘ঘাড়ে গর্দানে’।, জ্যোতিষিরা এমন চেহারাকে মঙ্গলের জাতক বা মার্শিয়ান বলে থাকেন। খুব ছোট ছোট করে সামরিক কায়দায় ছাঁটা চুলে তাঁকে মানায় ভালই। তিনি সেরকমই চুল ছাঁটেন। তাঁর পেশীবহুল দেহ, রোমশ বুক, ছোট চোখ, উঁচু হনু এবং পুরু ঠোট। তিনি সাধারণের তুলনায় বেশি কামাতুর কিন্তু এক নারীতেই সন্তুষ্ট। সে নারী তাঁর স্ত্রী পূরবী। অন্য মহিলারা যতই আকর্ষণীয়া হোন, রামায়নবাবু তাঁদের দিকে ভুলেও তাকান না। সাধারণ মার্শিয়ানদের সঙ্গে তাঁর একটাই তফাত, তিনি কথায় কথায় রেগে যান না বা আক্রমণাত্মক ব্যবহার করেন না। জ্যোতিষে এমন বিভ্রান্তি হয়েই থাকে, না হলে জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বলা হ’ত।
আমরা এবার তাঁর বেডরুমে ঢুকব। এ কাজটি সমীচিন নয়, কিন্তু আমরা অনোন্যপায়, কারন, এখানে কাহিনী একটা মোড় নেবে। বেডরুমে ঢোকার আগে অবশ্য আমরা একটু ফ্ল্যাশব্যাকে ঘুরে আসতে পারি। রামায়নবাবু ইকনমিক্সে মাস্টার্স করেছেন। কলেজে পড়ার সময়েই পূরবীদেবীর সঙ্গে পরিচয়। তাঁর অবশ্য সাবজেক্ট আলাদা ছিল, বাংলা। পূরবীও এম এ টা সেরে নিয়েছে বাংলায়। সে এম ফিল করতে যাচ্ছিল, রামায়ন একটা চাকরি পেল। পেয়েই বলল, বিয়ে করি চল। তার আর তর সইছিলনা। পূরবী রামায়নকে নিয়ে বাড়ি এল, বাবা মার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। বাবা খুশিই হলেন। যতই পণপ্রথা উঠে গেছে বলে সরকারি প্রচার হোক, ফোকটে দাবিহীন পাত্র পাওয়া চাঁদকপালে হ’লে হয়।
রামায়ন প্রণাম করতে যেতেই পূরবীর বাবা বললেন, থাক থাক। তাঁর নামটা ইমমেটিরিয়াল, তাই রেফারেন্সে রাখছিনা। থাক থাক বলতেই রামায়ণ নীচু হওয়া থেকে বিরত হয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। তার মাংসল ওজনে সোফাটা মৃদু আর্তনাদও করল। পূরবীর বাবা মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেন। নিজের মনেই গজগজ করলেন, থাক থাক তো বলতেই হয়, ওটা ভদ্রতা। তাই বলে – মুখে বললেন, তা তোমাদের বাড়িতে তো যেতে হবে আমাদের। মানে, আফটার অল কন্যেপক্ষ – রামায়ন বলল, বাড়িতে নিশ্চয় যাবেন, যে কোনও ছুটির দিন অবশ্য। তবে গেলে আমাকেই পাবেন। বাবা গত হয়েছেন বছর তিনেক, মা আরও আগে। - আর কোনও সিনিয়র আত্মীয় স্বজন – নাঃ কারো সঙ্গে যোগাযোগ নেই। পূরবীর বাবা কিছুক্ষণ মাথার ওপরে ঘুরন্ত ফ্যানটাকে মৃদু টিকটিক আওয়াজ করার অমুমতি দিয়ে নীরবে কী সব ভেবে বললেন, এই যে পূরবী রাম রাম বলে, তোমার পুরো নাম কি বাবা ? রামকুমার, রামজীবন, এমন কিছু থাকবে তো। তোমাদের মত বয়সে রাম দিয়ে নামও এখন দুর্লভ, সব আধুনিক নাম টাম –রামায়ন বলল, আমার নাম রামায়ন, রামায়ন চৌধুরী।
মৃদু বিষম খেলেন ভদ্রলোক। রামায়ন ? খুব আস্তে, একমাত্র নিজে শোনার মত করে বললেন, স্ট্রেঞ্জ ! তোমার পিতাঠকুরের নাম কি ছিল? রামায়ন বলল, নটবর। দ্বিতীয়বার বিষম খেলেন ভদ্রলোক। আবার ফ্যানের টিকটিক, আবার মনে মনে হিসেব, - আচ্ছা তোমরা যে চৌধুরী, এটা তো খেতাব। তোমরা আসলে কী? মানে, আসল পদবীটা কী? রামায়ন একটু হেসে বলল, কি জানি, ওসব নিয়ে কোনওদিন মাথাই ঘামাইনি। - ও, আচ্ছা বাবা, তোমাদের গোত্রটা কী ? রামায়ন কিছুক্ষণ থেমে বলল, বিশ্বামিত্র। বিরাট একটা শ্বাস ফেলে উদ্ভাসিত মুখ নিয়ে পূরবীর বাবা বললেন, বাঁচালে বাবা। বলে নিজের বুকে হাত বোলাতে লাগলেন। রামায়ন বলল, কেন, বাঁচালাম কেন? তিনি বললেন, আরে বিশ্বামিত্র মানে তোমরা মিত্তির, আমাদের পাল্টি ঘর – আমরা তো বোস, গৌতম গোত্র। কি নিশ্চিন্তই যে হলাম, কোনওদিন মেয়ের বাপ হলে বুঝবে।
আমরা যে বেডরুমে ঢুকব বলছিলাম, এই তার উপযুক্ত সময়। আমরা আর ঘন্টাখানেক পরে ঢুকতে পারতাম, নিশ্চিন্তে নিদ্রিত দুই নরনারীকে পেতাম। রামায়নবাবুর আবার মৃদু নাকও ডাকে। কিন্তু না, আমাদের এই সময়েই ঢুকতে হবে, না হলে উদ্দেশ্য সাধিত হবেনা। মাত্র কিছুক্ষণ আগে এঁদের রতিযুদ্ধ শেষ হয়েছে। রতিক্রিয়া বা রতিক্রীড়া শব্দদুটো ব্যবহার না করার কারণ হল, এঁদের বাড়িতে যুদ্ধই হয় এবং সেটা একতরফা। রামায়নবাবুর লিবিডো একটু প্রবল তা আগেই বলেছি। একটু নয়, বেশ। আর মার্শিয়ানদের আক্রমণাত্মক স্বভাবের যে ব্যতিক্রমের কথা আগে বললাম, সেটা ইনি পুষিয়ে নেন বিছানায়। পূরবীদেবী বিছানার ওপর পা ছড়িয়ে সোজা হয়ে বসে আছেন। একটা সাদা চাদরে তাঁর কাঁধ থেকে হাঁটু অবধি ঢাকা। ওই যে রকম হলিউডি ছবিতে দেখায়, সেই রকমই। রামায়ন কিন্তু বোম ভোলে স্টাইলে হাত পা ছড়িয়ে চিত হয়ে আছেন। লজ্জা কার কাছে, যে ঢাকাঢুকি দেবেন? আমাদের উপস্থিতি তো আর ওঁরা টের পাচ্ছেন না।
পূরবী বললেন, একটা কথা তোমায় জিজ্ঞেস করব ? রামায়ন এতটাই তৃপ্ত যে, যে কোনও কাউকে লাখটাকা দান করতে পারেন এক্ষুণি। বললেন, তুমি আবার পারমিশন নিয়ে কথা বল কবে? পূরবী বললেন, আজ ইন্সিওরেন্সের এজেন্ট এসেছিলেন। একটা প্রিমিয়াম ডিউ আছে কিনা দেখতে তোমার লকারটা খুলতে হয়েছিল। রামায়ন বললেন, থামলে কেন, বলো ? পূরবী বললেন, একটা কাগজ পেলাম। আমি দেখতে চাইনি, হাতে উঠে এল। সেটা একটা শিডিউল্ড কাস্ট সার্টিফিকেট। তাতে লেখা কাস্ট- মেথর, সাব কাস্ট- হাড়ি, - এগুলো কী ? আমাদের সঙ্গের সাউন্ড টেকনিশিয়ানকে বলা হল – ‘ঝাঁই’ করে একটা মিউজিক দাও, ক্লাইম্যাক্স টাইপ। রামায়ন খুব ক্যাজুয়ালি বললেন, ঠিকই লেখা আছে। আমার আসল নাম রামায়ন হাড়ি। আমরা জাতিতে মেথর। চৌধুরীটা এফিডেভিট কেস, তখন পঞ্চাশ টাকা লাগত। আমরা টেকনিশিয়ানকে বললাম, নাঃ কেটে দাও হে, আওয়াজটা খাচ্ছেনা।
পূরবী ভুরু কুঁচকে বললেন, কী বলছ কি তুমি? বিশ্বামিত্র গোত্র কার ? রামায়ন হাসতে হাসতে বললেন, ওটা তো শিবুর গোত্র। ওই যে, শিবুকে তুমি চেন তো, আমার বিয়ের সময়ে বরযাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে খচ্চরটা। এখন মন্ট্রিয়লে থাকে। ওর ছেলেটা ব্রিলিয়ান্ট, কী একটা আবিষ্কার ক’রে - পূরবী বললেন, ছিঃ তুমি আমাদের ঠকিয়েছ? রামায়ন এইবার একটু ঢাকাঢুকি দিলেন, তাও সামান্য। পাশ ফিরে খুব ঠান্ডা গলায় বললেন, ঠকিয়েছি ? সেটা কীরকম ? – ঠাকাওনি ? এফিডেভিট করা পদবী, বন্ধুর গোত্র, বাবা ঠিকই বলেছিলেন, রামায়ন, নটবর, এগুলো তো এযুগে ভদ্রলোকের নাম হয় না। টেকনিশিয়ান বলল, কিরে, এখানে দেব ? আমরা বললাম, নাঃ ঠিক জমছেনা। আর একটু দেখি। রামায়ন ঢাকাটা আর একটু টেনে দিয়ে বললেন, আরি! ভদ্রলোক কাকে বলে। আমি মাস্টার্স করেছি ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে। একটা পাবলিক সেক্টরের ডিজিএম। অডিওভিসুয়াল প্রেসেন্টেশনের সময়ে টানা নির্ভুল ইংরিজিতে ঘন্টাখানেক বকবক করি। আমার বাবাও গ্র্যাজুয়েশন করেছে। ঠাকুদ্দা অবশ্য – তা সে যাই হোক, তার নাম তো বলিনি। নটবর আর রামায়ন ভদ্রলোক নয় কী ক্যালকুলেশনে?
রামায়ন এবার আরও খানিকটা চাদর টেনে কাত হয়ে বসেছেন। পূরবীর মুখটা চিবুক ধরে ঘোরাতে গেলেন, ঘুরলনা। পূরবী কাঁদছেন সম্ভবতঃ। টেকনিশিয়ান ফিসফিস করে বলল, পেথস দিই? এস্রাজ টেস্রাজ ? আমরা ইশারায় থামালাম। রামায়ন বলছেন, আচ্ছা, তুমি তো জাত ফাত কিছু মাননা, নাস্তিক এবং লেফটিস্ট। তোমার সমস্যাটা কোথায়? পূরবী মুখ না ঘুরিয়েই বললেন, আমার কোনও সমস্যা নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতাম, চেঁচিয়ে বলতাম, আমি জাত মানিনা, ওকেই বিয়ে করব। রেজিস্ট্রি করতাম, অনুষ্ঠান করতাম না, কিন্তু বাবার সরল বিশ্বাসকে – নাঃ, আই ক্যান নট অ্যাকসেপ্ট ইট। রামায়ন বললেন হুম্।
ডিজিএম সাহেবের মন মেজাজ ভাল নেই। ক’দিন ধরে পূরবী ছেলের কাছে শুচ্ছেন। রামায়ন বিছানায় টসিং অ্যান্ড টার্নিং, বিরহে কাতর, কিন্তু পূরবী খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন ব্যাপারটা। আমরাও আর লোকেশনে নেই। ওঁরা নিজেরাই ফয়সালা করুন। রামায়নের অফিসে একটা নিজস্ব কেবিন আছে, থাকতেই হবে। তার মধ্যে একটা অ্যাটাচ্ড ওয়াটার ক্লোসেটও আছে। অফিসের মেন গেটের কাছে জেনারাল টয়লেট, কর্মীদের। সেখানে রামায়নের, থুড়ি, চৌধুরী সাহেবের যাওয়ার কথা নয়। আজ কী হয়েছে, ভীষণ ইয়ে পেয়েছে। ব্লাডারে বেশ চাপ, নিজের কেবিন অবধি দৌড়ে যাওয়াটাও বিচ্ছিরি দেখায়। চৌধুরী সাহেব জেনারাল লু তে ঢুকে পড়লেন। এখনও অফিস আওয়ার শুরু হয়নি, সব কর্মীরাও আসেনি। টয়লেট সাফ হচ্ছে। সুইপার বিশ্বনাথ হাত দিয়ে পরম যত্নে ইউরনাল বেসিনগুলো ঘষছে। চৌধুরীসাহেবকে দেখলেই অন্য কর্মীরা হাত তুলে সেলাম করে, বিশ্বনাথের সে সময় নেই। সে কাজে মগ্ন, গুনগুন করে গানও করছে।
সব কর্মীরা এসে কাজে বসলে চৌধুরী সাহেব বেল বাজিয়ে অফিস সুপারকে ডাকলেন। কী ব্যাপার গাঙ্গুলিবাবু, আজ একটু লু টা ইন্সস্পেক্ট করলাম। ওখানে বিশ্বনাথ হাত দিয়ে ইউরিনাল সাফ করে কেন? ওকে গ্লাভ্স দেয়া হয়না? গাঙ্গুলি বাবু বললেন, কী করব স্যার, বহুবার বলেছি। স্টোরে গ্লাভ্স আছেও বেশ ক’জোড়া। তা ছাড়া আজকাল মেকানাইজড ব্রাশও পাওয়া যায়, তাও কেনা আছে। ও কিছুতেই নেয়না। বলে হাতেই আমার সুবিধে। নীচু গলায় বললেন, আসলে শালারা জাতে মেথর তো, সাত পুরুষের অভ্যেস স্যার – চৌধুরী সাহেব চমকে ভাবলেন, আমার সার্ভিস ফাইলটা তো হেড অফিসে থাকার কথা, এখানে কপি ফপি নেই তো? টিফিনের সময় ক্যান্টিন থেকে খাবার দিয়ে যায়। আজ ছিল হাতরুটি, ডিমের ডালনা আর চাটনি। চৌধুরিসাহেবের হঠাৎ মনে পড়ল, বিশ্বনাথ সকালে সুইপিং করে দুপুরে ক্যান্টিনে রুটি বানায়। তাঁর বমি পেয়ে গেল। বেসিনে গিয়ে ওয়াক তুললেন। খাবারটা সরিয়ে রেখে চাপরাশিকে ডেকে বললেন, ক্যান্টিনের কোয়ালিটি গোল্লায় গেছে। কাল থেকে খাবার দিতে বারণ কোর। আমি বাড়ি থেকে টিফিন আনব।
বাড়ির থমথমে পরিবেশটা এখনো চলছে। পূরবীদেবী ছেলের সঙ্গেই শুচ্ছেন কিন্তু রামায়নের পক্ষে একা শোয়া সম্ভব নয়। একদিন পূরবীর হাত ধরে বললেন, তুমি এখনও রেগে আছ? আচ্ছা আমার কথা শোন। স্বামী হিসেবে তোমার সঠিক ভরণপোষণ করতে পারছি? হ্যাঁ কি না। আমি কি বিছানায় স্যাটিসফাই করতে পারি? হ্যাঁ কি না। ঐ সার্টিফিকেটের দৌলতে আজ আমি ডিজিএম। তোমায় পার্টিতে, অনুষ্ঠানে, সবাই মেমসাহেব, ম্যাডাম এই সব বলে, তোমার সামান্য হলেও বুক ফোলে, হ্যাঁ কি না। পাতি সুপারভাইজারের বৌকে যেমন লোকে বৌদি বলে, তার চাইতে তুমি অনেক বেশি সম্মান পাও, হ্যাঁ কি না। তোমার ছেলে ঋতম, মানে আই মীন, আমাদের ছেলে, গ্রীক দেবতার মত সুন্দর। হ্যাঁ কি না। তোমার বন্ধুই তো রাজাবাজারে জেনেটিক্স নিয়ে রিসার্চ করছে। সে-ই তো বলল, জেনেটিকালি উচ্চবর্ণের সঙ্গে দলিতদের কোনও ডিফারেন্স নেই। তোমার সামনেই তো বলল। কী, চুপ করে আছ কেন ? আমি আর পারছিনা। শুতে এস প্লীজ। পূরবীদেবী এলেন, কিন্তু খেলা জমলনা। আজ রামায়নই চাদর ঢেকে বসে আছেন। বললেন চল, কোথাও ঘুরে আসি। মন ভাল করা দরকার। আমি লীভ অ্যাপ্লিকেশন করছি কিন্তু।
ট্র্যাভেল এজেন্সির গাড়িটা পাহাড় বেয়ে এঁকেবেঁকে উঠছে। গাইডটার হিন্দী কেমন অদ্ভুত। ফরেনারদের জন্য ইংরিজি যা বলছে, তা আরও অদ্ভুত। সাদাগুলো অধিকাংশই পূর্ব ইওরোপের, তারা ইংরিজির বিন্দুবিসর্গ বুঝছেনা। গাইড বলল, অব হম চলতে হ্যাঁয় এক পেয়ারভরি অওর দর্দভরি কাহানি সুননে, কাহানি বাজ বাহাদুর অওর রাণী রূপমতী কি। ইয়েস, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, ( লেডিজের জ টা বর্গীয়, জেন্টেলম্যানে প্লিউরাল নেই, আমরা ডিটেলে যাচ্ছিনা) উই আর নাউ গোইং টু লিসিন টু এ লব ইশটোরি অফ কুইন রূপ- রামায়ন দেখলেন, পূরবী বাসের জানলা দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন। বাসটা কোথাও একটা থামল। টুরিস্ট বাস থামা মানেই নামা, কিছু একটা, দ্রষ্টব্য হোক আর না হোক তা দেখা আর বকবক শোনা। গাইড বলল, দেখিয়ে, অ্যাইসা বারহ্ দরওয়াজে হ্যাঁয়, দেয়ার আর টুএল(ভ উহ্য) গেটস হিয়ার। জ্যায়সে, ভাঙ্গি দরওয়াজা, আলমগীর দরওয়াজা, দিল্লী দরওয়াজা – দিস ইজ কল্ড ভাঙ্গি দরোয়াজা – পূরবী নামেন নি। রামায়ন নতুন কেনা ডিএসএলআরটা নিয়ে ছেলেকে বললেন, আয় ঋত –
পাথরের তোরণ পথের দু ধারে। ছাদ একটা ছিল, তা ভেঙে পড়ে গেছে অনেকদিন আগেই। দুধারে তোরণের ওপর বড় বড় অক্ষরে চূণ দিয়ে দু ভাগে লেখা, ‘রাম রাম কহো’।, রামায়ন বললেন, ঋত দেখেছিস, এইসব লেখা জোখা অ্যালাউ করে কী করে, মনুমেন্টটার অ্যাপিয়ারেন্সটাই নষ্ট। ঐখানে গিয়ে দাঁড়া তো, ঐ রাম লেখাটা কভার করে দাঁড়াবি। এই বলে তার দিকে ক্যামেরা তাক করলেন। ওঁর একটা অভ্যাস, কোথাও গেলে দৃশ্যটা ক্যামেরাবন্দী করার যোগ্য হোক আর না হোক, উনি কাউকে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলবেনই। গাইড বলল, দেখিয়ে ইয়ে হ্যায় ভাঙ্গি দরওয়াজা। ইয়াহাঁপর এক ভাঙ্গি কো বলি চঢ়াকে গেট বনায়ে থে। অওর আপলোগ রাজস্থান যাওগে তো কঈ অ্যায়সে গেট মিলেঙ্গে। ঋতম জিজ্ঞেস করল, আঙ্কল, ইয়ে ভাঙ্গি কেয়া হোতা হ্যায়? গাইড বলল, বেটা উওহ্ সুইপার লোগ হোতে হ্যাঁয় না, উনকো ভাঙ্গি কেহতে হ্যাঁয়। কোই গেট ইয়া ব্রিজ বনানে সে পেহলে ইনকা বলি চঢ়ানা শুভ্ মানা যাতা থা। রামায়ন দেখল উন্মাদিনীর মত এক নারীমূর্তি ছুটে আসছে। তার ওড়না বাসের দরজায় আটকে গেছে, তার পরোয়া না করে সে ছুটছে। ওড়না ছিঁড়ে দরজায় ঝুলে রইল, হাতও কেটে গেছে খানিকটা, সরু রক্তের ধারা নামছে ফর্সা হাত বেয়ে। একটানে ঋতমকে সরিয়ে নিয়ে হাঁফাচ্ছে পূরবী। পাগলের মত চিৎকার করে বলছে, এই ছবি ডিলিট করো, করো এক্ষুণি, করলে তুমি? – পূর্ব ইয়োরোপের কয়েকজন মহিলা এই সব দেখে বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে কানে কানে কী সব বলছেন। ওরা গাড়িতে উঠে পড়ল তাড়াতাড়ি।
আমরা আবার ফিরে এসেছি। আমরা এখন রাত তিনটের সময়ে, সেই ভিজে রাস্তায়, সাইকেল চাপা প্রৌঢ়র কাছে। তিনি অবাক হয়ে দেখছেন বারান্দায় দাঁড়ানো সাদা মূর্তিকে। আসলে সাদা দক্ষিণ ভারতীয় ভেশ্তি আর সাদা পুরোহাতা গেঞ্জি পরা বলে অমন লাগছে রামায়নকে। উনি স্যান্ডো গেঞ্জি ভুলেও পরেননা। প্রৌঢ়ের চোখকে জুম করা যাবেনা, কিন্তু আমরা জুম করে কাছে চলে এলাম। রামায়নের চোখেমুখে আতঙ্ক। কিসের আতঙ্ক উনি জানেন না, স্বপ্নের কথা কিছুই মনে নেই। কিন্তু আমরা জানি। উনি স্বপ্নে দেখেছেন, ক’টা বাঁধনির কাজ করা পাগড়ি পরা বিশাল গোঁফ ওয়ালা লোক ঋতমকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে বধ্যভূমির দিকে। ঋতম বলছে, বাবা, এরা আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ?
স্বপ্নটা মনে না থাকলেও তা অবচেতন থেকে উঠে এসেছিল, আবার সেখানেই ফেরৎ গেছে। পরদিন ঋতমের আইআইটির ফর্ম ফিল আপ। সে একাই করতে পারে, তবু বাবাকে না দেখিয়ে কিছুই লেখেনা। রামায়ন কাস্টের জায়গায় জেনারালে টিক মেরে দিলেন। ঋতম বলল, ফর্মটা নষ্ট করলে তো? আবার একটা ডাউনলোড করতে হবে। রামায়ন খুব ধীরে বললেন, সেটাতেও এখানেই টিক দেব। বাবা তুমি জয়েন্টে চব্বিশ পেয়েছ, তুমি তো উসেন বোল্ট। ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জডদের সঙ্গে দৌড়বে কেন? ঋতম বলল, তুমি জান, আমার হোল কেরিয়ারের কী বারোটা বাজবে? রামায়ন তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, এখন খারাপ লাগছে তো? যখন আমার মত বয়স হবে, তখন বুঝবি – বলে, অতবড় পালোয়ানি, মাংসল, কুস্তিগীরের মত লোকটা গেঞ্জির হাতায় চোখ মুছতে লাগল। টেকনিশিয়ান বলল, এবারে পেথস দিই? আমরা বললাম, নাঃ, এতক্ষণ দেয়া হয়নি যখন, আর লাগবেনা।